সূচী

ইতিহাস তথ্য ও তর্ক

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, আশুতোষ মুখোপাধ্যায় ও মৈমনসিংহ গীতিকা— দ্বিতীয় পর্ব

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, আশুতোষ মুখোপাধ্যায় ও মৈমনসিংহ গীতিকা— দ্বিতীয় পর্ব

লিপিকা ঘোষ

অক্টোবর ১২, ২০২৪ ৪৫ 0

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে দীনেশচন্দ্র সেনের আগমন

১৯০৫ সালে দীনেশচন্দ্র বি. এ. পরীক্ষার বাংলা পরীক্ষক হবার জন্য আবেদন করেন। পণ্ডিত রজনীকান্ত গুপ্তের মৃত্যুর পর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা পরীক্ষকের পদটি খালি হয়েছিল। এর আগেই ১৮৯৬ সালে ডিসেম্বর মাসে দীনেশচন্দ্রের ‘বঙ্গভাষা ও সাহিত্য’ এবং ১৯০৪ সালে রবীন্দ্রনাথের ভূমিকা সহ ‘রামায়ণী কথা’ প্রকাশিত হয়—সেকথা আশুতোষ মুখোপাধ্যায় জানতেন তাই খুশি হয়েই এই আবেদনের ভিত্তিতে তাঁকে পরীক্ষকের পদে নির্বাচন করেন। পরে ১৯০৭ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দীনেশচন্দ্রের ‘বঙ্গভাষা ও সাহিত্য’ বইটি ইংরাজিতে প্রকাশও করেন।

১৯০৮ সাল থেকে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় Special University Redership নামে বিশেষ বক্তৃতামালার সূচনা করা হলে এই বছর তিনজন বিশ্ববিশ্রুত পণ্ডিত এখানে বক্তৃতা দেন। তাঁরা হলেন Dr. G. Thibant, Sir T. Holland এবং Prof. A. Schuster। পরের বছর ১৯০৯ সালে স্পেশাল ইউনিভার্সিটি রিডার নিযুক্ত হয়ে জানুয়ারি থেকে এপ্রিল মাস ধরে বক্তৃতা দিলেন দীনেশচন্দ্র সেন। বিষয় ছিল ‘বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ইতিহাস: প্রাচীন যুগ থেকে ঊনবিংশ শতকের মধ্যযুগ পর্যন্ত’। ১৯১০ সালে দীনেশচন্দ্রকে বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেটের সদস্য করে নেওয়া হয় আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের ইচ্ছায়। ১৯১৩ সালে দীনেশচন্দ্র আবার বক্তৃতা দেন ‘মধ্যযুগের বাংলার বৈষ্ণব’ সম্পর্কে আর এখানেই ১৯২৩ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বক্তৃতা দেন ‘সাহিত্য’ সম্পর্কে ।

১৯০৮ সালে ২৭ আগস্ট রামতনু লাহিড়ীর পুত্র শরৎ কুমার লাহিড়ী তাঁর বাবার স্মৃতি রক্ষার উদ্দেশ্যে ‘লাহিড়ী’স সিলেক্ট পোয়েমস’ গ্রন্থের সর্বস্বত্ব কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়কে দান করেন। এই গ্রন্থ বিক্রি করে যে আয় হবে তা দিয়ে প্রতি বছর দর্শন (মেন্টাল এন্ড মরাল ফিলসফি) বিষয়ে প্রথম স্থানাধিকারীকে স্বর্ণপদক দেওয়া হবে বলে প্রস্তাব দেন। এই ‘লাহিড়ী’স সিলেক্ট পোয়েমস’ বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠক্রমে আনা হলে বইটির বিক্রি স্বাভাবিকভাবেই বেড়ে যায়। ১৯১১ সালে এত টাকা আয় হয় যে ঐ টাকায় দুটি স্বর্ণ পদক দেওয়ার কথা ভাবা হয়। ১৯১১ সালের ২৭ মে তারিখে রামতনু লাহিড়ী ও তাঁর স্ত্রী গঙ্গামণির নামে মোট দুটি স্বর্ণপদক দেওয়া হবে বলে সিণ্ডিকেট সিদ্ধান্ত নেয়। পরবর্তীতে আরও কিছু টাকা বেশি আয় হওয়ায় ১৯১২ সালে শরৎ বাবুর পরামর্শ অনুযায়ী সিনেটের অনুমতি নিয়ে ‘A Reaserch Fellowship in the History of the Bengali Language and Literature’ নামে গবেষণা বৃত্তি চালু করা হয়েছিল। দীনেশচন্দ্র সেন প্রথম ‘রামতনু লাহিড়ী রিসার্চ ফেলোশিপ’ পেয়েছিলেন, বৃত্তি ছিল আড়াইশো টাকা। প্রথমে নিয়োগের পাঁচ বছর পর মেয়াদ শেষ হলে দীনেশচন্দ্র সেনকে পুনরায় ঐ পদে বহাল রাখার জন্য আশুতোষ মুখোপাধ্যায় নিজে সিনেটের সভায় প্রস্তাব রাখেন। কিন্তু সিনেটের সদস্যরা প্রবল আপত্তি করে, অনেক তর্ক-বিতর্কের পর আশুতোষ মুখোপাধ্যায় বক্তৃতা দিতে উঠে বাংলা বিভাগে তাঁর নিজের অবদানের কথা না বলে দীনেশচন্দ্রের অবদানের কথা বললেন। সেদিন তাঁর অকাট্য যুক্তির কাছে সমস্ত আপত্তি ম্রিয়মান হয়ে গিয়েছিল। দীনেশচন্দ্র সেন রামতনু লাহিড়ী ফেলোশিপে আবার নির্বাচিত হলেন। উল্লেখ্য, এই পদে তিনি ১৯১৩ সাল থেকে ১৯৩২ সাল পর্যন্ত বহাল ছিলেন।

