ইহুদি গল্প এবং ডিএনএ প্রমাণের সাহায্যে একটি পুনর্মূল্যায়ন
“আপনি শুনেছেন যে বলা হয়েছিল, ‘আপনার বন্ধুদের ভালবাসুন, আপনার শত্রুদের ঘৃণা করুন।’ কিন্তু এখন আমি আপনাকে বলছি: আপনার শত্রুদের ভালবাসুন এবং যারা আপনাকে অত্যাচার করে তাদের জন্য প্রার্থনা করুন।”
– গুড সামারিটানের দৃষ্টান্ত -বাইবেল, ম্যাথু ৫:৪৩-৪৭
ইজরায়েল এবং ফিলিস্তিনের জাতিসত্তার মানচিত্র (চিত্র ঋণ-reddit)
প্রাককথন
ভূমধ্যসাগরের একেবারে পূর্বদিকে এই দেশ—ইজরায়েল, সেই প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে এই দেশ ছিল যুদ্ধের রক্তে মেতে ওঠা বিড়ম্বিত, শরণার্থী মানুষের বিচরণস্থান। অসম্মানিত মানুষের ছেলেভুলানো স্বপ্নে ‘নির্বাচিত মানুষ’-এর (Chosen people) দার্ঢ্যের তীব্র গন্ধে মাতোয়ারা একদল শরণার্থী মানুষের পিতৃপুরুষের দেশ।
“কেননা তোমরা তোমাদের ঈশ্বর হাশেমের কাছে পবিত্র মানুষ, এবং পৃথিবীর সমস্ত জাতি থেকে ঈশ্বর তোমাদেরকে তাঁর মূল্যবান লোক হিসেবে মনোনীত করেছেন৷”
– তোরাহ্, ইহুদি বাইবেল, অধ্যায় ১৪
এশিয়া ও ইউরোপের যোগবন্ধন—দুই মহাদেশের পুরানো চিন্তার আবর্জনা আর নতুন চিন্তার উন্মেষের টানাপোড়েনে বিভ্রান্ত এক দেশ। একদিকে বিপুল ঐতিহ্য, তৎসহ সংকীর্ণতা ও তা রক্ষায় জান কবুল লড়াই—অন্য দিকে চূড়ান্ত আধুনিকতা ও উদার মনোভাবের সহাবস্থান এই দেশ, ইজরায়েল।
তবে ইজরায়েল শুধু এক দেশ নয়, অনাদিকাল থেকে সভ্যতার ভরকেন্দ্র এই অঞ্চল। যুগের পরে যুগ ধরে মানুষের টিঁকে থাকার লড়াই চলেছে এই অনুর্বর ভূমিতে। সেই ‘নিয়েন্ডারথল’ ও ‘অ্যানাটোমিকালি আধুনিক মানুষ’-এর সময় থেকে চলছে জমি দখলের লড়াই — হয় এসপার, নয় ওসপার।
একসময়ে পরাজিত ইহুদিরা ছড়িয়ে পড়ে পৃথিবী জুড়ে। চলে যায় ভূমধ্যসাগরীয় ইউরোপের বিভিন্ন দেশে, পূর্ব ইউরোপ ও জার্মানিতে, উত্তর আফ্রিকায়, রাশিয়ায় এমনকি সামান্য পরিমাণে চলে আসে এই ভারতে। অবশ্য অনেকে থেকে গেছেন মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে।
