আইহোলে ৫০০
আমাদের মধ্যে যাঁরা দেশের অর্থনীতি, ব্যবসাবাণিজ্য নিয়ে খোঁজখবর রাখেন, তাঁদের কাছে ‘আ্যসোচ্যাম, ফিকি, সি.আই.আই’ – এই সংস্থাগুলো খুব চেনা। এই সংস্থাগুলো হল বর্তমান ভারতের বিভিন্ন বণিকসভা। এঁদের কাজ হল দেশের উদ্যোগপতিদের স্বার্থ রক্ষা করা। তাই প্রতিবছর বাজেটের আগে এই সংস্থাগুলির নাম খুব বেশি করে শোনা যায়। কারণ সেই সময় এই সংস্থাগুলি দেশের অর্থমন্ত্রীর কাছে তদ্বির করে থাকে শিল্প এবং ব্যবসাবাণিজ্য ক্ষেত্রকে বাজেটের মাধ্যমে সুযোগসুবিধা দেওয়ার জন্য।
‘আইহোলে ৫০০’ হল এইরকমই এক বণিকসভা। দক্ষিণ ভারতের। তবে এই যুগের নয়, সেই যুগের। সেই যুগ বলতে সাধারণ অব্দের আট শতকের শেষভাগ/ নয় শতকের গোড়া থেকে থেকে সাধারণ অব্দের চোদ্দ শতক পর্যন্ত। ‘আইহোলে ৫০০’ ছিল চোল এবং কল্যাণী/ পশ্চিমী চালুক্য রাজ্যের সবচেয়ে বড় বণিকসভা।
দক্ষিণ ভারতে ব্যবসাবাণিজ্যের বিশেষত নৌবাণিজ্যের বিকাশ শুরু হয়েছিল সাধারণ অব্দ শুরু হওয়ার আগে থেকেই। এর পিছনে মূলত দুটো কারণ ছিল – (১) তদানীন্তন দক্ষিণ ভারতে প্রকৃতিজাত বিশেষত বনজ এবং সমুদ্রজাত পণ্যদ্রব্যের সহজলভ্যতা এবং (২) দক্ষিণ ভারতের ভৌগোলিক অবস্থান।
সাধারণ পূর্বাব্দের তৃতীয় শতকের মাঝামাঝি থেকে ইরানের পার্থিয়ানদের বাধার কারণে চীন, ভারত এবং পূর্ব/ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া’র বিভিন্ন অঞ্চলের সাথে আরব, আফ্রিকা এবং ইউরোপের স্থলবাণিজ্য বাধা বিপত্তির সম্মুখীন হতে শুরু করে। ফলে ব্যবসায়ীদের দরকার হয়ে পড়ে সমুদ্রপথের। এমতাবস্থায়, তিন দিকে সমুদ্র দিয়ে ঘেরা দক্ষিণ ভারত হয়ে ওঠে তদানীন্তন ভারতবর্ষ, প্রাচ্য এবং পাশ্চাত্যের আন্তর্দেশীয় ব্যবসাবাণিজ্যের মূল সংযোগকেন্দ্র।
সেই সময় উত্তর ভারত থেকে যে সমস্ত পণ্যদ্রব্য বহির্বিশ্বে রপ্তানি করা হত, সেইসমস্ত পণ্যদ্রব্য প্রথমে উত্তরাপথ এবং দক্ষিণাপথ ধরে এসে পৌঁছতো দাক্ষিণাত্যের মালভূমিতে। তারপর অন্তর্দেশীয় স্থলপথ ধরে সেই সব পণ্যদ্রব্য পৌঁছে যেত মালাবার এবং করমণ্ডল উপকূলের বিভিন্ন বন্দরে। সেইসব বন্দর থেকে থেকে জাহাজে চেপে সেই সব পণ্যদ্রব্য পাড়ি দিত যথাক্রমে পাশ্চাত্যে এবং প্রাচ্যে। আবার পাশ্চাত্য এবং প্রাচ্য থেকে উত্তর ভারতের জন্য আগত পণ্যদ্রব্য প্রথমে জাহাজে করে এসে পৌঁছতো যথাক্রমে মালাবার এবং করমণ্ডল উপকূলের বিভিন্ন বন্দরে। সেখান থেকে দক্ষিণাপথ এবং উত্তরাপথ ধরে সেই সব পণ্যদ্রব্য পৌঁছে যেত তদানীন্তন উত্তর ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে।