বঙ্গভাষা ও সাহিত্য সম্পর্কে বক্তৃতা দেবার জন্য রিডার পদে নির্বাচিত হয়ে প্রথম বাঙালি হিসাবে কর্মভার গ্রহণ করেন দীনেশচন্দ্র সেন। এই সময় ইংরাজি ভাষায় বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস লিখতে গিয়ে তাঁকে রবীন্দ্রনাথ ও সিস্টার নিবেদিতার সাহায্য নিতে হয়েছিল। রিডার হিসাবে নিযুক্ত হয়ে তিনি যে সকল বক্তৃতা দিয়েছিলেন তা সংঘবদ্ধ রূপে ১৯১১ সালে ‘হিস্ট্রি অফ বেঙ্গলি ল্যাঙ্গুয়েজ এন্ড লিটারেচার’ নামে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয় এবং সেইসঙ্গে তিনি বিশ্বনন্দিত হন। এই সময় আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের উত্সাহে ও সহযোগিতায় দীনেশচন্দ্র লিখলেন ও সম্পাদনা করলেন বেশ কয়েকটি গ্রন্থ, নিজের গল্প লেখার বাইরে অক্লান্ত পরিশ্রম করে রচনা করলেন বাংলা সাহিত্যের নতুন ইতিহাস।

দীনেশচন্দ্র সেন

যিনি প্রথম জীবনে লিখেছেন ‘সেক্সপীয়ার বড় কি কালিদাস বড়’ প্রবন্ধ, যিনি লিখেছেন ‘বাল্মীকি ও হোমার, রামায়ণ ও ইলিয়াড’-এর মতো প্রবন্ধ তিনি যে বাংলা সাহিত্যের নতুন ইতিহাস রচনা করবেন তাতে আর আশ্চর্যের কী আছে! তখন যে গ্রন্থগুলি তিনি রচনা, সম্পাদনা এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রকাশ করলেন। সেগুলি হল-

১। ছুটি খানের মহাভারত (অশ্বমেধ পর্ব)—বিনোদ বিহারী কাব্যতীর্থকে সঙ্গে নিয়ে দীনেশচন্দ্র সেন সম্পাদনা করেন, ১৯০৫ সালে প্রকাশিত হয়।

২। শ্রী ধর্মমঙ্গল—মাণিক গাঙ্গুলী, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী ও দীনেশচন্দ্র সেন সম্পাদনা করেন, ১৯০৫ সালে প্রকাশিত হয়।

৩। ‘হিস্ট্রি অফ বেঙ্গলি ল্যাঙ্গুয়েজ এন্ড লিটারেচার’, রচনা করেন ১৯০৯ সালে, ১৯১১ সালে প্রকাশিত হয়।

৪। ১৯১২ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর সম্পাদনায় কাশীদাসী মহাভারত।

৫। বঙ্গ সাহিত্য পরিচয় (Typical selection from the earliest times to the middle of the nineteenth century) সম্পাদনা করে দুই খণ্ডে প্রকাশিত হয় ১৯১৪ সালে।

