
সময়, সমাজ, ইতিহাস ও জেন অস্টেন
জেন অস্টেনের সমকালীন লেখক স্যর ওয়াল্টার স্কটের কথা শিক্ষিত বাঙালি শুনে থাকে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের সূত্র ধরে। যদিও বঙ্কিম নিজে জানিয়েছিলেন যে ‘দুর্গেশনন্দিনী’ লেখার আগে তিনি স্কটের লেখা পড়েননি, তাও সাহেব স্কটের ‘আইভান হো’র প্রভাবেই নেটিভ বঙ্কিম ইতিহাস আশ্রিত রোমান্স-ধর্মী উপন্যাস লিখেছেন, এ জল্পনা থামেনি। বঙ্কিম অবশ্য পরবর্তীকালে স্কটের লেখা খুব মন দিয়ে পড়েছিলেন, তবে স্কটের সমকালীন জেন অস্টেনকে সেভাবে পড়েছিলেন কি? বঙ্কিমের লেখায় অস্টেনের উল্লেখ চোখে পড়েনি। তবে স্কট ও জেন অস্টেনের সমসাময়িক এক প্রভাবশালী ব্যক্তি, বাংলার বড়লাট ওয়ারেন হেস্টিংস, স্কটের মতো জেন অস্টেনেরও ভক্ত পাঠক ছিলেন। জেন অস্টেনের পরিবারের সঙ্গে হেস্টিংস-এর বন্ধুত্বও ছিল বেশ নিবিড়। ভারতের বড়লাটের পাশাপাশি জেন অস্টেনের আর এক ভক্ত পাঠক ছিলেন ইংল্যান্ডের রাজাও। যদিও জেনের উপন্যাসগুলো তাঁর জীবদ্দশায় স্বনামে প্রকাশিত হয়নি, বেরিয়েছিল ‘এ লেডি’ নামে, তবে ‘প্রাইড অ্যান্ড প্রেজুডিস’ ঘিরে বিপুল আলোড়নের সূত্রে অনেকেই লেখিকা জেনের নাম ও পরিচয় জেনে গিয়েছিলেন। ‘ম্যানসফিল্ড পার্ক’ বা ‘এমা’-ও অস্টেনের নামে বেরোয়নি, তবে এগুলির লেখিকা কে, তা ছিল এক ওপেন সিক্রেট। জেন অস্টেন রাজ দরবারে ডাকও পেয়েছিলেন তাঁর লেখার জোরে। একটি উপন্যাসের বিশেষ সংস্করণ রাজাকে উৎসর্গ করে উপহারও দিয়েছিলেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কার ইংল্যান্ডের বিখ্যাত রাজনীতিবিদ তথা প্রধানমন্ত্রী, উইনস্টন চার্চিল, যিনি নিজেও সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন, ছিলেন জেন অস্টেনের নভেলের বিশেষ ভক্ত। বিশ্বযুদ্ধের কঠিন সময়ে উদ্বেগ কাটাতে তিনি জেন অস্টেন পড়তেন বলে চার্চিল তাঁর স্মৃতিকথায় জানিয়েছেন। সমকাল থেকে উত্তরকাল – সাধারণ মানুষের পাশাপাশি সর্বোচ্চ পর্যায়ের রাষ্ট্রপ্রধান তথা রাজনীতিবিদ – যাঁরা ইতিহাসের ঘটনাগতিকে প্রবলভাবে প্রভাবিত করেছেন – জেন অস্টেনের ভক্ত পাঠক হলেও জেন অস্টেনের উপন্যাসে সমকালীন ইতিহাসের উপাদান কতটা আছে?
