বুদ্ধ ও নাগরাজ মুচলিন্দ: সাহিত্য ও শিল্পে
‘মনের পশ্চাতে ভাবনা না-থাকলে নূতন প্রশ্ন চিত্তে উদয় হয় না; নূতন প্রশ্নের উদয় না-হলে মানুষ নূতন তথ্যের সন্ধান করে না, নূতন ভাবে চিন্তা করে না। নূতন উত্তরও খুঁজে পায় না।…জ্ঞানাভিযানের ধর্মই তো অবিরাম প্রশ্ন উত্থাপন, অবিরাম উত্তর খুঁজে যাওয়া।’
নীহাররঞ্জন রায়, ভারতেতিহাস জিজ্ঞাসা
সুদূর প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে ভারতীয় উপমহাদেশের ধর্ম-সংস্কৃতি, পৌরাণিক সাহিত্য ও শিল্পকলায় মনুষ্যরূপী সর্পের উপস্থিতি ও কার্যকলাপের একটি প্রাণবন্ত ইতিহাস রয়েছে। আদিতে সর্প উপাসনার মূলে ছিল মানুষের ভীতি। পরবর্তীকালে উর্বরাশক্তির সঙ্গে সংযুক্ত হলে সর্পপূজা অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়। মনে রাখা দরকার, সাপ মানুষের শত্রু নয়। বস্তুতপক্ষে এই অদ্ভুতদেহী সরীসৃপ প্রাণীটি একাধারে বাস্তুতন্ত্র, কৃষিক্ষেত্র ও মানব সমাজের লোককাহিনির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হিসেবে স্বীকৃত। হিন্দু, জৈন ও বৌদ্ধ—এই তিন ধর্মাবলম্বীর মানুষই যে অতীতে নাগোপাসনা করতেন তার উল্লেখ প্রাচীন ভারতীয় সাহিত্য ও শিল্পকলায় পাওয়া যায়।
ঋগ্বেদে নাগপূজার কোনো প্রত্যক্ষ প্রমাণ পাওয়া যায়নি। তবে অথর্ববেদে সর্পদেবতাদের উল্লেখ রয়েছে। ব্রাহ্মণ্য ধর্ম-সংস্কৃতিতে মনুষ্যরূপী সর্পকে নাগরাজ, অনন্তনাগ, বাসুকীনাগ, কালীয়নাগ, শেষনাগ, তক্ষকনাগ ইত্যাদি বিভিন্ন নামে বৈদিক সাহিত্য, মহাভারত ও পৌরাণিক সাহিত্যে উল্লেখ করা হয়েছে। আশ্চর্যের বিষয়, শ্রীমদ্ভগবদগীতার দশম অধ্যায়ে (১০.২৮-২৯) সর্প ও নাগের মধ্যে সূক্ষ্ণ পার্থক্যের ইঙ্গিত দেখা যায়। অন্যদিকে বৌদ্ধ সাহিত্যে মুচলিন্দ নামে এক সর্পরাজের কথা জানা যায়, যিনি ভারতীয় ও বহির্ভারতের ভাস্কর্যে গৌতম বুদ্ধের সঙ্গে অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে দীপ্যমান রয়েছেন।
বৌদ্ধ ঐতিহ্যে নাগরাজ মুচলিন্দ
মুচলিন্দ নাগের কথা পাওয়া যায় বৌদ্ধ ধর্মগ্রন্থ ত্রিপিটকের অন্তর্গত সূত্তপিটকের মুচলিন্দ সূত্রে। ‘মুচলিন্দ’ পালি শব্দ, যাকে সংস্কৃত ভাষায় ‘মুচিলিন্দ’ লিখেছেন বিখ্যাত ভারততত্ত্ববিদ স্যার মনিয়র উইলিয়ামস। সূত্তপিটকে মুচলিন্দ সূত্রের মূল কাহিনিটি সংক্ষেপে হল এইরকম:
একসময় তথাগত বুদ্ধত্ব লাভ করে উরুবিল্বের নৈরঞ্জনা নদীতীরে উপস্থিত হয়েছিলেন। সেখানে মুচলিন্দ নামে একটি বৃক্ষমূলে তিনি একাসনে বসেছিলেন। হঠাৎ সেই সময় অকাল মেঘের আবির্ভাব ঘটে। এক সপ্তাহ যাবৎ প্রবল বর্ষণ ও শীতল বাতাসের সমন্বয়ে ভয়ংকর দুর্যোগের প্রাদুর্ভাব হয়। সেই ভয়ানক দুর্দিনে নাগরাজ মুচলিন্দ স্বগৃহ থেকে বেরিয়ে এসে ধ্যানমগ্ন বুদ্ধের শরীরে সাতবার কুণ্ডলী দিয়ে বেষ্টন করেন এবং বুদ্ধের মস্তকের উপর মহাফণা বিস্তার করে দণ্ডায়মান থাকেন। নাগরাজের উদ্দেশ্য ছিল ধ্যানমগ্ন তথাগতকে শীত, গ্রীষ্ম, দংশ, মশক, বায়ু ও উত্তাপ থেকে রক্ষা করা।
সেই দুর্যোগপূর্ণ সপ্তাহ অতিক্রান্ত হলে আকাশ মেঘমুক্ত হল। নাগরাজ মুচলিন্দও তথাগতের শরীর থেকে তার সর্প-বেষ্টনী ত্যাগ করেন। অতঃপর তিনি নাগরূপ পরিত্যাগ করে মানবরূপ ধারণ করে বুদ্ধকে প্রণাম জানালেন।
এই কাহিনি থেকে বুদ্ধের ধ্যানের অর্থ ও তাৎপর্য সঠিকভাবে উপলব্ধি করা যায়। স্যার মনিয়র উইলিয়ামস মনে করেন, যে সকল কঠিন পরীক্ষার মধ্য দিয়ে তথাগতকে যেতে হয়েছিল এটা তার মধ্যে অন্যতম। বস্তুতপক্ষে ‘বোধি’ বা পরম জ্ঞান লাভ করে ধর্ম প্রচারে উদ্দেশ্যে এই কাজটি বুদ্ধের অত্যন্ত প্রয়োজনীয় ছিল। অর্থাৎ কাহিনি অনুসারে, তাঁর ধ্যানের শেষ সপ্তাহটি ছিল সর্বাপেক্ষা কঠিন। কারণ বৌদ্ধ সাহিত্যে ঐ বিশেষ মুহূর্তটি ছিল ‘বুদ্ধত্ব’ লাভের সর্বোচ্চ এবং প্রয়োজনীয় প্রমাণ।
কেবলমাত্র ‘সূত্তপিটক’ নয়, সংস্কৃত ভাষায় রচিত মহাসাংঘিক সম্প্রদায়ের ‘মহাবস্তু’ গ্রন্থেও নাগরাজ মুচলিন্দের উল্লেখ রয়েছে। আবার মহাযান বৌদ্ধধর্মে বুদ্ধের জীবন কাহিনী সম্পর্কিত বিখ্যাত গ্রন্থ ‘ললিত বিস্তার’-এ এইমর্মে বলা হয়েছে, সেই ভয়ংকর কুজ্ঝটিকায় শুধুমাত্র নাগরাজ মুচলিন্দ একাকী নন; বরং ‘নাগেদের একটি দল’ তথাগতকে রক্ষার কাজে আত্মনিয়োগ করেছিল।
ভারতীয় ভাস্কর্যে রূপায়ণ
জনসন জোন্স ও জ্যোৎস্নারানী নাগের গবেষণা থেকে জানা যায় যে, বুদ্ধ ও মুচলিন্দের উপরিউক্ত ঘটনাকে কেন্দ্র করে সাধারণপূর্ব দ্বিতীয় শতাব্দী থেকে সাধারণপূর্ব দ্বাদশ-ত্রয়োদশ শতক পর্যন্ত ভারতীয় উপমহাদেশের পাশাপাশি কাম্বোডিয়া, শ্যাম (থাইল্যান্ড), সিংহল (শ্রীলঙ্কা), নেপাল প্রভৃতি দেশে অজস্র ভাস্কর্য নির্মিত হয়েছিল। বক্ষমান প্রবন্ধে আমরা ‘মুচলিন্দ বুদ্ধ’—এই শব্দবন্ধ ব্যবহার করব এবং বিভিন্ন সময়ের নির্মিত দশটি ভাস্কর্যে তার গঠনশৈলী ও বৈশিষ্ট্যের মধ্যে আলোচনা সীমাবদ্ধ রাখব।
