মানচিত্রের মল্লযুদ্ধ
আর্থার কনোলির খোঁজে
২রা জুলাই, ১৮৪৩ সাল। সকাল বেলা রিচমন্ডের ‘মর্নিং হেরাল্ড’-এর একটা প্রতিবেদন দেখে ভ্রু কুঁচকে উঠল ব্রিটিশ অফিসার ক্যাপ্টেন গ্রোভার-এর। প্রতিবেদনটা ব্রিটিশ সেনাবাহিনীকে উদ্দেশ্য করে লেখা একটা চিঠি, লিখেছেন রেভারেন্ড যোসেফ ওল্ফ। দুই ব্রিটিশ সামরিক অফিসার, ক্যাপ্টেন আর্থার কনোলি এবং চার্লস স্টড্ডারট, বিগত ৫ বছর ধরে নিরুদ্দেশ। এই বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন যোসেফ ওল্ফ। এই দুই অফিসার মধ্য এশিয়ার বুখারা থেকে নিখোঁজ। যেহেতু যোসেফ ওল্ফ নিজে কিছুদিন বুখারায় তাঁর মিশনের কাজে ছিলেন এবং এই অঞ্চলে থাকার অভিজ্ঞতা আছে, তাই তাকে যদি সামান্য অর্থ সাহায্য করা হয় বা কেউ যদি তাঁর সঙ্গে এই নতুন অভিযানে যেতে ইচ্ছুক হন তাহলে তিনি বিশেষ উপকৃত হবেন। তিনি বিশেষ ভাবে চিন্তিত কারণ তাঁর কাছে খবর আছে যে, এই দুই ব্রিটিশ অফিসারকে বুখারার কারাগারে দীর্ঘদিন বন্দি করে রেখে অবশেষে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। কনোলি এবং স্টড্ডারট দুজনেই ভক্ত খ্রীষ্টান, তাদের খোঁজ নেওয়া যোসেফের দায়িত্ব। এই বিষয়ে তিনি ব্রিটিশ সরকারের তরফ থেকে সহযোগিতা আশা করেন।
চিঠি লেখার পরেরদিন ক্যাপ্টেন গ্রোভার, যোসেফ ওল্ফ-এর সঙ্গে যোগাযোগ করেন। সরকারি ভাবে ওল্ফকে অর্থ সাহায্য করার প্রতিশ্রুতি দেন। ওল্ফ যাত্রা শুরুর আগে ভারত এবং মধ্য এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেন, যাতে আগে থেকে তাঁর কাছে কনোলি এবং স্টড্ডারটের বিষয়ে যথেষ্ট তথ্য মজুত থাকে। বহু জায়গায় পত্র মারফত যোগাযোগ করে এই বিষয়ে সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পান লেফটেনান্ট ভিন্সেন্ট আইরির কাছ থেকে। আইরি ১৮৪২ সালে কাবুলে পোস্টেড ছিলেন।
তখন কাবুলের টালমাটাল অবস্থা, ১৮৩৮ সাল থেকে শুরু হয়েছে অ্যাংলো-আফগান যুদ্ধ। দীর্ঘ চার বছরের যুদ্ধে ব্রিটিশরা পর্যুদস্ত হয়। এই সময় আইরি পরিবার আফগান নেতা আকবর খানের হাতে বন্দি হন। পরে সেপ্টেম্বর মাসে আইরি পরিবারকে উদ্ধার করা হয়। ভারতে ফিরে আসার পরেও মধ্য এশিয়ার সঙ্গে তাঁর সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়নি। আর্থার কনোলি সম্পর্কেও তিনি কিছু সংবাদ পেয়েছিলেন। রেভারেন্ড ওল্ফের এই অভিযানের কথা শুনে আইরি যোগাযোগ করেন। ১৮৪৩ সালের ১১ সেপ্টেম্বর আইরির চিঠি থেকে যোসেফ ওল্ফ জানতে পারেন বেশ কিছু তথ্য। ১৮৪২ সালের মাঝামাঝি আর্থার কনোলির শেষ চিঠি লেখেন তাঁর ভাই, জনকে। সেই চিঠি পৌঁছেছিল আইরির হাতে। আইরি সেই চিঠি থেকে প্রাপ্ত সংবাদগুলো বিস্তারিত ভাবে জানালেন ওল্ফকে। কনোলি তাঁর ভাইকে যা লিখেছিলেন, তা আদতে বড়োই মর্মান্তিক। চার্লস স্টড্ডারটের খোঁজ করতে গিয়ে কনোলি শেষ পর্যন্ত ১৮৪২ সালে পৌঁছেছিলেন বুখারায়। চার্লসকে গুপ্তচর হিসাবে চিহ্নিত করে বুখারার আমির বন্দি করে রাখে। বুখারার কারাগার ছিল নরক। ছোটো অন্ধকার প্রকোষ্ট, মলমূত্র বর্জনের আলাদা জায়গা নেই। চার্লসের শীর্ণ বুভুক্ষু শরীর, বিষ্ঠাজাত পোকার পীড়নে বিধ্বস্ত। কনোলি বুখারার রাজাকে চার্লসের শাস্তি মুকুব করার জন্য আবেদন জানিয়েছে। কিন্তু কোনও সদুত্তর পাননি। এটাই কনোলির লেখা শেষ চিঠি। এর পর থেকে প্রায় এক বছর হতে চলল, আর্থার বা চার্লস কারোর সম্পর্কেই কোনও তথ্য ব্রিটিশ সরকারের কাছে নেই।
চিঠি পড়ে মর্মাহত যোসেফ ওল্ফ তবুও যাত্রা শুরু করলেন বুখারার উদ্দেশ্যে। মনে বিশ্বাস, আর্থারদের ঠিক খোঁজ পাওয়া যাবে। কিন্তু এই আর্থার কে? কেনই বা তাঁর খোঁজে বেরোলেন জোসেফ ওল্ফ? এর পিছনে রয়েছে বিশাল ঐতিহাসিক পটভূমিকা, যার সূত্রপাত ঊনবিংশ শতকের গোড়ায়।
মস্কো থেকে কলকাতা, ১৮২৩
