হিন্দু না ওরা মুসলিম এই জিজ্ঞাসে কোন জন?
এসেছি রাজস্থান ভ্রমণে – কর্নেল টড আর অবন ঠাকুরের রাজকাহিনী অর্থাৎ রাজপুত রাজাদের দেশভক্তি, শৌর্যবীর্য, দেশের জন্য আত্মত্যাগ, আরও কতসব ঘটনা মিলিয়ে মিশিয়ে তৈরি এক বিশাল কোলাজ দর্শন করতে।
রাজস্থান ভ্রমণে বিশেষ করে বলতে হয় যে মেওয়ার বা মেবার (চিতর) দেশের রাজকাহিনী আবর্তিত হচ্ছে- মহারানা বাপ্পাদিত্য থেকে রানা কুম্ভ- রানা সাঙ্গা – রানা প্রতাপ – অসাধারণ সব দেশপ্রেমিকদের ঘিরে। আর এইসব দেশপ্রেমিকদের সঙ্গে যোগ্য সঙ্গত দিয়ে গেছেন রানী পদ্মিনীর মতন হাজার হাজার নারী। আবার বীরাঙ্গনাদের থেকে আলাদা জীবন দর্শন নিয়েও উজ্জ্বল হয়ে আছেন কৃষ্ণভক্ত মীরাবাঈ কিম্বা ধাত্রী পান্না। এসব ঘটনা তো অবন ঠাকুরের ভক্তরা সবাই জানেন।
এবার জানা অধ্যায় ছেড়ে চলেছি অজানা বা অল্প জানা ঘটনাস্থলে।
দাঁড়িয়ে আছি শত শত শহীদের রক্তে রঞ্জিত হলদিঘাটি গিরিবর্তে। গিরিবর্তের দুধারেই পাহাড়ের ঢালের মাটির রং- একেবারে যেন মিহি করে পেষা হলুদ গুঁড়ো, না দেখলে বিশ্বাসই হবে না। সেই পূত পবিত্র মাটি নিয়ে মাথায় ঠেকালাম, ঠিক তখনি সেখানে উপস্থিত কোন বাঙালি পণ্ডিত ও বুদ্ধিজীবী মন্তব্য করলেন- হলদিঘাটির যুদ্ধ হচ্ছে আবহমান কাল থেকে চলে আসা হিন্দু-মুসলিম লড়াই। তাল কেটে গেল- মনের মধ্যে অনেক প্রশ্নের উদয় হোল।
হলদিঘাটি গিরিবর্ত
কর্নেল টড ও অবন ঠাকুরের লেখার মধ্য দিয়ে যে মেবারকে আমরা জেনেছিলাম, আজকের যুগের প্রতিনিধিরা কি তা বিস্মৃত হয়েছেন? এঁদের দোষ দিয়ে কোন লাভ নেই কারণ খুব সুকৌশলে কিছু পণ্ডিত আমাদের চেতনায় ঢুকিয়ে দিয়েছেন অনেক কিছুই – যেমন এই বর্বর দেশের যত কিছু উন্নতি হয়েছে, তার কৃতিত্ব হয় মোঘলদের নয় ইংরেজদের। এরাই শিখিয়েছেন- স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস একদম হালের ঘটনা- ইংরেজদের বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা আন্দোলন।
তাহলে কি পররাজ্যগ্রাসী মোঘলদের বিরুদ্ধে মেবারের রাজা রানা প্রতাপ ও তাঁর সহযোগীদের মরণপণ যুদ্ধ স্বাধীনতা রক্ষার যুদ্ধ নয়? সপ্তম থেকে সপ্তদশ শতক ব্যাপী অত্যাচারী, পররাজ্যলোভী শক্তির বিরুদ্ধে শৌর্যবীর্যে অনন্য মেবারের মরণপণ যুদ্ধ- যার ইতিহাস ছিল জাগ্রত ভারতের প্রতীক, তাকে কি মুছে ফেলা সম্ভব ?
