সূচী

ইতিহাস তথ্য ও তর্ক

পাঞ্চরাত্র ও ভারতীয় উপমহাদেশে বৈষ্ণব ধর্ম

পাঞ্চরাত্র ও ভারতীয় উপমহাদেশে বৈষ্ণব ধর্ম

জয়ন্ত ভট্টাচার্য

ডিসেম্বর ৭, ২০২৪ ২২০ 3

উদ্ভব ও ক্রমবিবর্তন

ভারতীয় উপমহাদেশে বৈষ্ণব ধর্মের প্রাচীন ইতিহাস নিয়ে চর্চার সময় আধুনিক বিদ্বানরা দীর্ঘ প্রচলিত ঐতিহ্যকে মেনে নিয়ে নারায়ণ, বাসুদেব কৃষ্ণ ও বিষ্ণুর উপাসকদের একত্রে বৈষ্ণব বলে অভিহিত করেছেন। কিন্তু, প্রাচীন বৈদিক সৌর দেবতা বিষ্ণু, মহাজাগতিক এবং সম্ভবত অবৈদিক দেবতা নারায়ণ এবং সাত্বত বা বৃষ্ণিবংশীয় বীর বাসুদেব কৃষ্ণ প্রথমে যে সম্পূর্ণ পৃথক দেবভাবনার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। বাসুদেবের দেবচিন্তন নারায়ণ ও বিষ্ণুর সঙ্গে একীকৃত হওয়ার পরেও তাঁর উপাসকরা দীর্ঘদিন পর্যন্ত নিজেদের ধর্মকে ভাগবত, সাত্বত বা একান্তী বলে অভিহিত করেছেন। প্রথম সহস্রাব্দের মাঝামাঝি পর্যন্ত বৈষ্ণব কথাটির ব্যবহার দেখা যায়নি। পঞ্চম শতক সাধারণাব্দের বর্তমান মহারাষ্ট্রের কোঙ্কণ এলাকার ত্রৈকূটকবংশীয় শাসক দহ্রসেন ও তাঁর পুত্র ব্যাঘ্রসেনের মুদ্রায় প্রথম বৈষ্ণব কথাটির প্রয়োগ দেখতে পাওয়া যায়। সেখানে, তাঁদের পরমবৈষ্ণব বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এর পূর্ববর্তী শাসকদের ক্ষেত্রে, যেমন, দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত ও তাঁর পরবর্তী গুপ্তবংশীয় শাসকদের লেখে তাঁদের পরমভাগবত বলে উল্লেখ করা হয়েছে। প্রাচীন লেখ ও মুদ্রায় এই ভাগবত কথাটির বহুল প্রয়োগের কারণে সাধারণত আধুনিক বিদ্বানরা ভারতীয় উপমহাদেশের প্রাচীনতম বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের নাম ভাগবত বলে উল্লেখ করেন। বাস্তবে, ভাগবত কথাটির অর্থ ভগবৎ উপাসক এবং বিভিন্ন প্রাচীন লেখে শিব, কার্তিকেয়, বাসুদেব এমনকি বুদ্ধ বা জিনেন্দ্রকেও ভগবৎ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। পতঞ্জলি তাঁর ব্যাকরণ মহাভাষ্য গ্রন্থে পাণিনির অষ্টাধ্যায়ী গ্রন্থের একটি সূত্রের (৫.২.৭৬) ব্যাখ্যায় শিবভাগবত কথাটি উল্লেখ করেছেন। তবে, যে সব প্রাচীন লেখে উপাস্য দেবতার নামের উল্লেখ নেই, সেখানে ভাগবত অর্থে অবশ্যই বাসুদেবের উপাসক বোঝানো হয়েছে। প্রাচীন লেখ ও সাহিত্যে ভাগবত কথাটির মাধ্যমে কোনও বিশিষ্ট বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের উল্লেখ করা হয়েছে, তার কোনও সুস্পষ্ট প্রমাণ নেই। একই কথা সাত্বত প্রসঙ্গেও প্রযোজ্য। প্রকৃতপক্ষে, পাঞ্চরাত্র সম্প্রদায় বা পাঞ্চরাত্রিকরাই ভারতীয় উপমহাদেশের প্রাচীনতম বৈষ্ণব সম্প্রদায় এবং সম্ভবত উপমহাদেশের প্রাচীনতম একান্তী, অর্থাৎ একেশ্বরবাদী ধর্মীয় সম্প্রদায়। ভারতীয় উপমহাদেশে পাঞ্চরাত্রিকদের উদ্ভব, ক্রমবিবর্তন ও প্রভাববিস্তারের ইতিহাস অত্যন্ত কৌতূহলোদ্দীপক। 

বাসুদেব-সঙ্কর্ষণ উপাসনা ও পাঞ্চরাত্র

পাণিনির অষ্টাধ্যায়ী গ্রন্থের একটি সূত্র থেকে বোঝা যায়, ঐ সময় বাসুদেব কথাটির সঙ্গে ‘বুন’ প্রত্যয় যুক্ত করে, অর্থাৎ বাসুদেবক বলে তাঁর ভক্তদের বোঝানো হতো। এর ভিত্তিতে আধুনিক বিদ্বান বিনয়তোষ ভট্টাচার্য বাসুদেবের উপাসক পাঞ্চরাত্র সম্প্রদায়ের অস্তিত্ব পাণিনির সময় অর্থাৎ সাধারণাব্দের পূর্ববর্তী প্রথম সহস্রাব্দের মাঝামাঝি বিদ্যমান ছিল বলে অনুমান করেছেন। পাণিনির বাসভূমি প্রাচীন শলাতুর নগর বর্তমান পাকিস্তানের খাইবার-পাখতুনখোয়া প্রদেশে অবস্থিত ছিল বলে আধুনিক বিদ্বানদের অনুমান। এই অঞ্চল প্রাচীন গান্ধারের অংশ ছিল। গান্ধার অঞ্চলে সাধারণাব্দের পূর্ববর্তী কয়েক শতকে বাসুদেব উপাসকদের অস্তিত্বের প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণও পাওয়া গেছে। ১৯৭০ সালে উত্তর আফগানিস্তানের তখর প্রদেশের আল-খানুম প্রত্নক্ষেত্রে ফরাসি প্রত্নতত্ত্ববিদরা একটি মৃৎপাত্রের মধ্যে গ্রিক ও ব্রাহ্মী লিপিতে ভারতীয়-গ্রিক শাসক অগথোক্লেস-এর (রাজত্বকাল আনুমানিক ১৮০-১৬০ সাধারণপূর্বাব্দ) নাম লেখা ভারতীয় চতুষ্কোণ কার্ষাপণ মুদ্রার আকারের ৬টি রৌপ্য মুদ্রার সন্ধান পান। মুদ্রাগুলির দুই পিঠে শঙ্খ ও চক্র ধৃত কৃষ্ণ এবং হল ও মুষল ধৃত সঙ্কর্ষণের দণ্ডায়মান প্রতিমা উত্কীর্ণ, এবং এই মুদ্রাগুলি সম্ভবত প্রাচীন তক্ষশিলায় নির্মিত বলে অনুমান করা হয়েছে। ১৮৭৭ সালে আলেকজান্ডার কানিংহাম বর্তমান মধ্যপ্রদেশের তৎকালীন ভিলসা (বর্তমান বিদিশা) শহরের কাছে বেসনগরে দ্বিতীয় শতক সাধারণপূর্বাব্দের হেলিওদোরাসের প্রতিষ্ঠিত স্তম্ভটি প্রথম খুঁজে পান। এরপর, ১৯০৯ সালে আবিষ্কৃত এই স্তম্ভের উপর ব্রাহ্মী লিপিতে উত্কীর্ণ একটি সংস্কৃত প্রভাবিত প্রাকৃত ভাষায় রচিত লেখ থেকে জানা যায়, তক্ষশিলার অধিবাসী, দিওনের পুত্র হেলিওদোরাস বর্তমান পাকিস্তানের খাইবার-পাখতুনখওয়া ও পাঞ্জাব অঞ্চলের ভারতীয়-গ্রিক শাসক আন্তিয়ালকিদাস নিকেফোরোস-এর (রাজত্বকাল আনুমানিক ১৩০-১২০ সাধারণপূর্বাব্দ) দূত এবং ভাগবত (অর্থাৎ বাসুদেবের উপাসক)। তিনি এই গরুড়ধ্বজ স্তম্ভটি স্থানীয় শাসক কাশীপুত্র ভাগভদ্রের রাজত্বকালের চতুর্দশতম বর্ষে দেবাদিদেব বাসুদেবের উদ্দেশে স্থাপন করেছেন। সাধারণাব্দের পূর্ববর্তী দ্বিতীয় শতকের শেষার্ধের গান্ধারের অধিবাসী হেলিওদোরাস যে বাসুদেবের উপাসক ছিলেন, তা স্পষ্টতই বোঝা যাচ্ছে। কিন্তু, সাধারণাব্দের পূর্ববর্তী কয়েক শতকের গান্ধারের বা প্রাচীন বিদিশার বাসুদেব উপাসকরা পাঞ্চরাত্র সম্প্রদায়ভুক্ত ছিলেন এ কথা নিশ্চিতভাবে বলা সম্ভব নয়। তবে, আধুনিক বিদ্বান জিতেন্দ্র নাথ ব্যানার্জির মতে, বেসনগরের উৎখননে প্রাপ্ত সঙ্কর্ষণের সঙ্গে যুক্ত তালধ্বজের স্তম্ভশীর্ষ, প্রদ্যুম্নের সঙ্গে যুক্ত মকরধ্বজের স্তম্ভশীর্ষ ও অন্যান্য প্রত্নবস্তু প্রমাণ করে  বেসনগর অর্থাৎ বিদিশা পাঞ্চরাত্র সম্প্রদায়ের অন্যতম প্রাচীন ধর্মীয় কেন্দ্র ছিল। রাজস্থানের চিত্তৌরগড়ের কাছে ঘোসুণ্ডি ও হাথিওয়াড়া থেকে প্রাপ্ত প্রথম শতাব্দী সাধারণপূর্বাব্দের সংস্কৃত শিলালেখে স্থানীয় শাসক সর্বতাত কর্তৃক নারায়ণ-বাটিকায় অবস্থিত সঙ্কর্ষণ ও বাসুদেবের পূজাশিলার প্রাকার নির্মাণের উল্লেখ রয়েছে।১০ প্রাচীন রাজস্থানের সঙ্কর্ষণ ও বাসুদেবের এই উপাসকদের দেবভাবনায় বাসুদেব ও নারায়ণ একীভূত হয়েছেন দেখা যাচ্ছে, কিন্তু এঁদের সঙ্গে পাঞ্চরাত্র সম্প্রদায়ের সম্পর্ক নির্ধারণ করা সম্ভব নয়।  

পঞ্চ বৃষ্ণিবীর উপাসনা ও পাঞ্চরাত্র

১৮৮২ সালে আলেকজান্ডার কানিংহাম উত্তর প্রদেশের মথুরা শহর থেকে ১০ কিমি. দূরে অবস্থিত মোরা গ্রামের একটি প্রাচীন কূপের উপর নির্মিত পাথরের ছাদে উত্কীর্ণ একটি লেখ খুঁজে পান। প্রথম শতাব্দী সাধারণাব্দের প্রথম দিকে শক শাসক মহাক্ষত্রপ রাজুবুলের পুত্র শোদাসের আমলের এই সংস্কৃত লেখে তোশা নামে জনৈক ব্যক্তির নির্মিত শৈলদেবগৃহে অর্থাৎ প্রস্তরের মন্দিরে স্থাপিত বৃষ্ণিবংশীয় পঞ্চবীরের পাথরের প্রতিমা পূজার জন্য স্থাপনের উল্লেখ রয়েছে।১১ এই লেখে পঞ্চবীরদের নামের উল্লেখ না থাকলেও, বিদ্যমান পুরাণ গ্রন্থসমূহের মধ্যে সম্ভবত প্রাচীনতম বায়ুপুরাণে (আনন্দাশ্রম সংস্করণ, ৯৭.১-২) বাসুদেব, সঙ্কর্ষণ (বসুদেব ও রোহিণীর পুত্র), প্রদ্যুম্ন (বাসুদেব ও রুক্মিণীর পুত্র), অনিরুদ্ধ (প্রদ্যুম্নের পুত্র) ও সাম্বকে (বাসুদেব ও জাম্ববতীর পুত্র) পঞ্চ বৃষ্ণিবীর বলে উল্লেখ করা হয়েছে। সাধারণাব্দের গোড়ার দিকে বা সম্ভবত তারও আগে থেকে মথুরায় প্রচলিত বৃষ্ণিবংশীয় পঞ্চবীরদের উপাসনার সঙ্গে পাঞ্চরাত্র সম্প্রদায়ের সম্পর্ক নির্ণয় করা যায়নি। কেন, বিদ্যমান পাঞ্চরাত্রিক দেবচিন্তনে বৃষ্ণিবীর সাম্ব অনুপস্থিত, তাও জানার উপায় নেই। তবে, আধুনিক বিদ্বান বাসুদেব মহাদেব আপ্তের অনুমান, সাম্ব সম্ভবত ভারতে সৌর উপাসনার প্রবর্তক বলে পরিচিত হওয়ার কারণে ভাগবতদের কাছে গুরুত্ব হারিয়েছেন।১২  

নারায়ণীয় ও পাঞ্চরাত্র

মহাভারতের শান্তিপর্বের মোক্ষধর্মপর্বাধ্যায়ের অন্তর্গত ১৯টি অধ্যায় (সমীক্ষাত্মক সংস্করণের [Critical Edition] ৩২১-৩৩৯ অধ্যায়) বা ১৮টি অধ্যায় (গীতা প্রেস সংস্করণের ৩৩৪-৩৫১ অধ্যায়) নারায়ণীয় পর্ব নামে পরিচিত। মহাভারতের এই অংশে পাঞ্চরাত্র সম্প্রদায় সম্পর্কে প্রাচীনতম বিবরণ বিদ্যমান। নারায়ণীয় পর্বের রচনাকাল সাধারণাব্দের পূর্ববর্তী দ্বিতীয় শতক থেকে সাধারণাব্দের সূচনার মধ্যবর্তী সময় বলে অনুমিত হয়েছে,১৩ আবার এই অংশটি তৃতীয়, চতুর্থ বা পঞ্চম শতক সাধারণাব্দে রচিত বলেও অনুমান করা হয়েছে। নারায়ণীয় পর্বে নারায়ণকে পুরুষোত্তম ভগবান রূপে উপাসকদের জন্য চারটি পৃথক নামের উল্লেখ করা হয়েছে – সাত্বত, ভাগবত, একান্তী ও পঞ্চরাত্র (এখানে উল্লেখ্য, নারায়ণ ভক্তদের বোঝাতে মহাভারতের কোথাও বৈষ্ণব কথাটি ব্যবহৃত হয়নি)। এখানে (৩৩৬.৬২), এই ধর্মকে প্রতিবুদ্ধদের ধর্ম বলেও উল্লেখ করা হয়েছে। পরবর্তীকালে পাঞ্চরাত্র শাস্ত্রগ্রন্থসমূহেও নিজেদের ‘সাত্বত’ (ঈশ্বরসংহিতা ১.১০, পাদ্মসংহিতা ৪.২.৮৮) ও ‘ভাগবত’ (পাদ্মসংহিতা ৪.২.৮৮) উভয় নামেই অভিহিত করতে দেখা গেছে। নারায়ণীয় পর্বে (শান্তিপর্ব।৩৩৭.৬৭) বলা হয়েছে, যে পঞ্চরাত্রবিদরা একান্ত (অর্থাৎ, একেশ্বরবাদী) ভাবনার স্তরে পৌঁছাতে পারেন, তাঁরা হরিতে (অর্থাৎ ভগবানে) প্রবেশ করেন। পাঞ্চরাত্র শাস্ত্রগ্রন্থের (পাদ্মসংহিতা ৪.২.৮৮, লক্ষ্মীতন্ত্র ৪১.৭০) উল্লেখ থেকে বোঝা যায় অন্যান্য প্রাচীন ভারতীয় ধর্মের অনুসারীদের সঙ্গে নিজেদের পার্থক্য বোঝাতে পাঞ্চরাত্রিকরা নিজেদের একান্তী অর্থাৎ কেবল বাসুদেব বা নারায়ণের উপাসক বলে উল্লেখ করতেন।

