সূচী

ইতিহাস তথ্য ও তর্ক

অতীশ দীপংকর – আদি-মধ্যযুগের বাংলার এক মহাপরিব্রাজক  

অতীশ দীপংকর – আদি-মধ্যযুগের বাংলার এক মহাপরিব্রাজক  

জয়ন্ত ভট্টাচার্য

ফেব্রুয়ারি ১৮, ২০২৩ ৯৬৭ 7

এক নাস্তিক পণ্ডিতের কথানক

কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত তাঁর ‘আমরা’ কবিতায় লিখেছেন,

“বাঙালী অতীশ লঙ্ঘিল গিরি তুষারে ভয়ঙ্কর,

জ্বালিল জ্ঞানের দীপ তিব্বতে বাঙালী দীপঙ্কর।”

তিব্বত ও মঙ্গোলিয়ায় বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের কাছে এখনও যিনি বৌদ্ধ সাধনার পথপ্রদর্শক হিসেবে গভীর শ্রদ্ধার আসনে প্রতিষ্ঠিত, এক সহস্রাব্দ আগের সেই বাঙালি মহাপরিব্রাজক আচার্য অতীশ দীপংকর শ্রীজ্ঞান (৯৮২-১০৫৪ সাধারণাব্দ) আজকের ভারতে প্রায় বিস্মৃত। লোকশ্রুতি থেকে বুঝতে পারি, অতীশের সমসাময়িক বাংলায় তাঁকে শ্রদ্ধার সঙ্গে বলা হত ‘নাস্তিক পণ্ডিত’ আর তিব্বতি পুথিতে দেখছি মধ্যযুগের তিব্বতের অধিবাসীরা তাঁকে ভক্তিভরে কখনও তিব্বতিতে ‘জোবোজে’ (প্রভু) বা ‘জোবো ছেনপো’ (মহা আর্য) বলে উল্লেখ করছেন, কখনও বা সংস্কৃতে ‘অতীশ’ বলে।তিব্বতি ইতিবৃত্ত গ্রন্থমালায় বৌদ্ধ মধ্যমক দর্শনের মহাবিদ্বান ‘বঙ্গালে’র সন্ন্যাসীর দীপংকর শ্রীজ্ঞানের বিস্তারিত উল্লেখ, তিব্বতি বৌদ্ধ শাস্ত্রগ্রন্থ ‘তেঞ্জুর’-এ তাঁর গ্রন্থের সংকলন এবং তিব্বতি ভাষায় রচিত তাঁর জীবনী গ্রন্থসমূহে লিপিবদ্ধ বিবরণ থেকে তিব্বতের ধর্মীয় পরিমণ্ডলে তাঁর গুরুত্ব উপলব্ধি করতে বিন্দুমাত্র অসুবিধা হয় না। বিশ ও একুশ শতকে অতীশের জীবন ও দর্শন নিয়ে বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বই লেখা হয়েছে; সেই সব বইয়ের তথ্যভাণ্ডার থেকে কুড়িয়ে-বাড়িয়ে এই কথানকের সৃষ্টি।

জীবনকথার তিব্বতি উত্স

আশ্চর্যজনক হলেও সত্য, অতীশ দীপংকর শ্রীজ্ঞানের জীবন সম্পর্কে কোনও ভারতীয় উৎস থেকে তথ্যের সন্ধান এখনও পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। তাঁর জীবনসংক্রান্ত তথ্যের তিব্বতি উৎসের তিনটি ধারা বিদ্যমান। প্রথম ধারা, তাঁর প্রধান তিব্বতি শিষ্য ও ‘কাদমপা’ সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠাতা দ্রোমতোনপা জলওয়েই জুংনে (১০০৫-১০৬৪ সাধারণাব্দ) ও নাগছো ছুলঠিম জলওয়া (১০১১-১০৬৪ সাধারণাব্দ) রচিত স্তোত্র, তিব্বতের বৃহত্তম বৌদ্ধ সম্প্রদায় ‘গেলুগ-পা’-র প্রতিষ্ঠাতা লামা জোং-খাপার (১৩৫৭-১৪১৯ সাধারণাব্দ) রচিত ‘লাম-রিম-ছেন-মো’ (‘মার্গক্রম মহাগ্রন্থ’) গ্রন্থে উল্লিখিত তাঁর সংক্ষিপ্ত জীবনী এবং তাঁর অন্যান্য ‘নাম-থর’ অর্থাৎ জীবনী সাহিত্য। এর মধ্যে দু’টি গ্রন্থ জা দুলজিন চোনডুইবর (১১০০-১১৭৪ সাধারণাব্দ) রচিত বলে স্বীকৃত ‘নাম-থর-গ্যে-পা’ (‘বিস্তারিত জীবনী’) ও ছিম নামখা দ্রাক (১২১০-১২৮৫ সাধারণাব্দ) রচিত বলে স্বীকৃত ‘নাম-থর-ইয়ং-দ্রাক’ (‘সর্বজনবিদিত জীবনী’) সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রচনা।

দ্বিতীয়ধারা, লামা বুতোন-রিনছেন-ডুব (১২৯০-১৩৬৪ সাধারণাব্দ) রচিত ‘ভারত ও তিব্বতে বৌদ্ধধর্মের ইতিহাস’(১৩২২ সাধারণাব্দ), গোই লোচাবা ঝোন-নু-পাল (১৩৯২-১৪৮১ সাধারণাব্দ) ১৪৭৮ সালে রচিত ‘দেব-থের-ঙোন-পো’ (‘নীল বিবরণ’ নামে বেশি পরিচিত), লামা তারনাথের (১৫৭৫-১৬৩৪ সাধারণাব্দ) ‘ভারতে বৌদ্ধধর্মের ইতিহাস’ (১৬০৮ সাধারণাব্দ), লামা সুমপা-খানপো-এশে-পাল জোরের (১৭০৪-১৭৮৮ সাধারণাব্দ) ‘পাগ-সাম-জোন-জং’(‘কল্পবৃক্ষ’) (১৭৪৮ সাধারণাব্দ) ও অন্যান্য তিব্বতি ইতিবৃত্তকারদের রচনা।

তিব্বতি উৎসের তৃতীয় ধারা, তিব্বতি বৌদ্ধ শাস্ত্রগ্রন্থ ‘তেঞ্জুর’-এ সংগৃহীত দীপংকরের রচিত, অনূদিত ও সম্পাদিত গ্রন্থসমূহের পুষ্পিকা (অর্থাৎ সংক্ষিপ্ত গ্রন্থ পরিচয়)।