আমু দরিয়া আর সির দরিয়া নদী বয়ে চলছে মধ্য এশিয়ার রুক্ষ ভূমির বুক চিরে। আমু দরিয়ার উত্তরে জনপদ। মধ্য এশিয়ার অন্যতম জাঁকজমকপূর্ণ শহর, বুখারা। তুর্কমান প্রবাদে বলে, পৃথিবীর সর্বত্র আলো নেমে আসে, কেবল বুখারা থেকে আলো বিচ্ছুরিত হয়। বিশাল মাদ্রাসা-মসজিদ, আজুরাইটের তৈরি নীল গম্বুজ আর মিনার, উত্তপ্ত রাজপথ আর জনবহুল বাজার। সভ্যতার বিকাশের সময় থেকে বুখারা এরকমই চঞ্চল, আদিম, রোমাঞ্চকর। হাজার বছর ধরে মানব সভ্যতার বিবর্তনের সাক্ষী এই শহর। রেশম পথের সময় থেকে বুখারা বহু সংস্কৃতির মিলন হয়ে উঠেছিল, পারস্য, মঙ্গোল, তুর্কমান সাম্রাজ্যের হাত ধরে ১৯ শতকের বুখারা ছিল সাংস্কৃতিক মিলন ক্ষেত্র। বুখারা এবং তার চারপাশের লক্ষ লক্ষ বর্গকিলোমিটার জুড়ে বিস্তৃত তৎকালিন তুর্কিস্তান। উত্তরে বিশাল রুশ সাম্রাজ্য, দক্ষিণে ব্রিটিশ ভারতের মাঝে এই বিস্তীর্ন অঞ্চল, যার আয়তন ব্রিটিশ দ্বীপপুঞ্জের থেকে প্রায় বারো গুন বড়ো, তার ভূপ্রকৃতি, মানচিত্র, জনবৈচিত্র্য ইউরোপীয়ানদের কাছে অজ্ঞাত।
রুশ-ব্রিটিশ এই দুই সাম্রাজ্যবাদী শক্তি তখন নিজেদের সীমানা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি করছে। কিন্তু সঠিক মানচিত্রের অভাবে কেউই নিজের শেষ সীমানা সম্পর্কে সঠিক অবহিত নয়। রুশ জার প্রথম পল ১৮০১ সালে কাজাখ স্টেপের দিকে ক্রমশ অগ্রসর হতে থাকে। অনেক ঐতিহাসিক এবং ব্রিটিশ কূটনৈতিকরা মনে করেন, এই আক্রমণের আসল উদ্দেশ্য ছিল ভারত আক্রমণ করা। কিন্তু ওই বছরেই প্রথম পল খুন হন নিজের কর্মচারীর হাতে। এদিকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের “ক্রাউন জুয়েল”, ভারতের নিরাপত্তা নিয়ে লন্ডন-কলকাতায় বৈঠক শুরু হয়। ১৮০৪ সালে রুশ সাম্রাজ্য ইরেভেন (বর্তমান আর্মেনিয়ার রাজধানী) দখল করলে, কলকাতার রাজদরবারে হুঁশিয়ারির বার্তা পৌঁছায়।
কলকাতা সরকার এই পরিস্থিতিতে দুই রকম ভাবে প্রস্তুতি নিতে শুরু করে। প্রথম প্রস্তুতি ব্রিটিশ ভারতের একটা বিস্তারিত ম্যাপ তৈরি করা, যেটা থেকে তারা সাম্রাজ্যের সীমানা সম্পর্কে নিশ্চিন্ত হতে পারবে। দ্বিতীয়ত, ভারতের পার্শ্ববর্তি অঞ্চলে, যেমন আফগানিস্তান, তুর্কিস্তান (বর্তমান উজবেকিস্তান, তুর্কমেনিস্তান)এবং তিব্বতের অজানা জনপদ, গ্রাম নগরে সার্ভে করা। এই যুদ্ধের জন্য যুদ্ধকালীন তৎপরতায় তৈরি হয়েছে পৃথিবীর অজানা অচেনা মানচিত্র। মানচিত্র বানানোর সূত্রপাত যিনি করেছিলেন, তিনি সেই ব্রিটিশ অফিসার, আর্থার কনোলি। ১৮২৩ সালে লন্ডন থেকে সমুদ্র পথে কলকাতা না এসে, মধ্য এশিয়ার বুক চিড়ে মাসের পর মাস ধরে এগোতে লাগলেন।
কনোলির প্রথম গন্তব্য ছিল মস্কো। কিছুদিন সেখানে থেকে জারের রণসজ্জা পর্যবেক্ষণ করাটাও তাঁর একটা উদ্দেশ্য। মস্কো থেকে ঘোড়ায় চেপে পারি দিলেন চড়াই উৎরাই ঘেরা আর্মেনিয়ার দিকে। পূর্বে কাস্পিয়ান সাগর, পশ্চিমে কৃষ্ণ সাগর। তার মাঝে পাহাড় ডিঙিয়ে চলছে কনোলির ঘোড়া। তিবলিসি (বর্তমান জর্জিয়ার রাজধানী) পেরিয়ে পৌঁছলেন পারস্যের তাব্রিজে। তাব্রিজ পারস্য-রুশ সীমান্তের জনপদ। এইখান শুরু হয় ভাষার সমস্যা। ফার্সি ভাষা কনোলি বোঝেন না। কিন্তু ভাগ্য সহায়, পেয়ে গেলেন একজন স্থানীয় দোভাষীকে। সঈদ কারামত আলী নামের একজন পারসিক কনোলির সাথী হলেন। স্থানীয় রাস্তা ঘাট কারামতের পরিচিত। ক্যাস্পিয়ান সাগরের দক্ষিণ বাঁক দিয়ে পূর্বে অগ্রসর হতে হতে তেহরান পেরিয়ে কনোলি এলেন মাসাদ। এই পথে নিতে হয়েছে ছদ্মবেশ। কখনও ব্যাবসায়ী, কখনও হাকিমের পোশাকে পেরিয়েছেন জাগ্রোস পর্বত। নিজের নামকে হালকা বিকৃত করে পরিচয় দিতেন “খান আলী” হিসাবে, যাতে সহজে মিশে যেতে পারেন মধ্য এশিয়ার মানুষের সঙ্গে। কনোলি নিজে একজন ভক্ত ক্যাথলিক ছিলেন, কিন্তু ব্রিটিশ সরকারের স্বার্থে ধর্ম ভাবনাকে গৌণ রেখে মধ্য এশিয়ার ইসলামিক সংস্কৃতির সঙ্গে মানিয়ে নিয়েছিলেন। সঙ্গে চলছে মানচিত্রের আঁকিবুকি। মাসাদ পারস্য সাম্রাজ্যের সব থেকে পূর্বের শহর। এর পর থেকে শুরু হবে আফগান সাম্রাজ্য। হেরাত সে সাম্রাজ্যের অন্যতম প্রাণ কেন্দ্র। কনোলি হেরাতের পাস কাটিয়ে চললেন কান্দাহার। সেখান থেকে আরও দক্ষিণ পূর্বে সুলেমান পর্বতের পাদদেশ- সেখানে স্তরে স্তরে পাথর সমুদ্রের মতো ঢেউ খেলে আছে। পাহাড় কেটে গিরিখাত তৈরি করেছে বোলান নদী। বোলানের গিরিপথ পেরোলেই বালুচিস্তান। ওই দেখা যায় সিন্ধুর অববাহিকা। শুধু কনোলি নয়, সিন্ধু পারে আসার এই আনন্দ হয়তো হাজার হাজার বছর আগের মধ্য এশিয়ার খান -বাদশাদেরও আকৃষ্ট করেছিল। দিল্লী আর দূরে নয়। সারা বছরের পরিশ্রমের ফসল কনোলির হাতে। এক টুকরো মানচিত্র। কনোলি জানে সে কি উপহার দিতে চলেছে কলকাতার গভর্নর জেনারেলকে। একটা ৪০০০ মাইল রাস্তার সার্ভে সহ মানচিত্র (ম্যাপের মধ্যে লাল রঙের পথ)। সেযুগের ব্রিটিশ কূটনীতির অন্যতম সেরা অস্ত্র।
