সূচী

ইতিহাস তথ্য ও তর্ক

লেখক: জয়ন্ত ভট্টাচার্য

জয়ন্ত ভট্টাচার্য
লেখক যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রযুক্তিবিদ্যার স্নাতক এবং বিগত তিন দশক ধরে বিমান প্রযুক্তিবিদ্যার সঙ্গে যুক্ত। ইতিহাস, বিশেষতঃ সামাজিক ইতিহাস ও মুদ্রাতত্ত্ব নিয়ে অত্যন্ত আগ্রহী পাঠক। ইতিহাস নিয়ে লেখালেখির সূত্রপাত সাম্প্রতিক।
ভারতীয় উপমহাদেশে প্রাচীন যুগে ইতিহাস লেখকদের যখন প্রায় কোন সন্ধানই পাওয়া যায় না, তখন মধ্যযুগের কাশ্মীরের চার সংস্কৃত ইতিবৃত্তকার – কল্হণ (দ্বাদশ শতাব্দী সাধারণাব্দ), জোনরাজ (১৩৮৯? - ১৪৫৯ সাধারণাব্দ), শ্রীবর (পঞ্চদশ - ষোড়শ শতাব্দী সাধারণাব্দ) ও শুকের (ষোড়শ শতাব্দী সাধারণাব্দ) লেখা ‘রাজতরঙ্গিণী’ নামে পরিচিত অবিচ্ছিন্ন ধারাবাহিক ইতিবৃত্ত গ্রন্থমালা আমাদের বিস্মিত করে। শুধু তাই নয়, এই চার ইতিবৃত্তকারদের জীবন মধ্যযুগের কাশ্মীরের রাজশক্তির সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত থাকার কারণে তাঁদের লেখা ইতিবৃত্ত প্রামাণিকতার নিরিখেও মূল্যবান। সপ্তদশ শতকে লিপিবদ্ধ ‘রাজতরঙ্গিণী’ গ্রন্থমালার শারদা পাণ্ডুলিপিগুলি আজও মধ্যযুগের কাশ্মীরের চার প্রতিভাশালী সংস্কৃত কবির ইতিবৃত্ত রচনার দক্ষতার সাক্ষ্য বহন করে চলেছে।১
কড়ি এক ধরণের মৃত সামুদ্রিক শামুকের (বৈজ্ঞানিক নাম: সাইপ্রিয়া মনেটা) খোল, যা মূলত ভারত মহাসাগরে পাওয়া যায়। এশিয়া ও আফ্রিকার বহু দেশে মধ্যযুগে কড়ি বিনিময়ের মাধ্যম হিসাবে ব্যবহৃত হত। সাধারণাব্দের ষোড়শ থেকে ঊনবিংশ শতাব্দী পর্যন্ত ইউরোপ এবং আফ্রিকার মধ্যে যে দাস ব্যবসা চলত, তার একটা বড় অংশ হত কড়ির মাধ্যমে। প্রায় দুই সহস্রাব্দ ধরে কড়ি বাংলায় বিনিময়ের মাধ্যম হিসাবে ব্যবহৃত হয়েছে। অথচ, বাংলা বা তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে কড়ি পাওয়া যায় না, মালদ্বীপ থেকে ভারত মহাসাগরের সমুদ্রপথে কড়ি বাংলায় আমদানি করা হত। চতুর্দশ শতকের মরক্কোর পর্যটক ইবন বতুতা মালদ্বীপ ভ্রমণের সময় দেখেছেন, মালদ্বীপের অধিবাসীরা কড়ির বিনিময়ে বাংলা থেকে আমদানি করা চাল কিনতেন। ষোড়শ শতকের শেষদিক থেকে পর্তুগিজ বণিকরা ভারত মহাসাগরে বাণিজ্যের উপর নিয়ন্ত্রণ করতে শুরু করার পর মুখ্যত পর্তুগিজরাই বাংলায় কড়ি আমদানি করত।
বর্তমান বিহারের নালন্দা জেলায় অবস্থিত, প্রাচীন মগধের দুই প্রধান নগর রাজগৃহ ও পাটলিপুত্রকে সংযোগকারী রাজপথের ধারে অবস্থিত নালন্দার বৌদ্ধ মহাবিহারের গৌরবের ইতিহাস বিগত কয়েক দশক যাবৎ ভারতের প্রায় সব বিদ্যালয়ের পাঠক্রমের অন্তর্ভুক্ত। কিভাবে পঞ্চম শতকের শুরুতে গুপ্ত বংশের সম্রাটদের পৃষ্ঠপোষকতায় স্থাপিত পূর্ব ভারতের বৌদ্ধশাস্ত্রের, বিশেষতঃ মহাযান ধর্মশাস্ত্র ও বৌদ্ধ মূর্তিনির্মাণশাস্ত্র চর্চার এই মহান বিদ্যাপীঠের পঠন-পাঠনের সমাপ্তি ঘটল, এই প্রশ্নের উত্তরে, বোধহয় প্রায় সবাই বলবেন, ‘নালন্দা মুসলিম আক্রমণকারী বখতিয়ার খলজি ধ্বংস করেছিল।‘ এই বিশ্বাস জনমানসে অত্যন্ত ব্যাপক, এবং এর কারণ সম্ভবতঃ বিংশ শতক থেকে বহু আধুনিক বিদ্বানদের রচনায় এই বিশ্বাসের অভিব্যক্তি। এই বিদ্বানদের অনেকেই আবার নিজেদের বিশ্বাস অনুযায়ী, ১১৯৩, ১১৯৭, ১১৯৮, ১২০০ ১২০২, ১২০৫ বা ১২০৬ সাধারণাব্দের মধ্যে কোন একটি বর্ষকে এই ‘ঘটনা’র সম্ভাব্য তারিখ বলে চয়ন করেছেন।[১]