চিতর যুগে যুগে অত্যাচারী শাসকের লোভের শিকার হয়েছে। চিতরকে ধ্বংস করা সম্ভব হয়েছে, কিন্তু বশে আনা সম্ভব হয়নি। চিতরের স্বাধীনতা ও নারীর সম্ভ্রম রক্ষায় রাজপুত সেনাদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সাধারণ প্রজা এমনকি আদিবাসী ভিলেরাও প্রাণ দিয়েছেন, মেয়েরা জহরব্রত পালন করেছেন। তাই ধ্বংস প্রাপ্ত চিতরের ইতিহাস আজকের দিনেও, সাধারণ মানুষের মধ্যে এক প্রচ্ছন্ন গর্ববোধ জাগরিত করে।
পদ্মিনী মহল- চিতরগড়
চিতর তিনবার আক্রান্ত হয়েছে। প্রথমে আলাউদ্দিন খিলজি এবং দ্বিতীয়বার গুজরাটের সম্রাট বাহাদুর শাহের দ্বারা। কিন্তু চিতরের সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করেছেন মোঘল সম্রাট আকবর। রাজস্থানের বাকি সব রাজারা যখন মান ইজ্জত বিসর্জন দিয়ে মোঘলদের গোলামে পরিণত হয়েছেন, তখন দীর্ঘ ২৫ বছর ধরে, স্বাধীনতা বিসর্জন না দেবার অঙ্গীকার করে, পরাক্রমশালী আকবরের সঙ্গে বুক চিতিয়ে লড়ে গেছেন রানা প্রতাপ।
১৫৭৬ সালের ১৮ ই জুন থেকে শুরু হয়- ইতিহাস প্রসিদ্ধ হলদিঘাটির যুদ্ধ। এই অসাধারণ স্বাধীনতা রক্ষার যুদ্ধকে অনেক পণ্ডিত হিন্দু- মুসলিম যুদ্ধ বলে দেগে দিতে চাইছেন। এর থেকে বড় মিথ্যে আর হয় না।
দেখে নেওয়া যাক কি ঘটেছিল সেদিন। একদিকে রয়েছেন ৮০ হাজার মুঘল সেনা নিয়ে সম্রাট আকবর – না একটু ভুল হোল, আকবর নিজে উপস্থিত নেই। আকবরের হয়ে এই যুদ্ধে মুঘল সেনাপতি হচ্ছেন আকবরের হিন্দু শ্যালক- অম্বরের রাজা মানসিং। আর মুঘল সেনার অর্ধেকই হচ্ছে মুঘল সম্রাটের পায়ে শরণ নেওয়া বিভিন্ন রাজপুত রাজাদের নিজস্ব হিন্দু সম্প্রদায়ের সেনাবাহিনী। মুঘলদের সঙ্গে আছে হালকা কামান, কারণ সংকীর্ণ গিরিবর্তে ভারী কামান নিয়ে ওঠা সম্ভব হয়নি।
এবারে দেখেনি রানা প্রতাপের সেনাবাহিনীকে। অতি ক্ষুদ্র মাত্র ৯/১০ হাজার সেনা। সবাই উত্তেজনায় ফুটছে- জীবন মৃত্যু, পায়ের ভৃত্য, চিত্ত ভাবনাহীন।
এখানেও সর্বাগ্রে কিন্তু রানা প্রতাপ নেই, তিনি তাঁর রাজপুত সেনাদের নিয়ে রয়েছেন দ্বিতীয় সারিতে।
প্রথম সারির সর্বাগ্রে রয়েছেন রানা প্রতাপের অতি বিশ্বস্ত একদা রাজকোষের খাজাঞ্চি এবং বর্তমান যুদ্ধে তিনিই রানা প্রতাপের সেনাদলের সেনাপ্রধান। তাঁর সঙ্গে সামনের সারিতেই রয়েছেন সেনাপতির মতনই সর্বাঙ্গে কালো কাপড় এবং চাপদাড়ি যুক্ত একদল সেনা। এঁদের দেখেই বোঝা যাচ্ছে যে এরা প্রত্যেকেই অত্যন্ত যুদ্ধপটু ব্যক্তি।
সত্যি তো তাই, এই প্রথম সারির সেনারা কারা? কিসের জন্য এঁরা মেবারের ভাগ্যের সঙ্গে নিজেদের জড়িয়ে দিয়েছেন ? তাহলে শুনে রাখুন, এই সেনাপতি ও সেনারা কিন্তু কোন ভাড়াটিয়া সেনা নন।
প্রথমে আসি এই সেনাপতির কথায়- ইনি হচ্ছেন একদা ভারত সম্রাট পাঠান রাজ শের শাহ সুরি এবং সিকান্দার শাহ সুরির বংশোদ্ভূত- অসাধারণ বীর ও মুক্তিযোদ্ধা, মেবারের ইতিহাসের এক প্রাতঃস্মরণীয় চরিত্র – হাকিম খান সুরি, বোঝাই যাচ্ছে ইনি ধর্মে মুসলিম। আর এনার সঙ্গেই আছেন একদল দুর্ধর্ষ পাঠান যোদ্ধা। এরাও মুঘল সাম্রাজ্যের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে নেমেছে ধর্মযুদ্ধে। আরেকটি কথা হাকিম খান ও তাঁর সহযোদ্ধারাই কেবলমাত্র কামান চালাতে পারে। রাজপুত সেনারা লড়াইয়ে নেমেছে তীর, ধনুক, বল্লম ও তলোয়ার সম্বল করে। আর ভীল সেনারা পাহাড়ের উপরে এবং আড়াল থেকে প্রস্তুত হয়ে আছে তীর ধনুক এবং বিশাল বিশাল পাথরের চাঁই নিয়ে শত্রুপক্ষের দিকে নিক্ষেপ করবার জন্য।
এর পরেও কি বলবেন- এই যুদ্ধ স্বাধীনতা সংগ্রাম নয়, হিন্দু-মুসলিম যুদ্ধ?