১৯৬৭ সালে ভারতীয় উপমহাদেশে মুচলিন্দ বুদ্ধের অন্যতম প্রাচীন ভাস্কর্যটি মহারাষ্ট্রের পাউনি থেকে পাওয়া যায়। সাধারণপূর্ব দ্বিতীয় শতাব্দীতে নির্মিত এই স্তম্ভ চিত্রটি সম্ভবত হীনযান বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের পৃষ্ঠপোষকতায় তৈরি হয়েছিল। নাগরাজ মুচলিন্দের সাতটি কুণ্ডলী এবং পঞ্চফণা দৃশ্যমান। তবে এখানে বুদ্ধ অনুপস্থিত—শূন্য সিংহাসন এখানে বুদ্ধের প্রতীক। সর্পফণার ঊর্ধ্বে একটি বৃক্ষ বিদ্যমান। পণ্ডিতরা একে মুচলিন্দ বৃক্ষরূপে চিহ্নিত করেছেন, যার বিজ্ঞানসম্মত নাম Pterospermum Suberifolium।
Pterospermum suberifolium গাছের একটি ফুল
ভারতীয় উপমহাদেশে শিল্পকলার ইতিহাসে মধ্যপ্রদেশে অবস্থিত সাঁচীর স্তূপ এক সুপ্রাচীন স্থাপত্যের অসামান্য নিদর্শন হিসেবে স্বীকৃত। সাধারণপূর্ব তৃতীয় শতকে বিখ্যাত মৌর্যসম্রাট অশোকের পৃষ্ঠপোষকতায় এই অনবদ্য স্থাপত্যটি নির্মিত হয়েছিল। এই স্তূপের পশ্চিম প্রবেশদ্বারে মুচলিন্দ নাগের কাহিনির চমৎকার চিত্ররূপ খোদিত রয়েছে। বুদ্ধ এখানে অনুপস্থিত, তবে শূন্য সিংহাসন বুদ্ধের প্রতীক। সিংহাসনের নিচে নাগিনীদের সঙ্গে নাগরাজ মুচলিন্দ ললিতাসনে উপবিষ্ট। তাঁর মস্তকের উপরে পঞ্চফণা দৃশ্যমান। সিংহাসনের উপরে রয়েছে বোধিবৃক্ষ এবং বৃক্ষের দুই পাশে কিন্নরীরা উৎকীর্ণ। এখানে সূত্তপিটকের কাহিনিকে প্রাধান্য দেওয়া হয়নি। বরং শিল্পীর স্বাধীন কল্পনাশক্তির অনবদ্য প্রতিফলন ঘটেছে।
সাঁচী স্তূপের পশ্চিম প্রবেশদ্বারে মুচলিন্দ নাগের কাহিনির চিত্ররূপ
সাঁচী স্তূপের সমকালীন নির্মিত মধ্যপ্রদেশের ভারহুত স্তুপের একটি প্যানেলে এই কাহিনির শিল্পরূপের প্রতিফলন ঘটেছে। এখানেও বুদ্ধের পরিবর্তে শূন্য সিংহাসন বিদ্যমান। সিংহাসনের নিচে অঞ্জলিমুদ্রায় নাগরাজ মুচলিন্দ বুদ্ধকে প্রণাম করছেন। এছাড়া বোধিবৃক্ষ ও পঞ্চফণার পাশাপাশি একজন নাগরাজ ও দুজন নাগিনী জোড়হস্তে দণ্ডায়মান রয়েছেন। প্রকৃতপক্ষে সাঁচী ও ভারহুতের ভাস্কর্যের কাহিনি হীনযানী দৃষ্টিভঙ্গিতে নির্মিত হয়েছিল।
গান্ধার শিল্পশৈলীতেও মুচলিন্দ ও বুদ্ধের কাহিনির অনন্য প্রকাশ ঘটেছে বিভিন্ন ভাস্কর্যে। সাধারণপূর্ব দ্বিতীয় শতাব্দীতে ধূসর সিস্ট পাথরে নির্মিত এই প্যানেলটিতে দেখা যায় যে, বৃক্ষের নিচে ধ্যানরত বুদ্ধকে মুচলিন্দ নাগ কুণ্ডলী পাকিয়ে রয়েছেন। গান্ধার শিল্পের অপর একটি ভাস্কর্যে অনুরূপ চিত্র পাওয়া যায়। এখানে ধ্যানী বুদ্ধের মস্তকের উপরে মুচলিন্দ সপ্তফনা বিস্তার করে রয়েছেন এবং দুপাশে মনুষ্যরূপী নাগ ও নাগিনী বিদ্যমান।
