সূচী

ইতিহাস তথ্য ও তর্ক

বান-চিয়াং (থাইল্যান্ডের ৫৪০০-২৩০০ বৎসরের প্রাচীন নিদর্শন)

বান-চিয়াং (থাইল্যান্ডের ৫৪০০-২৩০০ বৎসরের প্রাচীন নিদর্শন)

তুষার মুখার্জী

জুন ২২, ২০২৪ ২৭০ 2

প্রতিবেশী দেশগুলোর অতীত সম্বন্ধে আমাদের খুব বেশি কিছু জানা থাকে না। যেটুকু সামান্য জানার উৎসাহ জাগে তা কেবল আমাদের দেশের সাথে, আমাদের গৌরবজনক সংযোগ সূত্রগুলো ঘিরেই।

দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় দেশগুলোর ইউরোপীয় অধীনতার কবল থেকে স্বাধীন হবার পরেই কেবল তাদের নিজেদের অতীত জানার আগ্রহ দেখা দিতে শুরু করে। এই আগ্রহের পেছনে তাগাদা ছিল ইউরোপীয় ধাঁচে জাতি-রাষ্ট্র গঠনের জন্য আপন আপন জাত্যাভিমানের সৃষ্টি করা। ইউরোপীয় ভাবধারায় জাতি-রাষ্ট্র গঠনের জন্য প্রয়োজন প্রতিটি রাজনৈতিক রাষ্ট্রের নিজস্ব জাতি পরিচয় সৃষ্টি করা ও তাকে সুদৃঢ় জাতিসত্তায় পরিবর্তিত করা। এই রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতার থেকেই নবীন রাষ্ট্রগুলো তাদের ইতিহাস চর্চার প্রয়োজন অনুভব করে। ফলে একেবারে আক্ষরিক অর্থেই তারা তাদের নিজেদের অতীত, মাটি খুঁড়ে বের করতে শুরু করে। শুরুতে এই কাজের জন্য প্রয়োজনীয় জ্ঞান, লোকবল, অর্থবল – কিছুই ছিল না বা প্রবল অভাব ছিল। তবু প্রয়োজনের তাগিদে কাজের শুরুটা হলো ঔপনিবেশিক শক্তিগুলোর উৎসাহ আর সক্রিয় সাহায্য নিয়েই। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ঔপনিবেশিক শক্তি ছিল মূলত ডাচ আর ফরাসিরা ও অতি সামান্য ব্রিটিশ। মূলত তাদের উদ্যোগে প্রত্ন-অনুসন্ধানের কাজ শুরু হলেও, পরিবর্তিত আর্থ-ভৌগোলিক রাজনীতির হাত ধরে প্রধান ভূমিকায় নামে আমেরিকা। আর সাথে একাধিক ইউরোপীয় দেশ তো ছিলই। শুরু থেকে এখন পর্যন্ত দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার রাষ্ট্রগুলো তাদের রাষ্ট্রীয় জাতির অতীত অনুসন্ধানের কাজে বিদেশিদের উপরই প্রবল ভাবে নির্ভরশীল। তারই মধ্যে কালক্রমে আগ্রহ বাড়ার সাথে সাথে বিষয়গত দক্ষতা সৃষ্টির প্রচেষ্টাও শুরু হয়। আর তার সুফলও দেখা দিতে শুরু করেছে ইতিমধ্যে। আজ এই প্রসঙ্গেই আলোচনায় থাকছে থাইল্যান্ডের একটি প্রত্নক্ষেত্র। এই থাই প্রত্নক্ষেত্রে অনুসন্ধান আরম্ভ হয় আমেরিকান সাহায্যে। এখনও সেই সাহায্য বজায় আছে। তবে আমেরিকান বিজ্ঞানীদের সাথে কাজ করতে করতে একঝাঁক থাই বিজ্ঞানীও প্রভূত দক্ষতা অর্জন করে ফেলেছেন ইতিমধ্যে।


বান-চিয়াং প্রত্নক্ষেত্র

এই প্রত্নক্ষেত্রের গুরুত্ব হলো এখানে বহমান জীবনধারা, যা শিকারি-সংগ্রাহক থেকে আধুনিক কাল অবধি বিস্তৃত; যদিও ধারাবাহিকভাবে নয়। তবু পাথরের হাতিয়ার দিয়ে শুরু করে হাড়ের, ব্রোঞ্জের হাতিয়ার হয়ে লোহার হাতিয়ার তৈরিতে উত্তরণ ঘটেছিল এই বান-চিয়াংয়ের। প্রত্নক্ষেত্রটিতে মানব বসতির ও কর্মকান্ডের ধারাবাহিকতা না থাকার কারণ এখানে কালে কালে ভিন্ন ভিন্ন জনগোষ্ঠীর আগমন ও নির্গমন।

মেকং নদীর বৃহত্তর অববাহিকার অন্তর্গত বলা যেতে পারে উত্তর-পূর্ব থাইল্যান্ডের উদোন-থানি প্রদেশের নঙ-হান জেলায় (ভিয়েতনামের কাছাকাছি) এই বান-চিয়াং প্রত্নক্ষেত্রটিকে। প্রত্নক্ষেত্রটির আয়তন ৬৭.৩৬ হেক্টর। তবে ২০১২ সন অবধি খনন কাজ হয়েছে মাত্র ০.০৯ শতাংশ এলাকায়। সাধারণ পূর্বাব্দ ১৪৯৫ থেকে সাধারণ পূর্বাব্দ ৯০০ অবধি অবিচ্ছিন্ন মানববসতি চলতে থাকা এই প্রত্নক্ষেত্রটির গুরুত্ব বেশি কারণ এখানেই দেখা যায় প্রাগৈতিহাসিক কালের শিকারি-সংগ্রাহক জীবনযাত্রা থেকে পশুপালক হয়ে ধান চাষ দিয়ে কৃষিকাজের আরম্ভ। শুধু তাই নয়, এরপরের ধাপে একেবারে জলজমা জমিতে ধান চাষের দেখাও এখানে পাওয়া যাবে। বিগত হাজার বৎসর আগে প্রকৃতি বিরূপ হলে এখান থেকে লোকেরা সরে যায়। পরিত্যক্ত বান-চিয়াংয়ের প্রাচীন বসতিটি ক্রমে ধুলো, মাটি আর আগাছার স্তরে ঢাকা পড়ে যেতে থাকে। এর ভালো দিকটা হলো এরই ফলে এলাকাটির প্রাচীন স্তর মাটির নীচে সুরক্ষিত থেকে যায়। দীর্ঘকাল পরিত্যক্ত থাকার পরে মাত্র দুই’শ বৎসর আগে এখানে আবার লোকবসতি শুরু হয়। শুরু হয় কৃষিকাজ। এখানে পাওয়া পোড়া মাটি ও ধাতব দানসামগ্রী সমৃদ্ধ, বহু কবরের বড়োসড়ো কবরখানাটির দেহাবশেষগুলো এখানকার মানুষদের সামাজিক বিবর্তনের ধারাবাহিক ইতিহাস ধরে রেখেছে। বান-চিয়াং প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে আধুনিক কাল অবধি মানব সমাজের বিবর্তনের প্রতিটি ধাপের তথ্য জমা করে রেখেছে। এখন শুধু আমাদের দায়িত্ব তা খুঁজে বের করা আর আধুনিক বিজ্ঞানের সাহায্যে সেই গোপন কথা বুঝে নেওয়া।

প্রত্নক্ষেত্রটি প্রথম নজরে আসে আচমকাই। ১৯৬৬-তে স্টিভ ইয়ং নামের হার্ভার্ড কলেজের এক রাজনীতির ছাত্র তাঁর পি. এইচ. ডি. গবেষণার কাজে বান-চিয়াং গ্রামবাসীদের সাথে কথা বলতে এসেছিলেন, সাথে সাহায্যকারী হিসাবে ছিলেন স্থানীয় স্কুলের শিল্পকলার শিক্ষক।

