সূচী

ইতিহাস তথ্য ও তর্ক

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, আশুতোষ মুখোপাধ্যায় ও মৈমনসিংহ গীতিকা— প্রথম পর্ব

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, আশুতোষ মুখোপাধ্যায় ও মৈমনসিংহ গীতিকা— প্রথম পর্ব

লিপিকা ঘোষ

আগস্ট ১০, ২০২৪ ২০৪ 1

দীনেশচন্দ্র সেন সম্পাদিত শতবর্ষ পুরোনো মৈমনসিংহ গীতিকা প্রকাশিত হয়েছিল কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। এই সময় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের সম্পর্ক ছিল নিবিড়, যা ছিল ঐতিহাসিকও। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তার বছর চল্লিশের ‘শৈশবকালে’ আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের মতো অভিভাবকের হাতে এসে পড়েছিল। তাঁর বুদ্ধিমত্তা, কর্মোদ্যম, শিক্ষাসচেতনতা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়কে অতি দ্রুত দেশের শ্রেষ্ঠ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সম্মান এনে দিয়েছিল। প্রচলিত ধারণাকে নস্যাৎ করে দেওয়ার মতো বাংলা সমাজ জীবনের দলিল মৈমনসিংহ গীতিকার প্রকাশ আর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা স্নাতকোত্তর বিভাগের ঐতিহাসিক দ্বারোদ্ঘাটন প্রায় সমসাময়িক ঘটনা।

দীনেশচন্দ্র সেনের উদ্যোগে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘গর্ভগৃহ’ থেকে প্রত্যন্ত গ্রামের নিম্নবিত্ত মানুষের জীবন বৃত্তান্ত-মূলক দশটি গাথা বা পালাগান মৈমনসিংহ গীতিকা নামে প্রকাশিত হয়েছিল ১৯২৩ সালের শেষে, ছেষট্টি বছরের কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তখন বেশ পরিণত। এমনিতেই কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের অবদান ছিল আশ্চর্য হওয়ার মতো, বিশেষ করে বিংশ শতাব্দীর প্রথম থেকে মৈমনসিংহ গীতিকার প্রকাশকাল পর্যন্ত তো বটেই! কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা, সিনেট-সিন্ডিকেটে আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের আগমন, কলা ও বিজ্ঞান বিভাগের সভাপতি হওয়া, তাঁর উপাচার্য হওয়া, দীনেশচন্দ্র সেনের আগমন, বাংলা বিভাগ চালু হওয়া ও সেই বাংলা বিভাগকে সাজাতে অন্যান্য গ্রন্থ রচনা, গ্রন্থ আবিষ্কার ও প্রকাশের সঙ্গে মৈমনসিংহ গীতিকারও আত্মপ্রকাশ বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে আশুতোষ মুখোপাধ্যায় ও দীনেশচন্দ্র সেনের মেলবন্ধন শুধু বিশ্ববিদ্যালয় ও তার বাংলা বিভাগকেই নয়, বাংলার ভাষা ও সাহিত্যচর্চার রাস্তাকে চওড়া করেছিল অনেকখানি, যার ওপর দিয়ে পরবর্তীকালে বাঙালি এগিয়ে চলতে পেরেছে। 

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়

১৮৫৪ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কম্পানির কোর্ট অফ ডিরেক্টরসের পক্ষ থেকে ভারতের গভর্নর জেনারেলের কাছে একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। অনেক পরিকল্পনা করে শেষপর্যন্ত ১৮৫৭ সালে, সিপাহী বিদ্রোহের বছরে, ব্যারাকপুরে মঙ্গল পাণ্ডে গর্জে ওঠার মাত্র কয়েকমাস আগে ২৪ জানুয়ারি ব্রিটিশ সরকার লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের আদর্শে তারা এই বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে মূলত তাদের প্রয়োজনে কিছু সস্তা কেরানি পাওয়ার জন্য। ভারতীয়দের সার্বিক শিক্ষা দেওয়া তাদের পরিকল্পনায় ছিল না।

কলকাতা তখন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের দ্বিতীয় বৃহত্তম নগরী ও ভারতের রাজধানী। তাই একে গুরুত্ব দিতে ভারতের বড়লাট পদাধিকার বলে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর বা আচার্য হতেন। কিন্তু ভারতের অন্যান্য প্রদেশে অবস্থিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে প্রাদেশিক গভর্নরই সেখানকার বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর হতেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম সিনেট গঠিত হয়েছিল ঊনচল্লিশ জন বিশিষ্ট ব্যক্তি নিয়ে যারা প্রশাসন, শিক্ষা, বিচার, ও সামরিক বিভাগের সঙ্গে যুক্ত, সেই সঙ্গে ছিলেন মিশনারিরাও। ফেলো বা প্রতিষ্ঠাতা-সদস্যদের মধ্যে মাত্র ছ’ জন ছিলেন ভারতীয়— ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, প্রসন্নকুমার ঠাকুর, রামগোপাল ঘোষ, রমাপ্রসাদ রায়, মৌলবী মুহম্মদ ওয়াজি ও প্রিন্স গোলাম মহম্মদ। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ভাইস চ্যান্সেলর বা উপাচার্য ছিলেন তত্কালীন সুপ্রীম কোর্টের প্রধান বিচারপতি জেমস উইলিয়াম কলভিল।