একই সময়ে প্রাচ্য এবং পাশ্চাত্যের মধ্যে যে সমস্ত পণ্যদ্রব্যে সরাসরি বাণিজ্য হত, সেইগুলির পরিবহনের জন্যও ‘ট্রানজিট পয়েন্ট’ হয়ে ওঠে দক্ষিণ ভারত। এর কারণ ছিল কন্যাকুমারী পেরোতে সেই সময়কার নাবিকদের চূড়ান্ত অনীহা। ফলে, আরব দুনিয়া এবং আফ্রিকার পূর্ব উপকূল থেকে মালপত্র নিয়ে জাহাজ এসে ভিড়ত মালাবার উপকূলে। সেখান থেকে স্থলপথে মালপত্র পৌঁছে যেত করমণ্ডল উপকূলের বিভিন্ন বন্দরে। তারপর আবার জাহাজে চেপে পাড়ি দিত চীন এবং পূর্ব/ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া’র বিভিৱ অঞ্চলে। ঠিক একই ভাবে, চীন এবং পূর্ব/ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া’র পণ্য করমণ্ডল উপকূল-মালাবার উপকূল হয়ে পাড়ি দিত পশ্চিমে।
সাধারণ অব্দের ছয় শতক পর্যন্ত দক্ষিণ ভারতের অর্থনীতির মূল ভিত্তি ছিল এই ব্যবসাবাণিজ্য আর যুদ্ধ করে লুঠ করা ধনসম্পত্তি। দক্ষিণ ভারতে অর্থনীতির আর এক ভিত্তি হিসাবে কৃষির উত্থান শুরু হয় সাধারণ অব্দের ছয় শতকে যখন উত্তর তামিলনাড়ু এবং দক্ষিণ অন্ধ্রে পল্লবদের, দক্ষিণ তামিলনাড়ুতে পাণ্ড্যদের এবং কর্ণাটকে বাদামি চালুক্যদের রাজত্ব শুরু হয়। তবে কৃষির এই উত্থানে, ব্যবসাবাণিজ্যের গুরুত্ব মোটেই হ্রাস পায়নি। উল্টে স্থায়ী এবং শক্তিশালী প্রশাসন থাকার সুবাদে, দক্ষিণ ভারতে ব্যবসাবাণিজ্য আরও ফুলে ফেঁপে ওঠে। আর তা সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছয় চোল আর কল্যাণী/ পশ্চিমী চালুক্যদের সময়ে।
ব্যবসাবাণিজ্য থাকবে, ব্যবসায়ী থাকবে আর বণিকসভা থাকবে না – তা তো হয়না। তাই মধ্যযুগের দক্ষিণ ভারতে তৈরি হয়েছিল একাধিক বণিকসভা যেমন – আইননুররুভার, আনজুভান্নান, মনিগ্রামম, চিত্রমেলি পেরিয়ানাডু ইত্যাদি। এছাড়াও এইসময় গড়ে উঠেছিল শহর/ নগর ভিত্তিক বহু স্থানীয় বণিকসভা ‘নগরত্তার’। এই বণিকসভাগুলির মধ্যে সবচেয়ে সক্রিয় এবং প্রভাবশালী বণিকসভা ছিল আইননুররুভার। আইননুররুভার নিজেদের প্রশস্তিতে নিজেদের বর্ণনা দিত ‘আয়াভোলেপুরার (তামিল)/ আয়াভোলের (কন্নড়)/ আয়াভোলুর(তেলেগু)/ আর্যরূপার(সংস্কৃত) ৫০০ প্রভু/ স্বামী’ বলে। যেহেতু ‘আয়াভোলেপুরা(তামিল)/ আয়াভোলে (কন্নড়)/ আয়াভোলু(তেলেগু)/ আর্যরূপা(সংস্কৃত) অধুনা কর্ণাটকের আইহোলে-র পূর্বতন নাম, ঐতিহাসিকরা এই বণিকসভার নাম দিয়েছেন ‘আইহোলে ৫০০’।
‘আইহোলে ৫০০’-এর সর্বপ্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় যে দুই লেখতে, সেই দুই লেখ লেখা হয়েছিল সাধারণ অব্দের আট শতকের শেষদিকে। এই দুই লেখ পাওয়া গিয়েছে কর্ণাটকের আইহোলের গড়ুরগুড়ি এবং লাদ খান মন্দিরে। এই দুই লেখর ভিত্তিতে মনে করা হয় যে ‘আইহোলে ৫০০’ তৈরি হয়েছিল সাধারণ অব্দের আট শতকের শেষদিকে। তবে বণিকসভা হিসাবে ‘আইহোলে ৫০০’ সক্রিয় হয়ে ওঠে সাধারণ অব্দের দশ শতকে এবং তা সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছয় সাধারণ অব্দের এগারো শতকে। এই সময় ‘আইহোলে ৫০০’-এর নেটওর্য়াক বিস্তৃত হয়েছিল পুরো তামিলনাড়ু আর কর্ণাটকে এবং অন্ধ্র, কেরালা আর শ্রীলঙ্কার বেশ কিছু অঞ্চলে। এই সমস্ত অঞ্চলের অধিবাসী ‘আইহোলে ৫০০’-এর সদস্যরা তখন ব্যবসা করতেন