বান-চিয়াংয়ে তখন সরকারী উদ্যোগে রাস্তা বানানোর জন্য মাটি কাটা চলছিল। সেই রাস্তায় যেতে যেতে হঠাৎ স্টিভের চোখে পড়ে, খোঁড়া মাটির স্তূপে, রাস্তার উপরই পড়ে থাকা লাল রঙের নক্সা করা পোড়ামাটির বাসনের কয়েকটি টুকরো। কয়েকটি বাসনের টুকরো স্টিভ হাতে তুলে নিলেন। দেখলেন, বাসনের পোড়ানোটা মোটেই দক্ষকাজের নমুনা নয় ঠিকই, কিন্তু এমন নক্সাও তিনি আগে কোথাও দেখেননি। অনুমান করতে পারেন এই মাটির বাসন প্রাচীন তো বটেই, সম্ভবত অতিপ্রাচীন। থাইল্যান্ডে প্রাচীন মানববসতির অস্তিত্বের একটা আভাস স্টিভের জানা থাকলেও এখানকার কথা বিশদে কিছুই জানা ছিল না। আর বাস্তবে তিনি থাইল্যান্ডের প্রাচীন ইতিহাসের কিছুই জানতেন না। সঙ্গে থাকা স্থানীয় শিল্পকলা শিক্ষকও কিছুই জানেন না। স্টিভ মাটির বাসনের টুকরোগুলো নিয়ে গেলেন ব্যাঙ্ককে। দেখালেন থাই সরকারের ফাইন আর্ট বিভাগে। বিভাগের বিদ্বজনেরা সেগুলোর তুলনামূলক যাচাই করলেন ভারত আর চিনের ঐতিহাসিক ও প্রাগৈতিহাসিক মাটির বাসনের আকৃতি আর নক্সার সাথে। না কারুর সাথেই মিল নেই। স্টিভের দেওয়া নমুনাগুলো একেবারেই ভিন্ন শৈলীর। এর অর্থ এগুলো থাইল্যন্ডের নিজস্ব ইতিহাসের হয়ত বা প্রাগিতিহাসের অংশ। গুরুত্ব অনুমান করে টুকরোগুলো পাঠানো হলো আমেরিকার পেন্সিলভেনিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে, উদ্দেশ্য এগুলোর প্রকৃত বয়স জানা।

নমুনাটির বয়স বের হলো আনুমানিক ছয় হাজার বৎসর আগেকার। থাইল্যান্ডের প্রাগিতিহাস। দ্রুত, সেই বৎসরেই, অর্থাৎ ১৯৬৬ সালেই, পেন্সিলভেনিয়া বিশ্ববিদ্যালয় আর থাই ফাইন আর্টস বিভাগ নেমে পড়ল কাজে। প্রথম বৎসরেই বের হলো অজস্র মাটির বাসন, নানা আকারের, নানা নক্সার। সাথে বের হলো বেশ কয়েকটি কঙ্কাল সহ কবর, আর ব্রোঞ্জের নানা জিনিস এবং লোহার জিনিসও। খনন কাজে বের হওয়া প্রত্নক্ষেত্রটির নিম্নতম স্তরে কিন্তু ব্রোঞ্জের দেখা পাওয়া গেল না। যেহেতু সর্বনিম্ন স্তরে ব্রোঞ্জের কিছুই নেই তাই সহজেই বোঝা গেল প্রত্নক্ষেত্রটি কেবল মাত্র ব্রোঞ্জ যুগ থেকে লৌহ যুগের নয়, একেবারে নব্যপ্রস্তর যুগের মানুষদের আমল থেকেই এটি মানব বসবাসের এলাকা।

বান-চিয়াং প্রত্নকাল নির্ণয়

১৯৬৬ সালে প্রথমবারে যে সব নমুনা আর তার বয়স বের হলো সেটা কিন্তু বেশিদিন টিকলো না। ১৯৭৪-৭৫ সালে অনেক বড়ো করে খনন কাজ হলে আগেকার অনেক ধারনাই দ্রুত বদলে গেল। নতুন খননে অনেক বেশি পরিমাণে প্রত্নসামগ্রী পাওয়ায়, তাদের বয়স বের করা হলো। এই নতুন করে করা কার্বন ১৪ পরীক্ষায় পাওয়া ভিন্ন ভিন্ন ফল বিতর্কের সৃষ্টি করে। প্রথমে করা থার্মোল্যুমিসেন্স পরীক্ষায় বয়স বের হয়েছিল ৪২০০ থেকে ৩৪০০ সাধারণ পূর্বাব্দ। পরের আরেক প্রস্থ খননে পাওয়া প্রত্ন সামগ্রীর বয়স বের হল ১৪৯৫ সাধারণ পূর্বাব্দ। আবার আরেক দফায় তারও পরের নমুনাগুলো থেকে বয়স বের হল ২১০০ সাধারণ পূর্বাব্দ থেকে ২০০ সাধারণ পূর্বাব্দ। অবশেষে আগের পরের, সব মিলিয়ে একটা মোটামুটি সর্বসম্মত কালস্তর ঠিক করা হলো। এই সর্বসম্মতভাবে বান-চিয়াং প্রত্নক্ষেত্রটিকে মূলত ছয়টি কালস্তরে ভাগ করা হয়েছে।

১. পর্যায়ঃ প্রাথমিক – স্তরঃ নিম্মতম – কালঃ ৪৪০০ সাধারণ পূর্বাব্দ

পাওয়া গেছেঃ বসবাসের জন্য বিশাল এলাকার বন। আগুনে পোড়ানোর পরে বসতি শুরু হলেও তা ধারাবাহিক বসতি হয়নি। ধারাবাহিক বসতির শুরু হয় আরও দুই হাজার বৎসর পরে। সম্ভবত ২১০০ সাধারণ পূর্বাব্দ থেকে।

২. পর্যায়ঃ প্রারম্ভিক-প্রথম – কালস্তরঃ ১২, ৩, ৪ – কালঃ ২১০০-১৫০০সাধারণ পূর্বাব্দ।

পাওয়া গেছেঃ শিকারি-সংগ্রাহক জীবনযাত্রা। তারই সাথে পশুপালন ও কৃষিকাজের আরম্ভ এবং ধান চাষের সূচনা। ব্রোঞ্জের ব্যবহারও এই পর্যায়েরই তৃতীয় স্তর থেকে শুরু হয়।

৩. পর্যায়ঃ প্রারম্ভিক-দ্বিতীয় – কালস্তরঃ ৫ – কালঃ ১৫০০-৯০০ সাধারণ পূর্বাব্দ।

পাওয়া গেছেঃ শিকারি-সংগ্রাহক জীবনযাত্রা। কৃষিকাজ, পশুপালন। বনাঞ্চল ধীরে ধীরে বাড়ছে। সম্ভবত পর্যাপ্ত বৃষ্টির সুফল। দড়ির ছাপ দেওয়া মাটির বাসন বানানো হচ্ছে এই কালস্তরে।

৪. পর্যায়ঃ মধ্যবর্তী – কালস্তরঃ ৬৭৮ – কালঃ ৯০০-৩০০ সাধারণ পূর্বাব্দ।

পাওয়া গেছেঃ গৃহপালিত পশুর মধ্যে মোষের প্রাধান্য। বনাঞ্চলের এলাকা বৃদ্ধি। বিচ্ছিন্ন বনাঞ্চলে ঘনঘন আগুন লাগানো হচ্ছিল জনবসতি বাড়াবার জন্য। লোহার ব্যবহার শুরু হয়ে গেছে। লাল রঙে নক্সা করা মাটির বাসন পাওয়া গেছে।

৫. পর্যায়ঃ অন্তিম – কালস্তরঃ ৯ ও ১০ –  কালঃ ৩০০-২০০ সাধারণ পূর্বাব্দ।

পাওয়া গেছেঃ জলাজমিতে ধান চাষ।

.

