সূচী

ইতিহাস তথ্য ও তর্ক

যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইলেকট্রিকাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ – ইতিহাসের এক ঝলক

যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইলেকট্রিকাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ – ইতিহাসের এক ঝলক

নির্মলেন্দু চ্যাটার্জি

অক্টোবর ৫, ২০২৪ ১৮৭ 2

ইতিহাসের সূচনা

যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা এক ঐতিহাসিক সন্ধিক্ষণে। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের সৃষ্টিকে এক ঐতিহাসিক ঘটনা বলে মনে না করার কারণ নেই। ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী শক্তি নিজের প্রয়োজনে ইঞ্জিনিয়ারিং পাঠ্যক্রম শুরু করেছিল। প্রথম শিবপুরে বি.ই কলেজ আর রুরকিতে কারিগরি মহাবিদ্যালয় গড়ে ওঠে। সেখানে প্রাথমিক বিষয় ছিল সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং। পরে অবশ্য মেকানিকাল এবং ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং পাঠ্যক্রম সংযোজিত হয়। 

‘বেঙ্গল টেকনিক্যাল ইন্সটিটিউট’ থেকে ‘সি.ই.টি’ থেকে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় ইঞ্জিনিয়ারিং ফ্যাকাল্টি   

আজকে অনেকেই জানেন ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের অঙ্গ হিসেবে সৃষ্টি হয় জাতীয় শিক্ষা পরিষদের। ভারতীয়দের জন্য ভারতীয়দের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত এবং পরিচালিত ছিল এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। সেখানে সাধারণ শিক্ষার সঙ্গে কারিগরি শিক্ষার প্রয়োজনীয়তাও অনুভূত হয়। এই উদ্দেশ্যে স্থাপিত হয় ‘বেঙ্গল টেকনিক্যাল ইন্সটিটিউট’। সময় ছিল ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের পরেই—১৯০৬-৭ সাল। পাঠ্যক্রমে স্থান পায় মেকানিকাল, ইলেক্ট্রিক্যাল এবং কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং। প্রাথমিক আস্তানা হয়েছিল রাজাবাজারের তারকনাথ পালিতের বাড়িতে। এই প্রতিষ্ঠান রাজাবাজার থেকে ১৯২৪ সালে স্থানান্তরিত হয় যাদবপুরের বর্তমান ঠিকানায়। নতুন নাম হল ‘কলেজ অফ ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজি’, লোকমুখে সি.ই.টি—সময় ১৯২৮। ১৯৫৫ সালে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা হয়, সি.ই.টি তখন তিনটি ফ্যাকাল্টির একটি।

আমরা যখন পঞ্চাশের দশকে ছাত্র তখনও ইঞ্জিনিয়ারিং ফ্যাকাল্টিকে বলা হত সি.ই.টি।

যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং-এ স্নাতক ডিগ্রী ছিল বি.ই.ই—ব্যাচেলর অফ ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং। প্রাথমিক স্তরে ‘বেঙ্গল টেকনিক্যাল ইন্সটিটিউট’ এবং ‘কলেজ অফ ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজি’-র স্নাতকদের দেওয়া হত এ.এম.ই.ই—ইঞ্জিনিয়ারদের সর্বভারতীয় সংস্থা ‘ইন্সটিটিউট অফ ইঞ্জিনিয়ারস (ইন্ডিয়া)’- এর দেওয়া ডিপ্লোমা।

ব্রিটিশ সরকারের শিক্ষা ব্যবস্থার বিরুদ্ধাচারণ করে গড়ে উঠেছিল ‘বেঙ্গল টেকনিক্যাল ইন্সটিটিউট’ যা পরবর্তীতে হয়ে উঠেছিল কলেজ অফ ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজি। সুতরাং ব্রিটিশ সরকারের কাছে এই প্রতিষ্ঠানে শিক্ষাপ্রাপ্তরা ছিল অচ্ছ্যুৎ। তাদের ডিগ্রির সরকারি স্বীকৃতি ছিল না। তাদের চাকুরির উৎস ছিল বেসরকারি প্রতিষ্ঠান। জামসেদপুরের টাটা ষ্টিল ছিল বড় কর্মসংস্থান কেন্দ্র। ১৯৪৪ সালে এই ডিপ্লোমাকে বি ই ই ডিগ্রিতে পরিবর্তন করা হয় এবং সরকারি স্বীকৃতি মেলে। ফলে চাকরির পাওয়ার সুযোগ অনেকটা বেড়ে যায়।

