নৌ বিদ্রোহে ৪৬: একটি নিঃসঙ্গ পর্যবেক্ষণ
(গ্রন্থের নাম: নৌ-বিদ্রোহের মুহূর্তকাল অথবা আজাদ হিন্দীদের কিসসা, লেখক: রক্তিম ঘোষ, প্রকাশক: পঞ্চালিকা)
১৯৮৭-এর বছর কয়েক পর, প্রাক্তন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ক্লিমেন্ট এটলী কলকাতায় আসেন। গভর্নর হাউসের এক জমায়েতে, কলকাতা হাইকোর্টের প্রাক্তন চিফ জাস্টিস পি. ভি. চক্রবর্তী তাঁকে জিজ্ঞাসা করেন, ক্ষমতা হস্তান্তরের পিছনে ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলনের ভূমিকা ঠিক কতটা। এটলি জানান, সামান্যই, বরং নৌ-বিদ্রোহ তাঁদের বাধ্য করেছিল, পরিকল্পিত সময়ের আগেই ভারত ছাড়তে!
নৌ-বিদ্রোহ ঘটে ১৯৪৬ সালে, বোম্বাইতে। আমরা অনেকেই জানি, বিদ্রোহের প্রত্যক্ষ কারণ ছিল; ব্রিটিশ অফিসারদের দুর্ব্যবহার,বেতন বৈষম্য, বিশ্বযুদ্ধের পর ঢালাও ভাবে ছাঁটাই হওয়া সেনাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা না থাকা, প্রাত্যহিক খাদ্যের অত্যন্ত নিম্নমান ইত্যাদি। কিন্তু রক্তিম ঘোষ তাঁর লেখা “নৌ বিদ্রোহের মুহূর্তকাল এবং আজাদ হিন্দীদের কিসসা” বইতে বিদ্রোহের কারণ এবং প্রেক্ষাপট নিয়ে দীর্ঘ আলোচনায় দেখিয়েছেন বর্ণ বৈষম্য, বেতন বৈষম্য, খারাপ মানের খাবার ইত্যাদি নানা অসন্তোষের কারণ থাকা সত্ত্বেও বলা যায় এতেই আটকে থাকেনি বিষয়টা। ঐ সময়ে লালকেল্লায় চলা আজাদ হিন্দ ফৌজের সেনাদের বিচারের সময়ে উঠে আসা, তাদের বীরত্বপূর্ণ কর্মকাণ্ডের বিবরণও, নৌ-সেনাদের প্রেরণা যুগিয়েছিল নিঃসন্দেহে। বৃহত্তর পরিপ্রেক্ষিত, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী বিশ্বপরিস্থিতি, বিশ্বময় ফ্যাসিবাদ বিরোধী সংগ্রাম এবং সেই সঙ্গে আজাদ হিন্দ ফৌজের প্রেরণা – এই সব কিছুর আলোয় বিচার করতে হবে নৌ-বিদ্রোহের উত্তাল সময়কে, যেখানে কার্যত বিপ্লবের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়েছিল গোটা দেশ। লেখক আমাদের চোখ খুলে দিয়েছেন একটা প্রশ্নে- এই বিদ্রোহে শুধু উঁচুতলার অফিসাররা নন বরং যুক্ত ছিলেন হাজার হাজার নিচু পদের সাধারণ রেটিং ও সিম্যান। তাঁদের কথাবার্তা-ভাবনা-উগ্রতায় স্পষ্ট ভারতীয় কৃষকের পরিচিতি। লেখক বলেছেন গোটা ব্রিটিশ শাসন জুড়ে এমনকি উত্তাল চল্লিশের দশক জুড়ে ভারতের নিম্নবর্গ যে প্রবল প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে, সেখানেই লুকিয়ে নৌ-বিদ্রোহের প্রাণ।
