হাজার বছর আগের সাবল্টার্ন বাঙালির জীবনচর্যা
( ১ )
আদি মধ্যযুগের বাঙালি সমাজের নিম্নবর্গের মানুষের প্রাচীন ইতিহাস জানতে প্রাচীন বাংলা ভাষায় রচিত চর্যাপদ এক আকর গ্রন্থ। ‘চর্যা’ শব্দের অর্থ হল আচরণ— বৌদ্ধ ধর্মের সিদ্ধপুরুষেরা ‘আলো-আঁধারি’ ভাষায় এতে সাধনার জন্য পালনীয় নির্দেশ দিয়েছেন। আজ থেকে হাজার বছর আগে এই অঞ্চলের নিম্ন বর্ণের মানুষ, যারা আবার আর্থ-সামাজিক শ্রেণিবিন্যাসের নিম্ন প্রান্তে অবস্থান করতেন, যাদের নব-নাম সাবল্টার্ন, কেমনভাবে জীবন যাপন করতেন, সমাজ কতটা শ্রেণি বিভক্ত ছিল ইত্যাদি জানতে হলে চর্যাপদ ঘাঁটতে হয়। ১৯০৭ সালে পণ্ডিত হরপ্রসাদ শাস্ত্রী নেপাল রাজদরবারের গ্রন্থাগার থেকে এই পুঁথি উদ্ধার করেন। তাঁরই সম্পাদনায় পুঁথিখানি ‘হাজার বছরের পুরাণ বাঙ্গালা ভাষায় বৌদ্ধগান ও দোহা’ নামে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ কর্তৃক ১৯১৬ সালে প্রকাশিত হয়।
চর্যাগীতির পদগুলি কবে রচিত হয়েছে? আমরা এই বিষয়ক বিতর্কের মধ্যে ঢুকব না। ড. সুকুমার সেন যেরকম অনুমান করেছেন, চর্যাগীতির সময়কাল মূলত দশম শতাব্দী (এবং সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় অনুযায়ী এদিকে ওদিকে আরও এক শতাব্দী করে ধরতে হবে) বলেই ধরে নেওয়া যাক।১ চর্যাগীতির ভাষা নিয়েও বাকবিতণ্ডা কম নেই। তবে যখন সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় এই চর্যাগীতির ভাষা বাংলা প্রতিপন্ন করেন তখন পণ্ডিতরা মোটের ওপর তা মেনে নেন।২ বঙ্গাল দেশ, পঁউয়া খাল (পদ্মা নদী), বঙ্গালী ভইলী, গুনিয়া, লেহঁ, দিল, ভণিআঁ, পড়িআঁ, উঠি গেল, আখি বুজিঅ, পার করেই, নিদ গেলা, অপণা মাংসেঁ হরিণা বৈরী, হাড়ীত ভাত নাহি ইত্যাদি শব্দযোজনা ও ছন্দকুশলতা বাংলা ভাষায় পরবর্তীকালেও মেলে। এই পদগুলির রচয়িতা বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্যরা অবশ্য সকলেই বাঙালি ছিলেন না। তাঁদের মধ্যে শবরপা, কুক্কুরীপা ও ভুসুকুপা বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে জন্মগ্রহণ করেন। তবে অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় মন্তব্য করেছেন, “চর্যার আচার্যেরা কামরূপ, সোমপুরী, বিক্রমপুর— যেখান থেকেই আসুন না কেন, আশ্চর্যের বিষয়, এঁরা সকলেই রাঢ় অঞ্চলের ভাষানীতি গ্রহণ করেছিলেন।”৩
