সূচী

ইতিহাস তথ্য ও তর্ক

অবলা-সবলা

অবলা-সবলা

শুভেন্দু চট্টোপাধ্যায়

মার্চ ১, ২০২৫ ৭৭ 0

‘সালটা ১৮৯৮। মামা ইউরোপ থেকে ফিরে আসার বছর খানেক পর আমাদের পাড়ায় এসে ৮৫ নম্বর আপার সার্কুলার রোডের বাড়ি ভাড়া নিলেন। সেই বাড়ির উঠোন আর আমাদের বাড়ির উঠোন একই পাঁচিলে ঘেরা। মামা মামীমা তখন সদ্য ইংল্যান্ড থেকে সাইকেল চালানো শিখে এসেছেন। শীতের সকালে প্রবল উদ্যমে বাড়ির উঠোনে প্রফুল্লচন্দ্র, নীলরতন সরকার আর তাঁর স্ত্রীকে সাইকেল চড়া শেখানোর উদ্যোগ চলল। তবে সে উদ্যোগ এক শীতের পর আর স্থায়ী হয়নি। পরিত্যক্ত সাইকেলগুলোর মালিক হলাম আমরা, তরুণ প্রজন্ম।’

দেবেন্দ্রমোহন বসুর স্মৃতিকথায় যে মামা মামীমার প্রসঙ্গ এসেছে তাঁরা আর কেউ নন, জগদীশচন্দ্র বসু এবং তাঁর স্ত্রী লেডি অবলা বসু। বাংলায় নবজাগরণের শুরুতে ব্রাহ্মধর্মের সঙ্গে যাঁদের প্রত্যক্ষ যোগাযোগ ছিল তাঁরা নারী স্বাধীনতার কথা বলেছেন। শুধু বলেছেন না, তার প্রয়োগ ঘটাচ্ছেন। একশ বছরেরও বেশি আগে ইংল্যান্ড থেকে সাইকেল চালান শিখে আসার আগেই অবলা দাস ব্যতিক্রমী নারী হিসেবে বাংলার বিদ্বৎসমাজ নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে ফেলেছিলেন।

অবলা দাসের জন্ম ১৮৬৫ খ্রিস্টাব্দের ৮ আগস্ট। যে পিতামাতার সন্তান অবলা, তাঁদের পরিচয় না দিলে পটভূমিটা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। অবলার পিতা দুর্গামোহন দাস, মাতা ব্রহ্মময়ী দেবী। দুর্গামোহনের পিতার কর্মক্ষেত্র ছিল বরিশাল। দুর্গামোহন এখান থেকে বৃত্তি নিয়ে কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়তে আসেন। ১৮৬১ আইনের প্রথম পরীক্ষায় (Licentiate of Law) পাশ করে তিনি কলকাতা সদর আদালতের উকিল হন। ১৮৬৩-তে বরিশালে সরকারি উকিল হয়ে প্রত্যাবর্তন করেন, তবে ১৮৭০ সাল থেকে কলকাতায় এসে পাকাপাকীভাবে বসবাস করতে থাকেন এবং লব্ধপ্রতিষ্ঠ উকিল হন। স্ত্রী স্বাধীনতায় বিশ্বাসী দুর্গামোহনের চেষ্টায় বরিশালে দুটি বালবিধাবার পুনর্বিবাহ হয়। পিতার মৃত্যুর পর তিনি তাঁর অল্পবয়স্ক বিধবা বিমাতার পুনর্বিবাহ দেন। সেই সময়ে এ এক সাহসী পদক্ষেপ। সম্ভবত এই সময়েও এই দেশে এই ধরনের পদক্ষেপের কথা শোনা যায় না।

