আল্হাখণ্ড— মহাভারততুল্য মধ্যযুগের এক লোক মহাকাব্য
আল্হাখণ্ড– বুন্দেলখণ্ডের লোক মহাকাব্য
বর্তমান উত্তরপ্রদেশ ও মধ্যপ্রদেশের বেশ কয়েকটি জেলা জুড়ে বুন্দেলখণ্ডের ভৌগোলিক এলাকার ব্যাপ্তি। বুন্দেলখণ্ডের পাহাড় আর উপত্যকা ঘেরা ভূখণ্ডে দুই নিম্নবর্গীয় বীর আল্হা আর উদলের যশোগাথা সম্ভবত অন্ত-মধ্যযুগের সূচনাকাল থেকেই লোকসংস্কৃতির অঙ্গীভূত। সেই সময় থেকে আজ পর্যন্ত এই লোকগাথার ২৩টি সমরাঙ্গনে ৫২টি যুদ্ধের আবেগদীপ্ত বর্ণনা এই অঞ্চলের মূলত কৃষিজীবী সমাজের কিশোর আর তরুণদের যুদ্ধে অংশ নিয়ে বীরত্ব প্রদর্শনে উদ্বুদ্ধ করে চলেছে। প্রতি বছর শ্রাবণ মাসে আকাশ যখন মেঘে ঢেকে যায়, ঢোলক, চিমটা আর মঞ্জিরার বাদ্যের সঙ্গে বুন্দেলখণ্ডের গ্রামে গ্রামে আল্হাখণ্ডের যুদ্ধগাথার হুংকারে মুখরিত হয়ে ওঠে মাটি আর পাহাড়। বীররসাত্মক আল্হাখণ্ডের বাহান্নটি যুদ্ধগাথার মধ্যে বুন্দেলখণ্ডের তরুণ হৃদয় সবচেয়ে বেশি আলোড়িত হয় যখন শুরু হয় আল্হার নিজের বিবাহের জন্য ন্যায়নাগড়ের লড়াইয়ের বাখান।
আল্হা ও উদলের জীবন ও সংগ্রাম নিয়ে রচিত এই লোকগাথার আদিরূপটি যদি আদৌ এখানে বর্ণিত ঘটনাবলির সমসাময়িক কালপর্বের অর্থাৎ দ্বাদশ শতক সাধারণাব্দের সৃষ্টি হয়ে থাকে, তবে সেই আদিরূপের ভাষা আজ আর নির্ণয় করা সম্ভব নয়। বর্তমানে বুন্দেলি, বাঘেলি, ভোজপুরি, অবধি, মৈথিলি, রাজস্থানি ও কন্নৌজি ভাষায় এই লোক মহাকাব্যের যে লিখিত ও মৌখিক রূপগুলির সঙ্গে আমরা পরিচিত, সেই রূপগুলির সঙ্গে আদিরূপটির কতটা মিল বা পার্থক্য আছে, তাও আজ আর জানার উপায় নেই। কয়েক শতাব্দী ধরে এই জনপ্রিয় লোককাব্যের ব্যাপ্তি ঘটেছে পশ্চিমে রাজস্থান থেকে পূর্বে বিহার পর্যন্ত। নিঃসন্দেহে বিভিন্ন অঞ্চলের বিভিন্ন ভাষার লোকগায়করা বংশানুক্রমিকভাবে এই কাব্যের বহু সংযোজন ও পরিবর্তন সাধন করেছেন, ভাষাও ক্রমাগত পরিবর্তিত হয়েছে।
প্রাগাধুনিক যুগে আল্হাখণ্ডের কাহিনিচক্র লোকসাহিত্যের গণ্ডি অতিক্রম করে সংস্কৃত ভবিষ্যপুরাণের প্রতিসর্গপর্বের তৃতীয় খণ্ডে (১-৩২ অধ্যায়) স্থানলাভ করেছে। মহাভারতের কাহিনিসমূহের ক্ষেত্রে আমাদের কাছে লোকগাথা থেকে ব্রাহ্মণ্য মহাকাব্যে পরিণতির বিষয়ে কোনও তথ্য না থাকলেও আল্হা ও উদলের কাহিনিচক্রের ক্ষেত্রে লোকসাহিত্য থেকে ভবিষ্যপুরাণে ব্রাহ্মণ্যবাদী পরিবর্তনের রূপরেখাটি অত্যন্ত স্পষ্ট। এই সংস্কৃত ভাষার রূপে আল্হা হয়েছেন রামাংশ (বলরামের অংশস্বরূপ) আহ্লাদ আর উদল কৃষ্ণাংশে পরিণত হয়েছেন। ভবিষ্যপুরাণে মূলত লোককাহিনির ধারাটিকেই অনুসরণ করা হলেও কলিযুগ ও ম্লেচ্ছশাসন নিয়ে তৎকালীন উচ্চবর্গের ইতিহাসবোধের সঙ্গে মেলাবার জন্য কিছু গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন করা হয়েছে। উত্তর ভারতের লৌকিক ঐতিহ্যে দীর্ঘদিন যাবৎ আল্হাখণ্ড কলিযুগের মহাভারত বলে পরিগণিত। আল্হাখণ্ডের লৌকিক রূপের মতোই ভবিষ্যপুরাণের বর্ণনাতেও মহাভারতের প্রভাব দৃশ্যমান। মহাভারতের শুরুতে যেমন সব মুখ্য চরিত্রদের বিভিন্ন দেব ও দানবদের মনুষ্যজন্ম বলে উল্লেখ করা হয়েছে, ঠিক তেমনই, আল্হাখণ্ডের লৌকিক রূপ এবং কিছু ব্রাহ্মণ্যবাদী পরিবর্তন সমেত ভবিষ্যপুরাণে বর্ণিত আল্হা ও উদলের কাহিনিতে শুরুতেও (প্রতিসর্গপর্ব ৩.১) দেখা যায়, প্রায় সব প্রধান চরিত্রই মহাভারতের চরিত্রদের পুনর্জন্ম। আবার ভবিষ্যপুরাণে বর্ণিত কাহিনির শেষেও (প্রতিসর্গপর্ব ৩.৩২) দেখা গেছে, মহাভারতের মতোই চূড়ান্ত যুদ্ধ হচ্ছে কুরুক্ষেত্রে, ১৮ দিন ধরে।
এই লোকগাথার রাজবৃত্তে দ্বাদশ শতকের উত্তর ভারতের তিন পরাক্রান্ত শাসকের উপস্থিতি বিদ্যমান– প্রিথিরাজ বা পিথৌরা রায় নামে উল্লিখিত চাহমান (চৌহান) বংশীয় শাসক তৃতীয় পৃথ্বীরাজ (রাজত্বকাল ১১৭৮-১১৯২ সাধারণাব্দ), জ্যায়চন্দ নামে উল্লিখিত গাহড়বাল (রাঠৌর) বংশীয় শাসক জয়চন্দ্র (রাজত্বকাল ১১৭০-১১৯৪ সাধারণাব্দ) এবং পরমাল বা পরিমাল নামে উল্লিখিত চন্দেল্ল বংশীয় শাসক পরমর্দিদেব (রাজত্বকাল ১১৬৬–১২০২ সাধারণাব্দ)। কিন্তু, এই লোক মহাকাব্যের নায়ক দুই তরুণ বীর, আল্হা আর উদল। শুধু তাই নয়, পৃথ্বীরাজ এই লোকগাথায় খলনায়ক রূপে দর্শিত।
ষোড়শ-সপ্তদশ শতক সাধারণাব্দে ‘পিঙ্গল’ অর্থাৎ রাজস্থানি মিশ্রিত ব্রজভাষায় রচিত ৬৯টি প্রস্তাব বা সময় (খণ্ড) সমন্বিত ‘পৃথ্বীরাজ রাসো’র দীর্ঘতম রূপটির শেষ ৬৯তম খণ্ড ‘মহোবা যুদ্ধ প্রস্তাব’ বা ‘মহোবা সময়’ নামে পরিচিত। আধুনিক বিদ্বানরা এই খণ্ডটিকে পরবর্তীকালে প্রক্ষিপ্ত বলে মনে করেন। জেমস টড (১৭৮২-১৮৩৫) আল্হা ও উদলের কাহিনি নিয়ে লেখা এই অংশটির একটি ইংরেজি সারানুবাদ তাঁর ‘অ্যানালস অ্যান্ড অ্যান্টিকুইটিস অফ রাজস’থান’ গ্রন্থের প্রথম খণ্ডে অন্তর্ভুক্ত করেন।১ ১৯১৩ সালে প্রকাশিত মোহনলাল বিষ্ণুলাল পণ্ড্যা ও শ্যামসুন্দর দাসের সম্পাদনায় ‘পৃথ্বীরাজ রাসো’র কাশীর নাগরী প্রচারিণী সভা সংস্করণের ষষ্ঠ খণ্ডে এই অংশটিকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। রাজস্থানি ভাষায় রচিত আল্হাখণ্ডের এই রূপটি কীভাবে ‘পৃথ্বীরাজ রাসো’র সঙ্গে যুক্ত হল জানা যায়নি। ১৯০১ সালে শ্যামসুন্দর দাস ১৮৪৯ বিক্রম সংবতে লিপিবদ্ধ রাজস্থানি ভাষায় রচিত আল্হাখণ্ডের একটি পাণ্ডুলিপি খুঁজে পান। ১৯১৯ সালে কাশীর নাগরী প্রচারিণী সভা ‘পরমাল রাসো’ নামে এই গ্রন্থটি প্রকাশ করেন।
