কণাপদার্থবিদ্যার বিবর্তন (পর্ব – ১)
শিরোনামটা দেখলেই যে অনিবার্য প্রশ্নগুলোর মুখে পড়তে হবে তা হল, “কণাপদার্থবিদ্যা বিষয়টা আবার কী মশাই? তার বিবর্তনই বা আবার কী বিষয়?” প্রশ্নগুলো সহজ কিন্তু খুব সহজে এর উত্তর দেওয়া যায় না কারণ আপাত সরল প্রশ্নের আকারে আসলে পেশ করা হয়েছে মানবমনীষার মৌল প্রশ্ন। সুতরাং আগে বুঝে নিই কণাপদার্থবিদ্যা বিষয়টা ঠিক কী।
কণাপদার্থবিদ্যাকে প্রকৃতপক্ষে বলা উচিৎ মৌল কণার পদার্থবিজ্ঞান। অতি প্রাচীনকাল থেকেই মানুষের মনের এক প্রধান জিজ্ঞাসা, “কোন বস্তু দিয়ে সমস্ত কিছু গড়া?” আমাদের চারপাশে আমরা যে বিভিন্ন বস্তু (প্রাণী অপ্রাণী দুইই) দেখতে পাই তাদের উপাদান কী? কীভাবে তৈরি হয়েছে তারা? ঠিক এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খোঁজার চেষ্টা করে কণাপদার্থবিদ্যা। অর্থাৎ কিনা, ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর স্তরে, সম্ভব হলে ক্ষুদ্রতম স্তরে সমস্ত পদার্থের গঠনগত একক কী? সে একক কি এক? না আলাদা? আলাদা হলে কতটা আলাদা? কিসের ভিত্তিতে আলাদা?
মজার বিষয় হল, উপরোক্ত প্রশ্নসমূহের উত্তর খুঁজতে গিয়ে দেখা গেল, ক্ষুদ্রতম স্তরে পদার্থসমূহ অতি ক্ষুদ্র কতকগুলি কণা দিয়ে গঠিত এবং এই কণাসমূহ মাত্র কয়েক রকমের (হাতে গোনা যায় এমন সংখ্যক)। অর্থাৎ আমাদের চারিদিকে আমরা যে বহু বিচিত্র বস্তুসকল দেখতে পাই তার সবেরই মূল উপাদান যৎসামান্য কয়েক প্রকারের কণা। এগুলি বিপুল সংখ্যায় একত্রিত হয়ে আমাদের চারপাশের এই দৃশ্য ও অদৃশ্য (হ্যাঁ অদৃশ্য, কারণ কণা দ্বারা গঠিত সব পদার্থই আমরা দেখতে পাই না) বহুবর্ণময়, নানাভাবে চিত্রিত নানাপ্রকার বস্তু তৈরি করে। মানুষের দৃষ্টিতে তো বটেই এমনকী যন্ত্রের চোখেও অদৃশ্য বহু পদার্থ ছড়িয়ে আছে আমাদের মহাবিশ্ব জুড়ে। মানুষের বৌদ্ধিক, গাণিতিক প্রজ্ঞা তাদের অস্তিত্ব নির্ণয় করতে পারে কিন্তু ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য স্তরে তারা এখনও অদৃশ্য, তাই তাদের নাম “ডার্ক ম্যাটার (Dark Matter)” বা অন্ধকার বস্তু। (কিন্তু তাদের বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা আমাদের বর্তমান নিবন্ধের পরিসীমার বাইরে)
আরও আশ্চর্যের বিষয় যে, এই কণাসমূহ কয়েকটি ধর্মের নিরিখে পরস্পর থেকে আলাদা হলেও কোনো এক প্রকারের কণার বিষয়ে যদি চিন্তা করি তাহলে দেখব যে তারা সবাই একই। ‘একই’ বলতে কিন্তু আমরা এখানে ‘একই রকমের’ বা ‘একই প্রকারের’ বলতে চাইছি না, যেমনটা আমরা দুটো মারুতি গাড়ি বা দুটো পেন বা দুটো ব্যাগ সম্পর্কে বলে থাকি। এসবগুলো একইরকমের হতে পারে, একই মেশিনে, একই মানুষ তাদের বানাতে পারে কিন্তু তবু তারা পুরোপুরি এক নয়। যদি সূক্ষ্ম ভাবে বিচার করা হয়, কিছু না কিছু পার্থক্য তাদের থাকবেই যা দিয়ে তাদের আলাদা করে চেনা যাবে। কিন্তু পদার্থকণার ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র জগতে বিষয়টা একেবারেই এমন নয়। দুটো ইলেকট্রন বা দুটো প্রোটনের মধ্যে কোনো পার্থক্যই নেই। দুটো ইলেকট্রন সর্বতোভাবেই একে অপরের নিখুঁত নকল। যেকোনো একটা ইলেকট্রন সম্পর্কে জানা মানেই মহাবিশ্বে উপস্থিত অর্বুদ নির্বুদ ইলেকট্রনের প্রতিটি সম্পর্কে জানা। বৃহত্তর বস্তুর জগত বা Macroscopic world-এ এর তুল্য কোনো উদাহরণ নেই। এবং এই ধর্মই কণাপদার্থবিদদের কাজটা সহজ করে দেয় কারণ একটা ইলেকট্রন হল একটা ইলেকট্রন— কোনো ‘বড়’, ‘ছোট’, ‘হাল্কা’, ‘ভারি’, ‘নতুন’, ‘পুরোনো’ ইলেকট্রন হয় না।