মনে রাখতে হবে জেন অস্টেন যে সময়টায় বড়ো হয়ে উঠছিলেন, লেখালিখি করছিলেন, সেটা ইতিহাসের এক ঝোড়ো সময়। ১৭৭৫ সালে জেন অস্টেনের জন্ম। তার আঠারো বছর আগে পলাশীর যুদ্ধের মধ্যে দিয়ে ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের গোড়াপত্তন হয়েছে। আর জেনের জন্মের চোদ্দ বছরের মাথায় ঘটবে ফরাসি বিপ্লব, যা ইতিহাসকে বদলে দেবে, সূচনা করবে এক নতুন যুগের। জেনের জন্মের বছরটি থেকেই শুরু হওয়া আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধের কথাও এই প্রসঙ্গে মনে রাখা দরকার। ইংল্যান্ড তথা ইউরোপ ও বিশ্ব-ইতিহাসের সেই আলোড়ন তোলা সময়টা থেকে পেছনে, মধ্যযুগে ফিরে গিয়েছিলেন স্যর ওয়াল্টার স্কট। আর জেন রাজনৈতিক উতরোলের বাইরে থাকা গ্রামীণ অভিজাতদের প্রেম-বিবাহকে তাঁর উপন্যাসের উপজীব্য করেছিলেন। জেন অস্টেনের মতোই আর এক পৃথিবী-বিখ্যাত ইংরেজ ঔপন্যাসিক চার্লস ডিকেন্স যেভাবে সমকাল দ্বারা স্পৃষ্ট হয়েছিলেন, তাঁর উপন্যাস-কল্পনা ‘এ টেল অব টু সিটিজ’-এ যেভাবে ফরাসি বিপ্লবের সময়টাকে ধরেছিলেন বা অগুনতি লেখায় ইংল্যান্ডের সমকালীন সমাজ পরিবেশকে যেভাবে এনেছিলেন ডিকেন্স, তার একেবারে অন্য মেরুতে দাঁড়িয়ে আছেন জেন অস্টেন।
কিন্তু এতদসত্ত্বেও এরকম একটা হঠকারী সিদ্ধান্ত আমরা নিয়ে নিতে পারি না যে জেন অস্টেন একজন সময় – সমাজ – রাজনীতি বিযুক্ত উপন্যাসকার, রোমান্টিক আখ্যানের জন্ম দিয়ে পাঠকের মন মাতানোই যার প্রধান ও পরম উদ্দেশ্য। এভাবে দেখাটা সাহিত্যের অত্যন্ত যান্ত্রিক বিশ্লেষণ হবে। ইতিহাসের দূরগত সময়কাল সম্পর্কেও ধারনাটিও হবে একপেশে।
জেন অস্টেনের ‘প্রাইড অ্যান্ড প্রেজুডিস’-এ ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের যুদ্ধের আবহে তৈরি মিলেশিয়ার প্রসঙ্গ গুরুত্ব নিয়ে এসেছে বা ‘ম্যানসফিল্ড পার্ক’-এ রয়েছে ওয়েস্ট ইন্ডিজের কলোনিতে বাণিজ্য ও মুনাফার কথা অথবা ‘পারসুয়েশন’-এ নৌ বাহিনীর ক্যাপ্টেনদের কথা – কেবল এইসব মনে রেখেই আমরা জেন অস্টেনকে সময় সচেতন বলছি না। জেনের উপন্যাসে সমাজ ও সময়চেতনা কীভাবে অভিব্যক্ত তা বুঝতে হলে ঘটনার আলোড়নের বাইরে গিয়ে আমাদের তাকাতে হবে উপন্যাসের অন্তর্বয়ানের দিকে।