এই বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্যরা সংস্কৃতে পারদর্শী হলেও তাঁরা তৎকালীন অপূর্ণাঙ্গ বাংলাতেই পদগুলি রচনা করেছিলেন— এর ভাষা আজ পর্যন্ত আবিষ্কৃত বাংলা ভাষার আদিতম রূপ। বিষয় আধ্যাত্মিক— তবে তা প্রকাশে ‘সন্ধ্যা’ বা ‘আলোআঁধারি’ ভাষা ব্যবহার করা হয়েছে।৪ ‘আলোআঁধারি’ ভাষায় অধ্যাত্মবাদের গূঢ়ার্থে না গিয়ে শুধু পদগুলির আপাতবক্তব্য নিয়ে আলোচনা করলে আমরা সেই যুগের বাঙালি সমাজের জীবনযাত্রা, সমাজ ও পরিবেশ বিষয়ে বাস্তব চিত্র খুঁজে পেতে পারি। আবিষ্কৃত পুঁথিটিতে ৫০টি চর্যায় মোট ২৪ জন সিদ্ধাচার্যের নাম পাওয়া যায়। এঁরা হলেন: লুই (>লুইয়া> রুইদাস>রোহিত;৫ তিব্বতী ঐতিহাসিক লামা তারনাথের মতে লুইপাদ গঙ্গার ধারে বাস করতেন), কুক্কুরী (তারনাথের মতে সঙ্গে একটা কুক্কুরী সবসময়ে থাকত), গুণ্ডরী (>গুণ্ডকরিক, সম্ভবত জাতিবাচক নাম), চাটিল (>চট্ট ?> চট্টগ্রাম?৫), বিরুআ (>বিরূপক>বিরূপাক্ষ৫), ভুসুকু(>ভূসুক্ষ্ম?৫), কাহ্ন (>কাহ্ন পা>কৃষ্ণপাদ;৬ ওড়িশার এক ব্রাহ্মণ বংশে জন্মগ্রহণ করেন, থাকতেন সোমপুরী বিহারে), কামলি (কম্বলিক = কেশকম্বলীর অপভ্ৰংশ?৫), মহিত্তা (>মহিণ্ডা, মহীধর, মহীপাদ৫) ডোম্বী হেরুক (পূর্ব দিকের ত্রিপুরা রাজ্যের রাজা), শান্তি, বীণা (ভালো বীণা বাজাতেন), সরহ (শবর? ব্যাধ?৫), শবর (জাতিতে শবর), ঢেণ্ঢণ (জাতিতে তাঁতি), তান্তী, লাড়ীডোম্বী, আর্যদেব (তারনাথের মতে তিনি ছিলেন মেবারের রাজা এবং গোরক্ষনাথের শিষ্য) ইত্যাদি।
এই নামগুলির অধিকাংশই তাঁদের ছদ্মনাম এবং ভনিতার শেষে তাঁরা নামের সঙ্গে ‘পা’ (>পাদ) শব্দটি সম্ভ্রমবাচক অর্থে ব্যবহার করতেন। চর্যাপদের কবিদের নামগ্রহণের মধ্যে জাতিবাচক ভাবনার সন্ধান পাওয়া যেতে পারে; যেমন ডোম্বীপাদ ও শবরপাদ। তিল্লকপাদ ছিলেন জাতিতে তিলি। ঢেণ্ঢণপাদ সম্ভবত ঢাক বাজিয়ে ভিক্ষায় বেরোতেন। যারা এই পদগুলি রচনা করেছেন তারাও অনেকে ছিলেন প্রান্তিক মানুষ। ডোম, চাঁড়াল, শবরদের জীবন, তার যন্ত্রণা, প্রেম ও বিনোদনের কথা তাই এখানে সহজ ভাবে উঠে আসে।
(২)
তখন বাংলায় উত্তর ভারতীয় ব্রাহ্মণ্য বর্ণাশ্রম প্রথার অনুপ্রবেশ ঘটে গেছে। বিভিন্ন দ্রাবিড় ও অস্ট্রো-এশিয়াটিকভাষী কৃষিজীবী ও শিকারি-সংগ্রাহক জনগোষ্ঠী বর্ণ প্রথার চাপে নিচু জাত বা অস্পৃশ্য হিসেবে বিবেচিত হতে লাগলেন। এরা উচ্চবর্ণ মানুষের গ্রাম ও নগর থেকে দূরে সমাজের প্রান্তবাসী হয়ে জঙ্গলে বা পাহাড়ে বাসস্থান গড়ে তোলেন।