কনোলির এই অভিযান ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের জন্য দুই ভাবে গুরুত্বপূর্ণ ছিল। প্রথমত মধ্য এশিয়ার অজানা প্রদেশের খোজ পাওয়া রাজনৈতিক ভাবে সুবিধাজনক। রাশানদের পদক্ষেপের ওপর তারা নজরদারি করার একটা সুবিধা পাবে। দ্বিতীয়ত বাণিজ্যিক কারণ। কলকাতা থেকে লন্ডনে ভারত থেকে লুন্ঠিত সম্পদ পাঠানোর জন্য সমুদ্রপথ খুবই সময়সাপেক্ষ। স্থলপথে যদি সম্ভব হয়, তাহলে অনেক দ্রুত কাঁচা মাল পাঠানো সম্ভব হবে। ব্রিটিশ পার্লামেন্টের মেম্বার এলেনবর্গ এই ম্যাপ আঁকার প্রজেক্ট আরও বিস্তৃত করতে চাইলেন।
ত্রিকোণমিতির জরিপ
যখন বিদেশের ম্যাপ তৈরি করতে মরুভূমি অতিক্রম করছে ব্রিটিশ অফিসাররা, ব্রিটিশ ভারতে চলছে আরও একটা মেগা প্রজেক্ট, দি গ্রেট ত্রিগনমেত্রিকাল সার্ভে। নেতৃত্ব দিচ্ছেন অফিসার উইলিয়াম ল্যাম্বটন। সমস্ত উপমহাদেশের জমিকে টুকরো টুকরো করে ভেঙে পৃথিবীর বিভিন্ন পরিমাপ (যেমন কার্ভেচার) করবে ব্রিটিশ সার্ভেয়াররা। সঙ্গে উপমহাদেশের আরও নিখুঁত একটা ম্যাপ তৈরি করা যাবে। ১৮০২ সালের ১০ এপ্রিল থেকে এই সার্ভের কাজ শুরু হয়। ল্যাম্বটন এবং কর্মীরা ভেবেছিলো বছর পাঁচেকের মধ্যে এই কাজ শেষ হয়ে যাবে। প্রকৃত পক্ষে দেখা যায় এই প্রজেক্ট শেষ হয়েছিল প্রায় ৭০ বছর পরে। মাঝে ব্রিটিশদের সঙ্গে আফগানদের যুদ্ধ হয়ে গেছে, উপমহাদেশে সিপাই বিদ্রোহ হয়ে গেছে, তবু এই সার্ভে থামেনি। এই সার্ভের যারা করেছেন, তাদের কথা স্বাভাবিকভাবেই কম জানা যায়। ল্যাম্বটন, এভারেস্ট-এর মতো ব্রিটিশ অফিসারদের নাম জানা যায় কেবল। অথচ যারা খাটো ধুতি পরে “থিওডলাইট” এর মতো একটা বিশাল ভারী যন্ত্র কাঁধে নিয়ে মাইলের পর মাইল পথ চলেছে, তাদের নাম হারিয়ে গেছে। এই সমস্ত শ্রমিকদের অক্লান্ত পরিশ্রম বিজ্ঞানের জগতে এনে দিয়েছে নতুন নতুন আবিষ্কার। মানচিত্রের মল্লযুদ্ধ সবেমাত্র শুরু হয়েছে সেখানে, ১৮৩০ সাল।
সিন্ধু থেকে আমু দরিয়া, ১৮৩১
১৮৪০ সালে আর্থার কনোলির একটি চিঠি পাওয়া যায়। একজন ব্রিটিশ অফিসারকে উদ্দেস্য করে লিখেছেন, “You’ve a great game, a noble game before you …”। “গ্রেট গেম” এই প্রবাদটা প্রথম ব্যবহার করেছিলেন কনোলি, পরে রুডিয়ার্ড কিপলিং তাঁর বিখ্যাত বই “কিম” -এ এই “গ্রেট গেম” প্রবাদকে জনপ্রিয় করে তুলেছেন। আমি বলব, এটা স্রেফ খেলা না, মানচিত্রের যুদ্ধ! মধ্য এশিয়ার বুকে চিরে কনোলির লন্ডন থেকে কলকাতা আসা এবং সেই অঞ্চলের মানচিত্র তৈরি করাই এই মল্লযুদ্ধের প্রথম ধাপ। আফগানিস্তান থেকে আরও উত্তরের বিস্তৃণ অঞ্চলের ম্যাপ বানাবার জন্য ব্রিটিশ সরকারের তরফ থেকে নিযুক্ত করা হল তরুণ স্কটল্যান্ড-এর অফিসার- আলেক্সান্ডার বার্নসকে । ষোলো বছর বয়েসে ব্রিটিশ বোম্বে আর্মিতে যোগ দিয়েছিলেন। পরে সিভিল সার্ভিস পরীক্ষা দিয়ে ব্রিটিশ অফিসার পদে নিযুক্ত হন। বার্নসের একটা বিশেষ গুন ছিল, উপমহাদেশের বুকে প্রচলিত অধিকাংশ ভাষায় ছিলেন পটু। হিন্দুস্তানী, উর্দু, ফার্সি এবং আরবি-এই চারটে ভাষাতেই বার্নসের দক্ষতা সেসময়ে যেকোনও ব্রিটিশ অফিসারদের থেকে সেরা ছিল । ১৮৩১ সালে, বার্নস সিন্ধু নদের তীরবর্তী অঞ্চল সার্ভে করেন। এই সার্ভে চলতো রাতের বেলায়। দিনের আলোয় মাপজোক করা, সেক্সট্যান্ট যন্ত্র বের করে দিক নির্ণয় করা সম্ভব ছিল না। সিন্ধ প্রদেশের আমির যদি বৃটিশ অফিসারদের সার্ভে করতে দেখে, তাহলে হয় কারাদণ্ড অথবা মৃত্যুদণ্ড। রাতে চাঁদের আলোয় বার্নসের বাহিনী সিন্ধু তীরে জমি জরিপ করতেন। বিস্তীর্ন সমতল ভূমি, আর কোন সে দূরের সুউচ্চ পাহাড় প্রাচীর। হামফ্রে ডেভির তৈরি করা হেড ল্যাম্প যে মানচিত্র তৈরির কাজেও আসবে সেটা হয়তো নিজেও ভাবেননি। পাঁচ মাস ধরে সিন্ধু পাড়ের সার্ভে করে বার্নস বাহিনী পৌঁছলেন লাহোর, তৎকালীন রঞ্জিত সিং-এর রাজধানীতে। সেখান থেকে রঞ্জিতের সঙ্গে কূটনৈতিক সুসম্পর্ক রেখেই দিল্লী ফিরে এলেন বার্নস। প্রথম বার প্রমান করলেন নদীর গতিপথকে জরিপ করা যায়, এবং সিন্ধু নদীর মধ্যে দিয়ে ব্রিটিশ বাণিজ্য তরীর যাতায়াত সম্ভব। দিল্লী ফিরে তৈরি করে ফেললেন এই অঞ্চলের ম্যাপ, “Map of the Indus and Punjab Rivers from the Sea to Lahore” ।