কলকাতায় এসে দুর্গামোহন আনন্দমোহন বসু, দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায়, মনমোহন ঘোষ, শিবনাথ শাস্ত্রী প্রমুখ ব্যক্তিদের নানাভাবে স্ত্রীশিক্ষা ও স্ত্রীজাতির উন্নতি বিধানে সহায়তা করতে থাকেন। উদ্ধারপ্রাপ্ত বালবিধবা ও কুলীন কন্যাদের তিনি নিজের বাড়িতে আশ্রয় দিতেন। এদের শিক্ষার জন্য প্রতিষ্ঠিত হয় ‘হিন্দু বোর্ডিং স্কুল’ ও পরে ‘বঙ্গ মহিলা বিদ্যালয়’। হিন্দু বোর্ডিং স্কুল প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে দুর্গামোহন নিজে যতখানি উদ্যোগী ছিলেন তার থেকে কম ততখানিই উৎসাহী ছিলেন না তাঁর স্ত্রী ব্রহ্মময়ী। তাঁদের সঙ্গে ছিলেন ‘অবলাবান্ধব’ পত্রিকার সম্পাদক দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায়। এঁদের সম্মিলিত চেষ্টায় তৈরি হল মেয়েদের বোর্ডিং স্কুল। কেশব সেন গিয়েছিলেন বিলেতে ব্রাহ্মধর্ম প্রচার করতে। সেই সময় এক ইউনিটারিয়ান পরিবারের সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়। এই একেশ্বরবাদী খ্রিস্টানরা ঈশ্বরকে একক এবং বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের অনন্য স্রষ্টা হিসাবে মনে করেন। সেই পরিবারের মেয়ে ‘অ্যানেটা সুসান অ্যাক্রয়েড’ লন্ডন-এর গর্টন কলেজ থেকে গ্রাজুয়েট হয়ে বেরিয়েছেন, ভারতবর্ষের মেয়েদের লেখাপড়ার বিষয়ে দারুণ উৎসাহী। মনমোহন ঘোষের আমন্ত্রণে তিনিও চলে এলেন কলকাতায়। স্কুল পরিচালনার জন্য তৈরি হল এক পাকাপোক্ত কমিটি। এই কমিটির সদস্য কলকাতা হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি স্যার জে. বি. ফিয়ার, দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায়, মনমোহন ঘোষ, দুর্গামোহন দাস আর কেশবচন্দ্র সেন। অ্যাক্রয়েড আর দ্বারকানাথের উদ্যোগে এবং দুর্গামোহন ও মনমোহনের আর্থিক সহায়তায় ২২ নম্বর বেনিয়াপুকুর লেনে গড়ে উঠল মেয়েদের স্কুল ‘হিন্দু বোর্ডিং স্কুল’; কুমারী অ্যাক্রয়েড হলেন স্কুলের সম্পাদিকা ও ইংরাজি শিক্ষিকা। এই স্কুল চলেছিল আড়াই বছরের মতো।

এই স্কুলের পাঠ্যসূচি নিয়ে ব্রাহ্মদের এক প্রগতিশীল গোষ্ঠীর সঙ্গে কেশবচন্দ্রের দ্বিমত ছিল। কেশব সেন পাঠ্যসূচিতে বিজ্ঞান ও অঙ্ক রাখেননি। প্রগতিশীল গোষ্ঠীর পুরোভাগে থাকা দ্বারকানাথ শুধু বিজ্ঞান ও অঙ্ক শেখান নয়, মেয়েদের উচ্চশিক্ষা লাভের জন্য প্রধান উদ্যোক্তা হয়ে ওঠেন। দুর্গামোহনও চাইছিলেন তাঁর দুই মেয়ে সরলা ও অবলাকে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলতে। এই প্রেক্ষিতেই বালিগঞ্জ-এ ‘বঙ্গ মহিলা বিদ্যালয়’ প্রতিষ্ঠিত হয়। স্কুলের জন্য অকাতরে অর্থ সাহায্য করেন ব্যারিস্টার মনমোহন ঘোষ।

কেমন চলেছে এই স্কুলের পড়াশুনা? ১৮৭৭ সালে ছাত্রবৃত্তি পরীক্ষায় অন্যান্য স্কুলের সঙ্গে বঙ্গ মহিলা বিদ্যালয়ের ছাত্রীরাও  অবতীর্ণ হল। মোট পরীক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল ৪৩, পাশ করে ১৩ জন—পাশের হার শতকরা ৩০। এই ১৩ জনের মধ্যে বঙ্গ মহিলা বিদ্যালয় থেকে ৫ জন উত্তীর্ণ হন। প্রথম হন কাদম্বিনী বসু (প্রাপ্ত নম্বর ২৫০ এর মধ্যে ১৫১), ইনিই পরবর্তীকালে বাংলার প্রথম মহিলা ডাক্তার কাদম্বিনী গঙ্গোপাধ্যায়, দ্বিতীয় সরলা দাস (প্রাপ্ত নম্বর ১৩৮, সরলা দুর্গামোহনের কন্যা, অবলার দিদি)—এঁরা দুজনেই অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী। আরও যাঁরা উত্তীর্ণ হয়েছিলেন তাঁদের মধ্যে ছিলেন সুবর্ণপ্রভা বসু (সপ্তম শ্রেণির ছাত্রী, জগদীশচন্দ্র বসুর ভগ্নী), অবলা দাস আর সরলা মহলানবিশ (ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্রী)।

