ভারতের ভূ-মানচিত্রের জনক শিবপ্রসাদ চ্যাটার্জি
সুপ্রিম কোর্টের প্রাক্তন বিচারপতি উমেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় একটি স্মৃতিচারণায় বলেছেন, লন্ডন থেকে কলকাতায় ফিরছেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক অধ্যাপক। বিমানে ওঠার আগেই কি মনে হল, তিনি ফোন করলেন কলকাতায় এক ছাত্রকে। ফোনে বললেন, বিমানবন্দরে পৌঁছেই তাঁদের সঙ্গে দেখা করতে চান। সেই বিমান পৌঁছনোর সময় বুঝে জনাকয়েক ছাত্র হাজির হলেন। ১৯৬৪ সালের জুলাই–আগস্ট মাসের কথা। কলকাতায় সেদিন ভ্যাপসা গরম। বিমান আসতে দেরি হল পাক্কা দুই ঘন্টা। প্রবীণ অধ্যাপক এলেন বিমানের ঠাণ্ডা আবহাওয়ায়, এলেন গুমোট কলকাতায়। জেনে নিলেন, ছাত্ররা এখনও বিশ্ববিদ্যালয়ে আছে। সোজা গেলেন বিশ্ববিদ্যালয়ে। বিশ্রামের নামগন্ধও নিলেন না। ছাত্রদের শোনালেন লন্ডনে ২১ থেকে ২৯ জুলাই পর্যন্ত অনুষ্ঠিত ইন্টারন্যাশনাল জিওগ্রাফিকাল ইউনিয়নের (আইজিইউ) দ্বাদশ সম্মেলনের নানা অভিজ্ঞতা।
এই সম্মেলন থেকে তিনি নিয়ে এসেছেন নানা মূল্যবান গবেষণাপত্র, অনেক অনেক মূল্যবান দলিল। সেই বছর থেকে পরের চার বছরের জন্য তিনি এই সংগঠন ‘আইজিইউ’-র বিশ্ব প্রেসিডেন্ট হয়েছেন। সেই সুবাদে এমন সব গুরুত্বপূর্ণ নথি তিনি এবার সহজেই পাবেন। সেই সব দলিল, নথি, গবেষণাপত্র যদি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা হাতে পায়, তাঁরা অনেকটা এগিয়ে যাবে, পূর্ণ হবে দেশের মেধাসম্পদের ভাণ্ডার, এটাই তার আশা। তিনি গল্প করে সেখানকার অভিজ্ঞতার কথা বলে যাচ্ছেন, আর ছাত্ররা মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনছেন অধ্যাপকের কথা। এভাবেই কখন পার হয়ে গিয়েছে তিন-তিনটি ঘন্টা।
ইনি ছাত্রদের প্রিয় অধ্যাপক ‘এসপিসি স্যর’, মানে ডঃ শিবপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়। আজকের অনেক ছাত্রও স্কুলে হয়তো তার লেখা ভূগোল বই পড়েছেন। সারা জীবন পড়িয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের, আস অবসরের পর তিনি স্কুলে যাতে সঠিকভাবে ভূগোল পড়ানো হয়, তার জন্য স্কুল ছাত্রদের উপযোগী বই লিখেছেন। এসপিসি স্যরকে ‘ভারতের ভূ-মানচিত্রের জনক’ বলে মানেন ভূগোলবিদরা।