নারায়ণীয় পর্বের সৃষ্টিতত্ত্বে (শান্তিপর্ব।৩২৬.৩১-৩৯, ৬৮-৬৯, ৩২৭.২৬-২৮) সনাতন পুরুষ বাসুদেব থেকে জীবরূপী সঙ্কর্ষণ, সঙ্কর্ষণ থেকে মনরূপী প্রদ্যুম্ন, প্রদ্যুম্ন থেকে অহংকাররূপী অনিরুদ্ধ এবং অনিরুদ্ধ থেকে ব্রহ্মার উত্পত্তির কথা বলা হয়েছে। সৃষ্টিতত্ত্বে অহংকাররূপী অনিরুদ্ধ থেকে পৃথিবী, বায়ু, আকাশ, অপ ও জ্যোতি, এই পঞ্চ মহাভূতের এবং পঞ্চ মহাভূত থেকে গুণসমূহের উত্পত্তিরও উল্লেখ রয়েছে। এর সঙ্গে পরবর্তীকালের পাঞ্চরাত্র শাস্ত্রগ্রন্থসমূহে বর্ণিত সৃষ্টিতত্ত্বের মিল লক্ষণীয়। নারায়ণীয় পর্বে (শান্তিপর্ব।৩২৫.৪) নারায়ণকে পঞ্চরাত্রিক বলেও অভিহিত করা হয়েছে। নারায়ণীয় পর্বে (শান্তিপর্ব।৩২১.৮-৯) নারায়ণের স্বায়ম্ভুব মন্বন্তরে ধর্মের চার পুত্র, নর, নারায়ণ, হরি ও কৃষ্ণ রূপে জন্মগ্রহণের যে প্রাচীন পুরাকথা উল্লিখিত হয়েছে, তার পুনরাবৃত্তি বা কোনও পরিবর্তিত রূপ বিদ্যমান পাঞ্চরাত্র শাস্ত্রগ্রন্থসমূহে দেখা যায় না। কিন্তু, প্রথম সহস্রাব্দ সাধারণাব্দের মাঝামাঝি রচিত বলে অনুমিত বিষ্ণুধর্মপুরাণে (১০২.১০) এই পুরাকথার উল্লেখ দেখতে পাওয়া যায়। এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই, নারায়ণীয় পর্বের রচনাকাল এবং বর্তমানে বিদ্যমান পাঞ্চরাত্র শাস্ত্রগ্রন্থগুলির রচনার সূচনাকালের মধ্যে বেশ কয়েক শতাব্দীর ব্যবধান রয়েছে। এই কালপর্বে পাঞ্চরাত্র সম্প্রদায়ের ধর্মীয় ভাবনা সম্পর্কে জানার জন্য কিছু প্রাচীন প্রত্ন নিদর্শন ছাড়া আর কোনও উত্স নেই।

কম্বোডিয়ার লেখে পাঞ্চরাত্র

পাঞ্চরাত্র কথাটির উল্লেখ রয়েছে এমন প্রাচীনতম লেখ পাওয়া গেছে ভারতীয় উপমহাদেশের বাইরে, কম্বোডিয়ায়। সপ্তম শতক সাধারণাব্দের বর্তমান কম্বোডিয়া ও লাওস জুড়ে ব্যাপ্ত চেনলা (বা কম্বুজদেশ) রাজ্যের শাসক প্রথম জয়বর্মনের (রাজত্বকাল ৬৫৭-৬৮১ সাধারণাব্দ) আমলের সংস্কৃত ও খমের ভাষায় উত্কীর্ণ বাসেত শিলালেখে জনৈক পাঞ্চরাত্র অর্চাচুঞ্চু (দেবপ্রতিমার অর্চনা সম্পর্কে অভিজ্ঞ) ব্রাহ্মণ দ্বারা শ্রীত্রৈলোক্যসার দেবতার জন্য পঞ্চযজ্ঞ করার কথা উল্লেখ করা রয়েছে।১৪ সাধারণাব্দের নবম-দশম শতাব্দীর কম্বোডিয়ার কম্বুজ রাজ্যের শাসক প্রথম যশোবর্মনের আমলের (রাজত্বকাল ৮৮৯ – আনুমানিক ৯১০ সাধারণাব্দ) সংস্কৃত ভাষায় নাগরী লিপিতে উত্কীর্ণ প্রাসাত কমনপ শিলালেখ তাঁর স্থাপিত একটি বৈষ্ণবাশ্রমের (অর্থাৎ, বৈষ্ণব মঠের) ব্যবস্থাপনা নিয়ে রচিত। এই লেখের ৬২তম শ্লোকে আশ্রমের আচার্যকে পঞ্চরাত্র বিধান সম্পর্কে জ্ঞানসম্পন্ন ও শব্দশাস্ত্র (বেদ) সম্বন্ধে অভিজ্ঞ হতে হবে বলে উল্লিখিত হয়েছে। এই লেখের ৭৩তম ও ৮৬তম শ্লোকে ভাগবত ও সাত্বত বলে যে পাঞ্চরাত্র মতাবলম্বীর কথাই উল্লেখ করা হয়েছে তা অনুমান করতে অসুবিধা হয় না।১৫

ভারতীয় উপমহাদেশে পাঞ্চরাত্র

ভারতীয় উপমহাদেশে পাঞ্চরাত্র সম্প্রদায়ের উদ্ভব, প্রসার ও ক্রমবিবর্তনের ইতিহাসের অধিকাংশ আজও অজ্ঞাত। দ্বিতীয় শতাব্দী সাধারণপূর্বাব্দে সম্ভবত উত্তর ভারতের অধিবাসী পতঞ্জলি তাঁর ব্যাকরণ মহাভাষ্য গ্রন্থে পাণিনির অষ্টাধ্যায়ী গ্রন্থের পূর্বে উল্লিখিত সূত্রের (৪.৩.৯৮) ব্যাখ্যায় বাসুদেবের উপাসক বাসুদেবকদের কথা উল্লেখ করেছেন,১৬ কিন্তু বাসুদেবকরাই যে পাঞ্চরাত্রিক এ কথা নিশ্চিতভাবে বলা সম্ভব নয়। সপ্তম শতকের মাঝামাঝি বাণভট্ট তাঁর হর্ষচরিত গ্রন্থের অষ্টম উচ্ছাসে পাঞ্চরাত্রিক ও ভাগবত নামের দু’টি পৃথক সম্প্রদায়ের সন্ন্যাসীদের বিন্ধারণ্যে অবস্থানের উল্লেখ করেছেন।১৭ এর কয়েক শতক বাদে সম্ভবত কাশ্মীরের বিদ্বান শঙ্কর তাঁর হর্ষচরিতের ব্যাখ্যামূলক ‘সংকেত’ গ্রন্থে ভাগবত কথাটির অর্থ করেছেন বিষ্ণুভক্ত আর পাঞ্চরাত্রিকদের বৈষ্ণবভেদ (অর্থাৎ একটি বিশিষ্ট বৈষ্ণব সম্প্রদায়) বলে উল্লেখ করেছেন। অষ্টম-নবম শতক সাধারণাব্দের অদ্বৈত বৈদান্তিক শঙ্করাচার্য (আনুমানিক ৭৮৮-৮২০ সাধারণাব্দ) তাঁর শারীরকভাষ্য গ্রন্থে ব্রহ্মসূত্রের উত্পত্তি অসম্ভব অধিকরণের চারটি সূত্রের (২.২.৪২-৪৫) ব্যাখ্যায় পাঞ্চরাত্র সম্প্রদায়ের দার্শনিক তত্ত্বকেই ভাগবত সম্প্রদায়ের মত বলে খণ্ডন করেছেন, যদিও, একটি সূত্রের (২.২.৪৪) ব্যাখ্যায় তিনি পঞ্চরাত্র সিদ্ধান্ত কথাটি উল্লেখ করেছেন।১৮  

পাঞ্চরাত্র ও ভাগবত – আধুনিক বিদ্বানদের সংশয়

প্রাচীন ভারতে ভাগবত কথাটি ঠিক কী অর্থে প্রযুক্ত হতো, পাঞ্চরাত্র ও ভাগবত আদৌ দুটি পৃথক বৈষ্ণব ধর্মাবলম্বী সম্প্রদায় কিনা, বা পৃথক হলে, তাদের মধ্যে ঠিক কী সম্পর্ক ছিল, এই সব বিষয় নিয়ে আধুনিক বিদ্বানরা এখনও কোনও ঐক্যমত্যে পৌঁছাতে পারেননি। রামকৃষ্ণ গোপাল ভাণ্ডারকর তাঁর বৈষ্ণবিজম, শৈবিজম অ্যান্ড মাইনর রিলিজিয়াস সেক্টস বইতে দুটি সম্প্রদায়কে এক বলেই উল্লেখ করেছেন।১৯ সুবীরা জয়সওয়াল তাঁর দ্য অরিজিন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অফ বৈষ্ণবিজম বইতে লিখেছেন, যদিও তাঁর পূর্ববর্তী বিদ্বানরা মনে করতেন পাঞ্চরাত্ররা প্রথমদিকে নারায়ণের উপাসক ছিলেন এবং ভাগবতরা বাসুদেবের উপাসক ছিলেন, তিনি তা মনে করেন না। তাঁর মতে, ভাগবত ও পাঞ্চরাত্র সম্প্রদায়ের মধ্যে মূল পার্থক্য তাঁদের উপাসিত দেবতা নয়, সামাজিক ভিত্তি। ভাগবতরা ব্রাহ্মণ্যবাদী সামাজিক শ্রেণিবিন্যাসকে মেনে নিয়েছিলেন কিন্তু পাঞ্চরাত্ররা এই বিষয়ে বীতস্পৃহ ছিলেন এবং সম্ভবত এর বিরোধী ছিলেন। তাঁরা নারী-পুরুষ নিবিশেষে সমস্ত বর্ণের মানুষকে নিজেদের মতে দীক্ষা দিতেন। পাঞ্চরাত্র মত তান্ত্রিক ভাবনার দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিল এবং তুলনামূলকভাবে নিম্নবর্গের মধ্যে বেশি জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল। অন্যদিকে ভাগবত মত শাসকশ্রেণির পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করেছিল এবং বর্ণাশ্রম প্রথার সমর্থক ছিল।২০ পরবর্তী কালে জান গোন্ডা, তাঁর মিডাইভ্যাল রিলিজিয়াস লিটারেচার ইন স্যান্সক্রিট বইতে পাঞ্চরাত্র সম্প্রদায়কে একেশ্বরবাদী ভাগবত সম্প্রদায়ের একটি শাখা (সাবডিভিশন) বলে অভিমত প্রকাশ করেছেন। তাঁর মতে, ভাগবত সম্প্রদায়ের অংশ হলেও পাঞ্চরাত্রদের নিজস্ব সাহিত্য ও ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের রীতি ছিল। ভাগবতরা ব্রাহ্মণ্যবাদী সামাজিক শ্রেণিবিন্যাসকে মেনে নিলেও নিম্নবর্গের মানুষদেরও নিজেদের মতে দীক্ষা দিতেন। পাঞ্চরাত্র মত নিম্নবর্গের মধ্যে ব্যাপকতা লাভ করলেও উচ্চবর্গের পাঞ্চরাত্র অনুসারী বিদ্বানদের রচনা থেকে সেই বিষয়ে কোনও অনুমান করা দুরূহ।২১

ধর্ম প্রবর্তন নিয়ে পুরাকথা  

পঞ্চরাত্র শাস্ত্রের উদ্ভব সম্পর্কে নারায়ণীয় পর্বে (শান্তিপর্ব।৩২৬.১০০-১০১,১০৬-১১০) বলা হয়েছে, চতুর্বেদ সমন্বিত ও সাংখ্য-যোগের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ পঞ্চরাত্র মহোপনিষদ (শাস্ত্র) নারায়ণের মুখ থেকে নারদ শুনে ব্রহ্মাকে বিবৃত করেন ব্রহ্মা সেই শাস্ত্র তাঁর ভবনে আগত সিদ্ধগণকে বিবৃত করেন। সূর্য পঞ্চরাত্র শাস্ত্র সিদ্ধগণের কাছ থেকে শোনার পর ৬৬ হাজার ঋষিকে শোনান এবং ঋষিরা মেরুপর্বতে আগত দেবতাদের শোনান। দেবগণের কাছ থেকে অসিত মুনি শুনে পিতৃগণকে শোনান। নারায়ণীয় পর্বের অন্যত্র (শান্তিপর্ব।৩২২.২৬-২৮, ৩৬-৩৭, ৪২-৪৪) বলা হয়েছে, মরীচি, অত্রি, অঙ্গিরস, পুলস্ত্য, পুলহ, ক্রতু ও বসিষ্ঠ – এই সাত মুনি চিত্রশিখণ্ডী নামে পরিচিত (পৌরাণিক ঐতিহ্যে এঁরা সপ্তর্ষি নামে উল্লিখিত)। চিত্রশিখণ্ডী মুনিরা স্বায়ম্ভুবের (মনুর) সঙ্গে একত্রে শত সহস্র (এক লক্ষ) শ্লোকে চতুর্বেদের অবিরোধী পঞ্চরাত্র শাস্ত্রগ্রন্থ রচনা করেন। চিত্রশিখণ্ডী মুনিদের কাছ থেকে এই শাস্ত্র বৃহস্পতি এবং বৃহস্পতির কাছ থেকে রাজা উপরিচর বসু লাভ করেছিলেন। সপ্ত চিত্রশিখণ্ডী মুনি ও স্বায়ম্ভুব মনুর এই পুরাকথাটি পরবর্তীকালের পাঞ্চরাত্র শাস্ত্রগ্রন্থেও (পারমেশ্বরসংহিতা।১.৬০-৬১) পুনরাবৃত্ত হয়েছে। নারায়ণীয় পর্ব রচনার কয়েক শতক পর, অষ্টম-নবম শতক সাধারণাব্দে শঙ্করাচার্য ব্রহ্মসূত্রের একটি সূত্রের (২.২.৪৫) ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে শাণ্ডিল্য ঋষি পঞ্চরাত্র শাস্ত্র অধিগত করেছিলেন বলে উল্লেখ করেছেন। দশম-একাদশ শতক সাধারণাব্দে তামিল শ্রীবৈষ্ণব বিদ্বান যামুনাচার্য তাঁর আগমপ্রামাণ্য গ্রন্থে নারদ ও শাণ্ডিল্য ঋষিকে পঞ্চরাত্র সম্প্রদায়ের প্রবর্তক বলে উল্লেখ করেছেন।২২ আরও পরবর্তীকালের একটি পাঞ্চরাত্র শাস্ত্রগ্রন্থ ঈশ্বরসংহিতায় (১.৩৮-৪১) বলা হয়েছে, ঋষি শাণ্ডিল্য তোতাদ্রি (তামিলনাড়ুর তিরুনেলবেলি জেলার বানমামলই) শিখরে বহু সহস্র বছর তপস্যার পর সঙ্কর্ষণের কাছ থেকে পাঞ্চরাত্র শাস্ত্রজ্ঞান লাভ করে সুমন্তু, জৈমিনি, ভৃগু, ঔপগায়ন ও মৌঞ্জায়নকে শিক্ষা দেন। পুরাকথার আবরণ উন্মোচন করে পাঞ্চরাত্র সম্প্রদায়ের উদ্ভবের কোনও প্রাচীন ইতিবৃত্তেরই ঐতিহাসিক সত্যতা নির্ণয় অবশ্য আজ আর সম্ভব নয়, তবে আদি-মধ্যযুগে শাণ্ডিল্য ঋষিকেই পাঞ্চরাত্র শাস্ত্রের প্রথম প্রচারক বলে মনে করা হতো।

পৃথিবীর বিভিন্ন সংগ্রহে সংরক্ষিত বৈকুন্ঠ বিষ্ণু প্রতিমা

চতুর্ব্যূহ থেকে বৈকুন্ঠ – পাঞ্চরাত্র দেবপ্রতিমা ভাবনার বিবর্তন

উত্তর প্রদেশের বর্তমান প্রয়াগরাজ (এলাহাবাদ) জেলার ভিটা থেকে ১৯৫৬ সালে সংগৃহীত এবং বর্তমানে লখনউ সংগ্রহশালায় সংরক্ষিত আনুমানিক দ্বিতীয় শতাব্দী সাধারণপূর্বাব্দের বেলেপাথরের তৈরি চতুর্ব্যূহ বাসুদেব প্রতিমা এখনও পর্যন্ত প্রাপ্ত প্রাচীনতম চতুর্ব্যূহ প্রতিমা। এই ভাস্কর্যটি পাদপীঠের উপর বাসুদেব, সঙ্কর্ষণ, প্রদ্যুম্ন ও অনিরুদ্ধের একত্রে দণ্ডায়মান প্রতিমা বলে অনুমিত। মুকুট পরিহিত মুখ্য প্রতিমার ডান দিকের প্রতিমার নীচের অংশটিতে একটি সিংহের মূর্তি এবং বাঁ দিকের প্রতিমার নীচের অংশে পিছনের পায়ের উপর দণ্ডায়মান বরাহের মূর্তি দৃশ্যমান। এই প্রতিমাটিতে পাঞ্চরাত্র ধর্মতত্ত্বের বাসুদেব থেকে সঙ্কর্ষণ, প্রদ্যুম্ন ও অনিরুদ্ধের উত্পত্তির তত্ত্ব পরিস্ফুট না হলেও, এটি পরবর্তীকালের বৈকুন্ঠ বিষ্ণু বা বিষ্ণু চতুর্মূর্তি প্রতিমার আদিরূপ। পাঞ্চরাত্র সৃষ্টিতত্ত্বের স্পষ্ট রূপ দেখতে পাওয়া যায় বর্তমানে মথুরার রাষ্ট্রীয় সংগ্রহালয়ে সংরক্ষিত কুষাণ আমলের ভগ্ন চতুর্ব্যূহ প্রতিমাটিতে। মথুরার রাষ্ট্রীয় সংগ্রহালয় চত্বরের সাতসমুদ্রী কূপ থেকে প্রাপ্ত মথুরা শিল্পরীতিতে নির্মিত আনুমানিক দ্বিতীয় শতাব্দী সাধারণাব্দের এই প্রতিমায় হার, মুকুট ও পুষ্পমালা পরিহিত চতুর্ভুজ বাসুদেবের প্রতিমার দক্ষিণ স্কন্ধ থেকে পানপাত্র ধৃত সঙ্কর্ষণের উত্পত্তির মূর্ত রূপ পরিদৃশ্যমান। কিন্তু ভগ্নাবস্থার কারণে বাসুদেবের প্রতিমার মস্তক ও বাম স্কন্ধ থেকে প্রদ্যুম্ন ও অনিরুদ্ধের উত্পত্তির মূর্ত রূপ দুটিকে নিশ্চিত ভাবে চিহ্নিত করা সম্ভব হয়নি।২৩ এখনও পর্যন্ত প্রাচীন উত্তর ভারতে পাঞ্চরাত্র সম্প্রদায়ের অস্তিত্বের সাক্ষ্য কেবল কয়েকটি চতুর্ব্যূহ প্রতিমাই বহন করছে।