বার্নসের সফলতায় খুশি হয়ে ব্রিটিশ সরকার এই অভিযানকে আরও উত্তর অভিমুখে পাঠাতে ইচ্ছে প্রকাশ করে।বার্নসের প্রথম পরিকল্পনা ছিল কাবুল পর্যন্ত ম্যাপ তৈরি করা। আফগান নেতা দোস্ত মোহাম্মদ তখন কাবুলের সিংহাসনে, ব্রিটিশ সরকারের সঙ্গে তখন দোস্ত মোহাম্মদের সম্পর্ক নিরপেক্ষ।
বার্নসবাহিনী সিন্ধু পেরিয়ে আরও উত্তরে মানচিত্র তৈরি করতে করতে এগিয়ে চলেছেন। অধিকাংশ সময়েই মানচিত্র তৈরির কাজ চলতো রাতের বেলা। তাতে দস্যু বাহিনীর হাত থেকেও বাঁচা যেত, বাঁচা যেত এই রুক্ষ ধূসর মরুভূমির উত্তাপ থেকে। বার্নসের দলে ছিলেন মুন্সি মোহনলাল। সম্ভবত এই মানচিত্রের মল্লযুদ্ধের প্রথম ভারতীয় যোদ্ধা।
১৮৩২ সালে বার্নসবাহিনী কাবুল এসে পৌঁছলেন। বসন্তের ছোঁয়ায় কাবুল তখন স্বর্গসম। দোস্ত মোহাম্মদের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক রেখেই বার্নস এগিয়ে চললেন আসল কাজের লক্ষ্যে। মানচিত্র বানাবার কাজ। কাবুল থেকে বাল্খ পৌঁছে আবিষ্কার করলেন আরেক ব্রিটিশ ভূপর্যটক উইলিয়াম মোরোক্রফটের সমাধি। জুন মাসের মধ্যে মানচিত্র তৈরি হয়ে গেল আমুদরিয়ার পাদদেশ পর্যন্ত। আমুর উত্তরে সেই স্বপ্নের দেশ। ইউরোপীয়ানরা বলে, ট্রান্সঅক্সনিয়া, আমরা বলি দোয়াব। আমু দরিয়া আর সির দরিয়ার মাঝের উৎকৃষ্ট ভূমি,আজকের উজবেকিস্তান – তুর্কমেনিস্তান। বার্নসের সময়ের পশ্চিম তুর্কিস্তান, রেশম পথ। আর সেই আলোর শহর, বুখারা।
অবশেষে বার্নস পৌঁছলেন বুখারা। কনোলি পারেনি, মোরোক্রফ্ট পারেনি। বার্নস-বাহিনী পেরেছে। সমস্ত অঞ্চলের আফগান, পস্তুন, পাঠান, তুর্কমান জনজাতির সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রেখেই এই অঞ্চল সার্ভে করে তাঁর মানচিত্র বানিয়ে দিল্লী ফিরে গেলেন। বার্নসের ম্যাপ ব্রিটিশ সরকারের কাছে সেই সময় অমূল্য। ক্রমশ ব্রিটিশের গুপ্তচর মধ্য এশিয়া আর আফগানিস্তানের সড়ক জমিন ছেয়ে ফেললো। সঙ্গে রুশ গুপ্তচরদের সংখ্যাও বাড়তে লাগলো। ব্রিটিশ আর রুশের মতো দুই বিশাল সাম্রাজ্যবাদী শক্তির দলাদলিতে চিন্তা বাড়লো মধ্য এশিয়ার আমীরদের মধ্যে।
কাবুল, ১৮৩৮
এদিকে আফগান সীমান্তে দেখা গেল আরও একটা ভূরাজনৈতিক সমস্যা। লাহোরের রাজা রঞ্জিত সিং আর কাবুলের রাজা দোস্ত মোহাম্মদের মধ্যে দ্বন্দ্ব ক্রমশ বাড়তে লাগল। দোস্ত মোহাম্মদ তুলনামূলক ছোটো সাম্রাজ্যের অধিকারী । রঞ্জিত সিংয়ের সামরিক শক্তি বেশি। স্বভাবতই দোস্ত মোহাম্মদ একটা বড়ো সাম্রাজ্যের আশ্রয় খোঁজে। প্রথমে ব্রিটিশদের সঙ্গেই তাঁর সদ্ভাব ছিল। এই কূটনীতির গোড়াপত্তন করেছিল সেই আলেক্সান্ডার বার্নস। কাবুলের দরবারের বার্নসের নিয়মিত যাতায়াত। বার্নস মোহাম্মদের দোস্তির দিকেই হাত বাড়াতে চাইলেন। কিন্তু রাজনীতির কূটনীতি এতই জটিল যে বার্নসের মতো পাকা রাজনীতিবিদও দোটানায় পরে যায়। ব্রিটিশ সরকারের পক্ষে কাবুলকে কোনও রকম সাহায্য করা সম্ভব ছিল না যাতে রঞ্জিত সিং এর স্বার্থ বিঘ্নিত হয়। ১৮০৯ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি রঞ্জিত সিংয়ের সঙ্গে অমৃতসর চুক্তি করে। সে সময় নেপোলিয়ান বোনাপার্টের ভারত আক্রমন রুখতে কোম্পানি এই চুক্তি সাক্ষর করে। ২০ বছর আগের সেই চুক্তির কারণে ব্রিটিশ রঞ্জিত সিংয়ের স্বার্থ বিরোধী কোনও কাজ করতে অপরাগ। বার্নস যদিও ওপর মহলে বোঝাবার চেষ্টা করেন যে এই সময় কাবুলের সঙ্গে সহযোগিতা করা দরকার। রঞ্জিত সিংয়ের বয়েস হয়ে গেছে, দোস্ত মোহাম্মদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করা মানে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সীমানাকে আরও বর্ধিত করা। কিন্তু ভিক্টোরিয়ান মরালিটিতে আসক্ত ব্রিটিশ উচ্চ আধিকারিকরা অমৃতসর চুক্তি খেলাপ করতে পারলেন না। বরং গভর্নর জেনারেল অকল্যান্ড বার্নসের মারফত দোস্ত মোহাম্মদের দরবারে আর্জি জানায় তারা যেন রাশিয়ার সঙ্গে কোনও রকম রাজনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন না করে।