এখন ভারতের সঠিক মানচিত্রের জন্য আমরা তাকিয়ে থাকি ‘ন্যাশনাল অ্যাটলাস অ্যান্ড থিমেটিক ম্যাপিং’ (ন্যাটমো)-র দিকে, শুরুতে যার নাম ছিল ‘ন্যাশনাল অ্যাটলাস অর্গানাইজেশন’। এই সংগঠনটির প্রতিষ্ঠাতা অধিকর্তা ছিলেন শিবপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়। তিনি তখন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। ধর্মের ভিত্তিতে বাঙলা ভাগের জন্য দরকার ছিল একটি মানচিত্র, যেটি বলে দেবে কোন এলাকায় কোন ধর্মের মানুষ বেশি বাস করেন। কে করবে সেই কাজ? কার আছে সেই দক্ষতা, যিনি অল্প সময়ে করতে পারবেন? দায়িত্ব এসেছিল শিবপ্রসাদ বাবুর উপরেই। সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার মানচিত্র আর নিজস্ব ফিল্ড স্টাডির ভিত্তিতে তৈরি করেছিলেন সেই মানচিত্র, পরে যেটি প্রকাশিত হয় ‘দ্য পার্টিশন অফ বেঙ্গলঃ এ জিওগ্রাফিকাল স্টাডি’ নামে। বলা বাহুল্য, ব্রিটিশ সরকার সেই মানচিত্র পুরোপুরি না মেনে বশংবদ রাজনৈতিক নেতাদের অনেক আর্জিকে গুরুত্ব দেয়, যার ফল আজও ভুগতে হচ্ছে দুই দেশের মানুষকে।
শিবপ্রসাদ বাবুর জন্ম ১৯০৩ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি। কলকাতায়। প্রয়াত হয়েছেন ৮৬ বছর ৫ দিন কাটিয়ে ১৯৮৯-এর ২৭ ফেব্রুয়ারি। এটা তার জীবনের দুটি উল্লেখযোগ্য তারিখ মাত্র। যেমন, তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ছিলেন, ১৯৬৪ থেকে ১৯৬৮ সাল পর্যন্ত আইজিইউ-র প্রেসিডেন্ট ছিলেন। ১৯৪৮ এ ওয়াশিংটনে আয়োজিত আইজিইউ-র কংগ্রেসে তিনি প্রতিনিধি ছিলেন, ১৯৬০-এর স্টকহোম কংগ্রেসে থেকে ভাইস প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন, পরের চার বছর প্রেসিডেন্ট। মৃত্যুর বছর চারেক আগে ভারত সরকার তাঁকে ‘পদ্মভূষণ’ সম্মানে ভূষিত করেছিল। এ সবই কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য। কিন্তু এই তথ্য দিয়ে এই মানুষটার অবদানকে পরিমাপ করা যাবে না।
তার সম্পর্কে আরেকটি খুব গুরুত্বপূর্ণ তথ্য হল, মাত্র কয়েকজন অস্থায়ী কর্মীর সহায়তায় কয়েক বছরের মধ্যে অবিশ্বাস্য দ্রুততায় ভারতের প্রথম ন্যাশনাল অ্যাটলাস তৈরি করে তিনি ১৯৫৯ সালে বিশ্বে ভূবিদ্যার জন্য প্রদত্ত শ্রেষ্ঠ সম্মান ‘মার্চিসন অ্যাওয়ার্ড’ জয় করেছিলেন। এই সম্মানটি দেয় ব্রিটেনের রয়্যাল জিওগ্রাফিকাল সোসাইটি। এখনও পর্যন্ত তিনিই একমাত্র ভারতীয় যিনি এই দুর্লভ সম্মান পেয়েছেন। এই অ্যাওয়ার্ড প্রাপকের তালিকায় অবশ্য ‘ইন্ডিয়া’ শব্দটা আরেকবার আছে। তবে সেটি ১৮৯৩ সালে, পেয়েছিলেন আর ডব্লিউ সিনিয়ার নামে ইন্ডিয়ান সার্ভে-র (এখন সার্ভে অফ ইন্ডিয়া) এক ব্রিটিশ অফিসার, যিনি কুলু ও লাহুল এলাকার জরিপ করেছিলেন।
