
জৈন ও বৌদ্ধ দর্শনে নিরীশ্বরবাদ
ভারতীয় দর্শনের একটা গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ হল কার্যকারণ ব্যাখ্যা – যা কিছুর অস্তিত্ব আছে তার অস্তিত্ব কেন আছে তার অনুসন্ধান। কার্য অর্থাৎ ফলাফল, আর কার্যের নেপথ্যে থাকে কারণ। মৃৎপাত্রের উপাদানকারণ হল মাটি, আর নিমিত্তকারণ হল কুমোর। আবার এই কারণগুলোর পিছনেও কারণ থাকে, আর সেই কারণগুলিরও কারণ থাকে – এই কার্যকারণ পরম্পরা প্রায় সব দর্শনেরই আলোচ্য বিষয়। ন্যায় দর্শনের মতে জগৎ সৃষ্টির নেপথ্যেও একজনকে থাকতে হবে যার ‘ইচ্ছা’ থেকে জগতের সৃষ্টি ও প্রলয় বারবার চক্রাকারে হয়েছে। ইনিই জগতের নিমিত্তকারণ, ইনিই ন্যায় দর্শনে ঈশ্বর রূপে পরিচিত। ন্যায়মতে জগতের উপাদানকারণ হল পরমাণু, আর নিমিত্তকারণ হলেন ঈশ্বর। এই ঈশ্বরের ইচ্ছা না থাকলে ন্যায় দর্শনে জগৎ সৃষ্টির ব্যাখ্যা করা যায় না। এই ঈশ্বর অতীন্দ্রিয় কিন্তু তাঁর ইচ্ছা আছে। এই ধারণার প্রতিফলন দেখা যায় বেদান্তেও। ন্যায়মতে উপাদানকারণ জড়, আর নিমিত্তকারণ হল চেতন- মাটি আর কুমোরের মতো। নৈয়ায়িকরা মনে করেন এই নিয়ম সমগ্র জগতের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য – তাই একজন চেতনাসম্পন্ন ঈশ্বরকে তাঁরা জরুরি মনে করেন।
ন্যায় দর্শনে ঈশ্বর একটিই, এবং এর সপক্ষে নৈয়ায়িকদের যুক্তি হল ঈশ্বর এক না হলে একাধিক ঈশ্বরের পারস্পরিক দ্বন্দ্ব চলত। বেদান্তেও এই ধারণা দেখা যায়। বেদান্তের সিংহভাগ শাখায় (দ্বৈত, বিশিষ্টাদ্বৈত, দ্বৈতাদ্বৈত ইত্যাদি) বিষ্ণুই একমাত্র ঈশ্বর, বাকি দেবতারাও তাঁর ইচ্ছায় চালিত – বৈষ্ণব পুরাণগুলিও সেই ধারণাটাকেই বলবৎ করে। বৈষ্ণব পুরাণগুলিতে বিষ্ণুর ইচ্ছায় জগৎ বারবার সৃষ্টি ও ধ্বংস হচ্ছে – এই ঈশ্বরের ইচ্ছায় সৃষ্টি-প্রলয়ের চক্র পরবর্তীকালীন ন্যায়-বৈশেষিক দর্শনের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। বেদান্ত দর্শনের প্রামাণ্য সাহিত্যগুলির একটি হল গীতা। ভগবানের হাতে প্রকৃতি ও পঞ্চভূতের পুনঃ পুনঃ সৃজনের বক্তব্য পাওয়া যায় গীতায়ও (৯.৮), সেখানে ভগবানকে সবকিছুর প্রবর্তা (১০.৮) এবং বীজপ্রদ পিতা (১৪.৪) রূপে বর্ণনা করা হয়েছে। প্রকৃতি থেকে যে বিশ্বচরাচরের সৃষ্টি হয়, সেই প্রক্রিয়ার পরিদর্শকও তিনিই (৯.১০)।
ন্যায় ও বেদান্তের এই ঈশ্বরের ধারণার যুক্তি সহকারে আপত্তি জানিয়েছিল জৈন ও বৌদ্ধ দর্শন। ভারতে অন্তত পাঁচটি দর্শনে নিরীশ্বরবাদী যুক্তি চোখে পড়ে। যার মধ্যে আছে তিনটি নাস্তিক দর্শন (বৌদ্ধ, জৈন, চার্বাক) আর দুটি আস্তিক দর্শন (সাংখ্য, পূর্ব মীমাংসা)। এই আলোচনা প্রথম দুটিকে নিয়ে।