অন্ধপ্রদেশের নাগাজুর্নকোণ্ডায় সাধারণপূর্ব তৃতীয় শতাব্দীর একটি মুচলিন্দ বুদ্ধের মূর্তি পাওয়া গিয়েছে। চুনাপাথরে নির্মিত এই ভাস্কর্যে শুধুমাত্র শাক্যমুনি ও নাগরাজ মুচলিন্দ দৃশ্যমান। পণ্ডিতদের মতে, নাগাজুনকোণ্ডার এই ভাস্কর্যে জৈন প্রভাব বিদ্যমান। কারণ জৈন মতে, ২৩তম তীর্থঙ্কর পার্শ্বনাথকেও একদা ধরণেন্দ্র নামে এক সর্পরাজ দুর্যোগ থেকে রক্ষা করেছিলেন। সেই ভাবনার সম্যক প্রতিফলন ঘটেছে এখানে।
অন্ধপ্রদেশের নাগাজুর্নকোণ্ডায় সাধারণপূর্ব তৃতীয় শতাব্দীর মুচলিন্দ বুদ্ধের মূর্তি।
কলকাতার ইন্ডিয়ান মিউজিয়ামে মুচলিন্দ বুদ্ধের একটি অসামান্য মূর্তি রয়েছে। বেলেপাথরে নির্মিত ভাস্কর্যটির সময়কাল সপ্তম শতাব্দী। এখানে সপ্তফণাবিশিষ্ট মুচলিন্দ নাগের সর্প-কুণ্ডলীর উপর বুদ্ধ ধ্যানাসনে উপবিষ্ট রয়েছেন। বিহারের বোধ গয়া থেকে প্রাপ্ত এই ভাস্কর্যে গুপ্তযুগের ক্লাসিকাল শিল্পরীতির অনবদ্য স্পর্শ রয়েছে।
বহির্ভারতীয় ভাস্কর্যে
শ্রীলঙ্কার প্রাচীন রাজধানী অনুরাধাপুরের সঙ্গে দক্ষিণ ভারতের অমরাবতী শিল্পরীতির নিবিড় সম্পর্ক অতীতে গড়ে উঠেছিল। এখানে মুচলিন্দ নাগ ও বুদ্ধের ভাস্কর্যগুলির প্রধান বৈশিষ্ট্য হল—সর্প-কুণ্ডলীকে বুদ্ধের সিংহাসন রূপে নির্মাণ করা এবং ধ্যানমুদ্রায় উপবিষ্ট বুদ্ধের উপর একফণা বিশিষ্ট মুচলিন্দ নাগকে ছত্রের মতো প্রদর্শন করা।
ভারতের প্রতিবেশী, ‘হিমালয়-কন্যা’ নেপালের বৌদ্ধ ভাস্কর্যেও মুচলিন্দ বুদ্ধের কাহিনির সুন্দর রূপায়ণ ঘটেছে। এখানে মুচলিন্দ পঞ্চফণাবিশিষ্ট। শিল্পী তাঁকে বৃত্তাকারে জালকের মতো উপস্থাপিত করেছেন। বৃত্তের কক্ষে রয়েছেন ক্ষুদ্র ধ্যানী বুদ্ধ।
চতুর্থ শতক থেকে ভারতীয় সংস্কৃতির অভূতপূর্ব বিস্তার ঘটেছিল দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার দেশগুলিতে। এক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করেছিল বৌদ্ধধর্ম। কম্বোডিয়ার প্রাচীন রাজবংশ, যা খমের সাম্রাজ্য (সময়কাল ৮০২–১৪৩১ সাধারণ অব্দ) হিসেবে স্বীকৃত, সেখানকার শিল্পকর্মে ভারতীয় শিল্পরীতির নিবিড় প্রভাবে অসংখ্য বুদ্ধের ভাস্কর্য নির্মিত হয়েছিল। অন্যদিকে অ্যাডালবার্ট গেইল একটি গবেষণাপত্রে এক অভিনব বিষয়ের অবতারণা করেছেন। তিনি দেখিয়েছেন, বৌদ্ধ-ভাস্কর্য বিশেষত মুচলিন্দ বুদ্ধের ভাস্কর্যের ক্ষেত্রে ভারতবর্ষ থেকে নয়, প্রাচীন সিংহলী (শ্রীলঙ্কা) শিল্পরীতির পরিযান ঘটেছিল কম্বোডিয়ার খমের শিল্পরীতিতে।