দোস্ত মোহাম্মদ কিন্তু তুখোড় কূটনীতিক। ব্রিটিশদের সঙ্গে যেমন সম্পর্ক রেখেছিল, রুশ গুপ্তচরদের সঙ্গেও কিন্তু দুর্ব্যবহার করেনি। বার্নসের সমকক্ষ রুশ গুপ্তচর ইয়ান ভিটকেভিচ কাবুলে তাঁর প্রভাব বিস্তার করার চেষ্টা করছেন। কলকাতা থেকে প্রত্যাখ্যাত হয়ে দোস্ত মোহাম্মদ ভিটকেভিচের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করেন। বার্নস কলকাতা ফিরে আসেন। ব্রিটিশ সরকার রঞ্জিত সিংয়ের সঙ্গে আঁতাত তৈরি করে দোস্ত মোহাম্মদকে কাবুলের সিংহাসন থেকে সরিয়ে ফেলার পরিকল্পনা করে। পরিবর্তে কাবুলের সিংহাসনে বসায় ব্রিটিশের হাতের পুতুল দুররানি রাজা শাহ সুজাকে। ব্রিটিশের এই চাল নতুন না। পলাশী থেকে শুরু করে সর্বত্র ভিক্টোরিয়ান মরালিটির মোড়কে বিশ্বাসঘাতকতার ছুরি মারতে পারদর্শী সাম্রাজ্যবাদী শক্তি। ১৯৩৮ সালে ব্রিটিশ সেনা দোস্ত মোহাম্মদকে সিংহাসন চ্যুত করতে কাবুল আক্রমণ করে। প্রথম দিকে ব্রিটিশের পরিকল্পনা সফল হলেও যুদ্ধের ফল ঘুরতে শুরু করে বছর খানেকের মধ্যে। ১৯৪২ সালে আফগানদের একত্রিত করে দোস্ত মোহাম্মদ ফিরে আসে কাবুলে। ব্রিটিশ সৈন্য পরাস্ত হয়ে ফিরে যায়।
প্রথম অ্যাংলো-আফগান যুদ্ধ ঐতিহাসিক, ভৌগোলিক এবং রাজনৈতিকভাবে এক বিরল সন্ধিক্ষণে হয়েছে। যুদ্ধে এই পটভূমিকা তৈরি হয়েছিল সেই উনিশ শতকের শুরুতে। যখন রুশ জার প্রথম পল ভারত আক্রমণের সম্ভাব্য পরিকল্পনা করে। তারপর থেকে ব্রিটিশ-রুশের ঠাণ্ডা লড়াই যেভাবে এগিয়েছে তাতে হয়েছে সার্ভে, ম্যাপ, রাস্তা। এই সব ম্যাপ, রাস্তাগুলো পরবর্তীকালে জিওলজিকাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার সূচনার অগ্রদূত। এই যুদ্ধের পর ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের পশ্চিমের সীমানা নির্ধারিত হয়, যা আবার দ্বিতীয় অ্যাংলো-আফগান যুদ্ধের সময় ডুরান্ড লাইন হিসাবে স্থির করা হয়।
১৮৪২, বুখারা
ফিরে আসা যাক সেই শুরুর কথায়। আর্থার কনোলির খোঁজে।
ব্রিটিশরা কাবুল আক্রমণ করার পর থেকে মধ্য এশিয়ার আমিররা ব্রিটিশ গুপ্তচরদের ওপর আরও বেশি নিষেধাজ্ঞা জারি করে। গুপ্তচর বৃত্তিতে ধরা পড়লে মৃত্যু দণ্ড। মধ্য এশিয়ার মানুষ এবং আমিররা বুঝে গেছিল, ব্রিটিশ প্রথমে মানচিত্র তৈরি করতে আসবে, তারপর জমি দখল করবে। এদেরকে কোনওভাবেই বিশ্বাস করতে তারা ছিল নারাজ। এই রকম একজন ব্রিটিশ গুপ্তচর চার্লস স্টড্ডারট ১৮৩৮ সালে বুখারা পৌঁছায়। চার্লসের কাজ ছিল বুখারার আমিরের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করা। আমিরকে বুঝিয়ে বলা যে কেন ব্রিটিশরা আফগান আক্রমণে বাধ্য হয়েছে। এদিকে ১৯৩৮ সালের বুখারার রাজনৈতিক পরিস্থিতি টালমাটাল। আমিরের সিংহাসন দখল করেছে নুসরুল্লা খান। প্রথম সাক্ষাতেই আমিরের অপছন্দ হয়েছিল স্টড্ডারটকে। সম্ভবত স্টড্ডারট এশিয়ার সংস্কৃতি সম্পর্কে বিশেষ অবহিত ছিলেন না। আমিরের সামনে ঘোড়া থেকে নামতে অস্বীকার করায় আমিরের রোষের মুখে পড়েন স্টড্ডারট। তিনি অনুমান করেন স্টড্ডারট সম্ভবত ব্রিটিশ গুপ্তচর। স্টড্ডারটের ওপর নজরদারি করা হয় এবং বেশ কয়েকবার কারাদণ্ড দেওয়া হয়। বুখারার কারাগার নির্মম, সে সময়ের পৃথিবীর সব কারাগারই নরকসম। বুখারার বন্দিদের রাখা হতো একটা গভীর কুয়োর মধ্যে। স্থানীয় নাম শিয়া কাহ। এই কুয়োর মধ্যে থেকে পালাবার কোনও পথ নেই। মূলমূত্র সজ্জা সবই এই অন্ধ কূপের গভীরে। তিন বছরের কারাবাসে স্টড্ডারট শীর্ণ, জীর্ণ।
১৮৪১ সালে আফগানদের সঙ্গে যুদ্ধে ব্রিটিশরা পরজয়ের মুখে। তাও স্টড্ডারটকে বাঁচাবার শেষ চেষ্টা করতে এগিয়ে এলেন সেই আর্থার কনোলি। বুখারার পথে রওনা দিলেন। বুখারায় পৌঁছে কনোলি আমির নুসরুল্লার সঙ্গে দেখা করতে চাইলেন। ততদিনে মধ্য এশিয়া আর ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের মধ্যে এতটাই কূটনৈতিক দূরত্ব তৈরি হয়েছে, যে কনোলিকে তৎক্ষণাৎ কারারুদ্ধ করার আদেশ দিলেন নুসরুল্লা। মাঝে একটি চিঠি লিখতে পেরেছিলেন তাঁর ভাইকে। যে চিঠি বহু পথ ঘুরে এসে পৌঁছায় যোসেফ ওল্ফের কাছে।