মগধ, কৌশল, সৌরাষ্ট্র, লতা (আজকের দক্ষিণ গুজরাত), পারস্য, নেপাল, কাম্বোজ এবং সুমাত্রা-এর ব্যবসায়ীদের সাথে। প্রসঙ্গত ‘আইহোলে ৫০০’-এর সর্বাধিক লেখ পাওয়া গিয়েছে তামিলনাড়ু এবং কর্ণাটকে। এছাড়াও অন্ধ্রপ্রদেশ এবং কেরালাতেও পাওয়া গিয়েছে ‘আইহোলে ৫০০’-এর বেশ কিছু লেখ। ভারতবর্ষের বাইরে যে সব জায়গায় ‘আইহোলে ৫০০’-এর লেখ পাওয়া গিয়েছে সেইগুলি হল শ্রীলঙ্কা, সিয়াম (দক্ষিণ থাইল্যান্ড), সুমাত্রা এবং বার্মা।
কোথায় পত্তন হয়েছিল ‘আইহোলে ৫০০’-এর? যেহেতু ‘আইহোলে ৫০০’-এর সর্বপ্রথম উল্লেখ পাওয়া গিয়েছে কর্ণাটকের আইহোলেতে প্রাপ্ত দুই লেখতে, তাই ঐতিহাসিকদের একাংশ মনে করেন যে এই বণিকসভার জন্ম হয়েছিল আজকের কর্ণাটকের আইহোলেতে। এই মতের স্বপক্ষে আর একটা নিদর্শন হল ‘আইহোলে ৫০০’-এর লেখগুলি থেকে প্রাপ্ত ‘আইহোলে ৫০০’ সম্পর্কিত প্রশস্তি। এই সব প্রশস্তিতে ‘আইহোলে ৫০০’ নিজেদের উল্লেখিত করেছিল ‘আয়াভোলেপুরার/ আয়াভোলের/ আয়াভোলুর/ আর্যরূপার ৫০০ প্রভু/ স্বামী’ বলে। এই সব প্রশস্তি অনুযায়ী ‘আইহোলে ৫০০’-এর সদস্যরা মনে করতেন যে তাঁরা ছিলেন আইহোলের দেবতা বাসুদেব, কাঁদালি, মূলভদ্র এবং দেবী পরমেশ্বরী(দুর্গা)-এর সন্তান।
‘আইহোলে ৫০০’-এর পত্তন সম্পর্কিত দ্বিতীয় মত অনুযায়ী ‘আইহোলে ৫০০’-এর পত্তন হয়েছিল আজকের তামিলনাড়ুতে। এই মতের স্বপক্ষে যুক্তি হল যে এই বণিকসভার প্রথমদিকের বেশিরভাগ লেখ পাওয়া গিয়েছে আজকের তামিলনাড়ুতে। কর্ণাটকে প্রাপ্ত ‘আইহোলে ৫০০’-এর লেখগুলির সিংহভাগই লেখা হয়েছিল সাধারণ অব্দের এগারো শতকে।
কেন তৈরি হয়েছিল ‘আইহোলে ৫০০’? বেদকিহাল লেখর প্রশস্তি অনুযায়ী আইহোলে ৫০০ তৈরি হয়েছিল এক জন ব্যবসায়ীকে “বীর-বনজুধর্ম” অর্থাৎ ‘সৎ এবং মহান ব্যবসায়ীর ধর্ম’ পালনে সাহায্য করতে। বনজু শব্দটা এসেছে সংস্কৃত শব্দ “ভানিজ” থেকে যার অর্থ হল ব্যবসায়ী। একজন ব্যবসায়ীকে ‘সৎ ব্যবসায়ী’ হতে গেলে কি ভাবে ব্যবসা করতে হবে তারও একটা সনদ বানিয়েছিল ‘আইহোলে ৫০০’ যাতে ছিল ৫০০’টা বীর-শাসন (আচরণবিধি)। ‘আইহোলে ৫০০’-এর প্রতীক ছিল ষাঁড় যার ছবি থাকতো এঁদের পতাকায়।
‘আইহোলে ৫০০’-এর সদস্যরা কোথাকার বাসিন্দা ছিলেন তা নিয়ে একাধিক বর্ণনা পাওয়া যায়। অধিকাংশ লেখতে, ‘আইহোলে ৫০০’-এর সদস্যদের সম্পর্কে বলা হয়েছে ‘নানাদেশি’, যা থেকে মনে হয় যে ‘আইহোলে ৫০০’-এর সদস্যরা এসেছিলেন একাধিক অঞ্চল/ প্রদেশ থেকে। বেশ কিছু লেখতে ‘আইহোলে ৫০০’-এর সদস্যদের উল্লেখ করা হয়েছে ‘বিশ্বায়াম/বিশ্বায়াত্তার’ (যার অর্থ আঠেরোটি অঞ্চল থেকে আগত) বলে। আবার অন্য একাধিক লেখতে ‘আইহোলে ৫০০’-এর সদস্যরা উল্লেখিত হয়েছিলেন ‘পাড়িনেন্দুভূমি’ (আঠেরোটি দেশ থেকে আগত) বলে। আবার কয়েকটি লেখ অনুযায়ী, ‘আইহোলে ৫০০’-এর সদস্যরা ছিলেন আঠেরোটি শহর (পাত্তিনম), বত্রিশটি বন্দর (ভেলাপুরম) এবং চৌষট্টিটি গ্রাম (কাদিগাই-তাভালাম)-এর বাসিন্দা।
