সূচী

ইতিহাস তথ্য ও তর্ক

আলাস্কার সাতরঙা ইতিহাস – পর্ব ১

আলাস্কার সাতরঙা ইতিহাস – পর্ব ১

ভাস্কর দাস

আগস্ট ৬, ২০২৩ ৬৬৮ 1

উত্তর আমেরিকার মূল শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন তার ৪৯তম রাজ্যের নাম আলাস্কা। ভূগোলের সঙ্গে সঙ্গে তার ইতিহাসও আমেরিকার থেকে একেবারে স্বতন্ত্র। বস্তুত, আমেরিকান হওয়ার আগে সে ছিল রাশিয়ার অংশ। আর তার আগে? সৃষ্টির আদি থেকে ভেসে থাকা এ স্থলভাগে প্রথম মানুষের পা পড়েছিল আনুমানিক ১৬০০০ বছর আগে। সাইবেরিয়া থেকে আসা মানুষ তখন বর্তমানে লুপ্ত বেরিং ব্রিজ পেরিয়ে এখানে এসে বসবাস শুরু করেছিল। কয়েক হাজার বছর চলেছিল তাদের কৌম জীবনের যাপন, যতদিন না রাশিয়ার পিটার দ্য গ্রেটের আকাঙ্ক্ষা তাকে এনেছিল সভ্যসমাজের দৃষ্টিসীমায়। তারপরের ইতিহাস বিচিত্র, রোমহর্ষক। তার বর্ণনা থাকবে পরবর্তী কয়েকটি আখ্যানে।  প্রচলিত পদ্ধতির বাইরে এক এক জন ব্যক্তিত্বের বিবরণীর মাধ্যমে সেই সময়ের ইতিহাসকে তুলে আনার চেষ্টা রইল এ ধারাবাহিক লেখায়। মনে মনে সেলাই করে নিয়ে আলাস্কার সামগ্রিক চেহারাটি আপনারাই নির্মাণ করবেন আপনাদের মানসে।

আলাস্কার অবস্থান নির্ণায়ক মানচিত্র

সংঘর্ষ-বিরতির পর মাতৃজঠরে এককোষী ভ্রূণ যেমন এক তরল সমুদ্রে অপেক্ষা করে অনন্ত সম্ভাবনা বুকে নিয়ে, ঠিক সেইভাবে, একশ কোটি বছর আগের পৃথিবীর সীমাহীন প্রাগৈতিহাসিক মহাসমুদ্রের বুকে আজ যেখানে উত্তরমেরু, সেইখানে জেগে উঠেছিল একখণ্ড স্থলভূমি – তারও বুকে লুকনো ছিল ভবিষ্যতের বীজ। তার শিকড় সুদৃঢ়ভাবে প্রোথিত ছিল আদিম মহাদেশীয় ‘প্লেট’-এর পৃষ্ঠতলে। প্লেটের চলাচল নিয়ন্ত্রণ করত সেই স্থলভূমির অবস্থান। তাই পরবর্তী পঞ্চাশ লক্ষ বছরে উত্তরমেরু থেকে বিষুবরেখা, এই বিস্তীর্ণ এলাকার সর্বত্র কখনো না কখনো অবস্থান করেছিল সেই স্থলভূমি। আর এই পরিক্রমার ফাঁকে যত খণ্ড খণ্ড স্থলভূমি নজরে এসেছিল তার, মাকড়শার তৎপরতায় পেটে পুরে নিয়েছিল তাদের। এই আত্মসাতের প্রক্রিয়ায় ভূমির সঙ্গে ভূমির সংঘর্ষ অধিকাংশ সময়েই ছিল বিস্ফোরক। তাতে এক খণ্ডের পিঠ ঠেলে উঠে পড়েছিল পর্বতমালা তো আর এক খণ্ডের পেটে তৈরি হয়েছিল সুবিশাল গহ্বর – তাতে জল জমে তৈরি হয়েছিল হ্রদ, বরফ জমে তৈরি হয়েছিল হিমকুন্ড। সৃষ্টি আর ধ্বংস চলেছিল পাশেপাশে। ক্রমে বয়ঃপ্রাপ্ত পৃথিবীর বালখিল্যতা যখন অনেকটা নিয়ন্ত্রিত, মহাসাগর মহাদেশের সীমানা অনেকটাই স্পষ্ট ও নির্ধারিত, তখন এই স্থলভাগ তার স্থান নির্দিষ্ট করেছিল আজকের উত্তর আমেরিকা আর এশিয়ার সাইবেরিয়ার মাঝামাঝি, খানিকটা উত্তর ঘেঁসে। আনুমানিক কুড়ি হাজার বছর আগে, পৃথিবীর শেষ বরফযুগ অন্তে উত্তরমেরু অঞ্চলের বিশাল পরিমাণ বরফগলা জলের কল্যাণে সমুদ্রের জলতল যখন প্রায় তিনশ ফুট উঠে গিয়েছিল, তখন এই ভূখণ্ডের সঙ্গে এশিয়ার যোগাযোগ প্রথমবারের জন্য ছিন্ন হয় এই দুইয়ের সংযোগকারী ভূভাগ ডুবে গিয়ে। পরের কয়েক হাজার বছরে বার বার ভেসে উঠেছে আর ডুবে গেছে এই  ভূভাগ। শেষে একসময়ে চিরকালের জন্য লুপ্ত হয়ে আমাদের মূল ভূখণ্ড উত্তর আমেরিকার উত্তর- পূর্ব কোণে জুড়ে গেছে উপাঙ্গের মত। এই স্থলভূমিই আমাদের আজকের নায়ক আলাস্কা। 

 উপাঙ্গই বটে। কারণ ভৌগোলিকভাবে একই স্থলভাগের অংশ হওয়া সত্ত্বেও উত্তর আমেরিকা, আরও নির্দিষ্টভাবে ইউনাইটেড স্টেটস অফ আমেরিকার সঙ্গে রাজনৈতিক আত্মীয়তা তৈরি হতে লেগে গেল কয়েক হাজার বছর। তার আগেই আনুমানিক খ্রিস্টপুর্বাব্দ ১৬০০০ বছর থেকে মানুষের বসবাস শুরু হয়ে গেছে। তারও অনেক অনেক আগে প্রাগৈতিহাসিক প্রাণী ম্যাসটোডন, সাইবেরিয়ার বাঘ, সিংহ, এমন কি উটের মত জীব এখানে বিচরণ করেছে ও কালের গর্ভে বিলীন হয়েছে। কুড়ি লক্ষ বছর আগে আবির্ভূত বাইসন গোত্রের প্রাণী মাস্ক অক্স আজও তার অস্তিত্ব বজায় রেখেছে। সেই আলাস্কাকে তার অংশ হিসেবে স্বীকার করে আমেরিকা তাকে তার ৪৯তম রাজ্যের মর্যাদা দিয়েছে মাত্র ১৮৬৭ সালে। তবে তার আগে আলাস্কাকে বাকী পৃথিবীর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেবার কৃতিত্ব যে দেশের তার নাম রাশিয়া। আর এই পরিচয়যজ্ঞের মূল হোতা জার সম্রাট প্রথম পিটার – ইতিহাসে যিনি ‘পিটার দ্য গ্রেট’ নামে সমধিক পরিচিত। ১৭২৪এর ডিসেম্বরে তিনি নির্দেশ দেন এক সমুদ্র-অভিযানের যাতে সাইবেরিয়ার পূর্ব-দক্ষিণ সাগরের স্থলভাগ নিরীক্ষণের কাজ করা হয় আর জানার চেষ্টা হয় সাইবেরিয়া আর আমেরিকার পশ্চিম উপকূলের মধ্যে কোন সংযোগকারী স্থলভূমি আছে কিনা। সাইবেরিয়ার দক্ষিণ-পূর্ব প্রান্তে আঙুলের মত বেড়িয়ে থাকা কামচাটকা উপদ্বীপ থেকে ভিটাস জোনাসেন বেরিং-এর নেতৃত্বে  শুরু হওয়া এই অভিযান প্রথম কামচাটকা অভিযান নামে পরিচিত।