শুরুতে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব কোনো ভবন না থাকায় ক্যামাক স্ট্রিটের এক বেসরকারি বাড়িতে একজন কেরানি নিয়ে রেজিস্টারের অফিস ছিল। ভাইস চ্যান্সেলরের বাড়িতে বসত সিন্ডিকেটের সভা আর টাউন হলে সেনেটের সভা। ফ্যাকাল্টির সভা বসত সভাপতির বাড়িতে। কাজের প্রয়োজনে ১৮৬২ সালে সিনেট হাউস তৈরির পরিকল্পনা করা হলে ১৮৭২ সালের ১২ মার্চ মাসে কলেজ স্ট্রিটের কাছে সুন্দর একটি ভবন তৈরি হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের একশ বছর পূর্তির সময় সিনেট হাউসকে ভেঙ্গে ফেলা হয়, সেখানে তৈরি হয় শতবার্ষিকী ভবন। তার আগে, বিগত শতাব্দির প্রথমেই দারভাঙ্গার মহারাজার অনুদানে মহারাজা রামেশ্বর সিং লাইব্রেরি ও দারভাঙ্গা ভবন তৈরি হয়েছে। দ্বিতীয় দশকে তৈরি হয়েছে কলুটোলা স্ট্রিটের গায়ে মাধববাবুর বাজারের মেছোহাটায় স্নাতোকোত্তর বিভাগের পঠনপাঠনের জন্য ভবন।

জন্মলগ্নে রেঙ্গুন থেকে পেশোয়া পর্যন্ত কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক্তিয়ার হলেও এর অধীনে সরকারি কলেজ ছিল মাত্র সাতটি আর মিশনারী কলেজ ছিল ছ’টি। বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ বলতে ছিল মূলত উচ্চতম শিক্ষার পঠনপাঠন নিয়ন্ত্রণ, পরীক্ষাগ্রহণ আর ডিগ্রি বিতরণ করা— বলা যায় প্রতিষ্ঠানের পরীক্ষা সংক্রান্ত আইনকানুন, পরীক্ষার্থীদের নাম, ঠিকানা, সংখ্যা, কোন নতুন কলেজ থেকে কোন পরীক্ষা দেওয়া হল তার তালিকা তৈরি করা, প্রশ্নপত্র তৈরি করা, পাশের তালিকা তৈরি করা, ইত্যাদি পরীক্ষা সংক্রান্ত যাবতীয় কাজকর্ম করা হতো। সিনেট-সিন্ডিকেটে এই সংক্রান্ত আলোচনা হতো।

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রথম এন্ট্রান্স পরীক্ষা নেওয়া হয়েছিল টাউন হলে ১৮৫৭ সালের ৬ এপ্রিল। প্রথম বছর পরীক্ষায় বসেছিলেন ২৪৪ জন পরীক্ষার্থী। পরীক্ষার ফল প্রকাশ হয়েছিল ২২ দিন পর, ২ মে। এন্ট্রান্স পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে পাশ করেছিলেন যাঁরা তাঁদের মধ্যে অন্যতম বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। যাঁরা এন্ট্রান্স পাশ করেছিলেন পরের বছর ৫ এপ্রিল তাঁদের পরীক্ষায় বসার অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। মোট তেরো জন পরীক্ষায় বসতে চেয়েও শেষপর্যন্ত মাত্র এগারো জন প্রথম বি.এ পরীক্ষায় বসেছিলেন, মোট ছ’টি বিষয়ে পরীক্ষা দিয়ে পাশ করেছিলেন দু’জন। বলা বাহুল্য তাঁদের মধ্যে একজন ছিলেন বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ও অন্যজন যদুনাথ বোস। তাঁরা ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম গ্র্যাজুয়েট।

১৮৬৮ সাল থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শ্রেষ্ঠ ছাত্রদের মধ্যে বিখ্যাত প্রেমচাঁদ-রায়চাঁদ স্কলারশিপ দেওয়া ও ১৮৭০ সাল থেকে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘ঠাকুর আইন অধ্যাপনা ও লেকচারশিপ’-এর আয়োজন করা হয়েছিল। তখন বিদেশ থেকে বিখ্যাত ও বিশিষ্ট আইনজীবীরা এসে ‘ঠাকুর বক্তৃতামালা’তে অংশ নিতেন। এছাড়াও তখন ‘ঈশান স্কলারশিপ’ ও গ্রিফিথ মেমোরিয়াল পুরস্কারও দেওয়া শুরু হল। পরে দেওয়া শুরু হল ‘রামতনু লাহিড়ী স্বর্ণপদক ও ফেলোশিপ’এর টাকা। ১৮৮২ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের পঁচিশ বছর পূর্তি উপলক্ষে লাহোর, পাতিয়ালা, সিমলা, দিল্লি, অমৃতসর, ইন্দোর, আগ্রা, আজমির, জয়পুর, কটক, ঢাকা, গুয়াহাটি, রেঙ্গুন, সিংহল ও বার্মাকে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক্তিয়ারভুক্ত করা হয়।

১৮৯০ সালে প্রথম ভারতীয় উপাচার্য হয়ে এলেন গুরুদাস বন্দ্যোপাদ্যায়। প্রথমদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ে মাতৃভাষায় পঠনপাঠন বিষয়টি উপেক্ষিত থাকলেও ১৮৯১ সালে বার্ষিক সমাবর্তন বক্তৃতায় উপাচার্য গুরুদাস বন্দ্যোপাধ্যায় (১৮৯১-৯২) উচ্চশিক্ষায় দেশীয় ভাষার প্রসঙ্গটি নিয়ে বক্তব্য রাখলেন। ১৮৯১ সালের ২৪ জানুয়ারি তিনি ভাষণে জানালেন,