৬। কৃত্তিবাসী রামায়ণ সম্পাদনা করেন ১৯১৬ সালে।

৭। The Vaisnava Literature of Medieval Bengal with preface by J. B. Anderson) এবং Chaitanya and his Companions বই দু’টি রচনা করেন ১৯১৩-১৪ সালে, প্রকাশিত হয় ১৯১৭ সালে।

৮। কৃত্তিবাসী রামায়ণ সম্পাদনা করেন ১৯১৬ সালে এবং The Bengali Ramayanas—প্রকাশিত হয় ১৯২০ সাল।

৯। দ্য ফোক লিটারেচার অফ বেঙ্গল, রচনাকাল ১৯১৭, মুদ্রণকাল ১৯২০।

১০। তাঁর লেখা Bengali Prose Style—প্রকাশিত হয় ১৯২১ সালে।

১১। ১৯২২ সালে Chaitanya and his age প্রকাশিত হয়।

১২। ১৯২৩ সালে ‘Estern Bengal Ballads’ (with foreword by Lord Ronaldshay) এবং মৈমনসিংহ গীতিকা সম্পাদনা করে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রকাশ করেন।

এ সবই ছিল আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের সুপরিকল্পিত শিক্ষার অগ্রসর নীতি। ব্রিটিশের প্রতিষ্ঠানে বাংলা ভাষাকে প্রতিষ্ঠা দেওয়ার প্রতিজ্ঞা।