জৈন নিরীশ্বরবাদ
জৈনধর্ম মৌলিকভাবে নিরীশ্বরবাদী। মহাবিশ্ব ঐশ্বরিক ইচ্ছা দ্বারা সৃষ্ট বা ঐশ্বরিক মনন দ্বারা পরিচালিত – এই মতবাদকে জৈনরা কঠোরভাবে প্রত্যাখ্যান করে এসেছে। জৈন দর্শনে প্রকৃতির নিয়মগুলিই প্রকৃতিকে ব্যাখ্যা করার জন্য যথেষ্ট। জৈনধর্মে যক্ষযক্ষী ও দেবদেবীদের অস্তিত্ব থাকলেও সৃষ্টিকর্তা ঈশ্বরের ধারণা সেখানে মৌলিকভাবে নেই।
ঈশ্বরের ধারণার বিরুদ্ধে জৈন দর্শনের যুক্তির সবচেয়ে ভালো উদাহরণ পাওয়া যায় জৈন ‘মহাপুরাণ’ গ্রন্থে, যা নবম শতাব্দীতে দিগম্বর শিক্ষক জিনসেন দ্বারা সংস্কৃতে রচিত হয়েছিল। জিনসেন রাষ্ট্রকূট রাজ্যবাসী ছিলেন। সমগ্র মহাপুরাণ বইটি হিন্দু পুরাণের আদলে লেখা এবং এতে প্রধানত বিশ্বতত্ত্ব এবং পিতৃপুরুষ ও তীর্থঙ্করদের কিংবদন্তি রয়েছে। হিন্দু পুরাণের মতো, এটিতেও বহুবিধ দার্শনিক এবং তার্কিক বিষয় আলোচিত হয়েছে। মহাপুরাণের বিশেষ একটি অংশ [মহাপুরাণ, ৪.১৬-৩১, ৩৮-৪০] এই প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য। নীচে মূল সংস্কৃতের ইংরাজি অনুবাদ থেকে বাংলায় ভাষান্তর করা হল (বন্ধনীর অংশগুলো এই লেখকের নিজস্ব টিপ্পনী) –
“কিছু মূর্খ ঘোষণা করে যে একজন সৃষ্টিকর্তা পৃথিবী তৈরি করেছেন। বিশ্বকে যে সৃষ্টি করা হয়েছিল এই ধারণাটিই অযৌক্তিক।
ঈশ্বর যদি পৃথিবী সৃষ্টি করেন তবে সৃষ্টির আগে তিনি কোথায় ছিলেন? আপনি যদি বলেন তিনি তখন অতীন্দ্রিয় ছিলেন, এবং তাঁর কোনো অবলম্বনের প্রয়োজন ছিল না, তাহলে এখন তিনি কোথায়?
কোনো সত্তারই এককভাবে এই জগৎ তৈরি করার দক্ষতা ছিল না – কেন না একজন নির্বস্তুক ঈশ্বর কি করে সেই জিনিস তৈরি করবেন যা বস্তুনির্মিত? কিভাবে ঈশ্বর কোনো কাঁচামাল ছাড়া পৃথিবী তৈরি করতে পারে? আপনি যদি বলেন যে তিনি প্রথমে কাঁচামাল তৈরি করেছেন, এবং তারপরে এই বিশ্বকে, তাহলে এই যুক্তি একটি সীমাহীন চক্রের মুখোমুখি হয়। (অর্থাৎ প্রশ্ন আসবে কাঁচামালগুলো কে নির্মাণ করেছিল বা কাঁচামালের কাঁচামাল কোথা থেকে এলো)
আপনি যদি দাবি করেন যে এই কাঁচামাল ‘স্বাভাবিকভাবেই’ উদ্ভূত হয়েছে, তাহলে আপনি অন্য একটি ভ্রান্তির মধ্যে পড়ে যান – যে মহাবিশ্বের কিছু বস্তু নিজেই নিজের স্রষ্টা (ঈশ্বরের হস্তক্ষেপ ছাড়াই)।
ঈশ্বর যদি কোনো কাঁচামাল ছাড়া শুধু নিজের ইচ্ছা থেকে পৃথিবী নির্মাণ করেন, তাহলে এটা শুধু তার ইচ্ছা ব্যতীত আর কিছু না – এই মূর্খতা কে বিশ্বাস করবে?