‘আইহোলে ৫০০’-এর সদস্য-দের পেশা কী ছিল বা সমাজের কোন স্তর থেকে তাঁরা এসেছিলেন, তা সম্পর্কে সম্যক ধারণা পাওয়া যায় তাঁদের লেখগুলির প্রশস্তি থেকে। ‘আইহোলে ৫০০’-এর প্রথমদিকের লেখগুলি থেকে জানা যায় যে চেট্টি এবং কাভারাই (দুই ভিন্ন জাতের ব্যবসায়ী), কামুন্ডস্বামী (ভূস্বামীদের নেতা), ছোট দোকানদার এবং অন্যান্য ছোটোখাটো পেশার সাথে যুক্ত ব্যক্তিরা এই সংগঠনের সদস্য ছিলেন। পরের দিকের অর্থাৎ সাধারণ অব্দের তেরো শতকের লেখগুলিতে সদস্যদের এই তালিকা অনেক লম্বা এবং বিস্তারিত হয়ে যায় যার থেকে বোঝা যায় যে সেই সময় পেশা এবং অর্থনৈতিক স্বার্থের মাপকাঠিতে যোগ্য হলে, জাত-ধর্ম নির্বিশেষে যে কেউ ‘আইহোলে ৫০০’-এর সদস্য হতে পারত।
এই প্রসঙ্গে উল্লেখ্য যে আইহোলের গড়ুরগুড়ি এবং লাদ খান মন্দিরে প্রাপ্ত ‘আইহোলে ৫০০’ সম্পর্কিত প্রথম দুই লেখতে ‘আইহোলে ৫০০’ বর্ণিত হয়েছিল ৫০০ জন ব্রাহ্মণের সংগঠন হিসাবে। এমনকি আইহোলেতে প্রাপ্ত সাধারণ অব্দের দশম শতকের লেখগুলিতেও ‘আইহোলে ৫০০’-কে উল্লেখ করা হয়েছিল ৫০০ জন ব্রাহ্মণের সংগঠন হিসাবে। এর থেকে মনে হয় যে ‘আইহোলে ৫০০’-এর যাত্রা শুরু হয়েছিল সম্ভবত ব্রাহ্মণদের এক সংগঠন হিসাবে। তারপর সময়ের সাথে সাথে যখন এই সংগঠন বণিকসভার চেহারা নিতে শুরু করে তখন এই সংগঠনের দরজা জাত-ধর্ম নির্বিশেষে সবার জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়েছিল।
‘আইহোলে ৫০০’-এর সাধারণ অব্দের তেরো শতকের লেখগুলিতে পঁচানব্বইটি গোষ্ঠীর নাম পাওয়া যায় ‘আইহোলে ৫০০’-এর সদস্য হিসাবে। এই পঁচানব্বইটি গোষ্ঠীকে আবার দশ’টি দলে ভাগ করা যায় – বড় ব্যবসায়ী, ভূস্বামী, নির্দিষ্ট পণ্যের লেনদেন যুক্ত স্থানীয় ব্যবসায়ী গোষ্ঠী, যুদ্ধে পটু ব্যবসায়ী, ব্যবসায়ীদের নিরাপত্তা প্রদানকারী ভাড়াটে সৈন্যদল, বিদেশী ব্যবসায়ী, দোকানদার, কারিগর, সংবাদ লেখক ও বাহক এবং ভৃত্য। ‘আইহোলে ৫০০’-এর বিভিন্ন লেখতে উপরোক্ত এই দশ’টি দলের মধ্যে সর্বাধিক বার উল্লিখিত হয়েছে ব্যবসায়ীদের নিরাপত্তা প্রদানকারী ভাড়াটে সৈন্যদল (২১ বার) এবং যুদ্ধে পটু ব্যবসায়ী (১৮ বার)। ‘আইহোলে ৫০০’-এর বিভিন্ন লেখতে এঁরা উল্লিখিত হয়েছিলেন ‘নাম্মাক্কাল’ বলে যার অর্থ ‘আমাদের সন্তান’। এর থেকে মনে হয় যে এই দুই গোষ্ঠী সংগঠনের মধ্যে অন্যান্য গোষ্ঠীর তুলনায় পদমর্যাদায় নিচে ছিলেন এবং অন্যান্য গোষ্ঠীর সাথে এই দুই গোষ্ঠীর মধ্যে একটা প্রভু-ভৃত্যের সম্পর্ক ছিল। তবে সেই সম্পর্ক ছিল বেশ জোরদার এবং বিশ্বস্ততার। তাই ‘নাম্মাক্কাল’-দের কাছে বণিকসভার অন্যান্য গোষ্ঠীগুলি বিবেচিত হতো ‘নাম পেরুমাক্কাল’ (আমাদের মহামানব) বলে।
‘আইহোলে ৫০০’ কেন রেখেছিল নিজস্ব ভাড়াটে সৈন্যদল? বিশেষ করে যখন তাদের মূল কর্মক্ষেত্র ছিল প্রবল পরাক্রমশালী চোল এবং কল্যাণী/ পশ্চিমী চালুক্য রাজ্য?