আসলে ১৯০৪ সালে লর্ড কার্জনের উদ্যোগে যে নতুন বিশ্ববিদ্যালয় আইন চালু হয়েছিল তার পিছনেও যে ব্রিটিশ সরকারের এক ধরনের ষড়যন্ত্র ছিল তা আশুতোষ মুখোপাধ্যায় বুঝতে পেরেছিলেন। শিক্ষার পুনর্গঠন, শিক্ষার প্রসারণ প্রভৃতির আড়ালে তাদের উদ্দেশ্য ছিল বাঙলায় শিক্ষার প্রসার সঙ্কুচিত করা, বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাধীনতা খর্ব করা, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাঙালির প্রতিষ্ঠা ও কর্তৃত্ব লোপ করা। তারা শিক্ষাদানের মাধ্যমে সরকারি কাজের উপযোগী কেরানি তৈরি করতে চেয়েছিল। ১৯০৬ সালে যখন আশুতোষ মুখোপাধ্যায় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হয়ে এলেন তখন তিনি আসলে বিশ্ববিদ্যালয় আইনকেই কার্যকর করতে নিয়োজিত হয়েছিলেন। তিনি ব্রিটিশ সরকারের মনোনীত ছিলেন বলে তাঁকে অনেকে ব্রিটিশের তোষামোদকারী বলে মনে করলেও তিনি আইনের কঠোর বিধিনিষেধের মধ্যেই আইনের ফাঁক খুঁজে নিলেন। এই কেরানি তৈরির কারখানাকে উচ্চশিক্ষার মাধ্যমে জনশিক্ষার হাতিয়ার করতে চেয়েছিলেন। তখন বিশ্ববিদ্যালয়কে পরীক্ষা নেওয়া আর ডিগ্রি দেওয়া ছাড়া ‘to appoint University Professors and Lecturers for Promotion of study and research’ এর ক্ষমতা দেওয়া হয়েছিল। আশুতোষ মুখোপাধ্যায় এই সুযোগটাকেই কাজে লাগিয়েছিলেন। শিক্ষার প্রসারে তাঁর বিভিন্ন পরিকল্পনা দেখে সরকার চাহিদামতো অনুদান বাড়াতে অস্বীকার করল। কিন্তু তিনি কিছু বিশিষ্ট শিক্ষানুরাগী ও ধনী ব্যক্তি যেমন তারকনাথ পালিত, রাসবিহারী ঘোষ, গুরুপ্রসাদ সিংকে অর্থদানে এগিয়ে আসতে উদ্বুদ্ধ করলেন। তাঁরা সরকারের তুলনায় অনেক বেশি অর্থ অনুদান দিলেন। আশুতোষ মুখোপাধ্যায় কলা বিভাগ, বিজ্ঞান বিভাগ ও প্রযুক্তি বিজ্ঞান বিভাগ খোলার পরিকল্পনাই নয় বাস্তবায়িত করতে একের পর এক পদক্ষেপ নিতে লাগলেন। বাংলার শহর ও গ্রামগুলিতে বেসরকারী স্কুল কলেজ যেমন বাড়ল তেমনি ম্যাট্রিকুলেট ও গ্রাজুয়েটের সংখ্যাও বাড়তে থাকল। ব্রিটিশ সরকার যতই মুখে শিক্ষার প্রসারের কথা বলে থাক না কেন, শিক্ষার প্রকৃত প্রসারে কিছুটা বিব্রত বোধ করেছিল। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় দ্রুত বাংলার শিক্ষা—প্রসারণে ধাবিত হচ্ছে দেখে নিয়োগের আট বছর পর উপায়ান্তর না দেখে আশুতোষ মুখোপাধ্যায়কে উপাচার্যের পদ থেকে বাদ দিলেন। উপাচার্যের পরিবর্তে তাঁকে বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্বিক উন্নতির দায়িত্বে রেখে দিলেন। স্নাতকোত্তর বিভাগ খোলার আগেই তাঁকে সরিয়ে তাঁর জায়গায় উপাচার্যরূপে আনলেন দেবপ্রসাদ সর্বাধিকারীকে। তিনি ১৯১৪ থেকে ১৯১৮ সাল পর্যন্ত যে চার বছর উপাচার্য ছিলেন সেই সময় আশুতোষ মুখোপাধ্যায় স্নাতকোত্তর বিভাগ গড়ে তোলার দিকে মনোনিবেশ করলেন। ১৯১৮ সালে এলেন হাইকোর্টের তত্কালীন প্রধান বিচারপতি মি. ল্যান্সলট স্যান্ডারসন। যেহেতু আশুতোষ মুখোপাধ্যায় এই প্রধান বিচারপতির অধীনে কাজ করতেন তাই এবার কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে আশুতোষের প্রভাব কমার সম্ভাবনায় এই নিয়োগ করা হয়েছিল। কিন্তু দু’একটি মিটিংয়ের পর স্যান্ডারসন বুঝতে পারলেন এই জায়গা তাঁর জন্য নয় বরং আশুতোষই এই চেয়ারের বসার উপযুক্ত। এক বছর পর এলেন আর এক ভারতীয় নীলরতন সরকার। তবু আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের প্রভাব কোনো অংশেই কমল না। দীনেশচন্দ্রের ভাষায়—তিনি “বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্ণধার না হইয়াও কর্ণধার রহিলেন; প্রতি ক্ষুদ্র বৃহৎ কর্ম তাঁহারই ছাপমারা, তাঁহারই ইঙ্গিতে নিয়ন্ত্রিত। সুতরাং কর্তৃপক্ষ বুঝিলেন, আশুতোষ যাহা বুঝিবেন তাহাই হইবে, অপরের কোনো নির্দেশ পালনের জন্য সেই বিশাল শিক্ষা—শালায় তিলমাত্র অবকাশ নাই।“

স্নাতকোত্তরে বাংলা বিভাগ

যে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ১৯০৪ সাল পর্যন্ত ছিল একটি পরীক্ষাশালা মাত্র পরে সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিতর ও বাইরের আমূল বদল হল। ইন্ডিয়ান ভার্নাকুলার এর অন্যতম প্রধান পাঠক্রম হিসাবে বাংলায় এম. এ. কোর্স চালু করার জন্য স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায় চেষ্টা করে আসছিলেন অনেক আগে থেকেই। আর সেই কারণেই দীনেশচন্দ্রকে প্রথম থেকেই প্রায় এগারো/ বারো বছর ধরে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস, সাহিত্যের সংকলন, আমাদের দেশের ইতিহাস, সাহিত্য সমালোচনা মূলক বিভিন্ন গ্রন্থ লিখতে উত্সাহিত করেন। সেই সঙ্গে আশুতোষ মুখোপাধ্যায় সর্বভারতীয় দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে অন্যান্য ভারতীয় ভাষা—সাহিত্যের পঠন—পাঠন শুরু করার উদ্দেশ্যে সেইসব ভাষার সাহিত্য প্রকাশের একটি বিশেষ পরিকল্পনাও সামনে রেখেছিলেন, এ প্রসঙ্গে স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায় ১৯১৮ সালে জুন মাসে সিনেটের সভাতে পরিকল্পনাটি উপস্থাপিত করেন। আরও স্পষ্ট করে বললে ‘Report for Post Graduate Teaching in the University of Calcutta 1918-1919’-এ প্রদত্ত বিবরণীর প্রাসঙ্গিক কিছু অংশ হল—

