কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ্যা বিভাগঃ প্রাক স্বাধীনতা যুগ – চন্দ্রশেখর বেঙ্কট রামন
(এই প্রবন্ধের সহলেখক হলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ্যার অধ্যাপক অনির্বাণ কুন্ডু। অধ্যাপক কুন্ডু মৌলিক কণা নিয়ে গবেষণা করেন। তিনি ইতিহাস বিষয়ে আগ্রহী এবং ন্যাশনাল অ্যাকাডেমি অফ সায়েন্সেসের ফেলো।)
আগের দু’পর্বে আমরা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, বিজ্ঞান কলেজ এবং পদার্থবিদ্যা বিভাগের প্রাকস্বাধীনতা যুগ নিয়ে কিছু কথা বলেছি। বিভাগের প্রথম তিরিশ বছরকে যদি মোটামুটি সমান দু ভাগে ভাগ করি, তার প্রথমার্ধকে (১৯৩৩ পর্যন্ত) রামন যুগ নাম দিলে অন্যায় হয় না। এই সময়ে সত্যেন্দ্রনাথ, মেঘনাদ, দেবেন্দ্রমোহন, শিশির মিত্র সকলেই পড়িয়েছেন, ভারতে বিজ্ঞানের ইতিহাসে এঁদের প্রত্যেকের নামই নিজের প্রতিভায় ভাস্বর, কিন্তু তা হলেও বিভাগের মূল চালিকাশক্তি ছিলেন রামন। আগেই বলেছি, রামন ১৯১৪ সালেই পালিত অধ্যাপক হিসেবে নির্বাচিত হয়েছিলেন, কিন্তু সরকারী চাকরি ছেড়ে যোগ দিতে দিতে ১৯১৭ হয়ে গিয়েছিল। ১৯৩৩ সালে কলকাতা ছেড়ে রামন বাঙ্গালোর চলে যান ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউট অফ সায়েন্সের অধিকর্তা হয়ে। এই ষোলো বছর রামন পালিত অধ্যাপক এবং সেই সুবাদে বিভাগীয় প্রধান ছিলেন, বিশ্ববিদ্যালয় এবং ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর কালটিভেশন অফ সায়েন্সে নিজের চারদিকে তরুণ গবেষকদের গোষ্ঠী গড়ে তুলেছিলেন এবং নিয়মিত প্রথম শ্রেণীর পত্রিকায় প্রবন্ধ প্রকাশ করেছিলেন। ১৯৩০ সালে তিনি এশিয়ার প্রথম বিজ্ঞানী হিসেবে নোবেল পুরস্কার পান, ভারতে রবীন্দ্রনাথের পর দ্বিতীয়।
রামনের জীবনীর কোনো অভাব নেই। আমাদের দেশে বড়ো কারো জীবনী লিখতে গেলে প্রায়শই ভক্তিভাবের আধিক্য ঘটে, ইংরেজিতে যাকে “মাটির পা” বলে সেটি অনেক সময়েই দৃশ্যমান হয় না। সেদিক থেকে উল্লেখযোগ্য ব্যতিক্রম সুরি ভগবন্তমের লেখা রামনের চমৎকার জীবনীটি। এছাড়া কলকাতায় রামনের কাজ ও গবেষণা নিয়ে লিখেছেন সমরেন্দ্রনাথ সেন। সমরেন্দ্রনাথের বই থেকে দেখি, ১৯০৭ থেকে ১৯৩৩ সালের মধ্যে রামন একা বা সহযোগীদের সঙ্গে ১৭১টি প্রবন্ধ লিখেছেন, আর তাঁর সহযোগীরা – বিশ্ববিদ্যালয় ও কালটিভেশনে – লিখেছেন ২৮১টি। আমরা এখানে শুধুই বিশ্ববিদ্যালয় অংশটা নিয়ে কথা বলব। রামনের নোবেলজয়ী কাজ, রামন এফেক্ট, আবিষ্কৃত হয়েছিল কালটিভেশনের গবেষণাগারে। কালটিভেশন তখনো বৌবাজারে, ২১০ নম্বর বৌবাজার (বর্তমানে বিপিন বিহারী গাঙ্গুলী) স্ট্রিটে, যাদবপুরে বর্তমান ক্যাম্পাসে যেতে বহু দেরি। কালটিভেশনে রামনের গবেষণা ও সেখানে তাঁর ছাত্রদের নিয়ে কোনো আলোচনা এখানে করা হবে না।
এই পর্বে মূল নথি থেকে কিছু উদ্ধৃতি দেওয়া হবে। মূলে ইংরেজি ছিল, আমরা চেষ্টা করব যতদূর সম্ভব মূলের অনুসারী বাংলায় অনুবাদের, কারণ বাংলা লেখার মধ্যে ইংরেজি উদ্ধৃতি অনেক সময় পাঠকের পড়ার ছন্দ নষ্ট করে দেয়। এটি যে উদ্ধৃতি, তা বোঝাবার জন্যে বাঁকা হরফ ব্যবহার করা হবে, দুটি প্যারাগ্রাফ পরেই উদাহরণ পাবেন। মূল উদ্ধৃতি আর তাদের উৎসের জন্যে “The Dazzling Dawn” বইটি দেখতে পারেন।
রামনের জন্ম ৭ই নভেম্বর, ১৮৮৮। মাদ্রাজের প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে (কলকাতার নয়) ১৯০৪ সালে বিএসসি এবং ১৯০৭-এ এমএ (তখন বহু জায়গাতেই বিজ্ঞানে এমএ ডিগ্রি দেওয়া হত) পাশ করেন। রামন ইন্ডিয়ান ফিনান্সিয়াল সার্ভিসে যোগ দিয়ে কলকাতায় আসেন, এবং অবসর সময়ে কালটিভেশনে গবেষণা করতে শুরু করেন। রামনের গবেষণা সেই সময়েই কিছু বাঙালী বুদ্ধিজীবীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে।
রামনকে আশুতোষ আগে থেকেই চিনতেন তরুণ এবং প্রতিভাবান গবেষক হিসেবে। কিন্তু পালিত অধ্যাপক পদে রামন প্রথম পছন্দ ছিলেন না। ১৯১২ সালের ২৯শে জুন আশুতোষ ভাইসরয়কে চিঠি লিখছেন – আশা করছি পদার্থবিদ্যার চেয়ার অধ্যাপক হিসেবে জগদীশচন্দ্র বসু যোগ দেবেন। জগদীশচন্দ্র খুব সম্ভবত প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছিলেন, কারণ তখন তাঁর মাথায় ঘুরছে নিজস্ব একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের কথা। বসু বিজ্ঞান মন্দির স্থাপিত হয় ১৯১৭ সালে।
রামন হয়তো নিজেই পালিত অধ্যাপক পদের জন্যে উৎসাহ দেখিয়েছিলেন, কারণ ১৯১৪ সালের ৩০শে জানুয়ারির সেনেটের সভার কার্যবিবরণীতে দেখছি, উপাচার্য সার আশুতোষ ও তাঁর সিন্ডিকেটের সহকর্মীরা রামনের প্রস্তাবে খুবই আশ্চর্য হয়েছিলেন –