ইজরায়েল হারিয়ে যায় পৃথিবীর মানচিত্র থেকে—নব নব নামে পরিচিত হয় ভূমধ্যসাগরের পূর্ব দিকের এই অঞ্চল।
ইউরোপের সেমিটিজম বিরোধিতার চিরন্তন ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে ঊনবিংশ শতকের শেষ থেকে আধুনিক যুগে আবারও ইজরায়েল রাষ্ট্র নির্মাণ চিন্তার উন্মেষ হয়, ‘ওয়ার্ল্ড জিওনিস্ট অর্গানাইজেশন’-এর পত্তন থেকে এই আন্দোলনের শুরু। ইজরায়েল-এর ভূমি অনুর্বর, বানজার—তেল আভিভের বাইরে যেদিকে দু চোখ যায় ধু ধু মরুভূমি। ঝলসে যাওয়া পাথরের গায়ে হলদে, শুকিয়ে ঝামা হয়ে যাওয়া দুই গাছা ঘাস। এখনো ওই মরু প্রান্তরে থাকেন অল্প কিছু বেদুইন।
ঐতিহ্যগতভাবে কৃষির উপর ভিত্তি করে ফিলিস্তিন-এর মধ্যে ১৯০৯ সাল থেকে ছোটো ছোটো ইহুদি বসতি গড়ে ওঠে। অটোম্যান সাম্রাজ্যের পতনের পরে এই কাজে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ ইজরায়েল রাষ্ট্র নির্মাণে সক্রিয় সহায়তা করেছে। ইহুদিরা নিপীড়িত হয়েছেন মূলত ইউরোপে। হলোকস্ট-এ ইউরোপীয় ইহুদিদের বেশিরভাগ ধ্বংসের পরে ১৯৪৭ সালে জাতিসংঘের ভোট হল ব্রিটিশ ম্যান্ডেট-এ ফিলিস্তিনকে দুটি রাষ্ট্রে বিভক্ত করার জন্য—একটি ইহুদিভূমি, একটি আরবভূমি। ইহুদিভূমিতে বসবাসকারী ফিলিস্তিনিদের বেশিরভাগ অংশ হয় বহিষ্কৃত হয়েছিলেন বা পালিয়ে গেছিলেন পাশের দেশে।
অপরিচিত দেশ, অনুর্বর ভূমি, মানুষগুলোর ভাষা বিভিন্ন, ধর্মে কেউ বিশ্বাসী, কেউ অবিশ্বাসী। তারা এসেছেন ইউরোপ, এশিয়া, উত্তর আফ্রিকা, উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকা থেকে। নিজেদের মধ্যে যোগাযোগের ভাষা নেই। প্রাচীন ভুলে যাওয়া ভাষা হিব্রু শিখে নিয়ে সেই ভাষাতেই তাঁরা এখন সাহিত্য লেখেন, আধুনিকতম প্রযুক্তির গবেষণা করেন।
স্বভাবতই ফিলিস্তিন বা প্রতিবেশী আরব দেশগুলো আধুনিক ইজরায়েল প্রতিষ্ঠাকে মেনে নেয়নি। ইহুদিদের সঙ্গে তাদের সশস্ত্র সংগ্রাম এখনো চলেছে।
এই প্রসঙ্গে মনে আসে, একটা প্রশ্ন — ইহুদিরা পাশের ফিলিস্তিন বা প্রতিবেশীদের থেকে জিনগতভাবে কতটা ভিন্ন? তাদের নিজেদের ‘নির্বাচিত মানুষ’-এর তকমা বিজ্ঞান কি মেনে নেয়?