১৮৬০-এর দশকের শেষ দিকে তত্কালীন উত্তর-পশ্চিম প্রদেশসমূহের (বর্তমান উত্তরপ্রদেশ) ফর্রুখাবাদ জেলার কালেক্টরের দায়িত্বে ছিলেন চার্লস আলফ্রেড এলিয়ট (১৮৩৫-১৯১১)। সেই সময় তিনি তিন-চার জন আল্হা গায়কের সন্ধান পান। এর মধ্যে এক আল্হা গায়ককে তিনি সমগ্র আল্হাখণ্ড স্মৃতি থেকে সংকলনের জন্য নিযুক্ত করেন। ঐ গায়কের সংকলিত কন্নৌজি ভাষার আল্হাখণ্ড এলিয়টের মুনশি ভোলানাথ কায়স্থ দেবনাগরী লিপিতে লিপিবদ্ধ করেন। এলিয়ট এই আল্হাখণ্ড রোমান লিপিতে লিপিবদ্ধ করে ইংল্যান্ডে পাঠিয়ে দেন। ১৮৬৫ সালে ভোলানাথ কায়স্থের দেবনাগরী লিপিতে লেখা মূল পাণ্ডুলিপির একটি লিথোগ্রাফ সংস্করণ প্রকাশিত হয়। ১৯২৯ বিক্রম সংবতে অর্থাৎ ১৮৭৩ সালে মুনশি রামস্বরূপ কায়স্থ এই দেবনাগরী লিপিতে লেখা পাণ্ডুলিপির প্রথম মুদ্রিত সংস্করণ ফতহগড়ের দিলকুশা প্রেস থেকে প্রকাশ করেন। ১৯১২ সালে লালা শিবচরণ কর্তৃক ‘অসলী আল্হাখণ্ড ২৩ লড়াই, ইলিয়ট কা পাঠ’ নামে কন্নৌজি ভাষার আল্হাখণ্ডের ২৫তম সংস্করণ, ফর্রুখাবাদ থেকে প্রকাশিত হয়েছিল। উইলিয়াম ওয়াটারফিল্ড এলিয়ট সংগৃহীত কন্নৌজি ভাষার আল্হাখণ্ডের কিছু অংশের ইংরেজি ‘ব্যালাড’ ছন্দে অনুবাদ করে ‘দ্য ক্যালকাটা রিভিউ’ পত্রিকার ৬১ (১৮৭৫), ৬২ (১৮৭৬) ও ৬৩ (১৮৭৭) খণ্ডে “দ্য নাইন লাখ চেইন অর দ্য মারো ফিউড” নামে প্রকাশ করেন। ১৯২৩ সালে উইলিয়াম ওয়াটারফিল্ড কৃত আল্হাখণ্ডের যাবতীয় অনুবাদ, জর্জ গ্রিয়ার্সনের বাকি অংশের সারানুবাদের সঙ্গে ‘দ্য লে অফ আল্হা’ নামে লন্ডন থেকে অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস প্রকাশ করে।
১৮৭০-এর দশকে ভিনসেন্ট আর্থার স্মিথ (১৮৪৩-১৯২০) উত্তর-পশ্চিম প্রদেশসমূহের হমীরপুর জেলায় কর্মরত থাকাকালীন স্থানীয় আল্হা গায়কদের কাছ থেকে বুন্দেলি ভাষার আল্হাখণ্ড সংগ্রহ করেন এবং এর কিছু অংশের ইংরেজি ভাষায় অনুবাদ করেন। জর্জ আব্রাহাম গ্রিয়ার্সন, তাঁর ১৯০৭ সালে প্রকাশিত ‘লিংগুইস্টিক সার্ভে অফ ইন্ডিয়া’ গ্রন্থের নবম খণ্ডের প্রথম ভাগে বুন্দেলি মূল ও স্মিথের অনুবাদের একটি সংশোধিত রূপ প্রকাশ করেন। ১৮৮১ সালে ভাটিপুরের চৌধরী ঘাসীরাম সম্পাদিত আল্হাখণ্ডের বুন্দেলি ভাষার একটি সংস্করণ পণ্ডিত হরদেও সহায় মেরঠের জ্ঞান সাগর প্রেস থেকে প্রকাশ করেন। ১৯১২ সালে বুন্দেলি ভাষার আল্হাখণ্ডের একটি সংস্করণ আগ্রার বম্বই মশিন প্রেস থেকে প্রকাশিত হয়।
জর্জ গ্রিয়ার্সন ‘দ্য ইন্ডিয়ান অ্যান্টিকোয়ারি’ পত্রিকার ১৮৮৫ সালের আগস্ট সংখ্যায় ‘আল্হা কা বিবাহ’ নামে পরিচিত ভোজপুরি ভাষায় আল্হাখণ্ডের একটি রূপের ইংরেজি অনুবাদ সমেত প্রকাশ করেন। গ্রিয়ার্সন জানিয়েছেন, জনৈক আল্হা গায়কের কাছ থেকে সংগ্রহ করার পর ভোজপুরি বিদ্বানদের সহায়তা নিয়ে সংশোধিত রূপটি তিনি প্রকাশ করেছেন।২
আল্হা ও উদলের লোকগাথার গায়করা ‘অল্হৈত’ নামে পরিচিত, ‘নট’ বা ‘নেটুয়া’ বলেও এঁদের উল্লেখ করা হয়। বুন্দেলখণ্ডে এই লোকগাথা ‘সৈরা’ বা ‘আল্হা’ নামে পরিচিত। যে লৌকিক ছন্দে এই মহাকাব্য রচিত, সেই ৩১ মাত্রার ছন্দটিও ‘আল্হা’ নামেই খ্যাত।৩ আল্হাখণ্ডের অংশগুলিকে ‘পঁবাড়া’, ‘সময়’ বা ‘মার’ নামে অভিহিত করা হয়। ‘অল্হৈত’রা সম্পূর্ণ আল্হাখণ্ড একসাথে গাওয়া সম্ভব নয় বলে শ্রোতাদের চাহিদা অনুযায়ী বিভিন্ন অংশ গেয়ে শোনান।
আল্হাখণ্ডের ঐতিহাসিকতা
নবম থেকে ত্রয়োদশ শতাব্দী সাধারণাব্দ পর্যন্ত মধ্য ভারতের বেশ বড় এলাকা জুড়ে চন্দেল্ল বংশীয় শাসকরা রাজত্ব করেছিলেন। বর্তমান উত্তরপ্রদেশ ও মধ্যপ্রদেশ রাজ্যের যে বিস্তীর্ণ এলাকা বুন্দেলখণ্ড নামে পরিচিত, চন্দেল্ল লেখমালায় সেই অঞ্চল জেজাকভুক্তি, জেজাভুক্তি বা জেজাভুক্তিকা নামে উল্লিখিত। সম্ভবত সাধারণাব্দের চতুর্দশ শতক থেকে বুন্দেলা বংশীয় শাসকদের অধিকারভুক্ত হওয়ার পর এই এলাকার বুন্দেলখণ্ড নাম জনপ্রিয়তা অর্জন করে। কালঞ্জর, মহোবা ও খর্জুরবাহক (অর্থাৎ খাজুরাহো) চন্দেল্ল বংশীয় শাসকদের তিনটি প্রধান শাসনকেন্দ্র ছিল। চন্দেল্ল লেখাবলিতে এই বংশের প্রতিষ্ঠাতার নাম নন্নুক বলে উল্লিখিত হয়েছে।
আল্হাখণ্ডের রচয়িতা বলে প্রসিদ্ধ জগনিক, জগনায়ক বা জগতসিংহ লোকশ্রুতি অনুযায়ী চন্দেল্ল বংশীয় শাসক পরমর্দিদেবের সভায় ভাট বা সভাকবি।৪ বর্তমান মধ্যপ্রদেশের দমোহ জেলার হটা তহসিলের অন্তর্গত সকোহা (জগনের) তাঁর জন্মভূমি বলে প্রচলিত বিশ্বাস। আল্হাখণ্ডে জগনিককে পরমালের অর্থাৎ চন্দেল্ল বংশীয় শাসক পরমর্দিদেবের আত্মীয় বলে বর্ণনা করা হয়েছে।
আল্হাখণ্ড চৌহান, রাঠৌর ও চন্দেল্ল বংশীয় শাসকদের মধ্যে সংঘর্ষের প্রেক্ষাপটে রচিত লোকগাথা, ইতিহাসের চেয়ে লোকশ্রুতির ভাগ অনেক বেশি। আল্হাখণ্ডে আল্হা ও উদলকে পরমালের অধীনস্থ সেনাপতি বলে উল্লেখ করা হয়েছে। উত্তরপ্রদেশের ললিতপুর জেলার মদনপুরে অবস্থিত একটি জৈনমন্দিরের দুটি স্তম্ভলেখ থেকে জানা যায়, তৃতীয় পৃথ্বীরাজ পরমর্দিদেবকে ১২৩৯ বিক্রম সংবতে (অর্থাৎ, ১১৮২-১১৮৩ সাধারণাব্দ) পরাস্ত করেছিলেন। আল্হাখণ্ডের কাহিনি অনুযায়ী, পৃথ্বীরাজের কাছে পরাজয়ের অব্যবহিত পর পরমালের অর্থাৎ পরমর্দিদেবের মৃত্যু হয় এবং তাঁর মৃত্যুর সাথে সাথে চন্দেল্ল বংশের শাসনের অবসান ঘটে। কিন্তু, হাসান নিজামীর ‘তাজ-উল-মাসির’ গ্রন্থে ৫৯৯ হিজরি সনে (১২০২ সাধারণাব্দ) পরমর্দিদেবকে কুতুবউদ্দিন আইবকের সঙ্গে কালঞ্জর দুর্গ রক্ষার্থে যুদ্ধের পর আত্মসমর্পণ করতে দেখা যায়। এই ঘটনার পর তাঁর মৃত্যু হয়। তাম্রশাসন ও ফার্সি ইতিবৃত্তের সাক্ষ্য থেকে জানা যায়, তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র ত্রৈলোক্যবর্মণ শাসনভার গ্রহণ করেন, কালঞ্জর দুর্গ পুনরুদ্ধার করেন এবং অন্তত ১২৪৭ সাধারণাব্দ পর্যন্ত রাজত্ব করেছিলেন। ত্রৈলোক্যবর্মণের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র বীরবর্মণ সিংহাসনে আরোহণ করেন। ১২৮৬ থেকে ১২৮৮ সাধারণাব্দের মধ্যবর্তী কোনও সময় তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র ভোজবর্মণ শাসনভার গ্রহণ করেন। ১২৮৯ সাধারণাব্দে ভোজবর্মণের মৃত্যুর পর তাঁর কনিষ্ঠ ভ্রাতা হম্মীরবর্মণ সিংহাসনে আরোহণ করেন। চন্দেল্ল বংশের শেষ জ্ঞাত শাসক হম্মীরবর্মণ সম্ভবত আলাউদ্দিন খলজির ১৩০৯ সাধারণাব্দে বুন্দেলখণ্ডে অধিকার বিস্তার পর্যন্ত রাজত্ব করেছিলেন। প্রকৃত ইতিহাসের সঙ্গে লোকগাথার কাহিনির এতটা পার্থক্য থাকায় অনুমান করা যায়, এই লোক মহাকাব্যের বর্তমান রূপগুলির আদিরূপটিও সম্ভবত চতুর্দশ শতকের পূর্বেকার সৃষ্টি নয়।
আল্হাখণ্ডের কাহিনিচক্র
আল্হাখণ্ডের কাহিনিচক্রে নিম্নবর্গের দৃষ্টিকোণ থেকে আদি মধ্যযুগের উচ্চবর্গের যে সামাজিক চিত্র অঙ্কিত রয়েছে, তা যে কোনও আধুনিক যুগের পাঠককে হতচকিত করতে পারে। আদি মধ্যযুগের উত্তর ভারতে শাসকবংশীয় পুরুষদের অনেকেই অন্য একটি শাসক পরিবারের কন্যাকে বিবাহ করে নিজেদের ক্ষমতার বৃদ্ধি প্রমাণ করতে সচেষ্ট থাকতেন। আবার কন্যার পিতাও নিজের ক্ষমতা প্রদর্শনের উদ্দেশে জামাতাকে বিভিন্ন শর্ত মেনে নেওয়ার জন্য চাপ দিতেন। এই পরিস্থিতিতে বিবাহ নিয়ে বিবাদ ও সংঘর্ষ লেগেই থাকত এবং সামাজিক ভাবে এই সব সংঘর্ষগুলিকে খুবই স্বাভাবিক বলে মেনে নেওয়া হত। এই রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপটে আল্হাখণ্ডের প্রেম ও যুদ্ধের কাহিনিগুলি রচিত। অত্যন্ত সামান্য বিষয় নিয়ে সামন্ত শাসকরা নিজেদের মধ্যে লড়াই শুরু করে দিতেন। আল্হাখণ্ডে বর্ণিত কোনও নারীর একটি মূল্যবান অলংকারের প্রতি আকর্ষণের কারণে বা কন্যা বাল্যবিবাহের পর প্রাপ্তবয়স্ক হলে ‘গৌনা’র (বর ও বধুর আনুষ্ঠানিক শারীরিক মিলন) জন্য কন্যাকে শ্বশুরালয়ে পাঠানো নিয়ে যুদ্ধ শুরু করার মতো ঘটনা সেই সময়কার উচ্চবর্গের সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিচায়ক।
আল্হাখণ্ডের প্রত্যেকটি যুদ্ধের বর্ণনার আগে ‘সৌরনী’ বা ‘সুমিরন’ নামের মঙ্গলাচরণ গাওয়ার রীতি। ‘সৌরনী’তে শিব, বিষ্ণু, গণেশ, সরস্বতী, দুর্গা, গঙ্গা বা রামের সঙ্গে সঙ্গে গোবর্ধনী, সন্দোহিনী বা ফুলমতীর মতো বুন্দেলখণ্ডের লৌকিক দেবীদের বন্দনাও দেখা যায়। আল্হাখণ্ডের ‘সৌরনী’তে পুরাকথার উল্লেখও দেখা যায়। আল্হাখণ্ডের ‘সৌরনী’তে উল্লিখিত এমনই এই পুরাকথা অনুসারে মহাভারতের যুগে মানুষ আর দেবতার মধ্যে সম্পর্ক অত্যন্ত নিবিড় ছিল। একবার শিব পাণ্ডবদের সঙ্গে দেখা করতে এলে নকুল ভুলবশত শিবকে বাণের আঘাতে আহত করেন। তখন, শিব কুপিত হয়ে শাপ দেন ভবিষ্যতে অর্জুন পরমালের পুত্র ব্রহ্মা ও দ্রৌপদী পৃথিরাজের কন্যা বেলা হয়ে জন্মাবেন এবং তাঁদের জন্য চৌহান ও চন্দেল্লদের মধ্যে অনেক যুদ্ধ হবে।
মধ্যযুগের অন্যান্য লোকগাথার মতোই এই লোক মহাকাব্যের যুদ্ধের বর্ণনায় অতিশয়োক্তির বাহুল্য রয়েছে। এমন কোনও যুদ্ধের বর্ণনা নেই, যে যুদ্ধে অন্তত এক লাখ সৈন্যের মৃত্যু হয়নি। যুদ্ধের বর্ণনায় পুনরাবৃত্তিও অত্যন্ত দৃষ্টিকটু। কোনও কোনও যুদ্ধের বর্ণনা চরিত্রের নাম ছাড়া অন্য একটি যুদ্ধের বর্ণনার হুবহু পুনরাবৃত্তি। কল্পনা ও বাস্তবের সংমিশ্রণের ফলে এই লোককাব্যে বর্ণিত সমস্ত স্থানের বর্তমান ভৌগোলিক অবস্থান নির্ণয় করা সম্ভব নয়। কয়েকটি নগর বা দুর্গের প্রকৃত অস্তিত্বও নির্ণয় করা সম্ভব নয়। নিম্নবর্গীয় সংস্কৃতিতে অলৌকিকতার প্রভাব সম্পর্কে আমরা অবহিত। এই লোক মহাকাব্যের কাহিনিমালায় যেমন উড়ন্ত ঘোড়া আর জাদুকরিদের দেখা যায়, তেমনই সংস্কৃত কাব্যের অনুসরণে কবন্ধদেরও যুদ্ধ করতে দেখা যায়। বীর মহমদীর তাবিজ পরিয়ে মানুষকে ভেড়া বানানো যায়, আবার বীর মহমদীর পুরিয়া দিয়ে কথা বলার শক্তি ফিরিয়ে আনা যায়।
এই লোক মহাকাব্যের উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে সংগৃহীত মৌখিক রূপে বনারস নিবাসী সৈয়দ মীর তাল্হনকে ভীমের অবতার (বা পুনর্জন্ম) আর দিল্লির রাজা পৃথ্বীরাজকে দুর্যোধনের অবতার (বা পুনর্জন্ম) বলে উল্লেখ থেকে বোঝা যায় তখনও উত্তর ভারতে ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের ধারণার বিশেষ অনুপ্রবেশ ঘটেনি। এই মহাকাব্যের প্রাক-জাতীয়তাবাদী ভাবনায় শাসকের ব্যক্তিগত স্বার্থের জন্য প্রজাদের যুদ্ধে প্রাণ দেওয়া গৌরবের বিষয়।
গোবিন্দ রজনীশ, তাঁর ১৯৯৫ সালে লেখা ‘লোক মহাকাব্য: আল্হা (ভূমিকা এবং পাঠ-সম্পাদন)’ গ্রন্থে আল্হা লোক মহাকাব্যের ৫২টি খণ্ডের শীর্ষকের একটি তালিকার উল্লেখ করেছেন। আল্হাখণ্ডের কাহিনিচক্রের ৫২টি কাহিনির শীর্ষকের এই তালিকা থেকে বিষয়বস্তু সম্পর্কে একটি সাধারণ ধারণা সম্ভব:
১. সংযোগিতা স্বয়ংবর, ২. পরমাল কা বিবাহ, ৩. মহোবা কী লড়াই, ৪. গঢ় মাড়োঁ কী লড়াই, ৫. নৈনাগঢ় কী লড়াই, ৬. বিদা কী লড়াই, ৭. মহলা-হরণ, ৮. মলখান কা বিবাহ, ৯. গঙ্গাঘাট কী লড়াই, ১০. ব্রহ্মা কা বিবাহ, নরবর গঢ় কী লড়াই, ১২. ঊদল কী কৈদ, ১৩. চন্দ্রাবলি কী চৌথী কী লড়াই, ১৪. চন্দ্রাবলি কী বিদা, ১৫. ইন্দল হরণ, ১৬. সংগল দীপ কী লড়াই, ১৭. আল্হা কী নিকাসী, ১৮. লাখন কা বিবাহ, ১৯. গাঁজর কী লড়াই, ২০. পট্টী কী লড়াই, ২১. কোট কামরূ কী লড়াই, ২২. বংগালে কী লড়াই, ২৩. অটক কী লড়াই, ২৪. জিন্সী কী লড়াই, ২৫. রুসনী গঢ় কী লড়াই, ২৬. পটনা কী লড়াই, ২৭. অম্বরগঢ় কী লড়াই, ২৮. সুন্দরগঢ় কী লড়াই, ২৯. সিরসাগঢ় কী লড়াই, ৩০. সিরসা কী দূসরী লড়াই, ৩১. ভুজরিয়োঁ কী লড়াই, ৩২. ব্রহ্ম কী জীত, ৩৩. বৌনা চোর কা বিবাহ, ৩৪. ধৌলাগঢ় কী লড়াই, ৩৫. গঢ় চক্কর কী লড়াই, ৩৬. ঢেবা কা বিবাহ, ৩৭. মাহিল কা বিবাহ, ৩৮. সামরগঢ় কী লড়াই, ৩৯. মনোকামনা তীরথ কী লড়াই, ৪০. সুরজাবতী হরণ, ৪১. জাগন কা বিবাহ, ৪২. শংকর গঢ় কী লড়াই, ৪৩. আল্হা কা মনৌআ, ৪৪. বেতবা নদী কী লড়াই, ৪৫. লাখন ঔর পৃথ্বীরাজ কী লড়াই, ৪৬. ঊদল হরণ, ৪৭. বেলা কা গৌনা, ৪৮. বেলা কে গৌনে কী দূসরী লড়াই, ৪৯. বেলা ঔর তাহর কী লড়াই, ৫০. চন্দন বাগ কী লড়াই, ৫১. জৈতখম্ব কী লড়াই, এবং, ৫২. বেলা সতী।
আল্হাখণ্ড লোক মহাকাব্য সম্পর্কে সম্যক ধারণার জন্য এর কাহিনিচক্রের বিভিন্ন ভাষার রূপগুলির একটি সংক্ষিপ্ত বিবরণ উল্লেখ করা প্রয়োজন।
সংযোগিনীর স্বয়ংবর
কন্নৌজি আল্হাখণ্ডের কাহিনিচক্রের সূত্রপাত কন্নৌজের রাজা জ্যায়চন্দের (জয়চন্দ্র) কন্যা সংযোগিনীর (বা সংযোগিতার) স্বয়ংবর, এবং সেই স্বয়ংবরকে কেন্দ্র করে জ্যায়চন্দ ও পিথৌরা রায়ের (পৃথ্বীরাজ) যুদ্ধের সুপরিচিত কাহিনির মাধ্যমে। কন্নৌজি আল্হাখণ্ডের প্রথম মুদ্রিত সংস্করণে এই কাহিনি একটি পৃথক কন্নৌজ খণ্ডের অন্তর্ভুক্ত।
পরমালের বিবাহ
কন্নৌজি আল্হাখণ্ডে দেখা যায় চন্দেল্ল রাজ পরমাল জ্যায়চন্দের অধীনস্থ শাসক কিন্তু, বুন্দেলি আল্হাখণ্ড অনুযায়ী পরমাল সারা ভারত জয় করেন। তাঁর রাজধানী মহোবা। রাজা বাসদেব পরিহারের (বুন্দেলি আল্হাখণ্ড অনুযায়ী বাসদেব বা মালবন্ত মহোবার পূর্ববর্তী রাজা) কন্যা মলনা (মল্হনা, মলন দে নার) ও পুত্র মাহিল (বা মহলা)। (বুন্দেলি আল্হাখণ্ডে বাসদেবের দুই পুত্র মাহিল ও জগনিক)। পরমাল বাসদেবকে পরাস্ত করে মল্হনাকে বিবাহ করেন। পরমাল মাহিলকে যথেষ্ট সম্মান করতেন। কিন্তু মাহিল পরিহার তাঁর পিতাকে পরাস্তকারী পরমালকে কোনও দিনই ক্ষমা করতে পারেনি। আল্হাখণ্ডে পরমালের পতনের অন্যতম মুখ্য কারণ মাহিলের অসদাচরণ ও ষড়যন্ত্র। আল্হাখণ্ডে মাহিলকে আগাগোড়া এক খলনায়কের ভূমিকায় দেখা যায়।
নৌলখা হারের যুদ্ধ
কন্নৌজি আল্হাখণ্ডের মূল কাহিনির শুরু নৌলখা হার নিয়ে যুদ্ধের প্রসঙ্গ থেকে। বাঘেলরাজ জম্বা ছিলেন মাড়ৌঁগড়ের শাসক। তাঁর পুত্র করিংঘা (বা করিয়া বা কড়ংঘা, বুন্দেলি আল্হাখণ্ডে কড়ংগা)। করিংঘা তার বোনের আবদার মেটাতে জাজমউ মেলায় নৌলখা হার কিনতে এসে মাহিলের কাছ থেকে জানতে পারে রানি মল্হনার কাছে একটি নৌলখা হার আছে। করিংঘা সেই হারের জন্য মহোবা আক্রমণ করে। বনাফর বংশীয় চার ভাই দসরাজ (আল্হাখণ্ডের বিভিন্ন রূপে দেসরাজ, দস্সরাজ, জস্সরাজ, জসর বা জসহর; ভবিষ্যপুরাণে দেশরাজ), বচ্ছরাজ; ভবিষ্যপুরাণে বত্সরাজ), রহমল (বা রহিমল) ও টোডর (বা টৌঁডর) সুদূর বক্সারে থাকতেন। বনারস নিবাসী সৈয়দ মীরা তাল্হনের ৯ ছেলে আর ১৮ নাতি। সেই তাল্হনের সঙ্গে বিবাদের মীমাংসার জন্য চার ভাই ও তাল্হন বহু পথ অতিক্রম করে মহোবা পৌঁছান। করিংঘার আক্রমণের সময় চার বনাফর ভাই ও তাল্হন অত্যন্ত বীরত্বের সঙ্গে মহোবার সিংহদ্বার রক্ষা করে তাকে পরাস্ত করেন। কৃতজ্ঞতাবশত রাজা পরমাল চার বনাফর ভাই ও তাল্হনকে সিংহদ্বার থেকে রাজপ্রাসাদে নিয়ে আসেন। পরমাল দসরাজ, বচ্ছরাজ, রহমল ও টোডরকে রাজপ্রাসাদের ধনসম্পদ রক্ষার দায়িত্ব দেন এবং সৈয়দ মীরা তাল্হনকে সেনাপতি নিযুক্ত করেন। দেবী (বা দেবল দে) ও বিরমা (বা বিরম্হাঁ) গোয়ালিয়রের শাসক দলপতের (বা দলপতি) দুই কন্যা। রাজা পরমাল দসরাজের সঙ্গে দেবীর আর বচ্ছরাজের সঙ্গে বিরম্হাঁর বিবাহ দেন। রানি মল্হনা তাঁর নৌলখা হার দেবীকে পরিয়ে দেন।
আল্হাখণ্ডের বুন্দেলি ভাষার রূপ অনুযায়ী একবার রাজা পরমাল কজরী বনে শিকার করতে যান। সেখানে দুটি অনাথ বালকের দেখা পান। পরমাল তাদের হাতির উপর বসিয়ে রাজ প্রাসাদে নিয়ে আসেন। রানি মলনার (মল্হনার) অনুরোধে পরমাল তাদের পুত্র হিসেবে স্বীকার করে নেন। দসরাজ ও বচ্ছরাজের পত্নীদের সম্পর্কেও আল্হা খণ্ডের বিভিন্ন রূপে পৃথক বর্ণনা দেখতে পাওয়া যায়। আল্হাখণ্ডের বুন্দেলি ভাষার রূপে দেখা যায়, দিবলা ও তিলকা রানি মলনার (মল্হনার) দুই বোন, মহোবার শাসক বাসদেব পরিহারের কন্যা। রাজা পরমাল জসরাজের (দসরাজের) সঙ্গে দিবলার আর বচ্ছরাজের সঙ্গে তিলকার বিবাহ দেন।
দসরাজ ও বচ্ছরাজের বিবাহের এক বছর পর জ্যৈষ্ঠ মাসের দশমী তিথিতে দসরাজের পুত্র আল্হার (বা নুন আল্হা) জন্ম হয় দশপুরওয়া (দশহরপুর, মহোবার প্রান্তবর্তী একটি ছোট গ্রাম) গ্রামে (আল্হা ও উদলের মাতা ও পিতার নামের ব্যাপারে এই লোককাব্যের বিভিন্ন রূপের মধ্যে অবশ্য কোনও পার্থক্য দেখা যায় না, সব রূপেই আল্হা ও উদলকে দসরাজ ও দিবলার (দেবলা) দুই পুত্র বলে উল্লেখ করা হয়েছে)। এরপর জন্ম হয় বচ্ছরাজের পুত্র – মলখান (বা মলখৈ), রহমলের পুত্র ঢেবা ও টৌঁডরের পুত্র তোমরের।
মাড়ৌঁগড়ের যুদ্ধ