“মিস্টার সি ভি রামন চেয়ার অধ্যাপক পদের জন্যে আগ্রহ দেখিয়েছেন। তিনি ভারতীয় অর্থবিভাগের একজন অফিসার, এবং মাসে ২০০০ টাকা বেতন পেতে পারেন। বিজ্ঞানের একজন একনিষ্ঠ সেবক হিসেবে তিনি বিরাট আত্মত্যাগ করতে রাজি হয়েছেন, ভারত সরকারের এই লোভনীয় চাকরি ছেড়ে পদার্থবিদ্যার অধ্যাপক হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দিতে চেয়েছেন।”
১৯১৭ সালের দোসরা জুলাই পদার্থবিদ্যার পালিত অধ্যাপক হিসেবে চন্দ্রশেখর বেঙ্কট রামন, এমএ, যোগ দিলেন। তাঁর নিয়োগপত্র পালিত ট্রাস্টের গভর্নিং বডির কাছে পাঠানো হয় অনুমোদনের জন্যে। পালিত ট্রাস্টের শর্ত ছিল চেয়ার অধ্যাপককে দু’ বছর বিদেশ থেকে ঘুরে আসতে হবে। রামন প্রথমেই জানিয়ে দেন ওই শর্তটি তাঁর পক্ষে মানা সম্ভব নয়। আশুতোষ রত্ন চিনতে ভুল করেননি, রামনের জন্যে বিদেশযাত্রার শর্ত রদ হয়। পরে রামন বহুবার বিদেশ গেছেন, তবে কখনোই দু’ বছরের মত দীর্ঘ সময়ের জন্যে নয়।
চাকরিতে যোগ দিয়েই রামন জানতে চাইলেন, তাঁকে ক্লাস নিতে হবে কিনা। তাঁর বক্তব্য, পড়ানোর পেছনে সময় নষ্ট করতে হলে তাঁর আর সহযোগীদের গবেষণার ক্ষতি হবে। এখনকার দিনে এই আবদার সরাসরি প্রত্যাখ্যাত হত, হওয়া উচিতও বটে;—সারা পৃথিবীতেই নোবেল লরিয়েট অধ্যাপকেরাও নিয়মিত ক্লাস নিয়ে থাকেন, আর রামন তখন নেহাৎই তরুণ এক গবেষক। কালটিভেশনে রামন যে সমস্ত কাজ করেছিলেন, সে সম্বন্ধে আশুতোষের বেশ উঁচু ধারণা ছিল, তিনি রামনের এই অনুরোধ পালিত ট্রাস্টের গভর্নিং বডির কাছে পাঠালেন। গভর্নিং বডি সিদ্ধান্ত নিল যে রামনকে কোনো ক্লাস নিতে হবে না, সিন্ডিকেট সেই সিদ্ধান্তে অনুমোদন দিল। রামন অবশ্য বিভাগে নিয়মিত ক্লাস নিয়েছেন, প্রশ্নপত্রও তৈরি করেছেন।
যোগ দেবার কিছুদিনের মধ্যেই রামনের সঙ্গে স্বয়ং জগদীশচন্দ্রের বিরোধ বাধল। ৩০শে আগস্ট, ১৯১৭ তারিখের এক চিঠিতে জগদীশচন্দ্র কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য দেবপ্রসাদ সর্বাধিকারীকে লিখলেন –
আমি জানতে পেরেছি যে এ মাসের ২৫ তারিখ বিজ্ঞান কলেজের পদার্থবিদ্যা বিভাগের এক সদস্য প্রেসিডেন্সি কলেজে আমার গবেষণাগারে এসেছিলেন। সে সময় আমি উপস্থিত ছিলাম না। তিনি অধ্যাপক রামনের বিশেষ নির্দেশ নিয়ে এসেছিলেন এবং আমার প্রধান যন্ত্রবিদকে (senior mechanic) বিজ্ঞান কলেজে যোগ দেবার আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। আমি তাঁকে যা বেতন দিই, প্রয়োজনে তার তিনগুণ পর্যন্ত বেতন দেবার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল।
নিজের বিশ্বস্ত কর্মীকে ভাঙিয়ে নেবার চেষ্টা জগদীশচন্দ্র সুনজরে দেখেননি, বলা বাহুল্য। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় অবশ্য রামনের বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ করেনি। ব্যাপারটা, যে কোনো ভাবেই হোক, ধামাচাপা পড়ে গিয়েছিল।
রামন পদাধিকারবলে বিভাগীয় প্রধান ছিলেন। ১৯১৭ সালে বিভাগের কাজকর্ম সম্বন্ধে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে যে রিপোর্ট পাঠান, তার একটা অংশ তুলে দিই –
এ বছরে বিভাগের উন্নতি খুবই সন্তোষজনক। জুলাই মাসের গোড়ার দিকে আমি পালিত অধ্যাপক হিসেবে যোগ দিই, তারপর থেকে সর্বক্ষণই পালিত গবেষণাগারে গবেষণার কাজে যুক্ত আছি, এবং একাধিক বিষয়ে মৌলিক গবেষণার সূত্রপাত করেছি। আমি যোগ দেবার কিছুদিন পরেই স্নাতকোত্তর শিক্ষাদান নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় একটি নতুন নিয়ম চালু করেছে, যাতে করে শিক্ষাদানের কাজ বিজ্ঞান কলেজ ও প্রেসিডেন্সি কলেজের শিক্ষকদের মধ্যে ভাগ করে দেওয়া হয়েছে। এতে বিজ্ঞান কলেজের শিক্ষকদের খুবই উপকার হয়েছে, তাঁরা তাঁদের নিজস্ব কাজের ওপর মনোযোগ দিতে পারছেন। ভবিষ্যতে এতে স্নাতকোত্তর শিক্ষারই উন্নতি হবে।
রামন জানতেন যে আধুনিক গবেষণার সঙ্গে প্রত্যক্ষ যোগ না থাকলে স্নাতকোত্তর স্তরে যথাযথ শিক্ষাদান সম্ভব নয়। তাঁর রিপোর্টে স্থানীয় স্তরে বানানো বা বিদেশ থেকে আমদানি করা অনেক যন্ত্রপাতির উল্লেখ আছে যা গবেষণাগার বানাতে কাজে লাগে। রামন গবেষক ছাত্রদেরও উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছেন।
রামনের রিপোর্টে দেখি, তিনি এবং তাঁর ছাত্ররা বিভিন্ন বিষয়ে তাত্ত্বিক এবং পরীক্ষামূলক কাজ করেছেন। এই সব বিষয়ের মধ্যে তড়িৎবিদ্যা, স্বনবিদ্যা এবং আলোকবিদ্যা ছিল। রামন লিখছেন –
এবছর স্বনবিদ্যার ওপর আমার তিনটে প্রবন্ধ ফিলসফিক্যাল ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হয়েছে, আরেকটা নেচার পত্রিকায় পাঠিয়েছি। এখন বেহালা ও অন্যান্য তারের যন্ত্রের ধর্ম নিয়ে একটা বড়ো রচনা লিখছি। আমার ছাত্র চিন্ময়ানন্দম তড়িৎচৌম্বকীয় ক্ষেত্রের শক্তিপ্রবাহ নিয়ে একটা কাজ করেছে, প্রবন্ধ হিসেবে প্রকাশও করেছে।
চিন্ময়ানন্দম, সুধাংশু ব্যানার্জি, আর শিশিরকুমার মিত্রের কাজ নিয়ে বিস্তারিতভাবে লিখেছেন রামন, বলেছেন –