‘During the session under review, on recommendation of the council of Post—Graduate Teaching in Arts, the Senate at its meeting held on the 31st august, 1918, Sanctioned a scheme for the Preparation of a series of volumes of typical selection of facilitate advanced study of Indian vernaculars in their critical, scientific, historical and comparative aspects for the degree of Master of Arts of the University. The scheme which was intitiated by the Hon’ble sir Ashutosh Mukherjee, the President of the Council, was first considered by a joint meeting of the board of Higher Studies in Sanskrit. Pali, Arbic, Persian and comparative philology. For the purpose of editing the selections the following arrangements were made.’

[বর্তমান সেশনে কলা বিভাগের স্নাতকোত্তর শিক্ষা কাঊন্সিল ও ১৯১৮ সালের ৩১শে আগস্টের সভায় নেওয়া সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে ভারতীয় ভাষা সমূহের বৈজ্ঞানিক, ঐতিহাসিক ও তুলনামূলক ধারার উচ্চশিক্ষার জন্য একটি পরিকল্পনা অনুমোদিত হল। এই পরিকল্পনাটি যা প্রথম কাঊন্সিলের সভাপতি সম্মানীয় স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায় কর্তৃক উত্থাপিত হয় সেটি উচ্চশিক্ষা সমিতির একটি সভায় আলোচিত হয় সংস্কৃত, পালি, আরবী, ফার্সি ও তুলনামূলক ভাষাতত্ত্বের জন্য। নির্বাচিত বিষয়গুলির সম্পাদনার জন্য নিম্নলিখিত ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। (অনুবাদ সম্পাদকের)]

Marathi – Mr. D. R. Bhandarkar, M.A., Carmichael Professor of Ancint Indian History and culture.

Prakrit – Dr. P. D. Gune, M. A. Ph. D Undero the guidance of sir Ramkrisna Gopal Bhandarkar, K. C. I. E, M. A.

Assamese – Srijit Hemchandra Goswami, Joint Editor of the Assammes Laxicon Heme-Kasha.

Pali – Mahamohopadhyay Dr. Satishchandra vidyashudan, M.A. Ph, d and Benimadhab Barua, M.A. D.Lit.

Oriya – Babu Bijaychandra Majumder, B.A., Lala Sitaram B.A.

Guzarati -Prof. I. J. S. TaraporeWala B.A. Ph. D and Prof. A.B. Dhuva LL.D.

Urdu – The Hon’ble Dr. Suhrawardy, M.A., Phd.”

আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হল। ১৯১৮ সালে ২৪ সেপ্টেম্বর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেটে বাংলা সহ অন্যান্য কয়েকটি আধুনিক ভারতীয় ভাষায় বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রি এম. এ. পঠন পাঠন ও পরীক্ষা গ্রহণের পরিকল্পনা অনুমোদন করা হল। তত্কালীন নতুন উপাচার্যের অনুপস্থিতিতে অস্থায়ী উপাচার্য হয়ে সেই আশুতোষ মুখোপাধ্যায়েরই উপস্থিতিতে ও নেতৃত্বে প্রথম দফায় বাংলা ভাষায় এম. এ. পরীক্ষা দেবার নীতি-পদ্ধতি বিনা বিতর্কে সর্ব-সম্মতিক্রমে গৃহীত হয়েছিল। ১৮৯১ সাল থেকে চেষ্টা করে শেষ পর্যন্ত কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকোত্তর বা পোস্ট গ্র্যাজুয়েশন বিভাগ স্থাপন করতে সক্ষম হলেন আশুতোষ মুখোপাধ্যায়। যারা বলেছিল বাংলাভাষায় এমন কী আছে যা দিয়ে স্নাতকোত্তর পড়ানো হবে— তাদের সামনেই ১৯১৯ সালের ১০ এপ্রিল তারিখে স্নাতকোত্তর সাহিত্য শিক্ষাবিভাগের পরিচালন সমিতির অধিবেশনে প্রধান ভাষা বাংলায় এম. এ. পরীক্ষার পাঠ্যক্রম অনুমোদিত হল।

এ বিষয়ে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ কথা ‘আশুতোষ—স্মৃতিকথা’ গ্রন্থে দীনেশচন্দ্র সেন লিখেছেন, তাঁকে ডেকে আশুতোষ মুখোপাধ্যায় বলেছেন,