এর দু’টো ব্যাখ্যা হতে পারে – (১) মহাশক্তিধর চোল (এবং কল্যাণী/ পশ্চিমী চালুক্য এবং শ্রীলঙ্কার রাজশক্তি)-এর পক্ষে সম্ভব ছিল না রাজ্যের সর্বত্র ব্যবসায়ীদের নিরাপত্তা দেওয়ার বিশেষত সেইসব ব্যবসায়ীদের যারা ব্যবসা উপলক্ষে দুর্গম পথে দূর-দূরান্তে ভ্রমণ করতেন; অথবা (২) রাষ্ট্র নীতিগতভাবেই ব্যবসায়ীদের নিরাপত্তা তাঁদের ওপরই ছেড়ে দিয়েছিল। কারণ যাই হোক না কেন, এর ফল হয়েছিল যে ‘আইহোলে ৫০০’- গঠন করেছিল নিজস্ব ভাড়াটে সৈন্যদল। ‘আইহোলে ৫০০’-এর অধিকাংশ সদস্য ছিলেন মূলত সেই সব ব্যবসায়ী যারা এক জায়গা থেকে আর এক জায়গায় ঘুরে ঘুরে ব্যবসা করতেন। আর এই ভ্রাম্যমাণ ব্যবসায়ীদের নিরাপত্তা দিত আইহোলে ৫০০-এর নিজস্ব ভাড়াটে সৈন্যদল।
সেই নিরাপত্তার প্রতিদানে, ‘আইহোলে ৫০০’-এর অন্যান্য সদস্য গোষ্ঠী ভাড়াটে সৈন্যদলের খেয়াল রাখতো। ভাড়াটে সৈন্যদলের খাওয়ার, পরার, রাতে পাহারা দেওয়ার জন্য বাতি জ্বালানোর তেল জোগানোর ভার ছিল ‘আইহোলে ৫০০’-এর অন্যান্য গোষ্ঠীর সদস্যদের। শুধু তাই নয়, ‘আইহোলে ৫০০’-এর স্বার্থ রক্ষার্থে, চোর-ডাকাতদের সঙ্গে বা কোন স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তির সাথে লড়াইয়ে কোন ভাড়াটে সৈন্য মারা গেলে, তাঁর স্মৃতিতে স্থানীয় শহরের নামকরণ করা হত বীরপত্তিনম/ এনবীরপত্তিনম বলে। সঙ্গম যুগে কোন যোদ্ধা মারা গেলে তাঁর স্মৃতিতে ‘বীরশীলা’ স্থাপনের যে প্রথা তামিলনাড়ুতে চালু হয়েছিল, এই বীরপত্তিনম/ এনবীরপত্তিনম নামকরণের প্রথা সম্ভবত ছিল তার পরিবর্ধিত এবং পরিমার্জিত রূপ।
মৃত ভাড়াটে সৈন্যের স্মৃতি রক্ষার্থে শহরের নামকরণের এই প্রথা শুধু চোল রাজ্যে নয়, শ্রীলংকাতেও চালু ছিল যা একার্থে শ্রীলংকাতে ‘আইহোলে ৫০০’-এর প্রভাবশালী উপস্থিতির সাক্ষ্য দেয়। আর এই নামকরণের প্রথা থেকে এইটাও বোঝা যায় যে ভাড়াটে সৈন্যদের সাথে ‘আইহোলে ৫০০’-এর অন্যান্য সদস্য গোষ্ঠীর বাস্তবিকই ‘নাম্মাক্কাল’ এবং ‘নাম পেরুমাক্কাল’-এর সম্পর্ক ছিল। অবশ্য ‘নাম্মাক্কাল’-দের কেউ কুকাজ করলে তাঁদের ছেড়ে দিত না ‘নাম পেরুমাক্কাল’-রা। ‘বীর-শাসন’-এর বিধি মেনে বিচার হতো সেই অপকীর্তির।
‘আইহোলে ৫০০’-এর সদস্যরা কোন কোন পণ্যদ্রব্যে অন্তর্দেশীয় বাণিজ্য/ রপ্তানি করতেন আর কোন কোন পণ্যদ্রব্য আমদানি করতেন তার একাধিক তালিকা পাওয়া গিয়েছে এঁদের বিভিন্ন লেখতে। এই তালিকাগুলির মধ্যে দুই সবচেয়ে লম্বা তালিকা হল পিরানমালাই (তামিলনাড়ুর রামনাদ জেলায় প্রাপ্ত) এবং কোভিলাপাত্তি লেখ-এর তালিকা। এই তালিকাগুলিতে অন্তর্দেশীয় বাণিজ্য/ রপ্তানি-এর ক্ষেত্রে যে সমস্ত পণ্যদ্রব্য দশ-এর অধিকবার উল্লিখিত হয়েছিল সেইগুলি হল সুপারি, পান পাতা, তেল, ধান, চাল, শস্য, লবণ, চন্দন কাঠ, সুতো, কাপড় এবং লোহার পাত। ‘আইহোলে ৫০০’-এর রপ্তানির পণ্যদ্রব্য তালিকায় তেল, সুতো ও কাপড়, এবং লোহার পাত-এর উপস্থিত দেখে মনে করা হয় যে সেই সময় দক্ষিণ ভারতে তেল নিষ্কাশন, তাঁত ও বস্ত্রশিল্প এবং লোহা নির্মাণশিল্প উল্লেখযোগ্যভাবে বিকশিত হয়েছিল।
পিরানমালাই লেখ অনুযায়ী যে সমস্ত পণ্যদ্রব্য ‘আইহোলে ৫০০’-এর সদস্যরা আমদানি করতেন তা হল আগর গাছের কাঠ (সুগন্ধি তৈরি করার জন্য), গোলাপ জল (পশ্চিম এশিয়া থেকে), রেশম (চীন থেকে), কর্পূরের তেল এবং সুগন্ধি (সুমাত্রা থেকে), হাতি (বার্মা থেকে) এবং ঘোড়া (আরব থেকে)। প্রসঙ্গত ১০৮৮-৮৯ সাধারণ অব্দে লেখা ‘আইহোলে ৫০০’-এর যে লেখটি সুমাত্রায় পাওয়া গিয়েছে, তা পাওয়া গিয়েছে বারুস- এ (Loboe Toewa) যা ছিল সুমাত্রার প্রধান কর্পূর উৎপাদক অঞ্চল।
