সূচী

ইতিহাস তথ্য ও তর্ক

বুদ্ধ ও যীশুর প্রাচীনতম রূপের সন্ধানে

বুদ্ধ ও যীশুর প্রাচীনতম রূপের সন্ধানে

সুদীপ্ত পাল

অক্টোবর ১৭, ২০২০ ১৮৭২ 8

বুদ্ধ আর যীশুর একটা জায়গায় মিল আছে। দুজনেই নূতন ধর্মের প্রবর্তক, তবে সেটা নয়, অন্য একটা সাদৃশ্যের কথা আমরা বলব। সেটা হল, দুজনেরই প্রথম প্রতিকৃতি পাওয়া গেছে তাঁদের মৃত্যুর কয়েক শতাব্দী পর থেকে। তাঁরা বাস্তবে কেমন দেখতে ছিলেন সেটা জানার পক্ষে একটা বড় অন্তরায় এটা। ওঁদেরকে যারা জীবিত অবস্থায় দেখে গেছে তারাও এই পৃথিবীতে ছিল না যখন ওনাদের প্রথম মূর্তি বা ছবি তৈরী হয়েছে।

আমরা জানি বুদ্ধের দেহাবসান ও দাহক্রিয়ার পর তাঁর দেহাস্থিগুলি রাজারা আট ভাগে ভাগ বাটোয়ারা করে নিজেদের রাজ্যে নিয়ে গিয়ে সেগুলোর উপরে স্তূপ নির্মাণ করেন। পরে অশোক সেই স্তূপগুলির উৎখনন করে ৮৪০০০ ভাগ করে এগুলিকে সারা দেশ জুড়ে ছড়িয়ে দেন, এবং এইভাবে আগামী কয়েকশো বছরে আরও নতুন নতুন স্তূপ গড়ে ওঠে। আফগানিস্তানের এমনই একটি স্তূপ- বিমরান স্তূপের নিচে পাওয়া গেছে ধাতুনির্মিত বিমরান কাস্কেট (বুদ্ধের দেহাস্থি রাখার বাক্স)। এর গায়ে দেখা যায় বুদ্ধকে উপাসনা করছেন ইন্দ্র ও কমণ্ডলু হাতে ব্রহ্মা। এখনও অবধি প্রাপ্ত প্রাচীনতম বুদ্ধের প্রতিকৃতির মধ্যে এটি একটি। অধুনা ব্রিটিশ মিউজিয়ামে রক্ষিত এই শিল্পকৃতিটি সম্ভবতঃ প্রথম সাধারণ পূর্বশতকের। এর থেকে পুরোনো বুদ্ধ-প্রতিকৃতি এখনও পাওয়া যায়নি। অথচ এটি বুদ্ধের মৃত্যুর প্রায় চারশ বছর পরে তৈরী। অনেকেই বলবেন এক্ষেত্রে একটা ‘সার্ভাইভাল বায়াস’ থাকতে পারে। হয়তো ওনার আদিতম প্রতিকৃতিগুলো এখনও টিকে নেই। কাঠ বা টেরাকোটার উপরে তৈরী কাজ নষ্ট হয়ে যেতেই পারে, ধাতু গলিয়ে অন্য বস্তুর নির্মাণ হতে পারে, এমনকি পাথরও হারিয়ে যেতে পারে। তবে বিশেষজ্ঞরা বলেন এর থেকে পুরোনো বুদ্ধ-প্রতিকৃতি থাকলেও সেটা মোটামুটি সমসাময়িকই হবে। তাহলে বুদ্ধমূর্তি নির্মাণে এত দেরি কেন? তার কারণ আমরা ধীরে ধীরে দেখব।

বিমরান কাস্কেট (বুদ্ধের দেহাস্থি রাখার বাক্স)- বুদ্ধকে উপাসনা করছেন ইন্দ্র ও কমণ্ডলু হাতে ব্রহ্মা- প্রথম সাধারণ পূর্বশতক।

