সূচী

ইতিহাস তথ্য ও তর্ক

মহাপ্রলয়ের চার অশ্বারোহী— ইউরোপে সপ্তদশ শতকের সংকট

মহাপ্রলয়ের চার অশ্বারোহী— ইউরোপে সপ্তদশ শতকের সংকট

অর্কপ্রভ সেনগুপ্ত

আগস্ট ১৭, ২০২৪ ২৭১ 0

‘And I looked, and behold a pale horse: and his name that sat on him was Death, and Hell followed with him. And power was given unto them over the fourth part of the earth, to kill with sword, and with hunger, and with death, and with the beasts of the earth.’— Revelation 6:1-8, King James Bible

সৃষ্টি যেদিন ধ্বংস হয়ে যাবে, সেই দিন কেমন হবে? এর বর্ণনা বিভিন্ন ধর্ম দিয়েছে বিভিন্ন ভাবে। অনেক সময়, এক-ই ধর্মের মধ্যেই পাওয়া যায় এই সৃষ্টি শেষের মহাপ্রলয়ের ভিন্ন ভিন্ন বিবরণ। খ্রিস্ট ধর্মের ঐতিহ্যেও শেষের সে দিন কেমন, তার বিবিধ বর্ণনা মেলে। তবে এর মধ্যে সর্বাপেক্ষা বিখ্যাত প্রলয়ের ভাষ্যের হদিশ সম্ভবতঃ রয়েছে বাইবেলের ‘বুক অফ রিভিলেশন’-এ। বলা হয়েছে প্রলয়কালে ধরায় অবতীর্ণ হবেন চার অশ্বারোহী। এই প্রলয়ের অশ্বারোহীদের পরিচয় কী ও তাঁরা ঠিক কীসের প্রতিক, তা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। তবে সর্বাপেক্ষা প্রচলিত মত অনুসারে এই চার সওয়ার হলেন যথাক্রমে পেস্টিলেন্স বা মহামারী, ওয়ার বা যুদ্ধ, ফেমিন বা দুর্ভিক্ষ এবং সর্বোপরি ডেথ বা মৃত্যুর প্রতীক। ঠিক এই কারণেই, আপনি যদি সপ্তদশ শতকের ইউরোপের বাসিন্দা কোনও ধার্মিক খ্রিস্টান হতেন, তাহলে এ’কথা আপনার মনে হওয়া অতি স্বাভাবিক ছিল যে, মহাপ্রলয়ের কাল সমাগত।

ইউরোপীয় ইতিহাসে সপ্তদশ শতক ছিল এক সংকটের শতক। অধিকাংশ ইউরোপবাসী, বিশেষ করে জার্মানি, স্পেন ও ইতালি মতো দেশগুলির বাসিন্দারা, ভেবেছিলেন পঞ্চদশ আর ষোড়শ শতকের হেন্সিয়াটিক লীগের বাণিজ্যিক সমৃদ্ধি, রেনেসাঁ প্রসূত সামাজিক-বৌদ্ধিক-সাংস্কৃতিক উন্নয়ন এবং সাগরপারের এক নতুন বিশ্ব জয়ের সামরিক গৌরবের দিনগুলি বুঝি অনন্ত। সপ্তদশ শতকের ঝোড়ো সংকট ও ইউরোপ জুড়ে চার অশ্বারোহীর সদর্প পদচারণা তাঁদের এই অনন্ত সুখের আশাকে বদলে দিল, ‘শেষ বিচার’-এর ভীতিতে। রেনেসাঁ প্রসূত যুক্তিবাদ পরিত্যাগ করে অনেকে আবার ভয়কে আঁকড়ে লুটিয়ে পড়লেন ঈশ্বরের চরণে। আধুনিক পাঠকের তাঁদের এই ভীতি কৌতুকপ্রদ মনে হতে পারে, কিন্তু তাঁদের দোষ দেওয়া যায় না। ঈশ্বর যেন সত্যিই সপ্তদশ শতকের ইউরোপে তাঁর চার ভয়ংকর অশ্বারোহীকে যথা ইচ্ছে তথা ভ্রমণের সম্মতি দিয়েছিলেন। এমন নয়, ইউরোপ পূর্বে মহামারী, যুদ্ধ অথবা দুর্ভিক্ষ দেখেনি। বা মৃত্যুর করাল ছায়ার সঙ্গে ইউরোপবাসীর কোনও পরিচয় ছিল না। কিন্তু একত্রে চার অশ্বারোহীর এই তাণ্ডবলীলা সপ্তদশ শতকের ইউরোপের বাসিন্দারা তাঁদের স্মরণের মধ্যে থাকা ইতিহাসে কখনও দেখেননি। বহু বহু বছর পরে, ‘Annales’ ঘরানার ঐতিহাসিকরা তাঁদের এই পর্যবেক্ষণকে যেন স্বীকৃতি দিয়েই বলেছিলেন সপ্তদশ শতকের সংকট আদতে কোনও একটি সংকট নয়, তা বহু সংকটের ‘conjecture’। এই সংকট এমন কতগুলি বিষয়ের একত্রিকরণের ফলে তৈরি হয়েছিল, যারা পৃথক পৃথক ভাবেই ভয়ংকর, কিন্তু একত্রে যেন বিশ্ব ধ্বংসের অগ্রদূত।