পিটারের মৃত্যুর পর ১৭৩৩ থেকে ১৭৪১, এই সময়ে আরও বড়মাপের অভিযান চালান বেরিং ও তাঁর সঙ্গীরা। তাতে আরও অনেক বিস্তারিতভাবে জানা যায় সাইবেরিয়ার পূর্বপারের ভূগোল, আলাস্কার বিভিন্ন দ্বীপের অস্তিত্ব। অভিযানে অংশ নেওয়া প্রবাদপ্রতিম প্রকৃতিবিদ জর্জ উইলহেলম স্টেলারের যুগান্তকারী অনুসন্ধানের কল্যাণে পাওয়া যায় তার প্রাণী আর বনসম্পদের তন্নিষ্ঠ বিবরণ। পাওয়া যায় এশিয়া ও আলাস্কার মধ্যে একটা কার্যকর সমুদ্রপথের সন্ধান। বৈচিত্র্য আর বিশালতার কল্যাণে এই দ্বিতীয় কামচাটকা অভিযানকে চিহ্নিত করা হয় ‘দ্য গ্রেট নরডিক এক্সপেডিশন’ বলে। 

পিটার দ্য গ্রেট বেঁচে থাকেননি তাঁর যুগান্তকারী সিদ্ধান্তের ফলাফল দেখে যেতে। দ্বিতীয় অভিযান শেষের আগেই প্রাণ গিয়েছে অসমসাহসী অভিযাত্রী ভিটাস বেরিং-এরও। ৭৬ জন নাবিকের ৩০ জনই পথশ্রমে, শীতে আর অসুস্থতায় বিভিন্ন সময়ে প্রাণ খুইয়েছেন। তাদের প্রথমজনের নাম নিকিতা সুমাগিন। অভিযান শেষে কামচাটকার আদিবাসীদের মধ্যে নির্বাসিতের অপমানিত জীবন যাপন অন্তে এক অকিঞ্চিতকর মৃত্যুতে শেষ হয়েছে স্টেলারের গল্প। আর এই অভিযানের ফলস্বরূপ যে অভূতপূর্ব রাশিয়ান আগ্রাসনের জন্ম হয়েছিল আলাস্কার বুকে অষ্টাদশ শতাব্দীর মধ্য ভাগ থেকে উনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগ পর্যন্ত, তাতে মৃত্যু হয়েছে অসংখ্য আথাপাস্কান, অ্যালিউট, লিঙ্গিত জাতির আদিবাসী মানুষের। সূর্যসন্ধানী মহানায়ক পিটার দ্য গ্রেট, অকুতোভয় অভিযাত্রী ভিটাস জোনাসেন বেরিং, প্রথম শহীদ নাবিক নিকিতা সুমাগিন, নিবেদিতপ্রাণ বিজ্ঞানী  জর্জ উইলহেল্ম স্টেলারএবং অসংখ্য নাম না জানা সাধারণ আদিবাসী মানুষদের মনে রেখে আমার এই আলাস্কা উপাখ্যানের উপস্থাপনা।

প্রথম ও দ্বিতীয় কামচাটকা অভিযানের রেখাচিত্র

পিটার দ্য গ্রেট

৯ই জুন, ১৬৭২ – ৮ই জানুয়ারী, ১৭২৫

আমি প্রথম পিটার ওরফে পিয়োতর অ্যালেক্সিভিচ রোমানভ ওরফে পিটার দ্য গ্রেট। ৬ ফুট ৮ ইঞ্চি উচ্চতা, চওড়া ছাতি আর কঠিন দৃষ্টির এই মানুষটাকে রাশিয়ার লোকে ভয় করে। ভক্তিও করে এইজন্য যে এই মানুষটারই হাত ধরে মাত্র ২৫ বছরের মধ্যে এই দেশটা তার মধ্যযুগীয় বর্বরতার দিনগুলো অতিক্রম করে রেনেসাঁর ছোঁয়া পাওয়া ইউরোপীয় সভ্যতার সমকক্ষ হয়ে উঠেছে।  

১৬৭২-এ জন্মের পর মাত্র ১০টি বছরের শৈশব আমার জন্য বরাদ্দ করেছিলেন ঈশ্বর। যদিও মাত্র ৪ বছর বয়সেই আমার স্বাস্থ্য আর প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব দেখে আমাদের পরিবারবন্ধু আর উপদেষ্টা আর্তামন মাতিইয়েভ মনে মনে আমাকে পরবর্তী ‘জার’ বলে চিহ্নিত করে রাখেন। ওই ১০ বছর বয়সেই যৌথভাবে আমার তুতো-ভাই ইভানের সঙ্গে জারের আসনে আমার অভিষেক ঘটল। কিন্তু কি দেখলাম? এই সিদ্ধান্তে দেশে ছোটখাটো বিদ্রোহের সৃষ্টি হল যার আঁচ এসে লাগল রাজপরিবারের গায়ে। চোখের সামনে আমার এক কাকাকে কিছু লোক টানতে টানতে প্রাসাদের বাইরে নিয়ে গিয়ে হত্যা করল। আর পরিবারবন্ধু আর্তামন যখন আর একদল উন্মত্ত মানুষের হাতে বন্দী, ছিঁড়ে নেওয়া হচ্ছে তার জামাকাপড়, চামড়া, মাংস, হাড় তখন আতঙ্কের চরম অভিব্যক্তিকে আমি যেন স্পর্শ করলাম। মৃত্যুর আগে আর্তামনের আর্তদৃষ্টি, মৃত্যুর পরে ওদের রক্তাক্ত ক্ষতবিক্ষত দেহ আমাকে পালাতে বলল দূরে কোথাও। চলে গেলাম মস্কোভা ছেড়ে দূর গ্রামে। শুরু হল আমার অ-রাজকীয় জীবন যাপন, সঙ্গী শুধু আমার মা। 