সমসাময়িক ব্রাহ্ম নেতা গুরুচরণ মহলানবীশ ‘হিন্দু মহিলা বিদ্যালয়’ প্রতিষ্ঠার সিংহভাগ কৃতিত্ব দিয়েছেন দুর্গামোহন দাসকে।

‘কেহ কোন ভাল কাজ করিলে তিনি (দুর্গামোহন) মুক্ত হস্তে দান করিতেন। এজন্য আমরা তাঁহার নাম রাখিয়াছিলাম ‘গৌরী সেন’। স্বর্গীয় আনন্দমোহন বসুর সহিত মিলিত হইয়া ব্রাহ্ম বালিকাদিগের জন্য অ্যাক্রয়েড স্কুল প্রতিষ্ঠা করিয়াছিলেন। সেই স্কুল বেথুন কলেজের সহিত যুক্ত হইয়া যায়। ‘সে সময়ের শিক্ষা বিভাগের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী বঙ্গ মহিলা বিদ্যালয় হল—’In every sense, the most advanced school in Bengal.’

এই বিদ্যালয়ের মেয়েরাই পরবর্তীকালে বাংলার গর্ব। মহিলাদের মধ্যে প্রবেশিকা পরীক্ষার জন্য প্রথম তৈরি হন সরলা দাস (অবলার দিদি) ও কাদম্বিনী বসু। পরীক্ষার আগেই মাতা ব্রহ্মময়ীর মৃত্যু, প্রসন্নকুমার রায়ের সঙ্গে বিয়ে হয়ে যাওয়ায় সরলা পরীক্ষা দিতে পারেননি। ১৮৮০ সালে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন কামিনী সেন (পরবর্তীকালের কবি কামিনী রায়) ও সুবর্ণপ্রভা বসু। মহিলাদের তৃতীয় দল পরীক্ষা দেন ১৮৮১ সালে। ওই দলে ছিলেন অবলা দাস ও কুমুদিনী খাস্তগীর। পরীক্ষা পাশের পর অবলা বেথুনের কলেজ বিভাগে ভর্তি হন। ১৮৮২ সালে কাদম্বিনী বসু এবং অবলা দাস মেডিকেল কলেজে পড়ার জন্য আবেদন করেন। সেই আবেদন মঞ্জুর হয়নি। তখন নিয়ম ছিল একমাত্র স্নাতক হলেই ডাক্তারি পড়া যাবে। কাদম্বিনী, অবলা তখন সবে এফ. এ. পাশ করেছেন। এতে কলকাতায় প্রচণ্ড আলোড়ন সৃষ্টি হয়। অবশেষে বাংলা সরকারের মাসিক ২০ টাকা বৃত্তি নিয়ে অবলা দাস মাদ্রাজ মেডিকেল কলেজে ডাক্তারি পড়ার জন্য রওনা হন। মাদ্রাজ মেডিকেল কলেজে মেয়েদের পড়ার ব্যাপারে কোনো বাধানিষেধ ছিল না। অবলা তাঁর স্মৃতিকথায় লিখছেন—

‘মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সিতে বঙ্গ দেশের ন্যায় স্ত্রীলোকের অবরোধ প্রথা নাই। সম্ভ্রান্ত পরিবারের স্ত্রীলোকরা বাহিরে যান না বটে, কিন্তু মধ্যবিত্ত স্ত্রীলোকদের আবশ্যকমতো বাহিরে যাইতে দেখিয়াছি।’