Ban Chiang Clay Jar, Ban Chiang, north-eastern Thailand, 1st millennium B.C.E. © Trustees of the British Museum

বান-চিয়াং,মাটির বাসন

বান-চিয়াং প্রত্নক্ষেত্র খননের পরে কাছাকাছি আরও কয়েকটি প্রত্নক্ষেত্র থেকে পাওয়া গেল বিশাল পরিমাণে মাটির বাসন। গোটা, ভাঙ্গা সব মিলিয়ে আনুমানিক সাত টন। এই বাসনগুলো পোড়ানোয় দক্ষতার অভাব ছিল। বদ্ধ ভাটির বদলে মাটির বাসনকে একত্রে জড় করে সেগুলো ঘিরে আগুন জ্বালিয়ে দেওয়া হতো। ফলে বাসনের সবদিকে সমান তাপ লাগত না। অনেক বাসনই খুব কম তাপ পেত। আবার অনেক বাসন বেশি তাপে ঝামা হয়ে যেত। দক্ষতার অভাব কেবল পোড়ানোতেই নয়, বানানোতেও ছিল। বাসন বানাবার কুমোরচাককে ঘোরাবার কৌশল জানা না থাকায় কুমোর নিজেই বাসনের চারপাশে ঘুরত। এই প্রাচীন পদ্ধতি হারিয়ে যায়নি। এখনও ঐ এলাকার অনেক গ্রামে দেখা যাবে। বাসন পোড়ানোর পরে পশুর লোমে বানানো তুলি দিয়ে রঙিন নক্সা করা হতো। এই নক্সা করা মাটির বাসন কিন্তু রান্নার কাজে লাগানো হতো না। রান্না জন্য ছিল নক্সা না করা সাদামাটা বাসন।

১৯৬৬-তে স্টিভ ইয়ংয়ের আগে এইসব বাসন কেউ দেখেনি এমনটা না। বহুকাল ধরেই ঐ এলাকায় মাটি খুঁড়লেই নক্সাকরা বাসন বের হয়ে আসত। স্থানীয় লোকেরা সেগুলো গৃহপালিত কুকুর মুরগীর খাবার দেবার কাজে অহরহ ব্যবহার করত। কিন্তু বান-চিয়াংয়ের অতীত কথা প্রচার হবার সাথে সাথে শুরু হয়ে গেল চোরা চালান। বাসনের টুকরো চলে যেত সোজা আমেরিকা। অনেক সময় চোরা চালানকারীরা ধরা পড়লেও লম্বা সময় ধরে মামলা চলতে থাকায় মামলা শেষ হবার আগেই দোষীরা প্রাকৃতিক নিয়মেই বৃদ্ধ হয়ে পরলোকে চলে যেত। শুধু একবার চোরাই জিনিস কেনার অপরাধে আমেরিকার এক সংগ্রহালয়ের প্রধানের দেড় বৎসর কারাদণ্ড হয়। সেই মামলার ফলে থাইল্যান্ডে ফেরৎ আসে সম্পর্কিত চোরাই জিনিষগুলো।


Ban Chiang Bronze: UNESCO whc.UNESCO.org

বান-চিয়াং,  ব্রোঞ্জ ও লোহা

কিছুকাল আগেও পশ্চিমের দেশগুলোর বেশিরভাগ বিশেষজ্ঞের ধারনায় দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে ব্রোঞ্জের ব্যবহার শুরু হয়েছে অনেক পরে। পৃথিবীর অন্য সব দেশে যখন ব্রোঞ্জ যুগ শেষ হয়ে লৌহযুগ শুরু হয়েছে তখন। কিন্তু বান-চিয়াং ব্রোঞ্জের নমুনাগুলোর বয়স স্থির হলো গড়ে ২০০০ সাধারণ পূর্বাব্দ, যা হরপ্পা সভ্যতার অবসানের ঠিক পরে পরে। এছাড়াও বান-চিয়াং-এর সূক্ষ্ম কারুকাজ করা ব্রোঞ্জের গয়নার বয়স ১৬০০ সাধারণ পূর্বাব্দ ধরা হয়।

বান-চিয়াং-এর কবরে থাকা ব্রোঞ্জের গয়না বা অন্য সব জিনিষের বয়স প্রথমে ধরা হয় ১৬০০ সাধারণ পূর্বাব্দ। এই বয়স নির্ধারণ হয় কবরে থাকা কাঠকয়লার টুকরো থেকে। তখন অনুমান করা হয়েছিল এই ব্রোঞ্জ এসেছে চিন থেকে। ১৬০০ পূর্বাব্দের শ্যাঙ রাজবংশের রাজত্বকালে। কিন্তু পরবর্তীকালে, ১৯৭৪-৭৫ সালে, কবরের বাইরে পাওয়া কয়েকশত ব্রোঞ্জের নমুনার সংলগ্ন কাঠকয়লা আর মাটির বাসনে লেগে থাকা ধানের পোড়া তুষ থেকে একাধিক পরীক্ষা চালিয়ে বয়স নির্ধারণ হয় ২৩০০-১৫০০ পূর্বাব্দ। যেহেতু নিম্নতম স্তর ২৩০০ পূর্বাব্দে কেবল তামা ছিল তাই তার উপরের স্তর, ২০০০ পূর্বাব্দ বা তার সামান্য কিছু পরের, সময়কেই বান-চিয়াং-এর ব্রোঞ্জের বয়স বলে ধরা হয়। অত আগে শ্যাঙ রাজবংশের ব্রোঞ্জ এখানে আসার কোন সম্ভাবনাই নেই। কাজেই এবার ভাবতে হলো, বান-চিয়াং নিজেই তার নিজস্ব ব্রোঞ্জ উৎপাদন করত। কিন্তু তার জন্য প্রয়োজনীয় প্রমাণ অধরা ছিল। শেষ অবধি বান-চিয়াংয়েই খুঁজে পাওয়া গেল ব্রোঞ্জ গলানোর নানা প্রমাণ। তার সাথে চিনের ব্রোঞ্জ আর বান-চিয়াং এর ব্রোঞ্জ তৈরিতেও পদ্ধতিগত পার্থক্য বের হবার পরে নিশ্চিত হওয়া গেল বান-চিয়াং নিজেই নিজের ব্রোঞ্জ উৎপাদন করত। বান-চিয়াংয়ে কোন কেন্দ্রীয় এলাকায় বড়ো করে ব্রোঞ্জ তৈরি হতো না। আশপাশের নানা এলাকায় ছোটো ছোটো চুল্লিতে তামা নিষ্কাশন হতো। তারপরে সেই তামা এনে আলাদা করে টিন মেলানো হতো বলে অনুমান। তবে এই টিনের সঠিক উৎস ও আনা নেওয়ার পথের কোন হদিস এখনো পাওয়া যায়নি।

অর্থাৎ থাইল্যান্ডের ব্রোঞ্জ যুগ  হলো মোটামুটিভাবে পরিণত হরপ্পা সভ্যতার অন্তিমকাল। ভারতে অনেকে বিশ্বাস করতেন বা করেন, হরপ্পা সভ্যতার ব্রোঞ্জ আসতো থাইল্যান্ড থেকে, তাম্রলিপ্ত হয়ে। তারপরে নৌপথে গঙ্গার নদী হয়ে, হরপ্পা সভ্যতার মহেঞ্জোদারো, হরপ্পা এবং রাখিগড়িতে যেত সেই থাই ব্রোঞ্জ। অতীতে ১৯৭৫-৭৬ সালের আগে বান-চিয়াং তথ্য অবশ্য অজানা ছিল। তাই ভুল ধারনার অবকাশ ছিল তখন। কিন্তু এখন আমাদের বান-চিয়াংয়ে পাওয়া তথ্যগুলো মাথায় রাখতে হবে।

বান-চিয়াং-এ লোহার ব্যবহারও ছিল। মোটামুটি গোটা পৃথিবীতেই ১২০০ থেকে ৮০০ পূর্বাব্দের মধ্যে লোহার ব্যবহার ছড়িয়ে পড়েছিল। কাজেই বান-চিয়াং-এ লোহা না আসার তেমন কোন কারণ ছিল না। নানা কাজেই যথাবিহিত লোহার ব্যবহার হতো এখানে। তবে সবচেয়ে কৌতূহলজনক ব্যাপার হলো এখানে আমদানি করা লোহাকে শুরুতে ব্রোঞ্জের চেয়েও মূল্যবান ধাতু হিসাবে গণ্য করা হতো। এতটাই মূল্যবান ধরা হতো যে ব্রোঞ্জের গয়নার উপরে লোহার কারুকাজ চাপানো হতো।