একেবারে প্রাথমিক স্তরে ১৯১২ সালে বেঙ্গল টেকনিক্যাল ইন্সটিটিউয়ের ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে ছাত্র ছিলেন সুরেন্দ্র কুমার রায়। তিনি আমেরিকার বিশ্ববিদ্যালয়ে এম.এস করে জার্মানিতে কাজ করে প্রশিক্ষিত হয়ে এসে হাল ধরলেন ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের, হলেন প্রথম বিভাগীয় প্রধান। পরবর্তী কালে ১৯৪৩ সালে তিনি কলেজের চাকরি ছেড়ে বেঙ্গল ল্যাম্প কারখানা স্থাপন করেন। তারপর বিভাগের প্রধান হয়ে এলেন প্রাক্তন ছাত্র, পরে এডিনবারা থেকে ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং-এ ডিগ্রি প্রাপ্ত হেমচন্দ্র গুহ। ইলেকট্রিকাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের তিনি দ্বিতীয় বিভাগীয় প্রধান।

অধ্যাপক হেমচন্দ্র গুহের নেতৃত্বে বিভাগের উত্তরণ শুরু হল। ততদিনে ভারত স্বাধীন হয়েছে এবং পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা বাস্তবায়নের পথে। ভারতের নানা প্রান্তে প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে কলকারখানা। শিল্পোৎপাদনের জন্য দরকার প্রচুর কলাকুশলী। প্রয়োজন বিদ্যুতের, তাই গড়ে তোলা হচ্ছিল উচ্চশক্তিসম্পন্ন বিদ্যুৎকেন্দ্র এবং তার পরিবহন ব্যবস্থা। দেশের প্রয়োজন ইলেক্ট্রিকাল ইঞ্জিনিয়ারদের।

শিক্ষক শিক্ষন

হেমচন্দ্র গুহ নতুন উদ্যমে বিভাগকে ঢেলে সাজাতে উদ্যোগী হলেন। একদিকে যেমন বিভাগে কর্মরত শিক্ষকদের বিদেশে, বিশেষত আমেরিকায় পাঠিয়ে উচ্চ শিক্ষিত করে আনলেন আবার অন্যদিকে ভারতের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে নিয়ে এলেন বিদেশে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত শিক্ষকদের। বিভাগ থেকে আমেরিকা গেলেন ধীরেন্দ্র নাথ দেব, অমিয় কুমার চ্যাটার্জি, মন্মথ নাথ চক্রবর্তী এবং গোবিন্দ প্রসাদ পুরকায়স্থ। ইংল্যান্ড-এর ইম্পিরিয়াল কলেজ থেকে উচ্চশিক্ষা প্রাপ্ত হয়ে এলেন জ্যোৎস্না কুমার চৌধুরী এবং শ্যামাপদ পাত্র, আর জার্মানীর স্টুটগার্ট থেকে উচ্চ শিক্ষা নিয়ে এলেন নীতিশ নারায়ণ রায়। আমেরিকায় শিক্ষাপ্রাপ্ত মতিলাল জৈন আর নন্দলাল শা এসেছিলেন বেনারস হিন্দু ইতিনিভার্সিটি থেকে।

আধুনিক গবেষণাগার

ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং-এর গবেষণাগারকে আধুনিক করার জন্য হেমচন্দ্র গুহ আমেরিকা যান। আমেরিকার একটি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের সঙ্গে সহজ চুক্তিতে ইলেক্ট্রিক্যাল মেশিনস ল্যাবরেটরির জন্য যন্ত্রপাতি সংগ্রহ করেন যা আজও ব্যবহৃত হয়ে চলেছে।