২৩৮ পৃষ্ঠার পেপারব্যাক ‘নৌ-বিদ্রোহের মুহূর্তকাল অথবা আজাদ হিন্দীদের কিসসা’ বইটি অনেক নতুন প্রশ্নকে সামনে নিয়ে আসে, যা আমাদের দেখার চোখকে পাল্টে দেয়। শুরু থেকেই চেষ্টা করা হয়েছে নির্মোহ হয়ে তথ্যনিষ্ঠ ভাবে বইটিতে ঘটনা পরম্পরাকে তুলে ধরতে নৌ-বিদ্রোহে অংশ নেওয়া ব্যক্তিদের অভিজ্ঞতার আলোকে এবং সরকারি দলিল দস্তাবেজের ভিত্তিতে। শুরুর কথা এবং শেষের কৈফিয়ত বাদ দিলে গোটা লেখাটিতে রয়েছে ৫টি অধ্যায়। প্রথম অধ্যায় হল ‘নৌ-বিদ্রোহের পূর্বক্ষণ’। নৌ-বিদ্রোহের সম্ভাব্য কারণ নিয়ে দীর্ঘ পর্যালোচনা রয়েছে এই অধ্যায়ে। রেটিং-দের ক্ষোভ-বিক্ষোভের কথা, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রেক্ষিত, সারা পৃথিবী ব্যাপী মুক্তির দর্শনের প্রভাব -এ সবই এসেছে এই অধ্যায়ে। দ্বিতীয় অধ্যায় “নৌ-বিদ্রোহের মুহূর্তকাল”-এ, ১৮ ফেব্রুয়ারি নৌ-বিদ্রোহ শুরু হওয়া থেকে ২৫ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত দৈনন্দিন ঘটনাক্রম তুলে ধরা হয়েছে তথ্যনিষ্ঠভাবে। অথচ আপনি একটুও আকর্ষণ হারাবেন না এই অধ্যায়টা পড়তে গিয়ে, কারণ একটানা একটি রুদ্ধশ্বাস গল্পের মতো প্রতিটা দিন ভেসে উঠবে আপনার চোখের সামনে। তৃতীয় অধ্যায়টি নৌ-বিদ্রোহে উত্তাল কলকাতা নিয়ে। লেখক দেখিয়েছেন ৪৬-এর কলকাতা বলতে ডাইরেক্ট অ্যাকশন ডে-র দাঙ্গাবিধ্বস্ত কলকাতাই শুধু নয় – একই সালের ফেব্রুয়ারির কলকাতায় প্রতিরোধের ব্যারিকেডে ধর্ম-দল-মত নির্বিশেষে ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা কামী মানুষ।
এর পরের অধ্যায়ে ভারতীয় নেতাদের মনোভাব, মন্তব্য এবং ভূমিকা সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন লেখক। জাতীয়তাবাদী নেতারা কেউই সমর্থনের জায়গায় দাঁড়াতে পারেননি। অবশ্য, সোশ্যালিস্ট নেতা অরুণা আসফ আলি ও কমিউনিস্ট পার্টি বিদ্রোহকে সমর্থন করেন। পরিশেষে, সর্দার প্যাটেল বোম্বে আসেন, মধ্যস্থতার জন্য। উল্লেখযোগ্য ভাবে উঠে এসেছে নৌ-বিদ্রোহের সমর্থনে কমিউনিস্ট পার্টির নেতা সোমনাথ লাহিড়ীর বেশ কিছু বক্তব্য। তিনি সঠিকভাবে সময়কে বুঝতে পেরেছিলেন।
বইটির কয়েকটা তথ্য পাঠককে রীতিমতো আশ্চর্য করে দিতে পারে। প্রচলিত ইতিহাস জ্ঞানের বাইরে থেকে তথ্য পাওয়া যায় যে এক নৌ-বাহিনীর সৈন্যের মাধ্যমে আজাদ হিন্দ বাহিনীর সেনারা চিঠি পাঠিয়েছিলেন শরৎচন্দ্র বসু এবং পণ্ডিত জহরলাল নেহরুকে। সেই চিঠির পরিণতি নিয়ে তথ্য তেমন না থাকলেও, পাঠকের আগ্রহের ক্ষেত্রকে উস্কে দেওয়ার জন্য তথ্যটুকু যথেষ্ট। তাছাড়া নৌ-বিদ্রোহে কমিউনিস্ট পার্টির ভূমিকা নিয়ে বিশদে আলোচনা করেছেন লেখক। তাঁদের ভূমিকা নেতিবাচক না ইতিবাচক ছিল নৌ-বিদ্রোহের ক্ষেত্রে, সেই নিয়ে সাম্প্রতিক কিছু বিতর্ক নজরে পড়েছে। আশাকরি পাঠকবৃন্দও সে সম্পর্কে ওয়াকিবহাল থাকবেন। এই বইটিতে এই বিষয় সম্পর্কে যেভাবে তথ্য পরিবেশন করা হয়েছে, তা এই সাম্প্রতিক বিষয়টিকে আলোকিত করতে সক্ষম হবে।
