সূচী

ইতিহাস তথ্য ও তর্ক

কণাপদার্থবিদ্যার বিবর্তন (পর্ব – ২)

কণাপদার্থবিদ্যার বিবর্তন (পর্ব – ২)

কৃশানু নস্কর

অক্টোবর ১৯, ২০২৪ ২০১ 3

গত পর্বে কণাপদার্থবিদ্যার ধ্রুপদী যুগের বর্ণনার শেষে আমরা বলেছিলাম যে ততদিনে আরও তিনটি অসাধারণ আবিষ্কার ও তত্ত্বের ভিত গাঁথা হয়ে গেছে যা পরবর্তী যুগে বিজ্ঞানীদের রাতের ঘুম উড়িয়ে দেবে। সে তিনটি হল— ইউকাওয়ার মেসন, ডিরাকের পজিট্রন এবং পাউলির নিউট্রিনো। এগুলোর বিষয়েই আমরা আলোচনা করব এই পর্বে।

কণাপদার্থবিদ্যার মধ্যযুগ: মেসন, বিপ্রতীপ কণা (Anti-particle) ও নিউট্রিনো

বোর-সমারফেল্ড-এর পরমাণু মডেল আপাতভাবে পরমাণুর গঠন, স্থায়িত্ব ও বর্ণালীসমূহের কারণ ব্যাখ্যা করলেও একটা ব্যাপারে তখনও প্রশ্ন ছিল। পরমাণুর কেন্দ্রীন সুস্থিত থাকে কী করে? ধনাত্মক আধান সমন্বিত একাধিক প্রোটন কণাগুলোতো একে অপরকে কুলম্বীয় বিকর্ষণ বলের কারণে দূরে ঠেলবে। অর্থাৎ কেন্দ্রীনের মতো ক্ষুদ্র জায়গায় একজোট হয়ে থাকার পরিবর্তে তাদের একে অপরের থেকে ছিটকে সরে যাবার কথা। কিন্তু এমনটা হয় না, কেন? নিশ্চয়ই এমন কোনো বল বা force আছে যা কুলম্বীয় বল বা তড়িৎচুম্বকীয় বলের থেকে বেশি শক্তিশালী। এই বলের নাম দেওয়া হল, Strong Interactive Force বা তীব্র মিথস্ক্রিয়া বল—সহজ ভাষায় তীব্র বল। দেখা গেল, এই বলের তীব্রতা মহাকর্ষ বা তড়িৎচুম্বকীয় বলের তুলনায় অনেক বেশি হলেও এর সীমা বা range খুবই কম। এর প্রভাব পরমাণুর মধ্যে, বলতে কী, কেন্দ্রীনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ।