প্রথম পঞ্চবার্ষিক যোজনায় ঠিক হয়েছিল বিদ্যুৎ পরিবহনের জন্য ১৩২ কেভি হাইভোল্টেজ ট্রান্সমিশন লাইন বসানো হবে। দূরদর্শী হেমচন্দ্র বিভাগে একটি হাইভোল্টেজ ল্যাবরেটরি তৈরি করার মনস্থ করেন। তখন ভারতে কোথাও হাইভোল্টেজ ল্যাবরেটরি ছিল না। এক মাত্র ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউট অফ সাইন্স, বেঙ্গালুরুতে ব্রিটেনের ম্যানচেস্টার ইতিনিভার্সিটির সহযোগিতায় একটি হাইভোল্টেজ ল্যাবরেটরি তৈরি করা হচ্ছিল। সমস্ত যন্ত্রাদি ব্রিটেন থেকে এনে তাদের কলাকুশলীদের সাহায্যে প্রতিস্থাপন করা হয়। হেমচন্দ্র হল্যান্ড-এর ফিলিপস কোম্পানি থেকে যন্ত্রাংশ এনে ভারতীয় কারিগর এবং কলাকুশলীদের সাহায্য হাই ভোল্টেজ ল্যাবরেটরি গড়ে তোলেন। অর্থ যুগিয়েছিলেন ভাগ্যকুলের বিখ্যাত জমিদার প্রমথনাথ রায়। ল্যাবরেটরির নাম রাখা হল পি এন রায় হাইটেনশন ল্যাবরেটরি। এই ল্যাবরেটরি পরিচালনার জন্য ডক্টর মতিলাল জৈনকে বিদেশে প্রশিক্ষিত করা হয়েছিল। পরবর্তী কালে এই হাইভোল্টেজ ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষিত হয়েছে, মহারাষ্ট্র থেকে আসাম, বিশাল ভূখণ্ডের বৈদ্যুতিক যন্ত্র এবং যন্ত্রাংশ এবং এই পরীক্ষার ফল স্বীকৃতি পেয়েছে ভারতের মানক সংস্থার।

‘কলেজ অফ ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজি’ থেকে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরের পর শিক্ষকদের শুধু শিক্ষার্থীদের শিক্ষাদানের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে গবেষণাকেও অগ্রাধিকার দেওয়ার কথা ভাবা হয়। সেই অনুযায়ী  ১৯৬০ সাল থেকে স্নাতকোত্তর কোর্স, এম.ই.ই শুরু করা হল।

ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং শিক্ষাক্রমকে পাঁচটি উপ-বিভাগে ভাগ করা হল। ইলেক্ট্রিকাল মেশিনস, ইলেক্ট্রিক্যাল মেজারমেন্ট, পাওয়ার সিস্টেম, কন্ট্রোল ইঞ্জিনিয়ারিং আর হাইভোল্টেজ ইঞ্জিনিয়ারিং। দায়িত্ব প্রাপ্ত অধ্যাপকেরা হলেন যথাক্রমে, নীতিশনারায়ণ রায়, জ্যোৎস্নাকুমার চৌধুরী, শ্যামাপদ পাত্র, সুশীল দাসগুপ্ত আর বিশ্বরূপ চৌধুরী। আমেরিকায় শিক্ষাপ্রাপ্ত সুশীল দাসগুপ্ত বি.ই কলেজের অধ্যাপক ছিলেন আর জার্মানিতে শিক্ষাপ্রাপ্ত বিশ্বরূপ চৌধুরী এলেন সিমেন্স, জার্মানি থেকে। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে উচ্চতর গবেষণার সূত্রপাত হল। শিক্ষাদান ছাড়াও গবেষণা করা শিক্ষকের আবশ্যিক কাজ হিসেবে গণ্য করা হল।

স্মরণীয় বিভাগীয় প্রধানেরা

যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম উপাচার্য ছিলেন ডক্টর ত্রিগুণা সেন। তাঁর কার্যকাল শেষ হবার পর ১৯৬৬ সালে উপাচার্য হলেন অধ্যাপক হেমচন্দ্র গুহ, তখনও তিনি ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের প্রধান এবং সেই সঙ্গে ইঞ্জিনিয়ারিং ফ্যাকাল্টির ডিন।