দিনের পর দিন বুখারার কারাগারে বন্দি দুই ব্রিটিশ অফিসার। বুখারার হিমশীতল রাতের অন্ধকূপ, শরীর গরম করার মতো কোনও ব্যবস্থা নেই। কনোলিকে বাঁচাতে ব্রিটিশ সরকারের কোনও দূত আসেনি, ঠিক যেমন আসেনি আলেক্সান্ডার বার্নস কে বাঁচাতে। যুদ্ধের সময়ে গা ঢাকা দিয়ে কাবুলে লুকিয়ে ছিলেন বার্নস। বিভিন্ন ভাবে সাহায্য করছিলেন ব্রিটিশ বাহিনীকে। সঙ্গে আফগানদের সঙ্গেও বোঝা পড়ার চেষ্টা চালাচ্ছিলেন। কাবুলের আমজনতা কিন্তু চরম ব্রিটিশ বিরোধী মনোভাব নিয়ে নিয়েছে।তিনি কাবুল বাজারের একটা ছোটো ঘরের মধ্যে নিজেকে বন্দি করে রাখেন । ১৮৪১ সালের নভেম্বরে বুঝতে পারছিলেন অবস্থা ক্রমশ খারাপ হচ্ছে। বার্নস চিঠি মারফত যোগাযোগ করার চেষ্টা করেন ব্রিটিশ বাহিনীর সঙ্গে। ৪.৫ হাজার ব্রিটিশ বাহিনী সেসময় কাবুলে মজুত। কেউ সারা দেয়নি বার্নসের চিঠিতে। একদিন উত্তেজিত জনতা বার্নসের বাড়ি খুঁজে পায় এবং ঘেরাও করে। সেই দিন উপস্থিত ছিলেন মুন্সি মোহনলাল। বার্নসের মানচিত্রের কারিগরদের একজন। মোহনলাল তাঁর স্মৃতিচারণে লিখেছেন, বার্নস পালানোর শেষ চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু উত্তেজিত জনতা কয়েক মুহূর্তে তাঁর শরীর থেকে মাথা আলাদা করে দেয়। সমস্ত ঘর বাড়ি জ্বালিয়ে ধ্বংস করে দেয়।
বার্নসের মতোই আর এক সূর্যাস্ত হতে চলেছে বুখারার বাজারে। আফগানদের কাছে পরাস্ত হয়ে ব্রিটিশদের ফিরে যাবার খবর এসেছে নুসরুল্লার কাছে। এখন দুই ব্রিটিশ অফিসার একদম একা। এই মধ্য এশিয়ার বুক চিরে বছর কুড়ি আগে কনোলি বীরদর্পে পারি দিয়েছিলেন অজানা রাস্তায়। আজ সেই রাজপথেই বন্দি। ব্রিটিশ সৈন্যদের প্রত্যাবর্তনের পরে নুসরুল্লা কনোলি আর স্টড্ডারটের মৃত্যু দণ্ড দিলেন। অন্ধ কূপ থেকে আলোর রাস্তায় বসে আছে দুই অফিসার। তাদের ছিন্ন বস্ত্র, শরীরে অজস্র আঘাতের চিহ্ন। দুজনেই জেনে ফেলেছে তাদের নিয়তি। কিছুক্ষনের মধ্যেই আমিরের জল্লাদের কুঠার বিচ্ছিন্ন করে দেবে এই দেহ। কনোলিকে একটা সুযোগ দিয়েছিলেন নুসরুল্লা। যদি ধর্মান্তরিত হন, তাহলে তাঁর জীবনদান করতে পারেন আমির। কিন্তু নিজের ধর্ম বিশ্বাসের প্রতি অটল কনোলি এই সুযোগ প্রত্যাখ্যান করেন। সঙ্গে, যেখানে নিজের বন্ধুর প্রাণও বাঁচাতে পারবেন না, সেখানে নিজের প্রাণের মায়া ত্যাগ করলেন কনোলি। বুখারার রাজপথ লাল হল।
যুদ্ধের পণ্ডিত
যোসেফ ওল্ফের এই অভিযানের পর যখন ব্রিটিশ সরকার সমস্ত বিষয় জানতে পারলো, তখন ভবিষ্যতের মানচিত্র তৈরি এবং সার্ভে করার জন্য নতুন কৌশল অবলম্বন করল। ততদিনে গ্রেট ত্রিকোনমেট্রিক্যাল সার্ভেও প্রায় শেষের দিকে। কিন্তু ভারতের উত্তর-পূর্বের সীমানা নিয়ে কোনও সার্ভে নেই। তিব্বত, টার্কি, সিনজিয়ান – অর্থাৎ চীনের তুর্কিস্তান অঞ্চল এখনও গভীর অন্ধকারে। এখানকার অধিবাসীরা ইউরোপীয়ানদের এখনও ক্রূর চোখে দেখে। ১৮৫৭ সালে কাশগড়ে জার্মান ভূতত্ববিদ এডলফ স্ল্যাজিন্টভিট-এর শিরোশ্ছেদ করে স্থানীয়রা। ব্রিটিশ বাহিনী হিমালায়রের উত্তর-পূর্বের সমস্ত সার্ভে বন্ধ রাখে এই ঘটনার পর। ১৮৬৫ সালে উইলিয়াম জনসন সরকারের আদেশ অমান্য করে হিমালয়ের উত্তরে কুনলুন পর্বতের পাদদেশে অবস্থিত খোটান পৌঁছে যান। মার্কো পোলো এবং জেসুইট বেনেডিক্টের পর এই প্রথম কোনও ইউরোপিয়ান খোটান শহরে পৌঁছেছিলেন। কিন্তু জনসনের বাহিনীর সার্ভেয়ারকে স্থানীয় ডাকাত বন্দি করে এবং গ্রেট ত্রিকোনমেট্রিক্যাল সার্ভের পুঁজি থেকে খরচ করে বন্দিদের ছাড়িয়ে আনা হয়।