হ্যাঁ এজন্য কণাপদার্থবিদ্যা সহজ, কিন্তু এজন্যই আবার কণাপদার্থবিদ্যা জটিল ও রহস্যময়। কারণ শুধু কণার ধর্ম ও পরিচিতি বর্ণনা করেই পদার্থবিদের কাজ শেষ হয়ে যায় না। সেই ধর্ম ও পরিচিতির পেছনে লুকিয়ে থাকা কারণও তাঁকে অনুসন্ধান করতে হয়। কেবল ‘কী’ ও ‘কোথায়’ নয়, পদার্থবিদের কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হল ‘কেন’। সব ইলেকট্রন একইরকমের, কিন্তু কেন? ইলেকট্রনের ধর্মগুলো বিভিন্ন পরীক্ষার মাধ্যমে জানা গেল; কিন্তু ঐরকম ধর্মগুলো ঠিক ঐরকমই কেন? কণাপদার্থবিদ্যার বর্তমান অগ্রগতি সবটুকুই প্রায় এমন সব ‘কেন’ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে।
অবশ্য কণাপদার্থবিদ্যার ইতিহাস বা তার বিবর্তনের ইতিহাস জানতে গিয়ে আমাদের এ ধরনের ‘কেন’ প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হবে না। আমরা শুধু জানবো, ‘কী’, ‘কবে’ এবং ‘কেমন করে’ জাতীয় প্রশ্নসমূহের উত্তর। তবে কণাপদার্থবিদ্যার ইতিহাস আমরা যেভাবে বর্ণনা করতে চলেছি তাকে ঠিক ইতিহাস না বলে ‘লোক ইতিহাস’ বা ‘লোকগাথা’ বলাই সঙ্গত। কারণ এখানে আমরা জানব কেবল সেই ঘটনাপ্রবাহ যা কণাপদার্থবিদরা মনে রাখতে বা বলতে ভালবাসেন। কিছু অসামান্য বৈজ্ঞানিক প্রজ্ঞা, অন্তর্দৃষ্টি ও উত্তরণের ঘটনাপরম্পরা যার মধ্যে কোনো ভুল, অস্পষ্টতা, হতাশা, ব্যর্থতার স্থান নেই। সমস্ত মিথ্যা আশা ও ব্যর্থতার কানাগলিতে শেষ হওয়া হতাশার কাহিনীগুলি আমরা এই ইতিহাস থেকে সযত্নে বাদ রেখেছি। এই পর্বে আমরা ফোটন বা আলোককণা আবিষ্কারের বর্ণনা করব।
মূল কাহিনী শুরুর আগে কিছু বুনিয়াদি তথ্য আমাদের জেনে নেওয়া প্রয়োজন যেগুলোর কথা আমাদের কাহিনীতে বারে বারে উল্লিখিত হবে, তাই সেগুলোর বিষয়ে কিছু ধারণা ব্যতিরেকে মূল কাহিনী বুঝতে অসুবিধা হবে।
যে কোনো বস্তু বা কণার স্থিতি ও গতি সংক্রান্ত গবেষণা পদার্থবিদ্যার একটি বুনিয়াদি বিষয়। পরমাণু বা তার চেয়েও ক্ষুদ্র (sub atomic) কণাসমূহ যেহেতু সরাসরি দেখা, মাপা বা ভর নির্ণয় করা যায় না সুতরাং এদের বিষয়ে জানার জন্য আমরা ব্যবহার করি কিছু পরোক্ষ উপায় যেগুলো সবই গতিবিদ্যার সঙ্গে সম্পর্কিত। এই গতিবিদ্যা বা mechanics ও কিন্তু একরকমের নয়। কণার আয়তন ও বেগের ওপর নির্ভর করে ভিন্ন ভিন্ন গতিবিদ্যা তৈরি করা হয়েছে। নীচের ছকে এগুলো সংক্ষেপে দেখানো হল।
সংক্ষেপে বর্ণনা করতে হলে বলা যায়, অধিক (macro) ভর ও কম বেগের কণার গতীয় অবস্থা বর্ণনা করার জন্য নিউটনীয় বলবিদ্যা উপযুক্ত, কিন্তু কণার বেগ অত্যন্ত বেশি (অর্থাৎ আলোর বেগের— ৩ লক্ষ কিমি প্রতি সেকেন্ড— সমতুল্য) হলে নিউটনীয় বলবিদ্যা সঠিক ফলাফল দেয় না। সেক্ষেত্রে ব্যবহার করতে হয় আপেক্ষিকতাতত্ত্ব নির্দেশিত বলবিদ্যা। অন্যদিকে কণার ভর ও আয়তন অত্যন্ত কম (পরমাণু বা তার চেয়েও ক্ষুদ্র) হলেও নিউটনীয় বলবিদ্যা কাজ করে না। তখন ব্যবহার করতে হয় কোয়ান্টামতত্ত্ব নির্দেশিত বলবিদ্যা। আর পরমাণু বা তার চেয়েও ক্ষুদ্র কণা আলোর বেগের সমতুল্য বেগে চললে তখন ব্যবহৃত হয় কোয়ান্টাম ক্ষেত্রতত্ত্ব। তবে এর মানে কিন্তু এই নয় যে নিউটনীয় বলবিদ্যা ভুল। আপেক্ষিকতাবাদী বলবিদ্যা বা কোয়ান্টাম বলবিদ্যা কম বেগ বা অধিক ভরের জন্য নিউটনীয় বলবিদ্যায় পর্যবসিত হয়। গণিতের ভাষায় যাকে বলে সীমাস্থ ঘটনা বা Limiting case।