‘আপনারা যতদিন ধরিয়া চিত্কার করিয়া আসিয়াছেন, আমি তাহারও পূর্ব হইতে বাংলায় এম এ বিভাগের সৃষ্টি করিতে সংকল্প করিয়া আসিয়াছি। কিন্তু ঢাল নাই, তলোয়ার নাই, শুধু খেমচির জোরে কিছু হয় না। বাংলায় এম এ পরীক্ষা হইবে, ভাষা ও সাহিত্যের ইতিহাস কোথায়? হয়তো বিদেশীরা বাংলা এম এ দিতে চাহিবে—আপনার বাংলা ভাষায় রচিত ইতিহাসে তো তাহা চলিবে না। সংস্কৃত, পারসি প্রভৃতি সমস্ত বিষয়ে টেক্সট ছাড়া, অপরাপর বিষয় ইংরাজিতে শিক্ষার ব্যবস্থা আছে। আপনাকে ‘History of Bengali Language and Literature’ সম্পূর্ণ নতুনভাবে প্রণয়ন করাইয়াছিলাম কেন? বৈষ্ণব ইতিহাস সম্বন্ধে ‘রিডার’ নিযুক্ত করিয়া আপনার দ্বারা তাহা লিখাইয়া লইয়াছি কেন? শ্রীযুক্ত জে. এন. দাস সাহেবের দ্বারা ষোড়শ ও সপ্তদশ শতাব্দীর বাংলা—সাহিত্যে বর্ণিত বঙ্গদেশের অবস্থা লিখাইলাম কেন? বিজয় মজুমদার ভাষার ইতিহাস—রচনায় উত্সাহ পাইয়াছেন কেন? এগুলি আমার মুখ্য উদ্দেশ্যের অবতরণিকা স্বরূপ। এখন ভিত তৈরি হইয়া গিয়াছে, মন্দির গঠন করিতে আর বিলম্ব হইবে না। আপনারা ক্ষেত্র প্রস্তুত হইবার পূর্বে ফসলের জন্য হৈ চৈ করিয়াছেন, তাও কি হয়? এইবার যান, এণ্ডারসন যেন শীঘ্র একটা খসড়া পাঠাইয়া দেন এর জন্য চিঠি লিখুন।‘

দীনেশচন্দ্র সেনকে দায়িত্ব দিলেন বাংলা বিভাগে উপযুক্ত অধ্যাপক নির্বাচনের জন্য। তিনি চারুচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, বসন্তরঞ্জন রায়, শশাঙ্কমোহন সেন এবং রাজেন্দ্র শীলকে নির্বাচন করলেন। সেই সময় দীনেশচন্দ্র সেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে একই সঙ্গে স্পেশাল ইউনিভার্সিটি রিডার, রামতনু লাহিড়ী ফেলোশিপ ও বাংলা সংকলন গ্রন্থের সম্পাদক বাংলা বিভাগের বিভাগীয় প্রধান রূপে দায়িত্ব পালন করলেন।

পরাধীন ভারতে ব্রিটিশের প্রতিষ্ঠানে, ব্রিটিশের অনুদানে তাদেরই নাকের ডগায় ১৯১৯ সাল থেকে বহু কাঙ্খিত বাংলা স্নাতকোত্তরের ক্লাস শুরু হল। এই বিভাগের অধ্যাপকরা ১ জুন ১৯১৯ সাল থেকে বেতন পেতে শুরু করলেন বলে এই নবগঠিত ভারতীয় ভাষাবিভাগের আইনত প্রতিষ্ঠা দিবস ঐ দিনটিকেই ধরা হয়। স্নাতকোত্তর পর্যায়ের বাংলা পাঠক্রম চালু হতে একটু সময় লেগেছিল উপযুক্ত পাঠ্যপুস্তক জোগাড়ের কারণে। ১৯১৮ সালের মধ্যে যে কয়টি বই প্রকাশিত হয়েছিল তার ওপরেই বেশি ভরসা করে বাংলা বিভাগকে ১৯১৯ সালে চালু করতে হয়েছিল। ১৯১৯ সালে ভারতীয় ভাষাবিজ্ঞানের জন্য যে পাঠক্রম তৈরি করা হল তা ১৯৩৯ শিক্ষাবর্ষ পর্যন্ত বহাল ছিল। বাংলা বিভাগের বিভাগীয় প্রধান দীনেশচন্দ্র সেন বাংলা পাঠ্যতালিকা তৈরি করলেন, তিনি যে আটটি পত্র তৈরি করেন তা হল—