প্রথম জীবন, প্রবজ্যা ও শিক্ষা

তিনটি ধারার তিব্বতি উৎস থেকে সংগৃহীত তথ্যসমূহ একত্রিত করলে অতীশের জীবনকথার একটি সংক্ষিপ্ত রূপরেখা পাওয়া যায়। অতীশ দীপংকর শ্রীজ্ঞান তিব্বতি পঞ্জিকার জল-অশ্ব বর্ষে (৯৮২ সাধারণাব্দ) জন্মগ্রহণ করেন এই মতই অধিকতর স্বীকৃত। অতীশ জন্মেছিলেন তৎকালীন বিক্রমপুর (অর্থাৎ, বর্তমান বাংলাদেশের মুন্সিগঞ্জ জেলা) অঞ্চলের বজ্রযোগিনী নগরে। বৌদ্ধ তান্ত্রিক দেবী বজ্রযোগিনীর নামে নামাঙ্কিত এই শহর আজও বিদ্যমান, বর্তমানে এর পরিচয় মুন্সিগঞ্জ সদর উপজেলায় অবস্থিত বজ্রযোগিনী ইউনিয়ন নামে। এখানে, অতীশের জন্মস্থান আজও ‘অতীশের ভিটা’ বা ‘নাস্তিক পণ্ডিতের ভিটা’ বলে পরিচিত। ২০১১-২০১৩ সালে সুফি মোস্তাফিজুর রহমানের নেতৃত্বে ‘অগ্রসর বিক্রমপুর ফাউন্ডেশন’-এর প্রত্নতত্ত্ববিদরা এই জন্মস্থানের কাছে মুন্সিগঞ্জ সদর উপজেলার রামপাল ইউনিয়নের রঘুরামপুর গ্রামে প্রত্নতাত্ত্বিক উৎখননের ফলে অতীশের সমকালীন একটি বৌদ্ধ বিহারের সন্ধান পান। নিকটবর্তী টংগিবাড়ী উপজেলার সোনারং-টংগিবাড়ী ইউনিয়নের নাটেশ্বর গ্রামে ২০১৩ সালে ‘অগ্রসর বিক্রমপুর ফাউন্ডেশন’-এর প্রত্নতত্ত্ববিদরা এবং তারপর ২০১৪-২০১৮ সালে বাংলাদেশ ও চীনের প্রত্নতত্ত্ববিদরা সুফি মোস্তাফিজুর রহমান ও চাই হুয়ানবোর যৌথ নেতৃত্বে উৎখননের কাজ চালান। এখানেও অতীশের সমসাময়িক বৌদ্ধ স্তূপ ও বিহারের সন্ধান পাওয়া যায়।তিব্বতি শাস্ত্রগ্রন্থ ‘তেঞ্জুর’-এও বিক্রমপুরী বিহারের উল্লেখ রয়েছে।দীপংকরের তিব্বতি শিষ্য ও পরবর্তী তিব্বতি ইতিবৃত্তকারদের মতে, অতীশের জন্ম বিক্রমপুরের রাজপরিবারে। তিব্বতি ঐতিহ্য অনুসারে বৌদ্ধ আচার্য শান্তরক্ষিতও এই রাজপরিবারেই জন্মগ্রহণ করেছিলেন। অতীশের পিতার নাম কল্যাণশ্রী ও মাতার নাম প্রভাবতী (বা শ্রীপ্রভা)। কল্যাণশ্রীর তিন পুত্রের মধ্যে অতীশ ছিলেন মধ্যম পুত্র। তাঁর পিতৃদত্ত নাম চন্দ্রগর্ভ। তাঁর জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার নাম পদ্মগর্ভ ও কনিষ্ঠ ভ্রাতার নাম শ্রীগর্ভ। বৌদ্ধ ধর্মে দীক্ষার পর শ্রীগর্ভের নামকরণ হয় বীর্যচন্দ্র।

চন্দ্রগর্ভ কৈশোরে প্রথম জেতারির কাছে তান্ত্রিক শিক্ষালাভ শুরু করেন। এরপর তিনি বিহারের রাজগিরের কাছে অবস্থিত কৃষ্ণগিরি বিহারে রাহুলগুপ্তের বা রাহুলগুহ্যবজ্রের কাছে তান্ত্রিকমতে অভিষিক্ত হয়ে বৌদ্ধ তন্ত্রের শিক্ষালাভ করেন। তান্ত্রিকমতে অভিষেকের পর তাঁর নামকরণ করা হয়েছিল ‘গুহ্যজ্ঞানবজ্র’। কোনও কোনও তিব্বতি জীবনী গ্রন্থে বলা হয়েছে, চন্দ্রগর্ভ রাহুলগুহ্যবজ্রের পূর্বে বোধিভদ্র, বিদ্যাকোকিল ও অবধূতিপার কাছ থেকেও শিক্ষালাভ করেন। গোই লোচাবা ঝোন-নু-পালের বিবরণ অনুযায়ী এই সময় অতীশ ওড্ডিয়ানে (সম্ভবত ওড়িশা) গিয়ে তিন বছর ডাকিনীদের গণচক্রে অংশগ্রহণ করেন এবং গুহ্যবজ্রগীতি শ্রবণ করেন।

অতীশ ওদন্তপুরী মহাবিহারে (গোই লোচাবা ঝোন-নু পালের বিবরণে বুদ্ধগয়ার মতিবিহারে) ‘মহাসাংঘিক’ সম্প্রদায়ের আচার্য শীলরক্ষিতের কাছে দীক্ষা নিয়ে বৌদ্ধ শাস্ত্র ও দর্শনের শিক্ষাগ্রহণ করেন। প্রবজ্যা ও দীক্ষার পর তাঁর নতুন নামকরণ হয় ‘দীপংকর শ্রীজ্ঞান’। অতীশ দীপংকর ওদন্তপুরী মহাবিহারে স্থবিরবাদী, মহাসাংঘিক, সম্মিতীয় ও সর্বাস্তিবাদী সম্প্রদায়ের ত্রিপিটকের অনুশীলন করলেও ব্যক্তিগত জীবনে কেবল মহাসাংঘিক সম্প্রদায়ের বিনয়পিটককে অনুসরণ করেছেন। ওদন্তপুরীতে তিনি শ্রাবকযানী আচার্য ধর্মরক্ষিতের কাছে সর্বাস্তিবাদী সম্প্রদায়ের অভিধর্ম গ্রন্থ কাত্যায়নীপুত্র রচিত ‘জ্ঞানপ্রস্থান’-এর ব্যাখ্যামূলক ‘মহাবিভাষা’ বা ‘অভিধর্ম বিভাষা’ গ্রন্থ অধ্যয়ন করেন। ওদন্তপুরীতে দীপংকর শ্রাবকযানী বৌদ্ধশাস্ত্র, বিশেষ করে বৈভাষিক দর্শনের যথেষ্ট অনুশীলন করেছিলেন অনুমান করা যায়। তিব্বতি ঐতিহ্য অনুযায়ী তিনি ওদন্তপুরীতে কলাপ, চান্দ্র ও পাণিনীয় ব্যাকরণ এবং দিঙনাগ ও ধর্মকীর্তির দার্শনিক রচনাও অধ্যয়ন করেছিলেন।