কণাজগতের খবর পাওয়ার জন্য আমরা নির্ভর করি মূলত তিনটি প্রক্রিয়ার ওপরে।
১) বিক্ষেপণ বা Scattering– যেখানে একটা কণাকে অন্য কণার দিকে ছোঁড়া হয় এবং সংঘর্ষ পরবর্তী বেগ ও দুটির গতিপথের মধ্যে সৃষ্ট কোণ ইত্যাদি মাপা হয়।
২) বিযোজন বা Decay– বেশিরভাগ তেজস্ক্রিয় কণা নিজের থেকেই ভেঙে বা বিযোজিত হয়ে নতুন কণার জন্ম দেয় এবং কোনো তেজস্ক্রিয় বিযোজন বা radioactive decay-এর পরে সেই ধ্বংসস্তুপের মধ্যে আমরা নতুন কণা খুঁজি বা তাদের ধর্ম বোঝার চেষ্টা করি উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন সন্ধানীযন্ত্র বা detector ব্যবহার করে।
৩) বদ্ধ দশা বা Bound State– অনেকসময় দুই বা ততোধিক কণা একত্রে একটিমাত্র কণার গুচ্ছ সৃষ্টি করে। অনেকটা যেন কয়েকটা রবারের বল আঠা দিয়ে একসঙ্গে জোড়া। সেক্ষেত্রে ঐ গুচ্ছবদ্ধ কণার ধর্ম বোঝার চেষ্টা করা হয় এবং আলাদা আলাদা কণাগুলোর সম্পর্কেও জানার চেষ্টা করা হয়।
বলাবাহুল্য, ওপরে বর্ণিত পদ্ধতিগুলোর কোনোটাই খুব সহজ সরল প্রক্রিয়া নয় এবং কোনো সহজ উপায়ে এগুলো সম্পন্নও করা যায় না। বৃহৎ, জটিল, উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন এবং অবশ্যই অত্যধিক দামী যন্ত্রপাতি ব্যতিরেকে এ গবেষণা করাই যায় না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কণাসমূহের ধর্ম বোঝার জন্য কোনো আন্দাজি তত্ত্ব বা প্রকল্প (hypothesis) ঠিক করা হয় এবং তারপর সেই তত্ত্ব নির্দেশিত ফলাফল পরীক্ষালব্ধ ফলের সঙ্গে তুলনা করে বিচার করা হয় সেই তত্ত্ব আদৌ গ্রহণযোগ্য কিনা। অবশ্য বিজ্ঞানের সব শাখাতেই প্রায় এমন পদ্ধতি অবলম্বন করা হয় কিন্তু কণাপদার্থবিদ্যার গবেষণায় এ পদ্ধতির ব্যবহার সর্বাধিক কারণ এখানে প্রত্যক্ষরূপে গবেষণার উপাদানগুলির (মৌল কণা) সঙ্গে মিথস্ক্রিয়া (interaction) করা যায় না।
আর একটিমাত্র বুনিয়াদী তথ্য পাঠকদের জানিয়ে আমরা কণাপদার্থবিদ্যার ইতিহাসে ঢুকে পড়ব। মহাবিশ্বে মোট কতরকম বল (force) আছে? একটা সময় অবধি মানুষ মাত্র দুরকমের বল-এর অস্তিত্ব জানত; মহাকর্ষ বল (Gravitation) এবং তড়িৎচুম্বকীয় বল (Electromagnetic force)। কিন্তু পরে আরও দুটি বলের বিষয়ে জানা গেল যখন কণাপদার্থবিদ্যার গভীরতর গবেষণা শুরু হল। এ দুটি বল হল সবল মিথস্ক্রিয়া (Srong Interaction) বল ও দুর্বল মিথস্ক্রিয়া (Weak Interaction) বল। এগুলির ক্ষমতা অতি সামান্য দূরত্বের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ফলে তীব্র বল মহাবিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী বল হওয়া সত্ত্বেও পরমাণুর নিউক্লিয়াস বা কেন্দ্রের মধ্যেই তার ক্রিয়া সীমাবদ্ধ, অন্যদিকে মহাকর্ষ সবচেয়ে দুর্বল বল হলেও তার সীমা দূর-দূরান্ত অবধি বিস্তৃত এবং মহাবিশ্বে সবচেয়ে বেশিমাত্রায় উপস্থিত। এই চারটি বলের উৎপত্তি, পারস্পরিক সম্পর্ক ও বস্তুজগতের ওপর এদের প্রভাব বিষয়ক প্রশ্নসমূহ আজও পদার্থবিদ্যার গভীরতর গবেষণার বিষয়, সুতরাং কণাপদার্থবিদ্যার ইতিহাস আলোচনাকালে আমরা এদের বিষয়ে ততটুকুই আলোচনা করবো যতটুকু আমাদের এ ইতিহাস বোঝার জন্য প্রয়োজন।
