সূচী

ইতিহাস তথ্য ও তর্ক

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, আশুতোষ মুখোপাধ্যায় ও মৈমনসিংহ গীতিকা—শেষ পর্ব

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, আশুতোষ মুখোপাধ্যায় ও মৈমনসিংহ গীতিকা—শেষ পর্ব

লিপিকা ঘোষ

নভেম্বর ৯, ২০২৪ ৩৯ 0

বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্থিক সঙ্কট

গান্ধীজির ভারতীয় রাজনীতিতে আগমন ও অসহযোগ আন্দোলন ব্রিটিশরাজের কপালে নতুন ভাঁজ ফেলেছিল। সেই সঙ্গে ছাত্ররা স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় বয়কট করলে সেখানেও বিপর্যয় নেমে আসে। এই অবস্থা সামাল দিতে বড়লাট চেমসফোর্ড-এর আদেশে ছোটলাট রোনাল্ড আশুতোষ মুখোপাধ্যায়কে ১৯২১ সালে আবার উপাচার্যের পদে নিয়োগ করেন।

চেমসফোর্ড-এর শাসন-সংস্কার অনুযায়ী ১৯১৯ সালে নতুন শাসনবিধি দ্বৈত শাসনব্যবস্থা চালু হয়। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভার ভারত সরকারের হাত থেকে প্রাদেশিক সরকার অর্থাৎ বাংলা সরকারের হাতে চলে আসে। সপারিষদ গভর্নর জেনারেল বা বড়লাটের জায়গায় গভর্নর বা ছোটলাট হলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য। সরকারের শিক্ষা দপ্তরের ভার পেলেন বিশিষ্ট আইনজীবী স্যার প্রভাসচন্দ্র মিত্র। মন্ত্রী হওয়ার পর প্রভাসচন্দ্র মিত্র আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে অসহযোগিতা করতে শুরু করেন। শুধু অসহযোগিতা নয় রীতিমতো বিরুদ্ধাচরণ করতেন বলে প্রাক্তন রেজিস্টার দীনেশচন্দ্র সিংহ জানিয়েছেন তাঁর ‘প্রসঙ্গঃ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়’ বইয়ে। সরকারী অনুদান দিতে বিলম্ব শুরু হল তখন থেকেই। আর্থিক সঙ্কটের সময়ে আড়াই লক্ষ টাকার বিনিময়ে মন্ত্রী প্রভাসচন্দ্র মিত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্বভৌমত্ব কেড়ে নেবার চেষ্টা করলেন, শর্ত দিলেন। সেই শর্ত অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও কর্মচারি নিয়োগ থেকে শুরু করে পঠনপাঠনের জন্য পাঠ্যক্রম তৈরি, শিক্ষার বিষয় নির্ধারণ, পরীক্ষা ব্যবস্থা, প্রশ্নপত্র ও অন্যান্য সমস্ত বিষয় সরকারের হস্তক্ষেপ থাকবে। কোন বিষয় পড়ানো হবে, কোন বিষয়ের স্নাতকোত্তর বিভাগ থাকবে, কে কোন বিভাগে কাজ করবে, বিশ্ববিদ্যালয়ের সমস্ত বিষয়কে তারা গ্রাস করতে চাইল। আশুতোষ মুখোপাধ্যায় এই প্রস্তাব প্রত্যাখান করলেন। সিনেট সভায় বক্তৃতা দিতে উঠে তিনি বললেন-