টালত মোর ঘর নাহি পড়বেষী।
হাড়ীত ভাত নাঁহি নিতি আবেশী॥
বেঙ্গ(গ)সংসার বড্হিল জা অ।
দুহিল দুধু কি বেন্টে ষামায়॥
আধুনিক বাংলায় বলা যায়,
“টিলায় আমার ঘর, প্রতিবেশী নেই। হাঁড়িতে ভাত নেই, নিত্যই ক্ষুধিত (অতিথি)। (অথচ আমার) ব্যাঙের সংসার বেড়েই চলেছে। দোয়ানো দুধ আবার বাঁটে ঢুকে যাচ্ছে।”
বোঝা যায়, তখনও বাঙালির মূল খাদ্য ভাত। আর অভাব হলো তার নিত্যদিনের সঙ্গী। কৃষির প্রসঙ্গে ভুসুকুপাদের রচিত ২১ সংখ্যক চর্যায় আছে এক ছটফটে ইঁদুরের কথা, সেই ইঁদুরের উপদ্রবে কৃষি বিপর্যস্ত হয়। সুকুমার সেন বলেছেন “অন্ধকার রাত্রিতে ইঁদুর চরে এবং যেখানে সেখানে গিয়া শস্য নষ্ট করে। তাহাকে মারিয়া ফেলিতে হয়।”৭ পাশাপাশি সেই সময় দুধের ব্যবহারের বাহুল্য দেখা যায়। যেমন: ‘দুহিল দুধ কি বেন্টে যামায়’ কিংবা ‘দুধ মাঝেঁ লড় অচ্ছন্তে ন দেখই’।
চর্যায় যে রান্নার বাসনের নাম বারবার উল্লেখ করা হয়েছে, তা হলো হাঁড়ি। ভাত রান্না করবার জন্য রকমারি হাঁড়ি আছে। পাশেপাশি কুড়ি অর্থাৎ কড়াইয়ের উল্লেখ কিন্তু নেই। এ যেন আরণ্যকের অতি দরিদ্র সিপাহি মুনেশ্বর সিং। তার একটা লোহার কড়াই পাবার জন্য কী আকুতি! “একখানা লোহার কড়া থাকলে কত সুবিধে হুজুর। যেখানে সেখানে সঙ্গে নিয়ে গেলাম, ভাত রাঁধা যায়, জিনিসপত্র রাখা যায়, ওতে ক’রে ভাত খাওয়া যায়, ভাঙ্বে না। আমার একখানাও কড়া নেই।” তখনকার হতদরিদ্র মানুষের রান্নার বাসন বলতে ছিল হাঁড়ি।
একটি পদে ভীত সন্ত্রস্ত হরিণের (শিকারের কারণে) অসাধারণ বর্ণনা আছে। সুকুমার সেন বলেছেন, “হরিণীকে শিকারি চায় না। সে যেন ‘ঘাইহরিণী’ বা টোপ। চর্যাকর্তা বা সাধক নিজেকে শিকারি কল্পনা করিয়াছেন।”৮
অপণা মাংসেঁ হরিণা বৈরী।
খনহ ন ছাড়অ ভুসুকু অহেরি॥
তেন ন চ্ছুপই হরিণা পিবই ন পানী।
হরিণা হরিণীর নিলঅ ন জানী॥
হরিণী বোলঅ সুণ হরিণা তো।
এ বণ চ্ছাড়ী হোহু ভান্তো॥
তরংগতে হরিণার খুর ন দীসঅ।
ভুসুকু ভণই মূঢ়হিঅহি ন পইসই॥
আধুনিক ভাষায় বলা যায় –
“হরিণ নিজের শত্রু হল নিজের মাংস-হেতু। ক্ষণকালের তরে ভুসুকু শিকার ছাড়ে না। হরিণ তৃণ খায় না, জল খায় না। হরিণ জানে না হরিণীর ঠিকানা। হরিণী (এসে) বলে, শোন হরিণ এ বন ছেড়ে ভ্রান্ত হয়ে (চলে) যাও। তীব্রগতিতে ধাবমান হরিণের খুর দেখা যায় না। ভুসুকু বলেন মূঢ়ের হৃদয়ে একথা প্রবেশ করে না।”