চিত্র ১ – মহাপ্রলয়ের চার অশ্বারোহী, ভিক্টর ভাসনেত্‌সভের তুলিতে

প্রকৃতিকে আমরা যদি ‘ঈশ্বর’ বলে মনে করি, একথা স্বীকার করে নিতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা নেই, সপ্তদশ শতকের সংকটের সূচনা এই ঈশ্বরের হাত দিয়েই হয়েছিল। ঐতিহাসিক জিওফ্রে পার্কার তাঁর গ্রন্থ ‘Europe in Crisis’-এ আবহাওয়ার পরিবর্তন সংক্রান্ত কারণকেই সংকটের উৎস বলে চিহ্নিত করেছেন। বর্তমানে অসংখ্য ঐতিহাসিক, আবহাওয়াবিদ ও সৌর পদার্থবিজ্ঞানীরা আবহাওয়ার ব্যাপক পরিবর্তনের মধ্যেই সপ্তদশ শতকের ইউরোপীয় সংকটের দাবানলের প্রথম স্ফুলিঙ্গের সন্ধান খুঁজে পেয়েছেন। তাঁদের মতে এই কালপর্বে বেশ কয়েকটি কারণে সূর্যের বিকরণ হ্রাস পায়। তার ফলে অতিরিক্ত ভেজা এবং ঠান্ডা আবহাওয়া ইউরোপের গ্রীষ্মকালকে গ্রাস করে। এই অবস্থাকে তাঁরা ‘Little Ice Age’ বলে বর্ণনা করেছেন। দীর্ঘকাল সূর্যালোক না থাকার কারণে যে শীতলতর জলবায়ুর ধরণ ইউরোপে দেখা যেতে থাকে, বলাই বাহুল্য, তার প্রভাব ছিল অত্যন্ত ক্ষতিকর। এই ‘প্রকৃতি’-রূপী ঈশ্বরের লীলার ফলেই মুক্ত হল প্রথম মহাপ্রলয়ের অশ্বারোহী— ‘দুর্ভিক্ষ’।  

দুর্ভিক্ষ

আবহাওয়ার পরিবর্তনের ফলে, প্রথমেই যা প্রভাবিত হয়, তা হল ফসলের উৎপাদন। ঐতিহাসিক ফার্নান্দ ব্রদেলের লেখায় আমরা পাই, ইউরোপে, বিশেষ করে ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে, ষোড়শ শতকেও কৃষি ব্যবস্থার চিত্র সুজলা সুফলা ছিল না। জমির উর্বরতার হার অধিক ছিল না, পর্যাপ্ত ছিল না খাদ্য শস্যের উৎপাদনও। বিগত দেড়-শতকের আপাত সমৃদ্ধির ফলে জনসংখ্যা বাড়ছিল দ্রুত গতিতে। পাল্লা দিয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছিল নগরায়ন ও অ-কৃষিজীবী জনতার সংখ্যাও। দক্ষিণ ও মধ্য ইউরোপে সামন্ততান্ত্রিক কৃষি ব্যবস্থা এই বর্ধিত খাদ্য শস্যের চাহিদার সঙ্গে পাল্লা দিতে পারছিল না। এমনকী ফ্রান্স, যার অবস্থা ইউরোপীয় দেশগুলির মধ্যে ছিল অপেক্ষাকৃত ভালো, সেখানেও প্রয়োজনীয় খাদ্য উৎপাদন করতে ভূমির উপর প্রবল চাপের সৃষ্টি হচ্ছিল। এর থেকে নিস্তার পাওয়ার জন্য উন্মুক্ত ছিল দু’টি পথ— কৃষকদের জমি বৃদ্ধি অথবা কৃষিকাজে প্রযুক্তিগত উন্নতির জন্য বিনিয়োগ। জমি বৃদ্ধির বিশেষ কোনও সুযোগ সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থায় কৃষকের ছিল না। ওদিকে আবার রাজা, অভিজাত শ্রেণী এবং চার্চ— এই তিন জাঁতাকলের মাঝে পিষ্ট কৃষকের এমন কোনও উদ্বৃত্তও ছিল না যা দিয়ে সে কৃষির উন্নতির জন্য কিছু বিনিয়োগ করতে পারে। তার উপর অভিজাতদের সবসময়ই নজর থাকতো কিভাবে তাঁদের বিপুল ভু-সম্পদকে সর্বোচ্চ মুনাফার কাজে ব্যবহার করা যায়। এই কারণে অনেক সময় খাদ্যশস্য উৎপাদন না করে আঙুরের মতো অর্থকরী ফসল চাষ করা হতো (ফ্রান্সে), কখনও বা বিশাল জমি পশম শিল্পের নিমিত্ত মেষ পালনের জন্য বরাদ্দ করা হতো (স্পেনে)। যতদিন ক্ষুদ্র তুষারযুগ আসেনি, ততদিন এই পরিস্থিতি বজায় রাখা গেছে।