বান-চিয়াং-এর জীবনধারা

বান-চিয়াং দিয়ে শুরু করে ক্রমে আরও বেশ কয়েকটি প্রত্নক্ষেত্র বের হবার পরে বোঝা গেল থাইল্যান্ডের বেশ অনেকটা বড়ো এলাকা জুড়ে বিস্তৃত ছিল একটি প্রাচীন সংস্কৃতির। তবে সেই সংস্কৃতির লোকেদের বাসস্থান বা দৈনন্দিন সামাজিক জীবনযাত্রার প্রায় কোন চিহ্নই নেই এখন। ফলে তাদের সভ্যতার প্রকৃত ও যথাযথ ঐতিহাসিক মূল্যায়ন সম্ভব না। বাসস্থানের জন্য স্থানীয় ভাবে সুলভ বাঁশই ছিল প্রধান উপাদান। স্বভাবতই বাঁশ কয়েক হাজার বৎসর পরে মাটির নীচে পাওয়া যাবে না। তবে বিজ্ঞানীরা অনুমান করেন বর্তমানে বহুল প্রচলিত পদ্ধতিতেই অতীতেও বাসগৃহ ছিল বাঁশের খুঁটিতে উঁচু করে বানানো মাচান ঘর বা টঙঘর। ব্যবহারের পর মাটির বাসন তারা ফেলে দিত উঁচু ঘরের মেঝে থেকে নীচের মাটিতে। সেখানে দিনভর ঘোরাঘুরি করে নানা পশু, মূলত শুকর। তাদের পায়ের চাপে বাসন হয়ে যেত টুকরো টুকরো। তারই ফলে সংগ্রহের ঝুলিতে বিপুল পরিমাণে বাসনের ভাঙ্গা টুকরো জমা হয়েছে।

বান-চিয়াংয়ের অর্থনৈতিক জীবনে মাটির বাসনের গুরুত্ব সম্ভবত বেশ বেশিই ছিল। হয়ত ব্যবসায়িক উৎপাদন কেন্দ্রই ছিল এটা। গোটা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় বাঁশের প্রাচুর্য থাকায় দৈনন্দিন জীবনযাত্রায় মাটির বাসনের বদলে বাঁশের ব্যবহারই হতো বেশি, যা এখনও এই আধুনিক যুগেও যথেষ্ট চালু আছে। তারই মধ্যে বান-চিয়াংয়ের নক্সা করা মাটির বাসন চমকপ্রদ তো বটেই। বিপুল চাহিদা না থাকলে এমন জিনিসের উৎপাদন শত শত বৎসর ধরে চালু থাকতো না। তাই অনুমান, সম্ভবত বান-চিয়াং ছিল মাটির বাসনের অন্যতম প্রধান উৎপাদন কেন্দ্র।

বান-চিয়াংয়ের আরেকটি ব্যবসায়িক উৎপাদন সম্ভবত ছিল লবন উৎপাদন। এখানে কিছু এলাকায় মাটিতে মিশে আছে বিপুল পরিমাণে লবন। এখনও লোকেরা মাটিকে ছয় ঘন্টা জলে ফুটিয়ে লবন বের করে। তারপরে সেই লবন বিক্রি করে স্থানীয় হাটে। লবন উৎপাদনের এই পদ্ধতি এখনও চালু আছে নাগাল্যান্ডের প্রত্যন্ত গ্রামে।

বান-চিয়াং-এর লোকেরা গোড়াতে স্বাভাবিক নিয়মেই শিকারি-সংগ্রাহক ছিল। তবে পরে তারা কৃষিকাজ যে করত তা নিশ্চিত। এখানে ধান পাওয়া গেছে। তার সাথে এটাতো জানাই আছে যে ১১ হাজার বৎসর আগে থেকেই ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া, থাইল্যান্ডে প্রাথমিক কৃষিকাজ হিসাবে ফল, সবজির চাষ আর পশুপালন শুরু হয়ে গিয়েছিল। থাইল্যান্ডের স্পিরিট কেভ-এ পাওয়া গেছে নানা সবজি আর ফলের বীজ, যা নিয়মিত চাষযোগ্য ছিল। ধান সে তুলনায় অনেক অনেক পরে আসে। এখানে পাওয়া পুতুলাকৃতি পশুর মূর্তির মধ্যে মোষের আধিক্য দেখে সহজেই বোঝা যায় মোষ ছিল এদের প্রধান পশু।

বান-চিয়াং-এর কবর ও কঙ্কাল

৩৬০০ সাধারণ পূর্বাব্দ থেকে ২০০ সাধারণাব্দ, এই চার হাজার বৎসরের কবর রয়েছে এখানে। নানা কালস্তরের মোট ১৪২টি কবর ও কঙ্কাল বের করা হয়েছে। একেবারে শিশু থেকে ৫০ বৎসরের পূর্ণবয়স্ক সবারই দেহাবশেষ রয়েছে এই কবরগুলোতে। পাওয়া গেছে ৫৪ জন পূর্ণবয়স্ক পুরুষ আর ৩৯ জন পূর্ণবয়স্কা নারীর কঙ্কাল। আরেকটা বিচিত্র তথ্য হলো প্রথমদিকের কবরগুলোতে সদ্যতরুণ ও শিশুদের কঙ্কাল ছিল ১৮টি অথচ পরেরদিকে সেই সংখ্যা কমে দাঁড়ায় ১০। হতে পারে কৃষিকাজের পরের উন্নত জীবনধারা শিশুমৃত্যুর হার কমিয়ে দিয়েছিল। এমনিতে মৃত্যুকালীন গড় বয়স ছিল ৩১ বৎসর। তবে আলাদা করে শুধু বয়স্কদের নিয়ে আরেকটি গড়ের হিসাবে এই বয়স দাঁড়ায় ৪৬ বৎসর। সময়ের পর্যায় ভাগ করলে দেখা যায় প্রাচীনদের গড় আয়ু ছিল ২৭ বৎসর আর পরের দিকে সেই আয়ু বেড়ে হয় ৩৪ বৎসর। এই প্রথমদিককার কম গড় আয়ুর কারণ হিসাবে বলা হয়েছে, প্রাচীনকালে বালক ও সদ্য কিশোরদের অত্যধিক বেশি হারে মৃত্যু।

বর্তমানের থাইল্যন্ডের বাসিন্দাদের সাথে তুলনা করলে বান-চিয়াং-এর কবরের লোকেরা লম্বায় বেশি ছিল। বর্তমানের থাইবাসীদের গড় উচ্চতা ১৫০ থেকে ১৫৭ সেঃ মিঃ। আর অতীতের কবরের লোকেদের উচ্চতা ছিল ১৬৫ থেকে ১৭৫ সেঃ মিঃ। অনেক অনেক ফারাক। এই বিশাল ফারাক বলে এটা শুধু খাদ্য-পুষ্টির বিষয় নয়, এটা ছিল জনগোষ্ঠীর নৃতাত্ত্বিক ভিন্নতারও সূচক। আগেকার লোকেরা কেবল লম্বায় বেশি ছিল না, তারা দৈহিক গঠনেও বর্তমানের চেয়ে বলিষ্ঠতর ছিল। প্রাচীনদের মুখের গড়ন ছিল চওড়া কপাল, মুখমন্ডল কিছুটা চাপা ও চওড়া। ছোট অক্ষিকোটর একটু উপরের দিকে, হনু উঁচু। মাথার খুলি বড়ো। তবে এখানেও একটি বৈশিষ্ট্য হলো পুরুষদের তুলনায় মেয়েদের খুলি চওড়া আর উপরের দিকেও বড়ো। তা হলেও মেয়েদের গড়পড়তা খুলি ছিল সুগঠিত গোলাকারই।

বান-চিয়াং এর কবরের লোকেদের দাঁতের বৈশিষ্ট্য বলতে প্রথমেই চোখে পড়বে তাদের উপরের আক্কেল দাঁত বেশ অনেকটা বড়, অথচ আর সব দাঁত ছোটোই। এটা একেবারেই চমক দেবার মত। বান-চিয়াংএর বাইরে এই জিনিস এখনও চোখে পড়েনি। তাদের গজদাঁতের আকার অনেকটা কোদালের মত। তবে সবার আগে যেটা চোখে পড়বে তা হলো সবসময় সুপারি চিবানোর জন্য দাঁতের রঙ বদলে যাওয়া। এই সারাদিন সুপারি চিবানোটা বর্তমানের লোকরাও চালিয়ে যাচ্ছে। সুপারি পাওয়া গেছে ১১০০০ বৎসর আগের থাইল্যন্ডের স্পিরিট কেভে। সেই সুপারিও ছিল রীতিমত কৃষিজাত। এছাড়াও এই প্রাচীন লোকেদের খাদ্য তালিকায় এমন আরও কিছু শক্ত জিনিস থাকত যা চিবোতে গিয়ে দাঁতের ক্ষয় হতো অতি দ্রুত। সেই ক্ষয় থেকে দাঁতের নানা রোগে তাদের নাজেহাল হতে হতো। তার সাথে ভাত খেয়ে দাঁতের ক্ষয় (ক্যাভিটি) তো আছেই। ফলে ২৭ বা ৩১ বা ৩৪, অত কম বয়সে মারা যাবার সময়ও তাদের অর্ধেক দাঁত নেই হয়ে যেত।