প্রাচীন পাঞ্চরাত্র ভাবনার চতুর্ব্যূহ প্রতিমা আদি-মধ্যযুগে ক্রমশ রূপান্তরিত হয়ে প্রথমে বিষ্ণু চতুর্মূর্তি এবং তারপর বিষ্ণু বৈকুন্ঠ রূপ গ্রহণ করেছিল বলে মনে হয়। আনুমানিক অষ্টম শতক সাধারণাব্দ বা তার পরবর্তীকালে উত্তর-পশ্চিম ভারতে (সম্ভবত কাশ্মীরে) রচিত বিষ্ণুধর্মোত্তর পুরাণে (৩.৮৫.১-৪২ক) চতুর্মূর্তি প্রতিমার বর্ণনা রয়েছে এই বিবরণে বাসুদেব, সঙ্কর্ষণ, প্রদ্যুম্ন ও অনিরুদ্ধের চারটি পৃথক বর্ণের প্রতিমা একত্রে নির্মাণের কথা বলা হয়েছে। এর ঠিক পরেই বিষ্ণুধর্মোত্তর পুরাণে (৩.৮৫.৪২খ-৪৮) বৈকুন্ঠ নামে জ্ঞাত সৌম্য, সিংহরূপবিশিষ্ট জ্ঞান এবং রৌদ্র বা ঐশ্বর্য সমেত চারটি মুখযুক্ত, চতুর্ভুজ গরুড়বাহন প্রতিমার বর্ণনা রয়েছে। বিষ্ণুধর্মোত্তর পুরাণের অন্যত্র (৩.৪৪.৯-১৩) পূর্ব (বা সামনের) দিকে সৌম্য (বাসুদেবের সৌম্য রূপ), দক্ষিণ (বা ডান) দিকে নৃসিংহ, পশ্চিম (বা পিছনের) দিকে কপিল ও উত্তর (বা বাম) দিকে বরাহ – বিষ্ণুর চারটি মুখযুক্ত, অষ্টভুজ প্রতিমারও বর্ণনা রয়েছে। মধ্যপ্রদেশের উজ্জয়িন শহরের বিষ্ণু চতুষ্টিকা প্রত্নতাত্ত্বিক সংগ্রহালয়ে একটি পরমারকালীন সৌম্য, নৃসিংহ, বরাহ ও কপিলের চতুর্মূর্তি প্রতিমা রাখা আছে। বিষ্ণুধর্মোত্তর পুরাণে বর্ণিত বৈকুন্ঠ প্রতিমা যে প্রাচীন পাঞ্চরাত্র চতুর্ব্যূহ প্রতিমারই রূপান্তর, সে কথা এই পুরাণের আর একটি স্থানে (৩.৪৭.৯-১৮) বর্ণিত বাসুদেব, সঙ্কর্ষণ, প্রদ্যুম্ন ও অনিরুদ্ধের চারটি মুখযুক্ত, অষ্টভুজ প্রতিমার বিবরণ থেকে বোঝা যায়। এখানে, দু’টি শ্লোকে (৩.৪৭.৯-১০) পাঞ্চরাত্র চতুর্ব্যূহ ধারণার অনুসরণ করে বাসুদেব, সঙ্কর্ষণ, প্রদ্যুম্ন ও অনিরুদ্ধের চারটি মুখকে বল, জ্ঞান ও ঐশ্বর্য ও শক্তির রূপ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। পাঞ্চরাত্র আগম গ্রন্থ জয়াখ্যসংহিতায় (৬.৭৩-৭৬) গরুড়বাহন বৈকুন্ঠ, নৃসিংহ, বরাহ ও কপিলের মুখবিশিষ্ট শঙ্খ, চক্র, গদা ও পদ্মধারী চতুর্ভুজ প্রতিমার ধ্যানের উল্লেখ রয়েছে। গুপ্ত শাসনকালে বৈকুন্ঠ বিষ্ণুর প্রতিমা নির্মাণ শুরু হয়। প্রাচীনতম বৈকুন্ঠ বিষ্ণুর প্রতিমা আলিগড় ও মথুরা থেকে পাওয়া গেছে। অষ্টম-নবম শতক সাধারণাব্দ থেকে কাশ্মীর ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে, বিশেষত চম্বা ও স্বাত উপত্যকায় নির্মিত বেশ কিছু সংখ্যক চতুর্ভুজ বৈকুন্ঠ বিষ্ণুর প্রতিমার সন্ধান পাওয়া গেছে। রাজস্থান ও গুজরাতেও বৈকুন্ঠ বিষ্ণুর অনেক প্রতিমা পাওয়া গেছে। খাজুরাহো থেকে পাঁচটি বৈকুন্ঠ বিষ্ণুর প্রতিমা পাওয়া গেছে। এর মধ্যে একটি প্রতিমায় চতুর্থ মুখটি কপিলের পরিবর্তে হয়গ্রীবের (বা বাগীশ্বরের)।২৪ খাজুরাহোর লক্ষ্মণ মন্দিরের ভিত্তিস্থল থেকে প্রাপ্ত চান্দেল্ল বংশীয় শাসক ধঙ্গদেবের আমলের ১০০২ বিক্রম সংবতের (৯৫৪ সাধারণাব্দ) শিলালেখ থেকে জানা যায় এই মন্দিরের গর্ভগৃহে তাঁর পিতা যশোবর্মনের স্থাপিত প্রতিমাটি বৈকুন্ঠ বিষ্ণুর। এই শিলালেখ থেকে জানা যায়, এই প্রতিমাটি কৈলাসের ভোট (তিব্বতি) শাসক কীরের (কাংড়ার) শাহী শাসককে উপহার দেন, তাঁর কাছ থেকে গুর্জর-প্রতিহার শাসক হেরম্বপাল (বা মহীপাল) প্রতিমাটি কেড়ে নেন। হেরম্বপালের পুত্র দেবপালের কাছ থেকে প্রতিমাটি যশোবর্মন পান।২৫ তবে, বর্তমানে এই মন্দিরে বিদ্যমান প্রতিমাটি কাশ্মীর বা পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের রীতিতে নির্মিত চতুর্মুখ মূল প্রতিমা নয়, পরবর্তীকালের চান্দেল্ল রীতিতে নির্মিত তিনটি মুখবিশিষ্ট প্রতিমা।

শাস্ত্রগ্রন্থ, দর্শন ও ধর্মতত্ত্ব

পঞ্চরাত্র নামের উত্স

পাঞ্চরাত্র সম্প্রদায়ের এই নামকরণের উত্স আজও স্পষ্ট নয়। পঞ্চরাত্র সত্র একটি প্রাচীন বৈদিক ধর্মীয় অনুষ্ঠান। শুক্লযজুর্বেদীয় শতপথব্রাহ্মণে (মাধ্যন্দিন।১৩.৬.১, কাণ্ব।১৫.৬.১) পঞ্চরাত্র সত্র প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, এই যজ্ঞ পুরুষরূপী নারায়ণ কর্তৃক আবিষ্কৃত এবং এই যজ্ঞের অনুষ্ঠান সম্পন্ন করেই নারায়ণ সবাইকে অতিক্রম করে সর্বব্যাপ্ত হতে সক্ষম হন। শতপথব্রাহ্মণে উল্লিখিত পঞ্চরাত্র পুরুষমেধ যজ্ঞ অর্থাৎ এই ধর্মীয় অনুষ্ঠানে নরবলির প্রয়োজন।২৬ পাঁচ দিনের পঞ্চরাত্র সত্রের উল্লেখ শতপথব্রাহ্মণের আগে শৌনকীয় অথর্ববেদসংহিতা (১১.৭.১১) এবং কৃষ্ণযজুর্বেদীয় তৈত্তিরীয়সংহিতাতেও (৭.১.১০) পাওয়া যায়। এই সত্র শুরুর আগের রাত থেকে পাঁচ দিনের গণনা শুরু হত বলে এই সত্রের নাম পঞ্চরাত্র। কিন্তু শতপথব্রাহ্মণেই প্রথম এই সত্রকে নারায়ণের সঙ্গে যুক্ত করে একটি পুরুষমেধ যজ্ঞ হিসাবে বর্ণিত হয়েছে। শতপথব্রাহ্মণে বর্ণিত পঞ্চরাত্র সত্রের রূপটি কেমন করে বৈদিক পরিমণ্ডলে স্থান করে নিয়েছিল, বা অবৈদিক দেবতা নারায়ণ কীভাবে এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন সেই ইতিহাস এখনও অজানা। তবে, পাঞ্চরাত্র সম্প্রদায়ের নামের উত্পত্তির সঙ্গে এই পঞ্চরাত্র সত্রের যোগ থাকার সম্ভাবনা প্রবল বলে আধুনিক বিদ্বানরা মনে করেন।২৭

পঞ্চ ও রাত্র কথাদু’টির প্রকৃত অর্থ কী, তাই নিয়ে প্রাচীন কাল থেকেই সংশয় রয়েছে। প্রাচীনতর বৈদিক সাহিত্য অনুসরণ করে শতপথব্রাহ্মণে পঞ্চরাত্র অর্থে আক্ষরিকভাবে পাঁচটি রাতের কথা বলা হলেও, পরবর্তীকালের আর কোনও গ্রন্থে এর পুনরাবৃত্তি দেখা যায়নিসম্ভবত নবম শতক সাধারণাব্দ বা তারও পরে রচিত অগ্নিপুরাণের একটি শ্লোকে (৩৯.৭) বলা হয়েছে, আকাশ, বায়ু, তেজ, অম্বু ও ভূ, এই পঞ্চভূতই পঞ্চরাত্র। পাঞ্চরাত্র সম্প্রদায়ের শাস্ত্রগ্রন্থসমূহও ‘রাত্র’ কথাটির অর্থ নিয়ে একমত নয়। তিনটি সর্বপ্রাচীন পাঞ্চরাত্র আগমের অন্যতম পৌষ্করসংহিতায় (৩৮.৩০৭-৩০৮) বলা হয়েছে, পুরাণ, বেদ, বেদান্ত, সাংখ্য ও যোগ – এই পাঁচটি বিষয়ক জ্ঞান, পাঁচটি রাত যেমন করে দিনের সঙ্গে মিশে যায়, সেই রকম ভাবে যে শাস্ত্রে এসে মিশে গেছে, তাই পঞ্চরাত্র। অহির্বুধ্ন্যসংহিতাকে অন্যতম প্রাচীন পাঞ্চরাত্র শাস্ত্রগ্রন্থ বলে অনেক আধুনিক বিদ্বান মনে করেন। অহির্বুধ্ন্যসংহিতার (১১.৬৩-৬৪) মতে বিষ্ণু তাঁর ‘পর’ (সনাতন রূপ), ‘ব্যূহ’ (৪টি সূক্ষ্ম রূপ), ‘বিভব’ (৩৯টি অবতার রূপ), ‘অন্তর্যামী’ (জীবের অন্তঃস্থলে অবস্থিত রূপ) ও ‘অর্চা’ (প্রতিমা রূপ) – এই পাঁচটি রূপের নিরূপণ করে যে শাস্ত্র রচনা করেছেন, সেই শাস্ত্রই পাঞ্চরাত্র পাঞ্চরাত্র শাস্ত্রসমূহের মধ্যে আর একটি তুলনামূলকভাবে প্রাচীন গ্রন্থ পরমসংহিতার (১.৩৯-৪১) মতে, মহাভূতরূপী পুরুষের (নারায়ণের) পাঁচটি রাত্র (অর্থাৎ দেহ) – পঞ্চভূত, পঞ্চতন্মাত্র, গর্ব (অহংকার), বুদ্ধি ও অব্যক্ত, এই পাঁচটি বিষয়ের কথাই পঞ্চরাত্র তন্ত্রে (শাস্ত্রে) বলা হয়েছে। আর একটি পাঞ্চরাত্র শাস্ত্রগ্রন্থ ঈশ্বরসংহিতার মতে (২১.৫১৯, ৫৩১-৫৩৩), ভগবান পাঁচ দিন ধরে দিবারাত্র পৃথকভাবে শাণ্ডিল্য, ঔপগায়ন, মৌঞ্জায়ন, কৌশিক ও ভারদ্বাজ, এই পাঁচ ঋষিকে একায়ন বেদ বা  রহস্যাম্নায় নামে জ্ঞাত এই শাস্ত্রের শিক্ষা দিয়েছেন বলে এর নাম পঞ্চরাত্র। আবার আর একটি পাঞ্চরাত্র শাস্ত্রগ্রন্থ শ্রীপ্রশ্নসংহিতার মতে (২.৪০) রাত্র মানে অজ্ঞানতা, পঞ্চ শব্দটি পচ্ ধাতু থেকে উত্পন্ন, যার অর্থ নাশ; অজ্ঞানতা বিনষ্ট করে বলে এই শাস্ত্রের নাম পঞ্চরাত্র। পাদ্মসংহিতা (১.১.৭২-৭৪) বা পাদ্মতন্ত্র গ্রন্থের মতে সূর্য যেমন রাত্রির অন্ধকার দূর করে, পাঁচটি দার্শনিক মত, যোগ, সাংখ্য, বৌদ্ধ, জৈন ও পাশুপত মতকে খণ্ডন করে বলে এই শাস্ত্রের নাম পঞ্চরাত্র। বিহগেন্দ্রসংহিতায় (১.৩০-৩৩) বলা হয়েছে, কেশব (নারায়ণ) কৃতযুগে (সত্যযুগে) পরপর পাঁচ রাতে অনন্ত, গরুড়, বিষ্বক্সেন, ব্রহ্মা ও রুদ্রকে পৃথকভাবে এক লক্ষ গ্রন্থের (শ্লোকের) শাস্ত্র শুনিয়েছিলেন বলে পাঁচ লক্ষ শ্লোকবিশিষ্ট শাস্ত্রের নাম পঞ্চরাত্র। অন্ত মধ্যযুগের বৈষ্ণব গ্রন্থ, নারদ পঞ্চরাত্র নামে প্রকাশিত জ্ঞানামৃতসারসংহিতার (১.১.৪৪-৫১) মতে রাত্র মানে জ্ঞান; তত্ত্ব, মুক্তিপ্রদ, ভক্তিপ্রদ, যৌগিক ও বৈশেষিক; পঞ্চরাত্র এই পাঁচ প্রকারের জ্ঞানের চর্চার আকর।

পঞ্চরাত্র কথাটির আদি অর্থ উদ্ধার করা আজ প্রায় অসম্ভব। তবে, আধুনিক বিদ্বান ভ্যান বুটেনেন ১৯৬২ সালে প্রকাশিত একটি নিবন্ধে পঞ্চরাত্র কথাটির আদি অর্থ প্রসঙ্গে যে অনুমান করেছেন তাই অত্যন্ত যুক্তিসঙ্গত বলে মনে হয়। তাঁর মতে, পাঞ্চরাত্রিকরাও আদিতে বৌদ্ধ ও জৈনদের মতো পরিব্রাজকের জীবন অতিবাহিত করতেন। ভ্যান বুটেনেন দেখিয়েছেন বুধস্বামীর বৃহৎকথাশ্লোকসংগ্রহ গ্রন্থে (২২.২২০) উল্লেখ করা হয়েছে, পরিব্রাজকরা পাঁচ রাত্রির বেশি কোনও নগরে এবং এক রাত্রির বেশি কোনও গ্রামে অবস্থান করতে পারেন না। বিজ্ঞানেশ্বরও তাঁর মিতাক্ষরা গ্রন্থে যাজ্ঞবল্ক্যস্মৃতির একটি শ্লোকের (৩.৫৮) ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে কণ্বের একটি শ্লোক উদ্ধৃত করেছেন, যেখানে বলা হয়েছে, পরিব্রাজকরা বর্ষাকালের চার মাস ছাড়া কোনও গ্রামে কেবল এক রাত্রি ও কোনও নগরে কেবল পাঁচ রাত্রি বাস করতে পারেন। তাঁর মতে, প্রাচীন কালের যে পরিব্রাজক বা সন্ন্যাসীরা পাঁচ রাত্রিবাসের এই নিয়ম পালন করতেন, তাঁদের পাঞ্চরাত্রিক বলে অভিহিত করা হতো এবং পরে তাঁদের ধর্মীয় মত পঞ্চরাত্র নামে পরিচিত হয়।২৮