ঈশ্বর যদি চিরন্তনভাবে নিখুঁত এবং সম্পূর্ণ হন, তবে কীভাবে তাঁর মধ্যে সৃষ্টি করার ইচ্ছা জাগবে? (সম্পূর্ণতা লাভের পর আরও কিছু যোগ করার ইচ্ছা সম্পূর্ণতার পরিপন্থী) অন্যদিকে, তিনি যদি নিখুঁত না হন, তবে তাঁর তৈরী মহাবিশ্ব একজন কুম্ভকারের সৃষ্টির চেয়ে খুব বেশি আলাদা হবে না।
তিনি যদি নিরাকার, কর্মহীন এবং সর্বাঙ্গীণ হন, তাহলে তিনি কীভাবে বিশ্ব সৃষ্টি করতে পারতেন? কারণ এইরূপ (নিরাকার, কর্মহীন এবং সর্বাঙ্গীণ) আত্মা সমস্ত সংসাধনবর্জিত, তাঁর কিছু সৃষ্টি করার কোন ইচ্ছা থাকবে না।
যদি তিনি নিখুঁত হন, তবে তিনি মানুষের মতো তিনটি লক্ষ্যের (ধৰ্ম-অর্থ-কাম) প্রত্যাশা রাখেন না, তাহলে মহাবিশ্ব সৃষ্টি করে তার লাভ কী হবে?
আপনি যদি বলেন, যে তিনি কোন উদ্দেশ্য ছাড়াই সৃষ্টি করেছেন, কারণ এটি করা তাঁর স্বভাব ছিল, তাহলে (এরকম উদ্দেশ্যহীন) ঈশ্বর অর্থহীন।
যদি তিনি খেলাচ্ছলে জগৎ সৃষ্টি করেন, তবে এটি একটি মূর্খ শিশুর খেলা ছিল।
যদি তিনি প্রাণীদের বিগত জন্মের কর্মফলরূপে জগৎ সৃষ্টি করেন তবে তিনি সর্বশক্তিমান প্রভু নন, অন্য কিছুর দ্বারা চালিত।
(টিপ্পনী – ন্যায় দর্শনের মতে প্রত্যেকবার সৃষ্টিক্রিয়ার সময় ঈশ্বর পূর্বকর্মের ফল জগতের প্রতিটা পরমাণুর মধ্যে আরোপ করেন, এবং এর ফলে তাদের ভবিষ্যৎ বা অদৃষ্ট নির্ধারিত হয়। প্রশ্ন আসে – যদি কর্মফল দিয়েই ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করা যায়, তাহলে ভবিষ্যৎ নির্মাণে ঈশ্বরের ভূমিকা কী? আর ঈশ্বরই যদি সমস্ত বস্তুর ভবিষ্যৎ ঠিক করে দেন তাহলে কর্মফলের ভূমিকা কী? ঠিক এই জায়গাটায় এসেই জিনসেন মোক্ষম আঘাত হেনেছেন ন্যায় দর্শনের সৃষ্টিতত্ত্বে। কর্মফলবাদের সঙ্গে সৃষ্টিকর্তা ঈশ্বরের ধারণা যে খাপ খায় না – সেটা তিনি এখানে দেখিয়েছেন।)
যদি ঈশ্বর জীবের প্রতি ভালবাসা এবং তাদের প্রয়োজন মাথায় রেখে পৃথিবী তৈরি করেন তবে কেন তিনি এই সৃষ্টিকে সম্পূর্ণ আনন্দময়, দুর্ভাগ্যমুক্ত করলেন না? তিনি নিজের সন্তানদের হত্যা করেন – যা পাপ। যদি আপনি বলেন দুরাচারীদের শাস্তি দিতে তিনি এই কাজ করেন, তাহলে প্রশ্ন ওঠে – তিনি দুরাচার বা দুরাচারীদের সৃষ্টিই বা করলেন কেন?”