জিনতত্ত্ববিদ্যা
আমরা জানি জীবদেহ গঠিত কোষ দিয়ে; আর সব কোষে আছে কয়েক ধরনের ডিএনএ। এই ডিএনএ বিশ্লেষণ করে আমাদের পূর্বজদের সম্পর্কে অনেক তথ্য পাওয়া যায় — যেমন, প্রজাতির উৎপত্তি ও সেই প্রজাতির বিবর্তন। গত দুই দশকে জিনতত্ত্ববিদদের সহায়তায় দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষের ডিএনএ বিশ্লেষণ করা হয়েছে। আমার বা আপনার ডিএনএ বিশ্লেষণ করলে আমাদের পিতামাতার উৎসের কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া যাবে।
আমাদের কোষের ‘মাইটোকন্ড্রিয়াল ডিএনএ’ আসে মায়ের দিক থেকে। আবার ‘ওয়াই-ক্রোমোজোম ডিএনএ’ আসে কেবল বাবার দিক থেকে। এই ডিএনএ কেবল পুরুষদের জনন কোষে থাকে। পুরুষের জনন কোষের ‘ওয়াই-ক্রোমোজোম ডিএনএ’ একমাত্র পিতার থেকে পুত্রতে প্রবাহিত হয়। এই ডিএনএ কোনো নারীর শরীরে থাকে না। ‘মাইটোকন্ড্রিয়াল ডিএনএ’ দিয়ে যেমন মাতৃক্রমের উৎসের সন্ধান পাওয়া যায় তেমনই ‘ওয়াই-ক্রোমোজোম ডিএনএ’ বিশ্লেষণ করে পিতৃক্রমের খোঁজ পাওয়া যেতে পারে।
তবে মানুষের শরীরে প্রতিটি কোষে থাকে আরও অনেক ক্রোমোজোম; সঠিকভাবে বললে ২৩ জোড়া ক্রোমোজোম থাকে। এর মধ্যে ২২ জোড়াকে বলে অটোজোম। বাকি এক জোড়া শুধুমাত্র জনন ক্রোমোজোম। পুরুষ ও নারীর অটোজোমে কোনও পার্থক্য কিন্তু নেই। অটোজোমের মধ্যে যে ডিএনএ থাকে তাকে বলে ‘অটোজোমাল ডিএনএ’। স্বভাবতই ‘অটোজোমাল ডিএনএ’ বিশ্লেষণ করে ওই ব্যক্তির পূর্বপুরুষ ও পূর্বনারীর অনেক বেশি তথ্য পাওয়া যায়।
যে কোনো প্রাণীর সমস্ত জিনের সেটকে সামগ্রিকভাবে বলে জিনোম। গত শতাব্দীর শেষ দশকে উন্নত দেশগুলির সহযোগিতায় ‘হিউমান জিনোম প্রজেক্ট’ নামে এক রিসার্চ প্রোগ্রাম শুরু হয়। ‘হিউমান জিনোম প্রজেক্ট’-এর লক্ষ্য ছিল মানুষের জিনোমের পূর্ণ চিত্র আঁকা। এই প্রকল্পের ফলে বিশ্বজোড়া বিভিন্ন জনগোষ্ঠী থেকে সংগৃহীত জিনোমিক তথ্যের এক বিশাল ভাণ্ডার তৈরি করা সম্ভব হয়েছে।
কিছু পরীক্ষা কিছু তথ্য
ইহুদিদের পিতৃক্রমের পরিচয়
ফিলিস্তিন ও ইজরায়েলি উভয় জনগোষ্ঠীই মূলত ভুমধ্যসাগরের পূর্ব অঞ্চলের আদিবাসী। ইহুদিদের অনেকগুলো শাখা রয়েছে, এদের মধ্যে প্রধান হল ‘আশকেনাজি’, ‘সেফার্ডিক’, ‘মাগরেবি’ এবং ‘মিজরাহি’। ইজরায়েল থেকে বিভিন্ন ডায়াস্পোরা বা বহিষ্কারের পরে লেভান্ত এবং মধ্যপ্রাচ্যে যে ইহুদিরা থেকে গিয়েছিলেন তাঁরা ‘মিজরাহি’ শাখার অন্তর্গত। মধ্যপ্রাচ্যের ‘মিজরাহি’ ইহুদি, উত্তর আফ্রিকার ‘মাগরেবি’ ইহুদি, স্প্যানিশ ‘সেফার্ডিক’ ইহুদি, ইতালীয় ও পূর্ব ইউরোপীয় ‘আশকেনাজি’ ইহুদি এবং ফিলিস্তিনিরা সকলেই বংশগতভাবে পিতৃক্রমের দিক দিয়ে একই ধরনের ‘ওয়াই ক্রোমোজোম ডিএনএ’ বহন করেন।