পাঠকবর্গ এতক্ষণে হয়তো বিস্মিত হয়ে প্রশ্ন তুলছেন, মাত্র চারটে বল? মহাকর্ষ আর তড়িৎচুম্বকীয়টা নাহয় বুঝলাম কিন্তু ঘর্ষণ বল গেল কোথায়? দুটো গাড়ির মধ্যে ধাক্কা লাগলে যে দুটোই তুবড়ে যায় সেটা তাহলে কোন বলের জন্য? কোনো ভারি পদার্থ তোলার জন্য আমি যে বল প্রয়োগ করি সেটা তাহলে কী বল? এই সমস্ত প্রশ্নের উত্তরে বলতে হবে, এ সবই আসলে তড়িৎচুম্বকীয় বল! শুনতে আশ্চর্য লাগলেও এটা সত্যি যে দৈনন্দিন জীবনে আমাদের আশেপাশে আমরা যেসব বলের প্রয়োগ দেখতে পাই তার মধ্যে মহাকর্ষ বাদে সবই তড়িৎচুম্বকীয় বল। আমরা আদতে বাস করি তড়িৎচুম্বকীয় বলের জগতে। মহাকর্ষ বাদে বাকি তিনটি বলই আমাদের কাহিনীর সাথে অঙ্গাঙ্গীরূপে জড়িত এবং এ কাহিনীর মধ্যেই আমরা এদের বিষয়ে আরও জানতে পারব।
কণাপদার্থবিদ্যার ইতিহাস যদিও খুব পুরোনো নয় এবং সর্বদা সরলরৈখিক ও একমাত্রিকও নয়, তবুও একে আমরা কয়েকটা যুগ বা অধ্যায়ে ভাগ করার চেষ্টা করেছি।
ধ্রুপদী যুগ (Classical Era):
যদিও এই যুগবিভাজন কিছুটা কৃত্রিম ও আলঙ্কারিক তবু আমরা ধ্রুপদী যুগ বা কণাপদার্থবিদ্যার সূচনা ধরে নেবো ১৮৯৭ সালে যখন জোসেফ জন থমসন ইলেকট্রন নামক মৌল কণাটি আবিষ্কার করলেন। আমরা থমসনের সময় থেকেই কাহিনী শুরু করি।
থমসনের সময়ে জানা ছিল, প্রচণ্ড উষ্ণতার ধাতবপাত বা ফিলামেন্ট থেকে ক্যাথোড রশ্মি নামক একপ্রকার অদৃশ্য রশ্মি নির্গত হয় যা চৌম্বক ও তড়িৎক্ষেত্র উভয়ের দ্বারাই স্বাভাবিক গতিপথ থেকে বিচ্যুত হয় এবং এই বিচ্যুতি থেকে এও বোঝা যায় যে এ রশ্মির তড়িৎ ধর্ম ঋণাত্মক। সুতরাং এটি যে প্রকৃতপক্ষে রশ্মি নয় বরং তড়িতাহিত কণার স্রোত, সেই ধারণা বিজ্ঞানীদের মনে ছিল। ১৮৯৭ সালে থমসন একটি পরীক্ষার মাধ্যমে এই কণার বেগ এবং আধান, ভরের অনুপাত নির্ণয়ে সমর্থ হলেন। বেগ দেখা গেল প্রায় আলোর বেগের এক দশমাংশ আধান (পদার্থ সৃষ্টিকারী মৌলিক কণাসমূহের বৈশিষ্ট্যমূলক ধর্মকে আধান বা চার্জ বলে), ভর অনুপাত অত্যন্ত বেশী, যা থেকে সিদ্ধান্ত করা যায় এই কণার আধান অত্যন্ত বেশী বা ভর অত্যন্ত কম। কিছু পরোক্ষ প্রমাণ থেকে অনুমান করা গেল যে দ্বিতীয় সিদ্ধান্তটিই হয়তো যথার্থ। থমস এই কণার নাম রেখেছিলেন সূক্ষ্ম কণা (corpuscules)। পরবর্তীকালে একক আধানের জন্য জর্জ জনস্টন স্টোনি ১৮৯১ সালে নাম রেখেছিলেন ইলেকট্রন।
১৯০৯ সালে মিলিকান তাঁর বিখ্যাত তৈলবিন্দু পরীক্ষার (Oil Drop Experiment) মাধ্যমে ইলেকট্রনের আধান নিখুঁতভাবে নির্ণয় করলেন। তারপর ভর বের করা তো পঞ্চম শ্রেণীর পাটীগণিত-এর বিদ্যা দিয়েই সম্ভব। দেখা গেল, এই কণার ভর অত্যন্ত কম। এমনকী সবচেয়ে হাল্কা মৌল হাইড্রোজেন পরমাণুর ভরের চেয়েও অনেক কম।
সুতরাং পরমাণু যে পদার্থের ক্ষুদ্রতম গঠনগত একক নয় বরং ক্ষুদ্রতর কিছু কণার সমষ্টি, এ ধারণা ক্রমেই বিজ্ঞানীদের মনে পাকাপোক্ত আসন করে নিল। কিন্তু পরমাণু পদার্থটা তাহলে কেমন? কী দিয়ে তৈরি? এই নব আবিষ্কৃত ইলেকট্রন কণার গুচ্ছ কি পরমাণু?