অধ্যাপক হেমচন্দ্র গুহ যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের পরিচিতিকে সর্বজনীন করে তুলেছিলেন। তিনি উদ্যোগী হয়ে কর্মরত ডিপ্লোমাপ্রাপ্ত ইঞ্জিনিয়ারদের রাত্রে ডিগ্রি কোর্সে ভর্তি হওয়ার সুযোগ করে দেন। অধ্যাপক গুহ পশ্চিমবঙ্গ ষ্টেট ইলেক্ট্রিসিটি বোর্ড এবং দামোদর ভ্যালি করপোরেশনের বোর্ড সদস্য ছিলেন। ওয়ার্ল্ড এনার্জি কংগ্রেসের সভায় ভারতের হয়ে প্রতিনিধিত্ব করেছেন দু’বার। বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে এমেরিটাস প্রফেসর এবং সন্মানিক ডক্টরেট ডিগ্রি দিয়ে সম্মানিত করেছিল।

অধ্যাপক হেমচন্দ্র গুহ

হেমচন্দ্র গুহের পর ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের বিভাগীয় প্রধান হলেন অধ্যাপক ধীরেন্দ্রকুমার দেব। তৎকালে বিভাগীয় প্রধানের কার্যকালের মেয়াদ শেষ হত চাকুরী থেকে অবসরপ্রাপ্তি পর্যন্ত। ধীরেন্দ্র কুমার দেব-এর সময় বিশ্ববিদ্যালয় তথা বিভাগকে এক কঠিন সময়ের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। তখন বাইরের রাজনৈতিক অস্থিরতা থেকে বিভাগকে বাঁচিয়ে পঠনপাঠন এবং গবেষণা চালিয়ে যাওয়া সহজ ছিল না। ছাত্র এবং পুলিশের মধ্যে সংঘাত ছিল দৈনন্দিন ঘটনা। ধীরেন্দ্র কুমার দেব সাহসের সঙ্গে অবস্থার মোকাবিলা করেছিলেন। কিছুদিন ছাত্রদের সাহস যোগাতে ছেলেদের এমনকী ছাত্রাবাসে রাত কাটিয়েছিলেন। সেই সময় তিনি ইঞ্জিনিয়ারিং ফ্যাকাল্টির ডিন-ও ছিলেন।

ধীরেন্দ্রকুমার দেবের পর বিভাগের প্রধান হন জ্যোৎস্নাকুমার চৌধুরী। তিনি আদিতে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র এবং লন্ডনের ইম্পিরিয়াল কলেজ থেকে উচ্চশিক্ষা প্রাপ্ত। আমাদের ছাত্রাবস্থায় আমরা তাঁর নাম খুঁজতাম লন্ডন থেকে বিদেশি লেখকদের বইয়ের পাতায়। তিনি তখন তাঁর বিষয়ে ভারত শ্রেষ্ঠ বললে অত্যুক্তি হবে না। তাঁর স্বীকৃতি স্বরূপ তাঁকে ভারতের বিজ্ঞান কংগ্রেসের বার্ষিক সম্মেলনে ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের সভাপতি করা হয়। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে সান্মানিক ডক্টরেট ডিগ্রি দিয়ে সম্মানিত করে। তিনি নিজে উদ্যাগী হয়ে একটি সর্বভারতীয় সংগঠন ‘ইনস্টিটিউশন অফ ইন্সট্রুমেন্টেশন সাইন্টিস্ট অ্যান্ড টেকনোলজিস্ট (ইন্ডিয়া)’ গড়ে তোলেন। উদ্দেশ্য ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং-এ ব্যবহৃত নানা যন্ত্র এবং মাপন পদ্ধতির উন্নতি এবং কলাকুশলী ও  বৈজ্ঞানিকদের একটি ছাদের নিচে  আনা। এই সংস্থার শাখা ছড়িয়ে ছিল ভারতের নানা শহরে।