সুবর্ণদ্বীপ ও বিক্রমশীল মহাবিহার

১০১২ সাধারণাব্দে দীপংকর শ্রীজ্ঞান শিক্ষা অর্জনের জন্য সুবর্ণদ্বীপের (বর্তমান ইন্দোনেশিয়ার সুমাত্রা) উদ্দেশে রওনা হন। ১৩ মাস সমুদ্রপথে অনেক দুর্যোগ ও ঝঞ্ঝার সম্মুখীন হয়ে ১০১৩ সাধারণাব্দে সুবর্ণদ্বীপে পৌঁছান। এই যাত্রায় দীপংকরের সঙ্গী ছিলেন তাঁর শিষ্য ক্ষিতিগর্ভ। তিব্বতি জীবনীগ্রন্থে এই সমুদ্রযাত্রা নিয়ে কয়েকটি অলৌকিক কাহিনি সমাবিষ্ট হয়েছে। এই কাহিনিগুলিতে তৎকালীন শৈব তান্ত্রিক দেবদেবীদের প্রতি বৌদ্ধদের বিরূপতা অত্যন্ত সুস্পষ্ট। সুবর্ণদ্বীপে তিনি ১২ বছর মহাযানী আচার্য ধর্মকীর্তির (বা চন্দ্রকীর্তি) কাছে মহাযানী বৌদ্ধশাস্ত্র, বিশেষত মধ্যমক দর্শনের শিক্ষালাভ করেন। তিনি এখানে ‘অভিসময়ালংকার’, ধর্মকীর্তির রচিত ‘অভিসময়ালংকার’ গ্রন্থের টীকা ‘দুরববোধালোক’ও অন্যান্য গ্রন্থের দীর্ঘ অনুশীলন করেন। ১০২৫ সাধারণাব্দে অতীশ ভারতে ফিরে আসেন। তিনি ধর্মকীর্তির রচিত অন্যান্য গ্রন্থের সঙ্গে তাঁর লেখা ‘আর্য-অচলসাধন-নাম’ ও ‘ক্রোধ গণপতিসাধন’ গ্রন্থের পাণ্ডুলিপি সঙ্গে নিয়ে আসেন। ভারতে ফিরে আসার পর দীপংকর বজ্রাসনের (অর্থাৎ, বুদ্ধগয়া) মহাবোধি বিহারে অবস্থান করেন। এখানে তিনি তিনবার তীর্থিক (অর্থাৎ বেদ অনুসারী) দার্শনিকদের বিতর্কে পরাস্ত করেন।এরপর, পাল বংশীয় শাসক প্রথম মহীপালের (রাজত্বকাল ৯৭৭-১০২৭ সাধারণাব্দ) অনুরোধে তিনি বিক্রমশীল মহাবিহারেরউপাধ্যায় পদ গ্রহণ করেন। প্রথম মহীপালের পরবর্তী পালবংশীয় শাসক নয়পাল (রাজত্বকাল ১০২৭-১০৪৩ সাধারণাব্দ) তাঁকে নিজের আধ্যাত্মিক গুরু বলে মানতেন।

বিক্রমশীল মহাবিহারের ভিক্ষুদের শৃঙ্খলারক্ষার দায়িত্বও অতীশ বহন করতেন। একাধিক তিব্বতি গ্রন্থে তিনি তৎকালীন প্রসিদ্ধ বৌদ্ধ তান্ত্রিক সিদ্ধ সাধক মৈত্রীপাকে (ইনি মৈত্রেয়পাদ ও অদ্বয়বজ্র নামেও পরিচিত ছিলেন) শৃঙ্খলাভঙ্গের অভিযোগে বিক্রমশীল মহাবিহার থেকে বহিষ্কার করেছিলেন বলে উল্লিখিত আছে। বজ্রযোগিনী সাধনার জন্য বিহারের অভ্যন্তরে দেশি মদ রাখার অভিযোগে তাঁকে বহিষ্কার করা হয়েছিল বলে অতীশের একটি জীবনী গ্রন্থে বলা হয়েছে।

পশ্চিম তিব্বতের ‘গুগ’ রাজ্যের শাসক ইয়েশে-ওদ (৯৪৭-১০১৯/২৪ সাধারণাব্দ) প্রাতিষ্ঠানিক বৌদ্ধধর্মের সংস্কার ও প্রসারের জন্য অনেক উদ্যোগ গ্রহণের করেছিলেন। তিনি বিক্রমশীল মহাবিহারে পাঠরত তিব্বতি শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে অতীশের প্রতিভার সম্পর্কে জানতে পেরে তাঁকে বৌদ্ধ ধর্ম ও দর্শনের শিক্ষাদান করতে তিব্বত আসার জন্য আমন্ত্রণ জানানোর সিদ্ধান্ত নেন। তাঁর ইচ্ছাকে বাস্তবায়িত করতে ১০৩১ সাধারণাব্দে ‘গুগ’ রাজ্যের আরেক শাসক ইয়েশে-ওদ-এর ভ্রাতুষ্পুত্র জাংছুব-ওদ (৯৮৪-১০৭৮ সাধারণাব্দ) তাঁর লেখা আমন্ত্রণপত্রও কিছু স্বর্ণখণ্ড সমেত জ্যা চোনডুই সেংগেকে বিক্রমশীল মহাবিহারে প্রেরণ করেন, কিন্তু অতীশ তিব্বত যেতে রাজি হলেন না। জ্যা চোনডুই সেংগে পরে অধ্যয়নের জন্য আবার বিক্রমশীল মহাবিহারে আসেন। এরপর তিব্বতি বৌদ্ধ সন্ন্যাসী ও অনুবাদক নাগছো ছুলঠিম জলওয়া জাংছুব-ওদ-এর আমন্ত্রণপত্র নিয়ে বিক্রমশীল মহাবিহারে এসে অতীশকে আবার তিব্বত যেতে অনুরোধ করেন। অতীশ জ্যা চোনডুই সেংগে ও নাগছো ছুলঠিম জলওয়ার কাছ থেকে তিব্বতে বৌদ্ধ ধর্মের ইতিহাস ও তৎকালীন পরিস্থিতি সম্পর্কে অবহিত হওয়ার পরশেষ পর্যন্ত তিব্বত যেতে রাজি হন।