চিত্র ২ – ক্ষুদ্র তুষার যুগে জমে বরফ হয়ে যাওয়া টেমস্‌ নদী, অ্যাব্রাহ্যাম হন্ডিয়াসের তুলিতে

এমন নয়, কৃষকরা এই শতকের সংকটের আগে দুর্দশার মধ্যে ছিল না। ইউরোপের কিছু দেশ বাদ দিলে সপ্তদশ শতকের সংকটের আগেও তাঁদের দুর্দশার সীমা পরিসীমা ছিল না। এমন এক সরু সুতোর উপর দিয়ে ইউরোপীয় কৃষক শ্রেণী হেঁটে চলেছিলেন, যার নিচে ছিল দুর্ভিক্ষের করাল খাদ, বিন্দুমাত্র ভারসাম্য নষ্ট হলেই যে খাদে তাঁদের পতন ছিল অবধারিত। ক্ষুদ্র তুষারযুগ সেই ভারসাম্যই আদতে নষ্ট করে দেয়। সপ্তদশ শতকের মাঝামাঝি, তৎকালীন ঐতিহাসিক উপাদান থেকে জানা যায়, জার্মানির গ্রামের পর গ্রাম দুর্ভিক্ষের প্রকোপে পরিত্যক্ত। একদা স্প্যানিশ সাম্রাজ্যের হৃৎপিণ্ড, কাস্তিল রাজ্যেও একই পরিস্থিতি। জানা যায়, বিপুল পরিমাণ কৃষিজমি পরিত্যক্ত হয়ে আবার পরিণত হয়েছে ঘাস জমিতে। গুস্তাভ উটারস্টর্ম এই জলবায়ুর প্রভাবে কৃষি ব্যবস্থার ভেঙে পড়া এবং তা থেকে দুর্ভিক্ষজনিত লোকক্ষয়কে গোটা সপ্তদশ শতকের বৈশিষ্ট্য বলে চিহ্নিত করেছেন। বিশেষ করে ১৫৯৬–১৬০৩, ১৬৩০, ১৬৪৯-৫২, ১৬৭৫-৭— এই বছরগুলির দিকে তিনি আলদা ভাবে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন ‘Disaster Years’ হিসেবে।

মহামারী

অশ্বারোহীদের মধ্যে মহামারী হল দুর্ভিক্ষের সহোদর। ইউরোপে মহামারী নতুন কোনও বিষয় অবশ্য নয়। এই মহাদেশ ব্ল্যাক ডেথ বা প্লেগের বিভীষিকা পূর্বেও প্রত্যক্ষ করেছিল। কিন্তু সপ্তদশ শতকে যে প্লেগ এবং স্মল-পক্স (গুটি-বসন্ত)-এর যৌথ মহামারী দেখা দেয়, তা ইউরোপের, বিশেষ করে ভূমধ্যসাগরীয় ইউরোপের চরিত্রই বদলে দেয়। একথা স্মরণে রাখতে হবে, পূর্বে পঞ্চদশ ও ষোড়শ শতকে ইউরোপীয় জ্ঞান-বিজ্ঞান ও সংস্কৃতির অগ্রবর্তী অঞ্চল ছিল রেনেসাঁ-এর পিঠস্থান উত্তর ইতালির ফ্লোরেন্স, ভেনিস, মিলান, জেনোয়ার মতো নগররাষ্ট্রগুলি। অশ্বারোহী মহামারী প্রথম হানা দেয় এই অঞ্চলেই। ১৬৩০-৩১ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ টাস্কানিতে প্লেগের প্রকোপ দেখা দিল এবং খুব দ্রুত ছড়াতে শুরু করল নগর থেকে নগরে। সপ্তদশ শতকের মধ্যভাগে এই মহামারী ছড়িয়ে যায় জেনোয়া, মিলান, নেপলস্‌-এর মতো শহরগুলিতে। মহামারীর ফলে মিলান, নেপলস্‌ বা জেনোয়ার মতো শহরগুলি নিজেদের প্রায় অর্ধেক জনসংখ্যা হারায়। নবজাগরণের মশালরূপী এই শহরগুলির সমৃদ্ধি দ্রুত ধ্বংস হয়ে যায় অশ্বারোহী মহামারীর ক্ষুরের তলায়।

চিত্র ৩ – ঈশ্বরের অভিশাপ— মহামারীর সময় নেপলস্‌কে যেমন দেখেছিলেন শিল্পী মিকো স্পাদারো