তীব্র বল সম্পর্কে ১৯৩৪ সালে প্রথম গুরত্বপূর্ণ তত্ত্ব দেন হিদেকি ইউকাওয়া। তিনি প্রস্তাব দেন, প্রোটননিউট্রন পরস্পরকে আকর্ষণ করে এক শক্তিক্ষেত্রর কারণে—ঠিক যেমন মহাকর্ষীয় ক্ষেত্রের কারণে গ্রহ-নক্ষত্রগুলো পরস্পরকে আকর্ষণ করে বা তড়িৎচুম্বকীয় ক্ষেত্রের মধ্যে ইলেকট্রনগুলো কেন্দ্রীনের প্রোটন দ্বারা আকর্ষিত হয়। এই ক্ষেত্রটি অবশ্যই সুষমরূপে কোয়ান্টাইজড [এখানে এই ‘কোয়ান্টাইজড’ শব্দটিকে একটু ব্যাখ্যা করা প্রয়োজন। কাকে বলে কোয়ান্টাইজড? ধ্রুপদী পদার্থবিদ্যায় আমরা দুটি কণার মধ্যে (ধরা যাক দুটি ইলেকট্রনের মধ্যে) বিকর্ষণকে কণাগুলির চারপাশে স্থিত ক্ষেত্রের (field) (ইলেকট্রনের কথা ভাবলে তড়িৎচুম্বকীয় ক্ষেত্রের বা Electromagnetic field এর) মাধ্যমে ব্যাখ্যা করি। প্রতিটি কণা ঐ ক্ষেত্র দ্বারা কিভাবে প্রভাবিত হয় আর ঐ ক্ষেত্রের ওপর কি প্রভাব ফেলে, এই মোটামুটি ধ্রুপদী পদার্থবিদ্যার ব্যাখ্যা পদ্ধতি। অর্থাৎ, ধ্রুপদী পদার্থবিদ্যায় আমরা ‘দূরাগত কার্য’ বা ‘Action at a distance’ কে ব্যাখ্যা করি সর্বব্যাপ্ত এক সুষম ক্ষেত্রের কুঞ্চন বা প্রসারণ দ্বারা, ধরে নিন একটা রবারের চাদর যার ওপরে বড়ো বড়ো মার্বেলের মতো কণাগুলো আটকানো তার সঙ্কোচন বা প্রসারণের কারণে কণাগুলো কাছে আসছে (আকর্ষণ) বা দূরে যাচ্ছে (বিকর্ষণ)। কিন্তু কোয়ান্টাম ক্ষেত্রতত্ত্বে এই সর্বব্যাপ্ত ক্ষেত্র যেন টুকরো টুকরো হয়ে (Quantized) এক সর্বব্যাপ্ত কণা সমুদ্রে পরিণত হয়েছে। অর্থাৎ ঐ রবারের চাদর যেন আসলে খুব ছোট ছোট পুঁতি দিয়ে বানানো যে পুঁতিগুলোর মানে কণাসমূহের আদানপ্রদানই ঐ আকর্ষণ বা বিকর্ষণ বলের কারণ। কণাগুলি যেন বার্তাবাহক যে দুটি বস্তু পরস্পরকে কাছে টানবে না দূরে ঠেলবে। তড়িৎচুম্বকীয় বলের ক্ষেত্রে এই কণা ফোটন] হতে হবে এবং তখন ইউকাওয়া প্রশ্ন করলেন যে এই কোয়ান্টাইজড ক্ষেত্রের কোয়ান্টাম বা কণা বা শক্তিগুচ্ছ (তড়িৎচুম্বকীয় ক্ষেত্রের শক্তিগুচ্ছ যেমন ফোটন) কী হবে? তার ধর্মই বা কেমন? এই প্রশ্নের উত্তরে তিনি নিজেই গণনা করে দেখালেন যে উক্ত কোয়ান্টাম বা তীব্র বল বহনকারী কণার ভর ইলেকট্রন ও প্রোটন-এর ভরের মাঝামাঝি হবে। ইলেকট্রন-এর ভরের প্রায় ৩০০ গুণ এবং প্রোটন-এর ভরের প্রায় এক-ষষ্ঠাংশ। মধ্যবর্তী ভরযুক্ত কণা, এর নাম দেওয়া হল মেসন (meson) অর্থাৎ কিনা মধ্যবর্তী ভর। একই যুক্তিতে ইলেকট্রনদের বলা হয় লেপটন (Lepton) বা লঘু ভর এবং প্রোটন, নিউট্রন-দের বলা হয় ব্যারিয়ন (Baryon) বা গুরুভার।

ইউকাওয়া জানতেন যে তখনও অবধি এমন কোনো কণার অস্তিত্ব প্রমাণিত হয়নি। যে কারণে তিনি নিজে ভেবেছিলেন যে তাঁর তত্ত্ব নিশ্চয়ই ভুল। কিন্তু সেসময় আমেরিকার মহাকাশ গবেষণাকেন্দ্রে মহাজাগতিক রশ্মি নিয়ে গবেষণা চলছিল। ১৯৩৭ সালে প্রায় একই সময়ে পশ্চিম উপকূলে অ্যান্ডারসন (Anderson) ও নেডারমেয়ার (Neddermeyer) এবং পূর্ব উপকূলে স্ট্রীট (Street) ও স্টীভেনসন (Stevenson) একটা কণার সন্ধান পেলেন যা ইউকাওয়া বর্ণিত কণার সঙ্গে মিলে যায়। যদিও মহাজাগতিক রশ্মির মধ্যে প্রাপ্ত কণা আর ইউকাওয়া বর্ণিত কণার মধ্যে যোগসূত্র বা মিলের প্রতি প্রথম দৃষ্টি আকর্ষণ করেন রবার্ট জে ওপেনহাইমার (Robert J. Oppenheimer)। হ্যাঁ, সেই ওপেনহাইমার যিনি কিছুদিনের মধ্যেই সম্পূর্ণ অন্য কারণে বিখ্যাত ও তার কিছুদিন পরেই কুখ্যাত হয়ে পড়বেন।