এই সমস্ত জনগোষ্ঠীর মধ্যে সবচেয়ে সাধারণ ‘ওয়াই-ক্রোমোজোম ডিএনএ’ হল J৷ প্রায় ৩৫-৪৩ শতাংশ ইহুদি পুরুষের ওয়াই ক্রোমোজোম ডিএনএ হল J এবং এর সাব-হ্যাপ্লোগ্রুপগুলো৷ এই হ্যাপ্লোগ্রুপটি বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্য এবং দক্ষিণ ইউরোপে পাওয়া যায়। ১৫ থেকে ৩০ শতাংশের E1b1b1 হ্যাপ্লোগ্রুপ রয়েছে।১ প্রসঙ্গত উল্লেখ করা দরকার যে, ভারতবর্ষের শিয়া মুসলমানদের মধ্যে E1b1b1a ও J ‘ওয়াই-ক্রোমোজোম ডিএনএ’-এর সন্ধান পাওয়া যাওয়া যায়৷ তা আবার সুন্নিদের মধ্যে পাওয়া যায় না।২ ভারতবর্ষের সুন্নিদের ‘ওয়াই-ক্রোমোজোম ডিএনএ’-র জিনোমিক প্রোফাইল ভৌগোলিকভাবে পার্শ্ববর্তী অমুসলিম অর্থাৎ হিন্দুদের সঙ্গেই মেলে।
ইহুদি ও তার প্রতিবেশীদের মধ্যে পারস্পরিক জিনগত সম্পর্ক
তবে শুধু ‘ওয়াই-ক্রোমোজোম ডিএনএ’ বিশ্লেষণ করেই ইহুদি ও ফিলিস্তিনিদের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক পুরোটা বোঝা যায় না। তার জন্য প্রয়োজন ‘অটোজোমাল ডিএনএ’ বিশ্লেষণ করে পুরো তথ্য তুলনা করা। ২০১৩ সালে সাতটি ইহুদি জনগোষ্ঠীর (ইরানীয়, ইরাকীয়, সিরিয়, ইতালীয়, তুর্কি, গ্রিক এবং ‘আশকেনাজি’ ইহুদি) ২৩৭ জন অসম্পর্কিত ব্যক্তির প্রত্যেকের থেকে তাদের ডিএনএ সংগ্রহ করা হয়েছে। এদের ডিএনএ বিশ্লেষণ করে জিন বৈচিত্রের নমুনা নিয়ে ‘হিউম্যান জিনোম ডাইভারসিটি প্রজেক্ট’ থেকে প্রাপ্ত অ-ইহুদিদের সূত্র নমুনার সঙ্গে তুলনা করা হয়েছিল।৩
এই গবেষণার ফল থেকে ইহুদিদের দুটি প্রধান গোষ্ঠীকে চিহ্নিত করা গেছে —
- মধ্যপ্রাচ্যের ইহুদি (ইরানীয়, ইরাকীয়), এবং
- ইউরোপীয়/সিরিয় ইহুদি।
ইহুদিদের এই দুই দলের মধ্যে বিভক্তি প্রায় ২,৫০০ বছর আগে ঘটেছিল। ইহুদিদের উভয় গোষ্ঠীর ডিএনএ যথাক্রমে সেই সময়ের মধ্যপ্রাচ্য এবং দক্ষিণ ইউরোপীয় জনগোষ্ঠীর ডিএনএ-এর সঙ্গে সংযুক্ত।
- এই সমীক্ষার ফলাফলগুলি দেখাচ্ছে যে, ইহুদি জনগোষ্ঠীগুলির মধ্যে সবচেয়ে ভিন্ন হল ইরানীয় ইহুদিরা এবং তারপরে ইরাকীয় ইহুদিরা। সবচাইতে বেশি মিল গ্রিক এবং তুর্কি ‘সেফার্ডিক’ ইহুদিদের মধ্যে যারা ইতালিয়, সিরিয় এবং ‘আশকেনাজি’ ইহুদিদের কাছাকাছি অবস্থান করে (চিত্র ২)। এইভাবে, দুটি প্রধান গোষ্ঠী শনাক্তযোগ্য এবং এদের মধ্যপ্রাচ্যের ইহুদি এবং ইউরোপীয়/সিরিয় ইহুদি হিসেবে চিহ্নিত করা যেতে পারে।