জ্যোৎস্নাকুমার চৌধুরী সময় থেকে বিভাগীয় প্রধানের কার্যকাল সীমিত করা হল তিন বছরের জন্য। সুতরাং বিভাগীয় প্রধানের পদটির গুরুত্ব অনেকটা হারাল।

বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত বিশেষ কিছু প্রকল্প

গবেষণার সুবিধার জন্য উপ-বিভাগ করবার ফল ফলতে শুরু করে। ভারতীয় রেলের সংস্থা আর.ডি.এস.ও (Research Design and Standards Organization-RDSO), লখনৌ, রেলের ইলেক্ট্রিক লাইনের বিশেষ কিছু সমস্যা এবং তার সমাধানের জন্য বিভাগের হাইভোল্টেজ উপ-বিভাগকে দায়িত্ব দেয়—সময় ১৯৬৬-৬৭ সাল। আমার জ্ঞানে সেটাই প্রথম বড় প্রজেক্ট।

এরপর কন্ট্রোল ইঞ্জিনিয়ারিং উপ-বিভাগ কলকাতার ভূতলগামী মেট্রোরেলের বিষয়ে আরও একটি প্রজেক্ট পায়। বিভাগের গবেষণার বিষয়ে বৃহত্তম প্রজেক্ট আসে ভারত সরকারের ডিফেন্স রিসার্চ ডেভেলপমেন্ট অরগানাইজেশান বা ডি.আর.ডি.ও থেকে মিসাইল গবেষণার জন্য।

বিভাগের উচ্চতর গবেষণার ফসল প্রকাশিত হতে থাকে ইঞ্জিনিয়ারিং-এর শ্রেষ্ঠ গবেষণার পত্রিকাগুলোতে। পৃথিবীর প্রথম সারির গবেষকদের মধ্যে স্থান করে নেয় বিভাগের শিক্ষকরা।

পাঠক্রমের বিস্তার

সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পাঠ্যক্রমে সংযোজিত হতে লাগল নতুন নতুন বিষয়। বিভাগে ছিল পাঁচটি উপবিভাগ বা সেকশন। ১৯৮৪-৮৫ শিক্ষাবর্ষে অধ্যাপক সুনীল রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়ের তত্ত্বাবধানে চালু হল একটি নতুন শাখা—ইলিউমিনেশন ইঞ্জিনিয়ারিং। এল ই ডি বালবের আবিষ্কার আলোর ব্যবহারে যুগান্তর এনে দিল। চতুর্থ বর্ষে ছাত্রদের আগের পাঁচটি উপবিভাগের পাঁচটি বিষয়ের সঙ্গে ইলুমিনেশন ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার সুযোগ দেওয়া হল। শুরু হল ইলুমিনেশন সেকশনের যাত্রা৷ ২০০৪ সাল থেকে এই বিষয়ে স্নাতকোত্তর কোর্স চালু হয়।

ভবনের ইতিহাস

প্রথম দিকে ইলেকট্রিকাল ইঞ্জিনিয়ারিং-এর অনেক ক্লাস হত জেনারেল বিল্ডিংয়ের দোতলায়, যাকে আজ বলা হয় অরবিন্দ বিল্ডিং। তার তিনতলা তখনও হয়নি। আজ যেখানে ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং-এর মূল বাড়ি সেখানে ছিল একটি একতলা বাড়ি, কিছু ক্লাস এবং ল্যাবরেটরি এই বাড়িতে হত। তৎকালীন বিভাগীয় প্রধান সুরেন্দ্রনাথ রায়ের ভাই কিরণশঙ্কর রায় ছিলেন ‘বেঙ্গল টেকনিক্যাল ইন্সটিটিউট’-এর প্রাক্তনী। তিনি আমেরিকার এম.আই.টি থেকে এম.এস করে এসে একটি বিদেশি কোম্পানির উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা হয়েছিলেন। তিনি উদ্যোগ নিলেন বাড়িটিকে একতলা থেকে দোতলা করার। তাঁর আকস্মিক মৃত্যুতে এই কাজ বাধাপ্রাপ্ত হয় কিন্তু বিভাগীয় প্রধানের উদ্যোগে দোতলা সম্পূর্ণ হয়। পরে হীরেন্দ্রনাথ দত্তের আর্থিক সাহায্যে তিন তলা হয়।