সপ্তদশ শতকের ইউরোপে হ্যাপসবার্গ স্পেন ছিল একটি মহাশক্তি। পেরু থেকে ফিলিপাইন পর্যন্ত বিস্তৃত তার বিশাল ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যে সূর্য অস্ত যেতো না। সামরিক বলে, নৌ-শক্তিতে অথবা সাম্রাজ্যের ব্যাপ্তিতে অদ্বিতীয় স্পেন সপ্তদশ শতকের একেবারে সূচনায় প্রবল সংকটের সম্মুখীন হয়। ১৫৯২-১৬০২ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে স্পেনের কাস্তিল ও আন্দুলুসিয়া অঞ্চলে মহামারীতে মৃত্যু হয় ছয় লক্ষ থেকে সাত লক্ষ মানুষের। দ্বিতীয়বার স্পেনে মহামারী তার থাবা বসায় ১৬৪৭-১৬৫২ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ। প্লেগ ও স্মলপক্স ছড়াতে শুরু করে ভূমধ্যসাগর তীরবর্তী স্পেনের সমৃদ্ধিশালী শহরগুলিতে। ভ্যালেন্সিয়া বা বার্সেলোনার মতো বাণিজ্য নগরী শ্মশানে পরিণত হয়। তবে সর্বাপেক্ষা ভয়াবহ প্রভাব দেখা যায় স্পেনের সেভিল শহরে। শুধু স্পেন বা ইউরোপেরই নয়, তৎকালীন পৃথিবীরও অন্যতম সমৃদ্ধিশালী শহর ছিল সেভিল। বিগত দেড় শতকে দক্ষিণ ও মধ্য আমেরিকার স্প্যানিশ সাম্রাজ্য থেকে যে বিপুল সম্পদ ইউরোপে প্রবেশ করেছিল তার সিংহদুয়ার ছিল সেভিল। মহামারীতে একদা সমৃদ্ধ এই নগর মৃত্যুপুরীর রূপ ধারণ করে। শহরের প্রায় দেড়-লক্ষ মানুষ প্রাণ হারান। সমগ্র স্পেনে মৃতের সংখ্যা ছিল আনুমানিক পাঁচ লক্ষ। সপ্তদশ শতকের মহামারীর সংকট কাটিয়ে সেভিল আর কোনও দিনই তার হৃত গৌরব পুনরুদ্ধার করতে পারেনি। এইভাবে একদা মহা শক্তিশালী স্প্যানিশ সাম্রাজ্যের ভিত সপ্তদশ শতকের মহামারীর সংকট ভয়ঙ্কর ভাবে দুর্বল করে দেয়।

মহামারীর প্রভাব ইতালি ও স্পেনে সর্বাপেক্ষা অধিক হলেও, এমন কোনও ইউরোপীয় দেশ ছিল না, যাকে মহামারী স্পর্শ করেনি। মধ্য সপ্তদশ শতকে মহামারী ছড়াতে থাকে জার্মানি, অস্ট্রিয়া, বোহেমিয়া এবং তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলগুলিতেও। ১৬৬৬ খ্রিস্টাব্দে রাইন অববাহিকা অঞ্চলে, ১৬৫০-এর দশকে নেদারল্যান্ডস-এ, ১৬৬৮ খ্রিস্টাব্দে ফ্রান্সে মহামারীর প্রকোপ দেখা যায়। ১৬৬৫-১৬৬৬ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে মহামারী আঘাত হানে লন্ডনে, প্লেগ কবলিত হয়ে মৃত্যু হয় প্রায় এক লক্ষ নরনারীর। ১৬৭৯ খ্রিস্টাব্দে ভিয়েনার প্লেগে মৃত্যু হয় প্রায় ছিয়াত্তর হাজার মানুষের, ১৬৮১ খ্রিস্টাব্দে প্রাগে প্লেগে প্রায় তিরাশি হাজার জন মৃত্যুমুখে পতিত হন। সমগ্র সপ্তদশ শতক ধরে মহামারীর কারণে উত্তর জার্মানির শহরগুলির লোকসংখ্যা হ্রাস পেয়েছিল ব্যপক ভাবে।

যুদ্ধ

সপ্তদশ শতক ছিল ইউরোপে এক প্রবল রাজনৈতিক সংকটের সময়। ইংল্যান্ডের গৃহযুদ্ধ, ফ্রান্সে ফ্রন্ডি বিদ্রোহ, ডাচদের স্প্যানিশদের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা সংগ্রাম— এরূপ বিবিধ রাজনৈতিক সংঘাতের আবর্তে ইউরোপের জনজীবন এই শতকে বিধ্বস্ত হয়েছে বারংবার। তবে এই সংকটগুলির মধ্যে সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ নিঃসন্দেহে ছিল ত্রিশ বৎসরের যুদ্ধ (খ্রি: ১৬১৮ – ১৬৪৮ )। জোসেফ পলিসেন্সকির মতো ঐতিহাসিকের মতে এই যুদ্ধ ছিল সপ্তদশ শতকের ‘সাধারণ সংকট’-এর ইমারতের একটি অতীব গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ।