সেই নির্বাসনে কিন্তু শিক্ষার আয়োজনে কোন ত্রুটি রাখেননি আমার মা। গির্জার প্রাক্তন করণিক, পরবর্তীকালে সরকারি আমলা নিকিতা জোটভের হাতে ১৬৭৭এর ১২ই মার্চ ‘হাতেখড়ি’ হল আমার। এরপর কিন্তু প্রচলিত পদ্ধতির বিরুদ্ধে চলতে থাকল আমার শিক্ষা। অক্ষর পরিচয় আর অঙ্ক শেখার পাশেপাশে সমান গুরুত্ব পেল রাশিয়ার ইতিহাসের অধ্যয়ন বা আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহার শিক্ষা। রাজপরিবারের সদস্যের পক্ষে বেমানান কামারের কাজ, ছুতোরমিস্ত্রীর কাজ বা ম্যাপ ও গ্লোবের ব্যবহার শিক্ষাও আমার পাঠক্রমের অন্তর্ভুক্ত করতে হল আর এর জন্য নিয়োগ করতে হল প্যাট্রিক গর্ডন বা পল মেনেসিসের মত বিদেশী শিক্ষকদের। আর এনাদের কাছে পাওয়া জাহাজ তৈরি ও চালানোর শিক্ষা তো আমার নেশায় পরিণত হল। 

ইভান শারীরিক ও মানসিকভাবে অসুস্থ। আর আমি ব্যস্ত আমার নেশার জগতে – জাহাজ বানানো আর চালানো। বকলমে দেশ চালাতে লাগল সৎদিদি সোফিয়া। শেষে ১৬৮৯ এর বিদ্রোহ – সোফিয়া পদচ্যুত ও কনভেন্টে নির্বাসিত। এর ৭ বছর পর ইভানের মৃত্যু আর আমি এককভাবে সিংহাসনে অধিষ্ঠিত – সেটা ১৬৯৬ সাল।

ছেলেবেলার ব্যতিক্রমী শিক্ষার কথা তো আগেই বলেছি। ১৬৯৪ তে সাক্ষাত হল ডাচ পণ্ডিত ফ্রাঞ্জ টিমেরমানের সঙ্গে। তিনি আমাকে দিলেন জ্যোতির্বিদ্যা, জ্যামিতি আর দুর্গ তৈরি ও রক্ষার প্রাথমিক পাঠ। ৯৬-তে জারের প্রাথমিক কাজ শেষ করে ৯৭-তে পাড়ি দিলাম ইউরোপের বিভিন্ন দেশে। এরপরের দেড় বছর সময় যে মানুষটা একদেশ থেকে আর এক দেশে ঘুরে বেড়াল তার নাম পিয়তোর মিখাইলভ। আমস্টারডাম আর জানদামে শিখলাম জাহাজ তৈরির অত্যাধুনিক কৌশল, কেনিসবার্গে শিখলাম বন্দুক আর কামান চালানো। ম্যানচেস্টারে জানলাম নগর পরিকল্পনা ও স্থাপত্য, লেডেনে পড়লাম মানবশরীরবিদ্যা। এমন কি প্রজাপতি ধরার কৌশল ও তার বিজ্ঞানসম্মত সংরক্ষণের পদ্ধতিও শিখলাম ডাচ উদ্ভিদবিজ্ঞানী ফ্রেডেরিক রুইস-এর তত্ত্বাবধানে। আর এও জানলাম যে কিসের অভাবে রাশিয়া আজও ইউরোপের কাছে অভিজাত সমাজের সভ্য হিসেবে অপাঙতেও। প্রতিজ্ঞা করলাম রাশিয়াকে পালটাবার।

১৭০০ সাল থেকে শুরু করলাম পরিবর্তন। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে তৈরি হল স্কুল অফ সায়েন্স, স্কুল অফ ম্যাথেমাটিক্স, নাভাল অ্যাকাডেমি, অসংখ্য ইস্কুল ও কলেজ। এতদিন শিক্ষার নিয়ন্ত্রণ ছিল যে চার্চের হাতে, তার অধিকার চূড়ান্তভাবে খর্ব করলাম। কারণ পুরনোপন্থী চার্চ, যাদের অনুশাসনের ভিত্তিভূমি ছিল মধ্যযুগীয় মূল্যবোধ, শিক্ষার ভিত্তিকে যারা বিজ্ঞানের পরিবর্তে ধর্মের বেদীতে প্রতিষ্ঠিত করেছিল, তাদের হাতে শিক্ষার নামে চলেছিল অজ্ঞানের আরাধনা। রাশিয়াকে বাকী পৃথিবীর থেকে এক শতাব্দী পেছনে ফেলে রাখতে তাদের ভূমিকাই ছিল প্রধান। 

 শাসনকাজ চালানোর জন্য ইংরেজ পার্লামেন্টের আদলে তৈরি করলাম ‘সেনেট’। সদ্যস্যদের বাধ্য করলাম আলোচনার ভিত্তিতে সহমত হয়ে সিদ্ধান্ত নেবার পদ্ধতিতে অভ্যস্ত হতে। সভাকক্ষে শৃঙ্খলার বাতাবরণ তৈরির অভিপ্রায়ে সভাসদদের পোষাকবিধিও চালু করলাম। প্রথাগত রাশিয়ান দাড়ি আমার চোখের বিষ। নির্দেশ দিলাম দাড়ি কেটে ফেলার। আর তা সত্ত্বেও যারা দাড়িরাখতে মনস্থ করলেন তাদের জন্য আদেশ দিলাম ‘বিয়ার্ড ট্যাক্স’-এর। নির্দিষ্ট কর ব্যবস্থার পত্তন করে তা থেকে আহরিত সম্পদে আধুনিক করলাম রাশিয়ার সেনাবাহিনী। তৈরি করলাম রাশিয়ার প্রথম নৌবাহিনী – সুইডেনের সঙ্গে ২১ বছর ব্যাপী ‘গ্রেট নরদার্ন ওয়ার’ আর তুরস্কের সঙ্গে যুদ্ধে যাদের পরাক্রম সমীহ আদায় করল সারা বিশ্বের। চালু হল গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার, প্রকাশিত হল রাশিয়ার প্রথম সংবাদপত্র ‘ভেদোমস্তে’। রাশিয়ার রাজধানী ততদিনে মস্কোভা থেকে সরে গিয়ে নতুনভাবে তৈরি হয়েছে অন্য এক শহরে – দেশের মানুষ আমাকে ভালোবেসে যার নাম দিয়েছে সেন্ট পিটার্সবার্গ। 