“I also deem it not merely desirable, but necessary, that we should encourage the study of those Indian vernaculars that have a literature, by making them compulsory subjects of our examinations in conjunction with their kindred classical languages. The Bengali Language has now a rich literature that is well worthy of study, and Urdu and Hindi are also progressing fairly in the same direction.” (Convocation Addresses 1858-1906, page 357) [আমি মনে করি, যেসব ভারতীয় ভাষার নিজস্ব সাহিত্য আছে, তাদের পঠনপাঠন শুধু কাঙ্ক্ষিতই নয় প্রয়োজনীয়ও বটে। বাংলায় এখন একটি সম্পদশালী সাহিত্য বর্তমান যা পাঠ্য হওয়ার উপযোগী এবং হিন্দি ও উর্দুও সেই পথেই এগোচ্ছে। (অনুবাদ সম্পাদকের)]

তত্কালীন সিন্ডিকেটের সদস্য আশুতোষ মুখোপাধ্যায় বিষয়টিকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়েছিলেন এবং বিষয়টি নিয়ে বিশেষভাবে তত্পর হয়ে উঠেছিলেন। বিষয়টিকে নিয়ে কয়েকটি প্রস্তাব গঠন করে ঐ বছর তিনি ১ মার্চ রেজিস্টারকে চিঠি পাঠিয়েছিলেন। সেই চিঠির মাধ্যমে এফ. এ., বি. এ. এবং এম. এ. পরীক্ষায় বাংলা, হিন্দি ও উর্দু ভাষাকে আবশ্যিক করার প্রস্তাব রাখলেন। তবে প্রস্তাবটি সিন্ডিকেট যাবার আগে ১১ জুলাই আর্টস ফ্যাকাল্টিতে যায়। সেখানে চরম বাদ-বিবাদের মাধ্যমে বাংলা ভাষাকে অপমান করা হলে আশুতোষ মুখোপাধ্যায় বাংলা ভাষার পক্ষে একঘন্টার একটি বক্তৃতা দিয়েছিলেন। তবু শেষরক্ষা হয়নি। ১১—১৭ ভোটে আশুতোষ মুখোপাধ্যায় হেরে যান। সেদিন আনন্দমোহন বসু, উমেশচন্দ্র দত্ত, চন্দ্রনাথ বসু, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, মহেন্দ্রনাথ রায়, রেভারেন্ড কে এস ম্যাকডোনাল্ড, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী প্রমুখ তাঁকে সমর্থন করলেও প্রস্তাবটি সিন্ডিকেট পর্যন্ত যায়নি। পরে ১৮৯০ ও ১৮৯৩ সালে সেনেট আইনটি সংশোধন করে গ্রহণ করার প্রস্তাব নেওয়া হলেও তাতে খুব বেশি কাজ হয়নি। এই সময় অনেক শিক্ষিত ভারতীয়রাও উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে শুধু বাংলা নয় ভারতের অন্যান্য প্রাদেশিক ভাষার অধিকারের দাবি তোলেন। ১৮৯৯ সালে ৬ জানুয়ারী বড়লাট লর্ড কার্জন কাজের দায়িত্ব গ্রহন করে এই কাজে অগ্রসর হলেন। এর কয়েক সপ্তাহ পরে বিশ্ববিদ্যালয়ের বার্ষিক সমাবর্তন অনুষ্ঠানে পদাধিকারী ভাষণ হিসাবে তাঁর প্রথম ভাষণেই তিনি জানালেন—

“Cautions reform and not wholesale reconstruction.” [সতর্ক সংস্কার, সম্পূর্ণ নবগঠন নয়, (অনুবাদ সম্পাদকের)]

মূলত তাঁরই উদ্যোগে ১৮৯৯ সালে তত্কালীন ব্রিটিশ সরকার শিক্ষা সংক্রান্ত একটি প্রস্তাব রাখল। ১৯০০ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য করা হল টমাস রেলে-কে, যিনি কার্জনের শাসন পরিষদ অর্থাৎ একজিকুটিভ কাউন্সিলের আইন উপদেষ্টা ছিলেন। ১৯০১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে কার্জন তাঁর সিমলার বাড়িতে ব্রিটিশ শিক্ষাবিদ ও শিক্ষাধিকারীদের নিয়ে একটি সম্মেলন করলেন। এই গোপন সম্মেলনে কিছু সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। এই সম্মেলনের চার মাস পরে ২৭ জানুয়ারি, ১৯০২ সালে ঘোষিত হল ‘ভারতীয় বিশ্ববিদ্যালয় কমিশন’। সেখানে জানানো হল—

ভাষাশিক্ষার ক্ষেত্রে ভারতীয় ভাষাশিক্ষা বিষয়টি অত্যন্ত অবহেলিত হয়েছে। ফলে বহু স্নাতকোত্তর মাতৃভাষায় যথোপোযুক্ত জ্ঞান অর্জন করতে পারছে না। ভারতীয় ভাষাশিক্ষাকে অগ্রাধিকার দেওয়ার জন্য কমিশনের কয়েকটি প্রস্তাব ছিল—প্রথমত, স্নাতক পরীক্ষা পর্যন্ত ভারতীয় ভাষায় পরীক্ষা আবশ্যিক করতে হবে। তবে এটা পড়বার কোনো ব্যবস্থার প্রয়োজন নেই। দ্বিতীয়ত, ইংরাজির সঙ্গে ভারতীয় ভাষা সমূহকে এম. এ. পরীক্ষার বিষয় করতে হবে। তৃতীয়ত, ভারতীয় ভাষা বিষয়ে অধ্যাপকদের পদসৃষ্টি সম্পর্কে বিশ্ববিদ্যালয় যথোপযুক্ত আর্থিক ব্যবস্থা করবেন। চতুর্থত, ভারতীয় ভাষাশিক্ষা বিষয়ে আগ্রহ বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে সাহিত্য ও বিজ্ঞান বিষয়ক গ্রন্থ রচনার জন্য পুরস্কার দিতে হবে।