‘আপনারা শুনে রাখুন, যতদিন আমার দেহে একবিন্দু রক্ত থাকবে সে পর্যন্ত আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের অবমাননায় অংশগ্রহণ করব না। এই বিশ্ববিদ্যালয়কে গোলাম তৈরির কারখানা হতে দেব না। আমরা সত্যের সন্ধানে থাকব। আমরা স্বাধীনতার শিক্ষা দেব। আমরা উঠতি প্রজন্মকে উচ্চ ও মহৎ চিন্তা এবং আদর্শে অনুপ্রাণিত করব। আমরা সরকারের দপ্তর খানার অংশবিশেষে পর্যবসিত হব না। ভুলে যাবেন না, যে টাকাটা আমাদের দেবার প্রস্তাব এসেছে তা কোনো স্থায়ী অনুদান নয়, এমন কি একটা নির্দিষ্ট সময়ের জন্য দানও নয়। কত টাকা দেবে?  মাত্র আড়াই লাখ। এর জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাধীনতা চিরতরে বন্ধক দিতে হবে। আমি জিজ্ঞাসা করি, আজ সন্ধ্যায় এখানে যারা সমবেত হয়েছি তাদের কি অধিকার আছে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকার ও মর্যাদা চিরতরে বিকিয়ে দেবার? বাংলার লোক আমাদের কী বলবে! ভারতবাসী আমাদের কী বলবে! পোষ্ট গ্র্যাজুয়েট শিক্ষকগণ কী বলবেন? তাঁরা আগামীকালই পদত্যাগ করবেন। এই অবমাননাকর শর্তে টাকা নেবার চেয়ে তাঁরা বরং নির্বাসনে যাবেন। অনাগত বংশধর আমাদের কী বলবে? ভবিষ্যত বংশধরগণ কি আমাদের এই বলে ধিক্কার দেবে না যে এই বিশ্ববিদ্যালয় সিনেট মাত্র আড়াই লাখ টাকার জন্য তার স্বাধীনতা বিকিয়ে দিয়েছে?’

বিশ্ববিদ্যালয়ের শুরুতে বাংলা পাঠ্যক্রম তৈরিতে পাদ্রিদের হস্তক্ষেপের প্রতিবাদ করে বিদ্যাসাগর মহাশয়ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়েছিলেন। তবে আশুতোষ মুখোপাধ্যায় ছাড়ার পাত্র নন। তিনি আরও বেশি করে আঁকড়ে ধরতে চাইলেন।

এরই মধ্যে আশুতোষের বিরুদ্ধে দেশীয় পণ্ডিতদের একটি দল তৈরি হয়েছিল ব্রিটিশদের ইশারায়। বিশ্ববিদ্যালয়ে কিছু লোক তাঁর বিরুদ্ধে অসন্তোষের বাতাবরণ তৈরি করেছিল। তারা সব সময় আশুতোষের সমস্ত কর্মকাণ্ডের বিরোধিতা করে দল পাকাত। তাঁদের বক্তব্য ছিল আশুতোষ মুখোপাধ্যায় অকারণ নিজের খেয়াল বশে নিত্যনতুন স্নাতকোত্তর বিভাগ চালু করছেন আর তার পিছনে একগাদা টাকা খরচ করে, অধ্যাপকদের অনেক বেশি মাইনে বাড়িয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের টাকাগুলো নষ্ট করছেন। তবে একথাও মনে রাখতে হবে আশুতোষ মুখোপাধ্যায় যখন উপাচার্য হন তখন বিশ্ববিদ্যালয়ে মাত্র দু’তিনজন কেরানি কাজ করতেন, আর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তাঁর অবসর নেওয়ার সময় সেই কেরানির সংখ্যা দাঁড়িয়েছিল প্রায় ১৫০ জন ও একজন অধ্যাপকের থেকে বেড়ে হয়েছিল ২৫ জন। সেই সময়ে তাঁরই প্রেরণায় বিভিন্ন ধনী ব্যক্তিরা বিশ্ববিদ্যালয়কে অর্থ দান করেছিলেন।   