দাড়ির ট্যাক্স টোকেন

১৭২৫-এর ৮ই ফেব্রুয়ারি ইউরিমিয়ায় আক্রান্ত হয়ে আমি যখন মৃত্যুশয্যায়, তখন আমি এক তৃপ্ত পুরুষ যার হাত ধরে রাশিয়া মধ্যযুগের অন্ধগলি পেরিয়ে ইউরোপীয় রেনেসাঁর সূর্যসন্ধানী। সেদিন ঠিক মৃত্যুর আগে বহু আত্মীয় পরিবৃত আমি আমার উত্তরসূরি নির্ধারণের সিদ্ধান্ত জানিয়ে যেতে পারিনি। শুধু দুটি শব্দ উচ্চারণ করে  বলে  যেতে  পেরেছিলাম ‘Give everything….’। তাতে  রাশিয়ার  ভবিষ্যৎ  নির্ধারণে  কোন ইতরবিশেষ হয়েছিল কিনা জানিনা। তবে তার কয়েকদিন আগে ২৯শে ডিসেম্বর ১৭২৪ এ একটা সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছিলাম যা পৃথিবীর ভবিষ্যৎ গতিপথের নির্ধারক হয়ে উঠেছিল। সেদিন নৌবাহিনীর বিশ্বস্ত কমান্ডার ভিটাস জোনাসেন বেরিং-কে নেতা নির্দিষ্ট করে এক অভিযানের নির্দেশ দিয়েছিলাম। সাইবেরিয়ার পূর্বপ্রান্তের উপদ্বীপ কামচাটকা থেকে শুরু হয়ে এই অভিযান ৫০ দিন ধরে সমুদ্রের বুকে সন্ধান করে ফিরেছিল নতুন দেশের। আরও পরে এরই দ্বিতীয়পর্ব হিসেবে স্বীকৃত দ্বিতীয় কামচাটকা অভিযানের ফলশ্রুতিতে মিলেছিল এক বিস্তীর্ণ স্থলভূমি যা ভবিষ্যতে পরিচিত হবে আলাস্কা নামে।

সেই আলাস্কা – যা আজ আমেরিকার ৪৯তম রাজ্য।  

ভিটাস জোনাসেন বেরিং

৫ই অগাস্ট ১৬৮১ – ৮ই ডিসেম্বর ১৭৪১  

অধিনায়কের মুকুটে গোলাপ তো কিছু থাকে, কাঁটা থাকে তার চেয়েও কিছু বেশী। তার ওপর প্রথম অধিনায়কত্বের ফলাফল যদি অনির্ধারিত হয়, তবে দ্বিতীয়বারের ভার আরও বেশী করে ঠেকে। আমার চেয়ে ভাল সেটা কেউ বুঝবে না।

১৭২৪-এর ডিসেম্বরে পিটার দ্য গ্রেট যখন আমার হাতে প্রথম কামচাটকা অভিযানের নেতৃত্ব দিলেন তখন আমি কিছু পরীক্ষিত নৌবিশারদ নই। তবুও আমারই ওপর দায়িত্ব পড়ল রাশিয়ার পূর্বপারে অভিযান চালিয়ে দেখার যে এশিয়া আর আমেরিকার মধ্যে কোন সংযোগকারী স্থলভূমি আছে কিনা। এছাড়া ইউরোপীওদের অধীনে কোন স্থলভাগ থাকলে তার বিস্তারিত বিবরণ সংগ্রহও আমার কাজ বলে জানানো হল। 

মানুষ, রসদ আর অভিযানের উপকরণসহ রাশিয়ার পশ্চিমপারে সেন্ট পিটার্সবার্গ থেকে পূর্বপারে কামচাটকায় আসতে অতিক্রম করতে হল ৪০০০ মাইল পথ। লেগে গেল ২ বছর সময়। অবশেষে কামচাটকায় পৌঁছে নতুন জাহাজ তৈরি হল। জারসম্রাট পিটারের নিজের হাতে তৈরি প্রথম জাহাজের স্মরণে নাম দেওয়া হল ‘আরকাঞ্জেল গ্যাব্রিয়েল’। অভিযান শুরু হল ১৪ই জুলাই ১৭২৮-এ। ৫০ দিনের এই অভিযানে সাইবেরিয়ার উত্তরপূর্ব সমুদ্র অঞ্চলের বিস্তারিত মানচিত্র তৈরি করা গেল। পাওয়া গেল এশিয়ার পূর্বসীমান্তের শেষ স্থলভূমির সন্ধান – দেখা গেল তা একটি দ্বীপ। নাম দিলাম সেন্ট লরেন্স আইল্যান্ড। তাকে অতিক্রম করে আরও ৪ দিন ক্রমাগত জাহাজ চালিয়ে নিশ্চিত হওয়া গেল যে আর কোন স্থলভূমি নেই যা এশিয়া আর আমেরিকার সেতুবন্ধনের কাজ করতে পারে। এই বিশ্বাস আর মানচিত্র নিয়ে কামচাটকায় ফিরলাম সেপ্টেম্বরের ২ তারিখ। এবার আবার  উল্টোপথে যাত্রা করে এই ফলাফল যেদিন সেন্ট পিটার্সবার্গের রাজদরবারে পেশ হল সেদিন কেটে গেছে আরও দেড় বছর সময়। দিনটা ২৮শে ফেব্রুয়ারী, ১৭৩০। খুশী হল সেনেট। আমার ইনাম মিলল ১০০০ রুবল আর ক্যাপ্টেন কমান্ডার খেতাব। পদোন্নতি হল আমার দুই সহকারি স্প্যানবার্গ আর চিরিকভেরও। 

অনেকে প্রশ্ন তুলল আমরা যথেষ্ট পূর্বদিকে গিয়েছিলাম কিনা। আর যেহেতু আমেরিকার পশ্চিমপারের কোন স্থলভূমি স্পর্শ করিনি, তাই আমেরিকার সঙ্গে আর কোন স্থলভাগের মাধ্যমে এশিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ আছে কিনা তা আমাদের অভিযান সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ বা অপ্রমাণ কোনটাই করতে পারে না বলে প্রচার করা হল। সিদ্ধান্তহীনতায় আক্রান্ত হল অভিযানের ফলাফল। মুকুটে কাঁটার খোঁচাটা টের পেলাম বেশ। প্রাথমিক উচ্ছ্বাসপর্ব শেষে রাশিয়ান রাজন্যবর্গও এই দোলাচলে আক্রান্ত। তারাও চাইলেন এমন আর এক অভিযান যাতে আরও বিস্তারিত অনুসন্ধান আর প্রমাণ সংগ্রহের কাজ করা যাবে – ফলাফল হবে সুনির্দিষ্ট। সাম্রাজ্যবিস্তারের সুপ্ত বাসনাও হয়ত তাতে ইন্ধন জুগিয়েছিল। অভিযানের খুঁটিনাটি সম্পর্কে যেহেতু আমি অবগত, তাই আমাকেই নিযুক্ত করা হল নেতার আসনে। ততদিনে আমিও উজ্জীবিত নিজেকে প্রমাণ করতে। স্থির হল অভিযানের উদ্দেশ্য হবে সাইবেরিয়ার পূর্বদিকে আমেরিকার উপকূল পর্যন্ত পর্যাপ্ত অনুসন্ধান চালিয়ে সেখানকার স্থলভাগের মানচিত্র তৈরি করা, সেখানকার দ্বীপপুঞ্জের পশুপাখি, গাছগাছালি, প্রকৃতি ও অধিবাসী (যদি দেখা মেলে)র ইতিহাস, ভূগোল ও নৃতত্বের বিবরণ লিপিবদ্ধ করা, আর আমেরিকার পশ্চিমপারে নেমে তার সঙ্গে প্রাথমিক পরিচয়টুকু সেরে ফেলা। সেই সময়ের নিরিখে এত বড় অভিযান আর কখনো হয়নি। শুরুর সময়ে বরাদ্দ হল ৩০০০ মানুষ আর ১৫ লক্ষ রুবল – যা সেই সময়ের রাশিয়ার এক বছরের রাজস্বের ৬ ভাগের ১ ভাগ। সহযোগী হিসেবে পেলাম পুরনো সঙ্গী অ্যালেক্সি চিরিকভকে। তফাতের মধ্যে আমরা দুজন স্বাধীনভাবে যাব দুটো আলাদা জাহাজ নিয়ে। আর প্রত্যক্ষ সহকারি হিসেবে পেলাম স্ভেন ওয়াক্সেল আর খিতরভ নামে দুই সুযোগ্য নৌবিদকে। 