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, কার্ল সাগান তাঁর কসমোস বইটিতে জিনসেনের এই বক্তব্যের কিছু অংশ উদ্ধৃত করেছেন।
জৈন দর্শন প্রমাণ করেছিল – ঈশ্বরও মূলত কার্য (অর্থাৎ ফলাফল)। তাই তাঁকে সব কারণের আদি কারণ বলা যায় না। জৈন দর্শন কার্যত এটাই বলেছিল – ঈশ্বর আসলে সৃষ্ট বস্তু, তিনি সৃষ্টিকর্তা নন। চতুর্দশ শতাব্দীর জৈন দার্শনিক গুণরত্নের লেখায় জৈন দর্শনের আরও কয়েকটি যুক্তি দেখা যায় – ঈশ্বরের সৃষ্টির বৈচিত্র এতই বেশি যে মানতে হবে ভিন্ন ভিন্ন বস্তু সৃষ্টি করার সময় তাঁর ইচ্ছারও বারবার পরিবর্তন হয়েছে, আর তা যদি হয় তিনি অপরিবর্তনশীল শাশ্বত নন। আর দেখা যায় ন্যায়দর্শনের একেশ্বর তত্ত্বের উপর মোক্ষম আঘাত। নৈয়ায়িকরা বলে – ঈশ্বর একাধিক হলে তাদের মধ্যে দ্বন্দ্ব থাকত। জৈন দর্শন তার উত্তরে বলেছে- যেখানে পিঁপড়ে আর মৌমাছিরা পারস্পরিক সহযোগিতা সহকারে কাজ করে – সেখানে ঈশ্বর এই দ্বন্দ্বটুকু যদি সামলাতে না পারেন তাহলে সেই ঈশ্বর অনির্ভরযোগ্য। তোমরা যে ঈশ্বরকে সমস্ত সদ্গুণের আধার বানিয়েছ এই ঈশ্বর তার বিপরীত।
আধুনিক বিজ্ঞান গত দুই শতাব্দীতে প্রমাণ করতে পেরেছে যে জগতের নির্মাণ স্বতঃস্ফুর্ত ভাবেই সম্ভব। ডারউইনীয় বিবর্তন এবং বিগ ব্যাং থিওরি দেখাতে পেরেছে বিশ্বসৃষ্টির ব্যাখ্যায় কোনো বুদ্ধিমান স্রষ্টার ইচ্ছা বা উদ্যোগের প্রয়োজন নেই। এই বৈজ্ঞানিক তত্ত্বগুলোকে নাকচ করার জন্য খ্রিস্টান ধর্মতাত্ত্বিকরা গত শতাব্দীতে একটা নূতন তত্ত্ব আনার চেষ্টা করেছে – যার নাম হল ‘ইন্টেলিজেন্ট ডিজাইন’। তারা প্রাণপণে প্রমাণ করার চেষ্টা করছে যে জগৎসৃষ্টি একজন বুদ্ধিমান স্রষ্টার কাজ। এই ‘ইন্টেলিজেন্ট ডিজাইন’ তত্ত্বকে নস্যাৎ করার জন্য বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং একটা বই লিখেছিলেন যার নাম ‘দ্য গ্র্যান্ড ডিজাইন’। এই ইন্টেলিজেন্ট ডিজাইন আর গ্র্যান্ড ডিজাইন তত্ত্বের দ্বন্দ্বের সঙ্গে তুলনীয় বিষয় দেখা যায় প্রাচীন ভারতীয় দর্শনেও – যেখানে ন্যায়দর্শন ও বেদান্তের প্রণেতারা প্রমাণ করার চেষ্টা করেছিলেন একজন ঈশ্বরের ইচ্ছা এবং উদ্যোগ থেকে বারবার জগৎ সৃষ্টি হয় – যেটাকে ‘ইন্টেলিজেন্ট ডিজাইন’ তত্ত্বের সঙ্গে তুলনা করা যায়। আর সেটাকে নস্যাৎ করার জন্য জিনসেন ও অন্যান্য জৈন দার্শনিকেরা যে যুক্তিগুলো দিয়েছেন তা অনেকাংশেই আধুনিক যুক্তিবাদীদের সঙ্গে তুলনীয়।
বৌদ্ধ নিরীশ্বরবাদ