এসময় মনে হচ্ছিল যে সব সমস্যার সমাধান হয়েছে, কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই যখন মহাজাগতিক রশ্মি বিষয়ে বিস্তারিত গবেষণা হল তখন দেখা গেল কণাটির জীবনকাল ও ভর যা পাওয়া যাচ্ছে তা ইউকাওয়া বর্ণিত কণার থেকে কিছুটা আলাদা। শুধু তাই নয়, বিভিন্ন পর্যবেক্ষণে বিভিন্ন মানের ভর পাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু তখনই এ নিয়ে বিস্তারিত গবেষণা করা গেল না কারণ পরবর্তী কয়েক বছর পৃথিবীর প্রায় সব অগ্রগণ্য পদার্থবিদ ব্যস্ত রইলেন ২য় বিশ্বযুদ্ধ ও তৎসংক্রান্ত গোলমালে। ১৯৪৬ সালে রোমে একটা পরীক্ষায় [1] দেখা গেল, মহাজাগতিক রশ্মি পরমাণুর কেন্দ্রীনের সঙ্গে খুব দুর্বল মিথস্ক্রিয়া করে। কিন্তু এমনটাতো হওয়ার কথা নয়! ইউকাওয়ার তত্ত্ব ঠিক হলে মিথস্ক্রিয়াটি অনেক বেশি তীব্র হওয়ার কথা।

এ ধাঁধার সমাধান করলেন পরের বছর ব্রিস্টলে পাওয়েল (Powel) ও তাঁর সহকর্মীরা [2]। তাঁরা দেখালেন, মহাজাগতিক রশ্মির মধ্যে আসলে দুরকমের মেসন আছে। একটাকে তাঁরা বললেন পাই (π) মেসন বা পাইয়ন (Pion), অন্যটা মিউ (µ) মেসন বা মিউয়ন (Muon)। [প্রসঙ্গত মার্শাক (Marshak) ও বেথে (Bethe) একইসময় একই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছিলেন সম্পূর্ণ তাত্ত্বিক দিক থেকে [3] ]। প্রকৃত ইউকাওয়া মেসন হল পাইয়ন যা বায়ুমণ্ডলের উচ্চতম স্তরে তৈরি হয় এবং মাটিতে এসে পৌঁছনোর অনেক আগেই ক্ষয় হয়ে যায় এবং যে সমস্ত অন্যান্য কণার সৃষ্টি হয় তার একটা হল মিউয়ন যা সমুদ্রসমতল অবধি পৌঁছায়। সোজা কথায় সমুদ্রসমতলে প্রাপ্ত মিউয়ন একটা নকল কণা যা কোনোভাবেই তীব্রবলের সঙ্গে সম্পর্কিত নয় কিন্তু এটা একটা ভারী ইলেকট্রন-এর মতো আচরণ করে যে কারণে একে লেপটন পরিবারের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে যদিও এখনো আগের অভ্যাসমতো একে মিউমেসন বলা হয়।

সুতরাং পাওয়া গেল আরও দুটো নতুন কণা এবং এখন কণা পরিবারের সদস্য সংখ্যা পাঁচ। ইলেকট্রন, প্রোটন, নিউট্রন ও দুটি মেসন। কিন্তু অনেক পথ যাওয়া এখনো বাকি।