কিন্তু ব্রিটিশের রাজনৈতিক বুদ্ধি অপরিসীম। দীর্ঘদিন ধরে এশিয়ানদের সঙ্গে থেকে বুঝতে পেরেছে, এই সমস্ত অঞ্চলের আদিবাসী জনগোষ্ঠী ইউরোপিয়ান দেখলে আক্রমণ করে। স্থানীয় বা অন্যান্য এশিয়ানদের ওপর এরা এতটা আগ্রাসী নয়। ব্রিটিশ অফিসার মন্টেগোমারি দেখলেন স্থানীয় ভারতীয়দের যদি ট্রেনিং দিয়ে এই সমস্ত অঞ্চলে ম্যাপিং এবং সার্ভে করতে পাঠানো হয় তাহলে কম ঝুঁকি পূর্ণ হবে। শুরু হল একাডেমি, ট্রেনিং। মাস খানেক ম্যাপিংয়ে ট্রেনিং দিয়ে শিক্ষানবিসদের একটা অজানা জায়গায় ম্যাপিং করতে পাঠানো হতো। অজানা শিক্ষার্থীদের জন্য, কিন্তু ব্রিটিশদের কাছে সেই অঞ্চলের ম্যাপ থাকতো। এর সাহায্যে মিলিয়ে দেখতে পারতো কার ম্যাপিং কতটা ঠিক। খুব পারদর্শী ছাত্রদের অভিযানের জন্য বাছা হতো। এই সমস্ত বুদ্ধিমান ছাত্রদের ব্রিটিশরা বলত “পণ্ডিত”।
ম্যাপিং করার দুটো গুরুত্বপূর্ণ হিসাব আছে। এক, কতটা পথ চলা হচ্ছে, দুই কোন দিকে চলা হচ্ছে। এই দুটো জানা থাকলে ম্যাপিং করা সম্ভব। কতটা পথ চলা হচ্ছে সেটা হাঁটার গতিবেগের ওপর নির্ভর করে। যেমন কেউ একশো পা হাঁটলে একশো ত্রিশ মিটার রাস্তা অতিক্রম করতে পারে। একটা একটা ভিত্তিরেখা। এবার যে যত পা হাঁটল, সেই হিসাবে দেখা যাবে মোট কত রাস্তা অতিক্রান্ত হয়েছে। তিব্বতের রাস্তা হেঁটে পেরোতে হবে, সমতল ভূমির যে হিসাব, তিব্বতের এবারো খেবড়ো রাস্তায় সেটা মেনে চলা অসম্ভব। নতুন কিছু পদ্ধতি খুঁজে পেল পণ্ডিতরা। বৌদ্ধ জপমালায় খুঁজে পাওয়া গেলো সমাধান। একটা সাধারণ জপমালায় একশো আটটা পুঁতি থাকে। মানচিত্রের পণ্ডিতদের জন্য একটা বিশেষ জপমালা তৈরি করা হল যাতে একশোটা পুঁতি থাকে। একশো নম্বর পুঁতিটা আকারে বড়ো। যাতে একশোটা গোনা হয়ে গেলে একটা হিসাব থাকে। পণ্ডিতরা এই ভাবে একটা রেফারেন্স ঠিক করলেন যাতে তিব্বতের এবড়োখেবড়ো পথে এক একটা একশো পুঁতি গুনতে কতটা পথ অতিক্রম করা হয়। সেই হিসাব মতো পুঁতি গোনার নামে ম্যাপিং করে ফেলতেন আমাদের দেশের পণ্ডিতরা। জপমালা গোনায় কেউ কোনও সন্দেহ করতো না। পণ্ডিত নয়ন সিং জপমালা গুনে তিব্বতের বুকে ষোলোশো মাইল পথ অতিক্রম করেছিলেন। তাঁর হিসাবে মাইল প্রতি দুহাজার পুঁতি গুনতে হলে, সমগ্র যাত্রায় বত্রিশ লক্ষ বার পুঁতি গুনেছিলেন! নয়ন সিংয়ের মতো পণ্ডিতের নাম আমাদের বিজ্ঞানের ইতিহাসে ব্রাত্য।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে দেরাদুনে একাডেমি তৈরি হল। এক একজন পণ্ডিতকে প্রায় দু বছর ধরে ট্রেনিং দেওয়া হতো। নয়ন সিং, আবুদল হামিদের মতো পণ্ডিতরা মাসে পাঁচ থেকে পনেরো টাকার মাইনের বিনিময় পৃথিবী পারি দিতেন। ১৮৯৯ সাল পর্যন্ত ব্রিটিশের খাতায় সরকারি ভাবে একুশ জন পণ্ডিতের নাম পাওয়া যায়। যাদের মধ্যে অন্যতম নাম, শরৎ চন্দ্র দাস। ১৮৪৯ সালে চট্টগ্রামে জন্মগ্রহণ করেন শরৎ চন্দ্র। পরবর্তীকালে প্রেসিডেন্সি কলেজে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে পড়াশুনো করেন, সঙ্গে তিব্বতি ভাষার ওপর দখল তৈরি হয়। নয়ন সিং ব্রিটিশ সার্ভেতে কাজ করার সময় তিনি তিব্বতের ম্যাপিং করতে শুরু করেন পূর্ব দিক থেকে। নয়ন সিং পশ্চিম ভারত হয়ে তিব্বতে প্রবেশ করেন। শরৎ চন্দ্র, যিনি এস সি ডি নাম বেশি পরিচিত ছিলেন, তিব্বতের মানচিত্র তৈরি করেন দার্জিলিং, সিকিম হয়ে। এস সি ডি-এর সঙ্গে সর্বক্ষণের সঙ্গী ছিলেন লামা উগায়ান গ্যাতসো। রুডিয়ার্ড কিপলিংয়ের ‘কিম’ বইয়ের হারু চন্দ্র মুখার্জি চরিত্রটি সম্ভবত শরৎ চন্দ্র দাসের অনুপ্রেরণা থেকে সৃষ্টি।
মল্লযুদ্ধের শেষে
দীর্ঘ একশো বছরের এই গ্রেট গেম, রাজনীতি ভূগোল ইতিহাস সমৃদ্ধ সময়। রাশিয়ার ক্রমশ দক্ষিণে অগ্রসর হওয়া থেকে ব্রিটেনের গুপ্তচরবৃত্তি— কখনও সরাসরি ব্রিটিশ-রুশ যুদ্ধ হয়নি। তবে, এটাই ছিল উনিশ শতকের ঠাণ্ডা লড়াই, ভিক্টোরিয়ান ঠাণ্ডা লড়াই। যেসব কারণে ব্রিটেন মধ্য-এশিয়ার ম্যাপ বানাতে শুরু করেছিল সেগুলোর মধ্যে অন্যতম কারণ ছিল বাণিজ্য পথ তৈরি করা। ১৮৭৬ সালে সুয়েজ খাল কাটা হলে জলপথে বাণিজ্যের বিশাল সুবিধা তৈরি হয়। সমস্ত আফ্রিকা ঘুরে মাল পরিবহন করার বদলে ভূমধ্যসাগর আর লোহিত সাগর পেরিয়েই বোম্বাই। কলকাতা বন্দরের গুরুত্ব ক্রমশ কমতে শুরু করে এবং ভারতের পশ্চিম উপকূল হয়ে ওঠে বাণিজ্য কেন্দ্র। অপর দিকে ১৯০৫ সালে রুশ বাহিনী জাপানের কাছে পরাস্ত হয় এবং দক্ষিণের ক্রমবর্ধমান আগ্রাসন কমে আসে। ১৯০৭ সালে ৩১ অগাস্ট সেন্ট পিটার্সবার্গে দুই সাম্রাজ্যবাদী শক্তি অবশেষে অ্যাংলো রাশান কনভেনশন-এ সাক্ষর করে। এই চুক্তি অনুযায়ী ব্রিটেন পারস্যের ওপরে কোনও রকম প্রভাব বিস্তার করবে না, আর রাশিয়া পারস্যের নিচে নেমে আসবে না। আফগানিস্তান এবং তিব্বতেরও নির্দিষ্ট সীমানা ঠিক করা হয়।