বেদ অনুসারীদের পাঞ্চরাত্র বিরোধিতা

বেদ অনুসারী ব্রাহ্মণ বিদ্বানরা প্রাচীন কাল থেকেই অবৈদিক পাঞ্চরাত্র মতের তীব্র বিরোধিতা করেছেন। বেদান্ত দর্শনের মূলগ্রন্থ ব্রহ্মসূত্রের উত্পত্তি অসম্ভব শীর্ষক অধিকরণে (২.২.৪২-৪৫) পাঞ্চরাত্র সম্প্রদায়ের বাসুদেব থেকে সঙ্কর্ষণ, প্রদ্যুম্ন ও অনিরুদ্ধের উত্পত্তি ও চতুর্ব্যূহের তত্ত্বকে খণ্ডন করা হয়েছে। পরবর্তী কালে শঙ্করাচার্য ব্রহ্মসূত্রের এই অধিকরণের অন্তর্গত একটি সূত্রের (২.২.৪৫) ব্যাখ্যায় পাঞ্চরাত্র মতকে বেদবিরোধী বলে উল্লেখ করেছেন। সপ্তম শতাব্দী সাধারণাব্দে কুমারিলভট্ট তাঁর তন্ত্রবার্তিক গ্রন্থে মীমাংসাসূত্রের একটি সূত্রের (১.৩.৪) শবরস্বামীর ভাষ্যের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে পাঞ্চরাত্রকে বেদের বিরোধী ধর্ম ও অধর্ম বিষয়ক শাস্ত্র বলে উল্লেখ করেছেন। সাধারণাব্দের নবম শতকের কাশ্মীরের ব্রাহ্মণ বিদ্বান জয়ন্তভট্ট তাঁর আগমডম্বর নাটকের চতুর্থ অঙ্কে পাঞ্চরাত্র আগমকে বেদবাহ্য বলে উল্লেখ করেছেন। তিনি জানিয়েছেন, বেদ অনুসারী ব্রাহ্মণরা বিবাহসম্পর্ক স্থাপন, ধর্মীয় অনুষ্ঠান ও অধ্যাপনার ক্ষেত্রে পাঞ্চরাত্রিকদের থেকে দূরত্ব বজায় রাখতেন। জয়ন্ত অভিযোগ করেছেন, পাঞ্চরাত্রিকরা (বর্ণাশ্রমপ্রথা না মেনে) সবাই নিজেকে ব্রাহ্মণ বলে মনে করতেন এবং বেদের স্বরের উচ্চারণ অনুকরণ করে তাঁদের আগমগ্রন্থগুলি পাঠ করতেন।২৯ জয়ন্ত অবশ্য তাঁর ন্যায়মঞ্জরী গ্রন্থের তৃতীয় আহ্নিকে বলেছেন, পাঞ্চরাত্র আগমের প্রামাণ্য অগ্রগণ্য বেদবিদ কৃষ্ণদ্বৈপায়ন দ্বারা স্বীকৃত এবং এই আগমগ্রন্থগুলির প্রণেতা ঈশ্বরস্বরূপ ভগবান বিষ্ণু বলে এই আগমও (বেদের মতোই) আপ্তপ্রণীত। সেই কারণে পাঞ্চরাত্র আগম বেদবিরুদ্ধ হলেও অপ্রামাণ্য নয়।৩০ সাধারণাব্দের নবম শতকেরই কাশ্মীরের আর এক ব্রাহ্মণ বিদ্বান মেধাতিথি মনুস্মৃতির একটি শ্লোকের (২.৬) ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে তৎকালীন কয়েকটি ধর্মীয় সম্প্রদায়ের নাম উল্লেখ করে লিখেছেন যে, বেদবাহ্য অর্থাৎ অবৈদিক সম্প্রদায়সমূহের অনুসারীরা কোনও অসাধারণ পুরুষ বা দেবতা বিশেষকে তাঁদের ধর্মীয় মতের প্রণেতা বলে মনে করেন, বেদকে তাঁদের ধর্মের মূল বলে স্বীকার করেন না। মেধাতিথি উল্লিখিত সম্প্রদায়দের তালিকায় ভোজক (অজ্ঞাত, সম্ভবত বৌদ্ধ), নির্গ্রন্থ (জৈন), পাশুপত ও অনার্যবাদীদের (বা অনার্থবাদী, অজ্ঞাত) সঙ্গে পাঞ্চরাত্রিকদেরও নাম রয়েছে। আদি-মধ্যযুগের বেদ অনুসারী বৈষ্ণব পৌরাণিক সাহিত্য, যেমন, কূর্মপুরাণে বলা হয়েছে পাঞ্চরাত্র বেদবাহ্য (অবৈদিক) মোহশাস্ত্র (পূর্বভাগ।১৬.১১১-১১৪) এবং কোনও শ্রাদ্ধ অনুষ্ঠানে পাঞ্চরাত্রিকরা খাদ্যগ্রহণ করলে, সেই শ্রাদ্ধ ফলপ্রদ হয় না (উত্তরভাগ।২১.৩৪-৩৫)। বেদ অনুসারী আশ্বলায়নস্মৃতি, বশিষ্ঠসংহিতা, বিষ্ণুসংহিতা, শাতাতপসংহিতা, বৃদ্ধহারীতস্মৃতি (স্মৃতিনাং সমুচ্চয়ঃ সংস্করণ ১১.১৭৯-১৯২, স্মৃতিসন্দর্ভঃ সংস্করণ, ৮.১৭৯-১৯২), বোধায়নসংহিতা ও যমসংহিতার মতো স্মৃতিগ্রন্থে এবং পরাশরপুরাণ (বা পারাশরোপপুরাণ, ৩.৩০), সাম্বপুরাণ (পুরুষোত্তমের ভাষ্যপ্রকাশ গ্রন্থে উদ্ধৃত), স্কন্দপুরাণের অন্তর্গত বলে জ্ঞাত সূতসংহিতা, বৃহন্নারদীয়পুরাণ, বায়ুপুরাণ (হেমাদ্রি উদ্ধৃত), লিঙ্গপুরাণ, আদিত্যপুরাণ ও অগ্নিপুরাণের মতো পুরাণগ্রন্থে পাঞ্চরাত্র সম্প্রদায় সম্পর্কে বিরূপ মন্তব্য দেখতে পাওয়া যায়।৩১

অবৈদিক না বৈদিক – একায়ন বেদ     

আদি-মধ্যযুগের পাঞ্চরাত্র শাস্ত্রগ্রন্থের অনুসারী দক্ষিণ ভারতের ব্রাহ্মণ বিদ্বানরা এই শাস্ত্রকে অবৈদিক বলে মনে করতেন না। তাঁরা পাঞ্চরাত্র শাস্ত্রকে একায়ন বেদ বা শুক্লযজুর্বেদের একায়ন শাখার শাস্ত্র বলে উল্লেখ করেছেন (ঈশ্বরসংহিতা।২১.৫৫৪)। একায়ন কথাটি প্রথম দেখা যায় ছান্দোগ্য উপনিষদে (৭.২), যেখানে নারদ সনৎকুমারকে নিজের অন্যান্য শিক্ষার সঙ্গে একায়ন শিক্ষার কথাও উল্লেখ করছেন। প্রাচীন পাঞ্চরাত্র শাস্ত্রগ্রন্থ জয়াখ্যসংহিতায় (২০.২৬৯) ‘একায়নীয়’ শাখার মন্ত্রকে পরমপাবন বলে উল্লেখ করা হয়েছে।  পরবর্তীকালের দুটি পাঞ্চরাত্র শাস্ত্রগ্রন্থ শ্রীপ্রশ্নসংহিতা (২.৩৯) ও ঈশ্বরসংহিতায় (১.১৯) পাঞ্চরাত্র শাস্ত্রকে একায়ন বা একায়ন বেদ বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। দশম-একাদশ শতক সাধারণাব্দের শ্রীবৈষ্ণব বিদ্বান যামুনাচার্য তাঁর আগমপ্রামাণ্য গ্রন্থে প্রমাণ করার প্রয়াস করেছেন, পাঞ্চরাত্র আগম গ্রন্থসমূহ বেদ না হলেও এই গ্রন্থগুলির নির্দেশের মান্যতা বেদের সমান; কারণ বেদের মতোই এই আগমশাস্ত্রসমূহের উত্স একই, ভগবান অর্থাৎ নারায়ণের মুখনিঃসৃত। সপ্তদশ শতক সাধারণাব্দের প্রথম দিকে উত্তর ভারতের ব্রাহ্মণ বিদ্বান মিত্রমিশ্র রচিত বীরমিত্রোদয় নামের স্মৃতিনিবন্ধ গ্রন্থমালার অন্তর্গত পরিভাষাপ্রকাশ গ্রন্থে উদ্ধৃত যোগিযাজ্ঞবল্ক্যস্মৃতি গ্রন্থের একটি শ্লোকে পাঞ্চরাত্রকে বৈদিক ও মান্য বলে উল্লিখিত হয়েছে। পরিভাষাপ্রকাশ গ্রন্থে এরপর পৌরাণিক সাহিত্যে পাঞ্চরাত্র শাস্ত্র সম্পর্কে বিরূপ মন্তব্যের কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে শ্রৌত বা বৈদিক ও অশ্রৌত বা অবৈদিক পাঞ্চরাত্র আগমের কথা উল্লেখ করা হয়েছে এবং বিরূপ মন্তব্যগুলি অবৈদিক পাঞ্চরাত্র শাস্ত্র সম্পর্কে বলে মন্তব্য করা হয়েছে।৩২      

ঈশ্বরসংহিতায় বলা হয়েছে (১.২২-২৪, ২৮-৩০) কৃতযুগে (অর্থাৎ, সত্যযুগে) একায়ন বেদ উদ্ভূত হয়, বাকি সব বেদ পরবর্তীকালে ত্রেতাযুগে উদ্ভূত, একায়ন বেদই মূলবেদ । বাকি সব বেদ উদ্ভূত হবার পর বাসুদেব একায়ন বেদকে প্রত্যাহার করে নিয়ে কেবল নারদ ও সপ্ত ঋষির কাছে প্রকাশ করেন। এই সাত ঋষি – সন, সনত্সুজাত, সনক, সনন্দন, সনৎকুমার, কপিল ও সনাতন একান্তী ধর্মের আচার্য ও প্রবর্তক বলে জ্ঞাত। দক্ষিণ ভারতের পাঞ্চরাত্র ঐতিহ্যে সবচেয়ে প্রাচীন তিনটি শাস্ত্রগ্রন্থ – সাত্বতসংহিতা, পৌষ্করসংহিতা ও জয়াখ্যসংহিতায় ভগবান নারায়ণ সঙ্কর্ষণের অনুরোধে একায়ন বেদের মর্মবস্তুর যে ব্যাখ্যা করেছেন, তাই লিপিবদ্ধ করা আছে বলে মনে করা হয়। সেই কারণে, ঈশ্বরসংহিতায় (১.৫৪, ১.৬৪-৬৬) সাত্বত, পৌষ্কর ও জয়াখ্য সংহিতাকে বাসুদেব প্রোক্ত মূল বেদ অর্থাৎ একায়ন বেদ অনুসারী ‘দিব্য’ শাস্ত্র বলা হয়েছে। এই গ্রন্থে (১.৫৬, ৬৩) ব্রহ্মা, রুদ্র ও ঋষি প্রণীত পাঞ্চরাত্র শাস্ত্রসমূহকে ‘মুনিভাষিত’ শাস্ত্র ও মনুষ্য রচিত পাঞ্চরাত্র শাস্ত্রগ্রন্থগুলিকে ‘পৌরুষ’ শাস্ত্র বলে উল্লেখ করা হয়েছে। ঈশ্বরসংহিতায় (১.৫৭-৬২) একই সঙ্গে বাসুদেব থেকে উদ্ভূত পাঞ্চরাত্র শাস্ত্রগ্রন্থসমূহকে সাত্ত্বিক শাস্ত্র এবং সাত্ত্বিক শাস্ত্রের ভিত্তিতে রচিত পাঞ্চরাত্র ও বৈখানস শাস্ত্রগ্রন্থসমূহকে রাজস শাস্ত্র বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

পাঞ্চরাত্র শাস্ত্রগ্রন্থ – সংক্ষিপ্ত রূপরেখা

ঈশ্বরসংহিতা (২১.৫৬০-৫৬১) ও পাদ্মসংহিতায় (চর্যাপাদ।১৯.১১২-১১৩) সমগ্র পাঞ্চরাত্র আগমকে অর্থাৎ শাস্ত্রগ্রন্থকে ৪টি ভাগে সিদ্ধান্তে করা হয়েছে – আগম, মন্ত্র, তন্ত্র ও তন্ত্রান্তর। সম্ভবত পাঞ্চরাত্র শাস্ত্রগ্রন্থসমূহের মুখ্য বিষয়বস্তুর নিরিখে এই ৪টি বিভাগ করা হয়েছিল। তবে, পাঞ্চরাত্র শাস্ত্রগ্রন্থসমূহকে বিষয়ের ভিত্তিতে বিভাজন করা যায় কিনা এ বিষয়ে সন্দেহ আছে। প্রাচীন ও আদি-মধ্যযুগের ধর্মীয় সাহিত্যে উল্লিখিত সংহিতা বা তন্ত্র নামে অভিহিত পাঞ্চরাত্র শাস্ত্রগ্রন্থের সংখ্যা অনেক। মধ্যযুগের পাঞ্চরাত্র শাস্ত্রগ্রন্থ পাদ্মসংহিতা, কপিঞ্জলসংহিতা, ভারদ্বাজসংহিতা, পুরুষোত্তমসংহিতা, মার্কণ্ডেয়সংহিতা, বিশ্বসংহিতা ও বিশ্বামিত্রসংহিতায় (২.৩৩) ১০৮টি তন্ত্র বা সংহিতা গ্রন্থের কথা বলা হলেও, এই গ্রন্থসমূহে প্রদত্ত তালিকায় উল্লিখিত গ্রন্থের সংখ্যা এক নয়।

বিশ শতকের গোড়ার দিক থেকে আধুনিক বিদ্বানরা পাঞ্চরাত্র শাস্ত্রগ্রন্থের কয়েকটি তালিকা তৈরি করেছেন। ১৯১৬ সালে প্রকাশিত ইন্ট্রোডাক্শন টু দ্য পাঞ্চরাত্রঅ্যান্ড দ্য অহির্বুধ্ন্য সংহিতা গ্রন্থে কপিঞ্জলসংহিতা (১.১৪-২৭), পাদ্মতন্ত্র, বিষ্ণুতন্ত্র (দ্বিতীয় অধ্যায়), হয়শীর্ষসংহিতা (২.২-৯) ও অগ্নিপুরাণে (৩৯.২-৫) উল্লিখিত পাঁচটি তালিকা থেকে সংগৃহীত ২১৫টি পাঞ্চরাত্র শাস্ত্রগ্রন্থের নামের একটি তালিকা দেওয়া হয়। এরপর, ১৯৫৯ সালে মাদ্রাজ থেকে প্রকাশিত লক্ষ্মীতন্ত্র গ্রন্থের উপোদ্ঘাত অংশে পাদ্মসংহিতা, মার্কণ্ডেয়সংহিতা, কপিঞ্জলসংহিতা, ভারদ্বাজসংহিতা, হয়শীর্ষসংহিতা ও বিষ্ণুসংহিতা ও অন্যান্য গ্রন্থ থেকে সংকলিত ২২৫টি পাঞ্চরাত্র শাস্ত্রগ্রন্থের নামের তালিকা দেওয়া হয়েছে। হয়েছে। ১৯৬৭ সালে মাদ্রাজ থেকে পাঞ্চরাত্র পরিশোধন পরিষদ কর্তৃক তামিল ভাষায় প্রকাশিত ‘পাঞ্চরাত্র নূলবিলক্কম’ গ্রন্থে পূর্ববর্তী তালিকার সঙ্গে জ্ঞানামৃতসার, স্পন্দপ্রদীপিকা, মহেশ্বরতন্ত্র প্রমুখ গ্রন্থ থেকে সংগৃহীত নাম যোগ করে ২৮৮টি পাঞ্চরাত্র শাস্ত্রগ্রন্থের নামের তালিকা দেওয়া হয়।৩৩ তবে, এই তালিকাগুলিতে উল্লিখিত পাঞ্চরাত্র শাস্ত্রগ্রন্থসমূহের মধ্যে বহু সংখ্যক গ্রন্থ বর্তমানে পাওয়া যায় না। ‘সংহিতা’ বা ‘তন্ত্র’ নামে উল্লিখিত শাস্ত্রগ্রন্থগুলি ছাড়াও অন্ত-মধ্যযুগে পাঞ্চরাত্র অনুষ্ঠানপদ্ধতি নিয়ে কিছু ‘প্রয়োগ’ গ্রন্থও লেখা হয়েছিল।