পরিকল্পনা, উপকরণ সংগ্রহ, লোকলস্কর বাছাই ও নিয়োগে কেটে গেল আড়াই বছরের বেশী সময়। শেষে ১৭৩৩-এ সেন্ট পিটার্সবার্গ থেকে যাত্রা শুরু করলাম সাইবেরিয়ার পূর্বউপকূলের দিকে। দুর্গম রাস্তা, ৪০০০ মাইলের বিশাল বিস্তার, তীব্র শীত, তুষারপাত আর অসুস্থতাকে অতিক্রম করে, বেশ কিছু মানুষকে হারিয়ে যখন গন্তব্যে পৌঁছলাম তখন কেটে গেছে ৫টি বছর। জ্যোতির্বিদ লুই দেলাই’ল দ্য লা ক্রোয়া, ইতিহাসবিদ গেরহার্ড ম্যুলার, রসায়নবিদ ও ‘ন্যাচুরালিস্ট’ জর্জ মেলিন – যাঁরা এই অভিযানে যোগ দিয়েছিলেন বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধানের

দায়িত্ব নিয়ে তাঁরা সকলেই অসুস্থতার অজুহাতে পালিয়ে বাঁচলেন। পরিবর্তে পেলাম আর এক জনকে। চালচুলোহীন, খর্বকায়, কিছুটা যেন অপ্রকৃতিস্থ এক যুবক – নাম জর্জ উইলহেলম স্টেলার। নিজের উদ্যোগে কুকুরে টানা স্লেডগাড়িতে একা এতটা রাস্তা পাড়ি দিয়ে এক বছর সময় ব্যয় করে যে মানুষটা এসে পৌঁছয়, তার অভিযানে সামিল হওয়ার সদিচ্ছা নিয়ে তো প্রশ্ন করা যায় না। তার ওপর পকেটে বিখ্যাত পাদ্রী থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের নামজাদা অধ্যপকের শংসাপত্র। শিক্ষাগত যোগ্যতায় প্রকৃতিবিদ, প্রাণীতত্ত্ববিশারদ, উদ্ভিদবিদ ও চিকিৎসক। এমন মানুষের উপস্থিতি অভিযানে অন্য মাত্রা যোগ করবে বলে আমার বিশ্বাস হয়েছিল। এই অভিযানে স্টেলারের পর্যবেক্ষণ এমন মাত্রায় পৌঁছেছিল যে তার লিপিবদ্ধ বিবরণকে শতাব্দীর অন্যতম সেরা কাজ বলে অভিহিত করেছিলেন পণ্ডিতেরা। আর এই বৈচিত্র্য আর বিশালতার দৌলতে এই অভিযানের নাম হয়েছিল ‘দ্য গ্রেট নরডিক এক্সপেডিসন’। 

১৭৩৮-এ পেত্রপোভলস্ক বন্দরে শুরু হল সমুদ্র অভিযানের উপযোগী দুটো জাহাজ তৈরির কাজ। অসংখ্য কারিগরের অক্লান্ত পরিশ্রমে ৩ বছরে তৈরি হল ৯০ ফুট দীর্ঘ, সাড়ে ২৩ ফুট চওড়া দুটি বিশালাকৃতি জাহাজ – ‘সেন্ট পল’ আর ‘সেন্ট পিটার’। প্রথমটির দায়িত্বে চিরিকভ, দ্বিতীয়টির আমি। শেষে ৪ঠা জুন, ১৭৪১ শুরু হল আমাদের দ্বিতীয় কামচাটকা অভিযান।

সেন্ট পিটার ও সেন্ট পল

২০শে জুন অব্দি একসঙ্গে চলার পর হঠাৎ গাঢ় কুয়াশায় সেন্ট পল বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল আমাদের থেকে। ৬ দিন খুঁজলাম, কিন্তু সন্ধান পেলাম না সেন্ট পলের। শেষে বিফল মনোরথ হয়ে যাত্রা করলাম নিজের রাস্তায়। মনটা কেমন যেন ‘কু’ গাইল।

২০শে জুলাই – পৌঁছেছি কায়াক দ্বীপপুঞ্জে। পাথুরে সমুদ্রতলে বহুকষ্টে নোঙর ফেলা গেছে। জাহাজে মজুদ দুটো নৌকোর বড়টিকে পাঠানো হয়েছে দ্বীপের ভেতরে মিষ্টি জল সংগ্রহের কাজে। কারণ জাহাজে ইতিমধ্যে পানীয় জলের টানাটানি দেখা দিয়েছে। তাছাড়াও নাবিকদের মধ্যে স্কার্ভি রোগের লক্ষণ প্রকাশ পেতে শুরু করেছে। এর চিকিৎসা অজানা হলেও প্রচলিত বিশ্বাস যে সদ্যসংগৃহীত মিষ্টি জল একে প্রতিহত করতে সাহায্য করে। আর ছোট নৌকোটি করে গেছে খিতরভ আর স্টেলার। উদ্দেশ্য এখানকার গাছপালা ও পশুপাখির সন্ধান ও নিরীক্ষণ। উপরি হিসেবে পাওয়া গেছে মানুষের বসবাসের চিহ্ন – একটা উনুন, কিছু পরিত্যক্ত খাবার, ঝলসানো মাংস। জাহাজবাসীরা উত্তেজিত। যদিও কোন মানুষের সঙ্গে সরাসরি সাক্ষাৎ হয়নি।

২১শে জুলাই – খিতরভ ও স্টেলার আবার গেছে এবং আবিষ্কার করেছে মাটির তলায় বসবাস করার মত কুঁড়েঘর, কাঠের সিন্দুকের মত জায়গা যেখানে মজুদ করা আছে প্রচুর শুকনো মাছ। কিন্তু কোন মানুষ দেখা যায়নি। খিতরভের সাথে বন্ধুত্বের নিশান হিসেবে পাঠানো হয়েছিল সাড়ে ১৬ আরসিন (১ আরসিন=২৮ ইঞ্চি) সবুজ কাপড়, ২টো লোহার ছুরি, ২০টা চীনা পুঁতি, ২টো তামাক সেবনের পাইপ। উপহার কারও হাতে দেওয়া না গেলেও রেখে আসা হয়েছে কুঁড়েঘরের পাশে।