- ‘আশকেনাজি’ ইহুদি জনগোষ্ঠী গঠনে মধ্য ও পূর্ব ইউরোপীয় এবং স্লাভিক জনগোষ্ঠীর বৃহৎ আকারের জেনেটিক অবদান আছে—এমন প্রচলিত ধারণা এই তথ্যের সাহায্যে খণ্ডন করা গেছে।
- ইউরোপীয় এবং সিরিয় ইহুদিরা একটি সাধারণ শাখা থেকে ভাগ হয়ে গেছে এবং তাতে অ-ইহুদি ইউরোপীয় জনগোষ্ঠী প্রভাব ফেলেছিল।
- দ্রুজ, ফিলিস্তিনি এবং বেদুইনরা অন্যান্য জনগোষ্ঠীর থেকে আলাদা শাখায় অবস্থান করছে।
- মধ্যপ্রাচ্যের ইহুদিদের নিকটতম জিনগত অ-ইহুদি আত্মীয় হল দ্রুজ, বেদুইন এবং ফিলিস্তিনিরা। ধর্মে এরা সকলেই মুসলমান।
দ্রুজ একটি একেশ্বরবাদী ধর্ম ও এক সামাজিক সম্প্রদায়ও বটে। দ্রুজ–দের মূল আবাসভূমি সিরিয়া-লেবানন অঞ্চল। ইজরায়েল ও জর্ডন-এ দ্রুজ ধর্মকে আলাদা ধর্ম হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয় না। কারণ এই ধর্মের ভিত্তি মূলত ইসলাম; এটি শিয়া ইসলামের একটি শাখা। তবে দ্রুজ-দের সামাজিক রীতিনীতি মুসলিম, ইহুদি ও খ্রিস্টানদের থেকে অনেকটা ভিন্ন।
বেদুইনরা এক যাযাবর জাতি—এরা একসময়ে শুধুমাত্র বর্তমান ইজরায়েল ও ফিলিস্তিনের অধিবাসী ছিলেন। আজকে বেদুইন জনগোষ্ঠী মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন এলাকায় বসবাস করেন। গোত্রভিত্তিক জীবনযাপনে অভ্যস্ত এই সম্প্রদায় নিজেদেরকে প্রকৃত আরব বলে দাবি করেন। এরা ধর্মে মূলত মুসলমান।
ফিলিস্তিন বা প্যালেস্টাইন—সরকারিভাবে ফিলিস্তিন রাষ্ট্র নামে পরিচিত। এখানকার অধিবাসীদের বলে ফিলিস্তিনি। এরা সংস্কৃতি ও ভাষাগতভাবে আরব, ধর্মে মুসলমান।
বিভিন্ন ইহুদি জনগোষ্ঠীর পারস্পরিক জিনগত দূরত্ব
- জিনোম তথ্য থেকে দেখা যাচ্ছে, ইহুদিদের ইউরোপীয় গোষ্ঠীর নিকটতম জিনগত আত্মীয় হল উত্তর ইতালীয়রা, তারপরে সার্ডিনিয় এবং ফরাসিরা।
ইতালির ইহুদি সম্প্রদায়ের ইতিহাস প্রায় দুই হাজার বছরেরও বেশি সময় ধরে রয়েছে। সম্প্রদায়টি এই অঞ্চলে বারবার নিপীড়িত হয়েছে, বহিষ্কৃতও হয়েছে, তবে মাঝে মাঝে শাসক এবং সাধারণ জনগণের সঙ্গে সুসম্পর্কও থেকেছে।
‘আশকেনাজি’ হল বৃহত্তম ইহুদি গোষ্ঠী—বিশ্বব্যাপী সমস্ত ইহুদির আনুমানিক ৭০-৮০ শতাংশ ‘আশকেনাজি’। ‘আশকেনাজি’ ইহুদিরাই প্রধানত উত্তর ইতালিতে বসবাস করতেন। ইতালি, জার্মানি, পোল্যান্ড, রাশিয়া সহ মধ্য ও পূর্ব ইউরোপে ‘আশকেনাজি’ ইহুদিদের বাসস্থান ছিল। তারাই আধুনিক ইহুদি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলি গড়ে তুলেছিলেন।