নেপাল ও পশ্চিম তিব্বত

১০৪০ সাধারণাব্দে দীপংকর শ্রীজ্ঞান বিক্রমশীল মহাবিহার থেকে তিব্বতের পথে যাত্রা শুরু করেন। বিক্রমশীলের স্থবির (অর্থাৎ সর্বোচ্চ পদে অধিষ্ঠিত ভিক্ষু) তাঁকে তিব্বত যেতে রাজি হবেন না বলে তিনি গোপনে বিক্রমশীল মহাবিহার ত্যাগ করেন। তিব্বতি ঐতিহ্য অনুযায়ী, অতীশ তিব্বত যাওয়ার পূর্বে বিক্রমশীল থেকে বজ্রাসনে তীর্থযাত্রা করে আসেন। অতীশ যখন বজ্রাসনে অবস্থান করছিলেন, তখন কলচুরিরাজ লক্ষ্মীকর্ণ তাঁর সেনা নিয়ে মগধ আক্রমণ করেন। কলচুরি সেনা মগধের একাধিক বৌদ্ধবিহারে লুণ্ঠন চালায়, বৌদ্ধ ভিক্ষু ও গৃহী উপাসকদের হত্যা করে। অতীশ কিন্তু এই ঘটনায় বিন্দুমাত্র বিচলিত হননি, বরঞ্চ নয়পালের বিজয়ের পর, তাঁরই উদ্যোগে উভয়ের মধ্যে শান্তিচুক্তি সম্পাদিত হয়। অতীশ বিক্রমশীল ত্যাগ করার কিছু পূর্বে মহাসিদ্ধ নারোপা (৯৫৬-১০৪০ সাধারণাব্দ) বিক্রমশীল বিহার পরিদর্শনে আসেন। নারোপা অতীশকে তাঁর অবর্তমানে সদ্ধর্ম (অর্থাৎ বৌদ্ধধর্ম) প্রচারের দায়িত্ব অর্পণ করে দক্ষিণের দিকে যাত্রা করেন, সেখানেই তাঁর অল্পদিন পর মৃত্যু হয়।

বিক্রমশীল মহাবিহার থেকে তিব্বত যাত্রায় অতীশের সঙ্গী হয়েছিলেন জ্যা চোনডুই সেংগে, নাগছো ছুলঠিম জলওয়া, তাঁর ভাই বীর্যচন্দ্র, ভারতীয় শিষ্য ভূমিগর্ভ এবং আরও কয়েকজন। তিব্বত যাওয়ার পথে অতীশ ১০৪১ সাধারণাব্দে নেপালের কাঠমাণ্ডু উপত্যকায় পৌঁছে স্বয়ম্ভূ চৈত্যে কিছু দিন অবস্থান করেন। স্বয়ম্ভূ চৈত্যে তিব্বতের রাজপ্রতিনিধিরা তাঁকে স্বাগত জানান। তিব্বতি প্রথায় চা বানিয়ে নিবেদন করা হয়। তিব্বতি ইতিবৃত্তকারদের বিবরণ থেকে জানা যায় অতীশ প্রথম চা পানের পর মুগ্ধ হয়ে চায়ের প্রশস্তিমূলক একটি কবিতা রচনা করেছিলেন। অতীশ নেপালে থাকার সময়ঠম-এ (বর্তমানে কাঠমাণ্ডুর ঠমেল এলাকা) একটি বিহার স্থাপন করেন। নেপালেই তাঁর সঙ্গী জ্যা চোনডুই সেংগের মৃত্যু হয়। তিব্বতে প্রবেশ করার পর ১০৪২ সাধারণাব্দে অতীশ মানস সরোবর হয়ে ‘গুগ’ রাজ্যের রাজধানীথোলিং পৌঁছান।

দীপংকর শ্রীজ্ঞান তিব্বতে অবস্থানকালে ধর্মীয় সাধনা ও দর্শনের শিক্ষার মাধ্যমে তিব্বতের তৎকালীন জীবনচর্যা ও সংস্কৃতির সঙ্গে ভারতীয় বৌদ্ধধর্মের মূল সিদ্ধান্ত, মহাযানী বৌদ্ধ মধ্যমক দর্শন এবং মন্ত্রযানী (বা বজ্রযানী) তান্ত্রিক সাধনাকে সংযুক্ত করতে সক্ষম হন। তিনি তিব্বতি বৌদ্ধ ভিক্ষুদের তৎকালীন তান্ত্রিক সাধনার যৌন আচার ও নরবলির মতো প্রথাকে ত্যাগ করার এবং বিনয়পিটক নির্দেশিত ব্রহ্মচর্য পালন করে তন্ত্র গ্রন্থ নির্দেশিত পূজা, মন্ত্রজপ, যোগ ও ধ্যানকে সাধনপথ হিসেবে অনুসরণ করার শিক্ষা দেন। ‘বোধিপথপ্রদীপ’ গ্রন্থের ৬৪-৬৭তম শ্লোকে তাঁর এই মত অত্যন্ত স্পষ্টভাবে ব্যক্ত। দীপংকর তান্ত্রিক সাধনার সামগ্রিকভাবে বিরোধী ছিলেন না এবং সাধনার অঙ্গ হিসাবে তান্ত্রিক চিত্র অঙ্কণ, চৈত্য ও তান্ত্রিক দেবদেবীদের প্রতিমার উপাসনা, চর্যাগীতি, বজ্রগীতিও দোহাকে যথেষ্ট গুরুত্ব দিতেন। তৎকালীন তিব্বতের বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে কেবল সর্বাস্তিবাদী বিনয়পিটক স্বীকৃত ছিল, সেই কারণে অতীশ মহাসাংঘিক বিনয়পিটক কখনও শিক্ষাদান করতে পারেননি। অতীশের জীবনীগ্রন্থে বলা হয়েছে এই কারণে অতীশ যথেষ্ট অসন্তোষ প্রকাশ করেছিলেন। তিব্বত প্রবাসের প্রথম তিন বছর (১০৪২-১০৪৫ সাধারণাব্দ) তিনি পশ্চিম তিব্বতের ঞারি অঞ্চলে, মুখ্যত থোলিং বিহারে অবস্থান করেন। ৯৯৭ সাধারণাব্দে এশে-ওদ এই বিহার নির্মাণ করান। এই সময়কার উল্লেখনীয় ঘটনা প্রখ্যাত তিব্বতি বৌদ্ধ বিদ্বান ও সংস্কৃত বৌদ্ধ শাস্ত্রের অনুবাদক রিনছেন জাংপোর (৯৫৮-১০৫৫ সাধারণাব্দ) সঙ্গে সাক্ষাৎকার। এই সময় অতীশ রিনছেন জাংপোকে বৌদ্ধ তান্ত্রিক সাধনার যে রীতি ব্যাখ্যা করেছিলেন, মধ্যযুগের তিব্বতে সেই রীতিই সর্বাধিক স্বীকৃতি লাভ করে। এরপর রিনছেন জাংপো অতীশের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন এবং অতীশকে সংস্কৃত থেকে তিব্বতি ভাষায় গ্রন্থ অনুবাদে যথেষ্ট সাহায্য করেন।

