ভারতের প্রথম মনঃসমীক্ষক ও তাঁর মৌলিকত্ব
সুরসিক সাহিত্যিক, সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিত, অনুবাদক, বৈয়াকরণ রাজশেখর বসুর নাম আমরা শিক্ষিত বাঙালি মাত্রেই জানি। তাঁরই কনিষ্ঠতম সহোদর ভারতের প্রথম মনঃসমীক্ষক গিরীন্দ্রশেখর বসুর ক্ষেত্রে তা বলা যাবে না। গিরীন্দ্রশেখরও সংস্কৃত ভাষায় সুপণ্ডিত ছিলেন। সাহিত্যকর্ম হিসেবে ছোটোদের জন্য লেখা তাঁর ‘লালকালো’ বইটিও কম উল্লেখযোগ্য নয়। কিন্তু তাঁর যে প্রধান কর্মক্ষেত্র ও গবেষণার বিষয় সেই মনঃসমীক্ষণ কখনই এদেশে খুব বেশি জনপ্রিয়তা পায়নি। সিগমুন্ড ফ্রয়েডের তত্ত্ব নিয়ে ইউরোপে যত হৈ চৈ হয়েছে, তার পরিবর্তিত ও পরিবর্ধিত রূপ নিয়ে বিদ্যাজগতের লোক এবং নারীবাদীরা যত আলোচনা করেছেন, আমাদের দেশে নানা কারণে ততটা গুরুত্ব পায়নি এই তত্ত্ব। কিন্তু গিরীন্দ্রশেখর এদেশে ফ্রয়েডের তত্ত্বকে সরাসরি প্রয়োগ করার চেষ্টা করেননি। তিনি মনঃসমীক্ষাকে গুরুত্ব দিলেও দেশজ পরিপ্রেক্ষিতটিকে মাথায় রেখে তার এক স্বাধীন, স্বতন্ত্র রূপ গড়ে তুলতে সচেষ্ট হয়েছিলেন। সেটাই সবচেয়ে আগ্রহোদ্দীপক।
গিরীন্দ্রশেখরের জন্ম ১৮৮৭ সালে। ১৯১০ সালে কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ থেকে স্নাতক হবার পর তিনি প্র্যাকটিস শুরু করেন। ম্যাজিক এবং সম্মোহনে তাঁর খুব আগ্রহ ছিল এবং এ ব্যাপারে ব্যুৎপত্তি অর্জন করেছিলেন। ১৯১৫ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় মনোবিদ্যা বিভাগ খোলার পর গিরীন্দ্রশেখর সেখানে ভর্তি হন এবং ১৯১৭ সালে মাস্টার ডিগ্রী লাভ করেন। মনোবিদ্যায় গিরীন্দ্রের আগ্রহ কিন্তু তার আগে থেকেই এবং ১৯১৪ সালেই তিনি মনঃসমীক্ষণ সম্পর্কে তাঁর ধারণা নিজস্ব ঘরানা গড়ে তুলেছেন। ইংরেজি ভাষায় ফ্রয়েডের লেখা ততদিনে অনূদিত হতে শুরু হয়েছে। ১৯২১ সালে গিরীন্দ্র তাঁর গবেষণাপত্র ‘Concept of Repression’ প্রকাশিত হবার পর ফ্রয়েডকে একটা কপি পাঠিয়েছিলেন। ফ্রয়েড খুশি হয়ে উত্তর দিয়েছিলেন। তারপর থেকে ১৯৩৭ সাল পর্যন্ত প্রায় ষোল বছর ধরে দুজনের পত্রালাপ চলতে থাকে, যদিও তাঁদের পারস্পরিক সাক্ষাৎ, ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও সম্ভব হয়ে ওঠেনি। ১৯২২ সালে কলকাতায় নিজের বাড়িতে গিরীন্দ্র ‘Indian Psychoanalytic Society’ প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৫৩ সাল পর্যন্ত অর্থাৎ আমৃত্যু তিনি এর সভাপতি ছিলেন। ১৯৪৭ সাল থেকে এই সংস্থাই প্রকাশ করতে থাকে তাদের পত্রিকা ‘সমীক্ষা’। রীতিমত উঁচুমানের এই পত্রিকায় দেশ বিদেশের নামকরা মনঃসমীক্ষকরা লিখতেন।
সিগমুন্ড ফ্রয়েড