তখনকার সেই রক্ষণশীল সমাজে সর্বপ্রথম এক বাঙালি মেয়ের চার দেয়ালের গণ্ডি ভেঙে সূদূর মাদ্রাজে ডাক্তারি পড়তে যাওয়া এক যুগান্তকারী ঘটনা। তাঁর এই যাত্রাকে ব্রাহ্মসমাজ বা কলকাতার প্রগতিশীল মানুষেরা কীভাবে গ্রহন করেছিলেন তার নমুনা পাওয়া যাবে অবলাকে লেখা শিবনাথ শাস্ত্রীর চিঠি থেকে। শিবনাথ লিখেছেন—

‘তুমি Jenson দের বাড়ীতে স্থান পাইয়াছ শুনিয়া আমি যে কী পর্যন্ত আহ্লাদিত হইয়াছি তাহা তোমাকে বলিতে পারি না। …. নাবিক সমুদ্রে পোত পাঠাইয়া যেরূপ অপেক্ষা করে তোমাকে মাদ্রাজ পাঠাইয়া ব্রাহ্মসমাজ সেইরূপ অপেক্ষা করিতেছেন জানিবে।’

তিনি মাদ্রাজ মেডিকেল কলেজে দ্বিতীয় বর্ষের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে প্রশংসাপত্র পেয়েছিলেন। তারপর তিনি শেষ পরীক্ষা না দিয়ে তার কিছু আগেই ফিরে আসেন। ১৮৮৫ সালের জুলাই মাসে অবলা ফার্স্ট এল.এম. এস. পরীক্ষায় বসেন। সে বছর ৮৪ জন পরীক্ষার্থীর মধ্যে ছাত্রী ছিলেন ১৪ জন। ৮৪ জনের মধ্যে ৪৭ জন পাশ করেন যার মধ্যে অবলা দাসও ছিলেন। ১৮৮৬ সালে সেকেন্ড এল. এম. এস. পরীক্ষায় একটি অন্যতম বিষয় ‘midwifery’ বা ধাত্রীবিদ্যায় স্বর্ণপদক পেয়েছিলেন অবলা। মাদ্রাজে প্রথম থেকেই তিনি বারবার ম্যালেরিয়ায় ভুগছিলেন। অসুস্থতা বাড়াবাড়ি রকমের হওয়ায় ডাক্তারি কোর্স শেষ না করেই ফিরে আসতে বাধ্য হন। এটা তাঁর জীবনের চরম ট্র্যাজেডি। মাদ্রাজ মেডিকেল কলেজের ওয়েবসাইটের বয়ান অনুযায়ী ১৮৮৮ সালে অবলা দাসকে সাম্মানিক এল. এম. এস. ডিগ্রি দেওয়া হয়।

১৮৮৭ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি জগদীশচন্দ্র বসুর সঙ্গে অবলা দাসের বিয়ে হয়। অবলার বিবাহিত জীবনের পর্যায়ক্রম তিনটি। প্রথম অধ্যায়ের সময়সীমা ১৮৯৪ সাল পর্যন্ত। এই সময়ে অবলা নিজেকে গড়ে তোলেন জগদীশচন্দ্রের যোগ্য সহধর্মিনী অবলা বসু হিসেবে। অবলার বিবাহিত জীবনের দ্বিতীয় পর্যায় শেষ হয় ১৯১০ সালের শুরুতে। এই সময়ে তিনি ভারতবর্ষে আধুনিক বিজ্ঞানচর্চার প্রতিষ্ঠায় জগদীশচন্দ্রের কর্মপ্রয়াসের উৎসাহদাত্রী হিসেবে নিজেকে পুরোপুরি সমর্পণ করেছেন। পরবর্তী পর্যায়ে ১৯১০ সালে অবলা ‘ব্রাহ্ম বালিকা বিদ্যালয়ের’ সম্পাদিকা হন। তারপর থেকে ১৯৩৬ সাল পর্যন্ত ২৬ বছর তিনি অসামান্য যোগ্যতার সঙ্গে স্কুলটিকে পরিচালনা করেন।

দেবেন্দ্রমোহন বসু জগদীশচন্দ্র সম্বন্ধে লিখেছেন—

‘বৈজ্ঞানিক শখ ছেড়ে গুরুতর বৈজ্ঞানিক গবেষণার কাজে আত্মনিয়োগের অনুপ্রেরণা তিনি সম্ভবত লেডি বসুর কাছেই পেয়েছিলেন। একটি বক্তৃতায় জগদীশচন্দ্র একবার জানিয়েছিলেন যে ১৮৯৪ সালে ৩৬তম জন্মদিন পালনের সময় তিনি বৈজ্ঞানিক কাজে গভীরভাবে আত্মনিয়োগের সিদ্ধান্ত নেন।’