কিছুক্ষণের জন্য ধরে নেওয়া যাক একজন পাঠকের কথা যিনি আমাদের মতো দূর দেশকালে বসে জেন অস্টেন পড়ছেন। ফরাসি বিপ্লব বা আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধের সাল তারিখ কিছু কিছু জানলেও আমাদের সেই কল্পিত পাঠকটি বিশদে ইতিহাস পড়েননি কখনো। তবে সাহিত্য, বিশেষত গল্প-উপন্যাস পড়তে ভালোবাসেন। জেন অস্টেনের উপন্যাসগুলি বেশ মনোযোগ দিয়ে একাধিকবার তিনি পড়েছেন বলে ধরে নেওয়া যেতে পারে। যদি তাঁকে সে সময়ের ইংল্যান্ড সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হয়, তিনি কি এর নানা দিকের একটা ছবি ফুটিয়ে তুলতে পারবেন? দেখার বিষয় হল, সে সময়ের ইংল্যান্ড সম্পর্কে তাঁর প্রিয় জেনের উপন্যাসের ভিত্তিতে তিনি কী কী বলতে পারবেন আর কোন কোন বিষয়ে তিনি নীরব থাকবেন।
সে সময়ের ইংল্যান্ডের রাজা-রানী-রাজনীতি সম্পর্কে আমাদের কল্পিত এই অস্টেন পাঠক কিছুই বলতে পারবেন না। সে সময় যুদ্ধ চলছিল। স্থায়ী সেনাবাহিনীর বাইরে মিলেশিয়া তৈরি হয়েছিল, তরুণেরা তাতে সামিল হচ্ছিল, তাদের নিয়ে তরুণী মনে আগ্রহ-উৎসাহ ছিল – ‘প্রাইড অ্যান্ড প্রেজুডিস’ ভালোভাবে পড়া থাকার সূত্রে এসব খবর তিনি দিতে পারলেও কাদের সঙ্গে কার যুদ্ধ হচ্ছিল আর কেনই বা এই যুদ্ধ, এই সব প্রসঙ্গে তাঁকে নীরব থাকতে হবে। এই মিলেশিয়া বা তার সালতামামি তিনি বলতে পারবেন না। স্থলবাহিনীর পাশাপাশি নৌবাহিনীরও বেশ গুরুত্ব ছিল – এই খবর তিনি ‘পারসুয়েশান’ উপন্যাসের ভিত্তিতে জানতে পারলেও এর বিস্তারিত তথ্য হাজির করা তার পক্ষে সম্ভব হবে না।
তবে একথাও আমাদের ভুললে চলবে না যে অস্টেনের অনেক উপন্যাসেই মিলেশিয়া ও নেভি বা সেখানে কর্মরতদের অনেক প্রসঙ্গ এসেছে। ‘প্রাইড অ্যান্ড প্রেজুডিস’-এর গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র উইকহ্যাম মিলেশিয়াতে কর্মরত, তা ছাড়াও মিলেশিয়াতে কাজ করা বেশ কয়েকজনের কথা এখানে আছে। নর্দাঙ্গার অ্যাবিতেও এসেছে সেনাবাহিনীর এক জেনারেল ও এক ক্যাপ্টেনের কথা, যারা নায়ক হেনরি টিনলের বাবা ও দাদা। তবে সেনাবাহিনী, বিশেষ করে নৌবাহিনীতে কর্মরত মানুষজনের কথা সবচেয়ে বেশি করে এসেছে ‘পারসুয়েশান’ উপন্যাসে। সেনাবাহিনী ও নেভি সম্পর্কে নানা ধারণা ও তথ্য সংবাদপত্রের পাতা বা বইপত্র থেকে যেমন জেন অস্টেন পেয়ে থাকবেন, তেমনই পেয়েছেন তার দাদাদের মুখ থেকে শোনা নানা বর্ণনা ও কাহিনী থেকে। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য জেনের দাদা ও ভাই – অস্টেন পরিবারের ষষ্ঠ ও অষ্টম সন্তান হলেন যথাক্রমে ফ্রান্সিস অস্টেন ও চার্লস জন অস্টেন। তারা দুজনেই ব্রিটিশ রয়াল নেভির অ্যাকাডেমিতে পড়াশুনো করেন ও তারপর নেভির চাকরীতে যোগ দেন। তারা উভয়েই দুটি করে বিয়ে করেন এবং উভয়েরই অনেক সন্তান সন্ততি নিয়ে বেশ বড়োসড়ো পরিবার ছিল। চার্লস নেভির কাজে জাহাজেই বেশি থাকতেন। জেন অস্টেন তার এই ছোটো ভাইয়ের সঙ্গে খুব বেশি সময় কাটানোর সুযোগ পাননি। তবে ফ্রান্সিস ও তার পরিবারের সঙ্গে জেন বেশ কিছু সময় কাটিয়েছিলেন ও সেই সূত্রে নেভি সম্পর্কে বেশ খানিকটা পরোক্ষ অভিজ্ঞতা লাভ করেছিলেন।
ইংল্যান্ডের সে সময়ের শ্রেণিবিন্যাস সম্পর্কে তিনি বেশকিছু কথা অবশ্যই জানাতে পারবেন। বিশেষ করে তিনটি শ্রেণি সম্পর্কে। অভিজাত, জমিদার গোছের জেন্ট্রি ও ব্যবসায়ী বুর্জোয়া সম্পর্কে বেশ কিছু গভীর পর্যবেক্ষণ তাঁর থেকে আমরা পাব। কিন্তু ‘এমা’ উপন্যাসের ভিত্তিতে রবার্ট মার্টিন নামক এক কৃষক ও তার পরিবার বিষয়ক কিছু খণ্ডচিত্র হাজির করতে পারলেও সে সময়ের ইংল্যান্ডের এক প্রধান শ্রেণি – নবোদিত ওয়ার্কিং ক্লাস বা শ্রমিকশ্রেণি সম্পর্কে আমাদের এই কল্পিত উপন্যাস পাঠক তেমন কিছুই জানাতে পারবেন না। এরপর যদি তাঁর হাতে ডিকেন্স রচনাবলী ধরিয়ে দেওয়া হয় তাহলে তিনি বিস্মিত হয়ে ভাববেন ডিকেন্সের উপন্যাসে এই যে এত দরিদ্র শ্রমিক, জেন অস্টেনের উপন্যাসে তারা একেবারেই নেই কেন। ধরে নিচ্ছি ইংল্যান্ডের শিল্প বিপ্লবের ইতিহাস সম্পর্কে অল্পকিছু আমাদের এই কল্পিত পাঠকের জানা আছে। তাই তিনি ভেবে নিতে পারেন ডিকেন্স হলেন এই শিল্প বিপ্লবের পরের কালের মানুষ আর জেন অস্টেন ঠিক আগের।
জেন অস্টেন আর ডিকেন্স পাশাপাশি পড়লে এঁদের পার্থক্য বিষয়ে আমাদের এই পাঠক বলবেন ডিকেন্স-এর উপন্যাস থেকে তিনি ইংল্যান্ডের শহরকে চিনেছেন আর জেন অস্টেন থেকে এই দেশের গ্রাম ও খামারকে। জেন অস্টেন আর ডিকেন্স – উনিশ শতকের এই দুই ঔপন্যাসিকের উপন্যাসের শ্রেণি আলাদা, ভূগোলও আলাদা।
ভূগোলের কথা প্রসঙ্গে জানতে ইচ্ছে হয় জেন অস্টেনের উপন্যাস পাঠক ইংল্যান্ডের কোন কোন এলাকা সম্পর্কে আমাদের জানাতে পারবেন। লন্ডন সম্পর্কে কিছু এলোমেলো খবর দেওয়া ছাড়া তিনি জানাতে পারবেন লাইম রিজিস-এর মতো সমুদ্র তীরবর্তী শহরটি সম্পর্কে। আর যে শহরটির বর্ণনা তিনি খুব ভালোভাবে দিতে পারবেন সেটি হল বাথ। জেন প্রথম যে উপন্যাসটির খসড়া লিখেছিলেন, সেই সুসান – যা সবার শেষে তাঁর মৃত্যুর পরে ‘নর্দাঙ্গার অ্যাবে’ নামে ছাপা হল – সেখানে বাথ শহরের অনুপুঙ্খ বর্ণনা আছে।