মধ্য তিব্বতে শেষ জীবন

অতীশের সঙ্গে তাঁর পরবর্তীকালের প্রধান শিষ্য ও ‘কাদমপা’ সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠাতা দ্রোমতোনপার সঙ্গে প্রথম সাক্ষাৎ হয় তিব্বত প্রবাসের তিন বছর অতিবাহিত হওয়ার পর, ঞারি এলাকায় এক পরিভ্রমণের সময়। দ্রোমতোনপা গৃহী উপাসক ছিলেন, কখনও সন্ন্যাস গ্রহণ করেননি। দ্রোমতোনপার অনুরোধে তিনি ভারতে ফিরে আসার পরিবর্তে জীবনের শেষ দশক মধ্য তিব্বত পরিভ্রমণ ও শিক্ষাদান করে অতিবাহিত করেন। মধ্য তিব্বতে থাকাকালীন একবার স্বদেশে ফেরার জন্য নেপাল সীমান্ত পর্যন্ত এসেও নেপাল ও তিব্বতের মধ্যে কোনও গোলযোগের কারণে পথ বন্ধ থাকায় তাঁকে ফিরে যেতে হয়। অতীশের জীবনীগ্রন্থের বর্ণনা থেকে অনুমান করা যায় অতীশ বুঝতে পেরেছিলেন মধ্য তিব্বতের বৌদ্ধ বিহারগুলির তৎকালীন ভারতের চেয়ে অধিকতর পৃষ্ঠপোষকতা লাভের কারণে সেখানকার ভিক্ষুদের সংখ্যা ও তাঁদের মধ্যে ধর্মীয় আচার ও সাধনা শিক্ষার আগ্রহ যথেষ্ট বেশি। সম্ভবত সেই কারণেই অতীশ মধ্য তিব্বতেই থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন।

অতীশ মধ্য তিব্বত পরিভ্রমণের সময় তিব্বতি পঞ্জিকার জল-শূকর বর্ষে (১০৪৭ সাধারণাব্দে) সামিয়ের পেকার মন্দিরে কিছু দিন অবস্থান করেন। এখানে তিনি ভারতে লুপ্ত হয়ে যাওয়া কয়েকটি সংস্কৃত পাণ্ডুলিপির সন্ধান পান। অতীশ এই পাণ্ডুলিপিগুলির প্রতিলিপি তৈরি করে ভারতে পাঠিয়ে দেন। সামিয়ে থেকে লাসা হয়ে নেথাং আসার সময় তিনি লাসার প্রখ্যাত জোখাং মন্দিরে অবলোকিতেশ্বর ও জোবো শাক্যমুনির প্রতিমা দর্শন করে অভিভূত হন, তিনি শাক্যমুনির এই প্রতিমাকে বুদ্ধের যথার্থ ‘নির্মাণকায়’ বলে মন্তব্য করেন।

অতীশ ঞোক জাংছুপ জুংনের আমন্ত্রণে লাসা থেকে ইয়েরপা এসে এখানে কিছুদিন অতিবাহিত করেন। ইয়েরপা থেকে তিনি নেথাং-এ চলে আসেন। তিব্বতি পঞ্জিকার কাষ্ঠ-অশ্ব বর্ষে (১০৫৪ সাধারণাব্দে) নেথাং-এর দ্রোলমা লাকাং-এ(অর্থাৎ তারাদেবীর মন্দির) তাঁর জীবনাবসান হয়। জীবনাবসানের পূর্বে তাঁর শেষ উপদেশ ছিল ‘ধর্মান্ আলোকয়ামঃ’। অতীশের জীবনাবসানের পর তাঁর শিষ্য দ্রোমতোনপা তাঁর অসাধারণ সাংগঠনিক ক্ষমতা ও অধ্যবসায়ের মাধ্যমে তিব্বতে প্রাতিষ্ঠানিক বৌদ্ধধর্মের বিস্তার এবং গৃহী উপাসকদের কাছে জনপ্রিয়তা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে এক ব্যাপক পরিবর্তনের সূত্রপাত করেন। সেই কারণেই মধ্যযুগের তিব্বতের ধর্মীয় ইতিবৃত্তকাররা দ্রোমতোনপার গুরু অতীশ দীপংকরকে এত শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করেছেন।

অতীশ বিক্রমশীল মহাবিহার ত্যাগকরার সময় কয়েকটি সংস্কৃত পুথি সঙ্গে নিয়েছিলেন। তিব্বতে আসার পথে নেপালেও তিনি কিছু সংস্কৃত পুথি উপহার হিসেবে পেয়েছিলেন। অতীশের জীবনাবসানের পর তাঁর এই সংস্কৃত পাণ্ডুলিপিগুলি শিষ্য দ্রোমতোনপা লাভ করেন। ১০৫৬ সাধারণাব্দে দ্রোমতোনপা লাসার কাছে রেডিং-এ একটি বৌদ্ধ বিহার স্থাপন করে পাণ্ডুলিপিগুলি সেখানে রেখে দেন। তারনাথ তাঁর আত্মজীবনীতে উল্লেখ করেছেন, ১৬০১ সাধারণাব্দে রেডিং বিহারে অবস্থানকালে তিনি বেশ কয়েকটি পুথির নীচের দিকে সংস্কৃতে ‘ভঙ্গাল পণ্ডিত ভিক্ষু দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞানস্য পুস্তকম্’ লেখা দেখতে পেয়েছিলেন। এই পুথিগুলির মধ্যে কয়েকটি সম্ভবত আজও লাসার পোটালা প্রাসাদে সংরক্ষিত আছে।

দীপংকর শ্রীজ্ঞান রচনাবলি

অতীশ দীপংকরের সংস্কৃতে রচিত, সংস্কৃত থেকে তিব্বতি ভাষায় অনূদিত এবং সম্পাদিত গ্রন্থের সংখ্যা প্রায় দু’শোর কাছাকাছি। তাঁর সর্বাধিক শ্রদ্ধেয় গ্রন্থ ‘বোধিপথপ্রদীপ’, সংস্কৃত ভাষায় লেখা, মাত্র ৬৮টি শ্লোকে সমাপ্ত। জ্ঞানের স্বরূপ বোধিসত্ত্ব মঞ্জুশ্রীকে বন্দনা করে তিনি এই গ্রন্থের সূচনা করেছেন। আনুমানিক ১০৪২-১০৪৩ সাধারণাব্দে থোলিং বিহারে অবস্থানকালে জাংছুব-ওদ-এর অনুরোধে তিনি এই গ্রন্থ রচনা করেন। তিনি এই গ্রন্থের ‘বোধিমার্গ দীপপঞ্জিকা’ নামক একটি সংস্কৃত ভাষ্যও রচনা করেছিলেন। তিনি এই গ্রন্থদ্বয়ের তিব্বতি ভাষায় অনুবাদেও অংশগ্রহণ করেছিলেন। কাগজের তিনটি পৃষ্ঠার উপর লেখা ‘বোধিপথপ্রদীপ’ গ্রন্থের একটি প্রতিলিপি অতীশ ভারতে বৌদ্ধ বিদ্বানদের পড়ার জন্য পাঠিয়েছিলেন। ‘বোধিপথপ্রদীপ’ গ্রন্থে তিনি বোধি লাভের যে পন্থার কথা বলেছিলেন, তিব্বতি ঐতিহ্যে সেই পন্থা ‘লাম-রিম’ (মার্গ-ক্রম) নামে পরিচিত। এই ধারা অনুসরণ করেইজোং-খাপা ১৪০২ সাধারণাব্দে ‘লাম-রিম-ছেন-মো’গ্রন্থ রচনা করেন।