ডিরাকের পজিট্রন বা বিপ্রতীপ কণা

প্ল্যাঙ্কের কোয়ান্টাম থিয়োরি কেমন করে পরে কোয়ান্টাম বলবিদ্যার ধারণার জন্ম দিল সে বিষয়ে অন্যত্র কিছু আলোচনা করেছি। এখানে সেসব বিস্তারিত লেখার সুযোগ নেই, তবে একটা কথা বলতেই হয় যে কোয়ান্টাম বলবিদ্যার সূচনা যে শ্রয়েডিংগার সমীকরণের মাধ্যমে হয়েছিল সেখানে আপেক্ষিকতার ধারণাকে গ্রহণ করা হয়নি। ফলে ঐ সমীকরণ থেকে জন্ম নেওয়া কোয়ান্টাম বলবিদ্যার নাম হল আপেক্ষিকতাবিহীন কোয়ান্টাম বলবিদ্যা বা Non-relativistic Quantum Mechanics যার পূর্ণতাপ্রাপ্তি ঘটেছিল অতি অল্পসময়ের (১৯২৩-২৬) মধ্যে।

আপেক্ষিকতাতত্ত্বভিত্তিক কোয়ান্টাম বলবিদ্যার জন্ম হল ১৯২৭ সালে পল ডিরাক- এর ‘ডিরাক সমীকরণ’ থেকে। কিন্তু এই সমীকরণই কণাপদার্থবিদ্যার জগতে নিয়ে এল নতুন বিপত্তি। ইলেকট্রন-এর শক্তি নির্ধারণে এ সমীকরণ প্রয়োগ করে দেখা গেল দুটি সমাধান পাওয়া যাচ্ছে। একটি ধনাত্মক মান, অন্যটি ঋণাত্মক মান। যেহেতু প্রকৃতিতে সব সিস্টেম সর্বদা নিম্নতম শক্তিস্তরে থাকতে চায় সুতরাং প্রতিটি ইলেকট্রন-এর ক্রমাগত আরো বেশি ঋণাত্মক শক্তিস্তরের দিকে যাওয়া উচিত এবং অসীম পরিমাণ শক্তি বিকিরণ করা উচিত। কিন্তু ইলেকট্রন মোটেই সর্বদা শক্তি বিকিরণ করে না!

সমীকরণের সমাধানটিকে ব্যাখ্যা করার জন্য ডিরাক এক অসাধারণ তত্ত্ব উদ্ভব করলেন। তিনি বললেন, সব ঋণাত্মক শক্তিস্তর আসলে অসীম সংখ্যক ইলেকট্রন-এর এক সমুদ্র বিশেষ। যেহেতু এ সমুদ্রতুল্য ইলেকট্রন-সমূহ সর্বদাই সর্বস্থানে সুষমরূপে বিরাজমান এবং কোনোকিছুর ওপরে কোনো বলপ্রয়োগ করে না তাই আমরা এর উপস্থিতি বুঝতে পারি না। এরপর তিনি পাউলির অপবর্জন নীতি (Exclusion Principle) ব্যবহার করে ইলেকট্রন-এর ধনাত্মক শক্তিস্তরে থাকার কারণ ব্যাখ্যা করতে সক্ষম হলেন। প্রশ্ন হল, যদি ঐ ঋণাত্মক শক্তিস্তরে উপস্থিত অসীম ইলেকট্রন-গুলির কোনোটিকে আমরা যথেষ্ট শক্তি সরবরাহ করি যাতে সেটি ওখান থেকে ধনাত্মক স্তরে ছিটকে আসে, তাহলে?

ডিরাকের তত্ত্বানুসারে সেক্ষেত্রে ঐ শক্তিস্তরে ঐ ইলেকট্রনটির অনুপস্থিতি একটি ধনাত্মক শূন্যস্থান রূপে থাকবে এবং ঐ ধনাত্মক শূন্যস্থানটিকে একটি সাধারণ ধনাত্মক কণা বলে মনে হবে। ডিরাকের প্রথমে ধারণা ছিল, যে এই ধনাত্মক শূন্যস্থান যেটি কণারূপে প্রতিভাত হবে সেটিই আসলে প্রোটন কণা। কিন্তু দেখা গেল ঐ শূন্যস্থানের ভর ইলেকট্রন-এর সমান হতে হবে যা কিনা প্রোটন-এর চেয়ে অনেক কম। অথচ এমন কোনো কণার কথা জানা নেই! তাহলে কি ডিরাকের তত্ত্ব ভুল?