কলকাতায় পদার্থবিদ্যার এই নতুন দলটির কাজ বিদেশেও প্রশংসা পেয়েছে। আমার বিশ্বাস পরের বছর আরো চমৎকার ফলাফল পাওয়া যাবে।
শিবপুর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের গবেষণাগার রামনের ছাত্রদের ব্যবহার করতে দেবার জন্যে রামন তাঁদের ধন্যবাদ জানাতে ভোলেননি।
১৯১৮ সালেও রামন নিজের গবেষণাগারের কাজকর্মের বিস্তারিত রিপোর্ট পেশ করলেন। এই বছর বিভাগ থেকে সাতাশটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়, অধিকাংশই রামন ও তাঁর ছাত্রদের, কিন্তু মেঘনাদ সাহা পাঁচটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন, তার মধ্যে একটিতে সহলেখক ছিলেন সত্যেন্দ্রনাথ, গ্যাসের অবস্থা সমীকরণ বিষয়ে। রামন বলছেন যে ১৯১৯ সালে আরো কিছু গুরুত্বপূর্ণ কাজ প্রকাশিত হবে, যেমন বিধুভূষণ রায়ের “Optical analogue of the whispering gallery problem” (এর বাংলা অনুবাদ করলাম না, হুইস্পারিং গ্যালারি কী, তা নিয়ে পরে বলার ইচ্ছা আছে, বিজাপুরের গোল গম্বুজে যারা গেছেন, তাঁরা মোটামুটি জানেন ব্যাপারটা কী), আর মেঘনাদ সাহার নিঃসরণ বর্ণালী বিষয়ে কিছু তাত্ত্বিক কাজ। এখন বেশ মজাই লাগে দেখলে যে রামন নিজের দলের কাজ নিয়ে অত লিখেছেন, কিন্তু মেঘনাদ সাহার কাজ সম্পর্কে প্রায় নীরব। এমনকি কর্মশালার যন্ত্রবিদ বাবু বিপিনচন্দ্র মল্লিককে নিয়েও এক প্যারাগ্রাফ লিখেছেন, তাঁর কর্মকুশলতার ভূয়সী প্রশংসা করে। আজ আমরা জানি, ১৯২০ সালে মেঘনাদ যে কাজ করেছিলেন, তার সঙ্গে তুলনা করলে ততদিন পর্যন্ত রামন ও তাঁর ছাত্ররা যা করেছেন (এমনকি সত্যেন্দ্রনাথও), সবই নেহাৎ অকিঞ্চিৎকর ঠেকে। কিন্তু বিজ্ঞান তো এইভাবেই এগোয়, সেই সময়ে বসে মেঘনাদের গবেষণা কীরকম যুগান্তকারী হবে, একথা জানা সম্ভব ছিল না।
১৯১৯ সালে চিন্ময়ানন্দম রামনের গ্রুপ ছেড়ে চলে গেলেন, সেখানে ২০০ টাকা মাসিক বেতনে যোগ দিলেন ব্রজেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী। ইনি পরে পূর্ণ সময়ের শিক্ষক পদে উন্নীত হন।
রামনের গবেষণাগারের কোনো চিহ্নই এখন আর অবশিষ্ট নেই। তাঁর ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি বহুকাল আগেই বাতিলের খাতায় নাম লিখিয়েছে। কিছু যন্ত্র অবশ্য কালটিভেশনে রাখা আছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে সে যুগের স্মৃতি নিয়ে পড়ে আছে শুধু একখানা ভাঙা পিয়ানো, রামনের স্বনবিদ্যা বিষয়ক গবেষণার শেষ নিদর্শন। খুব সম্ভবত রামনের ছাত্র পঞ্চানন দাস এই পিয়ানো নিয়ে কাজ করেছিলেন। সম্প্রতি পিয়ানোটিকে আবার আগের অবস্থায় ফিরিয়ে নিয়ে যাবার প্রস্তাব উঠেছে।
শুনলে আশ্চর্য লাগতে পারে, রামনের কিন্তু কোনো ডক্টরেট ছিল না। সে যুগে অধ্যাপনা বা গবেষণার সঙ্গে ডক্টরেটের অচ্ছেদ্য সম্পর্ক ছিল না, সত্যেন্দ্রনাথও ডক্টরেট করেননি। রামন ১৯২১ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাম্মানিক ডিএসসি পান, পরে জার্মানির ফ্রাইবুর্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাম্মানিক পিএইচডি। রয়্যাল সোসাইটির ফেলো মনোনীত হন ১৯২৪ সালে। নোবেল পুরস্কার পাবার পরে রামন পারি ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাম্মানিক ডক্টরেট পান।
ক্ষুব্ধ রামন
আগেই বলা হয়েছে, বিজ্ঞান কলেজ প্রায় পুরোটাই চলত পালিত আর ঘোষের দানে, এবং পরবর্তীকালে খয়রার মহারাজকুমারের। সরকারের থেকে বিশেষ কোনো সাহায্য পাওয়া যেত না, বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব তহবিল থেকে কিছু টাকা আসত। গবেষণার জন্যে অর্থের টানাটানি লেগেই ছিল, আর তাতে রামনের ধৈর্যচ্যুতি ঘটছিল। প্রথম দিকের উচ্ছ্বাস তখন অনেকটাই অন্তর্হিত। ১৯২৫ সালের ২২শে ডিসেম্বর তিনি বিশ্ববিদ্যালয়কে দুখানা শাণিত চিঠি লিখলেন। প্রথমটিতে বললেন যে বিশ্ববিদ্যালয় বেআইনি কাজ করছে এবং পালিত ট্রাস্টের নিয়মকানুন গুরুতরভাবে লঙ্ঘন করছে। এই ক্ষোভের কারণ কী? রামন বলছেন, ট্রাস্টের দলিলে লেখা আছে, ট্রাস্টের সম্পত্তি থেকে পাওয়া অর্থ বিশ্ববিদ্যালয় প্রথম ট্রাস্ট দলিলে যেভাবে নির্দেশ দেওয়া আছে, সেভাবেই খরচ করতে বাধ্য। কী ছিল প্রথম ট্রাস্ট দলিলে? পরিষ্কার করে বলা ছিল ঠিক কীভাবে তারকনাথ পালিতের দান ব্যবহৃত হবে। দুটি চেয়ার অধ্যাপক পদ তৈরি হবে এবং চেয়ার অধ্যাপকদের অধ্যাপনা ও গবেষণার জন্যে যা সাহায্য প্রয়োজন তা দেওয়া হবে। রামন আরো বলছেন, ৩৫ বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডে পালিতের সম্পত্তি সম্পূর্ণভাবে তাঁর শেষ ইচ্ছার বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হচ্ছে। ওই বাড়ি ভাড়া দিলে মাসে অন্তত ৩০০০ টাকা পাওয়া যাবে, সেই টাকা পালিত চেয়ারের জন্যে খরচ করা হোক।
দ্বিতীয় চিঠিটি আরো সাংঘাতিক। সেখানে রামন প্রায় ফেটে পড়েছেন –