এই আত্মনিয়োগের পিছনে জগদীশচন্দ্রের সর্বক্ষণের মানসিক সঙ্গী ছিলেন লেডি অবলা বসু। অবলা বসুর কলমেই জেনে নেব বিলেতে জগদীশচন্দ্রের বক্তৃতার বিবরণ।

‘১৮৯৬ সালে আচার্য বসু মহাশয় অদৃশ্য আলোক সম্বন্ধে তাঁহার নূতন আবিষ্ক্রিয়া বৈজ্ঞানিক সমাজে প্রদর্শন করিবার জন্য ব্রিটিশ অ্যাসোসিয়েশনে আহূত হন। তাঁহার সহিত আমিও যাই। …. বক্তৃতার দিন হলটি বিখ্যাত বৈজ্ঞানিক দ্বারা পূর্ণ দেখিলাম। তাহার মধ্যে স্যার জে জে থমসন, অলিভার লজ ও লর্ড কেলভিন ছিলেন। এতকাল ত ভারতবাসী বিজ্ঞানে অক্ষম এই অপবাদ বহু কণ্ঠে ঘোষিত হইয়াছে, আজ বাঙ্গালী এই প্রথম বিজ্ঞান-সমরে বিশ্বের সম্মুখে যুঝিতে দন্ডায়মান। ফল কি হইবে ভাবিয়া আশঙ্কায় আমার হৃদয় কাঁপিতেছিল, হাত-পা ঠাণ্ডা হইয়া আসিতেছিল। তাহার মধ্যে যে কি হইল সে সম্বন্ধে আমার মনে স্পষ্ট কোন ছবি আজ এর নাই। তবে ঘন ঘন করতালি শুনিয়া বুঝিতে পারিলাম যে পরাভব স্বীকার করিতে হয় নাই বরং জয়ই হইয়াছে। দেখিলাম একজন বৃদ্ধ লাঠিতে ভার করিয়া গ্যালারিতে উঠিয়া আমাকে অভিবাদন করিয়া আচার্যের আবিষ্কার সম্বন্ধে বহুবিধ প্রশংসা করলেন। জানিতে পারিলাম, ইনিই অদ্বিতীয় বৈজ্ঞানিক লর্ড কেলভিন।’

অবলা অন্যত্র লিখেছেন—

‘(লন্ডন-এর) রয়্যাল ইনস্টিটিউশনের কার্যপদ্ধতি দেখিয়া তখন হইতেই আমাদের দেশে এরূপ কোন স্থান করিবার বাসনা আমার মনে উদয় হইল এবং বসু-বিজ্ঞান-মন্দিরের কল্পনা ও সূচনা তখন হইতেই আরম্ভ হইল।’

অর্থাৎ বসু বিজ্ঞান মন্দির স্থাপনের চিন্তা এসেছিল অবলা বসুর মনেই।

১৮৯৯ থেকে ১৯০৪ জগদীশচন্দ্রের গবেষণার বিষয় ছিল কোহেরারের (metallic coherer) অবসাদ প্রক্রিয়ার পর্যালোচনা, এইসব ধাতব কোহেরার তড়িৎ তরঙ্গ নির্ণয়ের (detection) জন্য ব্যবহার করা হত। এরপর জগদীশচন্দ্র অজৈব গোষ্ঠী নিয়ে পরীক্ষা করেন, যেগুলি ভৌত উত্তেজনার প্রভাবে জীবন্ত দেহের মতো একইভাবে সাড়া দেয়। এই সংক্রান্ত বিষয়গুলি নিয়ে জগদীশচন্দ্র ১৯০১ সালের ১০ মে লন্ডন-এর রয়্যাল সোসাইটিতে বক্তৃতা দেন। এই বক্তৃতায় অভূতপূর্ব সাফল্যের পর রবীন্দ্রনাথকে অবলা বসু যে চিঠি লেখেন তার উল্লেখ না করলে জগদীশচন্দ্রের গবেষণাকর্মে অবলা বসুর অন্তর্ভুক্তি অধরা থেকে যাবে।

[London]