লর্ড কার্জনের সরকার কমিশনের প্রস্তাবগুলি সংশোধন করে মেনে নিলেন। আর আয়োগের প্রতিবেদনের ভিত্তিতেই ভারতীয় বিশ্ববিদ্যালয় আইন [Act no. VIII of 1904] তৈরি হল। ১৯০৪ সালের বিশ্ববিদ্যালয় আইন ২৪ ফেব্রুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন পেয়ে ১ সেপ্টেম্বর থেকে কার্যকরী হল। স্কুল ও কলেজের অনুমোদন গেল সরকারি আমলাদের হাতে। স্কুল কলেজে ন্যূনতম বেতন বেঁধে দেওয়ার কথা বলা হল। ১৯০৩-৪ সালে শিক্ষাখাতে বরাদ্দ হয়েছিল ২০৪.৬ লক্ষ টাকা, আর ১৯০৫-৬ সালের জন্য সামান্য বাড়িয়ে করা হল ২৪৪.৯ লক্ষ টাকা। তত্কালীন সরকার পুলিশ বিভাগের জন্য এর চেয়ে বেশি বরাদ্দ করেছে বলে সে সময় অভিযোগ উঠেছিল।

বিশ্ববিদ্যালয়ে আশুতোষ মুখোপাধ্যায়

১৯০৫ সালে বাংলাকে রাজনৈতিক কারণে ভাগ করার সিদ্ধান্ত নেবার আগে থেকেই বাংলার জনগণ বুঝতে পারছিল ব্রিটিশ সরকারের মতলব। তাই সিদ্ধান্ত ঘোষণার আগেই ছাত্ররা আন্দোলনের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিল। বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনে ছাত্রদের বিশেষ সক্রিয় ভূমিকা ছিল যা আলাদা করে চিন্তায় ফেলেছিল সরকারকে। বাংলার চিফ সেক্রেটারি আর ডব্লিউ কারলাইল যে সারকুলার জারি করেছিল তাতে ছাত্রদের রাজনৈতিক আন্দোলনে যোগদান নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছিল। আন্দোলনে যুক্ত কোনো ছাত্রকে জলপানি দিতে নিষেধ করা হল বরং স্কুল/কলেজ থেকে বহিষ্কার করার নির্দেশ দেওয়া হল। এই সারকুলারের বিরুদ্ধে ১৯০৫ সালের ৪ নভেম্বর কলেজ স্কোয়ারে ছাত্ররা প্রতিবাদসভা করে। এই সময় আন্দোলন করার জন্য রংপুরের স্কুলে কয়েকজন ছাত্রকে বহিষ্কারও করা হয়। এরপর বাংলার স্বদেশী আন্দোলনের নেতারা ছাত্রদের সরকারি স্কুল কলেজ ছেড়ে দিতে পরামর্শ দেন, তারা জাতীয় বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করার কথা ভাবলেন।

এমনিতেই এই সময় উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হবার প্রবল আকাঙ্খায় বাংলায় নতুন নতুন স্কুল কলেজ তৈরি হচ্ছিল যা দেখে ব্রিটিশ সরকার আতঙ্কিত হয়ে উঠেছিল। উচ্চশিক্ষার প্রসার না করে যাতে সঙ্কোচন করা যায় সরকার তার পরিকল্পনা করতে লাগল। মূলত সেই কারণেই প্রণয়ন করা হয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয় আইন। ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গের সিদ্ধান্ত নেওয়া হলেও সরকার ১৯০৪ সালের বিশ্ববিদ্যালয় আইন কার্যকরী করে উঠতে পারছিল না। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনে বিশৃঙ্খলা দেখা দিলে পরিস্থিতি সামলাতে বড়লাটের প্রিয়পাত্র কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি আশুতোষ মুখোপাধ্যায়কে উপাচার্যের দায়িত্ব দেওয়া হল। বঙ্গভঙ্গ ঘোষণার মাস ছয়েকের মধ্যে উত্তাল বাংলায় ১৯০৬ সালের ৩১ মার্চ, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় ভারতীয় উপাচার্য হিসাবে স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায় এলেন। তখন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বন্দেমাতরম উচ্চারণ করা নিষেধ, দেশীয় কলেজগুলিকে সরকারি অনুমোদন দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। এরই মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন নিয়মাবলী জারি হল; ১৯০৬ সালের ১১ আগস্ট জারি হওয়া নিয়মাবলীর মধ্যে ১১ নম্বর ধারায় ছিল—

‘The University shall Provide for post-graduate teaching study and research in the faculties of arts and science.’ [বিশ্ববিদ্যালয় কলা ও বিজ্ঞান বিভাগে গবেষণা ও স্নাতকোত্তর পড়াশোনা চালাবে। [অনুবাদ সম্পাদকের]

আশুতোষ মুখোপাধ্যায় মনে করতেন, ছাত্রদের রাজনীতি বা স্বদেশি আন্দোলনে সরাসরি যুক্ত না থেকে ঐ সময় নিজেকে শিক্ষিত করে তোলা উচিত। নিজে শিক্ষিত হয়ে, সমাজকে শিক্ষিত করে জাতির শিরদাঁড়া শক্ত করার উদ্দেশ্যকে বেশি প্রাধান্য দিতেন। তিনি সরাসরি ব্রিটিশ বিরোধিতা পছন্দ করতেন না। ব্রিটিশের তৈরি, ব্রিটিশের অর্থানুকুল্যে চালিত কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে সুকৌশলে নিজের দেশের ভবিষ্যতকে গড়ে তুলতে বেশি আগ্রহী ছিলেন।