১৯৩০ সাল অবধি অনেকেই সেকথা ভাবছিলেন বটে কিন্তু ১৯৩১ সালে যখন অ্যান্ডারসন ইলেকট্রন-এর সমতুল্য ভর কিন্তু বিপরীত আধানযুক্ত কণা পজিট্রন আবিষ্কার করলেন [4] তখন ডিরাকের অন্তর্দৃষ্টি সত্য বলে প্রমাণিত হল।

তবুও বিজ্ঞানীরা ঐ ইলেকট্রন-এর অদৃশ্য সমুদ্রের উপস্থিতি বিষয়ে সন্দিহান বা বলা ভালো অস্বস্তিতে ছিলেন। কারণ দেখা গেল ডিরাক সমীকরণের দ্বৈত সমাধান, কোয়ান্টাম ক্ষেত্রতত্ত্বের এক বুনিয়াদি ও সর্বব্যাপী ধর্ম। প্রতিটি কণারই একটি করে সমান ভর কিন্তু বিপরীত আধান বা শক্তিসমন্বিত বিপ্রতীপ কণা থাকার কথা। প্রোটন-এর অ্যান্টিপ্রোটন, মেসন গুলোর অ্যান্টিমেসন, এমনকি নিউট্রন-এর অ্যান্টিনিউট্রন (অনেকে হয়তো ভাবছেন, নিস্তড়িত নিউট্রন-এর আবার বিপ্রতীপ কণা কি করে হবে? কিন্তু আধান না থাকলেও নিউট্রন-এর শক্তিমাত্রা মাপার জন্য অন্যান্য কোয়ান্টাম সংখ্যা আছে যেগুলো বিপ্রতীপ কণার ক্ষেত্রে আলাদা হয়)। তাহলে প্রতিটি কণার জন্য এমন অদৃশ্য কণাসমুদ্র কল্পনা করতে হয়।

সৌভাগ্যের বিষয়, ১৯৪০ সালে ফাইনম্যান ও স্টাকলবার্গ ডিরাক সমীকরণের একটা সহজতর ও অধিক গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা দিলেন। তাঁদের ব্যাখ্যা বা ডিরাক সমীকরণের নবতর প্রকাশে ঋণাত্মক সমাধানগুলো একটা ভিন্ন কণার শক্তি অবস্থা বলে দেখানো গেল। ইলেকট্রনপজিট্রন আর রহস্যময় ইলেকট্রন সমুদ্রের কণা ও শূন্যস্থান রইল না বরং দুটি ভিন্ন কণা (যারা একে অপরের বিপ্রতীপধর্মী) রূপে প্রকাশ পেল। সুতরাং অদৃশ্য কণাসমুদ্রের কল্পনা করার আর প্রয়োজন রইল না। পজিট্রন-এর মতো অ্যান্টিপ্রোটন বা তড়িৎঋণাত্মক প্রোটন প্রথম আবিষ্কৃত হল বার্কলের বিভাট্রন নামক কণাত্বরণ যন্ত্রে ১৯৫৫ সালে [5], অ্যান্টিনিউট্রন আবিষ্কার হল ঐ একই গবেষণাগারে পরের বছর [6]। অ্যান্টিপার্টিকল বা বিপ্রতীপ কণাসমূহের অস্তিত্ব কণাপদার্থবিদ্যার জগতে সুপ্রতিষ্ঠিত হল।

এখানে বলে রাখা ভালো, কোনটিকে কণা বলা হবে এবং কোনটিকে বিপ্রতীপ কণা তা সম্পূর্ণ ঐচ্ছিক। আমরা অনায়াসেই ইলেকট্রন-কে অ্যান্টিপজিট্রন বলতে পারি। কিন্তু যেহেতু প্রকৃতিতে ইলেকট্রন প্রচুর পরিমাণে দেখা যায় এবং পজিট্রন প্রায় দেখাই যায় না তাই আমরা ইলেকট্রনকে কণা এবং পজিট্রন-কে বিপ্রতীপ কণা বলে ভাবতে অভ্যস্ত।