দোতলা এবং তিন তলার কিছু অংশ একীভূত করে তৈরি হয় একটি সুদৃশ্য হল। কিরণশঙ্কর রায়ের স্মৃতিকে মনে রেখে এই হলের নাম রাখা হয় কে.সি রায় মেমরিয়াল হল বা কেসিআর হল। পরে হলের উপরের অর্ধেক অংশ ঢালাই করে তৈরি হয় তিন তলার মেঝে৷ বর্তমানের মেজারমেন্ট ল্যাবরেটরির বর্তমান অবস্থান এখানে । তিনতলা বাড়িটার লিপিবদ্ধ নাম হীরেন্দ্র নাথ দত্ত মেমরিয়াল বিল্ডিং। লোক মুখে ইলেক্ট্রিক্যাল বিল্ডিং। তবে কে.সি আর হল এখনও  এই নামে হল হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। বড় অনুষ্ঠানে হল হিসেবে, আবার অন্য সময় ড্রইং ক্লাস হিসেবে। ইলুউমিনেশন ল্যাবরেটরি এই বাড়ির তিন তলার ছাদে তৈরি হয়। কিছু দিন আগে সেই ল্যবরেটরির কিয়দংশ আগুনে পুড়ে যায়। প্রাক্তনীদের সহায়তায় তার কিছুটা আবার নতুন করে গড়া সম্ভব হয়েছে। বিভাগের বিস্তৃতি বেড়েছে ডি.আর.ডি.ও অনুদানে গড়া জুপিটার বিল্ডিং আর কেন্দ্রীয় সরকারের অনুদানে হীরেন্দ্রলাল দত্ত মেমরিয়াল বিল্ডিং পশ্চাৎদেশকে চারতলায় রূপান্তর করেছে । 

ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং-এর প্রাক্তনীরা নানা ভাবে বিভাগকে সাহায্য করেছে। বিশেষ ভাবে দুজনের নাম মনে পড়ছে। কমল বোস আর আর চিত্ত দাসগুপ্ত। এঁরা কলকাতা ইলেক্ট্রিক সাপ্লাই কোম্পানির উচ্চপদে আসীন ছিলেন, উদ্যোগী হয়ে ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিল্ডিংয়ের দোতলায় একটি ক্লাস ঘরকে আধুনিক একটা সভা ঘরে পরিবর্তন করলেন—বিভাগ প্রায় স্বয়ংসম্পূর্ণ হল। এখানেই বক্তৃতা দিয়ে গেছেন পৃথিবীর নানা প্রান্ত থেকে আসা বিদগ্ধজনেরা।

শিক্ষা বিস্তারে ভূমিকা

বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ শিক্ষাদান আর গবেষণার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে না, লব্ধ জ্ঞানকে ছড়িয়ে দেওয়া তার একটি কর্তব্য। সেমিনার, ওয়ার্কশপ বা সিম্পোজিয়াম এই কাজের প্রক্রিয়া। বিভাগ অসংখ্য ওয়ার্কশপ এবং সেমিনার আয়োজন করেছে। এই লব্ধ জ্ঞানকে ছড়িয়ে দেওয়া প্রক্রিয়ার সর্বোচ্চ ক্রিয়া আন্তর্জাতিক কনফারেন্স। বিভাগ এই রকম দুটি বড় কনফারেন্স করেছে। তার মধ্যে একটি ১৯৯২ সালে ‘পাওয়ার সিস্টেম কনফারেন্স’ আর দ্বিতীয়টি বিভাগের শতবার্ষিকী উৎসব অনুষ্ঠানের সময়, ২০০৬-৭ সালে, নাম দেওয়া হয় ‘ইমারজিং ট্রেন্ডস ইন ইলেক্ট্রিকাল ইঞ্জিনিয়ারিং’। প্রথমটি অনুষ্ঠিত হয়েছিল হোটেল তাজ, কলকাতায়। উদঘাটক ছিলেন তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু আর দ্বিতীয়টি অনুষ্ঠিত হয়েছিল কলকাতার সাইন্স সিটির সভাগৃহে উদ্বোধক ছিলেন তৎকালীন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সি। উভয় কনফারেন্সে ভারতের নানা প্রান্ত থেকে অর্দ্ধ সহস্রাধিক গবেষক তাঁদের গবেষণা পত্র উপস্থাপিত করেন এবং আলোচিত হয়।