তথাগত এখানে সর্প-কুণ্ডলীর সিংহাসনে ধ্যানমগ্ন। তাঁর হস্তদ্বয় ধ্যানমুদ্রায় নিয়োজিত। তাঁর কণ্ঠ, কর্ণ ও বাহুতে কারুকার্যময় অলংকার দৃশ্যমান। অন্যদিকে মুচলিন্দ সর্প তাঁর সপ্তফণা বিস্তার করে শাক্যমুনিকে দুর্যোগ থেকে রক্ষা করছেন। ব্রোঞ্জে নির্মিত মূর্তিটির সময়কাল দ্বাদশ শতক। কম্বোডিয়ার খমের শিল্পরীতির সঙ্গে সিংহলী শিল্পরীতির এক অদ্ভুত সুন্দর সাদৃশ্য দেখা যায়।
উপসংহারের পরিবর্তে
ধ্যানরত শাক্যমুনিকে ভয়ংকর দুর্যোগে নাগরাজ মুচলিন্দ কর্তৃক রক্ষা করার অসামান্য কাহিনিটি যুগ যুগ ধরে শিল্পীদের অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে। আবার পাশ্চাত্য পণ্ডিতদের অনেকের ধারণা, সুপ্রাচীন নাগ জাতির ধর্মীয় সংস্কৃতির সঙ্গে বুদ্ধের গভীরভাবে সুপরিচিত থাকার জন্য বিষয়টি এত জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। ভারতীয় শঙ্ঘচূড় সাপ বা কিং কোবরা শিল্পীর কল্পনায় কখনো পঞ্চফণা অথবা সপ্তফণায় রূপান্তরিত হয়েছে। তবে এই কাহিনির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হল, অশুভ শক্তির উপর শুভ শক্তির বিজয়।
সর্প একাধারে উর্বরতা ও প্রাচুর্যের প্রতীক। আবার হিংস্রতাও তাঁর নিত্যসঙ্গী। বুদ্ধকে তিনি সুরক্ষা প্রদান করে এই বার্তা দিয়েছেন—বুদ্ধের জ্ঞানার্জনের পথে তিনি বা কোনো অকিঞ্চিৎকর প্রাণি কখনো অন্তরায় নন; বরং বন্ধুত্বের ভূমিকাই পালন করেন। প্রকৃতপক্ষে এই কাহিনি প্রাকৃতিক, অলৌকিক ও মানবিক; এই ত্রিধারার ভারসাম্যের অপূর্ব প্রতিনিধিত্ব করে।
স্বাভাবিকভাবেই শিল্পীর কল্পনায় মূর্ত হয়েছে ভারতীয় ও বহির্ভারতীয় ভাস্কর্যে। সপ্তম-অষ্টম শতাব্দীর পরবর্তীকালে ভারতীয় ভাস্কর্যে মুচলিন্দ বুদ্ধের ভাস্কর্য নির্মাণ ক্রমশ হ্রাস পায়। পূর্ব-ভারতের পাল যুগের (৭৫০–১১৭৫ সাধারণ অব্দ) শিল্পকলায় মুচলিন্দ বুদ্ধের ভাস্কর্য প্রায় নেই বললেই চলে। কারণ মহাযান বৌদ্ধধর্ম সেই সময়ে বজ্রযান, কালচক্রযান, সহজযান ইত্যাদি বিভিন্ন শাখা-প্রশাখায় বিভক্ত হয়ে পড়ে এবং অস্তমিত ও ক্ষয়প্রাপ্ত বৌদ্ধধর্ম ক্রমশ ব্রাহ্মণ্য ধর্মের সঙ্গে প্রায় মিশে যেতে শুরু করেছিল। অন্যদিকে দ্বাদশ শতকের পরবর্তীকালে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অন্তর্গত কম্বোডিয়ার খমের শিল্পকলায় মুচলিন্দ বুদ্ধের ভাস্কর্য নির্মাণে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়েছিল।
ঋণস্বীকার
1. শ্রীমৎ জ্যোতিপাল ভিক্ষু অনূদিত, খুদ্দনিকায়ে উদান, ত্রিপিটক পাবলিশিং সোসাইটি, বাংলাদেশ, ২০১৩
2. ড. বিমলাচরণ লাহা, গৌতম বুদ্ধ, গুরুদাস চট্টোপাধ্যায় এন্ড সন্স, কলকাতা, ১৩৪৫ বঙ্গাব্দ