অতীশ দীপংকর রচিত ‘বিমলরত্নলেখ’ নেপাল থেকে পালবংশীয় শাসক নয়পালের উদ্দেশে সংস্কৃত ভাষায় রচিত ৪০টি শ্লোক বিশিষ্ট উপদেশ সম্বলিত একটি পত্র। ‘তেঞ্জুর’-এ সংগৃহীত তাঁর আর একটি রচনা ‘বোধিসত্ত্ব মণ্যাবলি’র শ্লোকগুলি এই ‘বিমলরত্নলেখ’ গ্রন্থের শ্লোকের প্রায় অবিকল অনুলিপি। অতীশ দীপংকর শ্রীজ্ঞান বৌদ্ধ মধ্যমক দর্শনের বুদ্ধপালিত, ভাববিবেক ও চন্দ্রকীর্তির প্রতিষ্ঠিত ধারার অনুসারী ছিলেন। তাঁর লেখা মধ্যমক দর্শন বিষয়ক গ্রন্থের মধ্যে উল্লেখনীয় ‘মধ্যমকোপদেশ’, ‘বোধিসত্ত্বচর্যাবতারভাষ্য’,‘রত্নকরণ্ডোদ্ঘাটনাম-মধ্যমকোপদেশ’, ‘সত্যদ্বয়াবতার’, ‘সূত্রসমুচ্চয়সঞ্চয়ার্থ’ এবং ‘মহাসূত্রসমুচ্চয়’। দীপংকর শ্রীজ্ঞান তাঁর দু’টি গ্রন্থ –২৮টি শ্লোকবিশিষ্ট ‘সত্যদ্বয়াবতার’ ও ‘বোধিসত্ত্বচর্যাবতারভাষ্য’ সুবর্ণদ্বীপের গুরু ধর্মকীর্তির প্রত্যক্ষ প্রেরণায় রচনা করেন। প্রজ্ঞামুক্তি সংস্কৃত ভাষায় ‘মধ্যমকোপদেশবৃত্তি’ নামে ‘মধ্যমকোপদেশ’ গ্রন্থের একটি ব্যাখ্যামূলক গ্রন্থ রচনা করেন। ‘চর্যাসংগ্রহপ্রদীপ’ গ্রন্থে অতীশের সংস্কৃত ভাষায় রচিত ২২টি চর্যাগীতি সঙ্কলিত হয়েছে। ১০৪১ সাধারণাব্দে নেপালে তাঁর বন্ধু এক বৌদ্ধ ভিক্ষুর অনুরোধে তিনি এই গ্রন্থ রচনা করেন।

অতীশ থোলিং বিহারে থাকাকালীন জাংছুব-ওদ-এর জন্য গুহ্যসমাজতন্ত্র অনুসারী অবলোকিতেশ্বর সাধনপদ্ধতি নিয়ে ‘শ্রীগুহ্যসমাজলোকেশ্বরসাধন’ গ্রন্থটি রচনা করেন। অতীশ নিজে বৌদ্ধ দেবী তারার তন্নিষ্ঠ সাধক ছিলেন। তিব্বতের ঐতিহ্য অনুযায়ী অতীশের তারাদেবীর সাধনার শিক্ষা সেখানে তারা উপাসনার জনপ্রিয়তার অন্যতম কারণ, যদিও অতীশ তিব্বতে কখনও তারা দেবীর বজ্রযানী (তান্ত্রিক) উপাসনারীতি প্রচার করেননি।

দীপংকরের রচনাসমূহ অন্ত-মধ্যযুগেই মঙ্গোলীয় ভাষায় অনূদিত হয়েছিল। বিশ শতকে অতীশ দীপংকরের শ্রীজ্ঞানের ‘বোধিপথপ্রদীপ’ ইংরেজি, হিন্দি, বাংলা, ফরাসি, জার্মান ও ড্যানিশ ভাষায় অনূদিত হয়েছে। তাঁর ‘মধ্যমকোপদেশ’ ইংরেজি ও জাপানি ভাষায় অনূদিত হয়েছে। ১৯৯২ সালে ‘অতীশবিরচিতা একাদশগ্রন্থাঃ’ নামে অতীশের ১১টি রচনার রমেশচন্দ্র নেগী কর্তৃক তিব্বতি থেকে সংস্কৃত রূপের পুনর্গঠন ও রচনাগুলির হিন্দি অনুবাদ বারাণসীর সারনাথ থেকে কেন্দ্রীয় উচ্চ তিব্বতি শিক্ষা সংস্থান প্রকাশ করেন। অতীশের ‘বোধিপথপ্রদীপ’, ‘চর্যাসংগ্রহপ্রদীপ’, ‘সত্যদ্বয়াবতার’, ‘মধ্যমকোপদেশ’, ‘বোধিসত্ত্বমণ্যাবলি’, ‘ধর্মধাতুদর্শনগীতি’,‘গর্ভসংগ্রহ’, ‘হৃদয়নিক্ষেপ’ প্রমুখ রচনার হিন্দি অনুবাদ এই গ্রন্থে সংকলিত হয়েছে। ২০০০ সালে ‘দ্য কমপ্লিট ওয়ার্কস অফ অতীশ শ্রী দীপংকর জ্ঞান’ নামে রিচার্ড শেরবার্ন কৃত অতীশ দীপংকরের ‘বোধিপথপ্রদীপ’, এই গ্রন্থের দীপংকরের স্বকৃত ভাষ্য এবং তাঁর লেখা আরও ২৫টি গ্রন্থের ইংরেজি অনুবাদ দিল্লির আদিত্য প্রকাশন থেকে প্রকাশিত হয়েছে। ২০০৬ সালে থুপতেন জিনপা কৃত ‘বোধিসত্ত্বমণ্যাবলি’ গ্রন্থের ইংরেজি অনুবাদ ‘বোধিসত্ত্ব’স জুয়েল গারল্যান্ড’ নামে ‘মাইন্ড ট্রেনিং: দ্য গ্রেট কালেকশন’ গ্রন্থে প্রকাশিত হয়। ২০০৬ সালেই বেইজিং থেকে তিব্বতি ভাষায় অতীশের সমগ্র রচনাবলি প্রকাশিত হয়েছে। এই রচনাসংগ্রহের অনেক গ্রন্থ ‘তেঞ্জুর’-এ সংগৃহীত হয়নি। ২০২০ সালে ঢাকার প্রথমা প্রকাশন থেকে ‘অতীশ দীপঙ্কর রচনাবলি’ নামে অতীশ দীপংকরের ‘বোধিপথপ্রদীপ’ সমেত ৩১টি গ্রন্থের রায়হান রাইন কৃত বাংলা অনুবাদ প্রকাশিত হয়েছে। তবে আজও বিদ্বৎসমাজের তিব্বত ও বৌদ্ধ ধর্মীয় সাহিত্য চর্চার জগতের বাইরে অতীশ দীপংকর শ্রীজ্ঞান প্রায় অজ্ঞাত।