সার্ডিনিয়া হল ভূমধ্যসাগরের দ্বিতীয় বৃহত্তম দ্বীপ। সার্ডিনিয়ার ইহুদিদের ইতিহাস দুই সহস্রাব্দেরও বেশি সময় ধরে পাওয়া যায়। এখানকার ইহুদি সম্প্রদায় স্পেনীয় এবং ইতালীয় বংশোদ্ভূত ‘সেফার্ডিক’ ইহুদিদের নিয়ে গঠিত। ‘সেফার্ডিক’-রা আইবেরিয়ায় (স্পেন ও পর্তুগাল) পালিয়ে গিয়ে বসতি স্থাপন করেছিলেন।
ফ্রান্সের ইহুদিদের ইতিহাস অন্তত মধ্যযুগ থেকে শুরু হয়েছে। মধ্যযুগে ফ্রান্স ছিল ইহুদি শিক্ষার কেন্দ্র, কিন্তু সময়ের সঙ্গে নিপীড়ন বেড়ে যায়, একাধিকবার বহিষ্কার ঘটে, পরে প্রত্যাবর্তনও হয়। আবার ১৮ শতকের শেষের দিকে ফরাসি বিপ্লবের সময়, ফ্রান্স ছিল প্রথম ইউরোপীয় দেশ যে তার ইহুদি জনগোষ্ঠীর উপর থেকে সব রকমের বিধিনিষেধ উঠিয়ে নিয়েছিল।
ভিন্ন একটি সমীক্ষায় অনেকটা একই ধরনের তথ্য এসেছে। প্রধান উপাদান বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে যে ইউরোপ, উত্তর আফ্রিকা এবং মধ্যপ্রাচ্যের ইহুদি জনগোষ্ঠী একটি শক্ত ক্লাস্টার তৈরি করেছে যা তাদের অ-ইহুদি প্রতিবেশীদের থেকে কিছুটা আলাদা করেছে (চিত্র ৩)।৪ এখানে উত্তর আফ্রিকার ইহুদিদের তৃতীয় প্রধান গোষ্ঠী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
উত্তর আফ্রিকার ইহুদিরা হল বিভিন্ন বৈচিত্র্যময় গোষ্ঠী যারা প্রাচীন কাল থেকে উত্তর আফ্রিকার বিভিন্ন অঞ্চলে বসবাস করে আসছেন। এদের মধ্যে মাগরেবি ইহুদি মধ্যযুগে উত্তর আফ্রিকায় বসবাস করতেন৷ সেফার্ডিক ইহুদিদের একটি গোষ্ঠী ১৫০০ সালের দিকে স্পেন থেকে উত্তর আফ্রিকায় চলে যায়।
বিভিন্ন ইহুদি সম্প্রদায়ের সঙ্গে ইউরোপীয়, মধ্যপ্রাচ্য এবং উত্তর আফ্রিকীয় জনগোষ্ঠীর সম্পর্ক এই চিত্র থেকে দেখা যায়।
ইহুদিদের পিতৃক্রমের ইতিহাস
ডিএনএ বিশ্লেষণ থেকে আরও কিছু তথ্য পাওয়া গেছে —
- বেশিরভাগ ইহুদি গোষ্ঠীর নিকটতম জিনগত প্রতিবেশী হল ফিলিস্তিনি, ইজরায়েলি বেদুইন, দ্রুজ এবং দক্ষিণ ইউরোপীয়রা।
- ফিলিস্তিনিদের (পাশাপাশি জর্ডানিয়দেরও) ওই অঞ্চলের বেদুইনদের সঙ্গে জিনগতভাবে আধাআধি মিল পাওয়া যায়। আবার মিশরীয়দের সঙ্গেও একটা দূরবর্তী সংযোগ পাওয়া যায়।