বৌদ্ধ নিরীশ্বরবাদের সবচেয়ে বলিষ্ঠ যুক্তি পাওয়া যায় চতুর্থ শতাব্দীর দার্শনিক বসুবন্ধুর রচনায়। বসুবন্ধু ঈশ্বরতত্ত্বের বিরোধিতা করেছেন তিনটি আঙ্গিকে – ঈশ্বরের একত্ব খণ্ডন, ঈশ্বরের উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপন, এবং ঈশ্বরের অপরিহার্যতাকে খণ্ডন। সবার প্রথমে তিনি প্রশ্ন করেছেন ঈশ্বরের একত্বকে। তাঁর রচিত অভিধর্মকোষভাষ্যম্-এ তিনি যুক্তি দেখিয়েছেন – “যদি জগত সৃষ্টির একটিই মাত্র কারণ থাকত, সেই একক কারণটি ঈশ্বর হোক বা অন্য যা কিছু হোক, সকল জাগতিক বস্তুর উৎপত্তি একসঙ্গে, একই সময়ে সম্পূর্ণভাবে হত। কিন্তু বাস্তবে সৃষ্টিক্রিয়া ক্রমানুসারে ঘটে – একের পর এক – বিবর্তনমূলক প্রক্রিয়া হিসাবে। তাহলে দেখা যাচ্ছে – প্রত্যেকটি বস্তুর ক্ষেত্রে ঈশ্বরের সৃষ্টির ইচ্ছা জাগছে, এবং পরমুহুর্তেই সেই ইচ্ছার বিলয় হচ্ছে।”
এটাকে আরেকটু সহজ করে এভাবে বলা যায় – বীজের থেকে অঙ্কুর হয়, অঙ্কুর থেকে পাতা, তার পর গুঁড়ি, তার পর শাখাপ্রশাখা এবং তার পর ফুল ও ফল হয় – অর্থাৎ একের পর এক উৎপত্তি হচ্ছে – একযোগে নয়। বসুবন্ধু এবার বিরোধীপক্ষের যুক্তি মাথায় রেখে বলছেন, “কেউ এর বিপক্ষে বলতে পারে যে প্রত্যেকটি বস্তুর সৃষ্টি আর বিলোপ ঈশ্বরদ্বারা পূর্ব-ইচ্ছিত। কিন্তু সেক্ষেত্রে, আমরা (প্রত্যেকটি বস্তুর ক্ষেত্রে ভিন্ন ভিন্ন) বহুবিধ ইচ্ছা দেখতে পাচ্ছি ঈশ্বরের, অতএব জগৎ সৃষ্টির ইচ্ছাও বহুবিধ হওয়া উচিত। ঈশ্বরকে অখণ্ড ধরা হলে, এই বহুবিধ ইচ্ছাসমূহ ঈশ্বরের মধ্যে একযোগে উপস্থিত হতে পারে কি?” বসুবন্ধু আরো বলেছেন – যে মনে করে মহাবিশ্বের একটিই মাত্র কারণ আছে তাকে তাহলে অস্বীকার করতে হবে যে অন্যান্য (মানবকৃত) কার্যের নেপথ্যে মানুষের প্রচেষ্টা আছে। এইভাবে বসুবন্ধু এক ও অখণ্ড ঈশ্বরের ধারণাকে খণ্ডন করেছেন।
ঈশ্বরের উদ্দেশ্য নিয়ে বসুবন্ধু প্রশ্ন তুলেছেন – ঈশ্বর কি নেহাতই প্রীতি-বশত জগৎ সৃষ্টির প্রয়াস করেছিলেন? নেহাতই প্রীতি জেগে উঠল বলেই তিনি উদ্যোগ নিলেন – তাহলে বলতে হয় নিজের উপর তাঁর কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। তাহলে অন্য কোনো কিছুর উপরেই বা তাঁর নিয়ন্ত্রণ কী করে থাকে? ঈশ্বর যদি তাঁর প্রজাদের নরকবাসের যন্ত্রণা দেখে প্রীত হন, তাহলে সেই ঈশ্বরকে আমাদের প্রণাম! আর নেহাত কোনো প্রয়োজন ছাড়াই যদি তিনি জগৎ সৃষ্টি করে থাকেন, তাহলে তিনি উন্মাদ।
এরপর বসুবন্ধু বলছেন – ধরে নিলাম একা ঈশ্বর যথেষ্ট নন জগতের উৎপত্তি ব্যাখ্যায়, তাহলে ঈশ্বরকে যথেষ্ট কারণ (sufficient condition) হিসেবে না নিয়ে অন্তত অপরিহার্য কারণ (necessary condition) হিসেবে দেখা যায়? অর্থাৎ অন্য অনেক কারণের পাশাপাশি ঈশ্বর একটা কারণ, তবে একমাত্র কারণ নন। এই যুক্তি দেখা যায় ন্যায় দর্শনে – সেখানে পরমাণুর নিত্যতাকে স্বীকার করা হয়, আর সেইসঙ্গে আত্মার নিত্যতা। প্রত্যেকবার প্রলয়ের শেষে ঈশ্বর সমস্ত পরমাণুকে একত্র করে জগৎ সৃষ্টি করেন