বুদ্ধ পৌত্তলিকতাবিরোধী ছিলেন না। তবে নিজের ছবি আঁকাতে ওনার আপত্তি ছিল। কিন্তু শিষ্যদের তিনি অনুমতি দিয়েছিলেন উপাসনার জন্য বোধিসত্ত্বরূপের মূর্তি নির্মাণে। গান্ধার পূর্ববর্তী যুগে তাই বোধিসত্বেরই মূর্তি গড়া হত, অথবা অন্যভাবে বুদ্ধকে অদৃশ্য রেখে বুদ্ধজীবনী দেখানো হত। তবে মনে রাখতে হবে শিষ্যদের ঐ অনুমতি দেবার গল্পটাও অনেক পরবর্তীকালের। এখানেও দুইরকম গল্প আছে। মহাযানীদের মৈত্রেয়সিংহনাদ সূত্রে দেখা যায় শিষ্য কাশ্যপ ও গৌতম বুদ্ধ – দুজনের মধ্যে কথোপকথন, যার সারবস্তু হল- তথাগতকে বর্ণনা করা সম্ভব নয়, উনি তার উর্ধ্বে। এই কথোপকথনে দেখা যায় কাশ্যপ বুদ্ধকে মনে করাচ্ছেন বুদ্ধ নিজেই কোশলরাজ প্রসেনজিতকে বুদ্ধমূর্তিনির্মাণের অনুমতি দিয়েছেন। বুদ্ধ উত্তরে বলেছেন: প্রসেনজিত গৃহী- তাই তিনি অনুমোদন দিয়েছেন- কিন্তু ভবিষ্যতে দেখা যাবে, অনেকে বুদ্ধ-প্রতিকৃতি বিক্রয়কেই পেশা হিসাবে বেছে নেবে। এদেরকে কটাক্ষ করা হয়েছে এই কথোপকথনে। এটি কাল্পনিক কথোপকথন- প্রথম বা দ্বিতীয় শতকে রচিত, বুদ্ধের মৃত্যুর কয়েকশো বছর পর। আর যে ভবিষ্যতের কথা ওখানে বলা হয়েছে- সেটি ঐ লেখাটির সমসাময়িক। মোট কথা, বোঝা যায় ঐ সময়ে বুদ্ধমূর্তিনির্মাণের যৌক্তিকতা নিয়ে বৌদ্ধদের বিভিন্ন শাখায় পরস্পরবিরোধ ছিল। এই বিরোধ দ্বিতীয় শতক অবধি টিকে ছিল সেটা বোঝা যাচ্ছে, যদিও এরই মধ্যে মথুরা, গান্ধার সর্বত্রই ওনার মূর্তিনির্মাণ প্রচলিত হয়ে গেছে।

আবার প্রশ্ন আসে প্রথম সাধারণ পূর্বশতকেই কেন? তার আগে-পরে কেন নয়? ভারতে উৎকৃষ্ট মানের ভাস্কর্যনির্মাণ তো শুঙ্গযুগেই শুরু হয়ে গিয়েছিল- মোটামুটি দ্বিতীয় সাধারণ পূর্বশতকে। সাঁচী আর ভরহুতের ভাস্কর্যমণ্ডিত প্রাচীরগুলিও শুঙ্গযুগের। আর সাঁচীর ভাস্কর্যমণ্ডিত তোরণগুলি প্রথম সাধারণ পূর্বশতকের, সাতবাহন যুগের। সাঁচী আর ভরহুত- দু’জায়গাতেই বুদ্ধজীবনী প্রদর্শিত হয়েছে- তবে বুদ্ধকে অদৃশ্য রেখে- কখনও ছাতার আড়ালে- কখনও শূণ্য বজ্রাসন দেখিয়ে। এক্ষেত্রে দুটি দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে হবে। আমরা বাণিজ্যিক বিষয়গুলি যেরকম দু’ভাবে দেখি- প্রযুক্তি আর প্রতিযোগিতা- এখানেও তাই।

এক, প্রযুক্তি। সাঁচী-ভরহুতের তোরণ বা দেয়ালের ভাস্কর্যগুলি, মথুরার পাথর ও পোড়ামাটির মূর্তিগুলি, এবং আমাদের বাংলার চন্দ্রকেতুগড় ও তাম্রলিপ্তের পোড়ামাটির মূর্তিগুলি দেখিয়ে দেয় দ্বিতীয় ও প্রথম সাধারণ পূর্বশতকে ভাস্কর্যশিল্পে ভারত কীরকম উৎকর্ষ লাভ করেছিল। আর একটা প্রযুক্তি বহুলভাবে প্রচলিত হলে সেটা ব্যবহার করার চাপ সবার উপরেই আসতে থাকে। যাই হোক সাঁচী-ভরহুতের বুদ্ধজীবনী-চিত্রায়ণে বুদ্ধের অদৃশ্যমানতা থেকে বোঝা যায়, বাধাটা প্রযুক্তিগত ছিল না, বরং বৌদ্ধধর্মের ভেতরে বুদ্ধমূর্তিনির্মাণের প্রতি একটা আপত্তি ছিল।