ত্রিশ বৎসরের যুদ্ধের উৎস ছিল পবিত্র রোমান সাম্রাজ্যের মধ্যে উপস্থিত ক্যাথলিক ও প্রোটেস্ট্যান্ট ধর্মীয় বিবাদের মধ্যে। ‘রিফর্মেশন’ সঞ্জাত বিগত শতকের এই বিবাদের সমাধানের প্রচেষ্টা চলছিল দীর্ঘদিন ধরে। আশা করা হয়েছিল, ১৫৫৫ খ্রিস্টাব্দে ‘অগসবার্গের সন্ধি’-র মাধ্যমে এই বিবাদের ইতি টানা সম্ভব হবে। দীর্ঘকাল পবিত্র রোমান সাম্রাজ্যের ক্যাথলিক হ্যাবসবার্গ সম্রাটরা অগসবার্গের স্থিতাবস্থা বজায় রেখেছিলেন ও সাম্রাজ্যের অ-ক্যাথলিক শাসক এবং প্রজাদের ধর্মে হস্তক্ষেপ করা থেকে বিরত ছিলেন। কিন্তু উগ্র ক্যাথলিক দ্বিতীয় ফার্দিনান্দ পবিত্র রোমান সাম্রাজ্যের সম্রাট পদে অধিষ্ঠিত হয়েই মধ্য-ইউরোপে পুনরায় ক্যাথলিক ধর্মের প্রভাবে ফিরিয়ে আনতে সচেষ্ট হন। ফলে স্বাভাবিক ভাবেই সৃষ্টি হয় যুদ্ধ পরিস্থিতি। ফার্দিনান্দ ১৬১৭ খ্রিস্টাব্দে বোহেমিয়ার শাসক নিযুক্ত হয়েছিলেন। বোহেমিয়ায় প্রোটেস্ট্যান্ট ধর্মের মানুষই ছিলেন সংখ্যাগুরু। অভিজাতরাও তাই। যদিও ফার্দিনান্দ প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তিনি প্রজার ধর্মে হস্তক্ষেপ করবেন না, তাঁর এই প্রতিশ্রুতি কারোর কাছেই বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়নি। ১৬১৮ খ্রিস্টাব্দে কাউন্ট থ্রুনের নেতৃত্বে বোহেমিয়ার অভিজাতরা তাই ফার্দিনান্দের প্রতিনিধিদের বিতাড়িত করে ও বোহেমিয়ার রাজমুকুট প্যালেটাইনের শাসক ও প্রোটেস্ট্যান্ট রাজা ফ্রেডরিকের হাতে তুলে দেয়। এই অপমান সম্রাট ফার্দিনান্দের পক্ষে মেনে নেওয়া সম্ভব ছিল না। তাঁর এবং রাজা ফ্রেডরিকের মধ্যে যে সংগ্রাম শুরু হয় তাতে প্রথমে জার্মানির ক্যাথলিক ও প্রোটেস্ট্যান্ট রাজ্য সমূহ এবং ক্রমে ক্রমে ইউরোপের প্রায় সমস্ত প্রধান শক্তি জড়িয়ে পড়ে।

চিত্র ৪ – রক্তাক্ত রণক্ষেত্র, সেবাস্তিয়ান ভ্রান্সের দৃষ্টিতে ত্রিশ বর্ষীয় যুদ্ধ

এই যুদ্ধের মূলতঃ চারটি পর্যায় দেখা যায়— বোহেমিয়ান যুগ (১৬১৮-২৩), ড্যানিশ যুগ (১৬২৫-২৯), সুইডিশ যুগ (১৬২৯-৩২), ফরাসী যুগ (১৬৩৫-৪৮)। এর মধ্যে বোহেমিয়ান এবং ড্যানিশ যুগে সংঘাত মূলতঃ পবিত্র রোমান সাম্রাজ্যের মধ্যে অবস্থিত বিবিধ শক্তিগুলির মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। এই পর্যায়ে ফার্দিনান্দের নেতৃত্বাধীন জার্মান ক্যাথলিক গোষ্ঠীই একের পর এক বিজয় লাভ করে। এর ফলে ইউরোপের সকল শক্তি, এমনকি ক্যাথলিক ফ্রান্সও শঙ্কিত হয়। পবিত্র রোমান সাম্রাজ্য যতদিন ক্যাথলিক-প্রোটেস্ট্যান্ট দ্বন্দ্বের মধ্যে রয়েছে এবং যতদিন সেখানে সম্রাটের ক্ষমতা প্রিন্সদের দ্বারা সীমাবদ্ধ ততদিন ভীতির কিছু ছিল না। কিন্তু ফার্দিনান্দের নেতৃত্বে একটি কেন্দ্রীভূত শাসনকাঠামো গঠিত হলে এবং তাতে ক্যাথলিক ধর্মের বিজয়ের দ্বারা ধর্মীয় সংকটের অবসান হলে যে জার্মান সাম্রাজ্য আত্মপ্রকাশ করত, তা ইউরোপের শক্তিসাম্য বদলে দিত। ইংল্যান্ড ও ফ্রান্স, দুই দেশ-ই এর ফলে জার্মানির বাইরের প্রোটেস্ট্যান্ট শক্তি সমূহকে মদত দিতে শুরু করে। সুইডেনের রাজা গুস্তাভ এডলফাস্‌ এই দুই শক্তির অর্থনৈতিক ও সামরিক মদতে বলীয়ান হয়ে প্রোটেস্ট্যান্টদের রক্ষা করতে যুদ্ধে অবতীর্ণ হন। তিনি একের পর এক যুদ্ধে জয়লাভ করে যুদ্ধের গতি প্রোটেস্ট্যান্টদের পক্ষে ঘুরিয়ে দেন। কিন্তু ভাগ্যের পরিহাসে ১৬৩২ খ্রিস্টাব্দে লুটজেনের যুদ্ধে গুস্তাভ বিজয় লাভ করেও যুদ্ধক্ষেত্রে নিহত হন। এর ফলে দ্বন্দ্বের পরিসমাপ্তি হয় না।