এবং নিত্য আত্মাসমূহকে জড় দেহের মধ্যে স্থাপন করেন। এখানে ঈশ্বরের পাশাপাশি আরও কারণ আছে – তারা হল পরমাণু। ঈশ্বর নিমিত্তকারণ আর পরমাণু উপাদানকারণ – মৃৎপাত্রের ক্ষেত্রে যেমন কুমোর আর মাটি। বসুবন্ধুর প্রশ্ন – ঈশ্বর কেন তাহলে সবকিছুর কারণ হয়ে উঠতে পারলেন না? পরমাণুসমূহের কারণ তিনি নন কেন? মজার ব্যাপার যে, পরবর্তীকালে শঙ্করাচার্যের ঈশ্বরবাদী দর্শনও এই একই প্রশ্ন তুলেছিল ন্যায় দর্শনের বিরুদ্ধে, আর সেটার উত্তরেই শঙ্করাচার্য অদ্বৈতের ধারণা প্রচার করেন – যেখানে নিমিত্ত ও উপাদানকারণের দ্বৈততাকে অস্বীকার করা হয়।
ফেরা যাক বসুবন্ধুর যুক্তিতে। তিনি বলছেন, ঈশ্বর যদি সবকিছুর কারণ না হন, তাহলে কি তিনি কার্য (অর্থাৎ কারণের ফলাফল)? সেটা যদি হয় ঈশ্বরের কারণ থাকবে আর সেই কারণেরও কারণ থাকবে, আর এভাবে চলতে চলতে আমরা অসীমে গিয়ে ঠেকবো। এই যুক্তি দিয়ে দেখলে জগৎ অনাদি- তার কোনো সৃষ্টি নেই – তাই সৃষ্টিকর্তাও নেই।
ঈশ্বরকে নিমিত্তকারণরূপে দেখানোর জন্য ঈশ্বরবাদীরা আরেকটা যুক্তি দেখায় – সমস্ত জটিল সৃষ্টির পিছনে একজন বুদ্ধিমান স্রষ্টা দেখা যায়। অতএব জগতের মতো জটিল বস্তুর সৃষ্টিতেও একজন বুদ্ধিমান ঈশ্বরের হাত থাকবে। অষ্টম শতাব্দীর তিব্বতি বৌদ্ধ দার্শনিক শান্তরক্ষিত তাঁর তত্ত্বসংগ্রহ গ্ৰন্থে এই প্রসঙ্গে বলেছেন, সমস্ত জটিল সৃষ্টির নেপথ্যে একাধিক স্রষ্টা থাকে। যে কোনো জটিল সৃষ্টি একাধিক নিমিত্তকারণ ও উপাদানকারণের যোগফল। পিঁপড়ের ঢিবি তৈরি করে বহুসংখ্যক পিঁপড়ে একত্রিত হয়ে, নগর সৃষ্টি করে অনেক মানুষ একত্রভাবে। অতএব জগৎকে একজন সৃষ্টিকর্তার কাজ ভাবার কোনো কারণ নেই। যদি একজনের ইচ্ছায় জগৎ নির্মাণ হত তাহলে জাগতিক বস্তুদের মধ্যে পারস্পরিক সংঘাত দেখা যেত না। অতএব এক এবং একমাত্র এক সৃষ্টিকর্তা ঈশ্বরের ধারণা যুক্তিযুক্ত নয়।
বিষ্ণু আর শিবকে ঘিরে একেশ্বরবাদ ঘেঁষা ভক্তিমার্গ তখন হিন্দু ধর্মে জেগে উঠছিল। বৈষ্ণবদের চোখে বিষ্ণুই ছিলেন জগতের একমাত্র সৃষ্টিকর্তা ও পালনকর্তা, শৈবদের বিশ্বাসও অনেকটা একই রকম। এরকম অবস্থায় ঈশ্বর তথা একেশ্বরের ধারণাকে বলিষ্ঠ ভাবে নাকচ করেছিল বৌদ্ধ ও জৈন দর্শন।
সপ্তম শতাব্দীতে তামিলনাড়ুর এক ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মেছিলেন বৌদ্ধ দার্শনিক ধর্মকীর্তি। মিহিরকুলের আক্রমণ, গুপ্তসাম্রাজ্য ভেঙে পড়া, রোম সাম্রাজ্যের পতনের পর পাশ্চাত্যের সঙ্গে বহির্বাণিজ্য বন্ধ হওয়া, অগ্রহার অর্থনীতির প্রসার – এগুলির ফলে ধীরে ধীরে বৌদ্ধধর্ম দুর্বল হয়ে পড়ছিল। এরকম সময়েই ধর্মকীর্তির আবির্ভাব। তিনি নালন্দা মহাবিহারের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।