দুই, প্রতিযোগিতা। মথুরার শিল্পে যক্ষ-যক্ষী-নাগেদের বিশেষ গুরুত্ব প্রথম দিকে দেখা যেত। চন্দ্রকেতুগড়ের নারীদেরকেও যক্ষী বলেই মনে করা হয়। যক্ষ-যক্ষী-নাগেরা বৌদ্ধধর্মের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ হলেও হিন্দুধর্মে এদের নিজস্ব উপাসক-সম্প্রদায় ছিল। অর্থাৎ একটা প্রতিযোগিতা ছিল। প্রতিযোগিতা ছিল হিন্দু ভাগবতধর্মের দিক থেকেও।  দ্বিতীয় সাধারণ পূর্বশতকে বিদিশার হেলিওডোরাস পিলারে ব্যাক্ট্রিয়া থেকে আগত গ্রীক দূত ও ভাগবত- হেলিওডোরাসের লেখা বাসুদেব-বন্দনা আমরা দেখতে পাই। ভাগবতধর্ম বৈষ্ণবধর্মের পূর্বরূপ এবং অনেকটা ভক্তিমূলক ধর্ম ছিল, এবং জনপ্রিয়ও ছিল। ব্যাক্ট্রিয়াতে এই ধর্মমতের জনপ্রিয়তা বোঝা যায় দ্বিতীয় সাধারণ পূর্বশতকের বাসুদেব ও বলরামের চিত্রিত মুদ্রা থেকে। বৈদিক যুগের শেষের দিককার সাহিত্য শতপথ ব্রাহ্মণে পৃথ্বী, অদিতি এই দেবীদের মূর্তির কথা বলা হয়েছে- এবং মথুরার দ্বিতীয় সাধারণ পূর্বশতকের অনেক মূর্তিতে এই দেবীদের আভাস পাওয়া গেছে। এই মাতৃকামূর্তিগুলি প্রজননশীলতার আভাস বহন করে। অর্থাৎ বুদ্ধমূর্তি নির্মাণ শুরু না হলে বাসুদেব, যক্ষ, নাগ ও মাতৃকাদেবীদের উপাসকদের কাছে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ার সম্ভাবনা ছিল। এছাড়াও অনেকে মনে করেন গ্রীক সনাতন ধর্মের দেবদেবীদের উপাসনা-পদ্ধতির প্রভাবও ছিল। গ্রীকরাও ভারতীয়দের মত মূর্তিপূজায় বিশ্বাসী ছিল, আর ভাস্কর্যশিল্পে বিশেষভাবে পারদর্শী তো ছিলই। প্রথম দিকের বুদ্ধমূর্তির অনেকগুলি ব্যাক্ট্রিয়ার ইন্দো-গ্রীক রাজ্যে দেখা যায়।

বিমরানের পর থেকে মোটামুটি প্রথম শতক থেকে আমরা ভালমতই বুদ্ধমূর্তি দেখতে পাই। পাকিস্তানের স্বাত উপত্যকায় পাওয়া বুৎকারা স্তূপের মস্তকহীন বুদ্ধ, মথুরার একাধিক বুদ্ধমূর্তি, অহিচ্ছত্রের বুদ্ধ- ইত্যাদি। অনেকের মতে মথুরার প্রথম সাধারণ পূর্বশতকের জৈন তীর্থঙ্করদের মূর্তিগুলিই বুদ্ধমূর্তির প্রোটোটাইপ হয়ে ওঠে। বুদ্ধ ও তীর্থঙ্করদের দৃশ্যগত সাদৃশ্যের এটা একটা কারণ বলে ভাবা হয়।