বোঝা যায় সেই সময়ে এই অঞ্চলের মানুষ হরিণের মাংস খেতে পছন্দ করতেন।
চর্যায় মাছের সরাসরি উল্লেখ না থাকলেও নৌকার বহুল ব্যবহারের কথা বারবার উঠে এসেছে যা আদি মধ্যযুগের বাঙালির খাদ্যতালিকায় মাছের উপস্থিতিকে মান্যতা দেয়। সম্ভবত সেই সময়ে নৌকায় করে মাঝ নদীতে বৈঠা বেয়ে গিয়ে জাল ফেলে মাছ ধরার পরিচিত পদ্ধতি ছিল। তরঙ্গসঙ্কুল মাঝ নদীতেও যে এভাবে মাছ ধরা হতো তা চর্যার তেরো নম্বর পদে কাহ্নপাদের লেখা থেকে বোঝা যায়।
তরিত্তা ভবজলধি জিম করি মাআ সুইনা।
মাঝ বেণী তরঙ্গ ম মুনিআ॥
পঞ্চ তথাগত কিঅ কোডুআল।
বাহঅ কাঅ কাহ্নিল মাআজাল॥
মাঝনদীতে জাল ফেলে মাছ ধরার এই দৃশ্য বুঝিয়ে দেয় ভাত খাওয়ার মতোই বাঙালির মাছ খাওয়ার সংস্কৃতিও সুপ্রাচীন! তার জন্য অবশ্য সে অন্যদের থেকে গালমন্দও খেয়েছে। ডঃ নীহাররঞ্জন রায় বলেছেন, “সুপ্রাচীন কাল হইতেই মৎসভোজী বাঙালীর আহার্য অবাঙালীদের রুচি ও রসনায় খুব শ্রদ্ধেয় ও প্রীতিকর ছিল না।”৯ তাম্বুল বিলাসীরা কর্পূর দিয়ে পান খেতেন, ‘হি অহি মহাসুহে কাপুর তাম্বুল খা-অ।‘
যে অংশ তখন বঙ্গ নামে প্রসিদ্ধ ছিল সেখানে সম্ভবত নিম্নবর্গের দরিদ্র নিচু জাতির বসবাস ছিল। তাই সেই দেশের মেয়ে বিয়ে করা যেমন নিন্দনীয় ছিল তেমনি বিয়ে হলে সম্ভবত জাতিচ্যুত করা হতো। ভুসুকুপা একটি পদে লিখেছিলেন—
বাজনাব পাড়ী পঁউআ খাঁলে বাহিউ
অদব বঙ্গাল দেশ লুড়িউ॥
আজি ভুসুকু বাঙ্গালী ভইলী,
নিঅ ঘরিণী চণ্ডালেঁ লেলী॥
আধুনিক বাংলায় বলা যায়,
“বজ্ররূপ নৌকায় পাড়ি দিয়া পদ্মার খালে বাহিলাম। অদ্বয়রূপ বাঙ্গালা দেশ লুঠ করিলাম। হে ভুসুকু, আজি বাঙ্গালিনী জন্মিলেন। চণ্ডালে (তোমার) নিজ গৃহিনীকে লইয়া গেল।”
এই পদের অর্থ নিয়ে হরপ্রসাদ শাস্ত্রী ও ড. শহীদুল্লার মধ্যে বিরোধ আছে। ভুসুকু আজ বাঙালি হয়ে গেল, যেহেতু এক চণ্ডাল তার ঘরণীকে ‘লিয়ে’ চলে গেছে (লুট করেছে)। ভুসুকুপা কি বাঙালি ছিলেন না? ড. শহীদুল্লা অবশ্য বলেছেন, ভুসুকু বাঙালিই ছিলেন। এই পদ থেকে সেই সময়ের অরাজক সামাজিক অবস্থাও প্রতিফলিত হয়।