জগৎসৃষ্টির সময়ে ঈশ্বর কারণ রূপ নিলেন, কিন্তু তার আগে তিনি অকারণ ছিলেন – এই দুই রূপের ব্যাখ্যা কী? কেনই বা তিনি পরিবর্তিত হলেন? আর যাঁর স্বরূপ পরিবর্তিত হল, তাঁকে নিত্যবস্তু কী করে বলা যায়? ধর্মকীর্তি এই প্রশ্নগুলির মাধ্যমে ঈশ্বরের অস্তিত্বকে খণ্ডন করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন ক্ষণিক বস্তুর পক্ষেও কারণ হয়ে ওঠা সম্ভব – অস্ত্রের আঘাত ক্ষতের কারণ, আর ঔষধ নিরাময়ের। অস্ত্র আর ওষুধ দুটোই ক্ষণিক বস্তু। তাই ঈশ্বর নামক কোনো নিত্যবস্তুকে জগতের কারণ ধরার কোনো প্রয়োজন নেই। ঈশ্বর এবং আত্মা দুটিকেই খণ্ডন করার বিষয়ে ধর্মকীর্তির প্রধান পদ্ধতি ছিল নিত্যবাদের খণ্ডন।
নিত্যবস্তু আদৌ থাকতে পারে না – কার্যবস্তু এমনিতেও নিত্য নয় কারণ সেটি অন্য বস্তু থেকে উৎপন্ন, কিন্তু কারণবস্তুও নিত্য হতে পারে না – নূতন বস্তুর উৎপত্তির জন্য কারণকে বিকারগ্রস্ত হতেই হবে। নিত্য বস্তু বলে যদি কিছু থাকে তার মধ্যে বিকার হওয়া সম্ভব নয়, কারণ সেটি নিত্য, আর বিকার না হলে তার পক্ষে ক্রিয়াশীল হওয়া সম্ভব নয়। অতএব নিত্যবস্তু সর্বদাই নিষ্ক্রিয়। মন বা চেতনা কোনো নিত্যবস্তু নয়। মন হল প্রতি ক্ষণে উদয়-বিলয়, উদয়-বিলয়ের এক ধারাবাহিক প্রবাহ। মন থেকে মনের জন্ম হয়ে চলেছে প্রতিমুহূর্তে। নিত্য আত্মার ধারণাই স্নেহ-মোহ এবং অনর্থের মূল- এগুলিই দুঃখের কারণ – ধর্মকীর্তির মতে। বৌদ্ধ দর্শন বহু শাখায় বিভক্ত হলেও ক্ষণিকবাদের তত্ত্ব বৌদ্ধ ধর্মে সর্বজনস্বীকৃত। বৌদ্ধ দার্শনিকরা স্থায়ী আত্মার ধারণাকে খণ্ডন করতে যেমন ক্ষণিকবাদের ব্যবহার করেছিল, তেমনই ঈশ্বরের ধারণাকে খণ্ডন করতেও ধর্মকীর্তি ক্ষণিকবাদকেই ব্যবহার করেছেন।
প্রশ্ন জাগে বৌদ্ধ দর্শন কি তার নিরীশ্বরবাদী চরিত্র সার্বিকভাবে ধরে রাখতে পেরেছিল? বৌদ্ধ ধর্মে ত্রিকায় তত্ত্ব দেখা যায়, যেখানে বুদ্ধের তিনটি কায়া –
১. ধর্মকায় যা অনন্ত, নিরাকার, বিশ্বব্যাপী ও শূন্য।
২. সম্ভোগকায় – বুদ্ধের সেই কায়া যা উচ্চমার্গের ভক্তরাই দেখতে পায়।
৩. নির্মাণকায় – যে রূপে বুদ্ধ সাধারণ মানুষকে দেখা দিয়েছেন। শাক্যমুনি গৌতম বুদ্ধ হলেন এই নির্মাণকায়।
খ্রিস্টপূর্ব প্রথম শতকে অষ্টসাহস্রিকা প্রজ্ঞাপারমিতায় ধর্মকায়ের ধারণা প্রথম দেখা যায়। অনেক বৌদ্ধ শাখায় ধর্মকায়কে ‘চিরন্তন’ রূপে দেখা হয়, তাকে ‘পরমার্থ সৎ’ রূপে বর্ণনা করা হয়। প্রশ্ন জাগে – ধর্মকায় যদি চিরন্তন হয় তাহলে তা কী করে ক্ষণিকবাদের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ? ধর্মকায় যদি পরমার্থ সৎ হয় তাহলে প্রশ্ন হল তা শূন্য বস্তু কী করে হয়? মহাযানের বিভিন্ন শাখায় এই প্রশ্নগুলোর উত্তর নানাভাবে দেওয়া হয়েছে।