এভাবেই ধীরে ধীরে বুদ্ধ তাঁর মূর্তিরূপ পেলেন। মোটামুটি ঐ সময়েই বৌদ্ধধর্মে ত্রিকায়াতত্ত্বের আবির্ভাব হয়। সেখানে বুদ্ধর তিনটি শরীরের কথা বলা হয়েছে- ধর্মকায়া, সম্ভোগকায়া আর নির্মাণকায়া। মোটামুটি বুদ্ধের নির্গুণ, সগুণ এবং মানবরূপ বোঝানোর জন্য। এই তিনটি কায়াকে বোঝানোর জন্যও তাঁকে মূর্তিরূপ দেয়ার প্রয়োজন ছিল। তাছাড়া মূর্তির হাতের মুদ্রা, বসার ভঙ্গী, পায়ের চিহ্নাঙ্কন ও অন্যান্য ডিটেলের মাধ্যমে বুদ্ধের বিভিন্ন রূপের ছোট ছোট পার্থক্যগুলি বোঝানোও সহজ হল। যাই হোক, এইভাবেই জন্ম নিল পৃথিবীর সর্ববৃহৎ আইকোনোগ্রাফির একটি। একজন ভারতীয় পৌঁছে গেলেন এশিয়ার ঘরে ঘরে।

বুদ্ধ ছাড়া আর কারও যদি সারা পৃথিবী জুড়ে এত ভাস্কর্য ও চিত্র থাকে তিনি হলেন যীশু। আগেই বলেছি বুদ্ধর মত যীশুরও প্রথম প্রতিকৃতি পাওয়া গেছে তাঁর মৃত্যুর কয়েক শতাব্দী পর। প্রথমেই বলে নিচ্ছি যীশুর ঐতিহাসিকতা বা উনি কেমন দেখতে ছিলেন সেটি এই আলোচনার বিষয় নয়। সেগুলো নিয়ে গোটা একটা প্রবন্ধ লেখা যায়।

একদম শুরুর দিকে মানুষ যীশুকে আঁকা হত না তার দুটো কারণ- এক তো ইহুদী ধর্মে মানুষের প্রতিকৃতি বানানো নিষিদ্ধ, আর খ্রিস্টধর্মের উৎপত্তি সেখান থেকেই। খৃষ্টধর্মে যখন গ্ৰীক ও রোমান প্রভাব পড়তে শুরু করেছে এবং মূর্তি ও ছবি তৈরী স্বীকৃত হতে শুরু করেছে ততদিনে যীশুর মৃত্যুর পর প্রায় এক শতক পেরিয়ে গেছে। যারা যীশুকে জীবিত দেখে গেছিল তারা সেই যুগ অবধি বেঁচে ছিল না। সেইজন্য হয়তো যীশুকে আঁকার চেষ্টা কেউ করেনি। দ্বিতীয় কারণ- খ্রিস্টধর্মের প্রচলন প্রথম দিকে প্রান্তিক মানুষদের মধ্যেই বেশি ছিল এবং খৃষ্টানদেরকে রাজরোষে পড়তে হত। ৩০৬ সালের আগে অবধি রোম সম্রাটদের কাছে খ্রিস্টধর্ম ব্রাত্য ছিল, অন্ধবিশ্বাস হিসাবেই পরিগণিত হত, এবং খৃষ্টানদের শাস্তিও পেতে হত। সেইজন্যও খ্রিস্টানরা যীশুর ছবি না এঁকে তাকে মাছ বা অন্য কোনও প্রতীক হিসাবে গোপনে উপাসনা করত। (তৃতীয় সম্ভাব্য কারণ হতে পারে যীশু সম্ভবতঃ ছিলেনই না)

কাই-রো (Chi-Rho or χρ) এই দুটি গ্রীক অক্ষরের মাধ্যমে সাংকেতিকভাবে ‘খ্রিস্ট’ শব্দটাকে প্রথম দিককার খ্রিস্টানরা চিত্রায়িত করত। এই সংকেতটি রোমান হরফের এক্স (X) আর পি (P)-এর মতো দেখাতো বলে এটাকে ক্রুশের বিকল্প হিসাবে দেখা যেতে পারে। যদিও এটি প্রাক-খ্রিস্টানযুগের গ্রীকরা অন্য অর্থে (‘ক্রেস্টন’ অর্থাৎ কার্যকর বা ভালো) ব্যবহার করত। অর্থাৎ এটি একটি পুরোনো প্রতীকের নূতন প্রয়োগ। এছাড়া মাছকেও যীশুর প্রতীক হিসাবে দেখানো হত। মাছের সাথেও ক্রুশের সাদৃশ্য লক্ষণীয়। যীশুর মানব-চিত্রণ শুরু হবার আগে এগুলিই যীশুর প্রতীক ছিল।