১০ এই বিষয়ে ড. নীহাররঞ্জন রায় বলেছেন, “যেদিন চণ্ডালীকে নিজের গৃহিণী করিলেন সেদিন তিনি যথার্থ বঙ্গালী হইলেন। অর্থ বোধ হয় এই যে, আগে শুধু জন্মে বঙ্গালী ছিলেন, চণ্ডালীকে যোগসঙ্গিনী করে যথার্থ বাঙ্গালী হইলেন।” চর্যাপদের সময়ে বঙ্গাল দেশের সঙ্গে যুক্ত-বাংলার অন্যান্য অঞ্চলের সম্পর্ক বিষয়ে ড. রায় বলেছেন, “বঙ্গাল দেশের সঙ্গে বোধ হয় তখনও পশ্চিম ও উত্তরবঙ্গের বিবাহাদি সম্পর্ক প্রচলিত ছিল না। তাহা ছাড়া, পশ্চিম ও উত্তরবঙ্গবাসীরা বোধ হয় বঙ্গালবাসীদের খুব প্রীতির চোখেও দেখতেন না। সরহপাদের একটি দোহায় আছে, বঙ্গে জায়া নিলেসি পরে ভাগেল তোহার বিণাণা। অর্থাৎ পূর্ববঙ্গ হইতে লইয়াছিস স্ত্রী, পরে (তাহার ফলে) ভাগিল তোর বিজ্ঞান (তোর বুদ্ধি গেল চলিয়া)।”১১ সম্ভবত ওই অঞ্চলে বাস ছিল সামান্য আন্দামানি শিকারি-সংগ্রাহক এবং মূলত পরবর্তীকালে আগত দ্রাবিড় ও অস্ট্রো এশিয়াটিকদের। তুলনায় কিছুটা পরে ইন্দো-ইউরোপীয় জনগোষ্ঠীর স্বল্প সংখ্যক মানুষ বঙ্গাল দেশে পা ফেলেছে। তাই এক জাতি ঘৃণা অঞ্চল বিশেষে ছিল।
সিদ্ধাচার্যরা আর্যভাষীদের জাতিভেদ প্রথা মানতেন না। তাঁরা বিবাহাদি করেছেন অনার্য নিম্নবর্গীয় জনজাতিদের সঙ্গে। তাই চর্যায় যে জনসমাজের কথা আছে তাতে অনার্য জনগোষ্ঠীর কথা উঠে এসেছে। এদের মধ্যে ডোমেদের প্রধান বৃত্তি ছিল ঝুড়ি, চাঙ্গারি তৈরি করা ও বিক্রি করা। এছাড়া মাদুর বোনা, তাঁতে কাপড় বোনা, মাছ ধরার কথা রয়েছে। দশম পদে কাহ্নপাদ স্ত্রী ডোমকে (ডোম্বি) তাঁত বোনা, চাঙ্গাড়ি বেচা ইত্যাদি করতে বারণ করে বলছেন,
তান্তি বিকণঅ ডোম্বী অবর না চাঙ্গেড়া।
তোহোর অন্তরে ছাড়ি নড়এড়া॥
অর্থাৎ,
“তুই না তাঁত আর চাঙারি বিক্রি করিস, তোর জন্যে আমি নটের ঝাঁপি ত্যাগ করলাম।”
অন্যান্য অন্তজশ্রেণির মধ্যে মাঝিমাল্লা, তাঁতি, শবর, মাহুত, শুঁড়ি, কাপালিক, নট প্রভৃতি সম্প্রদায়ের উল্লেখ আছে। এছাড়াও নৌকা বাওয়া, দুধ দোওয়া প্রভৃতি জীবিকার পরিচয় পাওয়া যায়। সেই সময়ে নিম্নবর্গের মেয়েরা বিভিন্ন পেশায় যুক্ত ছিলেন। মদ তৈরি করা, মদ বেচা, নৌকা পারাপার, শিকার করা, গাছ কাটা ইত্যাদি পেশার পাশাপাশি সাধারণের মনোরঞ্জনের জন্য আয়োজিত নৃত্য, গীত, নাটক ইত্যাদিতে সক্রিয় ভাবে মেয়েরা অংশগ্রহণ করতেন।
এক সে শুন্ডিণী দুই ঘরে সান্ধঅ।
চীঅণ বাকলঅ বারুণি বান্ধঅ॥
“এক শুঁড়িনি দুই ঘরে ঢোকে, সে চিকন বাকল দ্বারা বারুণী (মদ) বাঁধে।”১২
শুঁড়িখানায় অবাধে মদ কেনা বেচা চলত। মদ প্রস্তুত ও বিক্রয়ের স্থান ভিন্ন ছিল এবং শুঁড়িনিরা এই কাজ করতেন। ঘড়ায় সাজিয়ে মদ নিয়ে বসতেন পসারিণী। ঘড়ার মুখে সরু নল লাগিয়ে শোধন করে তৈরি হত উৎকৃষ্ট মদ। ঘরের বাইরে চিহ্ন দেখে গ্রাহক সেখানে প্রবেশ করত। মদের নেশায় খদ্দেরদের হইচই, মারামারির দৃশ্যও উঠে এসেছে এই পদে। এই নিখুঁত বিবরণের ভঙ্গি দেখে বোঝা যায়, সেই সমাজে মদ্যপান অপরাধ বলে গণ্য হত না এবং এক শ্রেণির মানুষের মাদকাসক্তি ছিল।