মহাযান বৌদ্ধ ধর্মে শূন্যই একমাত্র সত্য। বস্তু বা তার উপাদানসমূহের কোনো নিজস্ব স্বভাব নেই – এটাই হল শূন্যের ধারণা। কিন্তু এই শূন্য নামক সত্যটা আমাদের চোখের আড়াল হয়ে থাকে দুটি আবরণ বা অবিদ্যার মাধ্যমে – ক্লেশাবরণ ও জ্ঞেয়াবরণ। এদেরকে সরাতে পারলেই সেই শূন্যের সন্ধান পাওয়া সম্ভব, দুঃখনিবৃত্তি বা মুক্তিলাভ সম্ভব। পরবর্তীকালের শংকরাচার্যের মায়াবাদ বা অদ্বৈত এই অবিদ্যার আবরণের ধারণাগুলিকেই গ্ৰহণ করেছে – শূন্যের জায়গায় ব্রহ্ম নিয়ে এসে। মহাযানমতে মানুষকে এই মুক্তিলাভে সাহায্য করেন বোধিসত্ত্বরা।
একটা কথা নিঃসন্দেহে বলা যায় – এই ধর্মকায়ের ধারণার ফলে ঐতিহাসিক গৌতম বুদ্ধের পাশাপাশি এক কাল্পনিক বুদ্ধ শরীরের ধারণা তৈরি হয়, যেখান থেকে আরো নূতন নূতন কাল্পনিক বুদ্ধরূপের এবং বোধিসত্ত্বদের জন্ম হয় – অবলোকিতেশ্বর, মঞ্জুশ্রী, বৈরোচন ইত্যাদি। আরও পরে বুদ্ধদের সঙ্গে তাদের নারীশক্তি বা প্রজ্ঞাও যুক্ত হয় – বিষ্ণু-লক্ষ্মী, শিব-পার্বতীর মতো। বৈরোচন বুদ্ধের শক্তি হলেন বজ্রধাত্বীশ্বরী, রত্নসম্ভব বুদ্ধের লোচনা ইত্যাদি। ঐতিহাসিক গৌতম বুদ্ধকে দেবতার স্তরে উত্তীর্ণ করা তো অনেক আগেই হয়েছিল, সেইসঙ্গে এল বহুবিধ কাল্পনিক বুদ্ধ ও তাদের শক্তির ধারণা।
ত্রিকায়তত্ত্ব বৌদ্ধ ধর্মকে বিভিন্ন ঈশ্বরবাদী ধর্মের কাছাকাছি নিয়ে আসে। সম্ভোগকায়ের সঙ্গে মিল পাওয়া যায় হিন্দু অবতারবাদের – যেখানে পরমাত্মা মানবদেহ ধারণ করেন সাধারণ মানুষের জন্য। ত্রিকায়তত্ত্বের সঙ্গে খ্রিস্টান ধর্মের ট্রিনিটারিয়ানিজম এবং হাইপোস্ট্যাটিক ইউনিয়নের ধারণারও মিল পাওয়া যায়। অমিলও আছে – কারণ ত্রিকায়তত্ত্বে কোনো সৃষ্টিকর্তা ঈশ্বরের ধারণা নেই।
তথ্যসূত্র
জৈন নিরীশ্বরবাদ:
১. Surendranath Dasgupta, ‘A History of Indian Philosophy, Vol. I.-V’ – chapters on Nyaya and Jaina philosophy.
২. Ainslie T. Embree, ‘Sources of Indian Tradition – Jain Philosophy and Political Thoughts’.
বৌদ্ধ নিরীশ্বরবাদ:
১. Richard P. Hayes, “Principled Atheism in the Buddhist Scholastic Tradition.” In ‘Journal of Indian Philosophy, vol. 16, no. 1’; 1988, pp. 5-28.
২. Nalinaksha Dutt, ‘Mahayana Buddhism’ Chapter V- Conception of Kaya.
৩. রাহুল সাংকৃত্যায়ন (বাংলা অনুবাদ- বৌদ্ধ ধর্মাঙ্কুর বিহার), ‘বৌদ্ধ দর্শন’।
৪. নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য, ‘ধর্ম ও সংষ্কৃতি : প্রাচীন ভারতীয় প্রেক্ষাপট’ (ষষ্ঠ অধ্যায়- বৌদ্ধ ধৰ্ম)।
৫. ‘Stanford Encyclopedia of Philosophy’ – entry on “Dharmakirti”.
গুরুত্বপূর্ণ লেখা। প্রাঞ্জল ভাষা। সুন্দর পরিবেশনা।