যীশুর সবচেয়ে পুরোনো খোদিত ভাস্কর্য পাওয়া গেছে বিভিন্ন রোমান স্যাক্রোফ্যাগাস বা কফিনের গায়ে। চতুর্থ শতকের দুটি ভাস্কর্যমণ্ডিত পাথরের কফিনের গায়ে- ডগমাটিক স্যাক্রোফ্যাগাস (শ্মশ্রুমণ্ডিত যীশু) আর জুনিয়াস বাসুসের স্যাক্রোফ্যাগাস (শ্মশ্রুহীন যীশু)। প্রায় সমসাময়িক দুটো কফিনে প্রাপ্তবয়স্ক যীশুর দাঁড়ি আছে এবং নেই- এই পার্থক্যটা লক্ষণীয়।

ভাস্কর্যমণ্ডিত পাথরের স্যাক্রোফ্যাগাসগুলি অভিজাতদের কবর দেয়ার জন্য ব্যবহার করা হত। তৃতীয় শতক অবধি এগুলিতে গ্রীক বা রোমান দেবদেবীদের ছবি অথবা বিভিন্ন ধর্মনিরপেক্ষ ঘটনারই চিত্রায়ণ করা হত। চতুর্থ শতকে খ্রিস্টধর্ম অভিজাতদের ধর্ম হয়ে উঠতে থাকায় এগুলিতে যীশু-বিষয়ক ঘটনার ও বাইবেলের কাহিনীর চিত্রায়ণ শুরু হল। রোমের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ সমাধিশিল্প ছিল ক্যাটাকম্ব বা পাতালস্থিত গণসমাধি। পাতালপুরী বলতে পারেন। ক্যাটাকম্বগুলিতে সেই দ্বিতীয় শতকেই ভালমত খৃষ্টান উপস্থিতি দেখা যায়। রোম শহরে এবং তার সীমানার বাইরেও জমির স্বল্পতা ছিল। জমির দাম অনেক ছিল, আর সবচেয়ে বড় কথা শহরে সমাধি নিষিদ্ধ ছিল। শহরের সীমানার বাইরেও জমি হয়তো খুব সহজলভ্য ছিল না। অতএব পাতালে নরম পাথরের স্তর কেটে তৈরী হত বড় আকারের সমাধিস্থল। খ্রিস্টানদের মধ্যেই এগুলো বানানোর চল বেশী ছিল। খ্রিস্টানরা বিশ্বাসজনিত কারণে সনাতনী রোমানদের মত শবদাহ করত না। অতএব ক্যাটাকম্বটা একটা ভাল বিকল্প ছিল।

পৃথিবীর প্রাচীনতম খ্রিস্টান শিল্পকলা দেখা যায় বেশ কিছু ক্যাটাকম্বে। বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হল ক্যাটাকম্ব অফ প্রিসিলা, ক্যাটাকম্ব অফ কমোডিলা, এবং ক্যাটাকম্ব অফ ক্যালিক্সটাস। প্রথমটি দ্বিতীয় থেকে চতুর্থ শতক অবধি ব্যবহার হত। এখানে দেয়ালচিত্রে একটি মাতা ও শিশুসন্তানের ছবি আছে যেটিকে অনেকে মরিয়ম ও যীশু বলে মনে করেন। আর আছে গুড শেফার্ডের ছবি। কাঁধে ভেড়া, আশেপাশে দুটি ভেড়া ও একজোড়া পাখী। শ্মশ্রুগুম্ফহীন রাখাল কিশোর যীশু। তবে একটা জিনিস মনে রাখতে হবে, খ্রিস্টানরা গুড শেফার্ডকে মানুষ যীশু হিসাবে দেখে না- এটি যীশুকে দেখানোর একটি পদ্ধতিমাত্র। ঠিক যেমন বোধিসত্ত্ব, অবলোকিতেশ্বর, মৈত্রেয়- এরা বুদ্ধ হলেও এরা কেউই মানুষ বুদ্ধ নয়। ক্যাটাকম্ব অফ কমোডিলায় দেয়ালচিত্রে দাঁড়িওয়ালা মানুষ যীশুকে দেখা যায়- সম্ভবতঃ এটিই এখনও অবধি প্রাপ্ত সবচেয়ে পুরোনো শ্মশ্রুমণ্ডিত যীশুর দ্বিমাত্রিক ছবি। এটি চতুর্থ শতকের বলে অনুমান করা হয়।