বান-চিয়াংবাসীদের ছিল হাড়ের সন্ধির ব্যাথা। আর ছিল হাড়ের ফোঁড়ার মত ফুলে যাওয়ার রোগ, বিশেষ করে পায়ের হাড়ে। অবশ্যই এগুলো একরকম হাড়ের টিউমার। বিজ্ঞানীরা ধারনা করেন তারা যেহেতু সারাদিন উবু হয়ে বসে থাকত তার থেকেই এই রোগের উৎপত্তি। তবে খুব বড়ো রকমের হাড়ের ক্ষয় রোগের লক্ষণ বিশেষ পাওয়া যায়নি। তারই সাথে যক্ষ্মারোগ জনিত হাড়ের ক্ষয় রোগ ছিল কিনা তা ভালো করে দেখে নিশ্চিত হওয়া গেছে বান-চিয়াংবাসীদের যক্ষ্মারোগ ছিল না। তবে পড়শি নন-নক-থা প্রত্নক্ষেত্রের কবরস্থ লোকেদের মধ্যে কিন্তু যক্ষ্মারোগের লক্ষণ পাওয়া গেছে।

প্রাচীন বান-চিয়াংবাসীর রোগের তালিকায় আছে রক্তাল্পতা। তারই ফলে ছিল অস্টিওপোরোসিস। শুধুই রক্তাল্পতা না থ্যালাসেমিয়াও ছিল? বর্তমানে স্থানীয়দের মধ্যে থ্যালাসেমিয়া ও রক্তাল্পতা দুইই আছে। এর একটা কারণ ম্যালেরিয়া রোগ প্রতিরোধকারী একটি রক্তকণিকার মিউটেশন (Hb-E)। অনুমান করা হয় এই মিউটেশনটির উৎপত্তি মেঘালয়ের খাসি সম্প্রদায়ের থেকে। যদি এই রক্ত কণিকার মিউটেশন সাড়ে চার হাজার বৎসর অতীতের বান-চিয়াংবাসীদের মধ্যে থাকে তবে ভাবতে হয় মেঘালয়ের খাসিরা তারও বহু আগে মেঘালয়ে বসতি গড়েছিল। কারণ এই মিউটেশনটি যে মেঘালয় থেকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া গেছে তা নানা পরীক্ষার মাধ্যমে ইতিমধ্যে নিশ্চিত ভাবে প্রতিষ্ঠিত। এবার বান-চিয়াংবাসীদের খুলিতে যে পরিবর্তন পাওয়া গেছে তাতে বিজ্ঞানীরা প্রায় নিশ্চিত যে তাদের অনেকেরই ম্যালেরিয়া রোগ ছিল। যেহেতু ম্যালেরিয়া রোগ ছিল তাই মেঘালয় থেকে মিউটেশন এইচ.বি-ই এখানে প্রয়োজনবোধেই স্বাগত হবে। কারণ এইচ.বি-ই মিউটেশন বাহকদের সুস্থ থাকার ও বেঁচে থাকার সম্ভাবনা অনেক বেশি। আবার মিউটেশন এইচ.বি-ই মানেই তো রক্তাল্পতা ও সম্ভাব্য থ্যালাসেমিয়া। খাসিদের মধ্যে ও উত্তর-পূর্ব ভারতের নানা ট্রাইবসের মধ্যে রয়েছে মিউটেশন এইচ.বি-ই। তাই তারা ম্যালেরিয়া রোগে ভোগে না। কিন্তু ভোগে রক্তাল্পতায়। এই মিউটেশন এইচ.বি-ই কিন্তু উত্তর-পূর্ব ভারতের সমতলবাসী উচ্চবর্ণের লোকেদের মধ্যে নেই। উত্তর বাংলায় আছে কেবল টোটো সম্প্রদায়ের মধ্যে।

বান-চিয়াংবাসীদের সম্ভবত বড়ো টিউমারও হতো। কয়েকটি বড়োসড়ো ব্রেন টিউমার ও ঘাড়ে টিউমার হবার প্রমাণ পাওয়া গেছে তাদের কবরের কঙ্কাল থেকে।

বান-চিয়াংয়ের কবরগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য একজন শিকারির কঙ্কাল। চার হাজার বৎসর আগের কবর। বেশ লম্বা ও বলিষ্ঠদেহের অধিকারী শিকারিকে কবর দেওয়া হয়েছিল একজন প্রকৃত শিকারির মত করেই। তার বাম হাতে হাড়ের ফলার বর্শা, বাঁ কাঁধে রাখা হরিণের ঝাঁকড়া সিং, মাথায় হাড়ের পিন, বোধহয় লম্বা চুল আটকে রাখার জন্য, আর গলায় বাঘ নখের নেকলেস।

বান-চিয়াংয়ের কবরগুলোতে মৃতদেহ রাখা হতো টানটান করে। মৃতের কবরে দেওয়া হত নানা দানসামগ্রী। দানসামগ্রীর মধ্যে ছিল নক্সা করা মাটির বাসন, মাটির পুঁতি, হাড়ের নিত্য ব্যবহার্য সরঞ্জাম ও অস্ত্র, ধাতুর কুড়াল, বর্শার ধাতব ফলা, হাতের চুড়ি-বালা, পায়ের মল, আর থাকতো নানা পশুর, যথা শুয়োর-গরু-মোষের মাথা আর পায়ের টুকরো। এই সব দানসামগ্রী মৃতের পারলৌকিক জীবনের কথা ভেবে দেওয়া না শুধুই মৃতের প্রিয় বলে সেগুলো তার সাথেই কবর দিয়ে দেওয়া, সেটা আমাদের উর্বর কল্পনার অঙ্গ হতে পারে, তবে নির্দিষ্ট করে কিছু বলা কঠিন।

বান-চিয়াং কবরে শায়িত লোকেদের কঙ্কাল পরীক্ষার পরে বিজ্ঞানীরা মোটামুটি একমত যে দীর্ঘ চার হাজার বৎসর ধরে এই লোকেরা শান্তিতে জীবনযাপন করেছে। কোন কঙ্কালে কোন বড়ো আঘাতের চিহ্ন নেই। এই একটি তথ্যই আমাদের বলে বান-চিয়াংবাসীরা প্রকৃত অর্থে সভ্য মানবিক সমাজের পত্তন করতে সক্ষম হয়েছিল।

বান-চিয়াংয়ের কবরে একজন পূর্ণবয়স্ক পুরুষের প্রায় পূর্ণাঙ্গ কঙ্কাল পাওয়া গেছে। ৪৫-৫০ বৎসর বয়স্ক ১৭৫ সেঃ মিঃ লম্বা পুরুষটির দৈহিক গঠনও ছিল বলিষ্ঠ। টানটান করে রাখা পুরুষটির আলাদা করে উল্লেখ করতে হলো কারণ তার বাম হাতে ছিল তিনটি ব্রোঞ্জের বালা। বালা চুড়ির মত গয়না মেয়েদের কঙ্কালেই পাওয়া গেলেও এই পুরুষের হাতে থাকাটা উল্লেখযোগ্য। তবে কি বান-চিয়াং পুরুষরা হাতে চুড়ি পরত? সন্দেহ দুর করার জন্য তার দাঁতের আইসোটোপ পরীক্ষা করা হল। সেই পরীক্ষায় দেখা গেল, না লোকটি স্থানীয় নয়, সে বহিরাগত।

(A) অস্ট্রোএশিয়াটিক, বৃহত্তর ফিলোজেনেটিক প্রসঙ্গ  (B) অস্ট্রোএশিয়াটিক ক্ল্যাড।
সম্পর্ক জোড়া দেওয়া লাইনগুলোর দৈর্ঘ্য সম্পর্কগুলোর জেনেটিক দূরত্বের সমানুপাতিক নয়।চিত্র কৃতজ্ঞতাঃ Science, 6th July 2018 361(6397):92-95