… এখন যা অবস্থা দাঁড়িয়েছে, বিজ্ঞান কলেজের পদার্থবিদ্যা বিভাগের প্রায় সব টাকাপয়সাই স্নাতকোত্তর শিক্ষাদানের জন্যে খরচ করা হচ্ছে। এসব ক্লাসের ছাত্ররা বেশির ভাগই স্নাতকে পাস ডিগ্রি নিয়ে এসেছে, তাদের পড়ানোর কাজটা খুবই গতানুগতিক স্তরের। স্নাতকোত্তরের ছাত্ররা কেউ গবেষণা করেই না। বিভাগের যেটুকু জায়গা, তার অনেকটাই এই সব মামুলি ছাত্রদের ল্যাবরেটরির জন্যে বরাদ্দ, বাকি জায়গাটুকু ঘোষ আর খয়রা অধ্যাপকেরা নিয়ে নিয়েছেন, বিভাগের কর্মশালাতেও এঁদের কাজের যন্ত্রপাতিই তৈরি হয়।
তখন ঘোষ ও খয়রা অধ্যাপক ছিলেন যথাক্রমে দেবেন্দ্রমোহন ও শিশিরকুমার। এখনকার দিনে এইরকম একটা চিঠির কী প্রতিক্রিয়া হত সহজেই আন্দাজ করা যায়। প্রথমত, বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষাদানের কাজ “গতানুগতিক স্তরের”, এই ধারণাটাই আপত্তিকর বলে গণ্য হত। দ্বিতীয়ত, অন্যান্য অধ্যাপকেরা পালিত অধ্যাপকের তুলনায় দ্বিতীয় শ্রেণীর, এটাও কেউ সহজে মেনে নিতেন না।
যাই হোক, চিঠিটি আরো একটু পড়ি। রামন বলছেন, কীভাবে তাঁর কাজের পরিসর সঙ্কুচিত হয়ে আসছে।
গবেষণাগার হিসেবে আমার আছে দুটো ছোট ঘর যা আগে ছিল রসায়ন বিভাগের হাতে। আর আছে একজন রিসার্চ অ্যাসিস্ট্যান্ট, ১০০-১০-১৫০ বেতনক্রমে, দুজন গবেষক ছাত্র যারা মাসে ৭৫ টাকা করে পায়, কর্মশালার কোনো সুবিধেই নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান আইনবলে সব অধ্যাপকরাই স্বাধীন, স্নাতকোত্তর ল্যাবরেটরিতে গবেষণা করানোর ব্যাপারে পালিত অধ্যাপকের কোনো ক্ষমতা নেই। থাকলেও বিশেষ কিছু করা সম্ভব হত না। এই সব ল্যাবরেটরি পুরোপুরিই ছাত্রদের তুলনামূলকভাবে প্রাথমিক স্তরের পরীক্ষানিরীক্ষার জন্যে ব্যবহৃত হয়। আমার মনে হয় না এই পরিস্থিতিতে স্বর্গীয় সার তারকনাথ পালিত যা চেয়েছিলেন, তার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ কোনো কাজ করা সম্ভব।
রামন সত্যিই কতটা স্বাধীনতা পাচ্ছিলেন, তাঁর দম বন্ধ হয়ে আসছিল কি না, সে বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের নথিপত্রে কী সাক্ষ্য আছে, তা আমরা একটু পরেই দেখব। চিঠিতে দেখি, এর পরে রামন প্রস্তাব করছেন বিভাগটিকে পদার্থবিদ্যার একটি গবেষণা কেন্দ্রে উন্নীত করার জন্যে। কী কী থাকবে সেই কেন্দ্রে?
রামনের প্রস্তাব, (১) পালিত রিসার্চ ল্যাবরেটরি নামে একটি আলাদা ভবন, যার মধ্যে অধিকর্তার বাসস্থানও থাকবে; (২) পদার্থবিদ্যার বিভিন্ন দিকে কাজ করার জন্যে অন্তত তিনজন রিসার্চ অ্যাসিস্ট্যান্ট, ১৫০-২৫-৩০০ বেতন কাঠামোয়; (৩) মাসিক ৭৫ টাকা হিসেবে অন্তত ছটি গবেষক বৃত্তি; (৪) বিশেষভাবে তৈরি একটি কর্মশালা যা একমাত্র পালিত অধ্যাপকের অধীন থাকবে; এবং (৫) গবেষণাখাতে বরাদ্দ একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ যাতে প্রয়োজনমত যন্ত্রপাতি কিনতে পারা যায়। ১৯২৬-এর ১৪ই জানুয়ারি এই প্রস্তাবটি রামন আরো বিস্তারিতভাবে পাঠালেন। সেই সময়ের আর্থিক টানাটানির মধ্যেও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ প্রস্তাবটি উড়িয়ে তো দিলেনই না, বরং পরিকল্পনা রূপায়ণ ও খরচের আন্দাজ পাবার জন্যে বোর্ড অফ অ্যাকাউন্টসে পাঠালেন। পদার্থবিদ্যা বিষয়ক গবেষণার জন্যে শক্তিশালী একটি কেন্দ্র গড়ে তুলতে কীরকম খরচ হতে পারে, সিন্ডিকেট রামনকেই সে নিয়ে আনুমানিক প্রস্তাব দিতে বললেন। এর জবাবে রামনের পরবর্তী চিঠির ভিত্তিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের ইঞ্জিনিয়ারকে বলা হল রামনকে সাহায্য করতে। যদিও এই পরিকল্পনাটি রূপায়িত হয়নি। হলে রামন হয়ত কলকাতা ছেড়ে যেতেন না। আমরা পরে দেখব, বিভাগের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট স্বয়ংশাসিত বা আধা-স্বয়ংশাসিত গবেষণা প্রতিষ্ঠান প্রথম রূপ পাবে মেঘনাদ সাহার হাত ধরে, ইন্সটিটিউট অফ নিউক্লিয়ার ফিজিক্স হিসেবে।
৩৫ বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডে পালিতের সম্পত্তি নিয়ে কী করা যায়, সেটা বিশ্ববিদ্যালয় দেখছিল। বিক্রি করা বা নেহাৎ না পারলে ভাড়া দেওয়া যায় কিনা, সে কথা উঠেছিল। ভাড়া দিলে কত টাকায়, তা নিয়ে পালিত ট্রাস্টের গভর্নিং বডি ও বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে অনেক চিঠি চালাচালি হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত বার্ষিক দশ হাজার টাকায় বিশ্ববিদ্যালয় পালিত ট্রাস্টের কাছ থেকে ঐ বাড়ি ভাড়া নেয়। ১৯৩৬ সালে দেখি যে ১১২০০ টাকা ভাড়া দেওয়া হচ্ছিল। ১৯৪৭ াল পর্যন্ত এই ভাড়াই ছিল, ফি ফান্ড থেকে ভাড়া আসত।
পালিত অধ্যাপকের সুযোগসুবিধে