জে জে থমসন
থমসন যথার্থই ভেবেছিলেন যে ইলেকট্রন অবশ্যই পরমাণুর অন্যতম উপাদান, কিন্তু একমাত্র উপাদান নয়। কেন? কারণ ইলেকট্রন কণাটা ঋণাত্মক আধানযুক্ত হলেও পরমাণুতো ঋণাত্মক নয়। পরমাণু যে নিস্তড়িত। সুতরাং একটা কোনো ধনাত্মক আধানযুক্ত পদার্থ নিশ্চয়ই আছে যা গোটা পদার্থটাকে নিস্তড়িত বানায়। থমসনের মতে গোটা পরমাণুটা একটা ধনাত্মক আধানের গোলা যার গায়ে ঋণাত্মক ইলেকট্রনগুলো গাঁথা আছে। ঠিক যেমন একটা কেকের গায়ে চেরী বা কাজুর টুকরো গাঁথা থাকে। এজন্যই এই পরমাণু মডেলকে বলা হতো ‘প্লাম-পুডিং মডেল’।
আর্নেস্ট রাদারফোর্ড
কিন্তু ১৯১১ সালে আর্নেস্ট রাদারফোর্ড তাঁর বিখ্যাত ‘আলফা কণা বিক্ষেপণ’ (Alpha Particle Scattering) পরীক্ষার মাধ্যমে থমসনের পরমাণু মডেলের অসারতা প্রমাণ করে দিলেন। রাদারফোর্ডের মডেলে পরমাণুর মধ্যের বেশিরভাগ স্থানই ফাঁকা, কেবল অতিক্ষুদ্র কোনো কেন্দ্রীয় অঞ্চলে প্রায় সমগ্র ভর ও ধনাত্মক আধান জমা হয়ে আছে। ঋণাত্মক আধানযুক্ত ইলেকট্রনগুলো এই ধনাত্মক আধানযুক্ত কেন্দ্রের (রাদারফোর্ডের ভাষায় Nucleus বা কেন্দ্রীন) চারদিকে বৃত্তাকারে পরিভ্রমণ করে। ঠিক যেমন সূর্যের চারদিকে গ্রহগুলি ঘোরে। রাদারফোর্ডের মডেল অনুসারে সবচেয়ে হালকা মৌল হাইড্রোজেনের কেন্দ্রীন একটিই মাত্র ধনাত্মক আধানযুক্ত কণা দ্বারা গঠিত যার আধান ইলেকট্রনের সমান কিন্তু ভর প্রায় ২০০০ গুণ বেশি। এই কণাটির নাম দেওয়া হল ‘প্রোটন’ (Proton)। প্রোটন এবং ইলেকট্রনের মধ্যে উপস্থিত বিপরীতধর্মী আধানের পারস্পরিক আকর্ষণ বলের (তড়িৎচুম্বকীয় বল) কারণে ইলেকট্রনগুলি কেন্দ্রীনের চারদিকে ঘোরে। যদিও এ মডেলের স্থায়ীত্ব নিয়ে কিছু সমস্যা হয়েছিল কিন্তু ১৯১৪ সালে নিলস বোর কোয়ান্টাম তত্ত্ব ব্যবহার করে স্থায়ীত্ব বিষয়ক সমস্যার সমাধান করেন। তিনি আগে থেকেই বিভিন্ন পরীক্ষার মাধ্যমে প্রাপ্ত হাইড্রোজেন গ্যাসের বর্ণালীসমূহের তাত্ত্বিক, গাণিতিক ব্যাখা দিতে সক্ষম হন।
নীলস বোর
বোরের তত্ত্ব পরীক্ষালব্ধ ফলের সঙ্গে আশ্চর্যজনকভাবে মিলে যাওয়ার ফলে ভাবা হয়েছিল যে এই তত্ত্ব দিয়েই তাহলে সব মৌলের গঠন ব্যাখা করা যাবে। কিন্তু সূক্ষতর পরীক্ষায় দেখা গেল বোরের তত্ত্ব সব ঘটনার ব্যাখা দিতে পারে না। হাইড্রোজেনের সূক্ষ্ম বর্ণালীর কারণ বা উচ্চতর মৌলগুলোর অত্যধিক ভরের কারণ বোর তত্ব দিয়ে ব্যাখা করা যায় না। এর মধ্যে প্রথমটা অর্থাৎ, হাইড্রোজেন বর্ণালীর প্রতিটি পটি বা Line-এর সূক্ষতর পটিতে বিভাজনের কারণ ব্যাখা করেন আর্নো সমারফেল্ড; আইনস্টাইনের বিশেষ আপেক্ষিকতা তত্ত্ব ব্যবহার করে। সে আলোচনা আমাদের বর্তমান প্রবন্ধের সীমার বাইরে। কিন্তু দ্বিতীয় সমস্যা অর্থাৎ উচ্চতর মৌলগুলোর অত্যধিক ভরের সমস্যাটা আমাদের একটু বুঝে নিতে হবে।
হাইড্রোজেনের কেন্দ্রীন যথাক্রমে একটি মাত্র ধনাত্মক আধানযুক্ত কণা বা প্রোটন দ্বারা গঠিত। সুতরাং পর্যায়সারণির পরবর্তী মৌল হিলিয়ামে দুটি, তার পরবর্তী মৌল লিথিয়ামে তিনটি, তার পরবর্তী বেরেলিয়ামে চারটি করে প্রোটন ও সমসংখ্যক ইলেকট্রন থাকবে এটাই স্বাভাবিক। সেক্ষেত্রে তাদের ভর হাইড্রোজেনের চেয়ে যথাক্রমে দুই, তিন ওচারগুণ বেশি হবে এটাই আশা করা যায়। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে দেখা গেল, হাইড্রোজেনের চেয়ে হিলিয়াম চারগুণ, লিথিয়াম সাতগুণ বেশি ভারি— তাহলে?