এরপর উপকূল সমুদ্রের ওপর দিয়ে দীর্ঘ যাত্রা শেষে আজ ৫ই অগাস্ট আমরা পৌঁছেছি সেমিডি দ্বীপপুঞ্জে। কিন্তু এই সময়ের মধ্যে ঝড়-বৃষ্টি, ঘন কুয়াশা আর নাবিকদের মধ্যে স্কার্ভির প্রাদুর্ভাব আমাকে অভিযানের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে ভীত করে তুলেছে। আমার একটা সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করছে এতগুলো প্রাণ। স্থির করেছি ফিরে যাব কামচাটকার দিকে।

২৭শে অগাস্ট – মিষ্টি জলের সন্ধানে আবার স্থলভূমিতে নামার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। স্কার্ভি আক্রান্ত নাবিকদের সংখ্যা ক্রমবর্ধমান। উপসর্গ বলছে আমিও সম্ভবত আক্রান্ত।

৩০শে অগাস্ট – আনুমানিক দেড় মাইল দূরে এক দ্বীপে আগুনের আভাস দেখতে পাওয়া গেছে। কিন্তু পাথুরে সমুদ্রতলের কল্যাণে এখানে নোঙর ফেলা অসম্ভব বলেই মনে হচ্ছে।

৩১শে অগাস্ট – নোঙর ফেলা গেছে। বড় নৌকোয় লোক পাঠানো হয়েছে জল সংগ্রহ করতে। আর অসুস্থদের নামানো হচ্ছে দ্বীপে বিশ্রাম নেবার আর জল খাওয়ানোর জন্য ( যাতে জাহাজে সংরক্ষিত জলে টান না পড়ে )। আমাদের দুর্ভাগ্য নিকিতা সুমাগিন নামে এক স্কার্ভি আক্রান্ত নাবিক পারে গিয়েই মারা গেল। আমরা তাকে এই দ্বীপের মাটিতেই কবর দিলাম। তার সম্মানে এই দ্বীপের নাম দিলাম সুমাগিন আইল্যান্ড। ছোট নৌকোয় খিতরভকে আবার পাঠানো হল আধ পাউন্ড চীনা তামাক, ৫টি তামার ঘণ্টা, ১৬০টি পুঁতি, ২০টি ছুঁচ, ২ আরসিন লাল কাপড়, ৫টি আয়না আর ৫টি ছুরি দিয়ে। ৬ জন সঙ্গীসহ খিতরভ গেল কিন্তু আটকে পড়ল দ্বীপে। জোয়ারের জেরে ফুলে ওঠা সমুদ্রের বড় বড় ঢেউ ছোট নৌকোর চলাচল অসম্ভব করে তুলল।

৩রা সেপ্টেম্বর – দুদিন অপেক্ষার পর বড় নৌকো পাঠিয়ে খিতরভ আর তার সঙ্গীদের উদ্ধার করা হল। যদিও ছোট নৌকাটিকে আমরা হারালাম।

৫ই সেপ্টেম্বর – দুটি বাইদারকা ( ছোট চামড়ার নৌকো – একটিতে ১জনই বসে আর চালায় ) করে দুজন মানুষ আমাদের জাহাজের কাছাকাছি এল। এরা আদিবাসী সম্প্রদায়ের। আমাদের জাহাজের দুজন চুকচি ও কোডিয়াক দোভাষী তাদের সম্ভাষণ করল সেই ভাষায়, কিন্তু তারা উত্তর না দিয়ে চলল দ্বীপের দিকে। নৌকো নামিয়ে দ্বীপের দিকে গেলাম তাদের পেছন পেছন, কিন্তু দ্বীপে ঢুকে তারা অদৃশ্য হয়ে গেল। এই দ্বীপ অঞ্চলের আদিবাসীদের সঙ্গে সেই আমাদের প্রথম সাক্ষাৎ।   

৬ই সেপ্টেম্বর – একইভাবে দেখা হল ৭টি নৌকোতে করে আসা ৭ জন আদিবাসীর সঙ্গে। তাদের একজন এবার আমাদের জাহাজে উঠে এল, গ্রহণ করল কিছু উপহার। কিন্তু কোন বাক্যালাপ সম্ভব হল না। সে ফিরে গেল নিজের নৌকোয় আর তারপর ত্বরিৎ গতিতে অদৃশ্য হল দ্বীপের ভেতরে।

আমরা ফিরতে লাগলাম কামচাটকার পথে। কিন্তু উত্তরোত্তর বাড়তে লাগল ঠাণ্ডা, কুয়াশা, বৃষ্টি ও সামুদ্রিক ঝড়। বাড়তে লাগল অসুস্থতা। দিন গড়াল সপ্তাহে, সপ্তাহ পাল্টে গেল মাসে – আমাদের অনন্তযাত্রা চলতেই থাকলো উপর্যুপরি ক্ষতি স্বীকার করে। জাহাজের ওপরের পাল ঝড়ে উড়ে গেছে। শুধুমাত্র নীচের পালের

ভরসায় চলছে জাহাজ। মাস্তুলও ক্ষতিগ্রস্ত। নাবিকরাও কমবেশি অসুস্থ, ক্লান্ত ও কিছুটা যেন হতচকিত। অক্টোবর কাটল একইভাবে চূড়ান্ত কষ্ট আর উদ্বেগে। অবশেষে সেই অভিশপ্ত দিন।

৪ঠা নভেম্বর – কয়েকদিন থেকেই আমি বেশ অসুস্থ ও কেবিনে বন্দী। ওয়াক্সেল আর খিতরভেরও অবস্থা তথৈবচ। প্রচুর নাবিকও অসুস্থ। দুজন ইতিমধ্যেই মৃত যাদের মৃতদেহ বিনা সৎকারেই সমুদ্রে ছুঁড়ে ফেলে দিতে বাধ্য হয়েছি। বিশেষ কারও নিয়ন্ত্রণ ছাড়া ছেঁড়া পাল ভাঙ্গা মাস্তুলে ভর করেই জাহাজ চলেছে নিজের তালে। আজ আকাশ ভাসিয়ে চাঁদের আলো – আজ বুঝি পূর্ণিমা। আর সেই ভরা পূর্ণিমায় হঠাৎ ওঠা ভরা জোয়ারের বিশাল ঢেউ আমাদের জাহাজকে টেনে নিয়ে আছড়ে ফেলল পাশের এক দ্বীপের পাথুরে বালুকাবেলায়। শুনতে পেলাম একে একে কেবিনের দরজা, ডেকের পাটাতন, মাস্তুলের কাঠ ভেঙ্গে পড়ার শব্দ; পালের কাপড়, দড়ি ছেঁড়ার আওয়াজ। আতঙ্কিত মনুষ্যকণ্ঠের চিৎকার আর তার মধ্যেই ঈশ্বরের করুণার চিৎকৃত প্রার্থনা ক্ষণেকের জন্য অবশ করল আমার চেতনা। তারপর সব চুপচাপ। অপার্থিব জ্যোৎস্নায় উত্তাল ঢেউয়ের মাথা ধবধবে সাদা ফেনায় ধুয়ে যাচ্ছে। দ্বীপের পাথর জড়িয়ে ধরে আছে কাত হয়ে পড়ে থাকা জাহাজের ধ্বংসাবশেষ। ঘটনার আকস্মিকতায়, ভয়াবহ ভবিষ্যৎ কল্পনায় জাহাজের সব মানুষ প্রস্তরমূর্তিবৎ। সৌভাগ্য যে কোন জীবনহানি হয়নি। 

