অশোক ও তাঁর ধম্মো
তৎকালীন ধর্মগুলির সাথে অশোকের সম্পর্ক
অশোকের (৩০৫ – ২৩২ সাধারণ পূর্বাব্দ) রেখে যাওয়া শিলানুশাসনগুলি তার কীর্তির অনন্য স্বাক্ষর। হরপ্পীয় অপঠিত লেখর পরে এই প্রথম ভারতবর্ষে কোন লিখিত পুরাদ্রব্য পাওয়া গেল। শিলানুশাসনগুলি খোদিত হয়েছে প্রাকৃত, ইন্দো-আরমীয় ও গ্রিক ভাষায়। এগুলিতে ব্রাহ্মী, খরোষ্ঠী, গ্রিক ও আরমীয় লিপি ব্যবহার করা হয়েছে।
অনুশাসনগুলি রচিত হয়েছে হরপ্পীয় সভ্যতার অবসানের দেড় হাজার বছর পরে। মাঝের সময়টায় হরপ্পীয় সভ্যতার অবসান, ইন্দো-ইউরোপীয় ও অস্ট্রো-এশিয়াটিকভাষীদের এই অঞ্চলে যথাক্রমে দেশের উত্তর পশ্চিম ও উত্তর পূর্ব দিক থেকে পরিযান, দেশজ জনগোষ্ঠীর সঙ্গে তাদের মিশ্ৰণ এবং তার ফলে উপমহাদেশে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠী গঠিত হতে শুরু করে। তবে এই দীর্ঘ সময়ে কোন লিখিত পুরাবস্তু আবিষ্কৃত হয়নি।
মধ্য আফগানিস্তান থেকে কর্ণাটক পর্যন্ত বিস্তৃত উপমহাদেশে অশোকের চল্লিশটি শিলানুশাসন বা স্তম্ভানুশাসন পাওয়া গেছে। মূলত অনুসাশনগুলিতে তিনি তার প্রজাদের উদ্দেশ্য করে কিছু উপদেশ দিয়েছেন, কিছু আবেদন রেখেছেন – ‘ধম্ম’ অভিমুখে নিজের ও প্রজাদের জীবনকে পরিচালনা করতে চেয়েছেন। এই ধম্ম হল মূলত বুদ্ধের শিক্ষাবলি। কিন্তু ‘ধম্ম’ প্রচারে ছিল অশোকের মৌলিকতা। লেখগুলিতে আছে সমকালীন গুরুতর সামাজিক, প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক বার্তা। আর আছে অশোকের উদ্বেগ, আত্ম-অনুশাসন এমনকি আত্ম-সমালোচনাও।
অশোক নিজে বৌদ্ধ ধর্মের প্রতি তাঁর আসক্তির কথা মুক্ত কণ্ঠে স্বীকার করেছেন। আবার গয়ার পাশে বারাবার পাহাড়ে তিনটি গুহা (চিত্র ১) দান করেছেন আজীবিকদের। পাথরের গুহা কাটিয়ে তাকে পালিশ করে বাসযোগ্য করা সহজ কাজ নয়। সেই গুহা তিনি বৌদ্ধদের না দিয়ে দান করেছিলেন আজীবিকদের। সেই সময়ের বৌদ্ধ পরম্পরায় আজীবিকদের সাথে বৌদ্ধদের তীব্র বৈরিতা ছিল। বৌদ্ধ, জৈন, আজীবিক ও ব্রাহ্মণ্য ধর্মের মধ্যে হৃদ্যতার সম্পর্ক ছিল এমন মনে করা যায় না। অশোকের মৃত্যুর পরে আজীবিকদের তাড়িয়ে দেওয়া হয় গুহাগুলি থেকে এবং তারা চিরতরে ইতিহাস থেকে হারিয়ে যায়।
চিত্র ১ – বারাবার পাহাড়ে গুহা
এমনকি বোধি বৃক্ষ দর্শনকালে তিনি ব্রাহ্মণদের দান করতেও ভোলেন না। সাহায্য দানের ক্ষেত্রে অশোক তার শিলানুশাসনগুলিতে প্রায় সকল সময়ে একই সাথে বৌদ্ধ শ্রমণ ও ব্রাহ্মণ সন্ন্যাসীদের উল্লেখ করেছেন। লক্ষ্য করার বিষয়, সমগ্র ব্রাহ্মণকুল নয়, তিনি বিভিন্ন সময়ে ব্রাহ্মণ সন্ন্যাসীদের কথা উল্লেখ করেছেন। বৌদ্ধ শ্রমণ ও ব্রাহ্মণ সন্ন্যাসী নিজ নিজ ধর্মের অগ্রণী হিসাবে সম্মানিত ছিল। তিনি শ্রমণ ও সন্ন্যাসীদের মধ্যে সাম্যভাব বজায় রাখতে চেয়েছেন। দ্বাদশ প্রস্তর অনুশাসনে তিনি বলেছেন, শুধু সংঘের প্রতি মনোযোগ দিলেই হবে না; ব্রাহ্মণ, আজীবিক ও জৈনদের প্রতিও সমান যত্নবান হতে হবে।
অশোকের সাম্রাজ্য ভারতবর্ষের সর্ববৃহৎ সাম্রাজ্যগুলির অন্যতম। সেই বিশাল সাম্রাজ্যকে বেঁধে রাখতে তাকে সমাজের সকল ক্ষমতাশালী গোষ্ঠীগুলিকে সঙ্গে নিয়ে চলতে হয়েছে। তাদের সাথে সুসম্পর্ক রাখতে হয়েছে। তিনি ব্রাহ্মণ্য ধর্মের বর্ণবিভাগকে সরাসরি আক্রমণ করেননি, তবে ব্রাহ্মণ্য ধর্মের নিচের অংশের প্রতি দয়া দেখাতে বলেছেন। তার রাজনৈতিক বিচক্ষণতা বৌদ্ধ ধর্মকে পূর্বের অভিজাতদের গোষ্ঠীর বাইরে এনে সাধারণের ধর্মে পরিণত করতে সাহায্য করেছে। তিনি নিজেকে সমগ্র মানব জাতির কাছে ঋণে আবদ্ধ বলেছেন। এ এমনই ঋণ যা পরিশোধের জন্য সমগ্র মানব জাতির সুখের ব্যবস্থা তাকে করতে হবে। বলেছেন, ‘সমস্ত মানুষই আমার সন্তান।’ ২২৫০ বছর আগে এখানে একজন ভারতীয় রাজা সভ্যতার মূল নিয়ম প্রণয়ন ও অনুশীলন করেছিলেন, এ বড় কম কথা নয়। আজকের আধুনিক পৃথিবীর বিভিন্ন রাষ্ট্রপ্রধানও বহু জাতি, বহু ধর্ম অনুশীলনের মূল নীতিগুলি ভুলে যাচ্ছেন।