এ সমস্যার সমাধান করলেন রাদারফোর্ডের ছাত্র চ্যাডউইক যখন ১৯৩২ সালে তিনি ‘নিউট্রন’ (Neutron) নামক মৌল কণাটি আবিষ্কার করলেন। এর ভর প্রোটনের ভরের প্রায় সমান এবং এটি নিস্তড়িত। প্রমাণ পাওয়া গেল যে হাইড্রোজেন ব্যতীত অন্যান্য সব মৌলের কেন্দ্রীন এক বা একাধিক প্রোটন ও নিউট্রনের সমন্বয়ে তৈরি। যেমন হিলিয়ামের কেন্দ্রীনে দুটি প্রোটন ও দুটি নিউট্রন উপস্থিত; ফলে, এর ভর হাইড্রোজেনের ভরের চারগুণ। লিথিয়ামের কেন্দ্রীনে তিনটি প্রোটন ও চারটি নিউট্রন উপস্থিত ফলে এর ভর হাইড্রোজেনের ভরের সাতগুণ। এমনকী পরে হাইড্রোজেনের দুটি আইসোটোপ (যাদের পরমাণু ক্রমাঙ্ক বা প্রোটন সংখ্যা সমান কিন্তু ভরসংখ্যা বা প্রোটন-নিউট্রনের মিলিত সংখ্যা আলাদা) উপস্থিত, ডয়টেরিয়াম ও ট্রিটিয়াম, যাদের কেন্দ্রীনে একটি প্রোটনের সঙ্গে যথাক্রমে একটি ও দুটি করে নিউট্রন উপস্থিত। প্রসঙ্গত, ডয়টেরিয়াম আইসোটোপ সহযোগে তৈরি জলের অণুকে ‘ভারি জল’ (Heavy Water) বলা হয়।
চাডউইক
নিউট্রনের আবিষ্কারের সঙ্গেই শেষ হয় কণাপদার্থবিদ্যার ধ্রুপদী যুগ। কণাপদার্থবিদ্যার জগত এত সহজ সরল কখনও ছিল না আর পরে কখনও আর হয়নি। সেই ১৯৩২ সালে মনে হয়েছিল, বস্তু বা পদার্থ কী দিয়ে তৈরি— এ প্রশ্নের উত্তর পাওয়া গেছে। ইলেকট্রন, প্রোটন ও নিউট্রন সহযোগে তৈরি পরমাণু; ব্যস, সহজ সরল একটা মডেল, কোনো জটিলতা নেই!! কিন্তু ততদিনে আরও তিনটি অসাধারণ আবিষ্কার ও তত্ত্বের ভিত গাঁথা হয়ে গেছে যা পরবর্তী যুগে বিজ্ঞানীদের রাতের ঘুম কেড়ে নেবে। সে তিনটি হল, ইউকাওয়ার মেসন, ডিরাকের পজিট্রন এবং পাউলির নিউট্রিনো। তবে এগুলোর বিষয়ে আমরা আলোচনা করবো পরবর্তী পর্বে। তার আগে ঘুরে আসা যাক, ‘ফোটন’ অর্থাৎ ‘আলোককণা’-র রাজ্যে। জেনে নেওয়া যাক এর আবিষ্কার ও ধর্ম বিষয়ে।
ফোটন বা আলোককণা
সত্যেন্দ্রনাথ বোস
কিছু অর্থে ফোটন একটা আধুনিক কণা; W বা Z কণার সমগোত্রীয় যেগুলো কিনা ১৯৮৩ সালের আগে আবিষ্কারই হয়নি। ইলেকট্রন প্রোটনের সঙ্গে এদের মিল খুবই কম। এখানে বলে রাখা উচিৎ, এই ফোটন বা W, Z ইত্যাদি কণাগুলির ধর্ম বা চরিত্র বোঝার জন্য আমরা ব্যবহার করি যে গাণিতিক তত্ত্ব তার নাম ‘বোস-আইনস্টাইন সংখ্যায়ন’ (Bose-Einstein Statistics)। হ্যাঁ, ঠিকই ধরেছেন, আমাদের সত্যেন্দ্রনাথ বোস আবিষ্কৃত তত্ত্ব। যে কারণে এই কণাগুলিকে একত্রে বলা হয় ‘বোসন’ এবং ইলেকট্রন প্রোটন গোত্রীয় কণা যারা ইতালীয় বিজ্ঞানী এনরিকো ফের্মি ও জার্মান বিজ্ঞানী পল ডিরাক আবিষ্কৃত তত্ত্ব ফের্মি-ডিরাক সংখ্যায়ন মেনে চলে তাদের একত্রে বলা হয় ‘ফের্মিয়ন’।
ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক
ঠিক কখন, কবে, কে ফোটন আবিষ্কার করলেন তা নিশ্চিত করে বলা মুশকিল তবে আবিষ্কারের মঞ্চ ১৯০০ সাল থেকেই তৈরি ছিল যখন ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক কৃষ্ণবস্তু বিকিরণের পরীক্ষালব্ধ ফলের তাত্ত্বিক ব্যাখা দেওয়ার জন্য চিরাচরিত ‘পরিসংখ্যান বলবিদ্যা’-র (Statistical Mechanics) পরিবর্তে এক নতুন তত্ত্ব উদ্ভাবন করলেন। প্ল্যাঙ্ক বললেন, বিকিরণের সময় শক্তির বিকিরণ নিরবিচ্ছিন্নভাবে হয় না, বরং কাটা কাটা ভাবে, ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র শক্তির প্যাকেট বা থলিরূপে হয়। এই প্যাকেটগুলিকে তিনি নাম দিলেন ‘কোয়ান্টা’। পুরোনো ধ্রুপদী পদার্থবিদ্যার যুগের অবসানে শুরু হল ‘আধুনিক পদার্থবিদ্যা’-র যুগ।
আলবার্ট আইনস্টাইন
প্ল্যাঙ্ক অবশ্য ব্যাখা করেননি যে, বিকিরণ এমন গুচ্ছবদ্ধ (Quantized) কেন? তিনি ভেবেছিলেন, এটা হয়তো বিকিরণের একটা বিশেষত্ব। কিন্তু ১৯০৫ সালে আইনস্টাইন আলোকতড়িৎ ক্রিয়া (PhotoElectric Effect) ব্যাখা করতে গিয়ে এক বৈপ্লবিক প্রস্তাব নিয়ে এলেন। তিনি বললেন, Quantization শুধু বিকিরণের বিশেষত্ব নয়, বরং এটি তড়িৎচুম্বকীয় ক্ষেত্রেরই নিজস্ব ধর্ম। শক্তির বিকিরণের মতো শোষণও গুচ্ছাকারে হয়, নিরবিচ্ছিন্নভাবে হয় না। এই তত্ত্ব ব্যবহার করে আইনস্টাইন আলোকতড়িৎ ক্রিয়ার যথাযথ ব্যাখা দিলেও (প্রসঙ্গত এর জন্যই তিনি পরবর্তীকালে নোবেল পুরস্কার পান) আলো বা তড়িৎচুম্বকীয় তরঙ্গকে ‘কণা’ বলে বর্ণনা করার জন্য তাঁকে তুমুল বিরোধীতা এবং সমালোচনার সম্মুখীন হতে হল। বিজ্ঞানীমহল মনে করছিলেন, তিনি প্রায় বিশবছর আগে কবরে চলে যাওয়া ‘আলোর কণিকাতত্ত্ব’কে পুনরুজ্জীবিত করছেন।
পরবর্তী প্রায় বিশ বছর সমগ্র বিজ্ঞানজগতের বিরুদ্ধে আইনস্টাইন এক নিঃসঙ্গ যুদ্ধ লড়তে থাকলেন (এর অতি মনোজ্ঞ এক বিবরণ পাওয়া যাবে তাঁর জীবনীকার আব্রাহাম পায়াস রচিত Subtle is the Lord গ্রন্থে) এমনকী ১৯১৬ সালে যখন মিলিকান আলোকতড়িৎ ক্রিয়ার ওপরে অনেকগুলি পরিশ্রমসাধ্য এবং নিখুঁত পরীক্ষা করলেন, তখনও তিনি লিখছেন, “Einstein’s Photo-Electric equation…… appears in every case to predict the observed results…… Yet the semicorpuscular theory by which Einstein arrived at this equation seems at present whilly untenable”
আইনস্টাইনের ফটো-ইলেকট্রিক সমীকরণ প্রতিটি ক্ষেত্রেই পর্যবেক্ষিত ফলাফলের পূর্বাভাস দিতে সফল,…… তবুও যে সেমিকরপাসকুলার তত্ত্বের মাধ্যমে আইনস্টাইন এই সমীকরণে এসেছিলেন তা বর্তমানে অসমর্থনীয় মনে হচ্ছে। [অনুবাদ সম্পাদকের]
বুঝুন কাণ্ড! তাত্ত্বিক ব্যাখা পরীক্ষালব্ধ ফলগুলিকে নিশ্চিতভাবে মিলিয়ে দিচ্ছে, তবু নাকি তত্ত্বটা মেনে নেওয়া যাচ্ছে না!!