  • প্রথম পত্র—বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস (প্রাচীনযুগ থেকে ১৮৫০ সাল পর্যন্ত)। আর বিশেষ যুগে ছিল ষোড়শ শতাব্দীর সাহিত্য। যে বই নির্ধারিত ছিল তা হল দীনেশচন্দ্র সেনের বঙ্গভাষা ও সাহিত্য, হিস্টরি অফ মেডিয়াভাল বৈষ্ণব লিটারেচার ও শ্রীচৈতন্য এন্ড হি’জ কম্পেনিয়ন।
  • দ্বিতীয় পত্র—বঙ্গসাহিত্য পরিচয়, ১ম ভাগ, নির্বাচিত অংশ, দীনেশচন্দ্র সেন সম্পাদিত। ময়নামতীর গান, ঢাকা সাহিত্য পরিষদ থেকে প্রকাশিত নলিনীকান্ত ভট্টশালী সম্পাদিত।
  • তৃতীয় পত্র—মুকুন্দ চক্রবর্তীর চন্ডীমঙ্গল, মধুসূদন দত্তের মেঘনাদ বধ কাব্য,
  • চতু্র্থ পত্র—বাংলা বাক্যরীতির বিবর্তন (১৮০০-১৮৫৭), বাংলা সাহিত্যে পাশ্চাত্য সংস্কৃতির প্রভাব। দ্বিতীয় ও তৃতীয় পত্রে পাঠ্যগ্রন্থের উপর তিন চতুর্থাংশ নম্বর ও পাঠ্য বহির্ভূত অংশের ওপর এক চতুর্থাংশ নম্বর থাকত।
  • পঞ্চম ও ষষ্ঠ পত্র—বিকল্প ভাষা (Subsidiary Language),
  • সপ্তম পত্র—মৌলিকভাষা (পালি ভাষা),
  • অষ্টম পত্র—ভাষাতত্ত্ব ও ব্যাকরণ।

দীনেশচন্দ্র সেন প্রাচীন বাংলা সাহিত্যের সঙ্গে লোকসাহিত্যকেও পাঠ্যক্রমের অন্তর্ভুক্ত করলেন। বাংলাসাহিত্য চর্চার ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায় শুরু হল। তিনি নিজেই লিখলেন লোকসাহিত্য নিয়ে প্রথম পূর্ণাঙ্গ গ্রন্থ ‘Folk Literature of Bengal’। ইংরাজি ভাষায় লেখার কারণে শুধু বাঙালি পাঠকের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেনি, তা ব্রিটিশ ও অন্যান্য ভারতীয়দের পাঠ উপযুক্ত হয়েছিল যা বাংলা লোকসাহিত্যকে বৃহত্তর পাঠকের কাছে পৌঁছে দিতে সাহায্য করেছিল।