17th May, 1901

শ্রদ্ধাস্পদেসু,

আপনি নানাজনের কাছ থেকে নানারকম খবর পাইয়া থাকিবেন, আমারও সামান্য কিছু বক্তব্য আছে—তাহা ভাল করিয়া লিপিবদ্ধ করিবার শক্তি যদিও আমার নাই তথাপি আমার সামান্য বক্তব্য সামান্য ভাষাতে আপনার নিকট উপস্থিত করিতেও আমার লজ্জা বোধ হইতেছে না। শুক্রবার দিন যদি বক্তৃতাতে আপনি উপস্থিত হইতেন তাহা হইলে বুঝিতে পারিতেন আমি লজ্জা ত্যাগ করিয়া কেন আপনার নিকট উপস্থিত হাইতেছি। সেদিন আমার মনে হইলো আমি স্ত্রী জাতির মধ্যে এমন কি পুণ্য করিয়াছিলাম! দীনা ভারতী বিজয়মাল্যে যে পুরুষরত্নকে শোভিত করিয়াছেন কি পুণ্যবলে আমি তাঁর সহধর্মিনী হইলাম!

আমার কেবল তাহাই মনে হইতেছিল। নিজের সৌভাগ্য স্মরণ করিয়া আহ্লাদ ও বিস্ময় যুগপৎ উদয় হইতেছিল। আপনিও যদি সেই বৈজ্ঞানিকমণ্ডলীর মধ্যে এই ক্ষুদ্র ভারতবর্ষীয় বিজ্ঞানীর নির্ভীক সত্যপ্রচার দেখিতেন তাহা হইলে স্তম্ভিত হইতেন,—সেদিন আর লোকে কী বালিবে সে ভয় ছিল না, ‘আমি সত্য লইয়া আসিয়াছি, তোমরা শ্রবণ কর’ এই ভাবই প্রকাশ হইতেছিল।

এই আমার বক্তব্য।

প্রনতা

শ্রী অবলা বসু।

শিকাগোতে এডউইন হার্বার্ট লুইসের বাড়িতে জগদীশচন্দ্র বসু ও অবলা বসু।

বাংলার মেয়ে কাদম্বিনী গঙ্গোপাধ্যায় সেকালের পুরুষশাসিত সমাজের মুখে ঝামা ঘষে যেভাবে এগিয়ে এসেছিলেন তা রক্ষণশীলরা হজম করতে পারেননি। তার মধ্যে দাঁড়িয়েই কাদম্বিনীর উত্থান ঘটেছিল। এর আগেই বা এই সঙ্গেই উত্থান ঘটতে পারত আর এক তরুণীর—বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসুর স্ত্রী অবলা দাসের। দুঃখের হলেও সত্য, ইতিহাস তাঁকে মনে রেখেছে শুধুই বিশ্ববরেণ্য বিজ্ঞানীর স্ত্রী হিসেবে বা বিধবা আশ্রম স্থাপনকারী এক বিশিষ্ট মানবী হিসেবে। কিন্তু তাঁরই তো প্রথম বাঙালি মহিলা ডাক্তার হওয়ার কথা!

অবলা বসুকে আমরা কেমন দেখেছি? জগদীশচন্দ্রের ভাষায় ‘আমার সহধর্মিনী একান্ত সে কালের’। সত্যিই কি তাই? অবলা বসু ছিলেন সে কালের আধুনিকাদের মধ্যে অন্যতম। নন্দলাল বসু আর অবন ঠাকুরের ছবি দিয়ে তাঁর ঘর সাজানো, তাঁর আসবাবে অজন্তার ভঙ্গিতে উৎকীর্ণ পদ্ম। বৈজ্ঞানিক স্বামীর সঙ্গে বিজ্ঞানসভায় ‘জড় পিণ্ডবৎ বাঙ্গললনার মতো’ বসে থাকেন। ইউরোপে গিয়ে দেখলেন সে দেশের ‘বৈজ্ঞানিকের স্ত্রীরাও খুবই পতিপ্রাণা ও পতির সেবায় নিযুক্ত’। অতএব তিনি সেভাবেই নিজেকে তৈরি করে নিয়েছিলেন। যে মহিলার স্বাবলম্বী হওয়ার ক্ষেত্রে বাঙালি মেয়েদের ‘রোল মডেল’ হওয়ার কথা, যিনি কলকাতায় মেডিকেল কলেজে মেয়েদের পড়ার সুবিধা নেই বলে মাদ্রাজে চিকিৎসা বিজ্ঞানের পাঠ নিতে গেলেন তবে অসুস্থতার কারণে পড়া ছেড়ে আদর্শ গৃহিণী হলেন—এটা তাঁর জীবনের ট্র্যাজেডি। 