ক্যাটাকম্ব অফ কমোডিলায় দেয়ালচিত্রে শ্মশ্রুমণ্ডিত যীশুর ছবি (চতুর্থ শতক)

তাহলে এখনকার শ্মশ্রুমণ্ডিত যীশুর প্রাচীনতম রূপগুলি দেখা যাচ্ছে চতুর্থ শতকে। ডগমাটিক স্যাক্রোফ্যাগাসে ভাস্কর্যরূপে, ক্যাটাকম্ব অফ কমোডিলায় দ্বিমাত্রিক চিত্ররূপে। বুদ্ধর মত এখানেও প্রশ্ন জাগে এই সময়েই কেন? চতুর্থ শতকেই কেন? আঁকার বা মূর্তি বানানোর প্রযুক্তি তো রোমে বরাবরই ছিল। এর কারণ হল চতুর্থ শতকে দুটো বড় ঘটনা ঘটে। ৩১১ সালে রোমসম্রাট কনস্টানটাইন  খ্রিস্টধর্মকে বৈধ ঘোষণা করেন, আর ৩৮১ সালে রোমসম্রাট থিওডোসিয়াস খ্রিস্টধর্মকে রাষ্ট্রধর্ম ঘোষণা করেন এবং রোমান সনাতন ধর্মকে অবৈধ ও শাস্তিযোগ্য ঘোষণা করেন। এই মাঝখানের সত্তর বছরে দ্রুতগতিতে খ্রিস্টধর্ম অভিজাতদের ধর্ম হয়ে উঠতে থাকে। যার ফলে  খ্রিস্টান শিল্পে বিনিয়োগ বাড়তে থাকে। আরেকটা কথা মাথায় রাখতে হবে- গ্রীস-রোমের সনাতনী পেগ্যান ধর্মের সঙ্গে সংঘাত থাকলেও এই ধর্মগুলির অনেককিছু খ্রিস্টধর্ম আত্তীকরণ করেছিল- বিশেষ করে এই ধর্মগুলির শিল্পরীতিগুলোকে। অতএব পুরোনো দেবদেবীদের মত যীশুর চিত্রায়ণ শুরু হয় এই সময়ে।

মজার ব্যাপার ছিল- যে কাই-রো সংকেতটি নিপীড়িত খ্রিস্টানদের একটি গোপন প্রতীক ছিল সেটি পরবর্তীকালে কনস্টানটাইনের সামরিক প্রতীক হয়ে গেল। রোমে চতুর্থ শতকের দ্বিতীয়ার্ধ্বে একটি পাতালসমাধিগৃহে (Catacombs of Marcellinus and Peter) দেখা যায় “ক্রাইস্ট ইন ম্যাজেস্টি” (রাজরূপী খ্রিস্ট) নামের একটি দেয়ালচিত্র। এটিও প্রথম দিকের শ্মশ্রুমণ্ডিত যীশুর একটি। এই রাজকীয় রূপ খৃষ্টধর্মের রাষ্ট্রধর্মে পরিণত হবার ইঙ্গিত বহন করে। পঞ্চম শতকের শুরুর দিকে ইতালির রাভেন্না শহরের একটি গীর্জায় দেখা যায় রোম সম্রাটের বেশে শ্মশ্রুহীন যীশু। এটি খ্রিস্টধর্মের পুরো রোম সাম্রাজ্যের ‘ইম্পেরিয়াল’ ধর্মে (অর্থাৎ সাম্রাজ্য-ধর্মে) পরিণত হবার ইঙ্গিতবাহী। রোমসম্রাট আর যীশুর একত্ব- অর্থাৎ যীশুই যে রোমসম্রাট, বা রোমসম্রাট যে যীশুরই প্রতিভূ, তাঁর ইচ্ছায়ই রাজ্যপাট চালাচ্ছেন- অনেকটা এরকমই বার্তা এই ছবিটি বহন করে। কিছুদিন পরে অবশ্য (৪৭৬ সালে) পশ্চিম রোম সাম্রাজ্যের পতন হয়, কিন্তু ইম্পেরিয়াল রোমান চার্চ টিকে থাকে, এবং আগামী এক হাজার বছর ধরে পুরো পশ্চিম ও উত্তর য়ুরোপে রাজত্ব করে বললে ভুল হয় না। যাই হোক, যীশুর দৈহিক রূপ, বেশভূষা, শৈল্পিক আড়ম্বর ইত্যাদির ধারাবাহিক বিবর্তনগুলো ক্ষয়িষ্ণু রোমের পরিবর্তনশীল রাজনীতি এবং খ্রিস্টধর্মের বর্ধনশীল রাজনৈতিক প্রভাবের স্বাক্ষর বহন করে। মাত্র আড়াইশো বছরে মাছ আর কাই-রো-এর সামান্য সংকেত পরিণত হল রাজবেশী যীশুখ্রিস্টে।