১৯০৬ সালে উপাচার্যের পদে যোগ দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন আইনের ১১ নম্বর ধারাকে অবলম্বন করে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়কে উচ্চশিক্ষা ও গবেষণার কেন্দ্র হিসাবে গড়ে তুলতে চাইলেন। পাঠক্রম, পরীক্ষাব্যবস্থাকে ঢেলে সাজালেন যাতে আরও বেশি করে ভারতীয় তরুণ প্রজন্ম শিক্ষিত হতে পারে। তাঁর নতুন কৌশল শিক্ষার প্রাঙ্গণে টেনে আনল অনেক বেশি তরুণকে। ব্রিটিশদের বোঝালেন এদের বেশি করে শিক্ষার আওতায় না আনলে এরা সন্ত্রাসবাদীদের সঙ্গে মিশে সন্ত্রাস ছড়াবে।

ছোটো থেকেই আশুতোষ মুখোপাধ্যায় যেমন ছিলেন মেধাবী, সাহসী, পরিশ্রমী, দূরদর্শী তেমন ছিলেন দেশভক্ত। কিন্তু কখনও কোনো স্বাধীনতা আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না। অনেকে তাঁকে শাসকের তোষামোদকারীও বলতেন। তবে তাঁর বুদ্ধিমত্তা ও মেধার কাছে বারবার ব্রিটিশ শাসক মাথা নত করেছে। তাঁর দেশপ্রেমের প্রকাশ ছিল ভিন্ন প্রকৃতির। তিনি ব্রিটিশদের সঙ্গে পায়ে পা মিলিয়ে নয়, এক পা এগিয়ে চলতে পছন্দ করতেন। সদ্য কলেজ পাশ করা এই আশুতোষ মুখোপাধ্যায়কে ব্রিটিশ আধিকারিক ডিরেক্টর ক্রফ্ট সাহেব শিক্ষা বিভাগে ২৫০ টাকা মাইনের চাকরি দিতে চাইলে তিনি সেই বয়সে ঐ চাকরির জন্য বেশ কয়েকটি শর্ত রেখেছিলেন। শর্ত দিয়েছিলেন কলকাতার বাইরে তাঁকে পাঠানো যাবে না, কলকাতায় তাঁকে গবেষণার সুযোগ করে দিতে হবে এবং তাঁকে সাহেবদের সমান গ্রেড বা তার চেয়ে বেশি গ্রেডের বেতন দিতে হবে। তাঁর সাহস দেখে অবাক হয়েছিলেন ক্রফট সাহেব। বড়লাট লর্ড কার্জন তাঁকে বিলাতে পাঠাতে চাইলে মায়ের অনুমতি নেই বলে জানিয়ে দেন এবং সেই সঙ্গে লর্ড কার্জনের আদেশপত্রের সম্ভাবনাকে ধুলিসাৎ করে জানিয়ে দেন মা ছাড়া তাঁকে আদেশ করার অধিকার কারোর নেই। আবার তিনি নিজেই কার্টেনি ইলবার্টকে বলে সেনেটের সদস্য হলেন পঁচিশ বছর বয়সে। অবশ্য তার আগেই পড়া হয়ে গিয়েছিল কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের কাগজ পত্র, বই ও ‘মিনিটস’ যা তাঁর কাকা, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফেলো রাধিকাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় ১৮৮২ সালে সিনেটের সদস্য হওয়ার সুবাদে বাড়িতে আনতেন। শুধু তাই নয় ১৮৮৪ সালে ছাত্রাবস্থাতেই একবার বিশ্ববিদ্যালয়ের ফেলে দেওয়া কিছু ক্যালেন্ডার ও ‘মিনিটস’ বেশি দাম দিয়ে কিনেছিলেন পড়ার জন্য। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতি তাঁর ছিল বরাবরের আগ্রহ।

হয়তো সেকারণেই মায়ের অনিচ্ছা সত্ত্বেও ছাত্রজীবন শেষ করার আগে কলকাতা হাইকোর্টে আইনের ব্যবসা শুরু করেন, পনেরো বছর পরে আইনের ব্যবসা ছেড়ে হাইকোর্টের বিচারপতি হন। (আশুতোষ স্মৃতি কথার ৫১ পাতায় দীনেশচন্দ্র লিখেছেন,

“…‘কলকাতার ল’ রিপোর্টে তাঁহার দুই সহস্রের অধিক জাজমেন্ট (রায়) পাওয়া যায়। কিন্তু অপরাপর বিচারপতিদের সহযোগে যে সব ‘জাজমেন্ট’ দিতেন, তন্মধ্যে শুধু তিনি যে যে ‘জাজমেন্ট’ লিখিতেন, তাঁহার সংখ্যা বোধ হয় আরও বেশি।”

