সূচী

ইতিহাস তথ্য ও তর্ক

লেখক: ভাস্কর দাস

ভাস্কর দাস
জন্ম ১৯৫৯। কলকাতা মেডিকেল কলেজ থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শিক্ষা। পেশায় অস্থিশল্য চিকিৎসক। লেখার জগতে বিলম্বিত প্রবেশ। লেখা প্রকাশিত 'দেশ', হরপ্পা, ভ্রমি ভ্রমণআড্ডা সহ নানা পত্রিকায় ও সংকলনে। প্রকাশিত বই 'টাইমলাইন আলাস্কা', 'এক চামচ বিদেশ', 'কোভিড-১৯, এক বিভ্রান্তির সন্ত্রাস'। ভ্রমণআড্ডা প্রদত্ত 'কলম' সম্মান লাভ ২০২২এ। ভ্রমণ, ইতিহাস অনুসন্ধান নিয়ে বিশেষভাবে অনুরাগী। ছবি তোলার নেশায় দেশে বিদেশে পাড়ি, তাতে কিছু দেশীয় ও আন্তর্জাতিক সম্মানপ্রাপ্তি। দেশে ও বিদেশে একক ও দলগত প্রদর্শনী।
বাংলাদেশ, মানে একসময়ের অবিভক্ত ভূখণ্ড (যার সীমানা অবশ্য বার বার পরিবর্তিত হয়েছে) সেই কোনো এক সময়ে ছিল বিপুল শিল্প ও বাণিজ্যের কেন্দ্রস্থল। বস্তুত, বাংলার সঙ্গে বাণিজ্য সম্পর্ক ছিল একসময়ে প্রায় সারা পৃথিবীর শ্লাঘার বিষয়। আশ্চর্য হলেও সত্যি, এর একটি ছিল বাংলার জাহাজশিল্প। আজকের তাম্রলিপ্ত অঞ্চল, কিছুটা মোগল শাসন কেন্দ্রিক ঢাকা অঞ্চল আর মূলত চট্টগ্রামের কর্ণফুলী তীরবর্তী অঞ্চল ছিল এর উৎস। পরবর্তীকালে সপ্তগ্রাম, হুগলী ও কলকাতায় এর রেশ ছিল। এর ইতিহাস দীর্ঘ, বিচিত্র এবং শেষ অবধি প্রায় গ্রিক ট্র্যাজেডির তুল্য বিয়োগান্তক পরিণতির শিকার, সৌজন্যে ইংরেজ বানিয়া ও রাজশক্তি। আজ তাকেই কিছুটা তুলে ধরার চেষ্টা করলাম।
'একদা যাহার বিজয় সেনানী হেলায় লঙ্কা করিল জয় একদা যাহার অর্ণবপোত ভ্রমিল ভারত সাগরময়।' ছেলেবেলায় দুলে দুলে যখন এই দুই ছত্র মুখস্ত করতাম, তখন তার ইতিহাস-ভূগোল নিয়ে প্রশ্ন করার বয়স হয়নি। মনেই আসেনি কে বিজয়, আর অর্ণবপোতই বা কী। পরিণত বয়সে তত্ত্ব তল্লাশ করে জানলাম খ্রিস্ট জন্মের প্রায় পাঁচশো বছর আগের বাংলার (নামকরণ নিয়ে প্রশ্ন থাকবে— ভৌগোলিক সীমারেখার আন্দাজ দিতে নামটি ‘বাংলা’ লিখলাম) রাঢ় অঞ্চলের অধিপতি সিংহবাহু আর তার আপন বোন সিংহসিবলির দাম্পত্যজাত বত্রিশ পুত্রের সবচেয়ে বড়োটির নাম ছিল বিজয় সিংহ। তার জন্মের পর বাকি একত্রিশটি সন্তানের উৎপাদনে ব্যস্ত বাবা মা বিজয়ের কোনো দেখভাল করতে না পারায় এক নিখুঁত লম্পট হয়ে ওঠে সে। তার সপারিষদ উৎপাতে অতিষ্ঠ প্রজাদের উপর্যুপরি অভিযোগে বিরক্ত হয়ে একসময় সিংহবাহু তাকে দেশান্তরী হবার আদেশ দেন।