আধুনিক বিদ্বানদের অনেকে বর্তমানে প্রাপ্ত প্রাচীন পাঞ্চরাত্র আগম গ্রন্থগুলির রচনার প্রারম্ভ সাধারণাব্দের পঞ্চম শতক বা তারও পূর্বে বলে অনুমান করেছেন।৩৪ তবে, আধুনিকতর সংহিতাগুলি রচনার কাজ ষোড়শ শতক সাধারণাব্দ পর্যন্ত চলেছিল বলে মনে হয়। আধুনিক বিদ্বানদের সাম্প্রতিক অনুমান, পাঞ্চরাত্র আগম গ্রন্থগুলির রচনার সূত্রপাত কাশ্মীর ও তার পার্শ্ববর্তী এলাকায় এবং পাঞ্চরাত্র আগম গ্রন্থে তান্ত্রিক অনুষ্ঠানরীতির অনুপ্রবেশ হয়েছে শৈব আগমের প্রভাবে। নেপাল থেকে প্রাপ্ত স্বায়ম্ভুবপঞ্চরাত্র, দেবামৃতপঞ্চরাত্র, বাসুদেবকল্প (মহালক্ষ্মীসংহিতার অংশ), জয়োত্তরতন্ত্র প্রমুখ পাঞ্চরাত্র গ্রন্থের প্রাচীন পাণ্ডুলিপিতে এই প্রভাবের সূচনা দেখতে পাওয়া যায়।৩৫ পাঞ্চরাত্র শাস্ত্রচর্চা কীভাবে কাশ্মীর ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চল থেকে সুদূর তামিল ভূমিতে পৌঁছাল, সেই ইতিহাস এখনও জানা যায়নি। কল্হণ তাঁর রাজতরঙ্গিণী (৬.৩০০,৩০৫) গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, দশম শতক সাধারণাব্দের শেষদিকে শাহীবংশীয় শাসক ভীমের দৌহিত্রী কাশ্মীরের শাসক দিদ্দা বৈকুন্ঠ বিষ্ণুর প্রতিমা স্থাপন করেন এবং কাশ্মীরে মধ্যদেশ (উত্তর ভারত), লাট (দক্ষিণ গুজরাত) ও শৌড়োত্র (সৌরাষ্ট্র বা ওড়িশা) থেকে আগত সন্ন্যাসীদের জন্য মঠ নির্মাণ করেন। সম্ভবত এই সন্ন্যাসীদের মাধ্যমেই কাশ্মীর থেকে দক্ষিণ ভারতে পাঞ্চরাত্র শাস্ত্রচর্চা উপনীত হয়েছিল। তামিল ভূমিতে পাঞ্চরাত্র শাস্ত্রচর্চার উল্লেখ সমন্বিত লেখ প্রথম পাওয়া যায় একাদশ শতক সাধারণাব্দে। তামিলনাড়ুর চেঙ্গলপট্টু জেলার তিরুমুক্কুদলে অবস্থিত ভেঙ্কটেশ পেরুমল মন্দিরের প্রাকারে উত্কীর্ণ বীররাজেন্দ্র চোলের (রাজত্বকাল ১০৬৩-১০৬৯ সাধারণাব্দ) ষষ্ঠ রাজ্যবর্ষের একটি তামিল লেখ থেকে জানা যায়, তিনি ঐ মন্দিরের জননাথ মন্ডপে অবস্থিত একটি শিক্ষায়তনে ঋগ্বেদ ও যজুর্বেদের সঙ্গে একই সাথে মহাপাঞ্চরাত্র, বৈখানস ও শৈব শাস্ত্রের চর্চারত ব্রাহ্মণদের জন্যও দান করেছিলেন।৩৬       

তিনটি মুখ্য প্রাচীন পাঞ্চরাত্র আগম গ্রন্থ সাত্বতসংহিতা, পৌষ্করসংহিতা ও জয়াখ্যসংহিতা পরবর্তী কালের পাঞ্চরাত্র শাস্ত্রগ্রন্থসমূহে ‘রত্নত্রয়’ নামে উল্লিখিত (পারমেশ্বরসংহিতা।১.১৯)। এই গ্রন্থগুলির বর্তমান রূপ সম্ভবত নেপাল থেকে পাওয়া প্রাচীন পাঞ্চরাত্র পাণ্ডুলিপিগুলির তুলনায় আধুনিক। সাত্বতসংহিতা ২৫টি পরিচ্ছেদে সম্পূর্ণ, পৌষ্করসংহিতা ৪৩টি অধ্যায় সমন্বিত এবং জয়াখ্যসংহিতা ৩৩টি পটলে বিভক্ত। জয়াখ্যসংহিতা ৬০০-৮৫০ সাধারণাব্দের মধ্যবর্তী সময়ে রচিত বলে আধুনিক বিদ্বানদের অনুমান। জয়াখ্যসংহিতা ও পৌষ্করসংহিতায় ভূর্জপত্র ও ভূর্জবৃক্ষের উল্লেখ থেকে অনুমান করা হয় এই গ্রন্থদ্বয় কাশ্মীরে রচিত। অন্যতম প্রাচীন পাঞ্চরাত্র শাস্ত্রগ্রন্থ অহির্বুধ্ন্যসংহিতায় ভূর্জপত্র (২৬.৭৫, ৪৫.৫৩) এবং হিমের (তুষার) (৩৯.২৩) উল্লেখ থেকে মনে করা হয় এই গ্রন্থটিও কাশ্মীরে রচিত। দুটি অর্ধে বিভক্ত এই বিশাল গ্রন্থটির পূর্বার্ধে ৩০টি অধ্যায় ও উত্তরার্ধে ৩০ অধ্যায় রয়েছে। যামুনাচার্যের কাশ্মীরাগমপ্রামাণ্য গ্রন্থটি লুপ্ত না হলে হয়তো জানা যেত, সাধারণাব্দের দশম-একাদশ শতকে দক্ষিণ ভারতে কোন পাঞ্চরাত্র আগমগ্রন্থগুলিকে কাশ্মীরের আগম বলে মনে করা হতো। 

ঈশ্বরসংহিতা গ্রন্থটি ঐতিহ্য অনুযায়ী সাত্বতসংহিতা থেকে উদ্ভূত, ২৫টি অধ্যায়ে সম্পূর্ণ। ঈশ্বরসংহিতায় যাদবাচল (মেলুকোটে), শ্রীরঙ্গ (শ্রীরঙ্গম) ও হস্তিশৈলের (কাঞ্চিপুরম) উল্লেখ (১.৬৭) ও যাদবাচল মাহাত্ম্য বর্ণনা (২০.১১২-৩২৯) থেকে অনুমান করা হয় এই গ্রন্থটি দক্ষিণ ভারতে রচিত। আধুনিক বিদ্বান মাৎসুবারার অনুমান, মুদ্রিত সংস্করণে প্রাপ্ত রূপটি প্রাচীন ঈশ্বরসংহিতা নয়।৩৭ ঐতিহ্যগতভাবে পৌষ্করসংহিতার সঙ্গে যুক্ত পারমেশ্বরসংহিতা ২৬টি অধ্যায়ে সম্পূর্ণ একটি উল্লেখনীয় পাঞ্চরাত্র শাস্ত্রগ্রন্থ। জয়াখ্যসংহিতার সঙ্গে ঐতিহ্য অনুযায়ী যুক্ত পাদ্মসংহিতায় পাঞ্চরাত্র রীতি অনুযায়ী পূজাবিধির বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য বিদ্যমান। এই শাস্ত্রগ্রন্থটি ৪টি পাদে বিভক্ত – ১২টি অধ্যায় বিশিষ্ট জ্ঞানপাদ, ৫টি অধ্যায় বিশিষ্ট যোগপাদ, ৩২টি অধ্যায় বিশিষ্ট ক্রিয়াপাদ ও ৩৩টি অধ্যায় বিশিষ্ট চর্যাপাদ। আজও কর্ণাটকের মেলকোটের শ্রীসম্পৎকুমার মন্দিরে ঈশ্বরসংহিতা, তামিলনাড়ুর শ্রীরঙ্গমের শ্রীরঙ্গনাথস্বামী মন্দিরে পারমেশ্বরসংহিতা ও কাঞ্চিপুরমের শ্রীবরদারাজস্বামী মন্দিরে পাদ্মসংহিতা অনুসারে দেবার্চনা করা হয়।

প্রথম সহস্রাব্দের শেষের দিকে বা দ্বিতীয় সহস্রাব্দের প্রথম দিকে রচিত বলে অনুমিত পাঞ্চরাত্র আগম গ্রন্থসমূহের মধ্যে সনৎকুমারসংহিতার বর্তমানে প্রাপ্ত খণ্ডিত পাণ্ডুলিপিগুলিতে সম্ভাব্য পাঁচটি অংশের মধ্যে চারটি অংশ বিদ্যমান – ব্রহ্মরাত্র, শিবরাত্র, ইন্দ্ররাত্র ও ঋষিরাত্র; পঞ্চম অংশ বৃহস্পতিরাত্র বর্তমানে বিলুপ্ত। ব্রহ্মরাত্র অংশে ১১টি অধ্যায় (প্রথম তিনটি অধ্যায় বর্তমানে লুপ্ত), শিবরাত্র অংশে ১০টি অধ্যায়, ইন্দ্ররাত্র অংশে ৯টি অধ্যায় ও ঋষিরাত্র অংশে ১০টি অধ্যায় আছে। তান্ত্রিক ভাবনায় প্রভূত প্রভাবিত লক্ষ্মীতন্ত্র ৫৭ অধ্যায়ে সম্পূর্ণ। এর ইংরেজিতে অনুবাদ হয়েছে। ৫৪টি অধ্যায়ে বিভক্ত শ্রীপ্রশ্নসংহিতা সম্ভবত যামুনাচার্যের পরবর্তীকালের রচনা, তামিলনাড়ুর কুম্ভকোনমের শার্ঙ্গপাণি মন্দিরে এখনও এই গ্রন্থ অনুযায়ী দেবার্চনা করা হয়। ৩১টি অধ্যায় বিশিষ্ট পরমসংহিতা যথেষ্ট পুরানো, যামুনাচার্য তাঁর রচনায় এই গ্রন্থ থেকে শ্লোক উদ্ধৃত করেছেন। এই গ্রন্থের ইংরেজিতে অনুবাদও হয়েছে। বিষ্ণুতত্ত্বসংহিতা ৩৯টি অধ্যায় বিশিষ্ট। পরাশরসংহিতা ৩১টি অধ্যায়ে সমাপ্ত। অনিরুদ্ধসংহিতা মহোপনিষদ ৩৪টি অধ্যায় বিশিষ্ট, কাশ্যপসংহিতা ১৩টি অধ্যায় বিশিষ্ট ও বিহগেন্দ্রসংহিতা ২৪টি অধ্যায় বিশিষ্ট। মুদ্রিত সংস্করণে সুদর্শনসংহিতায় ৪১টি অধ্যায়, বসিষ্ঠসংহিতায় ২৪টি অধ্যায়, বিশ্বামিত্রসংহিতায় ২৭টি অধ্যায় এবং বিষ্ণুসংহিতায় ৩০টি পটল আছে। মুদ্রিত সংস্করণে প্রাপ্ত অগস্ত্যসংহিতার বর্তমান রূপে ৩৪টি (বা ৩২টি) অধ্যায় বিদ্যমান, এই রূপটি অন্ত-মধ্যযুগে রচিত, আদৌ পাঞ্চরাত্র শাস্ত্রগ্রন্থ নয়। প্রকৃত পাঞ্চরাত্র শাস্ত্রগ্রন্থ অগস্ত্যসংহিতার খণ্ডিত পাণ্ডুলিপিসমূহের ভিত্তিতে ১২টি অধ্যায়ের পুনর্গঠন করা সম্ভব হয়েছে। ৩২ অধ্যায়ে সম্পূর্ণ মার্কণ্ডেয়সংহিতায় ১০৮টি পাঞ্চরাত্র সংহিতার কথা বলা হয়েছে এবং ৯১টি সংহিতার উল্লেখ আছে। মুদ্রিত সংস্করণে বিষ্বক্সেনসংহিতা ৩৯টি অধ্যায় বিশিষ্ট ও হিরণ্যগর্ভসংহিতা মাত্র ৫টি অধ্যায়ে সম্পূর্ণ। কপিঞ্জলসংহিতা বেশ পরবর্তীকালের রচনা, ৩২টি অধ্যায়ে গ্রন্থটি সম্পূর্ণ। জনপ্রিয় ও মুদ্রিত পাঞ্চরাত্র শাস্ত্রগ্রন্থসমূহ ছাড়া আরও বেশ কিছু সংখ্যক শাস্ত্রগ্রন্থের পাণ্ডুলিপি দক্ষিণ ভারতের বিভিন্ন গ্রন্থাগারে বিদ্যমান। এখনও পর্যন্ত খুব কম সংখ্যক পাঞ্চরাত্র শাস্ত্রগ্রন্থ ইংরেজি বা অন্য ইউরোপীয় ভাষায় অনূদিত হয়েছে।

আনুমানিক অষ্টম শতক সাধারণাব্দে রচিত পাঞ্চরাত্র শাস্ত্রগ্রন্থ হয়শীর্ষসংহিতার (হয়শীর্ষ পঞ্চরাত্র নামে প্রকাশিত) বিদ্যমান রূপটি ৪টি কাণ্ডে বিভক্ত – আদি কাণ্ড বা প্রতিষ্ঠা কাণ্ডে ৪২টি (বা 88টি) পটল, সঙ্কর্ষণ কাণ্ডে ৩৯টি পটল, লিঙ্গ (বা লৈঙ্গ) কাণ্ডে ২০টি পটল এবং সৌর কাণ্ডে ৪৩টি পটল সমাবিষ্ট। হয়শীর্ষসংহিতার বিদ্যমান রূপটি উত্তর ভারতে রচিত বলে মনে করা হয়। এর অন্যতম কারণ হলো গ্রন্থটির প্রতিলিপি কেবলমাত্র কাশ্মীর (শারদা) ও নাগরী লিপিতে লেখার নির্দেশ (সঙ্কর্ষণ কাণ্ড।৩১.১০),৩৮ যদিও এই গ্রন্থটির বাংলা লিপিতে লেখা পাণ্ডুলিপি পাওয়া গেছে। দক্ষিণ ভারতের পাঞ্চরাত্র গ্রন্থসমূহ থেকে সম্পূর্ণ পৃথক দৃষ্টিকোণ থেকে হয়শীর্ষসংহিতায় (২.২-৯) ২৫টি পাঞ্চরাত্র শাস্ত্রগ্রন্থের নাম উল্লেখ করে হয়শীর্ষসংহিতাকে আদিগ্রন্থ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। নবম শতক সাধারণাব্দ বা তারও পরে উত্তর ভারতে রচিত অনুমিত অগ্নিপুরাণে (৩৯.২-৫) এর প্রায় পুনরাবৃত্তি করা হয়েছে। মিথিলার বিদ্বান দেবনাথ ঠক্কুর তর্কপঞ্চানন তাঁর ১৫০৯ সাধারণাব্দে লেখা মন্ত্রকৌমুদী (৩.১৫-১৯) গ্রন্থেও একই তালিকার উল্লেখ করেছেন। হয়শীর্ষসংহিতায় (৩.৩-৪, ১৫) পাঞ্চরাত্র ধর্মীয় অনুষ্ঠানে আচার্য বা দেশিক হিসাবে নিয়োগের জন্য কচ্ছ (গুজরাত), কাবেরী (অন্ধ্রপ্রদেশ ও তেলঙ্গানা), কোঙ্কন (গোয়া ও কর্ণাটক উপকূল), কামরূপ (অসম), কলিঙ্গ (ওড়িশা), কাঞ্চি (তামিলনাড়ু), কাশ্মীর, কোশল (ছত্তিসগড়) ও মহারাষ্ট্রের ব্রাহ্মণদের বর্জন করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। অগ্নিপুরাণে (৩৯.৬-৭) এরই প্রায় পুনরুল্লেখ করে শুধুমাত্র মধ্যদেশের (অর্থাৎ উত্তর ভারতের) ব্রাহ্মণরাই উপযুক্ত বলা হয়েছে।