‘Calcutta Weekly Notes’ নামক আইন বিষয়ক পত্রিকায় তাঁর দুই হাজারের বেশি রায় মুদ্রিত আছে। আর এরই সঙ্গে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্টস ফ্যাকাল্টির সদস্য, সিনেট-সিন্ডিকেটের সদস্য হয়েছেন ও উপাচার্য পদের অবৈতনিক দায়িত্ব সামলেছেন। কলকাতা হাইকোর্টে দশটা-পাঁচটা ডিউটি করে সন্ধ্যায় বিশ্ববিদ্যালয়ে আসতেন যেখানে তাঁর জন্য দুটি টাইপ রাইটার অনবরত কাজ করে হাঁপিয়ে উঠত। তিনি হাইকোর্ট ও বিশ্ববিদ্যালয়ের সমস্ত কাজ সেরে রাতে বাড়ি ফিরেও দশটা পর্যন্ত সেই কাজেই ডুবে থাকতেন। তিনি যখন যে সংগঠনে থাকতেন সেখানেই কর্তৃত্বের শীর্ষে পৌঁছাতেন। তাঁর জ্ঞান, পরিশ্রম ও দূরদর্শিতা তাঁকে সেই শীর্ষে পৌঁছে দিত। এত ব্যস্ততার মধ্যেও তিনি সাহিত্য বিষয়ক প্রবন্ধ লিখতেন যার সমষ্টি ‘জাতীয় সাহিত্য’ (১৯২৪) নামক প্রবন্ধ সংকলন।

পাণ্ডিত্যের সুবাদেই তিনি ব্রিটিশ শাসকদলের প্রিয়পাত্র হয়ে ঊঠেছিলেন। তত্কালীন বড়লাট লর্ড কার্জন সহ ব্রিটিশ প্রশাসন ও পণ্ডিতদের অনেকেই তাঁর প্রতিভা ও কর্মোদ্যমকে শ্রদ্ধা করত বলেই নতুন ‘ইউনিভার্সিটি বিল’ সঙ্কলনের সময় তাঁর সাহায্য নিয়েছিলেন। ১৯০২ সালে বড়লাটের মন্ত্রীসভার যখন সদস্য হন তখনই বড়লাট লর্ড কার্জন তাঁকে বিশ্ববিদ্যালয় কমিশনের সদস্য হিসাবে নিযুক্ত করেছিলেন। ১৯০৩ সালে ক্যালকাটা মিউনিসিপ্যালিটিতে মনোনীত হয়ে সরকারি মন্ত্রীসভারও সদস্য হন। ১৯০৪ থাকে ১৯২৩ সাল পর্যন্ত কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি থাকাকালীন তাঁর সাহস, কর্মোদ্যম ও প্রতিভার কারণে সমসাময়িক অনান্য বিচারপতিরা প্রায় নিষ্প্রভ হয়ে থাকতেন।

আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের বংশপরিচয়ের দিকে তাকালে দেখা যায়, মৈমনসিংহ গীতিকার সম্পাদক দীনেশচন্দ্র সেন যেমন লক্ষণ সেনের সভাকবি ‘পবনদূত’-এর রচয়িতা ‘ধোয়ী’র বংশধর ছিলেন তেমনি গণিতজ্ঞ, আইনজ্ঞ আশুতোষ মুখোপাধ্যায় ‘নৈষধ’ কাব্যের রচয়িতা মহাপণ্ডিত ভরদ্বাজ গোত্রীয় ‘শ্রীহর্ষ’-এর বংশধর। এই বংশেই বেদের ভাষ্য রচনাকার সায়নাচার্য্য ও বহু সংস্কৃত গ্রন্থের রচয়িতা মহাপণ্ডিত মাধবাচার্য জন্মগ্রহণ করেন যাঁরা দাক্ষিণাত্যের হরিহর ও বুক্কা নামক দুই রাজার সভাকবি ছিলেন। শ্রীহর্ষ এক সময় কনৌজ থেকে এসে বঙ্গদেশে বসবাস শুরু করলে এখানে মুখোপাধ্যায় উপাধিতে পরিচিত হয়েছিলেন। তাঁর পূর্বপুরুষ সায়নাচার্য্য ও মাধবাচার্য্য চতুর্দশ শতাব্দীতে তুঙ্গভদ্রা নদীর তীরে পম্পা নগরীতে এসে বসবাস শুরু করেছিলেন। এই বংশেই দনুজমাধবের মন্ত্রী নৃসিংহ ওঝা জন্মগ্রহণ করেন যিনি ত্রয়োদশ শতাব্দীতে বিদ্যমান ছিলেন। চতুর্দশ শতাব্দীতে সামসুদ্দিন ফিরোজ শাহের বঙ্গবিজয়ের পর নৃসিংহ ওঝা সোনারগাঁর পৈতৃক বাসস্থান ত্যাগ করে নদীয়ার শান্তিপুরের কাছে ফুলিয়ায় বসবাস শুরু করেন। ফুলের বাগানে সাজানো ফুলিয়াতে শুধু ব্রাহ্মণ পল্লী ছিল না, ভরদ্দাজ গোত্রের মুখুটিদের বাসস্থানও ছিল। এই নৃসিংহ ওঝার পৌত্র ছিলেন মুরারী ওঝা আর মুরারী ওঝার পৌত্র হলেন কৃত্তিবাস ওঝা। শ্রীহর্ষের আঠারো প্রজন্ম হলেন কৃত্তিবাস ওঝা। এই বংশের আর এক কৃতি সন্তান নরেন্দ্রনারায়ণ ভুরসুট পরগণার রাজা সপ্তদশ শতাব্দীর শেষভাগে বর্তমান ছিলেন যাঁর পুত্র বাংলার বিখ্যাত কবি ভারতচন্দ্র রায়গুণাকর। মুখোপাধ্যায় বংশের ভরদ্বাজ গোত্রের নৃসিংহ ওঝা ফুলিয়ায় আর তাঁর ভাই রাম মুখো ছোটোফুলিয়ায় থাকতেন। রাম মুখোর বংশধর পুরুষোত্তম এবং তাঁর বংশধর বিশ্বনাথ মুখোপাধ্যায়, আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের পিতামহ ছিলেন। ইনি ১৭৮৭ সালে জন্মগ্রহণ করেন। এই বিশ্বনাথ মুখোপাধ্যায় আজ থেকে দুশো বছর আগে, ১৮৪০ সালে, সহজ সরল বাংলা গদ্যে একটি ভ্রমণ বৃত্তান্ত লিখেছিলেন। তাঁর সেই কালনা থেকে জলপথে রংপুর যাওয়ার অভিজ্ঞতা গদ্যে লেখা রোজনামচা থেকে তত্কালীন বাংলার নদীপথের ভৌগোলিক অবস্থার পরিচয় পাওয়া যায়। মনে রাখতে হবে, এই গদ্য লিখেছিলেন রাজা রামমোহন রায় মারা যাবার সাত বছর পর। বিশ্বনাথ মুখোপাধ্যায়ের পুত্র ডাক্তার গঙ্গাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় ছিলেন আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের পিতা। তিনি বাংলা ভাষায় চিকিত্সা-পুস্তিকা ‘মাতৃশিক্ষা’, ইংরাজি ভাষায় দুই খণ্ডের ‘প্র্যাক্টিস অফ মেডিসিন’, ও ‘শরীরবিদ্যা’র লেখক। গঙ্গাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় চিকিত্সক হওয়া সত্ত্বেও যে সাহিত্যপ্রেমী ছিলেন তার প্রমাণ পাওয়া যায় তাঁর বাল্মিকী রামায়ণের সুললিত বাংলায় পদ্যানুবাদে, যার অসম্পূর্ণ উত্তরাকাণ্ডের অংশ আশুতোষ মুখোপাধ্যায় শেষ করেন। এহেন বিখ্যাত বংশে আশুতোষ মুখোপাধ্যায় জন্মগ্রহণ করেন ১৮৬৪ সালের ২৯ জুন। তিনি বিদ্যাসাগরের সান্নিধ্য পেয়েছিলেন দশ বছর বয়সে, কিছুদিন পর তাঁর কাছ থেকে উপহার পেয়েছিলেন ‘রবিনসন ক্রুসো’।

বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী আশুতোষ মুখোপাধ্যায় ছাত্রাবস্থাতেই সকলকে চমকে দিয়েছিলেন। ১৮৮৪ সালে তিনি বি এ পরীক্ষায় প্রথম হয়ে অঙ্কে সব চেয়ে বেশি নম্বর পেয়ে ‘হরিশচন্দ্র পারিতোষিক’ পেয়েছিলেন। পরের বছর এম এ পরীক্ষাতেও অঙ্কে সব চেয়ে বেশি নম্বর পেয়েছেন। ১৮৮৬ সালে ‘বিশুদ্ধ গণিত’, ‘মিশ্র গণিত’ ও ‘পদার্থ বিদ্যা’য় দ্বিতীয়বার এম এ পরীক্ষা দেন তখনও প্রেমচাঁদ-রায়চাঁদ বৃত্তি পান। অসুস্থতার কারণে এন্ট্রান্স (১৮৭৯) ও এফ এ (১৮৮১) পরীক্ষায় প্রথম হতে না পারলেও দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থান লাভ করে ২০ টাকা করে বৃত্তি পেয়েছিলেন। মেধাবী, মনোযোগী ও পরিশ্রমী আশুতোষ ছাত্রাবস্থায় বৃত্তি ও পারিতোষক বাবদ যে দশ-পনেরো হাজার টাকা পেয়েছিলেন সেই টাকার সবটাই তিনি বই কিনে খরচ করেছেন।

মাত্র কুড়ি বছর বয়সে তিনি রয়াল এশিয়াটিক সোসাইটির সদস্য হয়েছিলেন। বাইশ বছর বয়সে এডিনবরা রয়াল সোসাইটির ফেলো, তেইশ বছর বয়সে লন্ডন ফিজিক্যাল সোসাইটির সদস্য হন এবং ১৯৮৮ সালে বি.এল পাশ করার সঙ্গে সঙ্গে প্যারিসের গণিত সোসাইটিরও সদস্য হন। ১৮৯০ সালে প্যারিসের ফিজিক্যাল সোসাইটি ও সিসিলির অন্তর্গত পেলামো-এর গণিত সোসাইটির সদস্য হন। অঙ্ক নিয়ে তাঁর বেশ কিছু লেখা বিলাতের বড় পত্রিকায়, কেম্ব্রিজ সহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের পত্রিকাতেও প্রকাশিত হয়েছিল। তাঁর অল্প বয়সে লেখা ‘কনিক সেকশন’ বেশ কিছুদিন ‘ফার্স্ট আর্ট’ পরীক্ষায় পাঠ্য ছিল। অঙ্ক নিয়ে বিশেষ গবেষণা করে নতুন আবিষ্কার করার পর তাঁর পাণ্ডিত্য দেখে বিশিষ্ট অঙ্কবিশারদ মিস্টার গ্লেসায়ার ও মিস্টার কেলি প্রশংসা করেন। এমনকি তাঁর সম্পর্কে সুপ্রসিদ্ধ র‍্যাংলার ডা আরপি পরাঞ্জপে মন্তব্য করেছেন,

“যদি আশুতোষ গণিতের অধ্যয়নে ও গবেষণায় নিযুক্ত থাকিতেন, তবে নিশ্চয়ই তিনি জগতের গণিতশাস্ত্রবিৎ পণ্ডিতগণের প্রথম পঙক্তিতে স্থান পাইতেন।” 