বিশেষ আপেক্ষিকতাবাদ এবং কোয়ান্টাম বলবিদ্যার মিলন কণাপদার্থবিদ্যার জগতে নিয়ে এল পদার্থ/বিপ্রতীপ পদার্থ প্রতিসাম্যের ধারণা। কিন্তু এর সঙ্গে একটা খুব বিভ্রান্তিকর প্রশ্নও উঠে এল, কেন আমাদের জগত ইলেকট্রন, প্রোটন, নিউট্রন এ ভর্তি? কেন এদের বিপ্রতীপ কণাগুলো পাওয়াই যায় না? পদার্থ ও বিপ্রতীপ পদার্থ একত্রে থাকতেই পারে না। এরা পরস্পরের সংস্পর্শে এলেই একে অপরকে বিনষ্ট করে ফেলে। তাহলে কি এটা নেহাতই একটা দুর্ঘটনা যে মহাবিশ্বের যে কোণায় আমরা বাস করি সেখানে পদার্থের পরিমাণ বিপ্রতীপ পদার্থের চেয়ে বেশি? তাই যদি হয় তাহলে মহাবিশ্বে কোনো এমন স্থানও থাকা উচিত যেখানে বিপ্রতীপ পদার্থ বেশি। কিন্তু এখনো অবধি এমন কোনো স্থানের সন্ধান পাওয়া যায়নি যেখানে বিপ্রতীপ পদার্থের রাজত্ব। এই ধাঁধার সমাধান আজও হয়নি।

কণাপদার্থবিদ্যার মধ্যযুগের ইতিহাসের অন্তিম চরিত্র নিউট্রিনো-র ইতিহাস সবচেয়ে বর্ণময়। কিন্তু সে বিস্তারিত ইতিহাস এখানে লিখলে পাঠকবর্গের ধৈর্যচ্যুতির আশঙ্কা আছে। তাই সেই গল্প তুলে রাখা গেল পরবর্তী পর্বের জন্য।

পরিবর্তে আমরা সংক্ষেপে একটু দেখে নিই কিভাবে অ্যান্ডারসন পজিট্রন নামক কণাটির অস্তিত্ব বুঝলেন।

১৯৩০ সালে অ্যান্ডারসন একটি বিশাল মেঘকক্ষ বা cloud chamber এর মধ্যে মহাজাগতিক রশ্মির থেকে আসা কণাসমূহের গতিপথ এবং অন্যান্য ধর্ম পর্যবেক্ষণ করছিলেন। সেসময় তিনি কিছু কণার সন্ধান পেলেন যাদের আধান ধনাত্মক কিন্তু শক্তি খুবই কম অর্থাৎ ভর অতি কম। এই কণাগুলির গতিপথ ও আধান, ভর ইত্যাদি সঠিকভাবে নির্ধারণের জন্য অ্যান্ডারসন মেঘকক্ষের মাঝবরাবর একটি সীসার পাত রেখে দিলেন (ছবিতে দেখুন, মাঝের ঐ মোটা কালো দাগ)। সীসার পাতের সঙ্গে সংঘর্ষের পর কণাগুলির বেগ কমে গেল এবং গতিপথের বক্রতা বৃদ্ধি পেল। ছবি থেকে দেখুন (ঠিক মাঝের ঐ সরু বক্ররেখাটি) পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে যে কণাগুলি নিচে থেকে অপরের দিকে যাচ্ছে। এদের ভর আধান সবই সঠিকভাবে মাপা গেল এবং দেখা গেল সেসময় জানা একমাত্র ধনাত্মক আধানযুক্ত কণা অর্থাৎ প্রোটন-এর চেয়ে এদের ভর অনেক কম, প্রায় ইলেকট্রন-এর সমতুল্য। যদিও ১৯৩২ সালে সায়েন্স ম্যাগাজিনে এই সংবাদ প্রকাশকালে অ্যান্ডারসন অতি সতর্কতার সঙ্গে লেখেন, ‘The Apparent Existence of Easily Deflectable Positives’। পরের বছর ফিজিক্যাল রিভিউ জার্নালে তিনি বিস্তারিত তথ্য, গণনা মেঘকক্ষের ছবিসহ প্রকাশ করেন (যে ছবিটি আপনারা নিচে দেখতে পাচ্ছেন) এবং তখন এর নাম দেন ‘The Positive Electron’।