কয়েক বছর পর, করিংঘা বদলা নিতে রাতের অন্ধকারে মহোবা আক্রমণ করে। সে দসরাজ ও বচ্ছরাজকে হত্যা করে রাজপ্রাসাদ লুঠ করে ফিরে যায়। এর এক মাস বাদে দসরাজের পুত্র উদন (আল্হাখণ্ডের বুন্দেলি ভাষার রূপে উদল বা উদয়সিংহ, ভোজপুরি ভাষার রূপে রুদল) ও বচ্ছরাজের পুত্র সুলখানের জন্ম হয়। একই সময়, পরমাল ও মল্হনার একমাত্র পুত্র ব্রহ্মার (ভবিষ্যপুরাণে ব্রহ্মানন্দ, বুন্দেলি ভাষার রূপে বরমজিত অর্থাৎ ব্রহ্মজিৎ) জন্ম হয়। বনাফর বংশীয় ৬ ভাই – আল্হা, উদন, মলখান, সুলখান, ঢেবা ও তোমর ব্রহ্মার সঙ্গে একসঙ্গে বড় হতে থাকেন। ১২ বছর বাদে আল্হা, উদন, মলখান, ঢেবা আর তাল্হন যোগীর ছদ্মবেশে মাড়ৌঁগড় পৌঁছান প্রতিশোধ নিতে। বহু দিন যাবৎ যুদ্ধের পর মলখান করিংঘাকে বধ করেন। তারপর, আল্হা জম্বাকে পরাস্ত ও হত্যা করেন। উদন জম্বার কন্যা বিজমার (বা বিজ্যায়সন) প্রতি আকর্ষিত হয়ে তাকে বিবাহ করতে চান, কিন্তু আল্হা তাঁকে নিরস্ত করেন। মলখান বিজমাকে হত্যা করেন। মৃত্যুর পূর্বে বেদনাতুর উদনকে বিজমা জানিয়ে যান, নরওয়ারের রাজা নরপতের কন্যা ফুলওয়া হয়ে আবার জন্মগ্রহণ করবেন, তখন দুজনের মধ্যে মিলন হবে।
ন্যায়নাগড়ের যুদ্ধ ও আল্হার বিবাহ
ন্যায়নাগড়ের শাসক নৈপালের কন্যা সুনওয়া (সোনবতী)। নৈপালের প্রতাপের ভয়ে কেউ সুনওয়াকে বিবাহ করতে সাহস পাচ্ছিলেন না। সুনওয়া আল্হাকে বিবাহের জন্য পত্র পাঠালে আল্হা তাঁর পাঁচ ভাই, তাল্হন, তাল্হনের সাত পুত্র ও জগনায়ক (বা জগনিক বা জাগিন, আল্হাখণ্ডের বুন্দেলি রূপে জগনিক মলনার ভাই) এবং চন্দেল সেনাদের সঙ্গে নিয়ে ন্যায়নাগড় অভিযানে রওনা হন। এদিকে মাহিল ন্যায়নাগড়ের শাসক নৈপালকে আল্হার অন্য এক বংশ পরিচয় বর্ণনা করে। মাহিলের বিবরণ অনুযায়ী, দেবলা ও বিরমা দুজনেই অরণ্যবাসী আহীর কন্যা। দসরাজ ও বচ্ছরাজ এক দিন হরিণ শিকার করতে জঙ্গলে যান, পথে দুটি মোষকে গুঁতোগুঁতি করতে দেখে দাঁড়িয়ে যান। দেবলা ও বিরমা দু’জনে দু’টি মোষের শিং ধরে তুলে এক পাশে সরিয়ে তাঁদের পথ পরিষ্কার করে দেন। দেবলা ও বিরমার শক্তি দেখে মুগ্ধ হয়ে দসরাজ ও বচ্ছরাজ তাঁদের বিবাহ করেন। মাহিলের বিবরণ শোনার পর, নৈপাল ‘ওছী জাত’ অর্থাৎ ‘নিচু জাতি’ বলে আল্হার সঙ্গে সুনওয়ার বিবাহ দিতে অস্বীকার করলে যুদ্ধ শুরু হয়। নৈপাল আল্হার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য সমস্ত ক্ষত্রিয়দের আহ্বান করেন, সুদূর দেশ থেকে হাবশি আর দুর্রানিদেরও ডেকে আনেন। দীর্ঘ যুদ্ধের পর, আল্হা ও সুনওয়ার বিবাহ সম্পন্ন হয়, কিন্তু আল্হা নৈপালের হাতে বন্দি হন। শেষ পর্যন্ত সুনওয়া ও উদন আল্হাকে মুক্ত করতে সক্ষম হন এবং সবাই সকুশলে মহোবা ফিরে আসেন।
মলখানের বিবাহ
বিসেন রাজ্যের শাসক গজরাজের কন্যা গজমোতিন। গজরাজের অধীনে দু’টি দুর্গ – জুন্নাগড় আর পথরীগড়। তাঁর কাছে রয়েছে এক নাক দিয়ে আগুন ওগড়ানো অগিনিয়া ঘোড়া আর আছে সিমিয়া (বা সুমিয়া; বুন্দেলি আল্হাখণ্ডে সুভিয়া) নামের এক জাদুকরি বিড়িনী অর্থাৎ বেদেনি। মহোবায় রাজা পরমালের কাছে গজমোতিনের বিয়ের জন্য সম্বন্ধ এলে তিনি মলখানের সঙ্গে বিবাহ দিতে রাজি হয়ে যান। মলখান বিবাহ করতে বিসেন পৌঁছালে গজরাজ বিয়ের রীতি বলে একের পর এক হত্যার চেষ্টা চালান। দীর্ঘ যুদ্ধ এবং জাদু ও পাল্টা জাদুর প্রয়োগের পর গজরাজ পরাজয় স্বীকার করে নেন, মলখানের সঙ্গে গজমোতিনের বিবাহ হয়।
ব্রহ্মার বিবাহ
পিথৌরা রায় (পৃথ্বীরাজ) ও তাঁর রানি অগমার কন্যা বেলা (বা বিলম দে) (বুন্দেলি ভাষার আল্হাখণ্ডে বেলা পৃথ্বীরাজের কাকা কুব্জকানের কন্যা)। বেলার ভাই তাহর বোনের বিবাহের জন্য পিতার নির্দেশে মহোবা বাদ দিয়ে আর সব রাজদরবারে যেতে শুরু করে। মাহিলের বুদ্ধিতে মল্হনা পরমালের সঙ্গে পরামর্শ না করেই ব্রহ্মাকে একলা বেলাকে বিবাহের জন্য প্রেরণ করেন। বেলা বিবাহের শর্ত হিসাবে দ্রৌপদীর আভূষণ দাবি করেন। আল্হা দেবী শারদাকে সন্তুষ্ট করে মাটির নীচে রাখা বেলাকে দ্রৌপদীর আভূষণ এনে দেন। পৃথ্বীরাজের সেনা বরযাত্রীদের আক্রমণ করলে যুদ্ধ শুরু হয়। যুদ্ধে পৃথ্বীরাজের ৭ পুত্র বন্দি হওয়ার পর পৃথ্বীরাজ বেলাকে ব্রহ্মার সঙ্গে বিবাহ দিতে বাধ্য হন। তিনি তত্ক্ষণাৎ বেলাকে মহোবা পাঠাতে অস্বীকার করেন, এক বছর বাদে ‘গৌনা’র জন্য পাঠাবেন বলে প্রতিশ্রুতি দেন। ব্রহ্মা বেলাকে ছাড়াই মহোবা ফিরে আসেন।
উদনের বিবাহ
নরওয়ারের রাজা নরপতের কন্যা ফুলওয়া। উদন পরমালের জন্য ঘোড়া কিনতে কাবুল যাওয়ার পথে নরওয়ারে পৌঁছে ফুলওয়াকে দেখে মুগ্ধ হয়ে যান। মহোবায় ফিরে গিয়ে সবাইকে জানানোর পর, আল্হা, উদন ও অন্যান্যরা নরবর রওনা হন। যুদ্ধে উদন বন্দি হন, মহোবার সৈন্যরা নিহত হয়। কিন্তু, দেবলা তাদের আবার পুনরুজ্জীবিত করেন, এবং আবার যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে পরাস্ত হয়ে নরপত আত্মসমর্পণ করেন। উদন ফুলওয়াকে বিবাহ করে মহোবায় ফিরে আসেন।
চন্দ্রাবলের চৌথীর যুদ্ধ
পরমাল ও মল্হনার কন্যা চন্দ্রাবল (বা চন্দ্রাবলী বা চন্দ্রবেল) বিবাহের ১২ বছর পর্যন্ত পিত্রালয়ে না আসায় উদন বৌরিগড় রওনা হন তাঁকে চৌথীর (বিবাহের পর প্রথম পিতৃগৃহে আসার অনুষ্ঠান) জন্য নিয়ে আসতে। পৃথ্বীরাজের নিষেধ সত্ত্বেও উদন বৌরিগড় পৌঁছালে রাজা বীরসাহি মাহিলের কুপরামর্শে উদনকে হত্যার চেষ্টা করেন। যুদ্ধে রাজা বীরসাহি ও তাঁর ৭ পুত্র বন্দি হন। রাজা ক্ষমা চেয়ে চন্দ্রাবলকে পিত্রালয়ে পাঠাতে রাজি হন, সবাইকে মুক্তি দেওয়া হয়।
ইন্দলের হরণ ও বিবাহ
দশহরার দিন গঙ্গাস্নান করতে উদন ও ঢেবার সঙ্গে আল্হার পুত্র ইন্দল বিঠুর যান। সেই সময় বল্খ-বুখারার রাজা অভিনন্দন ও তাঁর রানি চম্পার কন্যা চিত্তর রেখা বিঠুরে আসে। চিত্তর রেখা উদন ও ঢেবাকে অন্ধ ও অবশ করে ইন্দলকে তোতা বানিয়ে খাঁচায় পুরে বল্খ-বুখারা নিয়ে যায়। উদন ও ঢেবা বল্খ-বুখারা গিয়ে চিত্তর রেখাকে বুঝিয়ে ইন্দলকে আবার মানুষ বানিয়ে মহোবায় ফেরত নিয়ে আসে। এরপর আল্হা, উদন, মলখান ও ঢেবা আক্রমণ করে অভিনন্দন আর তাঁর ৭ পুত্রকে বন্দি করে। অভিনন্দন পরাজয় স্বীকার করলে সবাইকে ছেড়ে দেওয়া হয়। ইন্দলের সঙ্গে চিত্তর রেখার বিবাহ হয়।