উপসংহার

তিব্বত, মঙ্গোলিয়া, নেপাল, ভূটানও ভারতের মন্ত্রযানী বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা আচার্য অতীশ দীপংকরকে আজও একই রকম শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করেন। তাঁর রচিত গ্রন্থমালার পাঠ ও ব্যাখ্যার ধারা এই বিস্তীর্ণ ভূভাগের বৌদ্ধ বিহারগুলিতে আজও অব্যাহত। ১৯৮৪ সালে নেপালের কাঠমান্ডুতে তিব্বতি অভিবাসীদের শিশুদের শিক্ষার জন্য স্থাপিত একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় তাঁর নামে নামকরণ করা হয়। ইন্দোনেশিয়ার রাজধানী জাকার্তার কাছে বান্তেন প্রদেশের তানজেরাং উপ-প্রদেশের চুরুগ জেলার বিনোং-এ স্থাপিত হয়েছে অতীশ দীপংকর বিদ্যালয়। ২০০৪ সালে ঢাকায় স্থাপিত হয়েছে অতীশ দীপঙ্কর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়। তিব্বতে বৌদ্ধ ধর্ম সাধনার ইতিহাসে তাঁর অবদান নিয়ে সাম্প্রতিক কালে বেশ কিছু গবেষণা হয়েছে কিন্তু,অতীশ ভারতের বৌদ্ধ মধ্যমক দর্শনের প্রায় শেষ দিকের বিদ্বান, তাই পরবর্তীকালের ভারতের বিদ্বানদের মধ্যে অতীশের বৌদ্ধ দর্শনের ব্যাখ্যার প্রভাব ও প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে আরও গবেষণার প্রয়োজন আছে।

পাদটীকা

১. ‘তেঞ্জুর’-এ সংগৃহীত তাঁর তারা দেবী বিষয়ক লেখা গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে ‘তারাভট্টারিকাসাধন’, ‘আর্যতারাসাধন’, ‘অষ্টভয়ত্রাণ’ ও ‘আর্যতারাস্তোত্র’। বৌদ্ধ তান্ত্রিক দেবতা যমারির সাধনা নিয়ে তাঁর ‘তেঞ্জুর’-এ সংগৃহীত গ্রন্থগুলির মধ্যে রয়েছে – ‘চণ্ডখড়্গযমারিসাধন’ ‘বজ্রতীক্ষ্ণযমারিসাধন’, ‘অমিতাভহৃদয়রাগযমারিসাধন’, ‘কৃষ্ণযমারিক্রোধরাজাবত্সরসাধন’, ‘শ্রীকৃষ্ণযমারিসাধন’, ‘কৃষ্ণযমারিসাধন’, ‘প্রজ্ঞাসুখপদ্মযমারিসাধন’, ‘দণ্ডধৃক-বিদারযমারিনামসাধন’, ‘মুদ্গরক্রোধযমারিসাধন’, ‘রত্নসম্ভবযমারিসাধন’ এবং ‘বৈরোচনযমারি-অভিসময়নাম’।

‘তেঞ্জুর’-এ সংগৃহীত অতীশ দীপংকরের অন্যান্য মধ্যমক দর্শন ও তন্ত্র সাধনা বিষয়ক গ্রন্থের মধ্যে উল্লেখনীয় ‘ধর্মধাতুদর্শনগীতি’,‘প্রজ্ঞাপারমিতাপিণ্ডার্থপ্রদীপ’, ‘প্রজ্ঞাহৃদয়ব্যাখ্যা’, ‘হৃদয়নিক্ষেপ’, ‘বোধিমার্গপ্রদীপ’, ‘বোধিসত্ত্বচর্যাসূত্রীকৃতাববাদ’, ‘বোধিসত্ত্বাদিকর্মিকমার্গাবতারদেশনা’, ‘দশ-অকুশলকর্মপথ(দেশনা)’ ‘সর্বসময়সংগ্রহ’, ‘বলিবিধি’,‘হোমবিধি’, ‘বিমলোউষ্ণীষধারণীবিধি’ ‘পঞ্চচৈত্যনির্বপণবিধি’‘শ্রীবজ্রযোগিনীসাধন’, ‘কর্মবজ্রগৌরীসাধন’‘একবীরসাধন’, ‘খসর্পণঅবলোকিতসাধন’, ‘আর্যহয়গ্রীবসাধন’, ‘শ্রীহয়গ্রীবসাধন’,‘আর্যষড়ক্ষরীসাধন’,‘গণপতিগুহ্যসাধন’,‘বজ্রচর্চিকাসাধন’, ‘বজ্রডাকিনীযোগিনীসাধন’, ‘বজ্রগীতিসুখার্ধসাধন’, ‘কুলপ্রণিধান’, ‘গর্ভসংগ্রহ’, ‘কর্মবিভঙ্গ’ ‘সূত্রার্থসমুচ্চয়োপদেশ’, ‘গুরুক্রিয়াক্রম’, ‘শরণগমনদেশনা’, ‘পারমিতাযানসঞ্চ(ক) নির্বপণবিধি’, ‘মহাযানপথসাধনসংগ্রহ’ এবং ‘মহাযানপথসাধনবর্ণসংগ্রহ’।

২. ‘তেঞ্জুর’-এ সংগৃহীত দীপংকরের রচনার পুস্পিকাগুলিতে তাঁকে ‘দীপংকরজ্ঞান’, ‘শ্রীদীপংকরজ্ঞান’ ও ‘দীপংকর’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। তিব্বতি ভাষায় ‘জোবো’ সংস্কৃত বিভু, বল্লভ বা ভট্টারকের অনুবাদ এবং‘জে’ সংস্কৃত স্বামী বা প্রভু শব্দের অনুবাদ হিসেবে প্রযুক্ত হয়।এ ক্ষেত্রে সম্ভবত সংস্কৃত অতীশ শব্দের অতি ও ঈশের অনুবাদ হিসেবে ‘জে’ ও ‘জোবো’ প্রযুক্ত হয়েছে। দেখুন: Lokesh Chandra, “Atiśa Śrī Dīpaṅkara-jñāna and the BuddhistCosmopolis” in Shashibala edited, “Atiśa Śrī Dīpaṅkara-jñāna andCultural Renaissance: Proceedings of the International Conference16th – 23rd January 2013”; New Delhi: Indira Gandhi National Centre for The Arts, 2018, pp. 3-5.