টাকাপয়সা ও গবেষণাগারের স্থানসঙ্কুলানের ব্যাপারে রামন ক্ষুব্ধ ছিলেন, কিন্তু নিজেদের সীমিত সামর্থ্যের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় রামনকে স্বাধীনতা দিতে কার্পণ্য করেনি। মনে রাখতে হবে, রামন যতটুকু পেতেন, অন্যান্য অধ্যাপকরা তার সঙ্গে তুলনীয় কিছুই পেতেন না। প্রশাসনিক ব্যাপারেও রামনের যথেষ্ট স্বাধীনতা ছিল। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ১৯১৮ সালে রামন যন্ত্রপাতির হিসেব রাখার জন্যে চল্লিশ টাকা মাইনেতে পতিতচন্দ্র রায় নামে একজন কেরানীকে নিয়োগ করেন, সিন্ডিকেট সম্মতি দিতে দ্বিধা করেনি। ব্রজেন্দ্রনাথকেও পালিত গবেষক হিসেবে নিযুক্ত করা হয়েছিল রামনের সুপারিশেই।
রামন দেশে ও বিদেশে বহু জায়গায় আমন্ত্রিত হয়েছেন, বেশির ভাগই বক্তৃতা দেবার জন্যে, সিন্ডিকেট সর্বদা সেই সব আবেদন মঞ্জুর করেছে। প্রথমে নোবেল পাওয়ার আগের সময়টা দেখি। ১৯২০ সালে রামন গেছেন লাহোরের পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ে, সেখানে তিনি পনেরোটি বক্তৃতার একখানা কোর্স পড়াবেন, তার জন্যে সাম্মানিক পেয়েছেন দেড় হাজার টাকা। পরের বছর গেছেন মাদ্রাজ বিশ্ববিদ্যালয়ে। ১৯২১ সালেই একটি বিশেষ অনুসন্ধান কমিটি তৈরি হয় ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউট অফ সায়েন্স সম্পর্কে সরকারকে রিপোর্ট দিতে, রামন সেই কমিটির সদস্য ছিলেন। দৈনিক সাম্মানিক ছিল পঞ্চাশ টাকা, রামন বললেন যে সেই টাকা তিনি বিশ্ববিদ্যালয়কে দিতে চান। সিন্ডিকেট রামনের গবেষণার জন্যেই সে টাকা আবার ফিরিয়ে দেয়। ১০ই নভেম্বর থেকে ২৩শে ডিসেম্বর, এই বিয়াল্লিশ দিনে রামনের প্রাপ্য হয়েছিল ২১০০ টাকা।
রামনের প্রথম ইউরোপ যাত্রাও ১৯২১ সালে। অক্সফোর্ডে পৃথিবীর বিশ্ববিদ্যালয়গুলির একটি সম্মেলন হয়েছিল, রামন কলকাতার প্রতিনিধি ছিলেন। বিদেশযাত্রা বাবদ পালিত ট্রাস্ট ২৫০০ টাকা মঞ্জুর করেছিল, সম্মেলন ছাড়াও ইংল্যান্ডের কিছু গবেষণাগার দেখে আসার জন্যে।
১৯২৪ সালে রামন গেলেন কানাডায়, ব্রিটিশ অ্যাসোসিয়েশন ফর দা অ্যাডভান্সমেন্ট অফ সায়েন্সের মিটিংয়ে যোগ দিতে। এই সম্মেলনে যাবার খরচ যৌথভাবে দিয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয় ও ব্রিটিশ অ্যাসোসিয়েশন। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রামন পেয়েছিলেন ঘোষ ট্র্যাভেলিং ফেলোশিপ, ১৯২৩-২৪এর জন্যে। কানাডায় রামন রয়্যাল কানাডিয়ান ইন্সটিটিউট আয়োজিত আন্তর্জাতিক গণিত সম্মেলনে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন। এই সম্মেলন হয়েছিল ১৯২৪এর আগস্টে। সেখান থেকে রামন গেলেন ফিলাডেলফিয়ার ফ্র্যাঙ্কলিন ইন্সটিটিউটের শতবার্ষিকী অনুষ্ঠানে যোগ দিতে, সেপ্টেম্বরের ১৭ তারিখে। তারপর থেকে মাঝ-ডিসেম্বর পর্যন্ত রবার্ট মিলিকানের আমন্ত্রণে রামন আমেরিকাতেই ছিলেন।
ইউরোপ ও আমেরিকাতে রামন কী কী কাজ করেছিলেন, তার বর্ণনা দিয়ে তিনি রাসবিহারী ঘোষ বোর্ডকে একটি চিঠি পাঠান। ঘোষ বোর্ড প্রস্তাব করে যে চিঠিটি ক্যালকাটা রিভিউতে ছাপা হোক।
১৯২৫ সালে রামন রাশিয়ার অ্যাকাডেমি অফ সায়েন্সের দ্বিশতবার্ষিকী অনুষ্ঠানে যাবার আমন্ত্রণ পান। তিনি পালিত ট্রাস্টের কাছে আড়াই হাজার টাকা চাইলেন, কিন্তু ট্রাস্ট জানিয়ে দিল যে এই খাতে কোনোরকম টাকা দিতে তারা অপারগ। তখন সিন্ডিকেট নিজে উদ্যোগ নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের তহবিল থেকে রামনকে এই টাকাটা দেন, শুধু অনুরোধ ছিল যে ইউরোপের কিছু গবেষণাগারও যেন তিনি ঘুরে আসেন।
রামনের গবেষণাগারের উন্নতির জন্যও বিশ্ববিদ্যালয় তার সাধ্যমতো চেষ্টা করত। একটা উদাহরণ দেখা যাক। রামন বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়ার পরে সিন্ডিকেটকে লেখেন যে কলকাতা থাকাকালীন তিনি তিনটি যন্ত্র অর্ডার দিয়েছিলেন যেগুলি সবে বিদেশ থেকে ভারতে পাঠানো হয়েছে। সেগুলি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভাগে কেউ ব্যবহার করবেন না, ইন্সটিটিউট অফ সায়েন্স তাদের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কিনে নিতে চায়। সিন্ডিকেট সম্মতি দিয়েছিল; সেই তিনটি যন্ত্রের মোট দাম ছিল ১৭,৯০০ টাকা।
রামন হয়ত আরো বড়ো কিছুর স্বপ্ন দেখছিলেন, কিন্তু সেই সময়ে আর্থিক টানাটানির মধ্যে একজন অধ্যাপকের জন্যে যতটা করা যায়, বিশ্ববিদ্যালয় তার চেয়ে বেশি বই কম কিছু করেনি। অন্যান্য অধ্যাপকদের অবস্থার সঙ্গে তুলনা করলেই সেটা বেশ বোঝা যায়। মেঘনাদ ও সত্যেন্দ্রনাথ ততদিনে কলকাতা ছেড়ে যথাক্রমে এলাহাবাদ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দিয়েছেন, কলকাতায় যা মাইনে পেতেন তার চেয়ে বেশ কিছুটা বেশি মাইনের জন্যে, কিন্তু তখনো তাঁদের বেতন রামনের কলকাতার বেতনের (মাসে ১০০০ টাকা) চেয়ে কমই ছিল। বয়সে তাঁরা রামনের চেয়ে মাত্র বছর পাঁচেকের ছোট ছিলেন।