এমন অঙ্কবিশারদ আবার আইনও পড়লেন। কলকাতা হাইকোর্টের দক্ষ বিচারক ১৯৮৮ সালে সিটি কলেজ থেকে ল’ পাশ করেই কলকাতা হাইকোর্টের আইনের ব্যবসা শুরু করেছিলেন। পরের বছর তিনি সিন্ডিকেটের সদস্য হলেন। ঐ বছরেই কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফেলো ও সিন্ডিকেটের মেয়র হলেন। তিনিই ছিলেন এম এ-র প্রথম বাঙালি পরীক্ষক। ১৮৯৮ সালে সিন্ডিকেটের ও বাংলার লেজিস্লেটিভ এসেম্বলির সদস্য হলেন। তিনি যে বছরে ‘অনার্স ইন ল’ পাশ করেন সেই বছরেই রয়াল আইরিশ সোসাইটির সদস্য হলেন।

১৯০৭ সালের পর থেকে বেশ কয়েকবার এশিয়াটিক সোসাইটির সভাপতি হয়েছেন। ১৯০৯ সালে ভারতীয় জাদুঘরের কমিটির সভাপতি হন। এই বছরই সংস্কৃতে উপাধির পরীক্ষার পরীক্ষকদের কমিটির সভাপতি হন এবং কলকাতা ম্যাথমেটিক্যাল সোসাইটি প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯২০ সালে কয়েক মাসের জন্য কলকাতা হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতির দায়িত্বও সামলান।

ভূষিত হয়েছেন একাধিক উপাধিতে। ব্রিটিশ সরকার তাঁকে ‘নাইট’ উপাধি ও ‘সি এস আই’ উপাধি যেমন দিয়েছে তেমনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় দিয়েছে ‘ডি এস সি’ সম্মান। নবদ্বীপ থেকে ‘সরস্বতী’ উপাধি ও ঢাকা সারস্বত সমাজ থেকে ‘শাস্ত্র বাচস্পতি’ উপাধি পেয়েছেন। পেয়েছেন ‘সম্বুদ্ধাগম চক্রবর্তী’ উপাধিও। তিনি ১৯০৬ সাল থেকে ১৯১৪ সাল পর্যন্ত আট বছর এবং পরে ১৯২১ থেকে ১৯২৩ পর্যন্ত দুই বছর, মোট দশ বছর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ছিলেন। মাঝে যে সময় তিনি উপাচার্যের পদে ছিলেন না তখনও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের দায়িত্ব তাঁর কাঁধেই তুলে দেওয়া হয়েছিল। তখনও তিনি সিনেটের সদস্য, আর্ট ও সায়েন্স বিভাগের সভাপতির চেয়ারে। তাঁর চেয়ে ভালো পরিকল্পনা দেওয়ার মতো কোনো মাথা সেই সময় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছিল না। তাই ১৯১৭ সালে তিনি উপাচার্য না থাকলেও তাঁরই প্রচেষ্টায় ভারতীয় ভাষা-সাহিত্যে স্নাতকোত্তর শিক্ষা বিষয়ে যাবতীয় নিয়মাবলী অনুমোদন করেছে ব্রিটিশ সরকার।

(চলবে)

প্রচ্ছদ চিত্র পরিচিতিঃ ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, ছবি – ফ্রান্সিস ফ্রিথ

দ্বিতীয় পর্বের লিংক
https://www.itihasadda.in/https-www-itihasadda-in-university-of-calcutta-ashutosh-mukhopadhyay-and-mymensingh-geetika-part-ii/

তথ্যসূত্র

১) কনভোকেশন এড্রেস (১৮৫৮—১৯০৬), ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালকাটা, ২০০৭

২) শ্রী দীনেশচন্দ্র সেন, আশুতোষ-স্মৃতিকথা, পারুল প্রকাশন, ২০১১, পাতা ১০১।

৩) শ্রী দীনেশচন্দ্র সেন, মৈমনসিংহ গীতিকা, প্রথম খণ্ড, দ্বিতীয় সংখ্যা, ১৯৯৩।

৪) ড. দীনেশচন্দ্র সিংহ, প্রসঙ্গঃ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, প্রকাশক কলকাতা বি বি, ২০০৭।

৫) সুদেষ্ণা চক্রবর্তী, স্মৃতি বিস্মৃতিতে দীনেশচন্দ্র সেন, ঘরে বাইরে প্রকাশনা, ২০২০।

৬) প্রণব নস্কর, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকোত্তর বাংলা পাঠচর্চার প্রস্তুতিপর্ব ও আচার্য দীনেশচন্দ্র সেন, জলদ পত্রিকা, মৈমনসিংহ শতবর্ষ সংখ্যা, (সম্পাদক স্বপন ধর) ২০২৩।

৭) মনোজ মণ্ডল, বাংলা লোকসাহিত্যের যুগবিভাগ, জলদ পত্রিকা, মৈমনসিংহ শতবর্ষ সংখ্যা, (সম্পাদক স্বপন ধর) ২০২৩।

৮) সুমিত সরকার, আধুনিক ভারত ১৮৮৫-১৯৪৭, কে পি বাগচি এন্ড কম্পানি।

৯) কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরিতে ব্যক্তিগত অনুসন্ধান।

মন্তব্য তালিকা - “কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, আশুতোষ মুখোপাধ্যায় ও মৈমনসিংহ গীতিকা— প্রথম পর্ব”

মন্তব্য করুন

আপনার ইমেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।