ফ্রান্স এই পর্যায়ে যুদ্ধে প্রত্যক্ষ ভাবে প্রবেশ করে। ফ্রান্সের প্রধানমন্ত্রী কার্ডিনাল রিচল্যু নিজে ক্যাথলিক কার্ডিনাল হলেও রাষ্ট্রের স্বার্থে জার্মানিতে ক্যাথলিক বিজয় চাননি। দীর্ঘকাল যুদ্ধ করে ক্লান্ত ক্যাথলিক পক্ষ প্রোটেস্ট্যান্টদের স্বপক্ষে ফ্রান্সের এই হস্তক্ষেপ সামলাতে পারেনি। তেরো বছর যুদ্ধের পর ওয়েস্টফালিয়ার সন্ধির মাধ্যমে এই সুদীর্ঘ যুদ্ধের অবসান হয় এবং মোটের উপর পবিত্র রোমান সাম্রাজ্যে যুদ্ধ পূর্ববর্তী স্থিতাবস্থাই পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়। ইউরোপে নতুন শক্তি হিসেবে উত্থান হয় ফ্রান্সের। সুইডেনও একটি প্রথম শ্রেণীর ইউরোপীয় শক্তি হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়।

সপ্তদশ শতকের যে ‘সাধারণ বিপর্যয়’, তার অংশ হিসেবে ত্রিশ বৎসরের যুদ্ধের স্থান অত্যন্ত উচ্চে। প্রায় তিন দশক ধরে জার্মানির বিস্তীর্ণ অঞ্চল রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। বোহেমিয়া রাজ্য যুদ্ধের পূর্বে শুধু জার্মানির নয়, ইউরোপের অন্যতম সমৃদ্ধিশালী অঞ্চল ছিল। যুদ্ধের পরে ব্যপক লোকক্ষয়ের ফলে সেই সমৃদ্ধির অবসান ঘটে। উত্তর জার্মানির প্রোটেস্ট্যান্ট অধ্যুষিত শহরগুলি, যেগুলি উত্তর-সাগর এবং বাল্টিক সাগরের বাণিজ্যের ক্ষেত্রে চিরকাল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এসেছে, এই যুদ্ধে তারাও ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বিদেশী সেনাবাহিনী গ্রামের পর গ্রাম লুঠ করে, ফসলে অগ্নিসংযোগ করে। বাণিজ্যপথগুলি বিপদসংকুল হয়ে পড়ার ফলে জার্মানির বিভিন্ন অঞ্চলের মধ্যে পণ্যের আদানপ্রদানও বন্ধ হয়ে যায়। তিন দশকে শুধু যুদ্ধের ফলেই লোকক্ষয়ের পরিমাণ ছিল ১৩ লক্ষ থেকে ১৮ লক্ষ। পিত্রিম সোরোকিনের হিসেব যদি আমরা মেনে নিই, এই সংখ্যা ২০ লক্ষও হতে পারে। সপ্তদশ শতকের শুরুতে পবিত্র রোমান সাম্রাজ্যের জনসংখ্যা ছিল আনুমানিক ২০ লক্ষ। ১৬৫০ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ এই জনসংখ্যা কমে দাঁড়ায় ১১ লক্ষে। পূর্বের জনসংখ্যার স্তরে পৌঁছতে জার্মানিকে অপেক্ষা করতে হয়েছিল আরও একশত বছর। ঐতিহাসিক গুন্থার ফ্রাঞ্জ দেখিয়েছেন ১৬১৮ থেকে ১৬৪৮-এর মধ্যে জার্মানির গ্রামীণ জনসংখ্যা প্রায় ৪০ শতাংশ হ্রাস পায় আর শহরে জনসংখ্যা হ্রাসের পরিমাণ ছিল প্রায় ৩৩ শতাংশ। প্রত্যক্ষ যুদ্ধ ভয়াবহ তো ছিলই, তার থেকেও এই উচ্চ মৃত্যুহারের কারণ ছিল যুদ্ধের ফলে সৃষ্ট মহামারী ও দুর্ভিক্ষ। এই বিপর্যয় কোন স্তরের ছিল, তার আভাস যুদ্ধরত সেনাদের অনেকেরই রোচনামচায় পাওয়া যায়। তাঁরা লিখেছেন, একদা যে সকল অঞ্চল ছবির মতো সুন্দর গ্রাম ছিল, তা পতিত জঙ্গলে পরিণত হয়েছে। হাহুতাশ করেছেন এই বলে, যে সব অঞ্চল একদা মানুষের কোলাহলে পরিপূর্ণ জনপদ ছিল, সেখানে আজ হিংস্র নেকড়ের আবাস।  