বিভাগের উৎকর্ষ 

যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ আজ ভারতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ। ছাত্র এবং ছাত্রী বোধহয় সংখ্যার বিচারে ভারতে বৃহত্তম আর গুণের বিচারে প্রথম সারিতে। কয়েকদিন আগে ন্যাক, ন্যাশানাল এক্রিডেশন অথরিটি বিভাগের মূল্যায়ন করে এই রকম মন্তব্য করেছে। একদিকে বিভাগের ছাত্ররা দেশে বিদেশে নাম উজ্জ্বল করেছেন আবার শিক্ষকেরা বিভাগের ঐতিহ্যকে বহন করে এগিয়ে চলেছেন। এই বিভাগের শিক্ষকরা বিদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা করে সুনাম অর্জন করেছেন, আবার প্রশাসক হিসেবে নানা সংস্থায় অবদান রেখেছেন। সাম্প্রতিক কালে এই বিভাগের শিক্ষক শিবাজি চক্রবর্তী এন আই টি কালিকটের ডাইরেক্টর হিসেবে প্রতিষ্ঠানকে দক্ষতার সঙ্গে পরিচালনা করার নজির গড়েছেন।

উপাচার্য ড: শঙ্কর সেন, রাজ্যপাল ড: নুরুল হাসান, অধ্যাপক জোৎস্না চৌধুরী, অধ্যাপক নির্মলেন্দু চ্যাটার্জি

এখনকার বিচারে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ইঞ্জিনিয়ারিং জার্নালের পাতা খুললে বিভাগের শিক্ষকদের গবেষণার অবদান চোখে পড়ে—তার সংখ্যা খুব কম নয়। আমেরিকার স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের তৈরি  করা পৃথিবীর শতকরা দু’ভাগ শ্রেষ্ঠ গবেষকদের তালিকায় প্রতি বছরের মত এবারও (২০২৪ সালে) বিভাগের একাধিক শিক্ষক জায়গা করে নিয়েছেন। অদূর ভবিষ্যতেও এই মান বজায় থাকবে এমন আশা আছে।

প্রচ্ছদ চিত্র পরিচিতি: মূল ইলেক্ট্রিকাল ইঞ্জিনীরিং ভবন, হীরেন্দ্র নাথ দত্ত মেমরিয়াল বিল্ডিং

শিক্ষা, অধ্যাপনা এবং গবেষণা যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে। যুক্ত ছিলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, মৌলানা আজাদ ইউনিভার্সিটি অফ টেকনোলজি,আই’আই.ই.এস.টি-শিবপুর এবং বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা পরিচালনায়। কয়েকটি বেসরকারি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন। নানাবিধ সামাজিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গেও নিবিড় যোগ ছিল।

মন্তব্য তালিকা - “যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইলেকট্রিকাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ – ইতিহাসের এক ঝলক”

  1. খুবই মূল্যবান ও তথ্য সমৃদ্ধ রচনা। আমি যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং এ স্নাতক হই। ১৯৬৮-৭৩ ব্যাচ। আমাদের সৌভাগ্য যে শ্রদ্ধেয় নীতিশ রায়, জ্যোৎস্না চৌধূরী, সুশীল দাশগুপ্ত প্রমুখ প্রথিতযশা ব্যক্তিত্বের সাহচর্য লাভ করেছি আমরা। সত্যিই আমরা নিজেদের ভাগ্যবান মনে করি।

মন্তব্য করুন

আপনার ইমেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।