বান-চিয়াং জেনেটিক্স

যখন বান-চিয়াং এর কবরগুলো খোঁড়া হয় তখনও প্রাচীন ডি.এন.এ. সংগ্রহের আধুনিক পদ্ধতি জানা ছিল না। ফলে এই সব কঙ্কালের ডি.এন.এ. তখন সংগ্রহ হয়নি। কঙ্কালগুলো সব কটাই পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল হাওয়াই বিশ্ববিদ্যালয়ে। ফলে বান-চিয়াং এ বসতি স্থাপন করেছিল কোন জনগোষ্ঠী, এই প্রাথমিক প্রশ্নের উত্তর অধরা ছিল। কঙ্কালের খুলির মাপ, দাঁতের গঠন এসব থেকে জনগোষ্ঠীর প্রাথমিক পরিচয়ের একটা আভাস পাওয়া গেলেও প্রকৃত পরিচয় অধরাই থেকে যায়। তখন এটুকু জানা হলো যে বর্তমানের বান-চিয়াং এলাকার বাসিন্দারা বেশির ভাগই কম্বোডিয়া এলেওবান-চিয়াং কবরের প্রাচীন লোকেদের সাথে তাদের নৃতাত্ত্বিক নৈকট্যের কোন প্রমাণই নেই। কঙ্কালের মাপ থেকে তখন বোঝা গিয়েছিল যে, বান-চিয়াং-এর বাসিন্দাদের সাথে থাইল্যন্ডের অন্য দু’টি প্রত্নক্ষেত্র বান-কাও আর নন-নক-থা-এর প্রাচীন বাসিন্দাদের সম্পর্ক একটু দুরের। তুলনায় বেশি নৈকট্য নিওলিথিক লাও ও নিওলিথিক ভিয়েতনামবাসীদের।

আমাদের সৌভাগ্য যে পরবর্তীকালে, ডি.এন.এ. সংগ্রহ করে জেনেটিক বিশ্লেষণ করা সম্ভব হয়েছে। এই জেনেটিক বিশ্লেষণ আগেকার কঙ্কালের মাপ নিয়ে করা কিছু ধারনাকে ভুল বলে প্রমাণ করছে। জেনেটিক তথ্যের জন্য ডি.এন.এ. সংগ্রহের কাজ অবশ্য শুধুই বান-চিয়াং প্রত্নক্ষেত্রের জন্য সীমাবদ্ধ ছিল না। বরং এটি ছিল সামগ্রিকভাবে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মুল ভূখণ্ডের জেনেটিক পরিযান-পরিচয় জানার অংশ। সেই উদ্দেশ্যে ভিয়েতনাম, মিয়ানমার, কম্বোডিয়া থাইল্যান্ড জুড়ে ডি.এন.এ. সংগ্রহ করা হয়।

নমুনার ট্যাগনারী পুরুষএখন থেকে কত বৎসর আগেপ্রত্নক্ষেত্রদেশমাইটোকন্ড্রিয়া হ্যাপ্লোগ্রুপওয়াই-ক্রমোজম হ্যাপ্লোগ্রুপ
VN22নারী৩৮৩৫-৩৬৩৫মন বাকভিয়েতনামM13b 
VN29নারী৩৯০০-৩৬০০M7b1a 
VN33পুরুষ৩৯০০-৩৬০০B5a1aO2a
VN34নারী৪০৮০-৩৮৪৫M7b1a 
VN37পুরুষ৩৮২৫-৩৬৩৫M7b1aCT
VN39পুরুষ৩৮৩০-৩৬৯৫M7b1aO2a1c1b1
VN40পুরুষ৩৮২০-৩৬১৫M74bO1b1a
VN41নারী২১০০-১৯০০নুই ন্যাপC7a 
VN42পুরুষ১৯৯৫-১৯৯০M8a2aF
OAI1/S28নারী৩২০০-২৭০০ওয়াকিয়েমিয়ানমারD4q 
OAI1/S28নারী৩২০০-২৭০০D4h1c 
BCES B67নারী৩৫০০-৩২০০বান চিয়াংথাইল্যান্ডFaf 
BCES B38নারী৩৫০০-৩২০০B5a1a 
BCES B54পুরুষ৩৫০০-৩২০০B5a1aCT
BCES B27নারী৩৫০০-৩২০০M74b2 
BCES B16পুরুষ৩৫০০-৩২০০M72aF
AB40পুরুষ১৮৯০-১৭৩০ভাট কমনোকম্বোডিয়াB5a1aO


জেনেটিক বিশ্লেষণের প্রসঙ্গে বিজ্ঞানীরা বলছেন যে মূলত ভিয়েতনামের মন-বাক, থাইল্যান্ডের বান-চিয়াং আর কম্বোডিয়ার ভাট কমনোর লোকেদের সাথে অস্ট্রো-এশিয়াটিক ভাষীদের সম্পর্ক নিকট। ভিয়েতনামের মন-বাক পুরুষরা পরস্পর নিকট সম্পর্কিত। মহিলারা তা নন। একই ঘটনা দেখা গেছে বান-চিয়াংয়েও। মান-বাকের প্রাচীন জেনেটিক অ্যালের সূত্রে তাদের মিল পাওয়া গেছে ম্লাব্রি আর নিকোবরিদের সাথে। তারই সাথে নৈকট্যের হিসাবে আছে আধুনিক মায়ানমার, লাও, আর পশ্চিম ইন্দোনেশিয়ার অস্ট্রো-এশিয়াটিক ভাষীরা। তাহলে আমরা ধারণা করতে পারি যে থাইল্যন্ডের বান-চিয়াং, ভিয়েতনামের মন-বাকের প্রাচীন লোকেরা আধুনিক পশ্চিম ইন্দোনেশিয়া, লাও, মিয়ানমার, ম্লাব্রি, নিকোবরিদের সাথে জেনেটিকভাবে সম্পর্কিত, এবং অস্ট্রো-এশিয়াটিক ভাষী। এক কথায় দাঁড়ালো বান-চিয়াংয়ের প্রাচীন বাসিন্দারা অস্ট্রো-এশিয়াটিক।

আবার ভিয়েতনামেরই নুই ন্যাপের লোকেদের সাথে বেশি নৈকট্য হলো অস্ট্রোনেশিয়ান ভাষীদের। আর মিয়ানমারের ওয়াকিয়েলোকেদের বেলা নৈকট্য বেশি তিব্বেতো-বর্মি ভাষীদের সাথে। কিন্তু এই দুইয়ের সময় রেখাও অনেকটাই ভিন্ন।

বান-চিয়াং কঙ্কাল ও বায়ো-আর্কিওলজি

যেহেতু বান-চিয়াংয়ে শিকারি-সংগ্রাহক থেকে শুরু করে একেবারে লৌহ যুগ, সবকালেরই কবর পাওয়া গেছে, তাই প্রত্নক্ষেত্রটি জীবনধারাগত সাংস্কৃতিক পরিবর্তন বোঝার জন্য আদর্শ এলাকা। গোটা পৃথিবীর প্রাচীন ইতিহাস থেকে আমাদের জন্মানো সাধারণ ধারণা হল, শিকারি-সংগ্রাহক জীবন থেকে কৃষিজীবনে আসার পরে মানুষের নানা সাংস্কৃতিক উপকার হয়েছে এবং তারই খাদ্যাভাব কমে পুষ্টি বৃদ্ধি পেয়ে হয়তো স্বাস্থ্যও ভালো হয়েছে। আদত ঘটনা কিন্তু তা নয়। বিশেষ করে শিকারি-সংগ্রাহক জীবন থেকে কৃষিজীবনে আসার সংক্রান্তি কালটি মানুষের মোটেই ভালো যায়নি। এই সময়ে কৃষিকাজে জড়িত মানুষের জীবনে নানা দুশ্চিন্তা, অত্যধিক পরিশ্রম, আর নিত্যনতুন রোগের প্রাদুর্ভাব, বিশেষকরে পেটের গোলমাল তাকে শান্তিতে থাকতে দেয়নি। ঘনবসতির দরুন বাড়ছিল সংক্রামক রোগের দ্রুতবিস্তার। সাথে যোগ হয়েছিল তার দাঁতের ক্ষয়রোগ, যা থেকে আজও মানুষ রেহাই পায়নি। এটাও দেখা গেছে যে এই সময়ে মানুষের মৃত্যুকালীন ন্যূনতম বয়সের গড় কমেছে।