রামন বিক্ষেপ ও নোবেল পুরস্কার
রামন ক্রিয়া, রামন এফেক্ট, রামন বিক্ষেপ – বইপত্র খুঁজলে নানারকম নাম পাওয়া যায়, কিন্তু জিনিসটা ঠিক কী? আলো, আমরা সবাই জানি, তড়িৎচৌম্বকীয় তরঙ্গ। সে আলো আমরা চোখে দেখতে পাই বা না পাই, যেমন রেডিও তরঙ্গ, অবলোহিত, অতিবেগুনী, এক্স-রশ্মি, বা গামা-রশ্মি। আবার ১৯০০ সালে মাক্স প্লাঙ্ক দেখালেন, আলোকে অবিচ্ছিন্ন ঢেউ হিসেবে না দেখে বিচ্ছিন্ন শক্তির প্যাকেট হিসেবেও দেখা যায়, যাকে বলে ফোটন। কোন বর্ণনাটা ঠিক? উত্তর হল, দুটোই ঠিক, আপনি আলোর কোন ধর্ম দেখতে চাইছেন, তার ওপর নির্ভর করবে, আলো ঢেউ হিসেবে ধরা দেবে, না ফোটন হিসেবে।
কোনো অণুর, যেমন বাতাসের অক্সিজেন বা নাইট্রোজেন, ওপর আলো এসে পড়লে আলোর গতিপথ পাল্টে যায়, কিন্তু ফোটনের শক্তি একই থাকে। একে বলে স্থিতিস্থাপক বিক্ষেপ, ইংরেজ বৈজ্ঞানিক লর্ড র্যালের নামানুসারে যার আরেক নাম র্যালে বিক্ষেপ। আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য যত কম হয়, র্যালে বিক্ষেপের পরিমাণ তত বাড়ে। বাতাসের অণু সূর্যের আলোর লাল অংশের চেয়ে নীলের বিক্ষেপ ঘটায় বেশি, তাই আকাশের রং নীল, আর ভোরের বা গোধূলির সূর্য লালচে।
মুক্ত ইলেকট্রন, অর্থাৎ যারা কোনো পরমাণুর মধ্যে আটকা পড়ে নেই, তাদের থেকেও আলোর বিক্ষেপ হতে পারে। ফোটনের শক্তি যদি খুব বেশি হয় (এক্স-রশ্মি বা তারও ওপরে), তাহলে পাই কম্পটন বিক্ষেপ, আর কম হলে টমসন বিক্ষেপ। এগুলো নিয়ে এখন না ভাবলেও চলবে।
অণুর থেকে আলোর আরেক রকমের বিক্ষেপ হয় যেখানে ফোটনের (বা তরঙ্গ হিসেবে দেখলে আলোকতরঙ্গের) শক্তি পাল্টে যেতে পারে। সাধারণত কোনো অণুর মধ্যে ইলেকট্রনের বিন্যাস এমন হয় যে তার শক্তি হয় সর্বনিম্ন। একে বলে ভৌম স্তর বা গ্রাউন্ড স্টেট। কিন্তু অণুর আরো সম্ভাব্য শক্তিস্তর আছে যার শক্তি ভৌম স্তরের চেয়ে বেশি। এখানে অণুকে ওঠাতে গেলে ফোটনকে কিছুটা শক্তি খরচ করতে হয়, তার ফলে ফোটনের নিজের শক্তি কিঞ্চিৎ কমে যায়। অর্থাৎ অণুর ওপর যে আলো এসে পড়ল, তার থেকে বিক্ষিপ্ত আলোর শক্তি খানিকটা কম। উল্টোটাও যে হতে পারে না তা নয়; অণুটা হয়ত প্রথমে উঁচু শক্তিস্তরে ছিল, ফোটনের ধাক্কায় নিচে নেমে এলো, ফলে বিক্ষিপ্ত ফোটনের শক্তি বেড়ে গেল। একে বলে অস্থিতিস্থাপক বিক্ষেপ। এইরকম অস্থিতিস্থাপক বিক্ষেপ ঘটার সম্ভাবনা স্থিতিস্থাপক বিক্ষেপের তুলনায় নিতান্তই কম।
১৯২৩ সালে অস্ট্রিয়ান পদার্থবিদ আডলফ স্মেকাল তাত্ত্বিকভাবে দেখান যে কোনো পদার্থ থেকে আলোর এরকম অস্থিতিস্থাপক বিক্ষেপ হতে পারে। ১৯২৮ সালের ২৮শে ফেব্রুয়ারি কালটিভেশনের গবেষণাগারে রামন ও তাঁর ছাত্র কে এস কৃষ্ণন প্রথম এই বিক্ষেপের পরীক্ষামূলক প্রমাণ পান (এই ঘটনাকে স্মরণীয় করে রাখার জন্যেই ২৮শে ফেব্রুয়ারি জাতীয় বিজ্ঞান দিবস হিসেবে পালন করা হয়)। এটিই রামন এফেক্ট বা রামন বিক্ষেপ নামে পরিচিত, তবে পুরোনোদিনের জার্মান ভাষায় লেখা বইতে স্মেকাল–রামন এফেক্ট নামটাও দেখা যায়।
রামন বিক্ষেপ কোন কাজে লাগে? মূলত, অণুর শক্তিস্তরগুলোর সন্ধান পেতে এবং সেখান থেকে অণুর গঠনবিন্যাস বের করতে। আজকাল আলোর উৎস হিসেবে লেজার রশ্মি ব্যবহার করা হয়, ফলে খুব নিখুঁতভাবে অণুর গঠন বের করা যায়, পদার্থবিদ ও রসায়নবিদ দু পক্ষই রামন বিক্ষেপের সাহায্য নেন।
রামন এফেক্ট আবিষ্কৃত হয়েছিল কালটিভেশনের গবেষণাগারে, কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে পালিত অধ্যাপকের পদে থাকার জন্যে রামন অনেক সুবিধেও পেয়েছিলেন। নিয়মিত আর্থিক সহায়তা না পেলে রামনের পক্ষে বিদেশ যাওয়া খুব সহজ হত না। বিদেশযাত্রার ফলেই ইউরোপীয় ও আমেরিকান বিজ্ঞানীদের সঙ্গে রামনের আলাপ পরিচয় হয়, এবং রামন তাঁর কাজের গুরুত্ব সম্বন্ধে তাঁদের বোঝাতে সক্ষম হন। বিদেশী বিজ্ঞানীদের প্রত্যক্ষ সমর্থন না থাকলে রামন নোবেল পুরস্কার পেতেন কি না, সন্দেহ।
১৯২৮ সালে রামন এফেক্ট আবিষ্কারের পরে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে অভিনন্দন আসছিল, রামন তার কিছু কিছু পালিত ট্রাস্টকে পাঠিয়েছিলেন। দোসরা আগস্ট পালিত ট্রাস্টের কার্যবিবরণীতে দেখি–
অধ্যাপক সি ভি রামনের পাঠানো একটি চিঠির অংশবিশেষ পড়া হল। ১৬ই জুন ১৯২৮ তারিখে চিঠিটি তাঁকে লিখেছেন মিউনিখের অধ্যাপক আর্নল্ড সমারফেল্ড, এযুগের শ্রেষ্ঠ পদার্থবিদদের একজন। “আপনার প্রবন্ধগুলির ওপরে আমি মিউনিখে একটি বক্তৃতা দিয়েছি। বার্লিনের অধ্যাপক প্রিংসহাইম আপনার আবিষ্কৃত বিক্ষেপের কিছু চমৎকার ছবি তুলেছেন, সেই স্লাইডগুলোও দেখিয়েছি। আপনি একটা দারুণ পরীক্ষা করেছেন, আমরা সকলেই এই নিয়ে খুব উৎসাহী। জাপান আধুনিক পদার্থবিদ্যা নিয়ে আরো অনেকদিন কাজ করছে, সেখান থেকে তো আপনার কাজের সঙ্গে তুলনীয় কিছু এখনো বেরোয়নি।”