আল্হার বহিষ্কার ও লাখনের বিবাহ
পিথৌরা রায় (পৃথ্বীরাজ) পরমালের কাছে তাঁর উড়ন্ত ঘোড়া চেয়ে পাঠালে, পরমাল ভয় পেয়ে দিয়ে দিতে রাজি হয়ে যান। আল্হা ও উদন তাঁকে উড়ন্ত ঘোড়া পৃথ্বীরাজকে দিতে নিষেধ করলে, পরমাল তাঁদের রাজ্য থেকে বহিষ্কার করেন। আল্হা ও উদন সপরিবারে কন্নৌজে গিয়ে রাজা জ্যায়চন্দের আশ্রয় গ্রহণ করেন। উদনের পরামর্শে রাজা জ্যায়চন্দ ও রানি তিলকা বুঁদির রাজা গঙ্গাধরের কন্যা কুসুমার (বা কুসুম বা কুসুম দে) সঙ্গে তাঁদের পুত্র লাখনের (বুন্দেলি ভাষার আল্হাখণ্ডে লাখন জ্যায়চন্দের ভ্রাতা রতীভানের পুত্র) বিবাহ দিতে রাজি হন। লাখন বিবাহ করতে বুঁদি উপস্থিত হলে গঙ্গাধরের সেনা লাখন ও উদনকে বন্দি করে একটি গর্তের মধ্যে ফেলে দেয়। তখন কন্নৌজ ও মহোবার সেনার সঙ্গে বুঁদির সেনার ভয়ংকর যুদ্ধ হয়। আল্হা, মলখান, ব্রহ্মা, সৈয়দ মীরা তাল্হন সবাই যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। গঙ্গাধরের দুই পুত্র বন্দি হয়, গঙ্গাধর আল্হার কাছে পরাস্ত হন। লাখন ও কুসুমের বিবাহ সম্পন্ন হয়। এরপর, উদন গাঁজর, পট্টী, কামরূ, বঙ্গাল, কটক, জিন্সি, রসনি, গোরখপুর, পটনা, কাশী প্রমুখ ১২টি রাজ্যের রাজাকে যুদ্ধে পরাস্ত ও বন্দি করে তাঁদের কাছ থেকে রাজা জ্যায়চন্দের জন্য কর আদায় করে নিয়ে আসেন।
সিরসার যুদ্ধ, মলখানের মৃত্যু এবং আল্হার প্রত্যাবর্তন
আল্হা ও উদন মহোবা ত্যাগ করার পর মাহিল দিল্লি গিয়ে পৃথ্বীরাজকে খবর দেয় রাজা পরমাল আল্হা ও উদনকে রাজ্য থেকে তাড়িয়ে দিয়েছেন, মহোবা অরক্ষিত, এই সময় চন্দেল্ল রাজ্যের সীমান্তবর্তী সিরসা আক্রমণ করে দখল করতে পারলে মহোবাও দখল করা সম্ভব হবে। পৃথ্বীরাজের সেনাপতি চৌঁড়া (রাজস্থানি আল্হাখণ্ডে চামুণ্ড রায়, ভবিষ্যপুরাণে চামুণ্ড) নামের এক নাগর ব্রাহ্মণ। আল্হাখণ্ডের একটি রূপ অনুসারে এই চৌঁড়া দসরাজের এক আহীর পত্নীর অবৈধ পুত্র, তাকে জন্মের পর নদীতে ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছিল। সেই বালক পৃথ্বীরাজ চৌহানের কাছে আশ্রয় লাভ করে। চৌহান সেনা চৌঁড়ার নেতৃত্বে সিরসা আক্রমণ করে। মলখান সিরসা দুর্গ রক্ষার দায়িত্বে ছিলেন। সিরসাগড়ে চৌহান সেনার সঙ্গে মলখানের নেতৃত্বে মহোবার সেনার প্রচণ্ড যুদ্ধ হয়, শেষ পর্যন্ত চৌহান সেনা পিছু হঠতে বাধ্য হয়। এরপর পৃথ্বীরাজের নেতৃত্বে আবার চৌহান সেনা সিরসাগড় আক্রমণ করে, পৃথ্বীরাজ মলখানকে হত্যা করেন, মলখানের পত্নী গজমোতিনকে ‘সতী’ হতে হয়। (বুন্দেলি আল্হাখণ্ডে দেখা যায় আহমদ নামের এক বৃদ্ধ মুসলমান ফকির গজমোতিনকে ‘সতী’ না হওয়ার জন্য বোঝাবার চেষ্টা করছেন)। সিরসার পতনের পর, পৃথ্বীরাজের সেনা মহোবা অবরোধ করে। মাহিল রানি মল্হনাকে জানান, পৃথ্বীরাজের সেনা খজুহাগড় (খাজুরাহো), গোয়ালিয়র, ৫টি উড়ন্ত ঘোড়া, এবং নৌলখা হার পেলে ফিরে যাবেন। ব্রহ্মা এই প্রস্তাব অস্বীকার করলে, মহোবার কিরত সাগর হ্রদের ধারে যুদ্ধ শুরু হয়। ব্রহ্মার নেতৃত্বে মহোবার সৈন্য প্রাথমিক সাফল্য অর্জন করলে পৃথ্বীরাজ নিজেই কিরত সাগরের পার্শ্ববর্তী যুদ্ধক্ষেত্রে উপস্থিত হন। রানি মল্হনা আল্হা ও উদনকে ফেরত আনতে জগনিককে কন্নৌজ পাঠান। কন্নৌজে গিয়ে জগনিক জানতে পারেন, আল্হা ও উদন রিজগিরিতে আছেন। জগনিকের অনুরোধে আল্হা, উদন, ইন্দল, সৈয়দ মীরা তাল্হন ও লাখন সসৈন্যে বেতোয়া নদীর তিরে উপস্থিত হন। লাখনের নেতৃত্বে কন্নৌজের সৈন্য বেতোয়া নদী অতিক্রম করে চৌঁড়ার নেতৃত্বাধীন দিল্লির সৈন্যের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হয়, চৌঁড়া পরাস্ত হয়। এবার পৃথ্বীরাজ যুদ্ধক্ষেত্রে অবতীর্ণ হন, প্রচণ্ড আক্রমণে কন্নৌজের সৈন্য পিছু হঠতে শুরু করে। আল্হা ও উদন যুদ্ধক্ষেত্রে আসার পর, পৃথ্বীরাজ যুদ্ধক্ষেত্র ত্যাগ করেন, দিল্লির সৈন্য পিছু হঠে। আল্হা ও উদন কন্নৌজের সৈন্যের সঙ্গে মহোবায় প্রবেশ করেন। মহোবা বিপন্মুক্ত হয়।
উদন হরণ
একবার জ্যৈষ্ঠ মাসের দশমী তিথিতে সুনওয়া ও ফুলওয়া উদনের সঙ্গে বিঠুর যান গঙ্গাস্নান করতে। বিঠুরে নৃত্য প্রদর্শন করতে এসে জুন্নাগড়ের বেদেনি সিমিয়া (বা সুমিয়া) সেনা শিবিরে উদনকে দেখে মুগ্ধ হয়ে যায়। সে উদনকে তোতা বানিয়ে খাঁচায় পুরে ঝাড়খণ্ড নিয়ে যায়। সুনওয়া আল্হা, মলখান, ঢেবা ও ইন্দলকে নিয়ে ঝাড়খণ্ড পৌঁছে উদনকে আবার মানুষ বানিয়ে দেন। সিমিয়ার জাদুবিদ্যা দিয়ে সৃষ্ট সৈন্যদের উদন, মলখান, ঢেবা ও ইন্দল বিনষ্ট করার পর সিমিয়ার খোঁপা কেটে তার জাদুশক্তি নষ্ট করে দেওয়া হয়। আধুনিক বিদ্বানদের ধারণা উদন হরণের কাহিনিটি আসলে আল্হাখণ্ডের প্রথম দিকের কাহিনি, অনবধানতার কারণে শেষ দিকে চলে এসেছে।
বেলার ‘গৌনা’র যুদ্ধ