পাঞ্চরাত্র দর্শন ও ধর্মতত্ত্ব

আদি-মধ্যযুগের দক্ষিণ ভারতে বিভিন্ন বৈষ্ণব দেবমন্দিরের অর্চক ব্রাহ্মণরা, অর্থাৎ যাঁরা পূজা-অর্চনার কাজ করতেন, তাঁরা মূলত পাঞ্চরাত্র বা বৈখানস সম্প্রদায়ভুক্ত ছিলেন। গৌতম ধর্মসূত্র (৩.২) থেকে মনে হয়, বৈখানসগণ আদিতে বনবাসী তপস্বী সম্প্রদায় ছিলেন। এই সম্প্রদায়ের প্রাচীন ইতিহাস সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানা নেই। নারায়ণীয় পর্বে (৩৩৬.১৩-১৪) উল্লিখিত একটি পুরাকথা অনুসারে সৃষ্টির প্রথম কল্পে নারায়ণ একান্তী ধর্ম অনুসারে দৈব ও পিতৃ যজ্ঞের অনুষ্ঠান করেন, ফেনপা ঋষিরা এই ধর্ম গ্রহণ করেন, তাঁদের কাছ থেকে বৈখানসরা লাভ করেন, এবং বৈখানসদের কাছ থেকে সোম লাভ করেন, তারপর সেই ধর্ম অন্তর্হিত হয়। দক্ষিণ ভারতের বৈখানস সম্প্রদায়ভুক্ত ব্রাহ্মণরা নিজেদের কৃষ্ণযজুর্বেদের তৈত্তিরীয় শাখার অন্তর্গত বৈখানস শাখার সঙ্গে যুক্ত বলে পরিচয় দিতেন। তাঁরা ধর্মীয় অনুষ্ঠানে তৈত্তিরীয় শাখার বৈদিক গ্রন্থসমূহে উল্লিখিত মন্ত্র ও অনুষ্ঠানরীতি ছাড়াও বৈখানস স্মার্তসূত্র ও বৈখানস আগম নামে পরিচিত গ্রন্থসমূহও অনুসরণ করতেন। পাঞ্চরাত্র সম্প্রদায়ভুক্ত ব্রাহ্মণরা নিজেদের শুক্লযজুর্বেদের কাণ্ব শাখার অন্তর্গত একায়ন শাখার অনুসারী বলে উল্লেখ করতেন। পাঞ্চরাত্র ব্রাহ্মণরা ধর্মীয় অনুষ্ঠানে কাত্যায়নগৃহ্যসূত্র ও পাঞ্চরাত্র আগমগ্রন্থের তান্ত্রিক ভাবনা সম্পৃক্ত মন্ত্র ও অনুষ্ঠানরীতি অনুসরণ করতেন। দশম শতক সাধারণাব্দে নাথমুনি স্থাপিত দক্ষিণ ভারতের শ্রীবৈষ্ণব সম্প্রদায়ের ব্রাহ্মণরা পাঞ্চরাত্র আগম নির্দেশিত অনুষ্ঠানরীতি অনুসরণ করেন। শ্রীবৈষ্ণব সম্প্রদায়ের দুই ব্রাহ্মণ বিদ্বান যামুনাচার্য (দশম-একাদশ শতক সাধারণাব্দ) এবং বেদান্তদেশিক (ত্রয়োদশ শতক সাধারণাব্দের শেষার্ধ) পাঞ্চরাত্র শাস্ত্রবিহিত অনুষ্ঠানের প্রামাণ্য প্রতিপন্ন করতে তাঁদের আগমপ্রামাণ্য ও পঞ্চরাত্ররক্ষা গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। অবশ্য, উভয়েই তাঁদের রচনায় বৈখানস আগমকেও পাঞ্চরাত্র আগমের সমান মর্যাদা দিয়েছেন। শ্রীবৈষ্ণব সম্প্রদায় অনুসৃত বিশিষ্টাদ্বৈতবাদী দর্শনের তাত্ত্বিক ভিত্তি একাদশ-দ্বাদশ শতক সাধারণাব্দে রামানুজাচার্য নির্মাণ করেন। তিনিও তাঁর ব্রহ্মসূত্রের শ্রীভাষ্যে উত্পত্তি অসম্ভব অধিকরণের (২.২.৪২-৪৫) ব্যাখ্যায় পাঞ্চরাত্র সৃষ্টিতত্ত্বকে সমর্থন করেছেন। ত্রয়োদশ শতক সাধারণাব্দে মধ্বাচার্য স্থাপিত দক্ষিণ ভারতের সদ্বৈষ্ণব বা ব্রহ্ম সম্প্রদায়ের ব্রাহ্মণরা দ্বৈতবাদী দর্শন অনুসরণ করলেও পাঞ্চরাত্র আগম নির্দেশিত অনুষ্ঠানরীতি অনুসরণ করেন। মধ্বাচার্য তাঁর ব্রহ্মসূত্রের ভাষ্যে একটি সূত্রের (১.১.৩) ব্যাখ্যায় কেবল চারটি বেদ, রামায়ণ, মহাভারত ও পাঞ্চরাত্রকে শাস্ত্র বলে স্বীকার করেছেন।      

আদি-মধ্যযুগ থেকে দক্ষিণ ভারতের পাঞ্চরাত্র ব্রাহ্মণরা মঠ ও মন্দির প্রতিষ্ঠা এবং পূজা-অর্চনার সঙ্গে যুক্ত থাকার কারণে পাঞ্চরাত্র শাস্ত্রগ্রন্থগুলিতে মন্দির নির্মাণ, প্রতিমা নির্মাণ, পূজা পদ্ধতি ও ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান নিয়ে বিস্তৃত আলোচনা করা হয়েছে। পরবর্তীকালে, শ্রীবৈষ্ণব ব্রাহ্মণরা পাঞ্চরাত্র শাস্ত্রগ্রন্থ অনুসারে ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান নির্বাহ করলেও প্রাচীন পাঞ্চরাত্র দর্শন বা ধর্মতত্ত্বের সঙ্গে তাঁদের নিজস্ব ভাবনার যথেষ্ট পার্থক্য ছিল। সেই কারণে, অধিকাংশ পাঞ্চরাত্র শাস্ত্রগ্রন্থের বর্তমানে বিদ্যমান রূপ থেকে প্রাচীন পাঞ্চরাত্র দর্শনের প্রকৃত তত্ত্বচিন্তা প্রায় অবলুপ্ত হয়ে গেছে। আধুনিক বিদ্বান সুরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্ত তাঁর অ্যা হিস্ট্রি অফ ইন্ডিয়ান ফিলোসফি বইয়ের তৃতীয় খণ্ডে লিখেছেন, বিপুল সংখ্যক পাঞ্চরাত্র শাস্ত্রগ্রন্থের মধ্যে খুব কম সংখ্যক গ্রন্থেই এই সম্প্রদায়ের দার্শনিক মত নিয়ে আলোচনা রয়েছে, অধিকাংশ গ্রন্থেরই উপজীব্য শুধু ধর্মীয় অনুষ্ঠান। কেবল জয়াখ্যসংহিতা, অহির্বুধ্ন্যসংহিতা, বিষ্ণুসংহিতা, বিহগেন্দ্রসংহিতা, পরমসংহিতা ও পৌষ্করসংহিতায় পাঞ্চরাত্র দার্শনিক মতের আলোচনা খুঁজে পাওয়া যায়। এর মধ্যে অহির্বুধ্ন্যসংহিতা ও জয়াখ্যসংহিতা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। তিনি তাঁর বইতে জয়াখ্যসংহিতা ও অহির্বুধ্ন্যসংহিতায় বর্ণিত পাঞ্চরাত্র দার্শনিক মতের বিস্তারিত আলোচনা করেছেন।৩৯

পাঞ্চরাত্র দর্শনের সৃষ্টিতত্ত্ব অনুযায়ী ব্রহ্মস্বরূপ ভগবান পরবাসুদেব (বা বিষ্ণু) চতুর্ব্যূহ, অর্থাৎ চারটি ব্যূহের (ব্যূহ অর্থ গুণের সমন্বয়) রূপে প্রকাশিত – বাসুদেব, সঙ্কর্ষণ, প্রদ্যুম্ন ও অনিরুদ্ধ। বাসুদেব থেকে সঙ্কর্ষণ, প্রদ্যুম্ন ও অনিরুদ্ধ রূপ তিনটি ব্যূহের উদ্ভব। পরবাসুদেব ‘ষাড়গুণ্যবিগ্রহ’ অর্থাৎ, জ্ঞান, শক্তি, ঐশ্বর্য, বল, বীর্য ও তেজ – এই ৬টি গুণসম্পন্ন। বাসুদেব রূপী ব্যূহও এই ৬টি গুণের সমাহার। সঙ্কর্ষণ, প্রদ্যুম্ন ও অনিরুদ্ধ রূপী অন্য তিনটি ব্যূহ দুটি গুণের সমাহার – সঙ্কর্ষণ জ্ঞান ও বল, প্রদ্যুম্ন ঐশ্বর্য ও বীর্য এবং অনিরুদ্ধ শক্তি ও তেজ (অহির্বুধ্ন্যসংহিতা।৫.১৭-১৮)। চারটি ব্যূহ থেকে আবার ১২টি ব্যূহান্তর উত্পন্ন হয় – বাসুদেব থেকে কেশব, নারায়ণ ও মাধব; সঙ্কর্ষণ থেকে গোবিন্দ, বিষ্ণু ও মধুসূদন; প্রদ্যুম্ন থেকে ত্রিবিক্রম, বামন ও শ্রীধর এবং অনিরুদ্ধ থেকে হৃষীকেশ, পদ্মনাভ ও দামোদর (অহির্বুধ্ন্যসংহিতা।৫.৪৫-৪৮, লক্ষ্মীতন্ত্র।১১.৩০)। সনৎকুমারসংহিতায় (ইন্দ্ররাত্র।৬.৩৩) এই দ্বাদশ ব্যূহান্তর রূপকে ১২টি মাসের অধিপতি বলে উল্লেখ করা হয়েছে। সনৎকুমারসংহিতায় (ইন্দ্ররাত্র।৬.৩৪-৩৫) এরপর আরও ১২ সংখ্যক বিদ্যেশ্বরের উদ্ভবের কথা বলা হয়েছে। পাঞ্চরাত্র আগম গ্রন্থসমূহে বর্ণিত সৃষ্টিতত্ত্ব অনুযায়ী সবশেষে ৩৯ সংখ্যক বিভবের (পৌরাণিক সাহিত্যে বিষ্ণুর অবতার বলে উল্লিখিত) উত্পত্তি হয়।৪০ লক্ষ্মীতন্ত্রে (৪.২৯) বলা হয়েছে, অনিরুদ্ধ থেকে বিভবদের উত্পত্তি হয়েছে। অহির্বুধ্ন্যসংহিতায় (৪.৬২-৬৮) বলা হয়েছে, প্রতিসঞ্চরকালে অর্থাৎ প্রলয়ের সময় অনিরুদ্ধ প্রদ্যুম্নে, প্রদ্যুম্ন সঙ্কর্ষণে এবং সঙ্কর্ষণ সনাতন বাসুদেবে লীন হয়ে যান।  

অহির্বুধ্ন্যসংহিতার সৃষ্টিতত্ত্বে একাধিক পর্যায়ে সৃষ্টির কথা বলা হয়েছে; প্রাথমিক পর্যায়কে শুদ্ধ সৃষ্টি (৫.৬০) ও  পরবর্তী পর্যায়কে শুদ্ধেতর সৃষ্টি (৬.৭) বলে উল্লেখ করা হয়েছে। জয়াখ্যসংহিতায় প্রাথমিক পর্যায়কে শুদ্ধ সর্গ (৪.১), মধ্যবর্তী পর্যায়কে প্রধান (বা প্রাধানিক) সর্গ (৩.১) ও অন্তিম পর্যায়কে ব্রহ্ম সর্গ (২.৭৩) বলা হয়েছে। অহির্বুধ্ন্য সংহিতায় (৬.৬) পরবাসুদেব থেকে ৩৯ সংখ্যক বিভবের উত্পত্তি পর্যন্ত সৃষ্টিকে শুদ্ধ সৃষ্টি বলা হয়েছে। পাঞ্চরাত্র শাস্ত্রগ্রন্থে বর্ণিত মধ্যবর্তী পর্যায়ের সৃষ্টির সঙ্গে সাংখ্য (বা যোগ) দর্শনের সৃষ্টিতত্ত্বের প্রচুর মিল থাকলেও কিছু মৌলিক পার্থক্য আছে, বিভিন্ন পাঞ্চরাত্র শাস্ত্রগ্রন্থে উল্লিখিত সৃষ্টিতত্ত্বের উপর সাংখ্য দর্শনের প্রভাবও সমান নয়। ফলে, বিভিন্ন পাঞ্চরাত্র শাস্ত্রগ্রন্থে উল্লিখিত তত্ত্বের সংখ্যাও এক নয়। লক্ষ্মীতন্ত্রে (৬.৪২-৪৪) ৩৫টি তত্ত্ব ও পাদ্মসংহিতায় (১.৮.৩৯-৪৮) ৫১টি তত্ত্বের কথা বলা হয়েছে। সাংখ্যের সৃষ্টিতত্ত্বের প্রকৃতি ও পুরুষের সঙ্গে পাঞ্চরাত্র সৃষ্টিতত্ত্বে (অহির্বুধ্ন্যসংহিতা।৭.৩) আর একটি ‘তত্ত্ব’ কাল সংযুক্ত হয়েছে।

উত্তর ও পূর্ব ভারতে পাঞ্চরাত্র

আদি মধ্যযুগেই দক্ষিণ ভারতের পাঞ্চরাত্র শাস্ত্র অনুসারী শ্রীবৈষ্ণব ব্রাহ্মণরা প্রাচীন পাঞ্চরাত্র দর্শনের পরিবর্তে বেদান্ত দর্শনকে অনুসরণ করতে শুরু করেন। কিন্তু, জয়ন্তভট্টের ন্যায়মঞ্জরী ও আগমডম্বর গ্রন্থে কাশ্মীরের পাঞ্চরাত্রদের সম্পর্কে মন্তব্যগুলি থেকে তাঁদের প্রাচীন পাঞ্চরাত্র মতের অনুসারী বলেই মনে হয়। সাধারণাব্দের দশম শতকে কাশ্মীরের বিদ্বান উত্পল তাঁর স্পন্দপ্রদীপিকা গ্রন্থে পাঞ্চরাত্র শাস্ত্রগ্রন্থসমূহ থেকে উদ্ধৃত শ্লোকগুলির ক্ষেত্রে সাধারণত পঞ্চরাত্র, পঞ্চরাত্রশ্রুতি, পঞ্চরাত্র উপনিষদ প্রভৃতি নাম উল্লেখ করেছেন। পাশাপাশি, তিনি পৌষ্কর, সাত্বত ও জয়া (জয়াখ্য) সংহিতার ক্ষেত্রে নাম উল্লেখ করে ও শ্রী যোগ করে উদ্ধৃত করেছেন।৪১ নিঃসন্দেহে তাঁর উদ্ধৃত পাঞ্চরাত্র শাস্ত্রগ্রন্থগুলির পাণ্ডুলিপি তখনও কাশ্মীরে বিদ্যমান ছিল। পরবর্তীকালে দক্ষিণ ভারত ছাড়া বাকি সর্বত্র পাঞ্চরাত্র শাস্ত্রগ্রন্থের পাণ্ডুলিপি কবে বিলুপ্ত হয়েছে বলা কঠিন। নেপাল থেকে প্রাপ্ত তালপত্রের উপর লেখা জয়াখ্যসংহিতা ও কয়েকটি প্রাচীন পাঞ্চরাত্র গ্রন্থের পাণ্ডুলিপি বাদ দিলে অধিকাংশ পাঞ্চরাত্র শাস্ত্রগ্রন্থের পাণ্ডুলিপি কেবলমাত্র দক্ষিণ ভারত থেকেই পাওয়া গেছে। কেবল হয়শীর্ষসংহিতার পাণ্ডুলিপি পূর্ব ভারত থেকে পাওয়া গেছে।