১৯১০ থেকে ১৯৩৬ সাল পর্যন্ত অবলা বসু ব্রাহ্ম বালিকা বিদ্যালয়ের উন্নতির জন্য সর্বশক্তি নিয়োগ করেছেন। ১৯১৪ সালে ইউরোপ ভ্রমণ শেষে জগদীশচন্দ্র ও অবলা কিছুদিন জাপানে ছিলেন। সেখানকার নারীশিক্ষা সংক্রান্ত কর্মকাণ্ড অবলাকে নতুনভাবে অনুপ্রাণিত করে। এ প্রসঙ্গে তিনি লিখেছেন—

‘ …. কলকাতায় ফিরিয়া আমি আমার সকল বন্ধুবান্ধবদের সহিত এই বিষয়ে আলোচনা করি। তাঁহাদের উৎসাহে ও সাহায্যে ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে নারী শিক্ষা সমিতি প্রতিষ্ঠিত হয়।’

১৯২২ সালে ‘বিদ্যাসাগর বাণীভবন’ প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯২৬ সালে অবলা বসুর প্রচেষ্টায় বাণীভবনে শিল্প শিক্ষা বিভাগ খোলা হয়। যোগেশচন্দ্র বাগল তাঁর ‘বাংলার নারী’ প্রবন্ধে উল্লেখ করেছেন বিদ্যাসাগর বাণীভবনের প্রসঙ্গ।

‘বিদ্যাসাগর বাণীভবন আবাসিক বিদ্যালয়। … এখান হইতে শিক্ষাপ্রাপ্ত বহু ছাত্রী কখনও শিক্ষণ বিদ্যা আয়ত্তের পর, কখনও বা সরাসরি বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় বালিকা বিদ্যালয়ের শিক্ষয়িত্রী পদে নিযুক্ত হইতেন।‘ ‘সুকুমার রায়ের মৃত্যুর পর অবলা বসুর অনুরোধে সুকুমারের স্ত্রী সুপ্রভা বিদ্যাসাগর বাণীভবনে শিক্ষয়িত্রী পদে যোগ দিয়েছিলেন।

এবার একটু অন্য প্রসঙ্গে আসি। বিশ শতকের গোড়ার দিকে নারীর ভোটাধিকারের দাবি সোচ্চার হচ্ছিল ইংল্যান্ডে। এই সাফ্রিজেট (suffragatte) আন্দোলনের প্রভাব এসে পড়েছিল ভারতে এবং বাংলাতেও। ভারতে মহিলাদের এই আন্দোলন শুরু হয়েছিল ১৯১৭ সালে। সরোজিনী নাইডুর নেতৃত্বে মহিলারা ১৭ সেপ্টেম্বর দেখা করলেন মন্টেগু-চেমসফোর্ড মিশনের প্রতিনিধিদের সঙ্গে। দলে ছিলেন আইরিশ নারীবাদী মার্গারেট ই কাজিন্স, অ্যানি বেসান্ত, ডরোথি জিনারাজাদামা, উমা নেহরু, রামাবাঈ রানাডে ও অবলা বসু। নারীদের শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের অধিকার বিষয়ে তাঁরা সরব হয়েছিলেন, তবে মূল বিষয় ছিল মহিলাদের ভোটদান ও নির্বাচনে অংশগ্রহণের অধিকার, যাতে তাঁরা নিজেরাই নিজেদের সামাজিক সমস্যাগুলি সমাধানের রাস্তা খুঁজতে পারেন। বঙ্গীয় নারীসমাজ গঠনের মাধ্যমে বাংলাদেশে মহিলাদের ভোটাধিকারের দাবিতে আন্দোলন শুরু হয় ১৯২১ সালে। আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছেন কামিনী রায়, মৃণালিনী সেন, অবলা বসু, কুমুদিনী বসু, রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন প্রমুখ। ১৯২৪ সালে কলকাতা কর্পোরেশনের নির্বাচনে মহিলারা প্রথম অংশগ্রহণ করেন। ১৯২৫ সালে বেঙ্গল লেজিসলেটিভ কাউন্সিলে মহিলা ভোটাধিকার আইন পাশ হয়।