‘আইহোলে ৫০০’ -এর সদস্যরা যে শুধু ব্যবসাবাণিজ্যই করতেন, তা নয়। তাঁরা ধর্মকর্মও করতেন। ‘আইহোলে ৫০০’-এর লেখর প্রশস্তি অনুযায়ী, তাঁদের নীতি ছিল “আরাম ভালারা, কালী মেলিয়া” অর্থাৎ ধর্মের প্রচার করা এবং কালীর অশুভ শক্তিকে দুর্বল করা। তাই ‘আইহোলে ৫০০’ ব্যবসাবাণিজ্যের ক্ষেত্রে নিজের সদস্যদের স্বার্থরক্ষার সাথে সাথে, মন্দির নির্মাণ এবং রক্ষণাবেক্ষণের জন্য আর্থিক সহায়তা করতো। প্রথম দিকে এই কাজটা সদস্য ব্যবসায়ীরা ব্যক্তিগতভাবে করতেন ‘আইহোলে ৫০০’-এর তরফ থেকে। সাধারণ অব্দের দশ এবং এগারো শতকে লেখা এইরকম পাঁচটি লেখ পাওয়া গিয়েছে যাতে ‘আইহোলে ৫০০’-এর সদস্য ব্যবসায়ীদের মন্দির কর্তৃপক্ষকে ব্যক্তিগত দানের বিবরণ আছে। পরের দিকে, সাধারণ অব্দের এগারো শতক থেকে কর্ণাটকে এবং তেরো শতক থেকে তামিলনাড়ুতে, এই কাজটা ‘আইহোলে ৫০০’ সাংগঠনিক ভাবে করতে শুরু করে এবং কয়েকটি ক্ষেত্রে মন্দিরের সার্বিক দেখভালের দায়িত্ব নিয়েছিল ‘আইহোলে ৫০০’-। চোল এবং কল্যাণী/ পশ্চিমী চালুক্য রাজ্যে হিন্দু ধর্মের পৃষ্ঠপোষকতার সাথে সাথে শ্রীলংকাতে বৌদ্ধ বিহার এবং সংঘের পৃষ্ঠপোষকতাও করতো ‘আইহোলে ৫০০’।
‘আইহোলে ৫০০’-এর ধর্মকর্মের পিছনে সম্ভবত দু’টো ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যও ছিল। এক – ধর্মীয় স্থানের পৃষ্ঠপোষকতা করলে সাধারণ মানুষের মনে বণিক এবং বণিকসভা সম্পর্কে ভালো ধারণা তৈরি হয়। ফলে ব্যবসা করার ক্ষেত্রে কোন সামাজিক বাধার সৃষ্টি হয় না। দুই – ধর্মীয় প্রতিষ্ঠাগুলির মাধ্যমে আর্থিক লেনদেন-এর একটা প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো খাড়া হয়েছিল যাতে এই প্রতিষ্ঠানগুলি আজকের ‘ব্যাংক’-এর ভূমিকা পালন করতো।
‘আইহোলে ৫০০’-এর যাত্রা বণিকসভা হিসাবে শুরু হলেও, তেরো শতকের লেখগুলি থেকে মনে হয় যে ততদিনে ‘আইহোলে ৫০০’ এক বণিকসভা থেকে একাধিক বণিকসভার এক যুক্ত পরিষদে পরিণত হয়েছিল। ১৩০০ সাধারণ অব্দে লেখা পিরানমালাই লেখতে একাধিক বণিকসভা এবং নগরত্তা-এর নাম পাওয়া যায় যারা ‘আইহোলে ৫০০’-এর ছাতার তলায় চলে এসেছিল। আনজুভান্নান, মনিগ্রামম – এই সব বণিকসভাগুলি সেই সময় ‘আইহোলে ৫০০’-এর নেতৃত্বে বড় সভায় (সময়ম বা পেরুনিরবি) যোগদান করত। বিশাখাপত্তনমে প্রাপ্ত এক তেলেগু লেখ অনুযায়ী, যা লেখা হয়েছিল ১২০০ সাধারণ অব্দ থেকে ১২০৭ অব্দের মধ্যে, ইন্দোনেশিয়ার উত্তর উপকূলের বন্দর-শহর পাসাই-এর বাসিন্দা আনজুভান্নান বণিকসভার এক সদস্যকে ‘মা(বা)নগারি-বল্লভ-সময়-চক্রবর্তী’ উপাধি দেওয়া হয়েছিল। এই উপাধির ‘সময়-চক্রবর্তী’ অংশ থেকে মনে হয় যে সেই সময় আনজুভান্নান বণিকসভার সদস্যরা হয় ‘আইহোলে ৫০০’-এর পৃষ্ঠপোষকতা পেতেন অথবা ‘আইহোলে ৫০০’-এর সদস্য হয়ে গিয়েছিলেন।