অন্ত-মধ্যযুগ থেকে দক্ষিণ ভারত ছাড়া অন্যত্র পাঞ্চরাত্র শাস্ত্রচর্চা সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানা যায়নি। উত্তর ও পূর্ব ভারতে অন্ত-মধ্যযুগের বৈষ্ণব সাহিত্যে উদ্ধৃত নারদ পঞ্চরাত্র নামে গ্রন্থটি পূর্ণত পাঞ্চরাত্র শাস্ত্রগ্রন্থ কিনা এ বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ আছে। চৈতন্য অনুসারী বৃন্দাবনের গোস্বামীদের উদ্ধৃত নারদ পঞ্চরাত্র গ্রন্থের এখনও সন্ধান পাওয়া যায়নি। শ্রী নারদ পঞ্চরাত্রম নামে জ্ঞানামৃতসার গ্রন্থের ১৮৬৫ সালে কলকাতার এশিয়াটিক সোসাইটি থেকে প্রকাশিত সংস্করণ ও অন্যান্য মুদ্রিত সংস্করণগুলির উত্স বাংলার বিভিন্ন স্থান থেকে পাওয়া পাণ্ডুলিপিসমূহ। কিন্তু, বর্তমানে প্রাপ্ত জ্ঞানামৃতসার বা জ্ঞানামৃতসারসংহিতা গ্রন্থে বর্ণিত তাত্ত্বিক ভাবনার সঙ্গে পাঞ্চরাত্র মতের সংযোগ অত্যন্ত ক্ষীণ। এই গ্রন্থটি পঞ্চদশ শতকের প্রথমার্ধে কাশ্মীরের নিম্বার্ক সম্প্রদায়ের অনুসারী কেশবভট্টের লেখা ক্রমদীপিকা, ওড়িশার গজপতি বংশীয় শাসক পুরুষোত্তমদেব (রাজত্বকাল ১৪৬৭-১৪৯৭ সাধারণাব্দ) রচিত গোপালার্চনাবিধি ও অন্ত-মধ্যযুগের বিভিন্ন বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের লেখকদের গ্রন্থ থেকে সংগৃহীত অংশের সঙ্গে কিছু নিজস্ব সংযোজন যুক্ত করে ষোড়শ শতকের গোড়ায় বা মাঝামাঝি (বা তারও পরে) রচিত বলে অনুমান করা হয়।৪২ ষোড়শ শতক সাধারণাব্দে রঘুনন্দন ভট্টাচার্য, তাঁর মঠপ্রতিষ্ঠাদিতত্ত্ব গ্রন্থে হয়শীর্ষসংহিতার সঙ্কর্ষণকাণ্ডের সমুদায়প্রতিষ্ঠা পটল থেকে উদ্ধৃত করে জানিয়েছেন, বল্লালসেন (সম্ভবত উত্তর ভারত থেকে বাংলায়) এই গ্রন্থের ‘দ্বিখণ্ডাক্ষরে’ লেখা পাণ্ডুলিপি আহরণ করেছিলেন।৪৩ চৈতন্যচরিতামৃত গ্রন্থে (মধ্যলীলা।নবম পরিচ্ছেদ) বলা হয়েছে, চৈতন্য মহাপ্রভু দক্ষিণ ভারত থেকে পাঞ্চরাত্র গ্রন্থ ব্রহ্মসংহিতার একটি খণ্ডিত পুথি সংগ্রহ করে নিয়ে এসেছিলেন।৪৪ বৃন্দাবনের গোস্বামীদের মধ্যে রূপ গোস্বামী, জীব গোস্বামী ও গোপালভট্ট রচিত গ্রন্থে হয়শীর্ষপঞ্চরাত্র, স্বায়ম্ভুব আগম, ত্রৈলোক্যসম্মোহনতন্ত্র, ভাগবততন্ত্র, সাত্বত, গরুড়সংহিতা, জাবালিসংহিতা, কাত্যায়নসংহিতা প্রমুখ পাঞ্চরাত্র শাস্ত্রগ্রন্থ থেকে শ্লোক উদ্ধৃত করা হয়েছে। ষোড়শ শতক সাধারণাব্দে বাঙালি কবি পরমানন্দ সেন ‘কবি কর্ণপুর’ তাঁর সংস্কৃত চৈতন্যচন্দ্রোদয় নাটকের ষষ্ঠ অঙ্কে হয়শীর্ষপঞ্চরাত্র ও কপিলপঞ্চরাত্র গ্রন্থের কথা উল্লেখ করলেও বৃন্দাবনের গোস্বামীদের রচনায় কপিলপঞ্চরাত্র গ্রন্থের কোনও উল্লেখ পাওয়া যায়নি।৪৫ সপ্তদশ শতক সাধারণাব্দের কবীন্দ্রাচার্য সরস্বতীর বারাণসীর গ্রন্থাগারে সংগৃহীত পুথির তালিকায় অথর্বণপঞ্চরাত্র, দেবীপঞ্চরাত্র, শিবপঞ্চরাত্র, বিষ্ণুপঞ্চরাত্র, গণেশপঞ্চরাত্র, ব্রহ্মপঞ্চরাত্র, হয়শীর্ষপঞ্চরাত্র, নারদীয়পঞ্চরাত্র, ভাগবতপঞ্চরাত্র, লোকমোহনপঞ্চরাত্র প্রমুখ কয়েকটি গ্রন্থের পাণ্ডুলিপির নামের উল্লেখ রয়েছে।৪৬ উত্তর ভারতের হয়শীর্ষপঞ্চরাত্র বা স্বায়ম্ভুবপঞ্চরাত্র বাদ দিলে অন্য পাঞ্চরাত্র পুথিগুলি কোথা থেকে সংগৃহীত বলা কঠিন, কারণ গোপালভট্ট ও কবীন্দ্রাচার্য উভয়েরই আদি-বাসভূমি দাক্ষিণাত্যে।

চৈতন্য মহাপ্রভুর অনুসারী গৌড়ীয় বৈষ্ণবদের ধর্মতত্ত্বের সঙ্গে দক্ষিণ ভারতের বৈষ্ণবদের ধর্মতত্ত্বের যথেষ্ট পার্থক্য থাকলেও আজও তাঁদের দেবার্চনা ও অন্য ধর্মীয় অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে মূলত গোপালভট্ট রচিত হরিভক্তিবিলাস গ্রন্থে উল্লিখিত পাঞ্চরাত্র শাস্ত্রগ্রন্থ নির্দেশিত রীতির অনুসরণ করা হয়। গোপালভট্টের পিতা বেঙ্কটভট্ট শ্রীবৈষ্ণব সম্প্রদায়ভুক্ত তামিল ব্রাহ্মণ ছিলেন, সম্ভবত সেই কারণেই গোপালভট্ট পাঞ্চরাত্র শাস্ত্র সম্পর্কে অভিজ্ঞ ছিলেন।৪৭ সেই অভিজ্ঞতার ফসল ২০টি বিলাসে সম্পূর্ণ হরিভক্তিবিলাস গ্রন্থ। সনাতন গোস্বামী এই গ্রন্থের দিগ্দর্শিনীটীকা নামে একটি ব্যাখ্যামূলক গ্রন্থ রচনা করেন। এ ছাড়া, বিগত কয়েক শতকে গৌড়ীয় বৈষ্ণবদের পাঞ্চরাত্র শাস্ত্রচর্চা সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানা নেই।

শেষকথন

প্রাচীন পাঞ্চরাত্রিকদের ‘আদিদেব’ ও ‘পরমেশ্বর’ (সাত্বতসংহিতা।৫.৯৮) নারায়ণের চতুর্ব্যূহ উপাসনার ধর্মকে একান্ত ধর্ম বা একান্তীদের ধর্ম নামে মহাভারতের নারায়ণীয় পর্বে (শান্তিপর্ব।৩৩৬.৪,৬৯,৭৬) উল্লিখিত হয়েছে। এই একান্তী (একেশ্বরবাদী) ঈশ্বরভাবনার সঙ্গে ভারতীয় উপমহাদেশের তৎকালীন অন্যান্য প্রচলিত ধর্মমতের ব্যাপক পার্থক্যের কারণেই সম্ভবত মহাভারতের নারায়ণীয় পর্বে (শান্তিপর্ব।৩২২.৭-৮, ৩২৫.১) এও বলা হয়েছে, ঋষি নারদকে মেরুপর্বতের উত্তর-পশ্চিমে ৩২ হাজার যোজন দূরে অবস্থিত শ্বেতদ্বীপে গিয়ে নারায়ণের উপাসকদের ও নারায়ণের প্রকৃত রূপের দর্শন লাভ করতে হয়েছিল। পরবর্তীকালের পাঞ্চরাত্র শাস্ত্রগ্রন্থেও শ্বেতদ্বীপ ও সেখানকার অধিবাসীদের নিয়ে সমতুল্য পুরাকথা বর্ণিত হয়েছে (পরমসংহিতা।১.১৭-২৪, ৩১.৪-২৩)। তবে, শুধুমাত্র এই পুরাকথাগুলির ভিত্তিতে ভারতীয় উপমহাদেশে পাঞ্চরাত্র সম্প্রদায়ের একেশ্বরবাদী ঈশ্বরভাবনা মধ্য এশিয়া থেকে বা কোনও বহিরাগত উত্স (খ্রিস্টধর্ম) থেকে আগত, ইউরোপীয় প্রাচ্যবিদদের এই রকম ধারণাকে৪৮ মেনে নেওয়া আদৌ যুক্তিসঙ্গত নয়। ভারতীয় উপমহাদেশের একেশ্বরবাদী ধর্মে উপাস্য পরমেশ্বরের সঙ্গে অন্য দেবদেবীদেরও অস্তিত্বের স্বীকৃতি পশ্চিম এশিয়ার একেশ্বরবাদী ধর্মগুলিতে দেখা যায়নি।   

ভারতীয় উপমহাদেশের ধর্ম ও দর্শনের ইতিহাস চর্চার সঙ্গে যুক্ত আধুনিক বিদ্বানদের মধ্যে দীর্ঘদিন যাবৎ পাঞ্চরাত্র সম্প্রদায় নিয়ে কৌতূহল থাকলেও পাঞ্চরাত্রিকদের উদ্ভব, বিবর্তন ও প্রভাববিস্তারের দীর্ঘ ইতিহাসের সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট সম্পর্কে সার্বিক বিশ্লেষণ এখনও খুঁজে পাইনি। ভারতের মন্দির স্থাপত্যরীতি, প্রতিমা নির্মাণরীতি ও দেবার্চনা পদ্ধতির উপর পাঞ্চরাত্র ভাবনার প্রভাব নিয়েও এখনও আরও অনুসন্ধানের প্রয়োজন আছে। পাঞ্চরাত্র আগমের সঙ্গে শৈব আগমের তুলনামূলক আলোচনা হলেও, ভগবদ্গীতা, ভাগবত ও অন্যান্য বৈষ্ণব পুরাণ এবং বৈষ্ণব উপনিষদগুলির সঙ্গে পাঞ্চরাত্র শাস্ত্রগ্রন্থের সম্পর্ক নিয়েও এখনও বিস্তারিত গবেষণা চোখে পড়েনি। ভবিষ্যতের গবেষণা এই বিষয়গুলি নিয়ে আরও আলোকপাত করতে পারে বলে মনে হয়।

টীকা

১. Suvira Jaiswal, ‘The Origin and Development of Vaiṣṇavism (Vaiṣṇavism from 200 BC to AD 500)’; Delhi: Munshiram Manoharlal, 1967, pp. 32-33.

২. Edward James Rapson, ‘Catalogue of the Coins of the Andhra Dynasty, the Western Kṣatrapas, the Traikūṭaka Dynasty and the “Bodhi” Dynasty’; London: The Trustees of the British Museum, 1908, pp. 198-203.

৩. Bahadurchand Chhabra and Govind Swamirao Gai edited, Devdatta Ramkrishna Bhandarakar revised, ‘Corpus Inscriptionum Indicarum, Vol. III, Inscriptions of the Early Gupta Kings’; New Delhi: The Director General, Archaeological Survey of India, 1981, p. 253n3

৪. গ্রিয়ারসন তাঁর ১৯০৯ সালে প্রকাশিত নিবন্ধে ভাগবত নামে যে বৈষ্ণব সম্প্রদায়কে ভারতে একেশ্বরবাদের প্রাচীনতম রূপ বলে উল্লেখ করেছেন, তা প্রকৃতপক্ষে পাঞ্চরাত্র সম্প্রদায়। দেখুন, G.A. Grierson, “The Monotheistic Religion of Ancient India and its Descendant, The Modern Hindu Doctrine of Faith” in ‘The Imperial and Asiatic Quarterly Review, Third Series, Vol. XXVIII, July-October 1999’; Woking: Oriental Institute, 1909, p. 118-119। 

৫. “বাসুদেবার্জুনাভ্যাং বুন্” – অষ্টাধ্যায়ী ৪.৩.৯৮। 

৬. B. Bhattacharya, “Forward” in Embar Krishnamacharya edited ‘Jayākhyasaṁhitā’; Baroda: Oriental Institute, 1931, p. 13.

৭. Osmund Bopearachchi, “Emergence of Vaishnava Imagery in Gandhara: Numismatic and Sculptural Evidence” in Nanditha Krishna edited, ‘Iconography of the Hindus, Buddhists & Jains: Proceedings of the National Conference on January 8 & 9, 2016’; Chennai: C.P.R. Institute of Indological Research, 2016, pp. 61-73.

৮. J. Irwin, “The Heliodorus Pillar in Besnagar” in B.K. Thapar edited, ‘Puratattva: Bulletin of Indian Archaeological Society, No. 8 1975-1976’; New Delhi: Indian Archaeological Society, 1978, pp. 166-178.

৯. Jitendranath Banerji, “Besnagar—One of the Earliest Seats of The Pancaratra Cult” in ‘Proceedings of the Indian History Congress, Fifth session, 1941’; Indian History Congress, 1941, pp. 147-152.

১০. D.R. Bhandarkar, “Hathi-Bada Brahmi Inscription at Nagari” in N.P. Chakravarti edited, ‘Epigraphia Indica, Vol. XXII 1933-34’; Delhi: Manager of Publications, 1938, pp. 198-205.

১১. H. Lüders, “Seven Brahmi Inscriptions from Mathura and Vicinity” in N.P. Chakravarti edited, ‘Epigraphia Indica, Vol. XXIV 1937-38’; Delhi: Manager of Publications, 1942, pp. 194-200.

১২. V.M. Apte, “The doctrine of the four Vyūhas (chatur-vyūha)” in R.C. Majumdar, A.D. Pusalkar and A.K. Majumdar edited, ‘The Age of Imperial Unity’; Mumbai: Bharatiya Vidya Bhavan, 2001, p. 448.

১৩. Alf Hiltebeitel, “The Nārāyaṇīya and the Early Reading Communities of the Mahābhārata” in Patrick Olivelle edited ‘Between the Empires: Society in India 300 BCE to 400 CE’; New York: Oxford University Press, p. 227.

১৪. R.C. Majumdar, ‘Inscriptions of Kambuja’; Calcutta: The Asiatic Society, 1953, pp. 560-561.

১৫. ibid, pp. 119-127.

১৬. V.S. Agrawala, ‘India as known to Pāṇini’; Lucknow: University of Lucknow, 1953, p. 360.

১৭. প্রবোধেন্দ্রনাথ ঠাকুর অনূদিত, ‘হর্ষচরিত’; কলিকাতা: রঞ্জন পাবলিশিং হাউস, ১৯৫২, পৃ. ২৮৭।  

১৮. Swami Gambhirananda translated, ‘Brahma-Sutra-Bhasya of Sri Sankaracarya’; Calcutta: Advaita Ashrama, 1956, pp. 439-443.

১৯. R.G. Bhandarkar, ‘Vaiṣṇavism, Śaivism and Minor Religious Sects’; Varanasi: Indological Book House, 1965 [1913], p. 12.

২০. Suvira Jaiswal, ‘The Origin and Development of Vaiṣṇavism (Vaiṣṇavism from 200 BC to AD 500)’, pp. 44-46.

২১. Jan Gonda, ‘Medieval Religious Literature in Sanskrit’; Wiesbaden: Otto Harrassowitz, 1977, pp. 48-49.

২২. J.A.B. van Buitenen, ‘Yāmuna’s Āgama Prāmāṇyam or the Treatise on the Validity of the Pañcarātra: Sanskrit Text and English Translation’; Madras: Ramanuja Research Society, 1971, p. 5.

২৩. Doris Srinivasan, “Early Vaiṣṇava Imagery: Caturvyūha and Variant Forms” in ‘Archives of Asian Art, Vol. 32’; New York: Asia Society, 1979, pp. 39-54.

২৪. Maheshwari Prasad, “Two Viṣṇu images and their Cult Affiliation” in Surya Kanta edited, ‘Bhāratī, Bulletin of the College of Indology, Number Four’; Varanasi: Banaras Hindu University Press, 1960-61, pp. 146-147 ও Devangana Desai, “The Kashmir Connection of the Vaikuṇtha Image of Khajuraho” in Gerd J.R. Mevissen and Arundhati Banerji edited, ‘Prajñādhara: Essays on Asian Art, History, Epigraphy and Culture in Honour of Gouriswar Bhattacharya’; New Delhi: Kaveri Books, 2009, pp. 95-98। আরও দেখুন, Doris Meth Srinivasan, ‘Many Heads, Arms and Eyes: Origin, Meaning and Form of Multiplicity in Indian Art’; Leiden: Brill, 1997, pp. 240-241; Adalbert J. Gail, “On the Symbolism of Three- and Four-Faced Viṣṇu Images: A Reconsideration of Evidence” in ‘Artibus Asiae, Vol. 44, No. 4’; Zurich: Artibus Asiae Publishers, 1983, pp. 297-307।

২৫. F. Kielhorn, “Inscriptions from Khajuraho” in Jas Burgess edited, ‘Epigraphia Indica, Vol. I’; Calcutta: The Superintendent of Government Printing, India, 1892, pp. 122-135.