( ৩ )
চর্যার যুগে পারিবারিক জীবন ছিল একান্নবর্তী। শ্বশুর, শাশুড়ি, ননদ ও পুত্রবধূ সকলকে নিয়ে ছিল বিরাট পরিবার। সংসারে নারীর দুঃখ ও বেদনার প্রসঙ্গ এসেছে চর্যায়। খ্যামনা বা ঢ্যামনা ভাতারীর দুঃখের কথা বলা হচ্ছে নিচের পদে:
হাঁউ নিরাসী খমন ভাতারি।
মোহোর বিগোআ কহণ ন জাই।
এখানে সংসারে স্বামীর উদাসীনতার কথা বলা হচ্ছে। স্বামীর এরকম উদাসীন চিত্ত হলে নারীর কোনো সুখ থাকে না সংসারে। আবার চর্যাপদে মা, শ্বশুর, শাশুড়ী, ননদ ও শালীকে মেরে ফেলার ঘটনাও রয়েছে— এই ঘটনা সত্যি কিনা বলা মুশকিল।
মারি সাসু ননন্দ ঘরে সালী।
মাঅমারি কাহু ভইঅ কবালী॥
এই সময়ে নিম্নবর্গের নারীর স্বাধীনতা ছিল স্বেচ্ছায় সঙ্গী ও পেশা নির্বাচনের। ডোম ও নিচু জাতের মানুষ গ্রামের বাইরে বাস করতেন। উঁচু জাতের ব্রাহ্মণ তাঁদের ছুঁতেন না। নৌকায় করে তাঁরা যাতায়াত করতেন।
উঁচা উঁচা পাবত তঁহি বসই সবরী বালী।
মোরঙ্গি পীচ্ছ পরহিণ সবরী গীবত গুঞ্জরী মালী॥
ণাণা তরুবর মৌলিল রে গঅণত লাগেলি ডালী।
অর্থাৎ, “উঁচু উঁচু পর্বতের বাস করে শবরী বালিকা। তাঁর মাথায় ময়ূরপুচ্ছ, গলায় গুঞ্জার মালা। নানা তরুবর মুকুলিত হলো – তার ডালপালা আকাশ ছুঁয়ে গেল। শবর শবরীর জন্য পাগল কামনার রঙে তাদের হৃদয় জীবন রঙিন ও উত্তাল।”
অনুরূপ দেহানুরাগের অনুভূতি গুণ্ডরীপার একটি পদে পাওয়া যায় –
জোইনি তঁই বিনু ক্ষনহিঁ ন জীবমি।
তো মুহ চুম্বী কোমল রস পীবমি॥
অর্থাৎ “যোগিনী তোমাকে ছাড়া আমার এক মুহূর্তও বাঁচবো না। তোমার মুখ চুম্বন করে আমি কমল রস পান করব।”
তু লো ডোম্বী হাঁউ কপালী।
তোহোর অন্তরে মোএ ঘলিলি হাড়েরি মালী॥
“তুই ডোম্বী আমি কাপালিক, তোর জন্যে আমি হাড়ের মালা নিলাম।”
সমাজের নিচের অংশের নারীর মধ্যে কিছুটা যৌন শিথিলতা ছিল বলে মনে হয়। ডোম্বিরা অনেকে অভিজাত শ্রেণির মনোহরণের পেশায় ছিলেন। তবে ডোমদের প্রধান বৃত্তি ছিল ঝুড়ি, চাঙ্গারি তৈরি করা ও বিক্রি করা। ডোম্বি বা ডোমনী, চণ্ডালী, শুঁড়িনী, শবরী, ধীবরী প্রভৃতি অন্তজ পেশার নারীরা বর্ণ বিভক্ত সমাজে অস্পৃশ্য হলেও ব্রাহ্মণরা আবার তাদের সঙ্গে যৌন সম্পর্ক তৈরি করতেন। তবে তাঁরা সম্ভবত বৌদ্ধ ছিলেন।