অনেকেই প্রশ্ন করেন যে যীশু একজন আরামাইকভাষী ফিলিস্তীনীয় ইহুদী ছিলেন, তাহলে তাঁর দৃশ্যমান রূপ দক্ষিণ য়ুরোপের মানুষদের মত কেন? তার কারণ, তাঁর প্রথম দিককার চিত্রায়ণ রোমেই শুরু হয়েছিল। বাইজান্টাইন সাম্রাজ্য অর্থাৎ গ্রীসে এটি আরও বিকশিত হয়।  ডগমাটিক স্যাক্রোফ্যাগাস আর ক্যাটাকম্ব অফ কমোডিলার শ্মশ্রুমণ্ডিত যীশুই পরবর্তীকালের যীশুর প্রোটোটাইপ হয়ে ওঠে, তবে মধ্যযুগেও শ্মশ্রুহীন যীশু কম হলেও দেখা গেছে- মূলতঃ পূর্বতন পশ্চিম রোমসাম্রাজ্যে। আর বাইজান্টাইন বা পূর্ব রোমসাম্রাজ্যে শ্মশ্রুমণ্ডিত দীর্ঘকেশ যীশুই বাধ্যতামূলক ছিল। শ্মশ্রুহীন যীশুকে শেষবারের মত বড় আকারে দেখা গেছে রেনেসাঁর সময়, ১৫৪১ সালে, দ্য লাস্ট জাজমেন্ট ছবিতে, যেখানে মাইকেলেঞ্জেলো ওনাকে গ্রীক-রোমান দেবতা অ্যাপোলোর অনুকরণে এঁকেছিলেন। যদিও তার প্রায় শ’চারেক বছর আগেই শ্মশ্রুহীন যীশু অপ্রচলিত হয়ে যায়। এই ছবি নিয়ে সমালোচনাও হয়েছিল।

যীশু আর বুদ্ধ বাস্তবে কেমন দেখতে ছিলেন আমরা হয়তো কোনওদিনই জানতে পারব না। কিন্তু তাঁদের প্রথম দিকের ভাস্কর্য বা চিত্ররূপগুলি আমাদের অনেকটাই তাঁদের নিজেদের সময়ের কিছুটা হলেও কাছাকাছি নিয়ে যায়।

তথ্যসূত্র:

মন্তব্য তালিকা - “বুদ্ধ ও যীশুর প্রাচীনতম রূপের সন্ধানে”

  1. খুব ভালো লাগলো। কোথাও পড়েছি বুদ্ধের মৃত্যুর ছ’শো বছর পরে তাঁর মূর্তি তৈরি হয়েছিল। এখন মনে করতে পারছি না। ভালো প্রবন্ধ।

  2. খুব ভাল লাগল আর বিস্মিত হোলাম। Jesus এর সম্বন্ধে পড়েছিলাম যে crucification এর পর ওঁর অসুস্থ শরীরকে নিয়ে যাওয়া হয় কাশ্মীরে। এই ব্যাপারে ওঁর ভক্তদের সাহায্য করে কয়েকজন বৌদ্ধ শ্রমন। এবং কাশ্মীরে ওনার কবর পাওয়া যায়। আসলে ইতিহাস বলে আমরা যা পড়েছি পরবর্তীকালে research শুরু হোলে দেখেছি তা অনেকটাই পাল্টে যায়। ।

মন্তব্য করুন

আপনার ইমেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।