২৬. C.R. Swaminathan edited and translated, ‘Kāṇvaśatapathabrāhmaṇam, Vol. VII’; New Delhi: Indira Gandhi National Centre for the Arts, 2015, pp. 271-279.

২৭. F. Otto Schrader, ‘Introduction to the Pāñcarātra and the Ahirbudhnya Samhitā’; Madras: Adyar Library, 1916, pp. 25-26; আরও দেখুন, Surendranath Dasgupta, ‘A History of Indian Philosophy, Vol. III’; Cambridge: Cambridge University Press, 1952 [1940], p. 12.

২৮. J.A.B. van Buitenen, “The Name “Pañcarātra”” in ‘History of Religions, Vol. 1, No. 2’; Chicago: The University of Chicago Press, 1962, pp. 291-299.

২৯. V. Raghavan and Anantlal Thakur edited, ‘Āgamaḍambara, otherwise called Ṣaṇmatanāṭaka of Jayanta Bhaṭṭa’; Darbhanga: Director, Mithila Institute, 1964, pp. 74-75.

৩০. Surya Narayana Sukla edited, ‘The Nyāyamañjarī of Jayantabhaṭṭa’; Benares: The Chowkhamba Sanskrit Series Office, 1936, pp. 241-242.

৩১. Surendranath Dasgupta, ‘A History of Indian Philosophy, Vol. III’, pp. 19-20.

৩২. নিত্যানন্দ পন্ত পর্বতীয় সম্পাদিত, ‘মহামহোপাধ্যায় পণ্ডিত মিত্রমিশ্রপ্রণীতঃ বীরমিত্রোদয়ঃ (পরিভাষাপ্রকাশঃ সংস্কারপ্রকাশশ্চ) (ভাগদ্বয়াত্মকঃ)’; বারাণসী: চৌখম্বা সংস্কৃত সীরীজ অফিস, ১৯৮৭, পৃ. ২০-২৫।

৩৩. Parampurushdas and Shrutiprakashdas edited, ‘Catalogue of Pañcarātra Saṁhitā’; Amdavad: Swaminarayan Aksharpith, 2002, p. 57.

৩৪. B. Bhattacharya, “Forward” in Embar Krishnamacharya edited ‘Jayākhyasaṁhitā’; Baroda: Oriental Institute, 1931, pp. 34-35.

৩৫. Alexis Sanderson, “The Śaiva Age” in Shingo Einoo edited, ‘Genesis and Development of Tantrism’; Tokyo: Institute of Oriental Culture, University of Tokyo, 2009, pp. 61-70.

৩৬. K.V. Subrahmanya Ayyar, “The Tirumukkudal Inscription of Virarajendra” in Hirananda Sastri, K.N. Dikshit and N.P. Chakravarti edited, ‘Epigraphia Indica, Vol. XXI, 1931-32’; Delhi: Manager of Publications, 1933, pp. 220-250.

৩৭. Mitsunori Matsubara, ‘Pāñcarātra Samhitās and Early Vaiṣṇava Theology’; Delhi: Motilal Banarsidass, 1994, pp. 28-31.

৩৮. K.K. Dutta Śāstrī, “The Ritual of Manuscripts” in Bishnupada Bhattacharya edited, ‘Our Heritage: Bulletin of the Department of Post-graduate Training and Research, Sanskrit College, Calcutta, Vol XIX, Part I, January-June, 1971’; Calcutta: Sanskrit College, 1971, p. 23.

৩৯. Surendranath Dasgupta, ‘A History of Indian Philosophy, Vol. III’, pp. 24-62.

৪০. অহির্বুধ্ন্যসংহিতা (৫.৫০-৫৬), সাত্বতসংহিতা (৯.৭৭-৮৩) ও লক্ষ্মীতন্ত্রে (১১.১৯-২৫) উল্লিখিত নারায়ণের ৩৯টি বিভবের নাম মোটামুটিভাবে এক। এই দুই পাঞ্চরাত্র শাস্ত্রগ্রন্থে উল্লিখিত বিভবদের নাম: (১) পদ্মনাভ, (২) ধ্রুব, (৩) অনন্ত, (৪) শক্ত্যাত্মা (বা শক্তীশ), (৫) মধুসূদন, (৬) বিদ্যাধিদেব, (৭) কপিল, (৮) বিশ্বরূপ, (৯) বিহঙ্গম, (১০) ক্রোড়াত্মা (বা ক্রোধাত্মা), (১১) বড়বাবক্ত্র, (১২) ধর্ম, (১৩) বাগীশ্বর, (১৪) একাম্ভোনিধিশায়ী (বা একার্ণবশায়ী), (১৫) কমঠেশ্বর (বা কমঠাকৃতি বা কূর্ম পাতালধারক), (১৬) বরাহ, (১৭) নরসিংহ (বা নারসিংহ),  (১৮) পীযূষহরণ (বা অমৃতাহরণ), (১৯) শ্রীপতি ভগবানদেহ (বা শ্রীপতি দিব্যদেহ), (২০) কান্তাত্মা অমৃতধারক, (২১) রাহুজিৎ, (২২) কালনেমিঘ্ন, (২৩) পারিজাতহর, (২৪) লোকনাথ, (২৫) শান্তাত্মা, (২৬) দত্তাত্রেয় মহাপ্রভু, (২৭) ন্যগ্রোধশায়ী, (২৮) একশৃঙ্গতনু, (২৯) বামনদেহ, (৩০) ত্রিবিক্রম, (৩১) নর, (৩২) নারায়ণ, (৩৩) হরি, (৩৪) কৃষ্ণ, (৩৫) জ্বলত্পরশুধৃক রাম, (৩৬) ধনুর্ধর রাম, (৩৭) বেদবিদ, (৩৮) কল্কি ও (৩৯) পাতালশয়ন।

৪১. Mark Dyczkowski edited, ‘Spandapradīpikā: A Commentary on the Spandakārikā by Bhagabadutpalācārya’; Varanasi: Indica Books, 2000, p. 3, 9, 12, 21.  

৪২. G.C. Tripathi, “Some Remarks on the Supposed Nārada-Pāñcarātra” in ‘Indo-Iranian Journal, Vol, 18, No. 1/2, June/July 1976’; Brill, 1976, pp. 1-15.

৪৩. ‘শ্রীরঘুনন্দনভট্টাচার্য্যবিরচিতানি অষ্টাবিংশতিতত্ত্বানি, দ্বিতীয়োভাগঃ’; শ্রীরামপুর: শ্রীরামপুর মুদ্রাযন্ত্র, ১৮৩৫, পৃ. ৩৫২।

৪৪. উপেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় সম্পাদিত, ‘শ্রীশ্রীচৈতন্যচরিতামৃত’; কলিকাতা: বসুমতী সাহিত্য মন্দির, নবম সংস্করণ, ১৯৭৯, পৃ. ১৩৭।

৪৫. A.K. Majumdar, ‘Caitanya, His Life and Doctrine: A Study in Vaiṣṇavism’; Bombay: Bhartiya Vidya Bhavan, 1969, pp. 296-298.

৪৬. R. Ananta Krishna Sastry edited, ‘Kavindracharya List’; Baroda: Central Library, 1921, pp. 23-24, 26.

৪৭. A.K. Majumdar, ‘Caitanya, His Life and Doctrine: A Study in Vaiṣṇavism’, p. 297.

৪৮. Albrecht Weber, ‘Indische Studien: Zeitschrift für die Kunde des Indischen Alterthums, Erster Band’; Berlin: Ferd. Dümmler’s Buchhandlung, 1850, p. 400.

সহায়ক গ্রন্থ

১. Embar Krishnamacharya critically edited, ‘Jayākhyasaṁhitā’; Baroda: Oriental Institute, 1931.

২. F. Otto Schrader, ‘Introduction to the Pāñcarātra and the Ahirbudhnya Samhitā’; Madras: Adyar Library, 1916.

৩. গোবিন্দাচার্য সম্পাদিত, ‘শ্রীপাঞ্চরাত্রান্তর্গতা শ্রীপারমেশ্বরসংহিতা’; শ্রীরঙ্গম (তিরুচিরাপল্লি): কোদণ্ডরামসন্নিধি, ১৯৫৩।    

৪. H. Daniel Smith, ‘A Descriptive Bibliography of the Printed Texts of the Pāñcarātrāgama, Vol. I’; Baroda: Oriental Institute, 1975.

৫. Jan Gonda, ‘Medieval Religious Literature in Sanskrit’; Wiesbaden: Otto Harrassowitz, 1977, pp. 39-139.

৬. Kali Kumar Dutta Sastri edited, ‘Hayaśīrṣapañcarātra (Ādi kāṇḍa)’; Calcutta: The Asiatic Society, 1976.

৭. Lakshmi Narasimha Bhatta critically edited, ‘Viṣvaksena Saṁhitā’; Tirupati: Kendriya Sanskrit Vidyapeetha, 1972.

৮. Mitsunori Matsubara, ‘Pāñcarātra Samhitās and Early Vaiṣṇava Theology’; Delhi: Motilal Banarsidass, 1994.

৯. M.D. Ramanujacharya edited and V. Krishnamacharya revised, ‘Ahirbudhnya-Saṃhita of the Pāñcarātrāgama’; Madras: The Adyar Library and Research Centre, 1966.

১০. Priyabala Shah critically edited, ‘Viṣṇudharmottara-Purāṇa, Third Khaṇḍa’; Baroda: Oriental Institute, Vol. I: Text, Critical Notes etc., 1958, Vol. II: Introduction, Appendices, Indices etc., 1961.

১১. P.P. Apte critically edited, ‘Pauṣkara Saṁhitā’; Tirupati: Rashtriya Sanskrit Vidyapeetha, 1991.

১২. Sanjukta Gupta translated, ‘Lakṣmī Tantra: A Pāñcarātra Text’; Delhi: Motilal Banarsidass, 2000.

১৩. Seetha Padmanabhan and R.N. Sampath critically edited, ‘Pādma Samhitā’; Madras: Pāñcarātra Parisodhanā Pariṣad, Part I 1974, Part II 1982.

১৪. S. Krishnaswami Aiyangar edited and translated, ‘Paramasaṁhitā (of the Pāñcharātra)’; Baroda: Oriental Institute, 1940.

১৫. S.K. Belvalkar edited, ‘The Mahābhārata, for the first time critically edited, Fascicule 24, Mokṣadharma pt. 3’; Poona: Bhandarkar Oriental Research Institute, 1953, pp. 1812-1983.

১৬. T. Gaṇapati Śāstrī edited, ‘The Vishṇu Samhitā’; Trivandrum: The Superintendent Government Press, 1925.

১৭. Vraja Vallabha Dwivedi edited, ‘Sātvata-Saṁhitā with Commentary by Alaśiṅga Bhatta’; Varanasi: Sampurnanand Sanskrit Vishvavidyalaya, 1982.

১৮. V. Krishnamacharya edited, ‘Sanatkumāra-Samhitā of the Pāñcarātrāgama’; Madras: The Adyar Library and Research Centre, 1969.

১৯. V. Varadachari and G.C. Tripathi critically edited and translated, ‘Īśvarasaṁhitā’ in five volumes; New Delhi: Indira Gandhi National Centre for the Arts, 2009.

লেখক যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রযুক্তিবিদ্যার স্নাতক এবং বিগত তিন দশক ধরে বিমান প্রযুক্তিবিদ্যার সঙ্গে যুক্ত। ইতিহাসের আগ্রহী পাঠক। ইতিহাস নিয়ে লেখালেখির সূত্রপাত সাম্প্রতিক।

মন্তব্য তালিকা - “পাঞ্চরাত্র ও ভারতীয় উপমহাদেশে বৈষ্ণব ধর্ম”

  1. অসাধারণ লাগল। লেখার বিস্তার, ব্যাপকতা এবং সম্পূর্ণতা প্রশংসনীয়। পরিব্রাজকদের পাঁচ রাতের ব্যাপরটা বেশ ইন্টারেস্টিং

  2. খুব সুন্দর লাগল। কিন্তু পুরুষমেধ মানেই যে নরবলি হবে তার কোনো মানে নেই। বৈদিক গ্রন্থে পিতৃমেধের উল্লেখ আছে! তার মানে তো এই নয় যে বাবাকে বলি করা বা পূর্ব পুরুষদের বলি করা! এখানে পিতৃমেধ মানে পিতা বা পূর্ব পুরুষদের জন্য যজ্ঞ অর্থাৎ শ্রাদ্ধানুষ্ঠান! ঠিক তেমনি গো/অশ্ব/অবি(ভেঁড়া)/অজ(পাঁঠা)মেধ ইত্যাদি এমনকি পুরুষমেধ/ নরবলিও হতো বৈদিক যজ্ঞে তার প্রমাণ পুরাতাত্ত্বিক ভাবে প্রমাণিত। বৈদিক মতে পশুবলিকে বলি বলা হয় না তাকে পশ্যালম্ভন/আলম্ভন বলা হয়।বৈদিক যজ্ঞে শুরু থেকেই এই বলিপ্রথা চালু ছিল না অপেক্ষাকৃত অনেক প্রাচীন কাল থেকে তন্ত্রের কবলে পরে বৈদিক যজ্ঞ! প্রসঙ্গত বলে রাখি বৈদিক পশুবলি তন্ত্রের বলির থেকেও ভয়াবহ! সেখানে পশুর গলায়(মাথায় ও ঘাড়ে প্রহার করতে নিষেধ করেছে বৈদিক শাস্ত্র এবং আলম্ভনের সময় সবায় যেন যজ্ঞাগ্নির দিকে তাকায় কারণ এই কর্ম দেখার যোগ্য নয়! অর্থাৎ অহিংসার কথাও বলছে) দড়ি দিয়ে ফাঁস লাগিয়ে শ্বাস রোধ করে মারা হতো কিংবা হাতে করে শ্বাস রোধ করা হতো!! একটা গল্পে বলা হয়েছে প্রথমে পুরুষ/মানুষকে আলম্ভন করা হয় সেই মানুষের মেধ্যতা অর্থাৎ পবিত্রতা মানুষ থেকে অশ্বতে যায়, অশ্বের আলম্ভন করার পর সেই মেধ্যতা বৃষ/ষাঁড়ে যায় ষাঁড়কে আলম্ভন করালে সেই মেধ্যতা ভেঁড়াতে যায়,ভেঁড়ার আলম্ভনের পর সেই মেধ্যতা অজতে যায়, অজোর আলম্ভনের পর সেই মেধ্যতা পৃথিবীতে গিয়ে ব্রীহি(আয়ুশধান) ও যবের মধ্যে চলে যায়! অর্থাৎ ব্রীহি ও যব দ্বারা নির্মিত পুরোডাশ যজ্ঞে আহুতি দিলে সবকিছু পুণ্য অর্জন হবে। বৈদিক গ্রন্থে এটাও বলা আছে ব্রীহি ও যব চূর্ণকে যখন জল দিয়ে মাখানো হয় তখন পশুর মাংস! যখন শুকনো ভাজা হয় মানে স্যাকা হয় তখন পশুর অস্থি তারপর যখন তাতে ঘি দেওয়া হয় তখন তা মজ্জাতে পরিণত হয়ে মেধ্য পাক্তপশুতে পরিণত হয়! অর্থাৎ হিংসা থেকে অহিংসার পথে যাবার একটা ইতিহাস পাচ্ছি আমরা। এবার পুরুষমেধের কনসেপ্ট পুরুষসূক্ত থেকে এসেছে বলি আমি মনে করি। প্রমাণ আছে যে আসল পুরুষমেধে হত্যা করা হতো না! পুরুষ বা নারায়ণের যজ্ঞে অর্থাৎ বৈষ্ণব অনুষ্ঠানে তন্ত্রের প্রভাবেই হত্যা এসেছে শুধু তাই নয় বিষ্ণুর আভিচারিক রূপ গোপালকে মাছ মাংস দিয়ে পুজো করার মতো অশাস্ত্রিয় কাজ তন্ত্রের প্রভাবেই এসেছে! ভুলে গেলে চলবে না একদিন অহিংস বৌদ্ধ ধর্ম তন্ত্রের প্রভাবে এসে মূল স্রোত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়! এ কথা ইতিহাস সমর্থিত! সহজিয়া বৈষ্ণব মত তন্ত্রের প্রভাবেই আচার ভ্রষ্ট হয়েছে অতএব পাঞ্চরাত্র বৈষ্ণব ধর্মে তন্ত্র এসে মূল স্রোত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়নি এমন বলা যায় না! আমি বলছি না যে তন্ত্র মানেই খারাপ, আমার কথা একটা মতের উপর আধিপত্য বিস্তার করাটাই অপরাধ বা অনুচিত কাজ। প্রণাম নেবেন স্যার। ভালো থাকুন আপনি 🙏🙂

মন্তব্য করুন

আপনার ইমেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।