শিবপ্রসাদ চ্যাটার্জি ১৯২৬ সালে বেনারস ইউনিভার্সিটি থেকে জিওলজি-তে মাস্টার ডিগ্রি লাভ করার পর অধ্যাপনায় আসেন, যোগ দেন রেঙ্গুন ইউনিভার্সিটিতে। সেখানে জিওলজি (ভূতত্ত্ব) ও জিওগ্রাফি (ভূগোল) বিভাগের প্রধান ছিলেন ১৯২৬ থেকে ১৯২৮ পর্যন্ত। এরপর চাকরি ছেড়ে দিয়ে উচ্চশিক্ষার জন্য ফ্রান্সে যান। সরবোনের ‘ইউনিভার্সিটি দে প্যারিস’ থেকে ডিলিট করেন বিখ্যাত ফরাসি ভূগোলবিদ ইমানুয়েল মর্তোনে এবং পল ভিদাল দে লা ব্লাচ-এর অধীনে। ভিদাল ভূগোলের নামী অধ্যাপক, আর মর্তোনে-কে বলা হয় ‘ফাদার অফ জিও-মরফোলজি’।
এঁদের অধীনে শিবপ্রসাদ যে কাজটি করলেন, সেটি আসামের দুটি জেলায় গারো, খাসি ও জয়ন্তিয়া পাহাড়ের উপত্যকার ভূবিদ্যা নিয়ে। তখনই তিনি মেঘপুঞ্জের পাহাড়ি এলাকাটিকে ভালবেসে নেম দিয়েছিলেন – মেঘালয়। এই নামে কোনও রাজ্য তখন নেই, এলাকাটি তখন আসামের অধীনে। অথচ, তাঁর ডিলিট-এর পেপারটির শিরোনাম রেখেছিলেন ‘রিসার্চ অন লা প্লেটো দে মেঘালয়’, যেটি মোনোগ্রাফ হিসাবে প্রকাশিত হয় ১৯৩৬-এ। তার ৩৪ বছর পরে, ১৯৭০ সালে জন্ম হয় স্বশাসিত মেঘালয়ের এবং পূর্ণ রাজ্যের মর্যাদা পায় ১৯৭১-এ। ভারত সরকার তখন ডঃ এস. পি. চ্যাটার্জির রাখা নাম মেঘালয়-কেই বেছে নিয়েছে।
প্যারিসের শিক্ষা সমাপনে উনি যান লন্ডনে। লন্ডন ইউনিভার্সিটি থেকে টিচার্স ডিপ্লোমা লাভের পর ব্রিটেন ও ফ্রান্সের তুলনামূলক শিক্ষা ব্যবস্থার উপর গবেষণা করে লন্ডন ইউনিভার্সিটি থেকে পিএইচডি পেয়ে হলেন ডঃ শিবপ্রসাদ চট্যার্জি। যোগ দিলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল বিভাগে। ততদিনে বুঝেছেন, ছাত্রদের সঠিকভাবে ভুগোল পড়ানো কত জরুরি। কিন্তু তার জন্য দরকার ঠিকভাবে ভূগোল পড়ানোর কৌশল। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে সেই শিক্ষণের ব্যবস্থাই নেই। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভূগোল বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যাপক চ্যাটার্জি তখন বিভাগীয় প্রধান। ১৯৩৯-এ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভূগোল অনার্সে টিচার্স ট্রেনিং চালু করলেন। দু বছর পর তাঁর উদ্যোগে মাস্টার্স কোর্সও এল শিক্ষক শিক্ষণ।
১৯৬৭-তে তাঁর অবসরের দিন পর্যন্ত তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়িয়েছেন। অবসরের পরেও বিশ্ববিদ্যালয় আমৃত্যু তাঁকে ‘এমিরিটাস প্রফেসর’ রেখেছিল। এছাড়াও তিনি সোভিয়েত ইউনিয়নের মস্কো ইউনিভার্সিটি, ফ্রান্সে সারবোন ইউনিভার্সিটি, আমেরিকায় জর্জিয়া ইউনিভার্সিটি, ক্যালিফোর্নিয়া স্টেট ইউনিভার্সিটি এবং অস্টিন ইউনিভার্সিটিতে গত শতকের ছয়ের ও সাতের দশকে ভিজিটিং প্রফেসর থেকেছেন।