যে জনগোষ্ঠী তাদের জন্মভূমি ছেড়ে অন্য দেশে বসতি স্থাপন করতে বাধ্য হয়েছে বা বেছে নিয়েছে, তাদের বলে ডায়াস্পোরা। ইহুদিদের ক্ষেত্রে এমন ১৪টি· ডায়াস্পোরা বা বহিষ্কার হয়েছিল বলে তারা মনে করেন। ইহুদি জনগণের জিনোম-ডেটাবেসের উপরে গবেষকরা ১৪টি ইহুদি ডায়াস্পোরা গোষ্ঠীর ১২১ জন ব্যক্তির জিনোম থেকে কয়েক হাজার জেনেটিক বৈচিত্রের নমুনা সংগ্রহ করেছেন এবং এই রূপগুলির সঙ্গে তুলনা করেছেন আমেরিকার বাইরের অ-ইহুদি ৬৯টি জনগোষ্ঠী থেকে ১১৬৬ জন ব্যক্তির নমুনা।৪ দেখা গেছে ককেশাস (আজারবাইজান এবং জর্জিয়া), মধ্যপ্রাচ্য (ইরান ও ইরাক), উত্তর আফ্রিকা (মরক্কো) এবং ‘সেফার্ডিক’ ও ‘আশকেনাজি’ সম্প্রদায়ের ইহুদিরা—সামারিটানদের সঙ্গে একটা ক্লাস্টার বা গুচ্ছ গঠন করে যা আবার ইজরায়েলি দ্রুজ-দের সঙ্গে আংশিকভাবে সমাপতিত হয়।
আরেকটি মৌলিক গবেষণা থেকে জানা যায় যে,
- জর্ডানিয়, লেবানিয় এবং সিরিয়ানদের মতো ফিলিস্তিনিদের মধ্যে সাব-সাহারান আফ্রিকা থেকে মাতৃক্রমে ডিএনএ হ্যাপ্লোগ্রুপের জিন প্রবাহ রয়েছে।‘মাইটোকন্ড্রিয়াল-ডিএনএ’ ডিএনএ মা থেকে তার সন্তানদের মধ্যে প্রবাহিত হয়ে চলেছে। পরিব্যক্তির জন্য ‘মাইটোকন্ড্রিয়াল ডিএনএ’-র মধ্যে যে পার্থক্যগুলি হয়েছে তার সাহায্যে মায়ের দিক দিয়ে সমগ্র আধুনিক মানুষকে কিছু নির্দিষ্ট জেনেটিক গোষ্ঠীতে ভাগ করা যায়।৫
- ১১৭ ফিলিস্তিনি ব্যক্তির মধ্যে পরীক্ষা করে দেখা গেছে যে, ১৫ শতাংশ মাতৃক্রমে এমন হ্যাপ্লোগ্রুপ বহন করে যা সাব-সাহারান আফ্রিকায় (সাহারা অঞ্চলের বাইরের অংশ) উদ্ভূত হয়েছিল। এই ফলাফলগুলি গত কয়েক হাজার বছরের মধ্যে পূর্ব আফ্রিকা থেকে নিকটবর্তী অঞ্চলে মহিলাদের অভিবাসনের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। এই অঞ্চলে প্রধানত আফ্রিকীয় বংশোদ্ভূত নারীদের উপস্থিতির সবচেয়ে সম্ভাব্য ব্যাখ্যা হল যে তারা আরব দাস ব্যবসার অংশ হিসাবে আফ্রিকা থেকে আনা নারীদের অংশ ছিল, যা আরব শাসনের অধীন অঞ্চলগুলিতে পরবর্তীকালে আত্তীকরণ করা হয়েছিল।
অতঃ কিম
পিতৃক্রমে ইহুদি এবং ফিলিস্তিনিরা একে অপরের সঙ্গে সম্পর্কিত একথা আজ প্রমাণিত। ইহুদিদের জিনগত গবেষণায় দেখা গেছে যে ইহুদি এবং ফিলিস্তিনিরা একে অপরের অনেক কাছাকাছি অবস্থান করে ইহুদিদের পূর্ব বসতির জনগোষ্ঠীর তুলনায়। অর্থাৎ আরব এবং ইহুদিদের মধ্যে ‘ওয়াই-ক্রোমোজোম ডিএনএ’ বন্টন একই রকম ছিল কিন্তু অভিন্ন নয়।
ইহুদি এবং ফিলিস্তিনিরা যে জিনগত আত্মীয়তায় আবদ্ধ তা উপেক্ষা করা সহজ হতে পারে তবে বৈজ্ঞানিক গবেষণা দেখায় এদের একদিন সাধারণ পূর্বপুরুষ ছিল যাঁরা পাশাপাশি বাস করেছেন।