অশোকের বৌদ্ধধর্মনুরাগের অনুক্রম
আলোচনা করি অশোকের বৌদ্ধধর্মনুরাগের অনুক্রম নিয়ে।
অশোকের রাজত্বের নবম বছরে কলিঙ্গ যুদ্ধ হয়। সত্যি কি তিনি কলিঙ্গ যুদ্ধের শেষে দয়া নদীর তীরে লক্ষ মানুষের রুধিরস্রোত দেখে শোকে বিহ্বল হয়ে বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করেন? এরকম হলে বৌদ্ধ সন্ন্যাসীদের প্রচারে সুবিধা হয়, এ বিষয়ে সন্দেহ নেই। অশোক বুদ্ধের বাণী শুনে অতি দুষ্ট থেকে অতি শিষ্ট হয়েছেন – এই চিত্রকল্প বৌদ্ধধর্ম প্রচারে ও প্রসারে অতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে পারে। কিন্তু বিভিন্ন ঐতিহাসিক এই আবেগের বিস্ফোরণ নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেন।
মনে রাখা দরকার সেই সময়ের ভারতবর্ষে একাধিক দর্শন দানা বাঁধছে। এদের অনেকগুলিই হল সনাতন ধর্মের বিরোধী, নিদেনপক্ষে ভিন্ন মতাবলম্বী। ধর্ম বিরোধিতা সেই সময়ে মধ্য যুগের মত ছিল না। একই পরিবারে বিভিন্ন মতাবলম্বী সদস্য অবস্থান করতেন। ধর্ম পরিবর্তন বা বলা যেতে পারে জীবনদর্শনের পরিবর্তন ব্যক্তি মানুষকে চূড়ান্ত আঘাত করত না।
অশোকের পিতামহ সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য (৩৪০ – ২৯৭ সাধারণ পূর্বাব্দ) ছিলেন ব্রাহ্মণ্য ধর্ম অনুসারী। কিন্তু শেষ জীবনে জৈন ধর্মে দীক্ষা নিয়ে সিংহাসন ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন দাক্ষিণাত্যে। তাঁর পুত্র বিন্দুসার (২৯৭ – ২৭৩ সাধারণ পূর্বাব্দ) প্রথম জীবনে ব্রাহ্মণ্য ধর্ম অনুশীলন করতেন। পরবর্তীকালে তিনি আজীবিক অনুশাসন মেনে চলেছেন। অশোকের মাতা সুভদ্রাঙ্গী ছিলেন ব্রাহ্মণ কন্যা, তবে আজীবিক সম্প্রদায়ের প্রতি ছিলেন সহানুভূতিশীল।
তার মানে এই নয় যে, এই ধর্মমত ও দর্শনগুলির মধ্যে দ্বন্দ্ব ও সংঘর্ষ ছিল না। ছিল, কিন্তু সাথে ছিল দর্শনগুলির বুদ্ধিজীবীদের সামাজিক আন্দোলন। এই গতিশীলতার প্রভাব তাই শুধু ধর্মবিশ্বাসে নয়, সমাজের বিভিন্ন স্তরে পড়ত। রোমিলা থাপার উল্লেখ করেছেন, কোন একটি সময়কে তার ধর্মান্তরণের নিখুঁত মুহূর্ত হিসেবে উল্লেখ করার অর্থ, আসলে যা ঘটেছিল সে সম্পর্কে অত্যুক্তি করা। ব্রাহ্মণ্য ধর্ম অনুসারী ও বৌদ্ধদের মধ্যে বিরোধিতা ছিল। কিন্তু সাক্ষ্য প্রমাণ দেখিয়ে দেয় যে, এই সময়ে ধর্মীয় গোষ্ঠীর মধ্যে বিরোধিতা এত তীব্র ছিল না যে, নতুন ধর্ম গ্রহণের মাধ্যমে পুরনো সমস্ত বিশ্বাসকে অস্বীকার করার প্রয়োজন হতো।
অশোকের প্রথম স্ত্রী ছিলেন দেবী। সিংহাসনে আসীন হবার আগে রাজপ্রতিনিধি হিসেবে অশোক গিয়েছিলেন উজ্জয়িনী নগরে। যাবার পথে বিদিশাতে তাঁর সাথে পরিচয় হয় স্থানীয় ব্যবসায়ী কন্যা দেবীর। তারা প্রণয়াসক্ত হন, এবং তাদের দুই সন্তান জন্মায়। মাহিন্দ (২৮৫ – ২০৫ সাধারণ পূর্বাব্দ) ও সংঘমিত্তা (২৮১ -২০২ সাধারণ পূর্বাব্দ)। সংঘমিত্তা নামটিও সেই সময়ে অশোকের চিন্তাপ্রক্রিয়ার এক দৃষ্টান্ত ধরা যেতে পারে। অন্তত তার এই নাম নিয়ে কোন ক্ষোভ ছিল না, একথা পরিষ্কার।
চিত্র ২ – সাঁচি স্তূপ, রথে আরূঢ় অশোক
এই সময়টা অশোক বিন্দুসারের প্রতিনিধি হিসেবে উজ্জয়িনী নগরেই ছিলেন। দেবী ছিলেন বুদ্ধ অনুরক্ত। তখন থেকেই বিদিশা বৌদ্ধ ধর্মের এক কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। পরবর্তীকালে দেবীর উদ্যোগে বিদিশার বিহার নির্মিত হয়েছিল। অনেকে মনে করেন অশোকের বৌদ্ধ ধর্মের প্রতি সহানুভূতির পিছনে দেবীর ভূমিকা আছে।