কিন্তু অদ্ভুতভাবে বান-চিয়াংয়ে পৃথিবীজোড়া এই শিকারি-সংগ্রাহক থেকে কৃষিতে পরিবর্তন জনিত সমস্যা কিন্তু বিশেষ দেখা যায়নি। কেন এখানে সমস্যা কম ছিল? অন্যত্র কৃষিজীবিদের খাদ্য ছিল গম-বার্লি-ভুট্টা আর বান-চিয়াং-এ ছিল ধান। গম, বার্লি, ভুট্টা উৎপাদনের তুলনায় ধান উৎপাদনে সময় ও পরিশ্রম বেশি লাগে। ফলে বান-চিয়াংবাসীদের বেশি ক্লান্ত হবার কথা, জীবন বেশি কষ্টকর হবার কথা। তবু বান-চিয়াংয়ের কবরের কঙ্কাল থেকে পাওয়া তথ্য উল্টো কথাই বলে। এমন উল্টো ফল দেখাবার কারণ হিসেবে ভাবা যেতে পারে যে বান-চিয়াংবাসীরা খুব ধীরলয়ে তাদের জীবনযাপনে পরিবর্তন এনেছে। হয়ত শিকার আর চাষ দুটোই পাশাপাশি বজায় রেখেছিল দীর্ঘকাল।

বান-চিয়াংয়ের কঙ্কালগুলোর মধ্যে নৃতাত্ত্বিক দিক থেকে পরিবর্তন প্রায় নেই বা অতি সামান্য পরিবর্তন দেখা গেছে। এটাও খানিক অবাক হবার মতো বিষয়। দেড় দুই হাজার বৎসর এক এলাকার সব লোক প্রায় একই থেকে গেছে। কেবল শেষের দিকে যখন জল দাঁড়ানো জমিতে ধান চাষ পদ্ধতি স্থায়ী ভাবে চালু হয়েছে তার আগেই কেবল এসেছে ভিনদেশিরা। তাহলে বান চিয়াংয়ের প্রথমদিককার কৃষিকাজ কারা করছিল? জেনেটিক বিজ্ঞানীদের মডেল অনুযায়ী প্রথমদিককার ধানচাষীরা ছিল দক্ষিণ চিন থেকে আসা অস্ট্রো-এশিয়াটিক। আগে ভাবা হতো চিন থেকে আসা কৃষক অস্ট্রো-এশিয়াটিকদের প্রবল চাপে আগেকার শিকারি-সংগ্রাহকরা সরে যায় পাহাড়ে জঙ্গলে এবং কালক্রমে তারা লুপ্তও হয়ে যায়। কিন্তু জেনেটিক তথ্য বলছে না, উভয় জনগোষ্ঠী মিলেমিশেই ছিল। এই নবাগত অস্ট্রো-এশিয়াটিকদের সাথে আগেকার শিকারি-সংগ্রাহকদের জিন বিনিময় হয়। এই জিন বিনিময়ের হার তুলনামূলক ভাবে ভিয়েতনামেই বেশি হয়েছিল। বান-চিয়াংয়ে অতগুলো কবরের কোনটিতেই কোন আঘাতের চিহ্ন না থাকাও বলে ঐ সময়টা মোটামুটি শান্তিপূর্ণ সহ-অবস্থানের সময় ছিল।

বান-চিয়াংয়ে আর একটা অদ্ভুত জিনিস নজরে পড়েছে, তা হলো, প্রথমদিককার বেশির ভাগ পুরুষ একে অপরের ঘনিষ্ঠজন। কিন্তু নারীরা একে অপরের থেকে অনেকটাই দুর সম্পর্কীয়। এটা একটা বড় রকমের সামাজিক ধাঁধা। ধাঁধাঁটির দুটো সমাধান থাকতে পারে। দুটো সম্ভাব্য সমাধানের মধ্যে দ্বিতীয়টিকেই বেশি যুক্তিসঙ্গত ভাবা যেতে পারে। (১) বান-চিয়াংবাসীদের স্বগোষ্ঠীর মধ্যে বিয়ের ব্যাপারে অতিরিক্ত কঠোর নিষেধাজ্ঞা ছিল। কিন্তু অতটা কঠোরতা কেন থাকবে বা কেন সৃষ্টি হলো তা জানা নেই। (২) চিন থেকে আসা অস্ট্রো-এশিয়াটিকদের পরিযান ছিল পুরুষপ্রধান। আর নারীদের বেশিরভাগই ছিল স্থানীয় শিকারি-সংগ্রাহক গোষ্ঠীর। চিন থেকে আসা কৃষিজীবী অস্ট্রো-এশিয়াটিকরা আর সব পরিযানের মতই পুরুষ প্রধানই হবে। ইতিমধ্যে ধান চাষে অভ্যস্ত সেই কৃষক পুরুষরা ছিল পরস্পরের ঘনিষ্ঠ সম্পর্কিত সমাজের। আবার বান চিয়াংয়ের শিকারি সংগ্রাহক সমাজ স্বভাবতই হবে অনেকটা বিচ্ছিন্ন সমাজ। তারই ফলে শিকারি-সংগ্রাহক সমাজের নারীদের পরস্পরের সাথে জেনেটিক সম্পর্কের দূরত্বও বেশি হবে।

বান-চিয়াংয়ের লোকেরা আসলে ঠিক কোন নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীর তা প্রথমে পরিষ্কার ছিল না। খননকালে আধুনিক জেনেটিক্স পদ্ধতির অভাবে, আগেকার নৃতাত্ত্বিক পদ্ধতিতে খুলির মাপ নিয়ে বলা হয়েছিল যে, এদের সাথে ৪ হাজার বৎসর আগের লাওদের মিল আছে। আর মিল আছে সমসাময়িক থাইল্যান্ডেরই দুটো প্রত্নক্ষেত্রের বাসিন্দাদের। তবে কোন মিল নেই ৪ হাজার বৎসর আগেকার ভিয়েতনামের লোকেদের সাথে। পরে করা জেনেটিক বিশ্লেষণ বলছে এই সিদ্ধান্তগুলো ঠিক ছিল না।

বান-চিয়াং-এর প্রাচীন কবরস্থদের সাথে সর্বাধিক নৃতাত্ত্বিক প্রভেদ হলো থাইল্যান্ডেরই সমুদ্রসৈকতের কাছাকাছি সমতল এলাকার বাসিন্দাদের। সেটাই হবার কথা। কারণ সমুদ্রতট ও সমভূমির প্রায় সবটাই জুড়ে বসে আছে পূর্ব-এশীয়, তাইওয়ান থেকে বের হওয়া ওসানিয়ানধান চাষীরা। এরা এসেছিল আজ থেকে সাড়ে তিন-চার হাজার বৎসর আগে। নৌপরিবহনে অতি দক্ষ এই ওসানিয়ানরা গোটা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার তটভূমি জুড়ে বসবাস করতে শুরু করে, সাথে শুরু করে জল জমা জমিতে ধান চাষ।

শিকারি-সংগ্রাহক আর কৃষি, এই দুই জীবনধারায় ব্যান-চিয়াং-এর লোকেদের দৈহিক উচ্চতার পরিবর্তনঃ

জীবনধারালিঙ্গ পরিচয়দৈহিক উচ্চতা
শিকারি-সংগ্রাহকপুরুষ১৬৫.৪ সেমি
কৃষিকাজপুরুষ১৬৬.৪ সেমি
শিকারি-সংগ্রাহকনারী১৫৩.৯ সেমি
কৃষিকাজনারী১৫৪.৪ সেমি

অর্থাৎ বান-চিয়াং লোকেদের শিকারি জীবন থেকে দুই হাজার বৎসর পরের কৃষিজীবনে গড় উচ্চতা বেড়েছে। অর্থাৎ তাদের পুষ্টিগত উন্নতিই হয়েছিল। কঙ্কালগুলোতে কোন সংঘর্ষ জনিত দৈহিক আঘাতের চিহ্ন পাওয়া যায়নি। কাজেই বলা যায় তারা টানা দুই হাজার বৎসর ধরে মোটামুটি শান্তিপূর্ণ জীবন কাটিয়েছে। কারুর মধ্যেই যক্ষ্মা রোগের কোন চিহ্ন পাওয়া যায়নি।