জেন অস্টেনের উপন্যাস পাঠক সেই সময়কার ইংল্যান্ডের যানবাহন সম্পর্কে বেশ বিস্তারিত বর্ণনা দিতে পারবেন আর এক্ষেত্রেও ‘নর্দাঙ্গার অ্যাবে’ হবে তাঁর অন্যতম সহায়। সে সময়ের ইংল্যান্ডের সমস্ত যানই ছিল ঘোড়ায় টানা। ঘোড়ারা বেশি দূর একটানা যেতে পারত না। বিশ্রাম, খাওয়া দাওয়া বা বদলের দরকার পড়ত। আজকের দিনে মোটরগাড়ির রসদের জন্য যেমন পেট্রোল পাম্প থাকে, সেই সময় তেমনি ঘোড়ার রসদ যোগানের জন্য রাস্তার মাঝে মাঝে ব্যবস্থা রাখতে হত। ঘোড়ার গাড়ি ছিল নানা রকমের। মাল টানা গাড়ি ছিল সবচেয়ে ধীর গতির। সবচেয়ে দ্রুত গতির ছিল ডাকবহনের গাড়ি। ডাকবহনের গাড়ি চারজন করে লোকও নিতে পারত। ব্যক্তিগত বা পরিবারের চলাচলের গাড়ি ছাড়াও ছিল নানা রকমের পাবলিক ক্যারেজ। ব্যক্তিগত ও পারিবারিক গাড়ির মধ্যে ছিল কোচ, চেইজ, গিগ, ল্যান্ডাউ, বারুচ৷ কোন গাড়ি কীরকম, কোন শ্রেণির লোক সে গাড়িতে চড়ত – সেই ধারনাও জেন অস্টেনের উপন্যাস পাঠক দিতে পারবেন।
বিনোদন সম্পর্কে যদি তাকে প্রশ্ন করা হয়, তিনি বলবেন বল নাচের কথা। এর রীতিনীতিও তিনি জানাতে পারবেন বেশ বিস্তারে। ‘প্রাইড অ্যান্ড প্রেজুডিস’ বা ‘নর্দাঙ্গার অ্যাবে’র পাঠ তাঁকে অনেকটাই সাহায্য করবে। তবে থিয়েটার সম্পর্কে তিনি কিছু ভুল তথ্য ও ধারনা সরবরাহ করে বসতে পারেন ‘ম্যানসফিল্ড পার্ক’ পাঠের সূত্রে। তার মনে হতে পারে তরুণেরা থিয়েটারে আগ্রহী হলেও প্রবীণ মুরুব্বী গোছের লোকেরা বোধহয় থিয়েটারকে নিচু নজরে দেখতেন। কিন্তু তা একেবারেই সঠিক হবে না। অবশ্য নর্দাঙ্গার অ্যাবের সূত্রে ম্যানসফিল্ড পার্ক-এর পাঠ-অভিজ্ঞতা থেকে আসা ভুল ধারনাকে খানিকটা ঠিক করে নেওয়ার সুযোগ তিনি পাবেন। আবার ম্যানসফিল্ড পার্কের সূত্রেই সে সময়কার ইংল্যান্ডের একটি শ্রেণির কথা জানাতে আমাদের এই পাঠকের অসুবিধে হবে না, যাঁরা উপনিবেশের দেশ-দেশান্তরে মুনাফার লোভে যেতেন ও সেখান থেকে প্রভূত অর্থ উপার্জন করে ইংল্যান্ডে ফিরে আসতেন।