পৃথ্বীরাজের কথামত এক বছর পূর্ণ হলে পরমাল বেলাকে ‘গৌনা’র জন্য মহোবা নিয়ে আসার সিদ্ধান্ত নেন। উদন বেলাকে নিয়ে আসতে রাজি হলেও, মাহিল নীচু ‘বনাফর’ জাতির কাউকে না পাঠানোর পরামর্শ দেয়। ব্রহ্মা একাই বেলাকে আনতে রওনা হয়ে দিল্লির সীমান্তে শিবির স্থাপন করেন; আল্হা ও উদন অপমানিত হয়ে দশপুরওয়া চলে যান। পৃথ্বীরাজ বিনাযুদ্ধে বেলাকে দিতে অস্বীকার করলে দিল্লি ও মহোবার সেনাদের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয়। পৃথ্বীরাজের পুত্র তাহর ব্রহ্মাকে গুরুতরভাবে আহত করে। বেলার চিঠি পেয়ে উদন, ঢেবা, লাখন ও সৈয়দ মীরা তাল্হন ছদ্মবেশে দিল্লি পৌঁছে বেলাকে নিয়ে মহোবার পথে রওনা হন। চৌঁড়ার নেতৃত্বে চৌহান সেনা তাদের পশ্চাদ্ধাবন করে। লাখনের হাতে চৌঁড়া পরাস্ত হলে পৃথ্বীরাজ নিজেই সেনাবাহিনী নিয়ে উপস্থিত হন। তা সত্ত্বেও লাখন বেলাকে যুদ্ধশিবিরে মৃত্যুপথযাত্রী ব্রহ্মার কাছে নিয়ে আসতে সক্ষম হন। ব্রহ্মকে দেখার পর বেলাকে আল্হা ও উদন মহোবা নিয়ে আসতে সক্ষম হন। বেলা এবার নিজেই পুরুষের বেশে সেনা নিয়ে দিল্লি গিয়ে তাঁর ভাই তাহরের মুণ্ডচ্ছেদ করে ব্রহ্মার কাছে নিয়ে আসেন।
আল্হা ও উদলের শেষ যুদ্ধ
দিল্লির নিকটবর্তী শিবিরে ব্রহ্মার মৃত্যু হয়, বেলা ‘গৌনা’র পূর্বেই বিধবা হন। বেলা ‘সতী’ হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে চিতার জন্য দিল্লির চন্দন বাগান থেকে চন্দন কাঠ এনে দিতে অনুরোধ করলে উদন ও লাখন তাঁর অনুরোধ পূর্ণ করেন। তখন বেলা তাঁদের পৃথ্বীরাজের রাজ-দরবারের ১২টি চন্দন কাঠের স্তম্ভ কেটে নিয়ে আসতে অনুরোধ করেন। উদন সেনা নিয়ে দিল্লি পৌঁছে চন্দন কাঠের স্তম্ভগুলি কেটে নিয়ে শিবিরে ফিরে আসেন, চিতা প্রস্তুত করা হয়। ব্রহ্মার শব ও বেলাকে একই চিতায় পুড়িয়ে দেওয়া হয়। পৃথ্বীরাজের নিষেধ না মেনে উদন ‘নীচু জাতি’ বনাফর হয়েও ব্রহ্মা ও বেলার চিতায় অগ্নিসংযোগ করলে, পৃথ্বীরাজ ভয়ংকর ক্রুদ্ধ হয়ে বিপুল সৈন্য ও অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে দিল্লির সীমান্তবর্তী মহোবার সেনাশিবির আক্রমণ করেন। প্রথমেই সৈয়দ মীরা তাল্হনের মৃত্যু হয়। তারপর ঢেবা ও জগনিকেরও মৃত্যু হয়। পৃথ্বীরাজের হাতে লাখনের মৃত্যু হয়। উদনকে চৌঁড়া হত্যা করে। তারপর আল্হা চৌঁড়াকে হত্যা করে। পৃথ্বীরাজের ৭ পুত্রের মৃত্যু হয়। আল্হার সঙ্গে পৃথ্বীরাজের যুদ্ধ শুরু হয়। আল্হা পৃথ্বীরাজকে পরাস্ত করে তাঁর ধ্বজ কেড়ে নিলে পর্যুদস্ত পৃথ্বীরাজ দিল্লি ফিরে যান। মহোবার রাজপ্রাসাদে যুদ্ধের এই পরিণতির খবর পৌঁছালে শোকাকুল রাজা পরমাল অন্নজল ত্যাগ করেন, ১৩ দিন বাদে তাঁর জীবনাবসান হয়। আল্হা দেবী শারদাকে নিজের মাথা কেটে পূর্ণ খর্পর রক্তপান করিয়ে সন্তুষ্ট করায় দেবী তাঁকে অমরত্বের বর দিয়েছিলেন। এই শেষ যুদ্ধের পর আল্হা তাঁর পুত্র ইন্দলকে সঙ্গে নিয়ে মহোবা ত্যাগ করে কজরী বনে অদৃশ্য হয়ে যান। বুন্দেলি আল্হাখণ্ড অনুযায়ী, তিনি চিরজীবী এবং পৃথ্বীরাজের প্রতি প্রতিশোধ নিতে একদিন আবার প্রকট হবেন। রাজস্থানি ভাষার আল্হাখণ্ডের শেষে দেখা যায় আল্হার আক্রমণে প্রিথিরাজ ও তাঁর সামন্তরা মূর্ছিত হয়ে পড়লে গোরক্ষনাথ আবির্ভূত হয়ে আল্হাকে অমরত্ব প্রদান করে, তাঁকে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে যোগসাধনার জন্য অরণ্যে নিয়ে চলে যান। ফলে, পৃথ্বীরাজ প্রাণে বেঁচে যান। চামুণ্ড রায় (অর্থাৎ চৌঁড়া) পরিমালকে কালিঞ্জর দুর্গ থেকে তুলে নিয়ে আসে, চৌহান সেনা কালিঞ্জর দুর্গ লুঠ করে।
আল্হাখণ্ড কাহিনিচক্রের বনাফর কারা?
দসরাজ ও বচ্ছরাজ বুন্দেলখণ্ডের বনাফর বংশীয় বলে আল্হাখণ্ডে উল্লিখিত। মহোবায় আল্হাখণ্ডে বর্ণিত বনাফরদের উপাস্য দেবতা মনিয়া বা মনাইয়ার একটি মন্দির আজও বিদ্যমান। বনাফর বংশের উত্পত্তি নিয়ে আধুনিক বিদ্বানরা একমত নন। ‘দ্য ইন্ডিয়ান অ্যান্টিকোয়ারি’ পত্রিকার ১৯১৮ সালের ডিসেম্বর সংখ্যায় কাশী প্রসাদ জয়সওয়াল লিখেছেন, তাঁর মতে সারনাথের ভিক্ষু বলের প্রদত্ত বোধিসত্ত্ব প্রতিমা লেখে উল্লিখিত কনিষ্কের প্রাদেশিক শাসকের নাম ‘বনস্পর’ নয়, বনস্ফর। কারণ, পৃথ্বীরাজ চৌহানের সময় বনাফর রাজপুতদের কথা জানা যায়। যদিও উত্তর ভারতের গাথায় (অর্থাৎ আল্হাখণ্ডে) উল্লেখ করা হয়েছে, মহোবার বনাফরদের ‘নিচু জাতি’ বলে মনে করা হত, তাই আল্হা ও উদলকে কেউ বিবাহের জন্য কন্যা দেয়নি।৫ কন্নৌজি ভাষার আল্হাখণ্ডে দেখা যায়, এই মহাকাব্যে বর্ণিত উত্তর ভারতের শাসকদের কেউই যাতে বনাফরদের সঙ্গে কন্যার বিবাহ দিতে না হয়, সেই জন্য মহোবায় দূত পাঠাতেন না। জর্জ গ্রিয়ার্সন অবশ্য মনে করতেন, যদিও বনাফর বংশীয়দের কাহিনির সঙ্গে মহোবার যোগ নিবিড় আর এই অঞ্চলে আধুনিক যুগ পর্যন্ত বুন্দেলি ভাষার বনাফরি উপভাষার প্রচলন থাকা সত্ত্বেও বনাফররা সম্ভবত বক্সার অর্থাৎ প্রাচীন ব্যাঘ্রসর বা বাঘসর থেকে এসেছিলেন। গ্রিয়ার্সনের ধারণা, বনাফরদের পত্নীরা উচ্চবংশীয় ছিলেন কিন্তু পরবর্তীকালে তাঁদের আহীর বলে অভিহিত করা হয়েছে। তাঁর মতে, এমনও হতে পারে এই অপবাদ মাহিলেরই সৃষ্টি। আল্হাখণ্ডের বর্ণনা কিন্তু বনাফরদের নিম্নবর্গীয় অতীতের দিকেই ইঙ্গিত করে।
আল্হাখণ্ডের কাহিনিচক্রে বৈচিত্র্য
স্থান ও ভাষার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে আল্হাখণ্ডের কাহিনিতে চরিত্রের নামও পরিবর্তিত হয়েছে। কন্নৌজি আর ভোজপুরি ভাষার রূপ অনুসারে আল্হার বিবাহ নৈনাগড়ের রাজকুমারী সুনওয়ার (সোনবতী) সঙ্গে হয়েছিল। অন্যদিকে বুন্দেলি ভাষার রূপ অনুযায়ী হরিদ্বারের রাঘো মচ্ছের কন্যা মচ্ছলাবতী (বা মচ্ছল দে বা মাচ্ছিল) আল্হার পত্নী। আল্হা ও উদলের লোকগাথায় উল্লিখিত স্থানগুলির ভৌগোলিক অবস্থান আল্হাখণ্ডের বিভিন্ন ভাষায় রচিত রূপগুলিতে এক নয়। রাজস্থানের অল্হৈতরা নৈনাগড়কে চুনার দুর্গের সঙ্গে অভিন্ন বলে মনে করেন। মাড়ৌঁ কোথায় ছিল বলা কঠিন। ভিনসেন্ট স্মিথের মতে বর্তমান মির্জাপুর জেলার বিজয়পুর গ্রাম প্রাচীন মাড়ৌঁ। কজরী বন, অলৌকিকতার অন্তরালে হারিয়ে যাওয়া একটি স্থান। জুন্নাগড়কে আধুনিক বিদ্বানদের মহারাষ্ট্রের পুনে জেলার জুন্নর শহরের সঙ্গে অভিন্ন বলে মনে হয়েছে।