এদিকে ব্রিটিশ সরকার ১৯১৭ সালে পাটনা বিশ্ববিদ্যালয় ও ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করল। এলাহাবাদ, লাহোর, লক্ষ্ণৌ বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকারী অনুদান বাড়িয়ে দিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে যখন নয় লক্ষ টাকা দিল তখন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়কে দিল মাত্র দেড় লক্ষ টাকা। তারা ১৯২২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে ‘রিফর্মড ইউনিভারসিটি’ আখ্যা দিল আর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়কে ‘আনরিফর্মড ইউনিভারসিটি’ আখ্যা দিল। আশুতোষ মুখোপাধ্যায় প্রথম থেকেই সরকারী অনুদানের অপেক্ষায় না থেকে দানশীল ধনীদের সাহায্যে এতবড় কর্মকাণ্ড ঘটালেন সেটা তাদের কাছে ভালো লাগার বিষয় ছিল না। তাই কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়কে বিপাকে ফেলতে চেয়েছিল সরকার। আশুতোষ মুখোপাধ্যায় স্নাতকোত্তর বিভাগের অধ্যাপকদের বেশি বেতন দিয়ে রাখেন বলে যে সরকার এতদিন অভিযোগ করছিল সেই সরকার অন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলি থেকে আরও বেশি বেতনের প্রস্তাব দিল সেই অধ্যাপকদের কাছেই। এদিকে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের যা আর্থিক অবস্থা তাতে অধ্যাপকদের সময় মতো মাইনে দিতে না পারায় অনেকে নিরুপায় হয়ে অন্যত্র চলে গেলেন। যাঁরা থেকে গেলেন তাঁরা বেশ কিছুদিন বেতন না পাওয়ায় অনটনের মধ্যে পড়লেন। দীনেশচন্দ্র সেন জানাচ্ছেন,

‘রাধাকুমুদ, রাধাকমল – দুইজন বিশিষ্ট অধ্যাপক লক্ষৌ চলিয়া গেলেন, রমেশ মজুমদার ঢাকায় কাজ গ্রহণ করিলেন। মেঘনাদ সাহা, হরদাস ভট্টাচার্য প্রভৃতি খ্যাতনামা অধ্যাপকরা কলকাতা ছাড়িয়া গেলেন। সহিদুল্লা ৪০০ টাকা বেতন পাইয়া ঢাকায় চলিয়া গেলেন… আশুবাবুর মনে হইতে লাগিল যেন বিশ্ববিদ্যালয়ের এক একটি হাড় খসিয়া পড়িতেছে। যারা রইলেন তাদের জন্যও দুশ্চিন্তার অন্ত ছিল না। তবু আশুতোষ বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাধীনতা সরকারের হাতে বিকিয়ে দেননি। তিনি তার আগেই আড়াই লক্ষ টাকার শর্ত সম্বন্ধে বলে রেখেছেন, ‘আপনারা একহাতে দিচ্ছেন দাসত্ব, আরেক হাতে অর্থ। আমি এই দান প্রত্যাখ্যান করছি। আমরা এই অর্থ নেব না। আমরা খরচ ছাঁটাই করব এবং আয়ের মাঝে চলতে চেষ্টা করব। আমরা সারা বাংলার ঘরে ঘরে ভিক্ষা করব। বাংলার যে জনমত কিছুকাল ধরে নির্জীব হয়ে রয়েছে, আমরা সেই জনমত উজ্জীবিত করব। বাঙালির বিদ্যাশিক্ষার প্রধান আলয়, মানবিক ক্রিয়াকর্মের প্রধান হাতিয়ার, এই বিশ্ববিদ্যালয় রক্ষার দায়িত্ব সম্পর্কে তাদের সচেতন করে তুলব। আমাদের দাবী ন্যায্য, আমরা অবমাননাকর শর্তের কাছে নত হব না। আমাদের পোস্টগ্র্যাজুয়েট শিক্ষকগণ স্বাধীনতা বিসর্জনের চেয়ে বরং উপবাসী থাকবেন আমি আপনাদের আহ্বান করছি, সিনেটের সদস্য হিসাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাধীনতা রক্ষায় রুখে দাঁড়ান। বাংলা সরকারের কথা ভুলে যান। ভুলে যান ভারত সরকারের কথা। আপনাদের মাতৃপ্রতিম এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট সদস্য হিসাবে কর্তব্য করে যান। স্বাধীনতাই প্রথম, স্বাধীনতাই দ্বিতীয়, স্বাধীনতাই সর্বক্ষণ। স্বাধীনতা ছাড়া আর কিছুতেই আমার সন্তুষ্টি নেই।’

তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের মান বাড়ানোর জন্য বিভিন্ন পরিকল্পনা করতে থাকেন। কলকাতার এক ধনী মাড়োয়ারিকে ১০ লক্ষ টাকা দিতে রাজি করালেন। কিন্তু বিরোধীদের কুমন্ত্রণায় তিনি পিছিয়ে গেলেন। ১৯২১ সালে আশুতোষ মুখোপাধ্যায় নিজে তিন হাজার টাকার সরকারি ঋণপত্র বিশ্ববিদ্যালয়কে দান করেন। বাংলাসাহিত্যে বিশেষ অবদানের জন্য তাঁর মায়ের নামে একটি স্বর্ণপদক দেওয়ার কথা ঘোষণা করেন। প্রথম রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে এই জগত্তারিনী স্বর্ণপদক দেওয়া হয়। ১৯২১ সালে খয়রার মহারাজা গুরুপ্রসাদ সিং ও রানি বাগেশ্বরী দেবীর মধ্যে উদ্ভূত মামলার মীমাংসা করে দিয়ে শর্ত অনুযায়ী সাড়ে ছ’ লাখ টাকা বিশ্ববিদ্যালয় হাতে পেয়েছিল। এই খয়রা মামলার টাকা খরচ করার জন্য একটি কমিটি ঠিক করেন। খয়রা ফান্ডের কমিটিতে রবীন্দ্রনাথও নমিনি হিসাবে সদস্য ছিলেন। এই টাকা থেকে যে আয় হত তা থেকে পাঁচটি নতুন অধ্যাপক পদের সৃষ্টি করলেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পরামর্শ অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রাচীন বঙ্গ সাহিত্যের সংকলন গ্রন্থ করার ভার পড়ল দীনেশচন্দ্র সেনের ওপর। পারিশ্রমিক হিসাবে চার হাজার টাকা অনুমোদন হল। তিন-চার হাজার প্রাচীন বাংলা পুঁথি তিন হাজার টাকায় কিনে পুঁথি শালা তৈরি করলেন। পরে পুঁথিশালায় প্রায় নয়-দশ হাজার পুঁথি আনা হয়েছিল। তবে এই সময় থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের খরচ কমানোর দিকে বিশেষ নজর দেওয়া হয়েছিল।

মৈমনসিংহ গীতিকার আত্মপ্রকাশ

এদিকে ১৯১৩ সালে মৈমনসিংহ জেলা থেকে প্রকাশিত কেদারনাথ মজুমদার সম্পাদিত সৌরভ পত্রিকার একটি সংখ্যায় দীনেশচন্দ্র সেন মৈমনসিংহ গীতিকার ৪/৫ টি ছত্র দেখতে পান। সেই পল্লীগীতি দীনেশচন্দ্রের খুব ভালো লাগায় অনেক কষ্টে মৈমনসিংহ জেলার আইথর গ্রামবাসী চন্দ্রকুমার দে’কে পান এবং তাঁকে মৈমনসিংহ জেলা ও তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চল ঘুরে পালাগান সংগ্রহ করার কথা বলেন। দীনেশচন্দ্র সেন চন্দ্রকুমার দে’কে মৈমনসিংহ জেলায় পালাগান সংগ্রহের জন্য দায়িত্ব দিয়ে আশুতোষ মুখোপাধ্যায়কে বলে তাঁর জন্য কিছু পারিশ্রমিকের ব্যবস্থা করে দেন। পরে ১৯২১ সালে মার্চে এক বছরের জন্য সংগ্রাহক রূপে নিয়োগ করার জন্য আশুতোষকে অনুরোধ করলে মাসে ৫০ টাকার দেওয়ার ব্যবস্থা হয়। এই ভাবে পরপর কয়েক বছর চন্দ্রকুমার দে পুনর্নিয়োজিত হলেন। যতদিন চন্দ্রকুমার মৈমনসিংহ জেলা থেকে গ্রামবাংলায় ঘুরে ঘুরে এই পালাগান সংগ্রহ করে দিয়েছিলেন ততদিন আশুতোষ মুখোপাধ্যায় তাঁকে পারিশ্রমিক দেবার ব্যবস্থা করেছিলেন। সঙ্গে আরও কয়েকজনকে সংগ্রাহক হিসাবে নিয়োগ করলেন। তারা স্নাতকোত্তর ডিগ্রিপ্রাপ্ত বলে তাদের ৭০ টাকা করে মাসে দেওয়ার ব্যবস্থা করলেন।