শিবপ্রসাদ বাবু অনুভব করেন, দেশের ভূতত্ত্ব নিয়ে গভীর অনুসন্ধানের জন্য ভারতের একটি ভূতাত্ত্বিক সংস্থা থাকা দরকার। তিনি যোগ দেন ১৯৩৩-তে গঠিত হয়েছিল ক্যালকাটা জিওগ্রাফিকাল সোসাইটিতে, যার প্রথম সভাপতি ছিলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট সদস্য বি এম মজুমদার। এই সংস্থারই উদ্যোগে ১৯৩৬-এ তৈরি হয় ‘জিওলজিকাল সোসাইটি অফ ইন্ডিয়া’। ১৯৪৭-৪৮ পর্যন্ত মূলত ব্রিটিশরা বা তাঁদের মনোনীত জিওলজিকাল সার্ভের কর্তারা এর প্রেসিডেন্ট হতেন। স্বাধীনতার পর ১৯৪৮-এ প্রেসিডেন্ট হন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পি. এন. ব্যানার্জি। তাঁর হাত থেকে ১৯৫১-তে দায়িত্ব নেন এস পি চ্যাটার্জি। টানা ২০ বছর এই পদে তিনি ছিলেন। এত দীর্ঘদিন আর কেউ এই পদে থাকেননি। তারপরেই রয়েছেন অধ্যাপক সুনীল মুন্সী, ১৮ বছর।
ডঃ চ্যাটার্জির অসাধারণ কাজগুলির একটি হল বেঙ্গল ইন ম্যাপস। দেশভাগ হওয়ার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই এই মানচিত্র প্রকাশিত হয়। দেশ ভাগ হওয়ার আগেই ‘দ্য পার্টিশন অফ বেঙ্গলঃ এ জিওগ্রাফিকাল স্টাডি’-র কাজ করতে করতে তিনি বিভাজন-পরবর্তী বাঙলার একটা মানচিত্র তৈরির গুরুত্ব অনুধাবন করেন। সেই অনুযায়ী কাজ শেষও করে ফেলেছিলেন। ইতিমধ্যে দেশভাগ হয়। কিন্তু তাঁর মানচিত্র তো পুরোপুরি মানা হয়নি, নানা রাজনৈতিক নেতার নানা আবদার পূরণে। ফলে, তিনি মানচিত্র ছাপার কাজ থামিয়ে নতুন পরিবর্তনগুলি সেখানে যুক্ত করেন। যে যে গ্রামের উপর দিয়ে দেশভাগ হচ্ছে, সেগুলিকে চিহ্নিত করেন। কাজটা অত্যন্ত জটিল ও কঠিন হলেও অবিশ্বাস্য দ্রুততার সঙ্গেই তিনি সেই কাজ করে ফেলেন। যার ফলে দেশভাগের প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই পশ্চিমবাংলার মানচিত্র প্রকাশিত হয়। গোটা হাওড়া জেলার জমি ব্যবহারের মানচিত্র তিনিই প্রথম তৈরি করেছিলেন, সেই ১৯৫০ সালেই।
বাংলার মানচিত্র তৈরির পর তিনি অনুভব করলেন, ভারতের একটি সার্বিক মানচিত্র থাকা জরুরি। কেবল ভূ-প্রকৃতিগত মানচিত্রই নয়, তার শহর, নগর, গ্রাম, তার রাস্তাঘাট, খনি ও প্রাকৃতিক সম্পদের কেন্দ্র, বনভূমি, জলাশয়, বৃষ্টিপাতের আধিক্য ও খরা অঞ্চল – যাবতীয় বিষয়ের বিস্তৃত মানচিত্র শিক্ষা ও প্রশাসনের খুব প্রয়োজন। ১৯৫৩ সালে পণ্ডিত জওহরলাল নেহরুর সঙ্গে এক আলোচনায় তিনি সেই প্রস্তাব দিলেন। তৎক্ষণাৎ নেহরু সেই প্রস্তাব মঞ্জুর করে ‘মিনিস্ট্রি অফ ন্যাচারাল রিসোর্স অ্যান্ড সায়েন্টিফিক রিসার্চ’-এর কাছে পাঠান। মন্ত্রকের নামটি লক্ষ্য করুন। অন্যান্য মন্ত্রকের সঙ্গে কথা বলে ১৯৫৪ সালে এই কাজের জন্য একটি বোর্ড গঠিত হয়। বোর্ড সেই প্রস্তাব অনুমোদনের সময় কিছু নীতি-নির্দেশিকা ও কি কি তাতে থাকা উচিত, তার সুপারিশ করে। এরপর ১৯৫৪-র এপ্রিলে মাত্র ৭ জন অস্থায়ী কর্মী দিয়ে অধ্যাপক শিবপ্রসাদ চ্যাটার্জিকেই তার সাম্মানিক ডিরেক্টর নিয়োগ করে। কাজের প্রয়োজনে আরও ৫৬ জন অস্থায়ী কর্মীনিয়োগের ব্যবস্থা তাতে থাকে। এই অস্থায়ী কর্মীদের নিয়েই কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেনেট হাউসের ঠিকানায় গড়ে ওঠে ‘ন্যাশনাল অ্যাটলাস অর্গানাইজেশন’ (এনএও), ১৯৭৮ থেকে যার নাম ‘ন্যাশনাল অ্যাটলাস অ্যান্ড থিমেটিক ম্যাপিং অর্গানাইজেশন’ বা ন্যাটমো।
তার কাজে তৎপরতার প্রমাণ, ১৯৫৪ সালে কয়েকজন অস্থায়ী কর্মী নিয়ে গঠিত সংস্থার কর্মীদের উদ্বুদ্ধ করে ১৯৫৭ সালে তিনি ভারতের প্রথম পূর্ণাঙ্গ মানচিত্র বা ‘ন্যাশনাল অ্যাটলাস’ প্রকাশ করেন। এই কাজ যে কতটা দুরূহ, ভূগোলে সামান্য আগ্রহ রাখা ব্যক্তিরাই বুঝবেন। কাজের প্রতি আগ্রহ, নিষ্ঠা, একাগ্রতা ও নেতৃত্ব দেওয়ার যোগ্যতার বিচারেই ১৯৫৯-এ তাঁকে মার্চিসন অ্যাওয়ার্ড ও গ্রান্ট দেয় রয়্যাল জিওগ্রাফিকাল সোসাইটি। এখন যারা হিমালয়ের পাহাড়গুলির অবস্থানের মানচিত্রের জন্য ‘নিউ এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা’ ঘাঁটেন, তাঁরা জানতেও পারেন না, সেই মহাগ্রন্থে এই গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়টি অধ্যাপক শিবপ্রসাদ চ্যাটার্জিরই অবদান। ‘ম্যাপ অফ বেঙ্গল’ দিয়ে যার শুরু, সেই অধ্যাপক চ্যাটার্জির সর্বশেষ অবদান ‘ইকনমিক জিওগ্রাফি অফ এশিয়া’। অদম্য মানসিক শক্তি আর একাগ্র নিষ্ঠার অমলিন প্রতিমূর্তি ছিলেন তিনি।
সুপ্রিম কোর্টের প্রাক্তন বিচারপতি উমেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর জামাই। স্মৃতিচারণে তিনি বলেছেন, “বাড়িতে ধুতি আর ফতুয়া ছিল তার পোশাক। যখন কাজ করতেন, অন্য কোনওদিকে নজর থাকতো না।” একবার বিচারপতি উমেশচন্দ্র গিয়েছেন অধ্যাপক চ্যাটার্জির বাড়িতে। দেখছেন, একমনে লিখছেন তিনি। গরমে পিঠ বেয়ে ঘাম ঝরছে অথচ, মাথার পরে পাখাটি বন্ধ। খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে উমেশবাবু দেখলেন, জামাইকে খেয়াল করেননি শ্বশুরমশাই, লিখেই চলেছেন। তাঁকে বিরক্ত না করে ভিতরে চলে গেলেন বিচারপতি। পরে ঘর থেকে জামাইয়ের কণ্ঠস্বর শুনে বললেন, “কখন এলে? আমাকে কেউ জানালো না কেন?” উমেশবাবু জিজ্ঞাসা করলেন, পাখা না চালিয়ে কেন লিখছিলেন, এত গরমে, ঘামতে ঘামতে? অধ্যাপক চ্যাটার্জির জবাব ছিল, পাখার হাওয়া আরাম এনে দেয়, কাজের স্পৃহা কমিয়ে দেয়।