বস্তুত সাধারণ অব্দের বারো এবং তেরো শতকে ‘আইহোলে ৫০০’ হয়ে উঠেছিল দক্ষিণ ভারতের এক স্বশাসিত বাণিজ্যসংস্থা যা দূরপাল্লার বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করতো এবং যার হাতে ছিল (১) নিজস্ব ধর্মীয় স্থল স্থাপনের এবং রক্ষণাবেক্ষণের অধিকার এবং তার জন্য জন্য কর ও শুল্ক বসানোর অধিকার, (২) নিজস্ব রক্ষীদল তৈরি করার অধিকার; (৩) সুরক্ষিত গুদাম বানানোর অধিকার, এবং (৪) শহর/নগর (বীরপত্তিনম/এনবীরপত্তিনম) বসানোর এবং নামকরণের অধিকার। সামগ্রিকভাবে এই সময়ে এই সময়ে ‘আইহোলে ৫০০’-এর কার্যকলাপে রাষ্ট্রীয় প্রশাসন নাক গলাতো না। তবে, বীরপত্তিনম/এনবীরপত্তিনম স্থাপন ও নামকরণের জন্য সম্ভবত স্থানীয় চোল প্রশাসনের অনুমতির দরকার হত। আর মন্দির নির্মাণ এবং মন্দির সংরক্ষণের জন্য কর এবং শুল্ক বসানোর জন্য ‘আইহোলে ৫০০’-কে স্থানীয় কৃষক সংগঠন, স্থানীয় নাড়ু এবং নগরম-এর সদস্যদের সম্মতি নিতে হত। এইসময় ‘আইহোলে ৫০০’ কতটা প্রভাবশালী হয়ে উঠেছিল তা বোঝা যায় এসময়কার লেখগুলির প্রশস্তি থেকে। ‘আইহোলে ৫০০’-এর প্রথমদিকের প্রশস্তিতে তৎকালীন শাসকের উল্লেখ তাহাটাও। কিন্তু এসময়কার প্রশস্তিতে তদানীন্তন শাসকের কোন উল্লেখ নেই।
‘আইহোলে ৫০০’কে কেন এতটা প্রভাবশালী হয়ে উঠতে দিয়েছিল তদানীন্তন দক্ষিণ ভারতের রাজশক্তিগুলি বিশেষত প্রবলপরাক্রমশালী চোলরা? হতে পারে যে সেইসময় চোলদের কেন্দ্রীয় প্রশাসন দুর্বল হয়ে পড়েছিল এবং তাই ‘আইহোলে ৫০০’ হয়ে উঠেছিল এত প্রভাবশালী। তবে এর একটা অন্য দিকও আছে। চোল প্রশাসনের মূল নীতিই ছিল কেন্দ্রীয়শাসন এবং স্থানীয় স্বায়ত্তশাসনের মধ্যে এক ভারসাম্য বজায় রেখে রাষ্ট্র চালানো যা আজকের দিনেও অনুকরণযোগ্য। সম্ভবত সেই নীতি মেনেই ‘আইহোলে ৫০০’-কে স্বাধীনভাবে কাজ করতে দিয়েছিল চোল প্রশাসন।
এই প্রসঙ্গে আর একটা বিষয় উল্লেখ করা ভালো যে ‘আইহোলে ৫০০’, সম্ভবত সচেতনভাবেই, কখনও নিজের এক্তিয়ারের বাইরে গিয়ে রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে পা রাখেনি। তাঁরা না ছিল কোন রাজার পক্ষে, না ছিল কোন রাজার বিপক্ষে। তাঁদের ভাড়াটে সৈন্যের বাহিনী শুধুমাত্র ‘আইহোলে ৫০০’-এর স্বার্থরক্ষা ছাড়া অস্ত্র ধরত না, সে রাজার পক্ষে হোক বা বিপক্ষে। নির্দিষ্ট রাজনৈতিক পরিমণ্ডলের সাথে খাপ খাইয়ে নিজস্ব বণিকসভার সদস্যদের বাণিজ্যিক স্বার্থরক্ষাই ছিল ‘আইহোলে ৫০০’-এর একমাত্র উদ্দেশ্য। এই বিষয়ে ‘আইহোলে ৫০০’ সম্পর্কে ঐতিহাসিক জর্জ. ডব্লিউ. স্পেনসার-এর মন্তব্য – “Far from being the ‘creatures’ of any particular dynastic regime, the itinerant merchants exercise a chameleon-like ability to adapt themselves to local regimes to sit there own convenience”। ঐতিহাসিক নোবরু কারাশিমা মতেও তামিলনাড়ুতে প্রাপ্ত লেখগুলিতে ‘আইহোলে ৫০০’-এর এই রাজনৈতিক নিরপেক্ষতার ছাপ সুস্পষ্ট। সম্ভবত এই রাজনৈতিক নিরপেক্ষতার কারণেই, চোল, কল্যাণী/ পশ্চিমী চালুক্য এবং শ্রীলঙ্কা – এই তিন ভিন্ন রাজনৈতিক পরিমণ্ডলেই প্রভাবশালী হয়ে উঠেছিল ‘আইহোলে ৫০০’।
তবে এই প্রসঙ্গে এইটা উল্লেখ করা দরকার যে চোলদের সাথে ‘আইহোলে ৫০০’-এর একটা বিশেষ পারস্পরিক সাহায্যমূলক সম্পর্ক ছিল। চোল রাজ্যবিস্তারের পদাঙ্ক অনুসরণ করে ‘আইহোলে ৫০০’-এর বিস্তার ঘটেছিল আজকের তামিলনাড়ু, দক্ষিণ কর্ণাটক এবং শ্রীলঙ্কাতে। প্রথম রাজরাজ চোল এবং প্রথম রাজেন্দ্র চোল কঙ্গু অঞ্চল এবং পশ্চিমী গঙ্গা শাসিত অঞ্চলকে চোল রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করলে, ‘আইহোলে ৫০০’ সেখানে নিজেদের শাখা স্থাপন করে। একই ভাবে সাধারণ অব্দের এগারো শতকে শ্রীলঙ্কার উত্তরাংশ চোল রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হলে, উত্তর শ্রীলংকার রাজারত এবং পোলোননারুয়া হয়ে ওদের ‘আইহোলে ৫০০’ নেট ওয়ার্ক-এর দুই গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র। প্রথম কুলতুঙ্গার সময় ভেঙ্গির চালুক্য এবং চোলদের একত্রীকরণ হওয়ার পর ‘আইহোলে ৫০০’ পৌঁছে গিয়েছিল বিশাখাপত্তনম পর্যন্ত।