বেরিং-এর জাহাজডুবি – শিল্পীর তুলিতে

এর পরের ঘটনা এক চূড়ান্ত জীবনসংগ্রামের জয় পরাজয়ের গল্প। অসুস্থ আমাকে এরা নামিয়ে নিয়ে আসে দ্বীপে। নেতৃত্বের দায়িত্ব হাতে তুলে নেয় ওয়াক্সেল। স্টেলারের পরিকল্পনায় মাটির নীচে ৫টা থাকার জায়গা তৈরি হয় সকলে মিলে ভাগাভাগি করে থাকার জন্য। সেই ঘরে অসহায় আমি শুয়ে শুয়ে দেখলাম এদের জাহাজে থাকা খাবার আস্তে আস্তে ফুরিয়ে গেল। ক্রমশ প্রতিদিন সমুদ্রতীরে পাওয়া ভোঁদড় আর সিন্ধুঘোটক হয়ে উঠলো একমাত্র খাদ্য। একে একে আমার আরও ১২ জন বিশ্বস্ত অনুচর স্কার্ভি, শীত আর চূড়ান্ত পরিশ্রমের পরিণতিতে দেহ রাখল। সমুদ্রতীরে বালির ওপর তৈরি করা ছাউনি দেওয়া গর্ত, যেখানে এরা আমাকে এনে শুইয়ে রেখেছে আমার শরীর গরম রাখতে – তাতে শুয়ে শুয়ে দেখতে থাকলাম এদের যন্ত্রণা। হা ঈশ্বর ! আমার কথায় নির্ভর করে এরা তাদের ভূতভবিষ্যৎ সমর্পণ করেছিল যার হাতে, সেই আমার আর কোন ক্ষমতাই নেই এদের সামান্যতম সাহায্য করার। আমার বেঁচে থাকার সার্থকতা কি ? দয়া কর হে পরমেশ্বর – আমাকে নাও। ঈশ্বর শুনেছিলেন বেরিং-এর প্রার্থনা। Peter Lauridsen তাঁর বই Vitas Bering : The Discoverer of Bering Strait এ লিখছেন – From hunger, cold and grief he slowly pined away. He was so to speak, buried alive. The sand kept continually rolling down upon him from the sides of the pit and covered his feet. At first this was removed, but finally he asked that it might remain, as it furnished him with a little warmth he so sorely needed. Soon half his body was under the sand, so that after his death, his comrades had to exhume him to give him a decent burial. He died on the 8th of December, 1741, two hours before daybreak.

এর পরের ইতিহাস সংক্ষিপ্ত কিন্তু রোমহর্ষক। বেরিং-এর অনুপস্থিতিতে, ওয়াক্সেলের নেতৃত্বে চলল বেঁচে থাকার সংগ্রাম। ভোঁদড়ের মাংসে ক্ষুন্নিবৃত্তি, ভোঁদড়ের ছালে শীতনিবারণের পাশাপাশি চেষ্টা চলল সেন্ট পিটারের ধ্বংসাবশেষ থেকে একটা ছোট জাহাজ তৈরি করার। ৭ মাসের চেষ্টায় ৪০ ফুট দীর্ঘ এক জাহাজ তৈরি হল। ততদিনে দেহ রেখেছে আর ২৮জন নাবিক। এরই ফাঁকে স্টেলার তার বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধানের কাজ চালিয়ে গেছেন, যার লিপিবদ্ধ বিবরণ শতাব্দীর অন্যতম সেরা নথি বলে একসময় স্বীকৃত হবে। অবশেষে ১৬ই অগাস্ট, ১৭৪২ তাদের এতদিনের নির্বাসন শেষে সেই ছোট্ট জাহাজে ৪৬ জন সঙ্গীসহ পাড়ি দিলেন ওয়াক্সেল। ১০ দিনের নিরবচ্ছিন্ন যাত্রা ২৬শে অগাস্ট তাদের পৌঁছে দিল আভাচা সাগরমুখে কামচাটকায়। সঙ্গী তাদের প্রায় ৯০০ সমুদ্রভোঁদড়ের ছাল, সাইবেরিয়ার পূর্ব-দক্ষিণ সাগর, উপসাগর আর দ্বীপপুঞ্জের বিস্তারিত মানচিত্র, স্টেলারের যুগান্তকারী দলিল আর বেরিং-এর অমলিন স্মৃতি।

ভাবীকাল যাকে বেরিং আইল্যান্ড নামে চিনবে, সেই দ্বীপের মাটি মায়ের মমতায় গ্রহণ করেছিল ক্লান্ত অবসন্ন অভিযাত্রী বেরিং-এর নশ্বর দেহাবশেষ। আমরা নিশ্চিত, এই ভূমিখণ্ড, যা হবে আলাস্কার অংশ, তার আশ্রয়ে বেরিং অবশেষে খুঁজে পেয়েছিলেন তাঁর প্রাণের শান্তি, মনের আরাম।  

সেই আলাস্কা – যা আজ আমেরিকার ৪৯তম রাজ্য।

সংক্ষিপ্ত টীকাঃ

১. লুই দেলাই’ল দ্য  লা ক্রোয়া – জন্ম ১৬৮৫,প্যারিসে। জ্যোতির্বিদ ও মানচিত্রকর হিসেবে পিটার্সবার্গের ইম্পিরিয়াল একাডেমী অফ সায়েন্সে অধ্যাপক পদে নিয়োগ। দ্বিতীয় কামচাটকা অভিযানে ১৭৩৩এ যুক্ত হয়ে ১৭৩৭ অব্দি কাজ। শেষে স্কার্ভিতে মৃত্যু অক্টোবর ১৭৪১। মূল অভিযানে যোগদান করতে পারেন নি।

২. গেরহার্ড ফ্রেডেরিক ম্যুলার – রাশিয়ান ঐতিহাসিক। ১৭০৫ তে জন্ম।  ইম্পিরিয়াল একাডেমী অফ সায়েন্সের প্রতিষ্ঠাতা সদস্যদের একজন। ১৭৩৩ থেকে ১৭৪৩, এই সময়ে সাইবেরিয়ার মানুষ, প্রকৃতি ও সংস্কৃতির ওপর বিস্তারিত তথ্যসংগ্রহ ও গবেষণায়  পথিকৃৎ। মৃত্যু ১৭৬১।