অশোকের সিংহাসন অধিগ্রহণ মসৃণ ছিল না। সিংহলীয় ইতিবৃত্ত মহাবংশে বলা হয়েছে ৯৯ জন ভাইকে হত্যা করে তিনি সিংহাসনারূঢ় হয়েছেন। আবার তারানাথের বিবরণ অনুযায়ী অশোক তার ৬ জন ভ্রাতার মৃত্যুর জন্য দায়ী। এখানেও বৌদ্ধ ইতিবৃত্ত আধিক্য দোষে দুষ্ট। তবে এবিষয়ে সন্দেহ নেই যে, বিন্দুসারের মৃত্যুর পরে প্রাসাদ অভ্যুত্থান হয়েছিল। তাই পিতার মৃত্যুর পরে দীর্ঘ চার বছর লেগেছিল অশোকের নিরঙ্কুশভাবে সিংহাসনের অধিকারী হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে।
ভ্রাতৃহত্যা বা পিতার আদেশ অনুসরণ না করা ইত্যাদি মোটেই বৌদ্ধ অনুশাসনানুযায়ী কাজ নয়। তবে সেই সময়ে পৃথিবীটা কেমন ছিল সেটাও ভাবা দরকার। অর্থশাস্ত্র রচিত হয়েছে অশোকের পিতামহের সময়ে। অর্থশাস্ত্রের বিষয়াদি সম্পূর্ণভাবে ইহজাগতিক এবং পার্থিব। রাজার কর্তব্য তাতে স্থিরীকৃত হয়েছে। বিশুদ্ধ রাজতন্ত্রই শ্রেষ্ঠ শাসনব্যবস্থা। ক্ষমতা থাকতে হবে যোগ্যতমর হাতে, সেই শক্তিধর সেনাবাহিনীরও প্রধান হবে। রাজত্ব বিস্তারের প্রয়োজন আছে, কারণ অতিরিক্ত রাজস্ব আসবে বৃহত্তর সাম্রাজ্য থেকে। রাষ্ট্রের হাতে ব্যবসা-বাণিজ্য ও উৎপাদন ব্যবস্থার নিয়ন্ত্রণ রাখতে হবে, সেখান থেকেও রাষ্ট্রের আয় হবে। সাম্রাজ্য স্থাপনের এই টেমপ্লেট অনুসরণ করেছেন অশোকের পিতা ও পিতামহ। অশোক তার অনুবর্তী হয়েছেন।
সম্ভাবনাময় অশোকের সামনে ছিল পূর্ববর্তী রাজবংশের পিতৃঘাতক অজাতশত্রুর উদাহরণ। দরবারী অমাত্যবর্গের সহায়তা নিয়ে ভ্রাতৃহত্যা করে তিনি সিংহাসনে বসেছেন। আবার এইসব দ্বন্দ্ব ছিল বলেই সিংহাসনে বসবার আগের জীবন নিয়ে অশোকের শিলানুশাসনে নৈঃশব্দ বিরাজ করছে। স্বাভাবিক। পূর্বজীবনে তিনি যে গর্হিত কাজ করেছেন সে কথা পরবর্তী প্রজন্মের জন্য লিখে রাখা আহাম্মকি। শক্তিমান ও সম্ভাবনাময় অশোকের সিংহাসন দখল, কলিঙ্গ যুদ্ধ ইত্যাদিকে এই পটভূমিকায় দেখা দরকার।
তিনি তাঁর জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা সুমনকে (অথবা সুসীম) হত্যা করেছেন। সুমনের হত্যার বছরেই তাঁর পুত্র নিগ্রোধ জন্মগ্রহণ করেন। বৌদ্ধ সূত্র অনুযায়ী অশোকের রাজত্ব গ্রহণের সপ্তম বর্ষে নিগ্রোধ মাত্র সাত বছরে সন্ন্যাস নেন ও অশোককে বৌদ্ধ ধর্মান্তরণ করেন। অর্থাৎ অশোকের রাজত্বের সপ্তম বছরে তার সাথে ভ্রাতুষ্পুত্রের মিলন হয়। এখন এই সাত বছর ইত্যাদিকে এত গুরুত্ব দেবার হয়তো প্রয়োজন নেই। কারণ বৌদ্ধ শাস্ত্রগ্রন্থে এই সময়কালগুলি একটু আপন মাধুরীতে মিশিয়ে লেখা হয়েছে। তবে লক্ষ্য করার বিষয়, এই সময়কাল কিন্তু কলিঙ্গ যুদ্ধের আগে। আরও একটা বিষয় লক্ষ্য করা দরকার। অশোক যখন নিজের সিংহাসনে আর কোন বিপদের আশঙ্কা করেননি তখন থেকে তিনি তার বৃহত্তর পরিবারের সাথে আবারও ঘনিষ্ঠ হতে শুরু করেন। সুমনের পুত্রেরও রাজ দরবারে প্রবেশাধিকার জন্মায়। তবে তিনি সন্ন্যাস নিয়েছিলেন, অর্থাৎ সিংহাসনের দাবিদার ছিলেন না, এটাও লক্ষ্য করার বিষয়। অনুশাসনগুলি থেকে একটা কথা বেরিয়ে আসে। বৌদ্ধ ধর্মের জন্য অশোকের উৎসাহের প্রাবল্য বেড়েছিল তাঁর রাজত্বের শেষের দিকে।
কলিঙ্গ যুদ্ধের পরে ত্রয়োদশ শিলালেখতে লিখিত হয়েছে নিচের বয়ান:
‘‘যখন তিনি (অশোক) ঈশ্বরের প্রিয়পাত্র, রাজা পিয়দসি, আট বছর অতিবাহিত করলেন, তখন কলিঙ্গ জয় হল। এতে এক লক্ষ পঞ্চাশ হাজার লোক গৃহহীন হয়, এক লক্ষ মানুষকে হত্যা করা হয় এবং তারও কয়েক গুণ বেশী মানুষ ধ্বংস বা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তারপর যখন কলিঙ্গ তাঁর রাজ্যভুক্ত হয়, তখন ঈশ্বরের প্রিয়পাত্র ঐকান্তিকতার সঙ্গে ‘ধম্ম’ পালন করেন, তাঁর একমাত্র কাম্য হয়, ধম্ম প্রচার। কলিঙ্গ জয়ের পরে ঈশ্বরের প্রিয়জন অনুশোচনায় দগ্ধ হতে থাকেন। কারণ, যখন একটি স্বাধীন দেশ বিজিত হয় তখন হত্যা, মৃত্যু এবং নির্বাসিত মানুষগুলি ঈশ্বরের প্রিয়পাত্রের মনকে ভারাক্রান্ত করে। আরও অনুশোচনা হয় যখন সেখানে বসবাসকারী ব্রাহ্মণ, শ্রমণ, অন্ধ, যে কোনো বর্ণের লোক অথবা যারা তাদের উপরস্থদের প্রতি অনুগত, বাবা মায়ের প্রতি অনুগত, শিক্ষকের প্রতি অনুগত ও ভালো ব্যবহার করে, এবং বন্ধু, সহকারী, আত্মীয়, দাস ও ভৃত্যদের প্রতি সহানুভূতিশীল প্রত্যেকেই তাদের প্রিয়জনের প্রতি হিংস্রতা, হত্যা এবং বিচ্ছিন্নতায় কষ্ট পায়। এমনকি যে ভাগ্যবানেরা যুদ্ধের ভয়াবহতা থেকে রক্ষা পেয়েছে এবং যাদের ভালোবাসা কমেনি (যুদ্ধের নির্দয় প্রভাবেও) তারাও তাদের বন্ধু, সহকারী, সহকর্মী এবং আত্মীয়দের দুর্ভাগ্য দেখে কষ্ট পায়। সকল মানুষের এ ধরণের কষ্ট পাওয়ার বিষয়টি ঈশ্বরের প্রিয়পাত্রের মনের উপর ভারী বোঝা হয়ে জেঁকে বসে। ঈশ্বরের প্রিয়পাত্র বিশ্বাস করেন যে, যারা ভুল কাজ করে তাদের যতদূর সম্ভব ক্ষমা করে দেয়া উচিত। ঈশ্বরের প্রিয়পাত্র বনবাসী অপরাপর গোত্রদের তাঁর সাম্রাজ্যে স্বাগত জানিয়েছেন এবং ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন যে, প্রত্যেক মানবগোষ্ঠীকে নির্বিঘ্নে, স্বনিয়ন্ত্রিত হয়ে মানসিক শান্তিতে এবং ভদ্রভাবে বাস করতে দেয়া উচিত… (এশিয়া ও ইউরোপের যেসকল দেশে ‘ধম্ম’-এর প্রচারণায় তিনি বার্তাবহ পাঠিয়েছেন তাদের বর্ণনা) ধম্ম-এর এই সকল লিপি খোদাই করে রাখা হয়েছিল, যাতে কোনো পুত্র বা প্রপৌত্রদের ব্যাপারে নতুন বিজিত ভূখণ্ড প্রাপ্তির বিষয়ে ভাবনার কিছু না থাকে… তারা সত্যিকার এবং স্থায়ী জয় নিশ্চিত করার লক্ষ্যে শুধুমাত্র ধম্ম-এর মাধ্যমে জয় করার বিষয়টিই বিবেচনা করবে এবং ধম্ম-এর আনন্দই হবে তাদের পরিপূর্ণ আনন্দ। কারণ এ আনন্দই পার্থিব জগৎ এবং পর জগতের জন্য মূল্যবান।’’ [রোমিলা থাপারের অশোক ও মৌর্যদের পতন গ্রন্থ অনুযায়ী]।
যুদ্ধ জয় করেও নিজেকে যুদ্ধের শিকার হিসেবে নিজেকে দেখা, সন্দেহ নেই ইতিহাসে এমন ঘটনা তুলনাহীন। আজও পৃথিবীতে শত্রুর নিধনে, বিজিতকে হত্যার পরে জয়ী শঙ্খনাদ বাজায়।
তার ধর্ম ত্যাগে ঘৃণার বহিঃপ্রকাশ ছিল না। হঠাৎ উৎসারিত আবেগের প্রাবল্যে ধর্মান্তরণ হলে এই সমদৃষ্টি থাকা সম্ভব ছিল না।
অশোকের ব্যক্তি জীবন
প্রিয়দর্শী অশোক এই উপমহাদেশ, তথা সারা পৃথিবীর এক অতি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র। তার উত্তরণ, মানুষ হিসেবে, সম্রাট হিসেবে অনুধাবন করা প্রয়োজন।
অশোকের রাজত্বকালে অধিকাংশ সময়ে তার রাজমহিষী ছিলেন অসন্ধিমিত্তা। তিনি ছিলেন অশোকের অনুগামী। তার মৃত্যুর পরে রাজমহিষী হন তিস্সোরক্ষা। সম্ভবত অশোকের বৌদ্ধ প্রেমে তিনি ছিলেন সন্দিহান। তিনি বোধিবৃক্ষকে নষ্ট করতে চেয়েছিলেন। অশোকের পুত্র ও উত্তরাধিকারী কুনালের চোখ উৎপাটনের পিছনেও হয়তো তিনি ছিলেন এমন কথা সিংহলীয় গ্রন্থ দিব্যবদানে উল্লেখ করা আছে। যা হোক, এর পরে তিস্সোরক্ষার মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। এই ঘটনাবলী থেকে বোঝা যায়, অশোক বহুবিবাহ করেছেন, বৃদ্ধ বয়সে অল্পবয়সী স্ত্রীর হাতের পুতুল হয়ে গিয়েছিলেন, আবার প্রয়োজনে অমাত্যদের কথা শুনে রাজদণ্ড হাতে নিয়েছেন, তিস্সোরক্ষাকে বধ করতে বাধা দেননি।
শ্রেণী ও বর্ণবিভক্ত সমাজ ও অশোক
অশোক তাঁর শিলানুশাসন ও স্তম্ভানুশাসনে তিন তিনবার কারাগারের বন্দীদের উল্লেখ করেছেন।