‘অধিকাংশ ইহুদি গোষ্ঠীর নিকটতম জিনগত প্রতিবেশী ছিল সিপ্রিয়ট সহ দক্ষিণ ইউরোপীয়দের পাশাপাশি ফিলিস্তিনি, ইজরায়েলি বেদুইন এবং দ্রুজ’, অস্ট্রার এবং স্কোরেকি তাদের অনুসন্ধানের পর্যালোচনাতে লিখেছেন ২০১২ সালে।
‘আমরা জানতে চাই যে আমরা কে এবং আমরা কোথা থেকে এসেছি,’ অস্ট্রার, ‘আশকেনাজি’ ইহুদি এবং উত্তর ইজরায়েলি দ্রুজ জনগোষ্ঠীর মধ্যে ক্যান্সারের ঝুঁকি নিয়ে গবেষণা করছেন, যোগ করেন। কেইন এবং অ্যাবেলের বাইবেলের গল্পের উদ্ধৃতি দিয়ে অস্ট্রার উল্লেখ করেছেন — ‘মানুষ একে অপরের সঙ্গে সম্পর্কিত এই সত্যটি একে অপরের প্রতি তাদের চরম শত্রুতা বৃদ্ধিতে বাধা দেয় না।’৬
তথ্যসূত্র
১. Ornella Semino, et al, “Origin, Diffusion, and Differentiation of Y-Chromosome Haplogroups E and J: Inferences on the Neolithization of Europe and Later Migratory Events in the Mediterranean Area” in ‘The American Journal of Human Genetics’, 74(5), pp. 1023–1034 (2004).
২. Muthukrishnan Eaaswarkhanth et al, “Traces of Sub-Saharan and Middle Eastern lineages in Indian Muslim populations” in ‘European Journal of Human Genetics’, 18, pp. 354–363 (2010).
৩. Gil Atzmon, et al, “Abraham’s Children in the Genome Era: Major Jewish Diaspora Populations Comprise Distinct Genetic Clusters with Shared Middle Eastern Ancestry” in ‘Am J Hum Genet.’, 11; 86(6): pp. 850–859 (2010).
৪. H Ostrer, K. Skorecki, “The population genetics of the Jewish people” in ‘Hum Genet.’, 132(2), pp. 119-127 (2013).
৫. Martin Richards, et al, “Extensive Female-Mediated Gene Flow from Sub-Saharan Africa into Near Eastern Arab Populations” in ‘American Journal of Human Genetics’, 72(4), pp. 1058–1064 (2003).
৬. Josie Glausiusz, “Blood Brothers: Palestinians and Jews Share Genetic Roots” in ‘Haaretz’, Oct 20, 2015 [https://www.haaretz.com/science-and-health/2015-10-20/ty-article/palestinians-and-jews-share-genetic-roots/0000017f-dc0e-df9c-a17f-fe1e57730000].
এ লেখাটির অসাধারণত্ব প্রকাশের ভাষা জানা নেই– জটিল একটি বিষয়ের এক স্বচ্ছ্ব ধারণা আপনার সুলেখায় রূপ পেয়েছে।
একটি প্রশ্ন– এ লেখায় যেসব জার্ণালের নাম দিয়েছেন আমাদের মত পাঠকেরা কোথায় দেখতে পাবেন সেসব।
ধন্যবাদ, কয়েকটি অনলাইনে পাবেন।