৩. যোহান জর্জ মেলিন – জার্মান এই ”ন্যাচুরালিস্ট’-এর জন্ম ১৭০৯ সালে। ১৮ বছর বয়সেই ডাক্তারির ডিগ্রি লাভ। ১৭৩৩এ দ্বিতীয় কামচাটকা অভিযানে অংশগ্রহণ ও ১৭৩৭ অব্দি তার সঙ্গী হয়ে কাজ। পরে অভিযান

থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে প্রকৃতি ও উদ্ভিদবিদ্যার গবেষণায় যুগান্তকারি অবদান।

৪. বাইদারকা – অ্যালুসিয়ান দ্বীপপুঞ্জের আদিবাসীরা তাদের যাতায়াত ও শিকারের জন্য যে বিশেষ নৌকা ব্যবহার করত। বৃক্ষহীন এই দ্বীপে সমুদ্রের জলে ভেসে আসা টুকরো কাঠ ( drift wood ) দিয়ে এর কাঠামো তৈরি করে তাকে সীলমাছের চামড়া দিয়ে মুড়ে তৈরি হত এই নৌকা। সেলাইয়ের দায়িত্ব থাকত মেয়েদের, কিন্তু সম্পূর্ণ হয়ে গেলে তাকে ছোঁয়ার অধিকার থাকত না। কারণ অ্যালিউটরা একে জীবন্ত পুরুষ বলে বিশ্বাস করত।

৫,৬. চুকচি, কোডিয়াক – রাশিয়ার সাইবেরিয়া অঞ্চলে যে অসংখ্য উপজাতিদের বাস, যারা ভাষা, সংস্কৃতি ও জীবনযাপনের প্রক্রিয়ায় একে অন্যের থেকে ভিন্ন, তাদেরই দুটির নাম চুকচি আর কোডিয়াক।

৭.  Lauridsen Peter. Vitas Bering: The Discovere of Bering Strait. S.C. Griggs and Company, Chicago. 1889 p -186.

চিত্র পরিচিতিঃ

চিত্র-২   সুত্র – Russiapedia  http://russiapedia.rt.com/prominent-russians/exploring-russia/vitus-bering/

চিত্র-৩ – ১৬৯৮ খিস্টাব্দে Godfrey Kneller-এর আঁকা পিটারের প্রতিকৃতি। এটি পিটার  ইংল্যান্ডের রাজপরিবারকে উপহার দেবার জন্য আঁকান।

চিত্র-৫ – ভিটাস বেরিং-এর ৩০০তম জন্মদিনে তাঁকে শ্রদ্ধা জানাতে সোভিয়েত রাশিয়া এই ডাকটিকিট প্রকাশ করে।                

চিত্র-৬ – ১৯৭৯ Alaska Journal এ প্রাপ্ত সেন্ট পিটার ও সেন্ট পলের চিত্র – সৌজন্যে Lydia T.Black   Russians in Alaska 1723-1867. 2004. University of Alaska Press. Fairbanks, Alaska

সহায়ক গ্রন্থপঞ্জিঃ

1. Clause. M. Naske , Herman E. Slotnik. :  Alaska – A History : University of  Oklahoma Press, 2014.  

2. Stevens Dana Bunker.  Alaska – A Photographic Journey :  Crescent Books. New York, 1996.

3. Alaska – History and Cultural Studies : supported by The Alaska Humanities Forum.

4. F. A. Golder.  Bering’s Voyages : Vol-I, American Geographical Society Research Series No-1.  

5. Encyclopedia Britannica 2014 : Web Edition.

6. Hubert Howe Banaroff,  Alfred Bates,  Ivan Petroff,  William Nemos. History of Alaska 1730 – 1885 : A.I.Bancroft & Company. Sanfrancisco, 1886.

7. The Geographical Journal, Vol-II July – Dec 1893 : The Royal Geographical Society.

8. Bill Harris.  The Spirit of Alaska : Crescent Books. New York, 1992

9. Peter Lauridsen.  Vitus Bering – The Discoverer of Bering Strait : Chicago,S.C. Griggs & Company, 1889. 

10. Corey Ford.   Where the sea breaks its back : Alaska Northwest Books, Portland, OR. 1992

11. Georg Wilhelm Steller.  Journal of a Voyage with Bering, 1741-1742 : Stanford University Press. Stanford, California. 2002 

12. James A. Michener.  Alaska. A Novel : Dial Press Trade Paperbacks. New York, 2014

13. Norman Bancroft-Hunt  & Werner Forman.  People of the Totem; The Indians of the Pacific Northwest :  University of Oklahoma Press. Norman & London, 1979.

14. Lydia T. Black Russians in Alaska. 1732 – 1867: University of Alaska Press. Fairbanks, Alaska. 2004

15. Gay Salisbury & Laney Salisbury.  The Cruelest Miles : W.W.Norton & Company. New York. 2005.

16. Seth Kantner. Swallowed by the great land and other dispatches from Alaska’s frontier : Mountaineers Books. Seattle, WA, 2014.   

পর্ব ২

জন্ম ১৯৫৯। কলকাতা মেডিকেল কলেজ থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শিক্ষা। পেশায় অস্থিশল্য চিকিৎসক। লেখার জগতে বিলম্বিত প্রবেশ। লেখা প্রকাশিত 'দেশ', হরপ্পা, ভ্রমি ভ্রমণআড্ডা সহ নানা পত্রিকায় ও সংকলনে। প্রকাশিত বই 'টাইমলাইন আলাস্কা', 'এক চামচ বিদেশ', 'কোভিড-১৯, এক বিভ্রান্তির সন্ত্রাস'। ভ্রমণআড্ডা প্রদত্ত 'কলম' সম্মান লাভ ২০২২এ। ভ্রমণ, ইতিহাস অনুসন্ধান নিয়ে বিশেষভাবে অনুরাগী। ছবি তোলার নেশায় দেশে বিদেশে পাড়ি, তাতে কিছু দেশীয় ও আন্তর্জাতিক সম্মানপ্রাপ্তি। দেশে ও বিদেশে একক ও দলগত প্রদর্শনী।

মন্তব্য তালিকা - “আলাস্কার সাতরঙা ইতিহাস – পর্ব ১”

  1. স্কুলে ভূগোল পড়ার সময় কামচাটকা অভিযান ও বেরিং প্রণালী বিষয়ে দু এক লাইন জেনেছি। এর বেশি কিছু নয়। আপনার লেখা পড়ে বিশদ ভাবে এই বিষয়গুলি জানলাম।

    মহানায়ক পিটার দ্য গ্রেট, ভিটাস জোনাসেন বেরিং ও জর্জ উইলহেল্ম স্টেলার সম্বন্ধে অসাধারণ দক্ষতায় আপনি আমাদের ঋদ্ধ করেছেন। নিজের জবানীতে এই সকল মহামানবদের কথা আমাদের শুনিয়েছেন।

    আপনার লেখা যখন পড়ি তখন ভাবতে বসি আপনার নিজের কাজ শেষ করে কত সময় ব্যয় করেন ও কত পরিশ্রম করেন একটি লেখা তৈরি করবার জন্য।

    আপনাকে সেলাম

মন্তব্য করুন

আপনার ইমেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।