১) পঞ্চম মুখ্য শিলানুশাসন-
বন্দীরা যদি দায়িত্বজ্ঞানহীন আচরণ করে থাকে তাহলে তাদের মঙ্গলের জন্য (ধম্ম আধিকারিকরা) কাজ করে চলেছে বা সন্তান আছে এমন বন্দীদের এবং ব্যাধিগ্রস্ত ও বয়স্ক বন্দীদের মুক্তি দিচ্ছে।
২) ১ম স্বতন্ত্র অনুশাসন (ধৌলি ও জৌগড়)
এই লেখা এইজন্যই খোদাই করা দেওয়া হল, যাতে নগরপালেরা এই বিষয়ে সব সময়েই নজর রাখেন যে, উপযুক্ত কারণ ছাড়া কাউকে যেন কারাদণ্ড সইতে না হয়। এই উদ্দেশ্যে পাঁচ বছর অন্তর আমি এখন থেকে একজন আধিকারিককে সফরে পাঠাব, যিনি কঠোর বা নির্দয় নন, যিনি এই বিষয়ে তদন্ত করবেন..,তারা আমার নির্দেশাবলী পালন করছে কিনা। উজ্জয়িনী থেকেও রাজকুমার এই রকম একদল আধিকারিককে পাঠাবেন, কিন্তু তিন বছরের বেশি সময়ের ব্যবধানে নয়। একইভাবে তক্ষশীলাতেও আধিকারিকরা যখন সফরে বেরুবেন তারা স্বাভাবিক কর্তব্যে অবহেলা না করেই এই ব্যাপারে তদন্ত করবেন ও রাজার নির্দেশাবলী পালন করবেন।
৩) চতুর্থ স্তম্ভানুশাসন
এখন থেকে আমার নির্দেশ যাদের মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে তারা তিনদিনের একটা বিরতি পাবে। এতে তাদের আত্মীয়রা তাদের হয়ে প্রাণভিক্ষা করতে পারবে বা যাদের হয়ে বলার কেউ নেই তারা পরজন্মে আরও ভালো জীবনের জন্য দান বা উপবাস করতে পারবে। কারণ আমার ইচ্ছা এই যে, যেন তাদের পারত্রিক লাভ হয়।
উপরোক্ত অনুশাসনগুলি কয়েকটি তথ্য তুলে ধরে।
অশোকের রাজত্বে যথেষ্ট সংখ্যক কারাগার ছিল এবং তিনি জানতেন কারাগারে কিছু মানুষ বন্দি হয়ে থাকে যারা প্রকৃতপক্ষে দোষী নয়। তিনি ভালোই বুঝতেন তার অমাত্যবর্গের এক বড় অংশ দুর্নীতিগ্রস্ত, নির্মম ও অসৎ। এদের দ্বারা নির্দোষ বন্দিদের তিনি ন্যায়বিচার দিতে পারবেন না।
ন্যায় দেবার জন্য তিনি আরও একদল আধিকারিক রেখেছিলেন, যারা ন্যায় বিচার দেবে বলে তিনি মনে করেছেন। এদের বিশেষ যোগ্যতা হবে যে এরা কঠোর বা নির্দয় নন। লক্ষ্য করার বিষয়, নগরপালের উল্লেখ করেও অশোক আরেক দল আধিকারিক রেখেছেন যারা কঠোর বা নির্দয়ভাবে মানুষের বিচার করবে না বলে তিনি আশা পোষণ করেছেন।
এখানে এক বাস্তববুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের আভাস পাই যিনি জানেন তার শাসনতন্ত্র আমলাতান্ত্রিকতা দ্বারা আক্রান্ত। তিনি জানেন এই মুহূর্তে সেই দুর্নীতিগ্রস্ত আমলাদের থেকে তিনি মুক্তি পাবেন না। আর তাই তিনি দ্বিতীয় কোন পন্থার হদিস করতে চেয়েছেন। কীভাবে সেই নব আধিকারিকদের নিয়োগ করা হয়েছে জানি না। কারণ এখানে তিনি এমন এক গুণ খুঁজেছেন যার হদিস পাওয়া সহজ নয়। এই ধরণের অগণনীয় গুণ খুঁজে নিয়োগের পদ্ধতি বাস্তবানুগ কিনা সেই সন্দেহ থেকে যায়।
অশোক হাতড়ে বেড়াচ্ছেন নির্দোষ বন্দিদের সুবিচার দেবার উপায়। আবার দোষী বন্দিদের প্রতিও তিনি সহানুভূতিশীল। সন্তান আছে এমন বন্দীদের এবং ব্যাধিগ্রস্ত ও বয়স্ক বন্দীদের তিনি মুক্তি দিতে চান। মৃত্যুদণ্ড প্রাপ্ত বন্দিদের শাস্তিদানে সাময়িক বিরতি ও ক্ষমা প্রার্থনার সুযোগ দেওয়া একই সাথে মানবিক ও বিজ্ঞজনোচিত।
কারাগারের বন্দিদের প্রতি মানবিক আচরণ করবার জন্য এই আকুতি ইতিহাস কেন, আমাদের দেশে বর্তমান রাষ্ট্রনায়কদের মধ্যেও বিশেষ দেখি না। কারাগার সংস্কার আধ-খেঁচড়া হয়ে পড়ে আছ, বরং ক্ষমতাসীনের বিরোধিতা করলেই আইনি ও বেআইনি পথে কারাগারে ভরে দেওয়াই সাধারণ নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে।
চিত্র ৩ – অশোকের স্তম্ভানুশাসন, বিহার