কতদিন চলেছিল ‘আইহোলে ৫০০’-এর রমরমা? সাধারণ অব্দের চোদ্দ শতক পর্যন্ত। সাধারণ অব্দের চোদ্দ শতকের পরে ‘আইহোলে ৫০০’-এর আর কোন লেখ পাওয়া যায় না। বারো শতকে শেষে/তেরো শতকের শুরুতেই পতন হয় কল্যাণী/ পশ্চিমী চালুক্যদের। ১২৭৯ সাধারণ অব্দে চোলদের পতন ঘটে চোলদের। দক্ষিণ ভারত ভেঙ্গে যায় অপেক্ষাকৃত ছোট এবং দুর্বল চারটি রাজ্যে – পাণ্ড্য, হৈসল, যাদব এবং কাকতিয়া। চোদ্দ শতকের শুরু থেকে দক্ষিণ ভারত আক্রমণ করতে শুরু করে দিল্লি সুলতানি। সেই আক্রমণ প্রতিরোধ করার ক্ষমতা ছিল না এই ছোট রাজ্যগুলির। আবার দক্ষিণ ভারতে পাকাপাকি রাজ্যবিস্তারে আগ্রহী ছিল না দিল্লি সুলতানি। তাঁদের মূল উদ্দেশ্য ছিল ধনসম্পদ লুণ্ঠন। ফলে দক্ষিণ ভারতে তৈরি হয় এক রাজনৈতিক অস্থিরতার যা ব্যবসাবাণিজ্যের পক্ষে সহায়ক ছিল না। ফলে অবলুপ্তি ঘটে ‘আইহোলে ৫০০’ এবং অন্যান্য বণিকসভাগুলির। সাধারণ অব্দের পনেরো শতকে ভারত মহাসাগরে ইউরোপীয় বণিকদের আগমনও হয়তো এই বণিকসভাগুলির অবলুপ্তির জন্য কিছুটা হলেও দায়ী ছিল।
শীর্ষক চিত্র পরিচিতি: আইহোলের ‘লাদ খান’ মন্দিরে ‘আইহোলে ৫০০’ সম্পর্কিত লেখ (চিত্রঋণ: https://commons.wikimedia.org/wiki/File:Kannada_inscription_(8th_century)_at_the_Lad_Khan_temple_in_Aihole.jpg)
তথ্যসূত্রঃ:
- The World of the Tamil Merchant – Pioneers of International Trade; Kanaklatha Mukund; Portfolio Penguin; 2015
- South India under the Cholas; Y.Subbarayalu; Oxford University Press; 2012
- Nagapattinam to Suvarnadwipa – Reflections on the Chola Naval Expeditions to Southeast Asia,; edited by Hermann Kulke, K. Kesavapany and Vijay Sakhuja; Institue of Sotheast Asian Studies, Singapore; Manohar; 2023
- Trade, Ideology and Urbanisation – South India 300 BC to AD 1300; R Champakalakshmi; Oxford University Press; 1996
- The Illustraded History of South India – From Prehistoric Times to the Fall of Vijaynagar; K.A. Nilkanta Sastri; Oxford University Press; 2009
- Rajraja Chola – Interplay Between an Imperial Regime and Productive Forces of Society; Raghavan Srinivasan; Leadstart Inkstate; 2021
- A Concise History of South India – Issues & Interpretations; Noboru Karashima; Oxford University Press; 2014
- India – A History from the Earlist Civilisations to the Boom of the Twenty First Century; John Key; Harper Press, 2010
দারুণ লাগল শান্তনুদা। এই জিনিসটা পুরো অজানা ছিল। কখনও মনে হয়েছিল বটে যে বাণিজ্য ছিল কিন্তু তার মূল নিয়ন্ত্রক সংস্থা হয়তো কিছু ছিল। কিন্তু ভাবতাম সেটা হয়তো রাষ্ট্রকর্তৃক পরিচালিত ছিল। রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণের বাইরে (আজকের ভাষায় ) বেসরকারি এতোবড়ো প্রতিষ্ঠান সে যুগে গড়ে উঠেছিল তা ভাবতেই পারিনি।
অনেক নতুন চিন্তা ও নতুন পড়াশোনার উৎসাহ পেলাম।
ধন্যবাদ এ লেখাটির জন্য।