মৃত্যু

আগেই বলা হয়েছে, মৃত্যুর সঙ্গে ইউরোপ অপরিচিত ছিল না। কিন্তু সপ্তদশ শতকের দুর্ভিক্ষ, মহামারী ও যুদ্ধ এই তিন অশ্বারোহীর দাপটে তাদের নেতা সাদা ঘোড়ার সওয়ার মৃত্যু ইউরোপের মানুষের নিত্যসঙ্গী হয়ে দাঁড়ায়। ব্যাপক লোকক্ষয় থেকে তৎকালীন ইউরোপে জন্ম নেয় এক নতুন সংকট। এই সংকট হল জনসংখ্যার সংকট বা ডেমোগ্রাফিক ক্রাইসিস।

চিত্র ৫ – অশ্বারোহী মৃত্যু, শিল্পী স্তেফানো দেলা বেল্লার কল্পনায়

পূর্ববর্তী ষোড়শ শতক ছিল জনসংখ্যার দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে প্রাচুর্যের এক যুগ। ক্রমাগত যুদ্ধবিগ্রহ, মহামারী ও দুর্ভিক্ষ সপ্তদশ শতকে এই প্রাচুর্যের অবসান ঘটায়। জার্মানিতে পূর্বকথিত ত্রিশ বর্ষীয় যুদ্ধ এবং তার পরিণামে সৃষ্ট দুর্ভিক্ষ ও মহামারী সেই দেশের প্রায় অর্ধেক জনসংখ্যার ঘাটতির জন্য দায়ী ছিল। ১৬১১ খ্রিস্টাব্দে সুইডেন ও ডেনমার্কের যুদ্ধ, ইংল্যান্ড ও হল্যান্ডের যুদ্ধ, স্পেন ও ফ্রান্সের যুদ্ধের ফলেও জনসংখ্যা হ্রাস পায়। এই শতকের বৈশিষ্ট্যই ছিল চরম রাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলির প্রাধান্য রক্ষার্থে প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হওয়া। এই প্রায় বিরামহীন যুদ্ধ থেকে জন্ম নেয় একের পর এক রাজনৈতিক সংকট। প্লেগ ও গুটি বসন্ত স্পেন ও ইতালির একদা সমৃদ্ধিশালী অঞ্চলগুলিকে শ্মশানে পরিণত করে। ১৬০০-৫০ এই অর্ধশতকে ইতালির জনসংখ্যা ১৩.৩ মিলিয়ন (১ মিলিয়ন = ১০ লক্ষ) থেকে ১১.৫ মিলিয়নে নেমে এসেছিল। ১৫৯২-১৬৫০-এর মধ্যে স্পেনের জনসংখ্যা নেমে আসে ৭.৭ মিলিয়নের নিচে। ফ্রান্সের জনসংখ্যা কুড়ি শতাংশ হ্রাস পায়, এর মূল কারণ ছিল গৃহযুদ্ধ এবং জমির উপর প্রবল চাপ বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে দুর্ভিক্ষ পরিস্থিতি।

তবে এই জনসংখ্যা হ্রাসের সমস্যা ইউরোপে সর্বোত্র সমান ভাবে দেখা যায় নি। জঁ দ্য-ভ্রিস জনসংখ্যার আঞ্চলিক বিশ্লেষণ করতে সমগ্র ইউরোপকে তিনটি ভাগে ভাগ করেছেন—

১) ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চল, যেখানে স্পেন, পর্তুগাল, ইতালি ইত্যাদি দেশসমূহ, যেখানে ব্যাপক লোকক্ষয় হয় এবং যে ঘটতি পূরণ করতে তাদের সময় লাগে আরও এক শতক,

২) মধ্য অঞ্চল, ফ্রান্স, জার্মানি, অস্ট্রিয়া, সুইজারল্যান্ড, যেখানে লোকক্ষয়ের পরিমাণ খুব গুরুতর ছিল না (উত্তর জার্মানি ও বোহেমিয়া ব্যতিক্রম) এবং কোন কোন অঞ্চলে এমনকি সামান্য হলেও কিছু বৃদ্ধিও দেখা গিয়েছিল (উদাহরণ স্বরূপ – ফ্রান্স),

৩) উত্তরাঞ্চল, ইংল্যান্ড, নেদারল্যান্ড ও স্ক্যান্ডেনেভিয়ার দেশসমূহ যার অন্তর্ভুক্ত ছিল। ষোড়শ শতকের মতো না হলেও এই দেশগুলির জনসংখ্যা সপ্তদশ শতকেও বৃদ্ধি পেয়েছিল। বলা যেতে পারে সপ্তদশ শতকের সংকটগুলির মধ্যে অন্ততঃ জনসংখ্যার সংকট এই দেশগুলিকে স্পর্শ করেনি।