এক কল্পিত পাঠকের চোখ দিয়ে জেনের জগতকে দেখার চেষ্টা করার পর একটি উপন্যাসের নিবিড় পাঠের মধ্যে দিয়ে আমরা নিজেরা এবার অস্টেন ও তাঁর সময়কে একটু বোঝার চেষ্টা করি। এক্ষেত্রে আমরা বেছে নিচ্ছি অস্টেনের সবচেয়ে জনপ্রিয় উপন্যাস ‘প্রাইড অ্যান্ড প্রেজুডিস’কে। জেন অস্টেন ইংল্যান্ডের যে সমাজ পটভূমিতে তাঁর উপন্যাসগুলিকে স্থাপন করেছেন সেখানে মূলত পাঁচটি শ্রেণি রয়েছে। অভিজাত, জমিদার ভদ্রলোক, বুর্জোয়া মিল মালিক ও ধনী ব্যবসায়ী, শ্রমিক শ্রেণি ও কৃষক শ্রেণি। তার লেখায় সমাজের উপরের স্তরের তিন শ্রেণির মানুষদেরই মূলত দেখা যায়, শ্রমিক ও কৃষক শ্রেণির তেমন প্রতিনিধিত্ব নেই। অভিজাত মানুষেরা – ডিউক, মার্কুইস, আর্ল, ভাইক্যান্ট ইত্যাদি মাঝে মাঝে উপন্যাসে দেখা দেন বটে, কিন্তু জমিদার ভদ্রলোক ও বুর্জোয়া ব্যবসায়ীরাই উপন্যাসের মূল চরিত্র। ‘প্রাইড অ্যান্ড প্রেজুডিস’ উপন্যাসে লেডি ক্যাথরিন একজন আর্ল-এর কন্যা এবং তিনি অভিজাত সমাজের প্রতিনিধি। কর্নেল ফিজ উইলিয়ামও এক আর্ল পরিবারের সন্তান এবং ‘স্যর’ খেতাবধারী তথা অভিজাত। কিন্তু বিরাট জমিদারী থাকলেও মিস্টার ডার্সির অভিজাত খেতাব নেই, তিনি জমিদার ভদ্রলোক শ্রেণির প্রতিনিধি। অন্যদিকে বেনেট পরিবারও জমিদার ভদ্রলোক শ্রেণিরই মানুষ, যদিও তাদের জমিজমা এবং আয় অনেক কম। উপন্যাসের শেষের দিকে লেডি ক্যাথরিন যখন নায়িকা এলিজাবেথকে বোঝানোর চেষ্টা করছিলেন, ডার্সির সঙ্গে তার সামাজিক বিন্যাস মেলে না, তখন এই কারণেই এলিজাবেথ লেডি ক্যাথরিনকে মুখের উপর জানিয়ে দিয়েছিল ডার্সি যেমন একজন ভদ্রলোক জমিদার, সেও তেমনি এক ভদ্রলোক জমিদারের মেয়ে, একই সামাজিক বর্গের মানুষ তাঁরা। বাস্তবে অবশ্য এক সামাজিক বর্গের মধ্যেও তফাৎ কত ব্যাপক হয়ে থাকে, সেটা এই উপন্যাসে বারবার ধরা পড়েছে। ডার্সির বন্ধু এবং এই উপন্যাসের অন্যতম প্রধান চরিত্র মিস্টার চার্লস বিংলে কিন্তু জমিদার সম্প্রদায়ের মানুষ নন। তাঁদের ধন-সম্পদের উৎস পারিবারিক ব্যবসা এবং তারা বুর্জোয়া ব্যবসায়ী শ্রেণির প্রতিনিধি। এদের অনেকেই সে সময় জমিদারী কিনে জমিদার ভদ্রলোক শ্রেণিতে প্রবেশের জন্য ব্যগ্র ছিলেন। চার্লস বিংলের বোন ক্যারোলিন বিংলের মধ্যে এই সংক্রান্ত উদগ্র আকাঙ্ক্ষা আমরা দেখেছি। সমাজের উপরতলার এই তিনটি শ্রেণির প্রতিনিধিরা নিজ নিজ সামাজিক বর্গের অহংকার ও সংস্কার নিয়ে কিভাবে পরস্পরের সঙ্গে সম্পর্কের নানা জাল জটিলতায় জড়িয়ে পড়ে, বিত্ত ও চিত্তের নানামুখী দ্বন্দ্ব কিভাবে আবির্ভূত ও মীমাংসিত হয় – ‘প্রাইড অ্যান্ড প্রেজুডিস’ উপন্যাসটি সেই কাহিনীকেই আকর্ষণীয় ও জীবন্তভাবে তুলে ধরেছে।
চরিত্রদের আয় এবং সচ্ছলতা কতটা, সেই সম্পর্কে ‘প্রাইড অ্যান্ড প্রেজুডিস’-এর লেখিকা উপন্যাসে তার বেশ কিছু স্পষ্ট গাণিতিক হিসেব দিয়েছেন। সেই হিসেবকে আজকের মূল্যমানে রূপান্তর করে, এমনকি আমাদের টাকার অঙ্কে নিয়ে এসে আমরা চরিত্রদের আর্থিক সঙ্গতি-অসঙ্গতিকে বুঝে নেবার চেষ্টা করতে পারি।
মিস্টার ডার্সির আয় বছরে দশ হাজার পাউন্ড। মিস্টার বিংলের আয় বছরে সাড়ে চার হাজার পাউন্ড। এই আয় আজকের হিসেবে কত? অন্তত তিরিশ গুণ। হয়ত আরো সঠিক বিচারে প্রায় তেত্রিশ গুণ। সেই নিরিখে আজকের ভারতীয় মুদ্রায় প্রাইড অ্যান্ড প্রেজুডিসের নায়ক মিস্টার ডার্সির আয়ের পরিমাণ অন্তত বার্ষিক তিন কোটি টাকা। মিস্টার বিংলের আয় এক কোটি পঁয়ত্রিশ লক্ষ টাকার কাছাকাছি। অন্যদিকে মিস্টার বেনেট মারা গেলে সম্পত্তি চলে যাবে নিকটতম পুরুষ আত্মীয় মিস্টার কলিন্সের কাছে, মিসেস বেনেট ও তার কন্যার জন্য সব মিলিয়ে থাকবে মোট পাঁচ হাজার পাউন্ড বা আজকের হিসেবে দেড় কোটি টাকার সম্পত্তি। এই টাকাটা ব্যাঙ্কে রাখলে সুদ বার্ষিক ৫% হলে তা বাবদ বেনেট পরিবারের বার্ষিক আয় দাঁড়াবে ২৫০ পাউন্ড। লিডিয়া উইকহ্যামের সঙ্গে বিয়ের পরে তার অংশটি অর্থাৎ মোট এক ষষ্ঠাংশর হিসেব বুঝে নেয় ও তার সম্পত্তি থেকে সুদ বাবদ বার্ষিক আয় দাঁড়ায় বছরে চল্লিশ পাউন্ড, আজকের ভারতীয় মুদ্রায় বার্ষিক এক লক্ষ কুড়ি হাজার টাকা বা মাসিক মাত্র দশ হাজার টাকা। উইকহ্যামের স্থায়ী আকর্ষণীয় কোনও জীবিকা না থাকায় এজন্যই বিয়ের পর তাদের অন্যদের থেকে সাহায্য নিয়ে কৃচ্ছসাধনের মধ্যে দিয়ে দিন চালাতে হত।
সমকালের ঐতিহাসিক প্রসঙ্গ জেন অস্টেনের উপন্যাসে কমই এসেছে। ‘পারসুয়েশন’ উপন্যাসটিতে নেপোলিয়নের পরাজয়ের পর ব্রিটিশ সেনাদের ঘরে ফেরার প্রসঙ্গ ছিল। প্রাইড অ্যান্ড প্রেজুডিস-এ এসেছে ফরাসি বিপ্লবের পর ফ্রান্স থেকে আসা সম্ভাব্য আক্রমণের মোকাবিলার জন্য স্থায়ী সৈন্যবাহিনীর পাশাপাশি মিলেশিয়া গড়ে ওঠার প্রসঙ্গ। এই ঘটনাপর্বকেই জেন অস্টেন তাঁর উপন্যাসে ব্যবহার করেছেন যদিও ঐতিহাসিক পটটিকে বিস্তারে ব্যবহার করেননি। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য জেনের দাদা হেনরি অস্টেন নিজেই অক্সফোর্ডশায়ার মিলেশিয়ার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ১৮০১ সালে সেই কাজ থেকে সরে এসে তিনি তাঁর ব্যাঙ্কিং জীবন শুরু করেন। ঠিক কোন বছরগুলির কথা এই উপন্যাসে এসেছে সে সম্পর্কে অবশ্য অস্টেন বিশেষজ্ঞ গবেষকদের মধ্যে কিছু ভিন্নমত দেখা যায়। আর. ডব্লু. চ্যাপম্যান মনে করেছেন শেষতম পরিমার্জনের পর ১৮১১-১২ সালের সঙ্গেই ‘প্রাইড অ্যান্ড প্রেজুডিস’-এর ঘটনাপর্ব মিলে যায়। অন্যদিকে পি. বি. এস. অ্যান্ড্রুজ মনে করেছেন ১৮০২-০৩ সালের পুনর্মাজনের সময়কার দিনকালটিই উপন্যাসে অনুসৃত। এই বিতর্কে খুব নির্দিষ্টভাবে প্রবেশ না করে ১৭৯০ থেকে ১৮২০ – ইংল্যান্ডের ইতিহাসের রিজেন্সি যুগের প্রেক্ষাপটকে ‘প্রাইড অ্যান্ড প্রেজুডিস’ ধারণ করে আছে – সাধারণভাবে এটা মাথায় রেখেই আমরা উপন্যাসটির রসগ্রহণ করতে পারি। বস্তুতপক্ষে ফরাসি বিপ্লবের পর জেকোবিয়ান ফ্রান্সের মোকাবিলার আবহেই ইংল্যান্ডে মিলেশিয়াগুলি জন্ম নিয়েছিল। নেপোলিয়নের ফ্রান্সের মোকাবিলার সময়কাল, ১৮১৫ অবধিও সেগুলি সক্রিয় ছিল।
আকর –
1. Janet Todd (Ed.), Jane Austen in Context, Cambridge University Press, 2005.
2. Mary Waldron, Jane Austen and the Fiction of Her Time, Cambridge University Press, 1999.
3. Deirdre Le Faye, Jane Austen: The World of Her Novels, Harry N. Abrams, 2002.
4. Janet Todd (Ed.), The Cambridge Introduction to Jane Austen, Cambridge University Press, 2006.
5. Edward Copeland (Ed.), The Cambridge Companion to Jane Austen, Juliet McMaster, 1997.
6. Laura Lambdin & Robert Lambdin, A Companion to Jane Austen Studies, Greenwood, 2000.
ভালো লাগল। স্কুল পাঠ্য হিসেবে প্রথম জেন অস্টেন পড়েছি, পরে কতকটা কৌতূহল বশত পড়ে ফেলেছি। আমার মনে হয় বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন সামাজিক ব্যবস্থার জলছবি অস্টেনের লেখায় মোটামুটি ভাবে একই ছকের মধ্যে ফেলা যায়। অর্থাৎ এরকম জিনিস অমুক দেশের তমুক শহরের গল্প বলে চালিয়ে দেওয়া যায়! এটা আমার বেশ চিত্তাকর্ষক লেগেছে এই জন্যে, অস্টেন বাইরের খোলসটা ভেদ করে ভিতরের মানুষটাকে খুঁজেছেন।