কলিঙ্গ যুদ্ধের শেষে তিনি অনুতপ্ত হয়েছিলেন, এসেছিল আক্ষেপ। রাজা ও সাধারণ মানুষ, উভয়ের জীবনের কিছু পরিবর্তনের কথা ভেবেছিলেন। কিন্তু কলিঙ্গবাসীর মনে এই লেখা যে বেদনা সৃষ্টি করবে সে বিষয়ে তার সন্দেহ ছিল না। দগদগে ক্ষতে তিনি আঘাত দিতে চাননি। তাই এই বিখ্যাত শিলানুশাসন কলিঙ্গে স্থাপন করা হয়নি। মূল ১৩ নম্বর শিলানুশাসন পাওয়া গেছে কান্দাহার ও কর্ণাটকে। যুদ্ধের কথা অনুল্লিখিত রেখে ধৌলি ও জৌগড়ের শিলানুশাসন পরিবর্তন করে দিয়েছিলেন। তিনি ভালো করেই জানতেন যে, সবার উপরে তার পরিচয় তিনি রাজা, তাকে বিশাল মৌর্য সাম্রাজ্য শাসন করতে হবে, প্রজার মঙ্গল করতে হবে, দেশ রক্ষা করতে হবে, প্রতিবেশীর সাথে সুসম্পর্ক রাখতে হবে। কীভাবে তা সম্পাদন করবেন সেই পথ তিনি খুঁজেছেন। কলিঙ্গের মানুষের কাছে সরাসরি নিজের কৃতকর্মের জন্য দুঃখ প্রকাশ করে তার পক্ষে হয়তো রাজত্ব চালানো অসুবিধাজনক হত ।
তবে এই পৃথিবী বিখ্যাত শিলালেখ একই সাথে তুলনাহীন এক ঐতিহাসিক তথ্যও তুলে ধরে। এক রাজা যুদ্ধে জিতে হয়েছিলেন মুহ্যমান। তিনি তারপর জীবনভর খুঁজে গেছেন রাজার চলার পথ, যুদ্ধ থেকে পরিত্রাণের উপায়।
অশোক তাঁর শিলানুশাসন ও স্তম্ভানুশাসনে দাস ও ভৃত্যদের উল্লেখ বারংবার করেছেন।
১) ৫ম মুখ্য শিলানুশাসন
প্রভু ও ভৃত্য, ব্রাহ্মণ ও বিত্তবান, গৃহস্থ, দরিদ্র ও বৃদ্ধ এদের সবার মধ্যে তারা [ধম্ম আধিকারিকরা] ধম্ম অনুরাগীদের কল্যাণ ও সুখের জন্য, অসুবিধা দূর করার জন্য কাজ করে চলেছে।
২) ৯ম মুখ্য শিলানুশাসন
মানুষ নানারকম অনুষ্ঠানাদি করে থাকে। রোগ হলে, পুত্র কন্যার বিবাহের সময়ে, শিশু জন্মের সময়ে, যাত্রা শুরু করার আগে এবং আরও নানা উপলক্ষে লোকে অনেক অনুষ্ঠান করে। মেয়েরা বিশেষ করে এমন অনেক আচার অনুষ্ঠান পালন করে যা অতি তুচ্ছ ও কোন কাজের নয়। এইসব অনুষ্ঠানাদি যদি করাই হয়, তাহলে তার ফলাফল সামান্যই। কিন্তু যে একটি আচারের বিশাল মূল্য রয়েছে তা হল ধম্ম।
এই আচার অনুষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে – দাস ও ভৃত্যদের প্রতি যত্ন, শিক্ষকদের প্রতি শ্রদ্ধা, যে কোন স্বপ্রাণ বস্তুর প্রতি সংযমী আচরণ এবং ব্রাহ্মণ ও শ্রমণকে দান এইসব এবং এই ধরণের আরও নানা আচরণ ও অনুষ্ঠানকে ধম্ম সম্মত আচার অনুষ্ঠান বলা যায়।
৩) ১১শ মুখ্য শিলানুশাসন
ধম্ম-র দানের মতো অন্য কোন দান নেই। ধম্মর গুণকীর্তন, ধম্ময় অংশগ্রহণ এবং ধম্ম কেন্দ্রিক বন্ধুত্বের মতো আর কিছু হয় না। এবং এর অর্থ হল দাস ও ভৃত্যদের প্রতি ভালো ব্যবহার, পিতা ও মাতার প্রতি বাধ্যতা, বন্ধু, পরিচিত, আত্মীয়, শ্রমণ ও ব্রাহ্মণদের প্রতি ঔদার্য ও সম্মান প্রদর্শন, কোন কিছু হত্যা করা থেকে বিরত থাকা।
৪) ৭ম স্তম্ভানুশাসন
যা কিছু ভালো কাজ আমি করেছি জগৎ তার প্রতি সম্মতি জানিয়েছে এবং তাকে অনুসরণ করছে। এইভাবেই পিতামাতার প্রতি আনুগত্য, বয়োজ্যেষ্ঠদের প্রতি শ্রদ্ধা, ব্রাহ্মণ ও শ্রমণদের প্রতি, দরিদ্র ও দুর্দশাগ্রস্ত, দাস ও ভৃত্যদের প্রতি যত্ন এই সবই বৃদ্ধি পেয়েছে এবং আরও পাবে।
উপরে উল্লিখিত শিলানুশাসন ও স্তম্ভানুশাসনে চারবার ভৃত্যদের আর তিনবার দাসদের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। তখন সমাজে দাসপ্রথা ছিল, এদের অনেকে নিজেরাই অস্থায়ীভাবে নিজেদের দাস হিসেবে বিক্রি করত। অনেক স্থায়ী দাসও ছিল। তবে সেই সময়ে তাদের প্রতি যেন অত্যাচার করা না হয়, তাদের প্রতি যেন সংযমী আচরণ করা হয়, একথা রাজা সকলকে মনে করিয়ে দিচ্ছেন। অধিকাংশ সময়ে দাস ও ভৃত্যদের একই সাথে উচ্চারণ করা হয়েছে। এতে মনে হয়, দাসরা মূলত গৃহকর্ম বা গৃহস্থের পেশাগত কাজে সাহায্যকারী ছিলেন। তাই তিনি গৃহস্থকে বারবার দাস ও