নগর বাহিরেঁ ডোম্বি তোহোরি কুড়িআ।
ছই ছোই যাই সো বাহ্ম নাড়িআ॥
আলো ডোম্বি তোএ সম করিবে স সাঙ্গ।
নিঘিণ কাহ্ন কাপালি জোই লাঙ্গ॥
আধুনিক বাংলা ভাষায় তার অর্থ হল, “ওগো ডোম্বি তোমার কুঁড়েখানি নগরের বাইরে। তুমি সে ব্রাহ্মণ নেড়েকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাও। ওগো ডোম্বি আমি তোমাকে সাঙ্গা (বিয়ে) করব। আমি ঘৃণাহীন কানু-কাপালিক, উলঙ্গ যোগী।” এখানে বোঝানো হচ্ছে কানু জাত বাছে না, সে যে নগ্ন কাপালিক। একই পদের শেষাংশ অত্যন্ত আকর্ষণীয়। প্রেম করে বর্ণ প্রথা ভেঙে বিয়ে হয় আবার একই সঙ্গে জেগে থাকে সংশয় ও সন্দেহ।
একসো পদমা চৌষঠ্ঠী পাখুড়ী
তহিঁ চড়ি নাচঅ ডোম্বী বাপুড়ী॥
হালো ডোম্বী তো পুছমি সদভাবে
অইসসি জাসি ডোম্বি কাহরি নাবেঁ॥
“একখানি সে পদ্ম, তাতে চৌষট্টিটা পাপড়ি, তার উপরে ডোমনি নাচে, কী নৃত্য তার, বাপ রে!
ডোমনি, তোরে প্রশ্ন করি, সত্যি ক’রে বল্, কার নায়ে তুই এপার-ওপার করিস চলাচল?”
অবশ্য নিম্ন জাতের বাইরেও এক গৃহবধূর অভিসারের ইঙ্গিত পাওয়া গেছে কুক্করীপা রচিত ২ নং চর্যায়,
দিবসহি বহুড়ী কাউহি ডর ভাই।
রাতি ভইলে কামরু জাই॥
অর্থাৎ, “যে বধূটি দিনের বেলায় কাকের ভয়ে ভীতু হবার ভান করে, রাতের বেলায় সকলের অগোচরে সেই কামরূপ চলে যায়।”
সেই প্রাচীন কালেও বাংলাদেশে বিবাহে বরপক্ষ যৌতুক পেত। ডোম্বিকে বিয়ে করে জাত নষ্ট হইল, অর্থাৎ কুল গেল বটে, তবে ভাল যৌতুক মিলেছে তাতে বর খুশি হয়েছে। কাড়া-নাকাড়া ও ঢাক-ঢোল বাজিয়ে বর-কনেকে বিয়ের আসরে নিয়ে যাওয়া হতো।
জঅ জঅ দুন্দুহি সাদ উচ্ছলিআঁ।
কাহ্ন ডোম্বী বিবাহে চলিআ॥
ডোম্বী বিবাহিআ অহারিউ জাম।
জউতুকে কিঅ আণুতু ধাম॥
অহণিসি সুরঅ পসঙ্গে জাঅ।
জোইণি জালে রএণি পোহাঅ॥
ডোম্বীএর সঙ্গে জো জোই রত্তো।
খণহ ন ছাড়ই সহজ উন্মত্তো॥
বিবাহ এবং দেহাসক্ত প্রেমের চিত্রের বিশদ বর্ণনা আছে এই পদে।
দুন্দুভিতে জয় জয় ধ্বনি উছলিল। কাহ্ন ও ডোমনি বিবাহে চলিল॥
ডোমনিকে বিয়ে করে নবজন্ম হলো। অনুত্তর ধাম যৌতুক দেয়া হলো॥
অহর্নিশি সুরত প্রসঙ্গে যায়। যোগিনী জালে রজনী পোহায়॥
ডোমনির সঙ্গে যে যোগী অনুরক্ত। ক্ষণেক ছাড়ে না সহজে উন্মত্ত।।
গৃহ থাকে প্রেম থাকে, তবু সমাজে আছে চোর-ডাকাত, জলদস্যুর ভয়।
সসুরা নিদ গেল বহুড়ী জাগঅ।
কানেট চৌরে নিল কা গই মাগই॥
“শ্বশুর নিদ্রা গেল, বউড়ি জাগে, কানেট চোর নিল কোথা গিয়ে মাগে।”