বান-চিয়াং-এর কঙ্কালগুলোর মধ্যে পায়ের পাতা ও গোড়ালির হাড়ে ক্ষয় সব চেয়ে বেশি। তাতে অনুমান করা যায় এদের প্রতিদিন বহুদূর হাঁটতে হতো। আবার সব কবরেই দানসামগ্রী প্রায় এক রকম। এই দুইয়ে মিলে অনুমান, সামাজিক শ্রমমর্যাদা সূচক শ্রেণীবিন্যাস থাকলেও প্রভেদ খুব একটা ছিল না।

বান-চিয়াংয়ে নারী পুরুষের খাদ্যাভ্যাস নিয়ে আরেকটি অদ্ভুত জিনিস দেখা গেল। এমনিতে তাদের খাবারে মাছ-মাংস-ফল সবই আছে। পুরুষদের বেলা দেখা গেল তারা বেশি খেত গৃহপালিত পশুর মাংস। কিন্তু নারীদের খাবারে বৈচিত্র্য ছিল অনেক বেশি। নারীরা বেশি খেত বন্য পশুর মাংস আর মাছ। তাহলে কি মেয়েরাই শিকার করত, আর ছেলেরা ঘরে যা আছে তাই কেটেকুটে সাবাড় করে ঘুমত? হবেও বা। তাদের দাঁতের আইসোটোপ পরীক্ষার ফল তো তাই বলছে। তবে আসলে তা হয়ত হতো না। কারণ পায়ের পাতা গোড়ালির হাড়ের ক্ষয় নারী পুরুষ দু’জনেরই সমান হারে ঘটেছে। কাজেই এটা ঘটে থাকতে পারে তাদের নিজস্ব কোন সামাজিক আচরণগত প্রথার দরুন। কিন্তু তেমন কোন প্রথাই বা সৃষ্টি হল কেন? এটা একটা ধাঁধা হয়েই থাকলো।

মাতৃতান্ত্রিক অথবা নারী প্রধান সমাজ

বান-চিয়াং পুরুষদের অলসভাবে ঘরে থাকার সুখের দিন শেষ হয়ে গেল আনুমানিক সাধারণ পূর্বাব্দ ১০০০ থেকে সাধারণ পূর্বাব্দ ৬৫০ নাগাদ। এই সময় ওসানিয়ানরা জল দাঁড়ানো জমিতে নিবিড় ধান চাষ পদ্ধতি নিয়ে আসে এই এলাকায়। ধান চাষে বিশেষ করে জলজমা ধানক্ষেতে চাষের কাজে সাময়িকভাবে অতিরিক্ত লোকবল দরকার। পুরুষপ্রধান ওসানিয়ানদের ধানক্ষেতে মজুর হিসাবে স্থানীয় অস্ট্রিক পুরুষদেরই চাহিদা জন্মাল। স্থানীয় বান-চিয়াং পুরুষদেরই ধানক্ষেতে ডাক পড়ল। শুরু হল বান-চিয়াং পুরুষদের ‘ভোজনং যত্রতত্র শয়নং হট্ট মন্দিরে’। অথচ একই সময়ে বান-চিয়াং নারীরা নিজের ঘরেই থেকে মাছ ধরে, শিকার করে, ফল কুড়িয়ে, রান্না করে খেয়ে সুখে দিন কাটাচ্ছে।

কিছু সমাজ বিজ্ঞানীর মতে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় এটাই ছিল মাতৃতান্ত্রিক বা নারী প্রধান সমাজের আপন বৈশিষ্ট্যের সূত্রপাত। পূর্ণমাত্রায় কৃষিকাজ শুরুর আগে নারীরা শিকার থেকে আরম্ভ করে খাবার সংগ্রহ, গৃহপালিত পশুর দেখোশোনা, খাবার প্রস্তুত করা, এমন নানা কাজেই ব্যস্ত থাকত। পরে কৃষক সমাজে নারীদের শিকারের বদলে প্রধান ভূমিকা নিতে হলো খাবার তৈরি করায়। শিকার বা সংগ্রহের পর্ব কমে ঘরে পশুপালন আর খাদ্য প্রস্তুতে জড়িয়ে যাবার ফলে নারীরা বেশি করে গৃহ চত্বরেই থাকতে বাধ্য হলো। এইভাবে নারীদের বেশি সময় গৃহে থাকা অন্য এক সামাজিক ঘটনাপ্রবাহের জন্ম দিল।

ওসানিয়ানদের ধানচাষ পদ্ধতিতে তারা আগেকার অস্ট্রো-এশিয়াটিকদের চেয়ে বহুগুণ বেশি ধান উৎপাদন করতে সক্ষম ছিল। এই বাড়তি ফসল তাদের অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ করে তোলে। এই সমৃদ্ধি সমাজে তাদের  বর্ধিত প্রভাব প্রতিপত্তি এনে দেয়। তাদের এই সমৃদ্ধি স্থানীয় অস্ট্রো-এশিয়াটিক নারীদের কাছে তাদের অধিকতর গ্রহণযোগ্য করে তোলে। প্রতিযোগিতায় ক্রমে অস্ট্রো-এশিয়াটিক পুরুষরা সামাজিকভাবে পিছিয়ে পড়ে। তাদের বংশবৃদ্ধির হার কমতে থাকে।

সব পরিযানের মতই পূর্ব-এশীয় ধানচাষীদের পরিযানও ছিল মূলত পুরুষ-প্রধান। নৌকায় পরিযান ঘটায় তাদের পরিযান নারী শূন্য না হলেও স্বভাবতই নারী সংখ্যা সীমিত ছিল। ঘরে ঘর-জমি-গৃহপালিত পশু আগলে রাখা স্থানীয় নারীদের কাছে বহিরাগতরা পেল তাদের কাঙ্ক্ষিত বসতবাটি আর সংসার। এর থেকে যে সামাজিক পটপরিবর্তনের ছবি আঁকা যায়, তা হলো স্থানীয় নারীরা জমিজমা ঘর-বাড়ি আগলে রেখেছিল। ভাগ্যসন্ধানী পুরুষরা সেই নারীদের নিয়ে সেই ঘর-বাড়িতেই থেকে গেল। শুরু হল মাতৃতান্ত্রিক অথবা নারী প্রধান সমাজ ব্যবস্থা। এমন একটা আমূল সামাজিক পরিবর্তন সম্ভব হলো কিন্তু কোন রকম সংঘর্ষের ঘটনা ঘটলো না। ক্রমে অস্ট্রো-এশিয়াটিকরা সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল সংখ্যালঘু গোষ্ঠীতে পরিণত হলো। গোটা থাইল্যান্ডে তথা গোটা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াতে পূর্ব-এশীয়দের প্রায় নিরঙ্কুশ প্রাধান্যের সেই শুরু।

ঠিক এইভাবেই এমন একটি আমূল সামাজিক পরিবর্তন ঘটেছিল, তবে তার কিন্তু কোন প্রত্নপ্রমাণ নেই। লিখিত ইতিহাসের অভাবে এমন প্রমান পাওয়া সম্ভব না। তবু ধারনাটি দানা বেঁধেছে। কারণ এই দিককার বিশাল এলাকা জুড়ে বহু নারী-প্রধান সমাজের দেখা পাওয়া যায়, দেখা পাওয়া যায় মাতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থাও।

তথ্যসুচীঃ-

1. Chester Gorman and PisitCharoenowngsa: “Ban Chaing: A mosaic of impressions from the first two years.” Pennmuseum Expedition. Summer 1976.

2. Michael Pietrusewesky: “The People of Ban Chiang: Bioarcheology of the 1975-75 Skeletons”.   University of Hawaii, Manoa.  Conference paper. May 2016. Published in Researchgate.


3. Joyce. C. White: “Dating Early Bronze at Ban Chiang, Thailand”   University of Pennsylvania Museum.

4.  UNESCO: “Ban Chiang World Heritage site” UNESCO World Heritage site.

5. New World Encyclopedia: “Ban Chiang”

6. Khan Academy: “Ben Chang Clay Jar.”

7.Michael Pietrusewsky: “Ancient Inhabitants of Ban-Chiang/The Evidence from the Human Skeletal and Dental Remains.” University of Hawaii at Manoah. Expedition. 1982.

8. David Reich et al.: “Ancient genomes documents multiple waves of migration in South East Asian prehistory” Science, July 6, 2018.

মন্তব্য তালিকা - “বান-চিয়াং (থাইল্যান্ডের ৫৪০০-২৩০০ বৎসরের প্রাচীন নিদর্শন)”

মন্তব্য করুন

আপনার ইমেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।