সংগৃহীত গীতিকা পড়ে দীনেশচন্দ্রের মনে হল,

‘এ কী স্বর্গের ভাণ্ডারের অমৃতবিন্দু পাইলাম, নন্দন উদ্যানের পারিজাত পাইলাম, না নারদের সুমধুর বীণাধ্বনি শুনিলাম। এই গীতগুলি আমার চক্ষে বঙ্গ-ভারতীর অদৃষ্টপূর্ব এক মনোমোহিনী মূর্তি প্রকটিত করিয়া দেখাইল। ইহা সম্পূর্ণ অনাস্বাদিত মধুচক্র, অনাঘ্রাত পুষ্পকলি।’

দীনেশচন্দ্র আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের কাছে গিয়ে বললেন যে তিনি এতদিন জানতেন বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ট সম্পদ বৈষ্ণব পদাবলী, কিন্তু তিনি আর এক ভাণ্ডারের সন্ধান পেয়েছেন। তিনি এও জানালেন যে তিনি এই গানগুলিকে উদ্ধার করতে চান। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের চরম আর্থিক সমস্যার মধ্যেও আশুতোষ মুখোপাধ্যায় দীনেশচন্দ্রকে সংগ্রহের সমস্ত খরচ দেবেন বলে আশ্বস্ত করলেন। তাঁর এই আশ্বাস শতগুণ মনোবল ও উদ্যম বাড়িয়েছিল দীনেশচন্দ্রের।

পালাগান সংগ্রহ করার পর তাকে সম্পাদনা করে বই আকারে প্রস্তুত করতে একজন টাইপিস্ট, একজন সহায়ক নিয়োগ করার ব্যবস্থা করা হল। বইয়ের টীকা লেখার জন্য চলিত ভাষায় পারদর্শী একজন সহায়ককে মাসে ৬০ টাকা দিয়ে নিয়োগ করলেন। পুর্ববঙ্গে পালাগানের বিপুল ভাণ্ডারের সন্ধান পেয়ে দীনেশচন্দ্র আশুতোষ মুখোপাধ্যায়কে আরও কয়েকজন সংগ্রাহক নিয়োগ করার প্রস্তাব দেন। দীনেশচন্দ্রের রামতনু লাহিড়ী ফেলোশিপের দ্বিতীয় বারের নিয়োগের পরই মৈমনসিংহ জেলার পালাগানগুলি তাঁর হাতে আসে।

মৈমনসিংহ জেলা থেকে পাওয়া দশটি গীতিকা সম্পাদনা করে ছাপাতে দেওয়ার আগে আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের কাছে অর্থের জন্য আবেদন করলে বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্থিক দুরবস্থার মধ্যেও তা গ্রাহ্য হয়। দীনেশচন্দ্র সিংহের ‘প্রসঙ্গঃ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়’ বইয়ের ১২৫ পাতায় লিখিত সিন্ডিকেটের রিপোর্ট অনুযায়ী ৮/৯/১৯২২ তারিখে ৫০০ কপি মৈমনসিংহ গীতিকা ছাপাতে রেজিস্টার ১৫৯৫ টাকার দরকার বলে জানান। সেই মতো সিন্ডিকেট অনুমোদন করে। ইংরাজিতে ইস্টার্ন বেঙ্গল ব্যালাডস ও বাংলা মৈমনসিংহ গীতিকা নিয়ে দীনেশচন্দ্র যে ফেলোশিপ বক্তৃতা দেন তা সম্পাদনা করে প্রকাশ করার সময় দীনেশচন্দ্র সেন স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়কে উত্সর্গ করেন। মৈমনসিংহ গীতিকার উত্সর্গ পত্রে তিনি লিখলেন–