3. কল্যাণকুমার দাশগুপ্ত, প্রতিমা শিল্পে হিন্দু দেবদেবী, প. ব. বাংলা আকাদেমি, কলকাতা, ২০১৬
4. অমলকুমার মুখোপাধ্যায়, পৌরাণিকা, ফার্মা কে. এল. এম, কলকাতা, ১৯৮৫
5. Johns & Jyotsna Rani Nag, Muchalinda Buddha: An Interdisciplinary approach to Reinterpret the Depiction of the Buddha with Muchalinda Naga, Journal of Archaeological Studies of India, 2021
6. Nidaullah Sehrai & Aliya Jawad, Relief Panel Depicting Protected by Naga Muchilinda, Ancient Pakistan Vol. XXVI (2015)
7. J. Ph. Vogel, The Nagas in Hindu Legend and Art, Gyan Publishing House, New Delhi, 2021
8. Adalbert J. Gail, Migration of a Buddhist Icon: The Mucilinda-Buddha—A Reply on Pierre Dupont, Google
9. P. V. Bapat Edited, 2500 Years of Buddhism, Publication Division, New Delhi, 2012
10. Samuel Beal, Si-Yu-Ki: Buddhist Records of the Western World, LPP, New Delhi, 2008
11. The Way of The Buddha, Publication Division, Ministry of Information & Broadcasting, Government of India, New Delhi
12. Sir Monier Monier-Williams, A Sanskrit – English Dictionary, MLBD, New Delhi, 1986
প্রবন্ধে ব্যবহৃত আলোকচিত্র ইন্টারনেট থেকে প্রাপ্ত।
লেখা ও তার সঙ্গের ভাষ্কর্যের ছবি খুব ভালো লাগলো। বুদ্ধদেবের সঙ্গে পশুপাখি দের এই যোগ, আমাদের অন্যতর এক শিক্ষাও দেয়।হাতি,শামুক,বানর.. সকলের সঙ্গে এই যোগাযোগের মধ্যে দিয়ে যে সারকথাটি বলা হয়েছে এবং বিভিন্ন ভাষ্কর্যে তার প্রতিফলন ঘটেছে,তা আমাদের শিক্ষনীয়।
ধন্যবাদ লেখককে।
অসংখ্য ধন্যবাদ ম্যাডাম।
খুব খেটে লেখাটি তৈরী করতে হয়েছে |
উৎসুখ দের জন্য সুখাদ্য | ধন্যবাদ |
একদমই তাই। তবে আমার বিষয়টি সম্পূর্ণ অজানা ছিল। শুভেচ্ছা রইলো।
খুবই তথ্যবহুল, কুনাল বাবু। সমৃদ্ধ হলাম। 💐💐
অজস্র ধন্যবাদ মাস্টারমশাই।
বৌদ্ধ ধর্মের সর্প দেবতার বিষয়টি এতো সহজ করে উপস্থাপন করার জন্য লেখককে অনেক অনেক ধন্যবাদ। বৌদ্ধ ধর্মের অন্যান্য দেব- দেবীদের বিষয়ে এমন সুন্দর লেখা পাব আশা রাখি।
অজস্র শুভেচ্ছা রইলো। আগামী দিনে নিশ্চয়ই লিখবো।
অসাধারণ পরিবেশনা…
হার্দিক শুভেচ্ছা রইলো। অনেক বড়ো হও।
just incredible and very informative.. and useful for all
waiting for more writings in this field in nearterm future.
thanks ..