মনে রাখতে হবে এই চিঠির তারিখ ১৯২৮। নিউক্লিয়াসের গঠন এবং পাই-মেসন সম্বন্ধে জাপানি বিজ্ঞানী হিদেকি য়ুকাওয়ার কাজ প্রকাশিত হতে আরো সাত বছর দেরি।
সমারফেল্ডের কথা যখন উঠল, বলে রাখা যাক, তিনি ১৯২৮ সালে জাপান গিয়েছিলেন, বোম্বে (অর্থাৎ মুম্বই) হয়ে। রামন ও মেঘনাদ সাহার উদ্যোগে তাঁকে কলকাতায় আমন্ত্রণ করা হয় একটি বক্তৃতামালার জন্যে, সাম্মানিক ২০০০ টাকা। ১২ই অক্টোবর ১৯২৮ তাঁকে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাম্মানিক ডিএসসি উপাধি দেওয়া হয়। অক্টোবরের ৪ থেকে ২৬ তারিখ পর্যন্ত তিনি তরঙ্গ বলবিদ্যার (কোয়ান্টাম বলবিদ্যাকে এখনো অনেকে ঐ নামেই ডাকেন) ওপরে একগুচ্ছ বক্তৃতা দেন, কে এস কৃষ্ণন ও নিখিলরঞ্জন সেনের নেওয়া নোট থেকে একটি লিখিত পুস্তিকা আকারে এই বক্তৃতামালা প্রকাশ করা হয়। প্রকাশ করেছিল কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় প্রেস।
আবিষ্কারের সময়েই রামন বুঝেছিলেন যে এই অস্থিতিস্থাপক বিক্ষেপ বিজ্ঞানে নতুন দিগন্ত খুলে দিতে পারে। তাহলে তো এই আবিষ্কার সম্বন্ধে পশ্চিমের বিজ্ঞানীদের জানাতে হয়, তাঁদের মতামত নিতে হয়। ১৯২৯ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ডিসেম্বর এই চার মাসের জন্যে রামন ছুটি নিয়ে ইউরোপ গেলেন। পালিত ট্রাস্ট তাঁর রাহাখরচ বাবদ ৪০০০ টাকা আর গবেষণার জন্যে আরো ৩০০০ টাকা বরাদ্দ করল। ইউরোপে রামন যাদের সঙ্গে দেখা করলেন তাঁদের মধ্যে ছিলেন আর্নেস্ট রাদারফোর্ড, মারি কুরি, জঁ-বাপতিস্ত পেরাঁ, লুই দ ব্রয়ি এবং ইউজিন ব্লখ। পরের বছর রাদারফোর্ড, মাদাম কুরি, লুই ও তাঁর ভাই মরিস, এবং ব্লখ রামনকে নোবেল পুরস্কারের জন্যে মনোনীত করেন। সে বছরেই, অর্থাৎ ১৯৩০ সালে, রামন নোবেল পান।
রামন বিক্ষেপ সংক্রান্ত প্রবন্ধটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রেস থেকে “A New Radiation” নাম দিয়ে পুস্তিকা আকারে প্রকাশ করা হয়, রামন সেটিও অনেক বিজ্ঞানীকে পাঠিয়েছিলেন। তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য নাম নিলস বোর, তিনি ১৯২৯ ও ১৯৩০, দুবারই রামনের নাম নোবেলের জন্যে প্রস্তাব করেন। নোবেল কমিটির সদস্য সুইডিশ পদার্থবিদ মানে সিগবানকেও একটি পুস্তিকা পাঠানো হয়েছিল। সিগবানের জবাব রামন নিজেই বিশ্ববিদ্যালয়কে পাঠিয়েছিলেন।
কিছুদিন আগেই আপনার নতুন বিকিরণ সম্বন্ধে আলোচনাটি পড়ার সৌভাগ্য হয়েছে। আজ সেই বিষয়ের দ্বিতীয় প্রবন্ধটি পেলাম। খুব উৎসাহ নিয়ে পড়েছি। আমার মনে হয় বিশেষ করে দ্বিতীয় প্রবন্ধটিতে আপনি সংশয়াতীত ভাবে এই নতুন বিকিরণের অস্তিত্ব প্রমাণ করেছেন। আপনি একটি অসাধারণ আবিষ্কার করেছেন, এই চমৎকার বৈজ্ঞানিক পরীক্ষাটির জন্যে আপনাকে আন্তরিক অভিনন্দন।
১৯৩০এর নভেম্বরে রামনের নাম নোবেলজয়ী হিসেবে ঘোষিত হল। ১৪ই নভেম্বর সিন্ডিকেটের কার্যবিবরণীতে পাই–
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এবং সিন্ডিকেট সার চন্দ্রশেখর বেঙ্কট রামন, নাইট, এফ আর এস, এম এ, ডিএসসি, পিএইচডি (ফ্রাইবুর্গ), নোবেল লরিয়েটকে বিজ্ঞানের অগ্রগতিতে তাঁর বিরাট অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তির জন্যে আন্তরিক অভিনন্দন জানাচ্ছেন। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপক এশিয়া মহাদেশে বিজ্ঞানে প্রথম নোবেল পেয়েছেন, এতে সিন্ডিকেট অত্যন্ত আনন্দিত।
২১শে নভেম্বর রামনের নোবেল প্রাপ্তির জন্যে বিশ্ববিদ্যালয়ে বিশেষ ছুটি ঘোষণা করা হয়।
রামন যোগদানের পর থেকে ১০০০ টাকা বেতনের সঙ্গে ১২৫ টাকা ভাতা পেতেন। ১৯৩০এর ১৫ই ফেব্রুয়ারি সিন্ডিকেটে শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় প্রস্তাব আনলেন যে এই ভাতা বাড়িয়ে মাসে ৫০০ টাকা করা হোক। গণিতের বিভাগীয় প্রধান গণেশ প্রসাদ আপত্তি তুললেন। শেষে অনেক আলোচনার পর প্রস্তাবটি গৃহীত হল।
১৯৩০এর ১৫ই নভেম্বর থেকে ১৯৩১এর ফেব্রুয়ারির শেষ পর্যন্ত রামন বিশেষ ছুটি পেলেন ইউরোপ যাবার জন্যে (এবং অবশ্যই নোবেল পুরস্কার গ্রহণের জন্যে)। নভেম্বর থেকে জানুয়ারি, তিন মাসের বেতন বিশ্ববিদ্যালয় অগ্রিম দিয়েছিল।
১৯৩০ সালের নোবেল প্রাইজ পুরষ্কার বিতরণী অনুষ্ঠান
নোবেল পুরস্কারের পর কলকাতার শেষ কয়েক বছর