১লা জুন থেকে নতুন ভারতীয় ভাষাবিভাগের প্রধানভাষা বাংলা ভাষায় স্নাতকোত্তর বিভাগের পাঠক্রম অনুসারে যে পঠনপাঠন শুরু হল সেখানে প্রথম বছর মোট ছাত্র সংখ্যা ছিল ৩২ জন। প্রথম বছরের তুলনায় সংখ্যাটি কম নয়! বাংলা ছাড়াও হিব্রু, গ্রিকভাষা ও কেমিস্ট্রি বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে বিশেষ উন্নতির জন্য পদক্ষেপ নিয়েছিলেন আশুতোষ মুখোপাধ্যায়। মুসলিম ধর্মশাস্ত্র, সাহিত্য, দর্শন, অলঙ্কারশাস্ত্র, বিজ্ঞান, কাব্যাদর্শ, ব্যাকরণ প্রভৃতি আলাদা বিষয়ে শিক্ষার ব্যবস্থা করেছিলেন। তিনি উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে কুড়িটি বিষয়ের পঠন পাঠন চালু করেন—ইংরাজি, বাংলা, সংস্কৃত, পালি, আরবি, পারসি, ভারতীয় প্রাদেশিক ভাষাসমূহ, তুলনামূলক ভাষাতত্ত্ব, দর্শন, ইতিহাস, নীতিশাস্ত্র, ভূবিদ্যা, অর্থশাস্ত্র, গণিত শাস্ত্র, বানিজ্য বিদ্যা, রাষ্ট্রনীতি, শরীরতত্ত্ব, ভূ-নিম্নতত্ত্ব, নৃতত্ত্ব প্রভৃতি, আর বিজ্ঞান বিভাগে রসায়ন বিদ্যা, পদার্থবিদ্যা, উচ্চতর গণিত শাস্ত্র, জড়বিজ্ঞান প্রভৃতি বিষয়ে উচ্চশিক্ষার ব্যবস্থা করলেন সেই সঙ্গে তিব্বতি ভাষাশিক্ষারও ব্যবস্থা করলেন। সতীশচন্দ্র বিদ্যাভূষণের সঙ্গে বিশিষ্ট তিব্বতি পণ্ডিত গেসি লোব্রাং টারজিকে নিয়ে আসেন। কিমুরা প্রভৃতি পণ্ডিতকে এনে চিনাভাষা শিক্ষার ও মাসুদা প্রভৃতি পণ্ডিতকে এনে জাপানি ভাষা শিক্ষার ব্যবস্থা করলেন। প্রাদেশিক ভাষার ক্ষেত্রে হিন্দি, মৈথিলি, ওড়িয়া, অসমিয়া ভাষায় উচ্চশিক্ষার যেমন ব্যবস্থা করলেন তেমনি এই ভাষাগুলির প্রাচীন—সাহিত্য পরিচয় সংকলন করিয়েছিলেন। উচ্চশিক্ষার মধ্যে চারটি বিভাগে তাঁর বিশেষ অবদান রয়েছে তা হল ইন্ডিয়ান ভার্নাকুলার বিভাগ বা ভারতীয় প্রাদেশিক ভাষা সমূহের বিভাগ, প্রাচীন ভারতীয় ইতিহাস ও সংস্কৃতি, ইসলামিক বিষয় জ্ঞানচর্চা ও পালি ভাষাচর্চা বিভাগ। ১৯২২ সালের ১৮ মার্চ সমাবর্তন অনুষ্ঠানে আশুতোষ মুখোপাধ্যায় গৌরবের সঙ্গে ঘোষণা করলেন–

‘For the first time in the history of the Indian University, it became possible for a person to take the highest University Degress on the basis of his knowledge of his mother toungue.’

[ভারতীয় কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে প্রথমবার কোনো ব্যক্তির পক্ষে মাতৃভাষার জ্ঞানের নিরিখে বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ উপাধি লাভ করা সম্ভব হল। (অনুবাদ সম্পাদকের)]

(চলবে)

তথ্যসূত্র-

১) কনভোকেশন এড্রেস (১৮৫৮—১৯০৬)—ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালকাটা, ২০০৭

২) শ্রী দীনেশচন্দ্র সেন, আশুতোষ—স্মৃতিকথা, পারুল প্রকাশন, ২০১১, পাতা ১০১।

৩) শ্রী দীনেশচন্দ্র সেন, মৈমনসিংহ—গীতিকা, প্রথম খণ্ড, দ্বিতীয় সংখ্যা, ১৯৯৩।

৪) ড. দীনেশচন্দ্র সিংহ, প্রসঙ্গঃ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, প্রকাশক কলকাতা বি বি, ২০০৭।

৫) সুদেষ্ণা চক্রবর্তী, স্মৃতি বিস্মৃতিতে দীনেশচন্দ্র সেন, ঘরে বাইরে প্রকাশনা, ২০২০

৬) প্রণব নস্কর, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকোত্তর বাংলা পাঠচর্চার প্রস্তুতিপর্ব ও আচার্য দীনেশচন্দ্র সেন, জলদ পত্রিকা, মৈমনসিংহ শতবর্ষ সংখ্যা, (সম্পাদক—স্বপন ধর) ২০২৩,

 ৭) মনোজ মণ্ডল, বাংলা লোকসাহিত্যের যুগবিভাগ, জলদ পত্রিকা, মৈমনসিংহ শতবর্ষ সংখ্যা, (সম্পাদক—স্বপন ধর) ২০২৩,

৮) সুমিত সরকার, আধুনিক ভারত ১৮৮৫-১৯৪৭, কে পি বাগচি এন্ড কম্পানি।

৯) কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরিতে ব্যক্তিগত অনুসন্ধান।

প্রচ্ছদ চিত্র পরিচিতি: কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, আশুতোষ প্রাঙ্গন

মন্তব্য করুন

আপনার ইমেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।