ব্যারানভ চলে গেলেন। আলাস্কার সৈকতে সাগরের ঢেউ আগের মতোই ভাঙতে লাগল। স্প্রুসের ডাল থেকে খসে পড়া পাতা মাটিতে মিশে পরের প্রজন্মের চারাদের লালনে ব্যাস্ত থাকল। বাতাস আগের মতোই জলীয় বাস্প বয়ে নিয়ে গিয়ে জন্ম দিতে লাগল অন্ধ কুয়াশার। আর আলাস্কার আদিবাসী মানুষেরা বিশ্বাস করল যে আগের ছন্দেই চলতে থাকবে জীবন। ততদিনে রুশদের সঙ্গে অ্যালিউট আর লিঙ্গিতদের একটা তুলনামূলক শান্তিপূর্ণ বিনিময়ের সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। বানিজ্যিক বিনিময়ের বাইরে স্থাপিত হয়েছে সামাজিক সম্পর্ক। রুশদের সঙ্গে আদিবাসীদের মিশ্রণের ফলে জন্ম নিয়েছে এক মিশ্র প্রজাতির যার নাম ‘ক্রেওল’, সামাজিক অবস্থানে যারা যথেষ্ট সম্মানজনক স্থান পেয়েছে। শুধু প্রবল নাড়াচাড়া পড়ে গিয়েছে প্রশাসনের অন্দরমহলে।
আমেরিকার ‘ওয়েস্ট কোস্ট’-এর উত্তর কোণের ওয়াশিংটন রাজ্যের মধ্যে দিয়ে বয়ে গিয়ে কলম্বিয়া নদী যেখানে প্রশান্ত মহাসাগরে এসে মিশছে, সেখান থেকে উত্তর দিকে ব্রিটিশ কলম্বিয়া ছুঁয়ে কেউ যদি আলাস্কার দক্ষিণ পূর্ব উপকূল ধরে সিটকা পেড়িয়ে ইয়াকুতাত নদীর অববাহিকা অব্দি পৌঁছে যায়, তবে তার পায়ের তলায় থাকবে এমন এক ভূভাগ যার বিচিত্র চরিত্র তাকে অবাক তো করবেই, বিভ্রান্তও করবে যথেষ্ট। অশান্ত সমুদ্রের প্রায় পাড় থেকেই উঠে গেছে উঁচু পাহাড় যাদের কারোর কারোর উচ্চতা ৩ থেকে ৪ হাজার ফিট। সেই উচ্চতাতেই তাদের মাথায় বরফের টুপি। স্থলভূমির এই পাহাড়ি চরিত্র বিস্তৃত হয়েছে সংলগ্ন সমুদ্রের তলদেশে। জলের নিচে থাকা পাহাড় সমুদ্রের ওপরে বিভিন্ন উচ্চতায় মাথা বের করে তৈরি করেছে অসংখ্য ছোটো বড়ো দ্বীপ।
ইতিহাসের যদি কোনো ঈশ্বর থাকেন তবে তাঁর রাজত্বে তাঁর কিছু নিজস্ব নিয়মকানুন, রীতিনীতিও আছে। সে নিয়মানুসারে এক সম্রাট যদি আর এক সম্রাটের সাম্রাজ্য দখল করতে মনস্থ করেন তবে তিনি প্রথম পাঠান তাঁর সেনাবাহিনীকে। সামরিক শক্তিতে প্রাথমিক বাধা অতিক্রম করে বিজয়ী সম্রাটের জন্য লাল কার্পেট পেতে দেবার দায়িত্ব তাদেরই। তারপর আসেন রাজপুরুষের দল। প্রশাসনিক স্তরে নিয়ন্ত্রণ কায়েম করতে তারা তৎপর হন। সব শেষে আসে সাধারণ মানুষ, অর্থাৎ জনগণ। প্রতিযোগিতা ও সহযোগিতার বিনিময়ে সম্পর্ক স্থাপন হয় বিজিত জনগণের সঙ্গে। যদিও এ দখলদারি সাময়িক — অদূর বা সুদূর ভবিষ্যতে দেশের মাটি দেশের মানুষের একদিন প্রতিদিনের সীমানাতেই বাধা পড়ে। তবে অল্প কিছু ব্যতিক্রমী ক্ষেত্রে ঈশ্বর তাঁর নিয়মের ব্যতয় ঘটান — যেমন কিনা আলাস্কার বেলায়। ঘোড়ার আগে গাড়ি জুতে দেবার নিয়মে রাশিয়ার আলাস্কা অধিকারের প্রক্রিয়ায় সেখানে প্রথম যায় তার সাধারণ মানুষ, তারপর রাজপুরুষ বা তার প্রতিনিধিস্থানীয় মানুষ, বহু পড়ে নিয়মরক্ষার্থে এক ছোট্ট সেনাদল আর সম্রাট বা জার কখনই না।