ভীষণই ছাত্রদরদী ছিলেন, সেটা প্রথমোক্ত ঘটনা থেকেই বোঝা যায়। তার আরেক ছাত্র একটি কথা বলেছিলেন। আর্থিক সমস্যায় ছাত্রটির লেখাপড়া বন্ধ হতে বসেছিল। কয়েকদিন বিশ্ববিদ্যালয়ে যাননি। এরপর যেতেই অধ্যাপক চ্যাটার্জির জেরায় ছাত্রটি মনকষ্টের কথা জানায়। শিবপ্রসাদ বাবু চলে যান উপাচার্যের সঙ্গে কথা বলে ছেলেটির জন্য স্কলারশিপের ব্যবস্থা করতে। একটি মেধাবী ছাত্রকেও হারানোর ব্যথা তিনি সইতে নারাজ ছিলেন।
কলকাতায় ভূগোল নিয়ে কাজ করেন অনেকেই, কিন্তু শিবপ্রসাদ বাবুকে তেমনভাবে ধরে রাখার কোনও উদ্যোগ হয়নি। সুপ্রিম কোর্টের যাওয়ার আগে বিচারপতি বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন অন্ধ্রপ্রদেশ হাই কোর্টের প্রধান বিচারপতি। তিনি সেখানে দুটি ইনস্টিটিউট তৈরি করেছিলেন, যা আজও চলছে। একটি তার বাবা আইন বিশেষজ্ঞ এন. সি. ব্যানার্জির নামে ‘ইনস্টিটিউট অফ ইন্টেলেকচুয়াল প্রপার্টি ল’। আরেকটি ‘এস. পি. চ্যাটার্জি ইনস্টিটিউট অফ এনভিরনমেন্ট স্টাডিজ’। “এই দুজনই আমার কাছে ভগবান,” বলেছিলেন বিচারপতি ব্যানার্জি।
তথ্যসূত্র
১) জিওগ্রাফি অ্যান্ড ইউ-ডট-কম
২) ন্যাটমো
৩) উইকিপিডিয়া
Father of geomorphology is william Morris Davis….it should be corrected.
আপনি ঠিক বলেছেন। আমি একজ০নের লেখায় এটি পেয়েছিলাম।
ভারতীয় ভূগোলের পথপ্রদর্শক কে ভূগোলের এক ছাত্রের প্রণাম।
আমি কৃতজ্ঞ আপনার ভাল লাগায়। আরও কিছু তথ্য কারও কাছে থাকলে আরও একটু ভাল লেখা যায়।
অসাধারণ একটি লেখা। নিজে একজন ভূতত্ত্ব বিদ, তাই বড়ো ভালো লাগলো এই তথ্য গুলি জানতে পেয়ে।
ধন্যবাদ দেবাশীষ বাবু।
আমি অবশ্য ভূতত্বের থেকে অনেক দূরের মানুষ। সাংবাদিকতা পেশা। একসময় সেই সুবাদে অধ্যাপক সুনীল মুন্সির স্নেহ পেয়েছেই আর কিছু ধারণা।
একজন ব্যক্তি মানুষও কত ফারাক গড়ে দিতে পারেন, শিবপ্রসাদ বাবুর বিষয়ে খোজ করতে গিয়ে সেটাই আমাকে মুগ্ধ করেছে বলে এই নিবন্ধ।
লেখাটি পড়ে কি বলবো ভেবে পাইনি অনেকক্ষন l এরকম অদ্ভুত একটা লেখা আমি বলবো ইতিহাস, তথ্য এবং এক অদ্ভুত ও আমার কাছে একেবারেই নতুন একটা জীবনবোধ ও jeebon শৈলী আমার এতটুকু জানা ছিল না l বিষয়টি আমি বিশেষ কিছু জানি না l তবে উপস্থাপন অনবদ্য l লেখক কে শ্রদ্ধা ও শুভেচ্ছা জানাই l এরকম লেখা আরো চাই, রোজ চাই
আপনার ভাল লাগা আমার প্রাপ্ত আশীর্বাদ, শুভেচ্ছা।
এমন অনেক মানুষ আছেন, যাঁদের আমরা জানতে পারিনি, পারছি না। আপনার ধারে কাছেও হয়তো আছেন। আপনিও খোঁজখবর করে তাঁদের নিয়ে লিখুন।
আপনারও ভাল লাগবে, আমাদেরও
চমৎকার লেখা। অনেক কিছু জানলাম। লিংকটি শেয়ার করছি।
অবশ্যই। অনুমতির অপেক্ষা রাখে না। আর তোমার আমার ক্ষেত্রে আরও না।
মূল্যবান পোষ্ট। ধন্যবাদ।
কৃতজ্ঞ