জগদীশচন্দ্রের মৃত্যু হয় ১৯৩৭ সালের ২৩ নভেম্বর। সুদীর্ঘ অর্ধশতাব্দীর জীবনসঙ্গীর মৃত্যুর পর অবলার জীবনে শুরু হয় এক নতুন অধ্যায়। এই সময় তিনি পুরোপুরি আত্মনিয়োগ করেন নারীকল্যাণমূলক বিভিন্ন কর্মপ্রয়াসে। মৃত্যুর সময় জগদীশচন্দ্র এক লক্ষ টাকার একটি ফান্ড রেখে যান। বয়স্কা নারীদের শিক্ষার জন্য অবলা এই অর্থ ব্যয়ের সিদ্ধান্ত নেন। ১৯৩৮ সালে স্থাপন করেন ‘সিস্টার নিবেদিতা উইমেনস এডুকেশন ফান্ড’, যা দিয়ে তৈরি হয় ‘এডাল্টস প্রাইমারী এডুকেশন সেন্টার’—ভারতবর্ষের নারীশিক্ষার ক্ষেত্রে ভগিনী নিবেদিতার কথা স্মরণ করে অবলার জীবনসায়াহ্নে এই শ্রদ্ধাঞ্জলি।

অবলা তাঁর পরিচালিত প্রতিষ্ঠানগুলিকে সার্থকতার পথে নিয়ে যেতে পরিণত বয়সেও অক্লান্ত পরিশ্রম করতেন। নিজের কন্যাসন্তান জন্মের সঙ্গে সঙ্গেই মারা গিয়েছিল বলে তাঁর মাতৃহৃদয় সবসময় উন্মুক্ত ছিল প্রতিটি দুঃখী মেয়ের জন্য। এক কর্মময় জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটল ১৯৫১ সালের ২৫ এপ্রিল।

আমরা কজন তাঁকে মনে রেখেছি?

সাহায্যকারী সূত্র:

১. Acharya Prafulla Chandra Ray Birth Centenary Souvenir Volume, Calcutta University, (1962).

২. শিবনাথ শাস্ত্রী, রামতনু লাহিড়ী ও তৎকালীন বঙ্গসমাজ, নিউ এজ পাবলিশার্স প্রা: লি:, (২০০৮)৷

৩. দিবাকর সেন সম্পাদিত, পত্রাবলী, বসু বিজ্ঞান মন্দির, (১৯৯৪)৷

৪. নারায়ণ দত্ত, ঝড়ের মেয়ে কাদম্বিনী, সূত্রধর, (২০১১)৷

৫. ড. সুনীতা বন্দ্যোপাধ্যায়, কালজয়ী কাদম্বিনী ও তাঁর কাল, ডলফিন, (২০১২)৷

৬. পার্থসারথি চট্টোপাধ্যায়, তিন মনীষী ও অবলা বসু, নাথ ব্রাদার্স, (১৯৯৮)৷

৭. অপরাজিত সাহিত্য পত্র, আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু বিশেষ সংখ্যা, (২০০৪)৷

৮. যোগেশচন্দ্র বাগল, হিন্দু মহিলা ও বঙ্গ মহিলা বিদ্যালয়, প্রবাসী, (১৩৫৭ বঙ্গাব্দ)৷

৯. দময়ন্তী দাশগুপ্ত, অবলা বসু: এক আলোকিত ভুবন, সাহিত্য পরিষদ পত্রিকা, ১৩১ বর্ষ, ১-২ সংখ্যা, (১৪৩১ বঙ্গাব্দ)৷

বিজ্ঞান আন্দোলনের কর্মী ও বিজ্ঞান লেখক। উল্লেখযোগ্য সম্পাদিত বই: প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ের প্রবন্ধ সংগ্রহ, স্মৃতি - সত্তায় আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র, প্রফুল্লচন্দ্র রায় : একটি সংক্ষিপ্ত পরিক্রমা, বিজ্ঞান বিস্ময়, নানা চোখে বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বসু, প্রবাসীর প্রফুল্লচন্দ্র ইত্যাদি

মন্তব্য করুন

আপনার ইমেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।