সূচী

ইতিহাস তথ্য ও তর্ক

লেখক: তুষার মুখার্জী

তুষার মুখার্জী
লেখক কলকাতায় থাকেন। অবসর জীবনে প্রাচীন ইতিহাসের চর্চা করেন, জানার আর জানাবার জন্য।
প্রতিবেশী দেশগুলোর অতীত সম্বন্ধে আমাদের খুব বেশি কিছু জানা থাকে না। যেটুকু সামান্য জানার উৎসাহ জাগে তা কেবল আমাদের দেশের সাথে, আমাদের গৌরবজনক সংযোগ সূত্রগুলো ঘিরেই। দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় দেশগুলোর ইউরোপীয় অধীনতার কবল থেকে স্বাধীন হবার পরেই কেবল তাদের নিজেদের অতীত জানার আগ্রহ দেখা দিতে শুরু করে। এই আগ্রহের পেছনে তাগাদা ছিল ইউরোপীয় ধাঁচে জাতি-রাষ্ট্র গঠনের জন্য আপন আপন জাত্যাভিমানের সৃষ্টি করা। ইউরোপীয় ভাবধারায় জাতি-রাষ্ট্র গঠনের জন্য প্রয়োজন প্রতিটি রাজনৈতিক রাষ্ট্রের নিজস্ব জাতি পরিচয় সৃষ্টি করা ও তাকে সুদৃঢ় জাতিসত্তায় পরিবর্তিত করা। এই রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতার থেকেই নবীন রাষ্ট্রগুলো তাদের ইতিহাস চর্চার প্রয়োজন অনুভব করে।
“ইউফ্রেটিস নদীর পাড়ের শহর আজ়ুপিরানু। সেখানে আমার মা ছিলেন মন্দিরের উচ্চস্তরের পুরোহিত। বাবার কথা আমার জানা নেই। বাবার জ্ঞাতিগোষ্ঠীরা পাহাড়কেই বেশি পছন্দ করত। মা আমাকে গোপনে তাঁর গর্ভে ধারণ করেছিলেন। লুকোনো অবস্থায় আমার জন্ম দেন। মা জলনিরোধক ঘন আলকাতরা মাখা নলখাগড়ার এক ঝুড়িতে আমাকে রেখে, ঢাকনা বন্ধ করে, সে ঝুড়ি ভাসিয়ে দেন নদীতে। নদীর জল ঝুড়িতে ঢোকেনি। নদীর জলে ভেসে ভেসে আমি চলে আসি আক্কির কাছে। জল সেচ করার কর্মী আক্কি আমাকে তাঁর বাড়িতে নিয়ে নিজের ছেলের মত করে বড়ো করেন। তারপরে আমাকে বাগানের মালির কাজে লাগিয়ে দেন। বাগানে কাজ করতে করতে আমি দেবী ইশতারের আশীর্বাদ ধন্য হই। আর তারপরে আমি চার ও ... বৎসর রাজত্ব করতে থাকি।...” সম্রাটের রাজকীয় মোহর লাগানো, মাটির তালে, কিউনিফর্ম লিপিতে লেখা, ভাঙা টুকরোর এই অংশের মুল অনুবাদ করেছেন ইতিহাসবেত্তা সুসান বাওয়ার।
একটা প্রশ্ন প্রায়ই ঘুরে ফিরে আসে নানা আলোচনায়, প্রাচীনতম ভাষা কী? ভারতের ক্ষেত্রে এই প্রশ্নের উত্তরে হয় দুটো, না হয় তিনটি ভাষার নাম পাওয়া যাবে; সংস্কৃত, দ্রাবিড়, মুন্ডা। এর সঙ্গে কখনও আবার বিচিত্রভাবে যোগ হয় হিন্দি বা সিলেটিও। এমন উত্তরের পেছনে অবশ্যই কয়েকটি কারণ রয়েছে। বাংলায় প্রশ্ন করলে আমরা ধরে নেব ভারতীয় উপমহাদেশের প্রাচীনতম ভাষার কথাই জানতে চাওয়া হয়েছে। হরপ্পা সভ্যতার সূত্র ধরে বহুকালের চলা বিতর্কিত ধারণা অনুযায়ী স্বাভাবিকভাবেই দ্রাবিড় আর সংস্কৃতের নাম আসে, সেই সঙ্গে বর্তমানে হিন্দি আর সিলেটি যোগ হয়েছে মূলত বর্তমানের রাজনৈতিক আবহের ভিত্তিতে। তাই এই তালিকার শেষ দুটো নাম নিয়ে আমরা ভাবছি না। তবে, সবার আগে, উত্তর নিয়ে ভাবতে বসার আগে প্রশ্নটি নিয়েই ভাবা দরকার। এই প্রশ্নে কি জানতে চাওয়া হয়েছে? প্রাচীনতম ভাষা বলতে মৌখিক ভাষা না লিখিত ভাষা?
৫০০ পূর্বাব্দে প্রতিষ্ঠিত ইয়োরুবাদের ইলে-ইফে বা ইফে শহর। ইয়োরুবা জাতির প্রাচীন রাজধানী। ১২০০ থেকে ১৪০০ সাধারণাব্দের ইফে বিখ্যাত ছিল ঢালাই তামা, পিতল, পাথর, আর টেরাকোটা মূর্তি বানাবার জন্য। শহরের বাসিন্দা জনগোষ্ঠী ইয়োরুবাদের বিশ্বাসে, তাদের উৎপত্তিস্থল ও ধর্মীয় পীঠস্থান এই ইফে। ইফে শহরে ইয়োরুবাদের মন্দির ও দেবতার সংখ্যা বলা হয় ২০১. এই খানে ২০১ মানে আসলেই ২০১ নয়, ২০০ র পরে ১ যোগ হল মানে দুইশতের বেশি তিন শতের কম। ইয়োরুবা ভাষায় ইফে শব্দের অর্থ হল বৃদ্ধি বা ছড়ানো। আর ইলে শব্দের অর্থ ঘর বা বাড়ি। দুয়ে মিলে ইলে-ইফে, বাড়তে থাকা বাড়ি। যা হয়ত ইয়োরুবাদের প্রাচীন আধিপত্যের রূপক, যা বলে তাদের শক্তি কেন্দ্র ইফে থেকে ক্রমবর্ধমান দখলীকৃত এলাকার কথা।
আমাদের ছোটবেলা (১৯৬০-৬৫) ইতিহাসে পড়ানো হত “অন্ধকারাচ্ছন্ন মহাদেশ কাহাকে বলে?” আমরা মুখস্থ করতাম,"আফ্রিকাকে অন্ধকারাচ্ছন্ন মহাদেশ বলা হয়।" পরীক্ষার খাতায় উক্তিটির ব্যাখ্যায় লিখতে হত – “এই মহাদেশ সম্পর্কে মানুষ তেমন কিছু জানিত না। লিভিংষ্টোন এবং অন্যান্যদের দুঃসাহসিক অভিযানের ফলে এই মহাদেশের কথা মানুষ প্রথম জানিতে পারে।এই মহাদেশ সম্পর্কে মানুষ তেমন কিছু জানিত না, কারণ এই অঞ্চলে ছিল ভয়ঙ্কর জন্তু-ভর্তি গভীর অরণ্য, দুর্গম পর্বত, খরস্রোতা নদী, মরুভূমি, অস্বাস্থ্যকর জলবায়ু আর আদিম হিংস্র অধিবাসীরা বসবাস করিত। ফলে সভ্য লোক সেখানে যাইতে পারিত না। তাই উহাকে অন্ধকারাচ্ছন্ন মহাদেশ বলা হয়।”