গিরীন্দ্র কিন্তু ফ্রয়েডকে চিঠিতে জানিয়েছিলেন যে তাঁর তত্ত্বের মূল কিছু প্রতিপাদ্য ইউরোপে প্রাসঙ্গিক হতে পারে কিন্তু ভারতবর্ষের ক্ষেত্রে তা নয় – যেমন কর্তন গূঢ়ৈষা (Castration Complex)। কেন তিনি একথা বলছেন তার যুক্তিও তিনি দিয়েছেন। ফ্রয়েড স্বভাবতই একমত হতে পারেননি। তিনি তো চান যে তাঁর তত্ত্ব সর্বজনীন (Universal) মান্যতা পাক, দেশ ও সংস্কৃতি নিরপেক্ষভাবে। গিরীন্দ্র তাঁর গবেষণাপত্রে বরং সেটিকে প্রতিস্থাপন করতে চান ‘বিপরীত ইচ্ছার তত্ত্ব’ দিয়ে। এই তত্ত্ব অনুসারে কোনো ইচ্ছাই তার বিপরীত ইচ্ছা ছাড়া থাকতে পারে না এবং তা মনের মধ্যে (নির্জ্ঞান স্তরে) থাকে। ভালোবাসার ইচ্ছার সঙ্গে থাকে ভালোবাসা পাওয়ার ইচ্ছা, ঘৃণা করার ইচ্ছার সঙ্গে থাকে ঘৃণিত হওয়ার ইচ্ছা। একইভাবে প্রদর্শনকাম অবস্থান করে দর্শকামের সঙ্গে ইত্যাদি। ব্যক্তির ক্ষেত্রে সব ইচ্ছা বা বাসনাই আনন্দদায়ক। নিরানন্দ বা দুঃখ তৈরি হয় বিপরীত ইচ্ছার সঙ্গে সংঘাতে। মন এই সমস্যার সমাধান করে দুইয়ের মধ্যে দোলাচলে, আপোষ মীমাংসার দ্বারা, প্রায়ক্ষেত্রে একটি ইচ্ছার পূরণ করে। কিন্তু অবদমিত ইচ্ছা তার প্রভাব নিয়ে থেকে যায়। কর্তন গূঢ়ৈষার বদলে গিরীন্দ্র বালকের নির্জ্ঞানে নারী হয়ে ওঠার ইচ্ছা দেখেন। মাতৃচ্ছায়া থেকে বেরিয়ে আসার অনিচ্ছা (গিরীন্দ্রের মতে যেটা এই উপমহাদেশের পুরুষদের ক্ষেত্রে ভীষণভাবে দেখা যায়) তারই প্রভাব এটা। ফ্রয়েডের লিঙ্গকেন্দ্রিক (Phallocentric) মতবাদ থেকে গিরীন্দ্র এভাবেই স্বাধীন দূরত্ব রচনা করেন। নারী হয়ে ওঠার বাসনা আমাদের ধর্মে, সংস্কৃতিতে, জীবনাদর্শে, শিল্পে, সাহিত্যে তো বটেই ধর্মগুরু বা মহাপুরুষদের যাপনচিত্র থেকেও ভুরি ভুরি উদাহরণ টেনে দেখানো যায়। গান্ধী, রবীন্দ্রনাথ এবং রামকৃষ্ণদেবের উদাহরণ তো আছেই। এখান থেকে লিঙ্গনির্মাণের (Gender Construction) ভারতীয় ঘরানা সম্পর্কে কোনো তত্ত্বায়ন সম্ভব কিনা ভাবা যেতে পারে। যদিও লিঙ্গ সচলতা (Gender fluidity) মানেই যে পিতৃতান্ত্রিক ধারণা থেকে মুক্তি তা নয়, বরং অনেক ক্ষেত্রেই উল্টোটা, তা উপরোক্ত মনীষীদের জীবনাদর্শ থেকেই অনেক সময় বোঝা যাবে বলে আমার ধারণা।
গিরীন্দ্রশেখর বাংলায় অনেক লেখালিখি করেছেন যদিও তার অধিকাংশই এখন দুষ্প্রাপ্য। মনোবিজ্ঞানের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে তিনি ধর্মকে দেখেছিলেন। তিনি চেয়েছিলেন ধর্মের অতীন্দ্রিয় (অলৌকিক নয়) বোধের সঙ্গে বিজ্ঞানের একটা যোগসূত্র গড়ে তুলতে। এই লক্ষ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ লেখা হল তাঁর ‘সত্ত্ব, রজঃ, তমঃ’। গিরীন্দ্রের মতে গুণ প্রধানত দুই প্রকার – (১) গুণ যা জ্ঞান এবং প্রকাশকে নিয়ন্ত্রণ করে, (২) গুণ যা অজ্ঞান এবং অপ্রকাশকে নিয়ন্ত্রণ করে। শেষেরটিকে তিনি বলেন ‘তমঃ’। আর প্রথমটিকে দুইভাগে ভাগ করেন — (ক) অন্তর্মুখী বা সত্ত্ব (খ) বহির্মুখী (রজঃ)। অজ্ঞান আর অপ্রকাশ মিলিয়ে যে ‘তমঃ’ তাকে গিরীন্দ্র নিকৃষ্ট ব্যক্তিত্বের পরিচায়ক বলেছেন। উৎকর্ষের নিরিখে গিরীন্দ্রের বিচারে রজঃর ওপরে সত্ত্বের স্থান। গিরীন্দ্রের মতে আত্মন (self) সম্পর্কিত জ্ঞানের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ প্রকৃতির সঙ্গে আত্মনের সম্পর্ক বিষয়ক জ্ঞান। এইভাবেই মানুষের