১৯০৭ সালের চুক্তি ব্রিটেন-রাশিয়ার ঠাণ্ডা লড়াইয়ের একটা সাময়িক বিচ্ছেদ টানে। এবং তার কৃতিত্ব অনেকটাই মানচিত্রের মল্লযোদ্ধাদের। নিজেদের প্রাণ দিয়ে, জীবন দিয়ে পৃথিবীর গহীন অঞ্চল চসে বেড়িয়েছেন। হয়তো তাদের খানাবাদস জীবনের এটাই একমাত্র চাহিদা ছিল। মধ্য এশিয়ার সূর্যের মধ্যে আজও লুকিয়ে আছে কনোলি, বার্নসদের রক্ত, আর তিব্বতের হিমবাহে জমে আছে নয়ন সিং, শরৎ দাসের রক্ত-জল-ঘাম।
তথ্যসূত্র
1. Wolff, Joseph. Narrative of a Mission to Bokhara: In the Years 1843-1845. Vol. 2., (1845)
2. Burnes, A., Travel into Bokhara together with a Narrative of a Voyage on the Indus, with an introduction by Major General James Lunt, (1834)
3. Conolly, A., Journey to the North of India, 2 vols. London: Richard Bentley, (1834)
4. Sergeev, E., The Great Game, 1856–1907. Johns Hopkins University Press, (2013)
5. Hopkirk, P., Quest for Kim: In Search of Kipling’s Great Game. Oxford University Press, USA, (2001)
6. Sale, F.W., A Journal of the Disasters in Afghanistan, 1841-2. John Murray, (1844)
7. Yapp, M.A., British perceptions of the Russian threat to India. Modern Asian Studies, 21(4), (1987):647-665.
8. Dean, R., Mapping the great game: Explorers, spies and maps in 19th-century Asia. Casemate, (2020)
9. Dalrymple, W., Return of a King: the Battle for Afghanistan. Bloomsbury, (2014)
10. Personal discussion with tour guides in Central Asia
কত অজানারে জানাইলে তুমি 🙏
অনেক ধন্যবাদ
ইনক্রিডিবল বা অসাধারণ বললে সঠিক এডজেকটিভ হচ্ছে না।
কতটা মরিয়া হয়ে লুট তরাজের কূটকৌশল তৈরি করেছিল ইউরোপীয় দেশগুলো।
বৃটিশ সরকার নিজেদের লোকদের ও মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিতে পিছপা হতো না।
তবে এর মধ্যে থেকে যে সব ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে অজানা তথ্য সমৃদ্ধ লেখাটি আমাদের উপহার দিলেন, ঋদ্ধ হলাম সেটা বলাই বাহুল্য। সাথে সাথেই ঐ অঞ্চলের ভৌগোলিক গতি প্রকৃতি ও জানা গেল।
অনেক ধন্যবাদ লেখাটা পড়ার জন্য। বিষয় যে একসূত্রে বাঁধা এবং সেটা যে লেখাটা পরে বোঝা যাচ্ছে, সেটা জেনে খুশি হলাম।
অসাধারণ একটা লেখা। ব্রিটিশ ভারতের গ্রেট টিগনোমেট্রিক সার্ভে বিষয়ে আগে সামান্য কিছু পড়েছিলাম এবং তিব্বতের দিকের মানচিত্র বিষয়ে সামান্য কিছু।
কিন্তু এতো বিস্তারিত জানা ছিল না। আফগানিস্তানের দিকের সার্ভের বিষয়ে কিছুই জানতাম না। সাম্রাজ্য বিস্তার, বাণিজ্য, কূটনীতি এ সবকিছুরই সাফল্যের পেছনে আদতে কিছু মানুষের শ্রম রক্ত ঘাম লুকিয়ে আছে তাও বেশ ভাল বোঝা গেল।
একটা সংশোধন বলি, মূল লেখায় কয়েকবার ১৮৩৮ এর বদলে ১৯৩৮ বা ১৯৪২ ইত্যাদি লেখা হয়ে গেছে। ঐটা একটু দেখবেন।
আর ভারতের জমি জরীপ বিষয়ে একটা এরকম বিস্তারিত লেখা ভবিষ্যতে আশা করবো।
অনেক ধন্যবাদ। হ্যাঁ, দুটো সাল ১৮ এর বদলে ১৯হয়ে গেছে। আমি দেখছি বলে, যদি পরিবর্তন যায়।
GTS নিয়ে ডকুমেন্ট কম, বিশেষ করে ভারতীয় শ্রমিকদের নিয়ে বিশেষ কোনো তথ্য জানা যায় না। এটা ঐতিহাসিকদের খুঁজে বের করতে হবে। আমি GSI এর পরিচিতদের এই নিয়ে কিছু জিজ্ঞাসা বাদ করেছিলাম, তারাও তেমন কোনো সোর্স দিতে পারে নি।
1831 নাগাদ রাধা নাথ শিকদার এই GTS এর সদস্য হিসেবে দার্জিলিং, সিকিমের পথে mount এভারেস্ট জরিপ করেছিলেনI তার আগে সম্ভব ত কাঞ্চনজঙ্ঘা কেই highest peak ধরা হতো I Dehradun এর অ্যাকাডেমি কি তখন তৈরী হয়ে গিয়েছিল?
রাধানাথ সিকদার গণিতবিদ, উনি যে একাডেমিতে ছিলেন, আর ম্যাপিংয়ের একাডেমী সম্ভবত আলাদা। ম্যাপিংয়ের জন্য একাডেমী ১৮৬০ এর পর খোলা হয়। ততদিনে ত্রিকোণমিতির সার্ভে প্রায় শেষের দিকে।