‘যাঁহার উত্সাহ ভিন্ন এই পালাগানগুলি সংগৃহীত হইত না, বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘোর দুর্দিনেও যিনি উচ্চশিক্ষা কল্পে আমাদের প্রযত্ন একদিনের জন্যও শিথিল হইতে দেন নাই, সেই অপরাজেয় কর্মবীর, বঙ্গ-ভারতীর আশ্রয়-কল্পতরু, জ্ঞানরাজ্যের কল্পবৃক্ষ স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়, সি এস আই, এম এ ডি এল, ডি এস সি পি এইচ ডি, মহোদয়ের করকমলে ভক্তির এই সামান্য অর্ঘ্য মৈমনসিংহ গীতিকা অর্পিত হইল।’

মৈমনসিংহ গীতিকা প্রথম হাতে নিয়ে আশুতোষ মুখোপাধ্যায় তার গোঁফের তলায় পরিতৃপ্তির যে হাসি হেসেছিলেন তা দীনেশচন্দ্রের ভাষায় ‘পুন্নমাসী চাঁদ যেমন দেখায় নদীর তলা।‘

মৈমনসিংহ গীতিকা প্রকাশের বছরেই ১৯২৩ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আশুতোষ মুখোপাধ্যায় অবসর নেন। এর কিছুদিন পরে তিনি পাটনায় যান, সেখানে অসুস্থ হয়ে ১৯২৪ সালের ২৫ মে মারা যান।

তাঁর মৃত্যুর দু’দিন পর তাঁর সম্পর্কে কলকাতা হাইকোর্টের তত্কালীন প্রধান বিচারপতি বলেছেন,

“He was the greatest Bengalee of his generation. I do not thing that I would be wrong if I were to say that in many respects he was the greatest Indian of his days.” [তিনি ছিলেন তাঁর প্রজন্মের শ্রেষ্ঠ বাঙালি। আমার মনে হয় না খুব ভুল বলা হবে যদি আমি বলি তিনি ছিলেন তাঁর সময়ের শ্রেষ্ঠ ভারতীয়। (অনুবাদ সম্পাদকের)]

আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের আকস্মিক মৃত্যুর পর তাঁর দ্বিতীয় পুত্র শ্যামাপ্রসাদ ‘Bengali Ballads Committee’ নামে তিন সদস্যের একটি কমিটি গঠন করে অন্যান্য পূর্ববঙ্গ গীতিকা সংগ্রহ ও প্রকাশের কাজ চালাতে উত্সাহিত করেন। এই বেঙ্গল ব্যালাডস কমিটি একজন রিসার্চ স্কলার, চন্দ্রকুমার সহ তিনজন সংগ্রাহক ও একজন সহায়ক নিয়োগ করেন ১৯২৫ সালে। সেই সময় বাংলা তথা ভারতের রাজনৈতিক পালাবদল চলছিল। দ্বৈত শাসন ব্যবস্থার ফলে তখন শিক্ষা প্রাদেশিক সরকারের এক্তিয়ার ভুক্ত হয়, যার ফলে যে কোনো আর্থিক বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়কে সরকারের অনুমোদনের অপেক্ষায় থাকতে হত। অনেক চেষ্টা করে সরকারের কাছ থেকে খরচের অর্ধেক আদায় করা সম্ভব হয়েছিল—তাও তিন বছরের জন্য। প্রতি বছর তাদের কাছ থেকে গীতিকা সংগ্রহ ও প্রকাশের জন্য তিন হাজার টাকার কিছু বেশি আদায় করা গেছে। ঐ বছর ৬ জুনের কমিটি রিপোর্ট অনুযায়ী এই সময় চন্দ্রকুমার দে মাসে ২৫ টাকা করে পেতেন। ১৯২৮ সালের ১ জুন পুনর্নিয়োগের সময়ও চন্দ্রকুমার দে মাসে ২৫ টাকা করে পেতেন। কিন্তু  ১৯২৫ সালে ও তার আগে স্নাতকোত্তর ডিগ্রিপ্রাপ্ত সংগ্রাহকেরা মাসে ৭০ টাকা করে পেতেন, যেমন আশুতোষ চৌধুরী, জসিমুদ্দিন মুন্সি, মনোরঞ্জন চৌধুরী, নগেন্দ্রনাথ দে প্রমুখ। সংগৃহীত পালাগুলি থেকে ৫৪টি পালাগান বেছে নিয়ে সম্পাদনা করে দীনেশচন্দ্র শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের পৃষ্টপোষকতায় ‘পূর্ববঙ্গ গীতিকা’ নামে আরও তিনটি খণ্ড (দ্বিতীয় খণ্ড ১৯২৬ সালে, তৃতীয় খণ্ড ১৯৩০ সালে, ও চতুর্থ খণ্ড ১৯৩২ সালে) প্রকাশ করেন। এই গীতিকাগুলিও বাংলা সাহিত্যের ভাণ্ডারে মণি-মুক্তোর মতো চির উজ্জ্বল হয়ে আছে।

এই চারটি খন্ডের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য মৈমনসিংহ গীতিকা বিশ্বের দরবারে পৌঁছে গিয়েছিল ইংরাজিতে অনুদিত হওয়ার সুবাদে। অনুবাদ করেছিলেন দীনেশচন্দ্র সেন নিজেই। আমেরিকার বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ, লোকসাহিত্য গবেষক ও ইংরাজি সাহিত্যের প্রফেসর ফ্রান্সিস জেমস চাইল্ড-এর ‘The English and Scottish popular Ballads’ এর মতো জনপ্রিয় বাংলা সাহিত্যের প্রেমগাথা ‘মৈমনসিংহ গীতিকা’। এর দশটি পালাগানের নির্মল প্রেমগাথার সুবাস বাংলার বাতাসে মিশে আছে। মৈমনসিংহ গীতিকা শুধু নারী পুরুষের নয়, জাতি ধর্মের ভেদাভেদহীন অসাম্প্রদায়িক প্রেমের সুবাস ছড়ায়। এ গীতিকায় মুসলমান পীরের কাছে হিন্দুর ছেলে দীক্ষা নেয়, হিন্দুর ছেলে মুসলমানের মেয়ের প্রেমে পড়ে, হিন্দু-মুসলমান একাসনে বসে পালাগান শোনে আর গায়েন গলা ছেড়ে গান ধরে—‘সভা কইর‍্যা বইছ ভাইরে ইন্দু মুসলমান।/ সভার চরণে আমি জানাইলাম ছেলাম’।।

এমন গীতিকা যখন প্রকাশিত হল ভারতবর্ষ তখন দফায় দফায় মালাবার, পেশোয়ার, বাংলা, পাঞ্জাব, মুলতানে হিন্দু-মুসলমানের দাঙ্গা দেখছে। এই গীতিকা প্রকাশ ছিল দেশবাসীর সামনে সম্প্রীতির স্মারক প্রদর্শন। এই কাজটি সফল হয়েছিল আশুতোষ মুখোপাধ্যায় ও দীনেশচন্দ্র সেনের উদ্যোগ।