প্রকৃত আত্মজ্ঞান জন্মায়, চেতনার মুক্তি ঘটে। তবে এই আত্মজ্ঞান লাভের জন্য বহিরিন্দ্রিয় নির্ভরতা থেকে অন্তর্মুখীনতা প্রয়োজন। মনোবিদ্যা তাঁর মতে বিজ্ঞানের মর্যাদাকে দৃষ্টবাদী (Positivist) অবস্থান থেকে চেতনার বিজ্ঞানে উন্নীত করে। আত্মজ্ঞান লাভ মানেই গিরীন্দ্রের মতে ব্রহ্মজ্ঞানলাভ। তাই শাস্ত্রকার বলেন ‘আত্মানং বিদ্ধি’। জ্ঞানকেও গিরীন্দ্র দুইভাগে ভাগ করেন — বস্তুজগতের জ্ঞান বা বহির্মুখী জ্ঞান আর অন্যদিকে শুদ্ধ অভিজ্ঞতা বা চেতনার জ্ঞান তথা অন্তর্মুখ জ্ঞান। এই শুদ্ধ জ্ঞানে বহুত্ব নেই, তা পরম। অর্থাৎ মনোবিদ্যায় দেহ ও মনের যে দ্বৈততা তা কোনো এক স্তরে অদ্বৈততায় উত্তীর্ণ হয়। তবে তার জন্য গুণের ক্রমোত্তরণ এবং অন্তর্মুখীনতার মাধ্যমে নিজেকে প্রস্তুত করতে হবে। গিরীন্দ্র বিশ্বাস করেন মনোবিদ্যা নতুন যুগের ধর্ম হয়ে উঠতে পারবে। অজ্ঞান বা নির্জ্ঞান সম্পর্কিত জ্ঞানের মাধ্যমে কুসংস্কার, ছদ্ম আধ্যাত্মিকতা এবং ‘তমঃ’ কে চিনতে শিখবে মানুষ। হ্যাঁ, মনে হতেই পারে গিরীন্দ্র সনাতন ধর্মের বেশ কিছু ধারণার আশ্রয় নিয়েছেন। কিন্তু, এটা ঠিক যে তার সঙ্গে প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম বা অলৌকিকতার কোনো যোগ নেই। ধর্মকে যিনি কাল্পনিক আখ্যান মনে করেন, সেই ইউভাল নোয়াহ হারারি যেমন নিয়ম করে প্রতিবছর বিপাসনা ধ্যান করতে যান মানসিক শান্তির জন্য সেরকমই যেন গিরীন্দ্রশেখর মনোবিজ্ঞানীর মন নিয়ে ধর্মের দ্বারস্থ হন আত্মিক প্রয়োজনে। হারারি যেমন স্বীকার করেন আমাদের বহির্জগতের জ্ঞান যতটা এগিয়েছে, মন সম্পর্কিত জ্ঞানে আমরা তার কণামাত্র এগোতে পারিনি। গিরীন্দ্রশেখর বসুর চিন্তনপদ্ধতি আমাদের সে ব্যাপারে কিছু সাহায্য করতে পারবে কি?
তথ্যসূত্রঃ
(১)Ashis Nandy, The Savage Freud and other essyas on possible and retrievable selves, OUP
(২)Salman Akhtar, Freud along the Ganges : Psychoanalytic Reflections on the People and Culture edited, Other press.
লেখাটি বেশ সুন্দর হয়েছে। তবে বানানগত কয়েকটি ত্রুটি চোখে পড়লো, যেমন-‘দর্শকাম’। লেখাটা লিখতে গিয়ে নিশ্চয়ই আপনি বইগুলো পড়েছেন, অথচ আমি বহু খুঁজেও ‘স্বপ্ন’ ছাড়া আর কিছুই পাইনি। পিডিএফ থাকলে যদি এই মেইল আইডিতে পাঠান, উপকৃত হবো। লেখা চলুক। ধন্যবাদ নেবেন।
আমি voyerism এর বাংলা হিসেবে দর্শকাম লিখেছি। ভুল তো কোথাও চোখে পড়ল না। বইয়ের কোনো সফট কপি আমার কাছে আপাতত নেই। তবে অনুষ্টুপ থেকে প্রকাশিত ডঃ অমিতরঞ্জন বসু সম্পাদিত ‘ অগ্রন্থিত গিরীন্দ্রশেখর ‘দেখতে পারেন।
ভালো লেখা। গিরীন্দ্রশেখর তো টাওয়ার পারসোনালিটি ছিলেন। তাঁকে নিয়ে চর্চা হওয়া উচিত। লেখাট পড় সমৃদ্ধ হলাম।
অনেক ধন্যবাদ। আপনার মন্তব্য উৎসাহিত করল।
Ref এই বিষয়ে আলোকপাত করা হয়েছে ইতিপূর্বে বিজ্ঞান ও বিজ্ঞানকরমী কাগজে। বছর দুই আগে কোন সংখ্যা হবে। লেখকের নাম উল্লেখ করতে না পারায় আমি দুঃখিত। বিশদে আলোচনা করা হয়েছে।