ভৃত্যদের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করতে ও যত্ন নিতে উপদেশ দিয়েছেন। তৎকালীন গ্রিক বা রোমান সমাজের সাথে তুলনায় রাজার এই অনুরোধ ভিন্নধর্মী ও মানবিক। মনে হতে পারে যে, অন্তত রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে গৃহস্থ ও ভৃত্যকে তিনি সমান দৃষ্টিতে দেখবার চেষ্টা করেছেন। অবশ্য দাস বা ভৃত্যকে স্বাধীন মানুষের সম-অধিকার রাষ্ট্রীয় প্রচেষ্টায় দেওয়া হয়েছে, এমন নয়। কিন্তু দুজনেই মানুষ ও ন্যায়ের দিক থেকে সম-দৃষ্টির যোগ্য, এই কথাটুকু বলা তখনকার দিনে প্রায় অভাবনীয় ছিল—বিশেষ করে সম্রাটের সিংহাসন থেকে। রাষ্ট্রীয় ধম্ম আধিকারিকরা গৃহস্থদের সাথে সাথে ভৃত্যদের অসুবিধা দূর করার জন্যও কাজ করত। তিনি উল্লেখ করেছেন, দাস ও ভৃত্যদের প্রতি যত্ন নেওয়া ধম্মসম্মত আচার। এগুলি ব্রাহ্মণ ও শ্রমণকে দানের মতই প্রার্থিত অনুষ্ঠান। এমনকি জাঁকজমকপূর্ণ অন্নপ্রাশন, বিবাহ, মঙ্গলযাত্রা অনুষ্ঠান ইত্যাদির থেকেও এদের প্রতি সংযমী আচরণ অনেক বেশি প্রার্থিত, অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
নিরপরাধী দণ্ডিত মানুষের জন্য তার অকৃত্রিম চিন্তা বোঝা যায় নিচের অনুশাসনেও।
১ম স্বতন্ত্র অনুশাসন (ধৌলি ও জৌগড় )
আধিকারিক ও নগর প্রশাসকদের উদ্দেশ্যে-
‘আপনাদের দায়িত্বে হাজার হাজার মানুষ রয়েছে। মানুষের প্রীতি ও ভালোবাসা আপনাদের অর্জন করতে হবে। সমস্ত মানুষই আমার সন্তান। আমার সন্তানদের জন্য যেমন আমি ঐহিক ও পারত্রিক কল্যাণ কামনা করি, তেমনই সমস্ত মানুষের জন্য আমি তাই কামনা করি। কিন্তু আপনারা উপলব্ধি করতে পারেন না যে এই আদর্শ কত সুদূরপ্রসারী – হয়তো আপনাদের মধ্যে কেউ কেউ তা উপলব্ধি করেন। ..প্রায়ই কোন একজন কোন কারণ ছাড়াই কারাদণ্ড ও অত্যাচার ভোগ করে ও তারপরে হঠাৎ খালাস পেয়ে যায়। অনেকে আবার আরও কষ্ট পেয়ে যেতে থাকে। আপনাদের নিরপেক্ষতার অনুশীলন করা দরকার।’
কারাবন্দী, দাস ও ভৃত্যদের প্রতি যে মনোযোগ অশোক দিয়েছেন, সেই মনোযোগ কি দিতে পেরেছিলেন বনবাসীদের প্রতি?
১৩শ মুখ্য শিলানুশাসন
‘দেবপ্রিয় বিশ্বাস করেন, ভুল যে করে যতদূর সম্ভব তাকে ক্ষমা করা উচিত। দেবপ্রিয় তার সাম্রাজ্যের বনাঞ্চলের অধিবাসীদের সাথে সমঝোতা করেছিলেন। তবে তিনি তাদের সাবধান করে দিচ্ছেন যে, তার অনুতাপের মুহূর্তেও তার হাতে ক্ষমতা আছে এবং তিনি তাদের নির্দেশ দিচ্ছেন, নিহত হতে না চাইলে তারা যেন দোষ স্বীকার করে। কারণ দেবপ্রিয় চান সমস্ত প্রাণীই যেন অক্ষত থাকে এবং আত্মসংযমী, নম্র ও শান্তমনের অধিকারী হয়।’
অশোকের রাজত্বে কিছু প্রাণীহত্যা একেবারে নিষিদ্ধ হয়েছিল। এরমধ্যে রয়েছে – কথা বলা পাখি, বাদুড়দের কিছু প্রজাতি, জলজ কিছু প্রাণী, কয়েকটি সরীসৃপ। সম্ভবত এদের খাদক ছিল বনচারী কিছু গোষ্ঠী।
অশোকের অহিংস ধম্ম নিশ্চিতভাবে অরণ্যচারী কিছু গোষ্ঠীর স্বাভাবিক জীবনে বাধা দিয়েছে। অরণ্যে আদিম কৃষিজীবীদের কৃষির উপায় ছিল বন কেটে বা পুড়িয়ে জমি সাফ করে কৃষিকাজের জমি তৈরি করা (জুম)। এই রীতি আজও ভারতে অল্প কিছু জায়গায় প্রচলিত। অশোক নিয়ম জারি করলেন, অকারণে কিংবা প্রাণীদের ক্ষতি করার জন্য অরণ্যে আগুন লাগান চলবে না। বনবাসীদের প্রাণধারণের কোনও বিকল্প ব্যবস্থা এই নিয়মের সঙ্গে সঙ্গে চালু করা হয়েছিল কিনা তার খোঁজ অবশ্য পাওয়া যায়নি। এইসব নিয়ম সম্ভবত বনবাসী মানুষের জীবনচর্যায় আঘাত হেনেছিল।
আলাদা করে শূদ্রদের উল্লেখ অশোকের অনুশাসনে পাইনি। যদিও তিনি সকলের প্রতি সমদৃষ্টির কথা বারবার বলেছেন। তবে বাস্তবক্ষেত্রে সেই সমদৃষ্টি কতটা পর্যন্ত যেতে পারে?