চিত্র C. D. Anderson, Phys. Rev. 43 491 (1933) থেকে।

প্রচ্ছদ চিত্র পরিচিতিঃ CERN Large Hadron Collider, GENEVA (হলুদ বৃত্ত LHC সুড়ঙ্গটিকে দেখাচ্ছে) পৃথিবীর সর্ববৃহৎ কণাত্বরণ যন্ত্র ও গবেষণাগার। পেছনে মঁব্লা পর্বতমালা দেখা যাচ্ছে।

তথ্যসূত্র

1. Abraham Pais, Inward Bound, (Clarendon Press, Oxford 1986)

2.  Abraham Pais, Subtle is the Lord, (Oxford University Press, 1982)

কণাপদার্থবিদ্যা বিষয়ে এই দুটি বইয়ের জুড়ি নেই। ইতিহাস ও গণিত সমন্বিত বিজ্ঞান যে এতো সুন্দরভাবে একইসঙ্গে বলা যায় তা এগুলো না পড়লে জানতেই পারতাম না। এছাড়া অন্যান্য যেসব বই বা গবেষণাপত্রের সাহায্য নিয়েছি সেগুলোর কথা এখানে সূত্রতালিকা আকারে দেওয়া হল।

  1. M. Conversi, E. Pancini, and O. Piccioni, Phys. Rev. 71, 209 (1947).
  2. C. M. G. Lattes et al., Nature 159, 694 (1947); 160, 453, 486 (1947).
  3. R. E. Marshak and H. A. Bethe, Phys. Rev. 72, 506 (1947).
  4. Anderson, C. D. Phys. Rev. 43 491 (1933).
  5. O. Chamberlain et al., Phys. Rev. 100, 947 (1955)
  6. B. Cork et al., Phys. Rev. 104, 1193 (1956)

পর্ব ১ লিংক

মন্তব্য তালিকা - “কণাপদার্থবিদ্যার বিবর্তন (পর্ব – ২)”

  1. মিউ মেসনকে লেপটন বলতে হবে কেন, সেটা বুঝিনি। তার ভর পাই মেসনের চাইতে অনেক কমে গেছে কি?

    যাই হোক, দুর্দান্ত লেখা হচ্ছে।

    1. পড়ার জন্য ধন্যবাদ। মিউ মেসনের ভর অবশ্যই পাই মেসনের চেয়ে কম কারণ এটি ক্ষয় হয়েই মিউ মেসন তৈরি হয়।

      তবে ভরের পার্থক্য এখানে মূল ব‍্যাপার নয়। মূল কথা হলো মিউ মেসন তীব্র বিক্রিয়া বা স্ট্রং ইন্টার‍্যাকসনে অংশগ্রহণ করে না।
      লেপটন তাদেরই বলা হয় যারা তীব্র বিক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করে না। তাই মিউ মেসনকে লেপটন পরিবারের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।

    2. পড়ার জন্য ধন্যবাদ। মিউ মেসনের ভর অবশ্যই পাই মেসনের চেয়ে কম কারণ এটি ক্ষয় হয়েই মিউ মেসন তৈরি হয়।

      তবে ভরের পার্থক্য এখানে মূল ব‍্যাপার নয়। মূল কথা হলো মিউ মেসন তীব্র বিক্রিয়া বা স্ট্রং ইন্টার‍্যাকসনে অংশগ্রহণ করে না।
      লেপটন তাদেরই বলা হয় যারা তীব্র বিক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করে না। তাই মিউ মেসনকে লেপটন পরিবারের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।

মন্তব্য করুন

আপনার ইমেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।