আধুনিক যুগে আল্হাখণ্ড চর্চা
উনিশ শতকের শেষদিক থেকেই স্বনামে কন্নৌজি ভাষার আল্হাখণ্ডের স্বকীয়তাপূর্ণ রূপ নির্মাণ করে বই ছাপিয়ে গ্রাম ও শহরের মেলায় বিক্রির প্রচলন শুরু হয়। ৫২টি যুদ্ধ আর ২৩টি যুদ্ধক্ষেত্রের বর্ণনা সম্বলিত এই বইগুলির মধ্যে সবচেয়ে পুরোনো ও জনপ্রিয় বোধ হয় পণ্ডরী কলান নিবাসী ললিতা প্রসাদ মিশ্রের লেখা ‘আল্হখণ্ড: তেইস ম্যায়দান, বাওন লড়াই’। ১৮৫৬ বিক্রম সংবত অর্থাৎ ১৮৯৯ সালে তাঁর এই গ্রন্থ রচনা সমাপ্ত হয় বলে তিনি জানিয়েছেন। ১৯৫২ সালে লখনউ থেকে নওলকিশোর প্রেস এই বইটির একাদশ সংস্করণ প্রকাশ করে। ১৯৭২ সালে এর দ্বাদশ সংস্করণ প্রকাশিত হয়। এরপর উল্লেখনীয় ১৮৫৭ বিক্রম সংবত অর্থাৎ ১৯০১ সালে সম্পূর্ণ মটরুমল অত্তারের রচনা। এই বইটির সর্বশেষ সংস্করণ দিল্লির খারী বাওলিস্থিত অগ্রবাল বুক ডিপো প্রকাশ করেছে। সাম্প্রতিক কালে দিল্লির মনোজ পকেট বুকস তাদের ‘মনোজ চিত্র কথা’ সিরিজের অংশ হিসাবে ‘আল্হা ঊদল’ নামে একটি কমিক বই প্রকাশ করেছে। এই বইয়ের কাহিনি রচনায় মূলত রাজস্থানি রূপের অনুসরণ করা হয়েছে। ২০১২ সালের ২৯ অক্টোবর থেকে আল্হাখণ্ডের কাহিনি নিয়ে দূরদর্শনের জাতীয় চ্যানেলে ‘সবসে বড়ে লড়াইয়া – আল্হা উদল’ নামের একটি হিন্দি ধারাবাহিকের প্রসারণ করা হয়েছে। এই ধারাবাহিকের কাহিনি ও চিত্রনাট্য লিখেছিলেন বিক্রম সুদ। প্রায় একই সময়, বলাকা ঘোষের পরিচালনায় ‘ইন সার্চ অফ আল্হা’ নামে এই লোক মহাকাব্য নিয়ে একটি তথ্যচিত্রও নির্মিত হযেছে। ভারতের বাইরে, ত্রিনিদাদ, গায়ানা ও সুরিনামের ভারতীয় বংশোদ্ভূত নাগরিকদের মধ্যে কয়েক দশক আগে পর্যন্ত মুদ্রিত আল্হাখণ্ড থেকে পাঠের অনুষ্ঠানের কথা জানা গিয়েছে।৬
উত্তর ভারতে আল্হাখণ্ডের মৌখিক রূপ ‘আল্হা’ গানের ধারা ‘অল্হৈত’দের নিরন্তর প্রয়াসে আজও অব্যাহত ভাবে প্রবহমান। আধুনিক যুগে ‘আল্হা’ গানের ধারার বিকাশে যাঁদের ভূমিকা স্মরণীয়, তাঁদের মধ্যে রয়েছেন, মুসানগরের পীর খান, কানপুরের কালী সিংহ ও তাঁতী সিংহ। সাম্প্রতিক কালের জনপ্রিয় ‘আল্হা’ গায়কদের মধ্যে উল্লেখনীয় উন্নাও জেলার নারায়ণদাস খেড়া গ্রামের লল্লু (চন্দ্রনাথ) বাজপেয়ী (?-০২.০৫.২০১৩), কানপুরের রামখিলাওন মিশ্র, হমীরপুরের কাশীরাম প্রমুখ। ‘আল্হা’ গায়ক বাচ্চা সিংহ মহোবার জনকবি জগনিক শোধ সংস্থানের ভবনে আল্হা গান শেখানোর জন্য একটি সঙ্গীত বিদ্যালয় স্থাপন করেছেন। সাম্প্রতিক কালে ভোপালে অবস্থিত মধ্যপ্রদেশ আদিবাসী লোককলা পরিষদ আল্হাখণ্ডের ৩৫টি পৃথক রূপ নথিবদ্ধ করেছে। মহোবা, দতিয়া, সাগর ও নরসিংহপুর শৈলী নামে পরিচিত ‘আল্হা’ গানের ৪টি শৈলী আজও যথেষ্ট জনপ্রিয়।
আল্হা ও উদলের বীরত্ব নিয়ে রচিত অন্ত-মধ্যযুগের লোক মহাকাব্য ভারতের লোকসংস্কৃতির এক অনন্য সম্পদ। অন্ত-মধ্যযুগের উত্তর ভারতে নিম্নবর্গীয় সমাজের রাজনৈতিক ও সামাজিক ভাবনার ইতিহাস নিয়ে অনুসন্ধানের জন্য আল্হাখণ্ডের সামগ্রিক সমীক্ষাত্মক অধ্যয়ন অত্যন্ত আবশ্যক।
পাদটীকা
১. James Tod, ‘Annals and Antiquities of Rajas’than or the Central and Western Rajpoot States, Vol. 1’; London: Smith, Elder & Co., 1829, pp. 614-621.
২. G.A. Grierson, “The Song of Alha’s Marriage; A Bhojpuri Epic” in ‘The Indian Antiquary, A Journal of Oriental Research’, Vol. XIV, Delhi: Swati Publications, 1984 (1885), pp. 209-227.
৩. রামবহাল তেওয়ারী, ‘হিন্দী সাহিত্যের ইতিহাস’; কলকাতা, সাহিত্যলোক, ২০১৮, পৃ. ২৩-২৪।
৪. রামচন্দ্র শুক্ল, ‘হিন্দী-সাহিত্য কা ইতিহাস’; কাশী: নাগরী প্রচারিণী সভা, ১৯৪৯ [১৯২৯], পৃ. ৫১-৫২।
৫. K.P. Jayaswal, “Identification of some of the post-Andhravritya rulers of the Puranic List” in ‘The Indian Antiquary, A Journal of Oriental Research’, Vol. XLVII, Delhi: Swati Publications, 1985 (1918), p. 298n7.
৬. Peter Manuel, “The Trajectories of Transplants: Singing Alhā, ‘Birhā’, and the Rāmāyan in the Indic Caribbean” in ‘Asian Music, Vol. 43, No. 2 (Summer/Fall 2012)’; Austin, Texas: University of Texas Press, 2012, pp. 115-154.
আকর গ্রন্থ ও নিবন্ধ
১. আশা গুপ্ত, ‘আল্হ খণ্ড’; নয়ী দিল্লী: বাণী প্রকাশন, ২০১১।
২. ললিতা প্রসাদ মিশ্র, ‘আল্হখণ্ড: তেইস মৈদান, বাওন লড়াঈ’; লখনউ: তেজকুমার প্রেস, ১৯৫২।
৩. বিশ্বনাথ শাস্ত্রী, ‘প্রতাপী আল্হা ঔর উদল’ ত্রিবেণী গ্রন্থমালা ভাগ ৩৭; বনারস সিটি: চৌধরী এন্ড সন্স, ১৯৩৭।
৪. শ্রীরাম শর্মা আচার্য অনূদিত ও সম্পাদিত, ‘ভবিষ্য পুরাণ, প্রথম খণ্ড’; বরেলী: সংস্কৃতি সংস্থান, দ্বিতীয় সংস্করণ, ১৯৭০, পৃ. ৪০৯-৫০০।
৫. শ্রীরাম শর্মা আচার্য অনূদিত ও সম্পাদিত, ‘ভবিষ্য পুরাণ, দ্বিতীয় খণ্ড’; বরেলী: সংস্কৃতি সংস্থান, দ্বিতীয় জনোপযোগী সংস্করণ, ১৯৭০, পৃ. ৯-১৫৬।
৬. নারায়ণপ্রসাদ সীতারামজী সংকলিত ও পরিবর্ধিত, ‘আল্হখণ্ড-বড়া অসলী ৫২ গঢ়কী লড়াঈ’; মুম্বই: খেমরাজ শ্রীকৃষ্ণদাস, ২০১৩।
৭. Sisir Kumar Mitra, ‘The Early Rulers of Khajurāho’; Calcutta: Firma K.L. Mukhopadhyay, 1958.
৮. William Waterfield and George Abraham Grierson, ‘The Lay of Alha’; London: Oxford University Press, 1923.