নোবেল পাওয়ার পর রামন পুরো তিন বছরও কলকাতায় থাকেননি। এই সময়ে তাঁর কিছু কথা বিতর্কের জন্ম দিয়েছিল, বেশ অপ্রীতিকর পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল, কিন্তু সে সব কথায় আমাদের না গেলেও চলবে। রামনের সঙ্গে যাদের ব্যক্তিত্বের সংঘাত হয়েছিল, ঘটনাচক্রে তাঁরা সকলেই বাঙালি, আর তাই “রামন বাঙালিবিদ্বেষী” এরকম একটা সাধারণীকরণ বাতাসে ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছিল। এটা সম্পূর্ণ ভুল কথা, আর এর পেছনে যা প্রমাণ দেওয়া হয় সেগুলোও শোনা কথা, ইংরেজিতে যাকে বলে হিয়ারসে। এগারো জন বাঙালি ছাত্র রামনের গবেষণাগারে কাজ করে ডক্টরেট হয়েছেন (বিশ্ববিদ্যালয় ও কালটিভেশন মিলিয়ে), আরো অনেকে কাজ করেছেন কিন্তু ডক্টরেট শেষ করেননি। মানুষ হিসেবে দোষগুণ তো সবারই থাকে, কিন্তু রামনের অবদান ছোট করে দেখানো এক রকম অসহিষ্ণুতা। দুর্ভাগ্যের বিষয়, রামনের প্রতিদ্বন্দ্বীদের জীবনীতে অনেক সময় এই অসহিষ্ণুতা প্রকাশ পেয়েছে।
১৯৩১ সালের ২৬শে জুন কলকাতা পৌরসভার পক্ষ থেকে রামনকে নাগরিক সংবর্ধনা দেওয়া হয়, দিয়েছিলেন তৎকালীন মেয়র ডাক্তার বিধানচন্দ্র রায়। এর জবাবে রামন একটি দু পাতার ভাষণ দেন। সেখানে তিনি কালটিভেশনের প্রতিষ্ঠাতা মহেন্দ্রলাল সরকার এবং সার আশুতোষের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন। কলকাতার বন্ধুদের ধন্যবাদ জানিয়েছেন, আলাদা করে জানিয়েছেন তাঁর বিশেষ সুহৃদ ও শুভানুধ্যায়ী আচার্য প্রফুল্লচন্দ্রকে। বলছেন, আমার সমস্ত বৈজ্ঞানিক কাজের সব ব্যাপারে সহযোগিতা ও সহানুভূতির জন্যে আমি সর্বদা প্রফুল্লচন্দ্রের ওপর নির্ভর করতে পারতাম, কখনো এর অন্যথা হয়নি।
কলকাতার প্রশংসায় রামন পঞ্চমুখ – গত একশো বছর ধরে কলকাতা শুধু বাংলা বা ভারত নয়, গোটা এশিয়ার বৌদ্ধিক চর্চার কেন্দ্র। রামনের ভাষণের বড়ো জায়গা জুড়ে কিন্তু কালটিভেশন, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় নয়। রামন বলছেন –
কালটিভেশনের গবেষণাগার ও গ্রন্থাগার যদি আরো সমৃদ্ধ হত, ভারতের সব জায়গার সব প্রস্তাব একত্র করে আমাকে দিলেও এই শহর থেকে আমাকে কেউ নড়াতে পারত না।
রামনের গুরুত্বপূর্ণ কাজের বেশির ভাগই কালটিভেশনে করা। কালটিভেশনকে রামন পশ্চিমী দুনিয়ার সঙ্গে তুলনীয় একটি অ্যাকাডেমি বানাতে চেয়েছিলেন, সে উদ্দেশ্যে ইওহানেস স্টার্ক, পীটার জীমান, ও নিলস বোরের মত বিজ্ঞানীদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন। সে স্বপ্ন অবশ্য রূপায়িত হয়নি।
১৯৩৩ সালের পয়লা এপ্রিল রামন কলকাতা ছেড়ে চলে যান। তাঁর আগের বছর ১৬ই সেপ্টেম্বর তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের নিবন্ধককে চিঠি দিলেন যত দ্রুত সম্ভব পালিত ট্রাস্টের গভর্নিং বডির মিটিং ডেকে তাঁর উত্তরসূরী ঠিক করতে। ২৩শে সেপ্টেম্বর মিটিং হল, বিশ্ববিদ্যালয় পালিত অধ্যাপক পদের জন্যে আবেদন চাইলেন। রামনকে বিনা বেতনে চোদ্দ মাসের ছুটি মঞ্জুর করা হল। ১৯৩৪ সালের ২৮শে মে পালিত অধ্যাপকের জন্যে বিজ্ঞাপনের খসড়া অনুমোদিত হয়। নতুন পালিত অধ্যাপক হিসেবে মনোনীত হন দেবেন্দ্রমোহন বসু। তাঁকে এবং বিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর পঠনপাঠন বিষয়ক সচিব সতীশচন্দ্র ঘোষকে পালিত গবেষণাগারের যন্ত্রপাতির দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়ে ২০শে জুন রামন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সরকারিভাবে পদত্যাগ করেন।
এই দীর্ঘ ষোল বছরে বিশ্ববিদ্যালয়ে যারা রামনের সঙ্গে কাজ করেছিলেন, তাঁদের নামের তালিকা নিচে দেওয়া হল, সঙ্গে তাঁরা কোথায় পরে চাকরি করেছেন, সে কথাও। এটি সমরেন্দ্রনাথ সেনের বই থেকে গৃহীত। বিভাগের নাম উল্লেখ না থাকলে পদার্থবিদ্যা বিভাগ বুঝতে হবে।
১। ভবনাথ ব্যানার্জি করাচিতে আবহবিদ
২। দুর্গাদাস ব্যানার্জি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
৩। নলিনীমোহন বসু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, গণিত বিভাগ
৪। টি কে চিন্ময়ানন্দম অধিকর্তা, কোলাবা পর্যবেক্ষণাগার, বোম্বে
৫। ব্রজেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়
৬। পঞ্চানন দাস কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, ফলিত গণিত বিভাগ
৭। ফণীন্দ্রনাথ ঘোষ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, পরে ফলিত পদার্থবিদ্যা বিভাগ
৮। শিশিরকুমার মিত্র কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়
৯। এল এ রামদাস কৃষি আবহবিদ, পুনা
১০। বিধুভূষণ রায় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়
১১। নিহাল করন শেঠি আগ্রা কলেজ
১২। সুকুমারচন্দ্র সরকার কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়
এছাড়া সুধাংশুকুমার ব্যানার্জি ও কেদারেশ্বর ব্যানার্জি রামনের গবেষণাগারে যুক্ত ছিলেন, কিন্তু স্বাধীনভাবেই গবেষণা করেছিলেন।
খুব সাবলীল লেখা। ভালো।
Namoskar sir🙏
I always eager to know the starting of scientific research in India. I got your article through my friend who is in Physics dept.(MSc.) CU. Your article is very informative. Thank you sir.
I’m Currently doing M.Sc. in Chemistry(PBU)Cooch Behar.