প্রথম মৌর্য রাজা, অশোকের প্রপিতামহ, চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের সময়ে রচিত অর্থশাস্ত্র বলেছে শূদ্রদের জীবিকার্জনের উপায় হল দ্বিজাতির সেবা। তবে কারুশিল্পী, নর্তক, অভিনেতা ইত্যাদি বৃত্তির মাধ্যমে তারা নিজেদের প্রতিপালন করতে পারে। অর্থাৎ কিছু স্বাধীন পেশাও তারা গ্রহণ করতে পারে।
রোমিলা থাপার বলেছেন, অর্থশাস্ত্রে উল্লিখিত ‘শুদ্রকর্ষকপ্রায়’ শব্দটির অনুবাদ শূদ্র ও কৃষক হবে না শূদ্র-চাষি হবে তা নিয়ে মতদ্বৈধতা আছে। এই শব্দের অর্থের মধ্যে যেন শূদ্রদের সামাজিক মর্যাদার সম্পর্ক রয়ে গেছে। সেইসময়ে মজুরের চেয়ে চাষির অবস্থা উন্নততর ছিল। এরকম মতামতও দেওয়া হয়েছে যে, কৃষিকাজের বেশিরভাগই চালানো হত রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণের ক্রীতদাস ও শূদ্র মজুরদের দ্বারা।
রামশরণ শর্মা মনে করেন, সব কৃষক শূদ্র ছিল না। কয়েকজন বিশেষ শূদ্রকে কৃষক হিসেবে গণ্য করা হয়েছিল। অর্থশাস্ত্রের ওই একই অধ্যায়ে বৈশ্য ও শূদ্রদের দুটি আলাদা শ্রেণীতে ফেলা হয়েছে। শূদ্ররা ছিল কারুশিল্পী এবং অ-কারুশিল্পী। তারা গৃহভৃত্য, কৃষিশ্রমিক ইত্যাদি রূপে বৈশ্যদের সেবা করত।
অশোক ছিলেন এক সাম্রাজ্যের অধিপতি, তার অধীনে ছিল সুসংগঠিত আমলাতন্ত্র। রাজা ছিলেন সর্বব্যাপী রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার কেন্দ্রে। তিনি ধর্মপ্রবর্তকের ভূমিকা নিয়েছিলেন, তবে সমাজের শ্রেণীগুলির সম্পর্ক বদলাতে চেষ্টা করেননি। সম্ভবত শূদ্র জনসংখ্যার প্রধান অংশকে কৃষিশ্রমিক ও দাসরূপে নিয়োগ সেই সময়ে অব্যাহত ছিল। তিনি তাদের প্রতি মানবিক হতে আহ্বান করেছেন, এই মাত্র।
খেয়াল রাখতে হবে, বুদ্ধের আবির্ভাবের ফলেও সামাজিক বিন্যাস একেবারে পরিবর্তিত হয়ে যায়নি। অন্য তিন বর্ণের চেয়ে ব্রাহ্মণদের শ্রেষ্ঠত্বের দাবি বুদ্ধ অস্বীকার করেছেন। বলেছেন, ব্রাহ্মণদের চাইতে ক্ষত্রিয় হল উচ্চতর বর্ণ। তবে বৈশ্য বা শূদ্রদের চাইতে ব্রাহ্মণ বা ক্ষত্রিয়ের শ্রেষ্ঠত্ব নিয়ে বুদ্ধ প্রশ্ন তোলেননি। অপর দিকে বৌদ্ধ ধর্মে অন্তত এটুকু দেখান হয়েছে যে, নির্বাণের সন্ধানে বর্ণের কোন মূল্য নেই। বুদ্ধের সময়েও আলাদা করে বৈশ্য বা শূদ্রদের অর্থনৈতিক, সামাজিক উন্নয়নের প্রচেষ্টা নেওয়া হয়েছে বলে ঐতিহাসিক রামশরণ শর্মা মনে করেন না।
এই আলোকে অশোকের অনুশাসনগুলোকে দেখা যায়। সামাজিক পরিকাঠামোর মধ্যে তিনি সচেষ্ট হয়েছেন দাস ও ভৃত্যদের (এদের অধিকাংশই শূদ্র) প্রতি মানবিক আচরণ করতে।
তথ্যসূত্র –
- রোমিলা থাপার, ‘অশোক ও মৌর্যদের পতন’, কে পি বাগচী এন্ড কোম্পানি , ২০০০
- Nayanjot Lahiri, ‘Ashoka in Ancient India, Ashoka University 2018
- Nayanjot Lahiri, ‘Time pieces, a whistle-stop tour of Ancient India’, hachette, 2018
- Wytez Keunning ( translated by J E Steur), Ashoka
- রামশরণ শর্মা, প্রাচীন ভারতে শূদ্র, কে পি বাগচী এন্ড কোম্পানি, ১৯৮৯
- ইরফান হাবিব, বিবেকানন্দ ঝা, ‘মৌর্য যুগের ভারত,’ ন্যাশনাল বুক এজেন্সি, ২০১৮
প্রতিটি শিলালেখ ও স্তম্ভলেখের অনুবাদ নিয়েছি রোমিলা থাপারের গ্রন্থ থেকে। রোমিলা থাপারকে অনুবাদে সহায়তা করেছিলেন এ.এল. বাশাম।
Khub E Bhalo
অনেক ধন্যবাদ নেবেন।
খুবই ভালো। এটা আগেই পড়েছি যদিও বিচ্ছিন্ন ভাবে। অনুশাসনগুলোর অনুবাদ দীনেশচন্দ্র সরকার তুলনামূলক ভালো করেছেন বলে আমার ধারণা যদিও।
দীনেশচন্দ্র সরকারের অনুবাদগুলি পড়িনি। অনেক ধন্যবাদ জানাই।
আমি ইতিহাসের ছাত্র নই, তবে এই বিষয়ে খুব আগ্রহ আছে। ভালো লাগলো আপনার লেখাটি। চল্লিশ বছর আগে দিল্লিতে স্মরজিত দত্ত ” প্রিয়দর্শী” নামে ওঁর লেখা নাটকে অশোকের সম্বন্ধে অনেক কিছু বলেছিলেন। তার একটা হলো যে রোজ অশোক ময়ূরের মাংস খেতেন, যেটা মৌর্য হিসাবে অনুমোদিত ছিলনা।
কোশাম্বীও এক জায়গায় লিখেছেন যে অশোকের রাজত্বকালে ভ্রাম্যমাণ ভিক্ষুরা কি গুপ্তচরের ভূমিকাও পালন করতেন? কবি জয়ন্ত মহাপাত্র তাঁর একটি কবিতায় লিখেছেন যে সম্রাট অশোক কোনো শিলালেখেই কলিঙ্গবাসীদের কাছে মার্জনা চাননি যেটা ওই কবি দাবী করছেন কলিঙ্গবাসীদের প্রতিনিধি হিসেবে।
বিনম্রভাবেই বলছি, প্রবন্ধের ভাষাটা কোথাও একটু আড়ষ্ট লেগেছে, যেমন প্রবন্ধের শেষ বাক্যটির আগের বাক্যের আরম্ভ ” এই আলোকে….”। তবে লেখাটা আমাদের যা দিয়েছে তার তুই এই “ত্রুটি” তুচ্ছ।
লেখিকাকে অনেক ধন্যবাদ 🙏
অনেক নতুন তথ্য জানলাম l আরো জানার আগ্রহ রইল l