আজ বিশ্ববিদ্যালয় ‘ফাইভ স্টার’ মর্যাদা সম্পন্ন। তার মূল ভবন ‘আশুতোষ শিক্ষা প্রাঙ্গন’ নামাঙ্কিত। মেছোহাটার স্নাতকোত্তর বিভাগের ভবন ‘আশুতোষ ভবন’ নামে পরিচিত। আজ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরিতে দীনেশচন্দ্রের রচিত ও সম্পাদিত অধিকাংশ বই খুঁজে পাওয়া যায় না। এখান থেকে মৈমনসিংহ গীতিকার দু একটি সংখ্যা পাওয়া গেলেও অন্যতম শ্রেষ্ঠ পালা ‘মহুয়া’ পালার অনুবাদ প্রকাশিত হয়েছিল একাধিক ভারতীয় ও বিদেশি ভাষায়, তারও কোনও অস্তিত্ব নেই। নেই মৈমনসিংহ গীতিকা নিয়ে একমাত্র বিদেশি দুসান জুবাভিতেলের বিশ্লেষাত্মক বই ‘বেঙ্গলি ফোক ব্যালাডস ফ্রম ময়মনসিংহ অ্যান্ড দ্য প্রবলেম অফ দেয়ার অথেন্টিসিটি’-এর অস্তিত্বও। যদি এদের কোনো অস্তিত্ব থেকেও থাকে মৈমনসিংহ গীতিকা প্রকাশের শতবর্ষ উপলক্ষ্যে তা থেকে পুনরায় প্রকাশের কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি! একশো বছর আগে যে বই প্রকাশিত হয়ে বাংলা লোকসাহিত্যের গবেষণার রাস্তাকে শতগুণ প্রশস্ত করেছিল, অনুবাদ সাহিত্যকে প্রভাবিত করেছিল, সেই বই নিয়ে আজ শতবর্ষে এপারের ‘পুস্তক বিপণী’, ‘তবু একলব্য’, ওপারের ‘জলদ’ পত্রিকারা স্মরণ করলেও জন্মভিটেতে তার গুরুত্ব হারিয়েছে কি না সে প্রশ্ন থেকেই যায়।

দ্বিতীয় পর্বের লিংক
https://www.itihasadda.in/https-www-itihasadda-in-university-of-calcutta-ashutosh-mukhopadhyay-and-mymensingh-geetika-part-ii/

তথ্যসূত্র-

১) কনভোকেশন এড্রেস (১৮৫৮—১৯০৬), ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালকাটা, ২০০৭৷

২) শ্রী দীনেশচন্দ্র সেন, আশুতোষ—স্মৃতিকথা, পারুল প্রকাশন, ২০১১, পাতা ১০১।

৩) শ্রী দীনেশচন্দ্র সেন, মৈমনসিংহ—গীতিকা, প্রথম খণ্ড, দ্বিতীয় সংখ্যা, ১৯৯৩।

৪) ড. দীনেশচন্দ্র সিংহ, প্রসঙ্গঃ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, প্রকাশক কলকাতা বি বি, ২০০৭।

৫) সুদেষ্ণা চক্রবর্তী, স্মৃতি বিস্মৃতিতে দীনেশচন্দ্র সেন, ঘরে বাইরে প্রকাশনা, ২০২০

৬) প্রণব নস্কর, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকোত্তর বাংলা পাঠচর্চার প্রস্তুতিপর্ব ও আচার্য দীনেশচন্দ্র সেন, জলদ পত্রিকা, মৈমনসিংহ শতবর্ষ সংখ্যা, (সম্পাদক—স্বপন ধর) ২০২৩৷

৭) মনোজ মণ্ডল, বাংলা লোকসাহিত্যের যুগবিভাগ, জলদ পত্রিকা, মৈমনসিংহ শতবর্ষ সংখ্যা, (সম্পাদক—স্বপন ধর) ২০২৩৷

৮) সুমিত সরকার, আধুনিক ভারত ১৮৮৫-১৯৪৭, কে পি বাগচি এন্ড কম্পানি।

৯) কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরিতে ব্যক্তিগত অনুসন্ধান।

মন্তব্য করুন

আপনার ইমেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।