বইটির একদম শেষে ‘শেষের কৈফিয়ত’ অংশে লেখক রেখেছেন তাঁর নিজের মতামত বা পর্যালোচনা। পাঠকদের অনুরোধ এই অধ্যায়ে অবশ্যই একবার চোখ বোলানোর জন্য। অনেক নতুন দিক উঠে এসেছে লেখকের বিশ্লেষণে। তিনি দেখিয়েছেন একেবারে সাধারণ মানুষগুলোরই উত্থান হয়েছিল এই বিদ্রোহে। ‘আমরা সবাই নেতা’-এই ভাবনাটাই দাপিয়ে বেড়িয়েছে আন্দোলনকে। বীরপূজার এই দেশে এ ধরণের ঘটনা, এই অভূতপূর্ব সন্ধিক্ষণ সত্যিই বিরল।
এই বইটির একটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ উপাদান পরিশিষ্টে নৌ-বিদ্রোহী শহীদদের সম্পূর্ণ তালিকা। নাম না জানা শহীদদের কথা ইতিহাস বইতে শুধু সংখ্যা হয়েই রয়ে যায়, কিন্তু সেই শহীদদের সঙ্গে পাঠকের পরিচয় করিয়ে দেবার দায়িত্ব যত্ন নিয়ে পালন করা হয়েছে।
তাছাড়া পরিশিষ্ট অংশে লেখক আরও একটি প্রবন্ধ যুক্ত করেছেন। লেখাটি তাঁর পূর্ব প্রকাশিত একটি রচনা। সেখানে লেখক পেশ করেছেন খাইবার জাহাজের বৃত্তান্ত। এদিকে খাইবার জাহাজ আবার প্রখ্যাত নাট্যকার উৎপল দত্তর মঞ্চ কাঁপানো নাটকের স্মৃতি বিজড়িত। সে প্রসঙ্গ টেনে লেখক অত্যন্ত মুন্সিয়ানার সঙ্গে খাইবার জাহাজের ঐতিহাসিকতাকে তুলে ধরেছেন।
সার্বিকভাবে বলতে গেলে চল্লিশের দশক বিশ্ব রাজনীতি এবং ভারতের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক জীবনে একটি যুগ সন্ধিক্ষণ। সেই বিশেষ সময়কে চমৎকারভাবে ধরেছেন লেখক। আধুনিক চিন্তায় নতুনভাবে সাধারণ মানুষের অভূতপূর্ব উত্থানের তাৎপর্যের কথা মনে করিয়ে দিয়ে অত্যন্ত তথ্যনিষ্ঠভাবে নৌ-বিদ্রোহের দিনলিপি লিখেছেন লেখক। সবশেষে লেখক খানিকটা আবেগপ্রবণ করে দিলেন পাঠককে সেই অসীম সাহসী বাঙালি মেয়েটির গল্প শুনিয়ে।
আজ ফায়ারিং স্কোয়াডের কথা শুনলেই আমাদের মনে পড়ে মার্কেসের নিঃসঙ্গতার ১০০ বছর অথবা ফেদেরিকো লোরকার অদম্য সেই চোখ দুটো। গল্পগুলো মিথ হয়ে বেঁচে আছে আমাদের মনে। কিন্তু বিস্মৃতির আড়ালে তলিয়ে গেছে দুটি ভারতীয় মেয়ের ফায়ারিং স্কোয়াডে দাঁড়ানোর সেই দুঃসাহসী মুহূর্ত । দিনটা ৩১ মার্চ, ১৯৪৪ আর স্থান মুলুন্দ বন্দীশিবির। খুব ভোরে ৪৪-এর নৌ বিদ্রোহের বন্দীদেরকে শিকল বাঁধা অবস্থায় দাঁড় করানো হল দেওয়ালের গায়ে। উপরে জ্বলছে সার্চ লাইট। কমান্ডার কিং এবং ইন্ডিগো জোন্স উপস্থিত ঘটনাস্থলে। ঘোষিত হল কোর্ট মার্শালের রায়। পড়ে শোনালেন কমান্ডার কিং। রায়ে ছিল ঊর্মিলা বাঈ আর অনুভা সেনকে ফায়ারিং স্কোয়াডে মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার কথা আর বাকি ১৫০০ জন বিদ্রোহী রেটিং-কে যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ড। মহারাষ্ট্রের মেয়ে ঊর্মিলা আর অনুভা বাঙালি। সামনে তাক করা বন্দুক কিন্তু অদ্ভুত শান্ত দুই মেয়ে- শুধু তাদের শেষ উচ্চারণ-“ভারতের বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক, জয়হিন্দ!” আমরা বাঙালিরা ক’জন মনে রেখেছি বীরাঙ্গনা সেই মেয়েকে? অনুভাদের মৃত্যু আমাদের অপরাধী করে, বন্দুকের নলের সামনে দৃঢ় চোখদুটিতে শেষ বারের জন্য খেলা করা সেই স্বপ্নটাকে আমরা কি আমাদের মধ্যে বাঁচিয়ে রাখব না? ৪৪-এর সেই বিদ্রোহের অন্যতম অংশীদার এবং এই ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ফণীভূষণ ভট্টাচার্য তাঁর ‘নৌ-বিদ্রোহের ইতিকথা’ বইতে লিপিবদ্ধ করেন সেই হারিয়ে যাওয়া দুঃসাহসী মেয়ে দু’টির কথা। ৪৪-এর সেই প্রচেষ্টা ব্যর্থ হতে পারে কিন্তু সচেতন ভাবেই তা মুছে দেওয়া হয় ইতিহাসের পাতা থেকে।
এই সমস্ত তো আছেই, এছাড়াও অনেক ঘটনার ধারাবাহিক উল্লেখ পাওয়া যাবে বইটি থেকে। সাম্প্রতিক কালে বাংলায় নৌ-বিদ্রোহ নিয়ে মৌলিক কাজ করেছেন সন্দীপ বন্দ্যোপাধ্যায়, তারপর রক্তিম ঘোষ। কলকাতা তথা বাংলাও যে আন্দোলনে উত্তাল হয়েছিল, সেই আন্দোলনকে আমরা অনেকাংশেই মনে রাখিনি। বম্বে বা করাচী কীভাবে সেই আন্দোলন মনে রেখেছে, সেই খোঁজও যে রেখেছি এমন নয়। নিজেদের ইতিহাস ভুলে যাওয়া আমাদের সংস্কার নাকি অভ্যাস, সে আলোচনা প্রায়শয়ই হয়ে থাকে বুদ্ধিবৃত্তির পরিসরে। কিন্তু ভুলে যাওয়াটা যদি ইচ্ছাকৃত হয়! বইটি পাঠকের সামনে এমনই একটা প্রশ্ন ছুঁড়ে দিতে পেরেছে। তবে সেটা এমনি এমনি নয়; যুক্তিসিদ্ধ ভাবে। আসুন নিজেদের আয়নার সামনে একবার দাঁড় করাই।
খুব ভালো লাগল। বইটি সংগ্রহ করতেই হবে।
আগামী ১৫ আগস্ট অবধি বইটি ১৯০ টাকা এবং ফ্রি ডেলিভারিতে আমরা পাঠকের কাছে পৌঁছে দিচ্ছি। আপনি বইটি সংগ্রহ করতে চাইলে দয়া করে আমাকে হোয়াটসঅ্যাপ করবেন এই নম্বরে ৭০০৫৩০৯৬৩০
ফনিভুষণ ভট্টাচার্য্যের বই টা পড়লাম কিছু দিন আগে।এই বইটাও পড়ার ইচ্ছে থাকলো।
আগামী ১৫ আগস্ট অবধি বইটি আমরা ১৯০ টাকা এবং ফ্রি ডেলিভারিতে পাঠকের কাছে পৌঁছে দিচ্ছি। আপনি বইটি সংগ্রহ করতে চাইলে দয়া করে হোয়াটসঅ্যাপ করবেন এই নম্বরে ৭০০৫৩০৯৬৩০
আগামী ১৫ আগস্ট অবধি বইটি আমরা ১৯০ টাকা এবং ফ্রি ডেলিভারিতে পাঠকের কাছে পৌঁছে দিচ্ছি। আপনি বইটি সংগ্রহ করতে চাইলে দয়া করে হোয়াটসঅ্যাপ করবেন এই নম্বরে ৭০০৫৩০৯৬৩০।
বইটি বইমেলায় কিনেছিলাম। নৌ-বিদ্রোহ নিয়ে সাম্প্রতিককালের এক অভিনব বই। অত্যন্ত তথ্যসমৃদ্ধ বই। লেখক এবং প্রকাশককে অনেক শুভেচ্ছা জানাই।
আগামী ১৫ আগস্ট অবধি বইটি আমরা ১৯০ টাকা এবং ফ্রি ডেলিভারিতে পাঠকের কাছে পৌঁছে দিচ্ছি। আপনি বইটি সংগ্রহ করতে চাইলে দয়া করে হোয়াটসঅ্যাপ করবেন এই নম্বরে ৭০০৫৩০৯৬৩০
আগামী ১৫ আগস্ট অবধি বইটি আমরা ১৯০ টাকা এবং ফ্রি ডেলিভারিতে পাঠকের কাছে পৌঁছে দিচ্ছি। আপনি বইটি সংগ্রহ করতে চাইলে দয়া করে হোয়াটসঅ্যাপ করবেন এই নম্বরে ৭০০৫৩০৯৬৩০।