৩. Sufi Mustafizur Rahman, M. Mamun Dewan, Muhammad Mahbubul Alam, Mohammad Shohrab Uddin, M. Awlad Hossain; Chai Huanbo, Li Yiyuan, Mo Linheng and Yuan Weipp, “Vikramapura” in Abdul Momin Chowdhury and Ranabir Chakravarti edited ‘History of Bangladesh: Early Bengal in Regional Perspectives (up to c. 1200 CE)’, Vol. 1; Dhaka: Asiatic Society of Bangladesh, 2018,pp. 441-466.

৪. Dipak Kumar Barua, ‘Vihāras in Ancient India: A Survey of Ancient Monasteries’; Calcutta: Indian Publications, p. 177.

৫. বিক্রমশীল মহাবিহারের অবস্থান আজও নিশ্চিত ভাবে জানা যায়নি। তবে বিহারের ভাগলপুর জেলার অন্তিচক গ্রামের পূর্বদিকে ১৯৭১ থেকে ১৯৮১ সাল পর্যন্ত ভারতীয় প্রত্নতাত্ত্বিক সর্বেক্ষণের উৎখননের পর এই প্রত্নক্ষেত্রটিকেই বিক্রমশীল মহাবিহারের অবশেষ বলে মোটামুটিভাবে ধরে নেওয়া হয়েছে। দেখুন: B.S. Verma, ‘Antichak Excavations-2 (1971-1981)’; New Delhi: The Director General, Archaeological Survey of India, 2011, pp. 391-392।

৬. পালবংশীয় শাসকদের রাজত্বকাল নিয়ে এখনও যথেষ্ট মতবিরোধ রয়েছে। এই নিবন্ধে দীনেশচন্দ্র সরকারের ‘পাল-সেন যুগের বংশানুচরিত’ গ্রন্থকে অনুসরণ করা হয়েছে। দেখুন: দীনেশচন্দ্র সরকার, ‘পাল-সেন যুগের বংশানুচরিত’; কলকাতা: সাহিত্যলোক, ২০১৭, পৃ. ৭৭-৮০।

৭. MarkTatz,“Maitrī-pa and Atiśa” in Helga Uebach and Jampa L. Panglung edited, ‘Tibetan Studies: Proceedings of the 4th Seminar of the International Association for Tibetan Studies. Munich 1985’; Munich: Kommission für Zentralasiatische Studien Bayerische Akademie der Wissenschaften, 1988, pp. 473-482.

৮. Kazuo Kano, “The Transmission of Sanskrit Manuscripts from India to Tibet: The Case of a Manuscript Collection in the Possession of Atiśa Dīpaṃkaraśrījñāna (980–1054)” in Carmen Meinert edited ‘Transfer of Buddhism Across Central Asian Networks (7th to 13th Centuries)’; Leiden: Brill, 2015, pp. 82-117.

৯. Stephan Beyer, ‘Magic and Ritual in Tibet: The Cult of Tara’; Delhi: Motilal Banarsidass, 2001, pp. 11-13.

তথ্যসূত্র

১. James B.Apple, ‘Jewels of the Middle Way: The Madhyamaka Legacy of Atiśa and His Early Tibetan Followers’; Somerville: Wisdom Publications, 2019.

২.James B.Apple, ‘Atiśa Dīpaṃkara: Illuminator of the Awakened Mind’; Colorado: Sambhala Publications, 2019.

৩. A.Chattopadhyaya, ‘Atīśa and Tibet: Life and Works of Dīpaṃkara Śrījñāna in Relation to the History and Religion of Tibet’; Calcutta: Indian Studies: Past and Present, 1967.

৪. অলকা চট্টোপাধ্যায়, ‘অতীশ দীপংকর শ্রীজ্ঞান’; কলকাতা: অনুষ্টুপ, ২০১৮।

৫. গৌরী মিত্র, ‘অতীশ দীপঙ্কর’; কলকাতা, গ্রন্থতীর্থ, ২০০৯।

৬. জিতেন্দ্র লাল বড়ুয়া, ‘অতীশ দীপংকর(৯৮২-১০৫৪): জীবন ও কর্ম’; ঢাকা: জোনাকী প্রকাশনী, ২০০১।

৭. জিতেন্দ্র লাল বড়ুয়া, ‘দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞানঅতীশ’; ঢাকা: অন্যধারা, ২০১৪।

৮. S.C. Das, ‘Indian Pandits in the Land of Snow’ Calcutta: Baptist Mission Press, 1893, pp. 50-76.

৯. L.T. Kalsang, ‘Atisha: A Biography of the Renowned Buddhist Sage’; New Delhi: Mahayana Publications, 1984.

১০. D.S.Ruegg, ‘The Literature of the Madhyamaka School of Philosophy in India. Vol. VII, Fasc. I’; Weisbaden: Otto Harrassowitz, 1981, pp. 110-113.

১১. D.Tulku and G.H. Mullin edited, ‘Atisha and Buddhism in Tibet’; New Delhi: Tibet House, 1983.

১২. Thupten Jinpa translated and edited, ‘Mind Training: The Great Collection’; Boston: Wisdom Publications, 2006.

১৩.HelmutEimer, “The Development of the Biographical Tradition concerning Atiśa (Dīpaṃkaraśrījñāna).” In ‘Journal of the Tibet Society’ vol. 2; London, 1982,pp. 41-51.

১৪.Richard Sherburne, ‘A Lamp for the PathandCommentaryofAtīśa’; London: George Allen & Unwin, 1983.

লেখক যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রযুক্তিবিদ্যার স্নাতক এবং বিগত তিন দশক ধরে বিমান প্রযুক্তিবিদ্যার সঙ্গে যুক্ত। ইতিহাসের আগ্রহী পাঠক। ইতিহাস নিয়ে লেখালেখির সূত্রপাত সাম্প্রতিক।

মন্তব্য তালিকা - “অতীশ দীপংকর – আদি-মধ্যযুগের বাংলার এক মহাপরিব্রাজক  ”

  1. অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান সম্পর্কে আমরা জানি কম। এই লেখাটাতে তাঁর একটা সামগ্রিক পরিচয় পেলাম।
    লেখককে ধন্যবাদ জানাচ্ছি।

  2. একজন বাঙালী হিসেবে আমি গর্বিত, শ্রীজ্ঞান অতীশ দিপংকর বাঙালী ছিলেন।
    শ্রদ্ধেয় মধুশ্রী বন্দ্যোপাধ্যায়কে অনেক অনেক ধন্যবাদ, শ্রীজ্ঞানকে অজ্ঞান বাঙালিদের সামনে তুলে ধরার জন্য।

মন্তব্য করুন

আপনার ইমেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।