তোমার মন্তব্য পেয়ে খুব ভালো লাগলো তুহিদা। ভালো থেকো।
এককথায় অনবদ্য। অনেক অনেক সমৃদ্ধ হলাম। আগামীতে এই ধরনের আরও অজানা তথ্য বহুল লেখার অপেক্ষায় থাকলাম। আগামীর জন্য অনেক অনেক শুভেচ্ছা ও ভালোবাসা রইল।
তোমার বক্তব্যে আমিও সমৃদ্ধ হলাম দিদি। শুভেচ্ছা নিও।
বুদ্ধের সাথে সপ্তমুখী নাগরাজ মুচলিন্দকে দেখে পঞ্চমুখীনাগের ছত্রছায়ায় শ্রীকৃষ্ণের কথা মনে আসে যা এক সনাতন সংস্কৃতি ও বৌদ্ধ সংস্কৃতির মিলবন্ধন। এই ধরনের অপরূপ ধর্মসংস্কৃতি ও শিল্পকলার কারুকার্য সম্পন্ন মূর্তি দেখে প্রথমেই যে কৌতূহল হয়েছিল তা লেখার মাধ্যমে যেভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে তা অনবদ্য। জীবজন্তু, পশুপাখি, কীটপতঙ্গ, সরীসৃপ ইত্যাদি নিয়ে আমাদের এক বৃহৎ পরিবার অর্থাৎ বসুধৈব কুটুম্বকম্।
এই লেখাটি সুন্দরভাবে পরিবেশন করার জন্য অনেক ধন্যবাদ।
অসংখ্য ধন্যবাদ সপ্তম। শুভেচ্ছা রইলো।
অসাধারণ বর্ণনা স্যার, এই বিষয়ে আগে কোনোদিন পড়িনি, আপনার থেকে অনেক কিছু প্রবন্ধ আরও পড়ার ইচ্ছে রইল।
অজস্র ধন্যবাদ আশুতোষ।
অপূর্ব বর্ণনা স্যার। অনেক অজানা তথ্য জানতে পারলাম। এমন তথ্যবহুল লেখা আমরা আরও পড়তে চাই💐💐💐 ।
তোমার মন্তব্য খুব ভালো লাগলো। স্নেহাশিস নিও।
খুব ভালো লাগলো।
অজস্র ধন্যবাদ বন্ধু।
শ্রম যত্ন ও বর্ণনার সারল্য ‘বুদ্ধ ও নাগরাজ মুচলিন্দ : সাহিত্যে ও শিল্পে’ সৃজনে বড় ভূমিকা পালন করেছে যেমন, বিশ্লেষণী মেধার বিচ্ছুরণে পাঠককে সম্মোহিত করে ধরে রাখার ক্ষেত্রেও সফল এই আয়োজন। কুণ্ঠার বালাই না-করে সোজাসুজি বলি : ইতিহাসের পাতিহাসও নই আমি, সেই মানুষও যখন শুধুমাত্র তোমার নামের টানে এই অনবদ্য নির্মাণের সম্মোহনী যাদুশক্তিতে আচ্ছন্ন হয়ে যাই, আর কিছু কী বলার থাকে!
সর্প ও নাগের মধ্যে সূক্ষ্ম প্রভেদ আভাসিত শ্রীমদ্ভাগবতগীতায়, এ কিন্তু পশ্চিমে ঢলে পড়া বয়সে এই অজ্ঞের এক পরম প্রাপ্তি।
স্পষ্ট চিত্রাবলী লেখাটির আর-এক গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ, বোধ হয়, সন্দেহ নেই।
কাহিনি ও শিল্পীর কল্পনাপ্রসূত শিল্পের সংশ্লেষে বিম্বিত শিল্পে শুভ-অশুভের দ্বন্দ্বে অশুভের নাশ ও শুভশক্তির বিজয় ঘোষণার মধ্যে শাশ্বত সত্যের আবহমানতারই দৃপ্ত ঘোষণা।
কুণালকান্তি সিংহরায়ের ‘বুদ্ধ ও নাগরাজ মুচলিন্দ : সাহিত্যে ও শিল্পে’, বলতেই পারি, এক সুখপাঠ।
আপনার প্রতিটি শব্দই আমার কাছে মূল্যবান। খুব ভালো লাগল দাদা। হার্দিক শুভেচ্ছা রইলো।
খুবই প্রয়োজনীয় তথ্য, অপূর্ব বর্ণনা স্যার।