সূচী

ইতিহাস তথ্য ও তর্ক

লেখক: ভাস্কর দাস

ভাস্কর দাস
জন্ম ১৯৫৯। কলকাতা মেডিকেল কলেজ থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শিক্ষা। পেশায় অস্থিশল্য চিকিৎসক। লেখার জগতে বিলম্বিত প্রবেশ। লেখা প্রকাশিত 'দেশ', হরপ্পা, ভ্রমি ভ্রমণআড্ডা সহ নানা পত্রিকায় ও সংকলনে। প্রকাশিত বই 'টাইমলাইন আলাস্কা', 'এক চামচ বিদেশ', 'কোভিড-১৯, এক বিভ্রান্তির সন্ত্রাস'। ভ্রমণআড্ডা প্রদত্ত 'কলম' সম্মান লাভ ২০২২এ। ভ্রমণ, ইতিহাস অনুসন্ধান নিয়ে বিশেষভাবে অনুরাগী। ছবি তোলার নেশায় দেশে বিদেশে পাড়ি, তাতে কিছু দেশীয় ও আন্তর্জাতিক সম্মানপ্রাপ্তি। দেশে ও বিদেশে একক ও দলগত প্রদর্শনী।
ইতিহাসের যদি কোনো ঈশ্বর থাকেন তবে তাঁর রাজত্বে তাঁর কিছু নিজস্ব নিয়মকানুন, রীতিনীতিও আছে। সে নিয়মানুসারে এক সম্রাট যদি আর এক সম্রাটের সাম্রাজ্য দখল করতে মনস্থ করেন তবে তিনি প্রথম পাঠান তাঁর সেনাবাহিনীকে। সামরিক শক্তিতে প্রাথমিক বাধা অতিক্রম করে বিজয়ী সম্রাটের জন্য লাল কার্পেট পেতে দেবার দায়িত্ব তাদেরই। তারপর আসেন রাজপুরুষের দল। প্রশাসনিক স্তরে নিয়ন্ত্রণ কায়েম করতে তারা তৎপর হন। সব শেষে আসে সাধারণ মানুষ, অর্থাৎ জনগণ। প্রতিযোগিতা ও সহযোগিতার বিনিময়ে সম্পর্ক স্থাপন হয় বিজিত জনগণের সঙ্গে। যদিও এ দখলদারি সাময়িক — অদূর বা সুদূর ভবিষ্যতে দেশের মাটি দেশের মানুষের একদিন প্রতিদিনের সীমানাতেই বাধা পড়ে। তবে অল্প কিছু ব্যতিক্রমী ক্ষেত্রে ঈশ্বর তাঁর নিয়মের ব্যতয় ঘটান — যেমন কিনা আলাস্কার বেলায়। ঘোড়ার আগে গাড়ি জুতে দেবার নিয়মে রাশিয়ার আলাস্কা অধিকারের প্রক্রিয়ায় সেখানে প্রথম যায় তার সাধারণ মানুষ, তারপর রাজপুরুষ বা তার প্রতিনিধিস্থানীয় মানুষ, বহু পড়ে নিয়মরক্ষার্থে এক ছোট্ট সেনাদল আর সম্রাট বা জার কখনই না।
'Swallowed by the great land' - আলাস্কাকে বিষয় করে লেখা সেথ কাঁতনার-এর একটা বইয়ের নাম। একটি বাক্যে প্রতিটা শব্দ কি অমোঘভাবে অর্থবহ হয়ে উঠে এক বৈপ্লবিক 'স্টেটমেন্ট'-এর জন্ম দেয়, তার সার্থক উদাহরণ হতে পারে এই বাক্যটি। ভূমি যে মহান তাতে তো সন্দেহের অবকাশ নেই। কিন্তু ভূমিপুত্রের জন্মবৃত্তান্ত, পারিপার্শ্বিক প্রকৃতি ও পরিবেশের সঙ্গে তাদের আন্তঃসম্পর্ক, তাদের জীবনযাপনের লড়াই, সে লড়াইতে তথাকথিত সভ্য জগতের দখলদারির গল্পের ঘূর্ণাবর্তে যে একবার পড়েছে, তার আর নিস্তার নেই। আলাস্কার ইতিহাসে বড় মায়া। সে নিশিডাকে একবার যে সাড়া দিয়েছে, তাকে অক্টোপাসের আলিঙ্গনে গিলে নিয়েছে আলাস্কা — কাঁতনার-এর ভাষায় swallowed.
আকাশ মেঘাচ্ছন্ন। সঠিকভাবে বলতে গেলে আজও আকাশ মেঘাচ্ছন্ন। এই জাহাজ, যার নাম 'সেন্ট পিটার' - তার বিস্তীর্ণ ডেকের ওপর খেলে বেড়াচ্ছে এলোমেলো হাওয়া। নাম না জানা এক দ্বীপের ধারে আজ নোঙর করতে পেরেছি। দিনটা ৩০ অগাস্ট ১৭৪১। জাহাজের চারধারে অজানা সমুদ্রের সাম্রাজ্য। আজ থেকে ঠিক ৮৬ দিন আগে ৪ জুন আমরা ভেসেছিলাম কামচাটকার ছোট্ট বন্দর পেত্রপোভলস্ক থেকে। ৯০ ফুট লম্বা জাহাজে আমরা ৭৬ জন নাবিক। আমাদের নেতা ভিটাস জোনাসেন বেরিং। ডেনমার্কের মানুষ এই বেরিং বিগত ২০ বছর ধরে রুশ নৌবাহিনীতে কর্মরত। এঁরই হাতে ছিল ১৭২৭ এর প্রথম কামচাটকা অভিযানের ভার। আজ দ্বিতীয় অভিযানেও প্রধান দায়িত্ব তাঁর। রাশিয়ান সেনেটের 'উকাজ' বা নির্দেশ অনুসারে আমাদের লক্ষ্য কামচাটকার পূর্ব ও দক্ষিণপূর্ব সাগরে অভিযান চালিয়ে দেখা সেখানে কোন কোন স্থলভাগের অস্তিত্ব আছে, আমেরিকার পশ্চিম উপকূলে নেমে তার ভূগোল ও প্রকৃতি সম্পর্কে একটা ধারণা তৈরি করা, আর সম্ভব হলে সেখানকার মানুষজনের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করা।
উত্তর আমেরিকার মূল শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন তার ৪৯তম রাজ্যের নাম আলাস্কা। ভূগোলের সঙ্গে সঙ্গে তার ইতিহাসও আমেরিকার থেকে একেবারে স্বতন্ত্র। বস্তুত, আমেরিকান হওয়ার আগে সে ছিল রাশিয়ার অংশ। আর তার আগে? সৃষ্টির আদি থেকে ভেসে থাকা এ স্থলভাগে প্রথম মানুষের পা পড়েছিল আনুমানিক ১৬০০০ বছর আগে। সাইবেরিয়া থেকে আসা মানুষ তখন বর্তমানে লুপ্ত বেরিং ব্রিজ পেরিয়ে এখানে এসে বসবাস শুরু করেছিল। কয়েক হাজার বছর চলেছিল তাদের কৌম জীবনের যাপন, যতদিন না রাশিয়ার পিটার দ্য গ্রেটের আকাঙ্ক্ষা তাকে এনেছিল সভ্যসমাজের দৃষ্টিসীমায়। তারপরের ইতিহাস বিচিত্র, রোমহর্ষক। তার বর্ণনা থাকবে পরবর্তী কয়েকটি আখ্যানে।