সোনা রূঅ মোর কিম্পি ণ থাকিউ
কারো সোনারূপা থাকে না। যদিওবা কিছু থাকে, চোর ডাকাতরা রাতে সামান্য কানের দুলও চুরি করে নিয়ে যায়। তাই ‘সুন বা তথ তা পহারি’ চোর ডাকাতের ভয়ে ঘরে প্রহরী রাখতে হয়। সরহপাদের একটি পদে বলা হচ্ছে, ‘বাট অভঅ খান্টা বি বল আ’ পথঘাটে ডাকাতের ভয়ে ভীত হয়ে পথ চলতে হয়, সাধুবেশী চোরের সংখ্যাই বেশি।
নির্দয় লুঠেরা ডাকাতেরা এসে সব লুট করে নিত, এমনকী ঘরের বৌকেও ধরে নিয়ে যেত। ভোলা যায় না সেই বঙ্গাল ভুসুকুপাদের বৌকে চণ্ডাল দস্যু লুট করে নিয়ে গেল। নিঅ ঘরিণী চণ্ডালেঁ লেলী॥
নারীও লুট হয়ে যেত। যেমন তারা লুট হয়েছে— যুগে যুগে দ্রৌপদী আর ভুসুকু ঘরণীকে পণ্যের মতো ব্যবহার করে পিতৃতন্ত্র।
“সভাঘর ক্ষুব্ধ হল, বৃদ্ধেরা ধিক্কার দিল, ভীষ্ম হতবাক
সেইদিন, আপনারা জানেন, বিদুর এবং গুরু দ্রোণাচার্য
দু’হাত মাথায় দিয়ে চুপচাপ মোহগ্রস্ত বসে রইলেন
খুশি গোপন না করে ধৃতরাষ্ট্র বললেন, কে? জিতল? কে?
পিনপতনের শব্দ শোনা যায়, সভাঘর এমন নীরব
দুই পক্ষ উদগ্রীব। শকুনির পাশা বলে উঠল – জিতেছি”
– মল্লিকা সেনগুপ্ত
তথ্যসূত্র
১. সুকুমার সেন, চর্যাগীতি পদাবলী, আনন্দ সংস্করণ প্রকাশ, সপ্তম মুদ্রণ, (২০১৯): ২০।
২. S.K Chatterjee, The Origin and Development of Bengali Language, Vol. 1, Calcutta, (1926): 112.
৩. অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত, প্রথম খণ্ড, মডার্ণ বুক এজেন্সী প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা, (২০০৬): ১৪৩।
৪. সুকুমার সেন, চর্যাগীতি পদাবলী: ২০।
৫. সুকুমার সেন, চর্যাগীতি পদাবলী: ২০।
৬. নীহাররঞ্জন রায়, বাঙালীর ইতিহাস আদি পর্ব, দে’জ পাবলিশিং, সপ্তদশ সংস্করণ, (১৪২৯): ৭৫৪।
৭. সুকুমার সেন, চর্যাগীতি পদাবলী: ১৩৭।
৮. সুকুমার সেন, চর্যাগীতি পদাবলী: ১২৮।
৯. নীহাররঞ্জন রায়, বাঙালীর ইতিহাস আদি পর্ব, দে’জ পাবলিশিং: ৫৭৮।
১০. রমেনকুমার সর, চর্যাগীতি ও বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ পত্রিকা, নবনির্মাণে চর্যাপদ সম্পাদক সুব্রত রায়চৌধুরী, তথ্যসূত্র, (২০১৫): ১৫০।
১১. নীহাররঞ্জন রায়, বাঙালীর ইতিহাস আদি পর্ব, দে’জ পাবলিশিং: ৬০০।
১২. নীহাররঞ্জন রায়, বাঙালীর ইতিহাস আদি পর্ব, দে’জ পাবলিশিং: ৫৭৭।
দারুণ লাগল!
ধন্যবাদ নেবেন।
আপনার সব লেখাই ভাল লাগে। এটাও লাগল।
ধন্যবাদ সুপ্রিয়।