পিটার ক্রেইটের মতে এই সংকট ছিল একই সঙ্গে একটি ম্যালথুসীয় ও সামাজিক সংকট। ষোড়শ শতকে ইউরোপে জনসংখ্যার দ্রুত বৃদ্ধি কৃষি ব্যবস্থার উপর চাপ সৃষ্টি করে। টমাস ম্যালথাস যুক্তি দিয়েছিলেন জনসংখ্যার যে বৃদ্ধি তা নির্ভরশীল সেই জনসংখ্যাকে সমর্থন করতে পারে এমন প্রাকৃতিক সম্পদের উপর। প্রাকৃতিক সম্পদ সমর্থন করতে পারে যে পরিমাণ জনসংখ্যা তার থেকে যদি তা বেশি হয়ে যায় তাহলে দুর্ভিক্ষ ও মহামারি হানা দেয়। ব্যাপক লোকক্ষয় হয় এবং প্রকৃতি নিজেই এইভাবে সম্পদ ও জনসংখ্যার ভারসাম্য এইভাবে সংশোধন করে দেয়। তাঁদের মতে সপ্তদশ শতকের জনসংখ্যার সংকট ছিল এই ভারসাম্য রক্ষায় প্রকৃতির হস্তক্ষেপেরই বহিঃপ্রকাশ। দীর্ঘকাল ধরে রাজনৈতিক সংকটকেই ঐতিহাসিকরা জনসংখ্যা সংকটের প্রধান কারণ হিসেবে দায়ী করে এসেছিলেন। রাজনৈতিক সংকটের ভূমিকা ছিল, একথাও সত্যি। কিন্তু বর্তমানে ক্ষুদ্র তুষারযুগ উদ্ভূত খাদ্য সংকট এবং প্লেগ ও গুটিবসন্তের মহামারীর ভূমিকাকে সপ্তদশ শতকের সংকটের প্রেক্ষিতে অধিক গুরুত্ব দিয়ে ঐতিহাসিকরা দেখছেন। সেই প্রেক্ষিতে জন-সংকটের এই ম্যালথুসিয় ব্যাখ্যা সম্পূর্ণ অবান্তর এমন হয়তো বলা চলে না। একদিক দিয়ে, এই সময়ের ধর্মপ্রাণ মানুষেরা সপ্তদশ শতকের এই ‘সাধারণ সংকট’-কে যে ঈশ্বর প্রদত্ত শাস্তি হিসেবে দেখেছিলেন, তার কিছু ভিত্তি ছিল। বিগত শতকে সমৃদ্ধির কারণে জনসংখ্যা বৃদ্ধি হয়েছিল দ্রুত হারে। এই অস্বাভাবিক বৃদ্ধির ফলে, বিঘ্নিত হয়েছিল প্রাকৃতিক ভারসাম্য। সপ্তদশ শতকের সংকট ছিল প্রকৃতির দাঁড়িপাল্লায় আবার ভারসাম্য আনার প্রচেষ্টা। সেই নিমিত্তেই তার অঙ্গুলিহেলনে মুক্ত হয়েছিল মহাপ্রলয়ের চার অশ্বারোহী। অবশ্যই এই মতের গুরুতর বিরোধ রয়েছে ঐতিহাসিকদের মধ্যে থেকেই। এই ক্ষুদ্র প্রবন্ধে সেই আলোচনাগুলি ধরা সম্ভব নয়। সম্ভব নয় সংকটের নানা খুঁটিনাটি দিকের বিস্তারিত আলোচনাও। তবুও, এই ক্ষুদ্র পরিসরে এক অদ্ভুত উত্তাল শতকের আলোচনা যদি পাঠকদের এই বিষয়ে আরও বিস্তারিত পাঠে উৎসাহিত করে, তাহলেই এই নিবন্ধ সার্থক মনে করব।

প্রচ্ছদ চিত্র পরিচিতি – হেনড্রিক অ্যাভারক্যাম্পের আঁকা শীতকালীন ল্যান্ডস্কেপ (১৬০৮)। অ্যাভারক্যাম্প মূক ও বধির ছিলেন। সৌজন্যে রিজক্স মিউজিয়াম, আমস্টারডাম

তথ্যসূত্র

  • Sinha, Arvind. “Europe in Transition from Feudalism to Industrialization.” Manohar, 2016
  • Parker, Geoffrey & Snith, Leslie M. (Edited). “The General Crisis of the Seventeenth Century.” Routledge, 2005
  • Parker, Geoffrey. “Europe in crisis, 1598-1648.” Wiley, 1979
  • Trevor-Roper, Hugh Redwald. “The Crisis of the Seventeenth Century.” Harper & Row, 1968
  • Parker, Geoffrey. “Global Crisis – War, Climate Change, & Catastrophe in the Seventeenth Century.” Yale University Press, 2013
এম.ফিল গবেষক, ইতিহাস বিভাগ, রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়।

মন্তব্য করুন

আপনার ইমেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।