মেবারের ঐতিহাসিক গ্রন্থ “বীর বিনোদ” এবং বদায়ুনির লেখায় আছে- রানার সেনার অগ্রবর্তী সেনারা, অর্থাৎ পাঠান সেনারা এমন ভয়ঙ্কর আক্রমণ করে যে, অত বৃহৎ সংখ্যার মোঘল সেনারা ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়।
আপনারা সকলেই অবগত আছেন যে, এই যুদ্ধের মোড় ঘুরে যায়, রানা প্রতাপের বিশ্বস্ত ঘোড়া চেতকের একটি পা কেটে যাওয়ায়। তিন পায়ে দৌড়ে, নদী পেরিয়ে কিভাবে চেতক, প্রভুকে নিরাপদ জায়গায় নিয়ে গিয়ে মৃত্যুর মুখে ঢলে পড়ে, সে ঘটনা সবাই জানেন। সেই স্থলটির উপরে একটি সমাধি প্রতাপ নিজেই পরে তৈরি করেন। রানা প্রতাপ যুদ্ধস্থল ছেড়ে যাওয়ার পরে, প্রতাপের হামসকল সর্দার ঝালামাল কিভাবে প্রতাপ সেজে যুদ্ধ পরিচালনা করেন এবং প্রাণ দেন, সেও এক বীর কাহিনী, অনেকেই জানেন। কিন্তু অনেকেই হয়ত জানেন না যে, মেবারের এই সম্মান যুদ্ধে, পাঠান হাকিম খান সুরি ও তাঁর সঙ্গের প্রতিটি আফগান সেনা যুদ্ধক্ষেত্রে বীর গতি প্রাপ্ত হন।
তাই আজ অমর শহীদ হাকিম খান সুরির কামান চালানো মূর্তি, চেতকের উপর আসীন রানা প্রতাপের মূর্তির পাশেই শোভা পাচ্ছে, উদয়পুরের ফতেহ সাগর লেকের পাশে মতিমাগরিতে। হাকিম খান সুরি আজ বীরগাথায় উত্তীর্ণ, তাঁকে পীরের আসনে বসিয়ে প্রতিবছর মেলা বসে হলদিঘাটিতে।
কামান নিয়ে হাকিম খান সুরি
পণ্ডিত নরেন্দ্র মিশ্রর উদ্ধৃতি দিয়ে বলি-
“জিনকা বলিদান মেবার ঔর ভারত কি আন বন গয়া হ্যায়।
গঙ্গা যমনা কী ধরতী কী কওমি পহচান বন গয়া হ্যায়।”
তথ্যসূত্র:-
১) James Tod, Annals and Antiquities of Rajasthan, Books Treasure, Jodhpur- Ahmedabad.
২) রাখালচন্দ্র দাস, রাজপুতনা রাজস্থান, প্রভা প্রকাশনী, ভবানী দত্ত লেন, কলকাতা-৭০০০৭৩
৩) Haldighati- Wikipedia.
৪) মোহন শ্রীমালি ও এস পি জৈন, যুগ-পুরুষ মহারানা প্রতাপ, অনুবাদ- পরিমল রায়, চিরাগ প্রকাশন, উদয়পুর
খুব ভাল লাগল আপনার লেখাটা পড়ে। এর আগে পুনিয়ানি একটি ভিডিওতে এমন কথাই জানিয়েছিলেন তার অনবদ্য ভঙ্গিমায়। হিন্দু মুসলমানের কোন বাইনারি ইংরেজ আমলের আগে ছিল না। যে কারণে পুরীর রথযাত্রায় শাহজাহানের অংশগ্রহণের কথা জানতে পারি। অতীতকে আমরা চিরকাল বর্তমানের চোখে দেখতে ভালবাসি। আপনার লেখাটা কেবল সমসাময়িক ইতিহাসিকেই সমৃদ্ধ করে না, সাধারণের মধ্যে যে ভুল নির্মাণ, তাকেও চ্যালেঞ্জ করে। ধন্যবাদ।
Religion where a way to know the almighty there god and allah and iswar is one. When relogion is tool to capture and enjoy power or a comodity of business there hindu mushlim and cristion are different identity and god iswar and allah as wel. 2. Pathans were defited lost power by Mughals. At haldighat the enemy’s enemy become friend and sperit of revenge powered over the. Sperit of freedom.