যাইহোক, ১৯২৩ সালে কম্পটন তাঁর বিখ্যাত ‘কম্পটন বিক্ষেপণ’ (Compton Scattering) পরীক্ষার ফলাফল যখন প্রকাশ করলেন তখন এই বিতর্ক মিটে গেল। দেখা গেল, আলো সত্যিই কণাধর্ম প্রদর্শন করে, বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে আলোর কণাধর্ম দেখা যায়। সুতরাং আইনস্টাইন ঠিকই বলেছিলেন। ১৯২৬ সালে রসায়নবিদ গিলবার্ট লুইসের প্রস্তাব অনুসারে এই কণার নাম দেওয়া হল ‘ফোটন’।
ফোটন কণার নামকরণের সঙ্গেই ধ্রুপদী যুগের গল্পটা শেষ করা গেল। তবে প্রাসঙ্গিক বিবেচনায় আরও কিছু কথা বলে রাখা উচিৎ। পারমাণবিক বা অব-পারমাণবিক (Sub-atomic) স্তরে প্রাপ্ত আলোর কণিকা ধর্মের সঙ্গে কেমন করে বৃহৎ ক্ষেত্রে আলোর তরঙ্গ ধর্ম এবং এর সঙ্গে সম্পর্কিত ঘটনাসমূহের (অপবর্তন, ব্যবর্তন) সমতা বা তুল্যতা স্থাপন করা হয় তা কোয়ান্টাম বলবিদ্যার গভীরতর বিষয়। জটিলতা পরিহারের স্বার্থে আমরা গাণিতিক সমীকরণ ইত্যাদি বাদ দিয়ে সহজ করে বিষয়টা একটু বোঝার চেষ্টা করি।
কোয়ান্টাম ক্ষেত্রতত্ত্বের মধ্যে ফোটন বা আলোককণার ধারণা স্বাভাবিকভাবেই আসে গাণিতিক সমীকরণগুলি থেকে যার ফলে তড়িৎচুম্বকীয় মিথস্ক্রিয়াকে এক নতুন দৃষ্টিভঙ্গী থেকে ব্যাখা করে।
ধ্রুপদী তড়িৎগতিবিদ্যায় (Electrodynamics) আমরা দুটি কণার মধ্যে (ধরা যাক দুটি ইলেকট্রনের মধ্যে) বিকর্ষণকে কণাগুলির চারপাশে স্থিত তড়িৎচুম্বকীয় ক্ষেত্রের মাধ্যমে ব্যাখা করি। প্রতিটি ইলেকট্রন ঐ ক্ষেত্র দ্বারা কীভাবে প্রভাবিত হয় আর ঐ ক্ষেত্রের ওপর কী প্রভাব ফেলে, এই মোটামুটি ধ্রুপদী তড়িৎগতিবিদ্যার ব্যাখা পদ্ধতি।
কোয়ান্টাম ক্ষেত্র তত্ত্বে এই তড়িৎচুম্বকীয় ক্ষেত্র অসংখ্য ছোট ছোট টুকরো বা ফোটন কণায় বিভক্ত (Quantized) বলে ভাবা হয় এবং দুটি কণার মধ্যে মিথস্ক্রিয়া বলতে বোঝায় সে দুটির মধ্যে ফোটন কণার আদানপ্রদান। দুটি ইলেকট্রনই যেন ক্রমাগত ফোটন বিকিরণ ও শোষণ করছে। এবং যেকোনো স্পর্শরহিত বলের ক্ষেত্রেই এ ঘটনা ঘটে।
ধ্রুপদী পদার্থবিদ্যায় আমরা ‘দূরাগত কার্য’ বা ‘Action at a distance’-কে ব্যাখা করি সর্বব্যাপ্ত এক সুষম ক্ষেত্রের কুঞ্চন বা প্রসারণ দ্বারা কিন্তু কোয়ান্টাম ক্ষেত্রতত্ত্বে এই সর্বব্যাপ্ত ক্ষেত্র যেন টুকরো টুকরো হয়ে (Quantized) এক সর্বব্যাপ্ত কণা সমুদ্রে পরিণত হয়েছে। এই কণাসমূহের আদানপ্রদানই আকর্ষণ বা বিকর্ষণ বলের কারণ। কণাগুলি যেন বার্তাবাহক যে, দুটি বস্তু পরস্পরকে কাছে টানবে না দূরে ঠেলবে। তড়িৎচুম্বকীয় বলের ক্ষেত্রে এই কণা ফোটন, মহাকর্ষের ক্ষেত্রে এই বার্তাবাহক কণা গ্র্যাভিটন। যদিও আজ অবধি সফল মহাকর্ষীয় ক্ষেত্রতত্ত্ব তৈরি করা বা পরীক্ষাগারে গ্র্যাভিটন সনাক্ত করা সম্ভব হয়নি, যে কারণে কোয়ান্টাম ক্ষেত্রতত্ত্ব এখনও পর্যন্ত অসম্পূর্ণ তত্ত্ব।
যাইহোক, পরমাণুর মতো বড়ো কোনো ব্যবস্থা (System) যেখানে কণাগুলি বদ্ধদশায় রয়েছে সেখানে ক্ষেত্রের কোয়ান্টাইজেশন প্রভাব অনেকটাই প্রশমিত ও মসৃণ হয়ে আসে। ফলে কোয়ান্টাম ক্ষেত্রতত্ত্ব নির্দেশিত কণাবাদী ব্যাখ্যার (অর্থাৎ ফোটন আদানপ্রদান) সীমাস্থ ঘটনা (Limiting Case) রূপে কুলম্বীয় আকর্ষণ বা বিকর্ষণ ঘটনাগুলি (কেন্দ্রীন ও ইলেকট্রনের মধ্যে আকর্ষণ) ব্যাখা করা যায়। কিন্তু আলোকতড়িৎ ক্রিয়া বা কম্পটন বিক্ষেপণের মতো ঘটনা যেখানে কয়েকটি মাত্র ফোটন জড়িত সেখানে আর কোয়ান্টাইজেশন প্রভাব প্রশমিত হয় না এবং একে অগ্রাহ্যও করা যায় না।
শীর্ষক চিত্র পরিচিতি: CERN Large Hadron Collider, GENEVA (হলুড বৃত্ত LHC সুড়ঙ্গটিকে দেখাচ্ছে) পৃথিবীর সর্ববৃহৎ কণাত্বরণ যন্ত্র ও গবেষণাগার। পেছনে মঁব্লা পর্বতমালা দেখা যাচ্ছে।
তথ্যসূত্র
1) Abraham Pais, Inward Bound, Clarendon Press, Oxford, (1986)
2) Abraham Pais, Subtle is the Lord, Oxford University Press, (1982)
কণাপদার্থবিদ্যা বিষয়ে এই দুটি বইয়ের জুড়ি নেই। ইতিহাস ও গণিত সমন্বিত বিজ্ঞান যে এতো সুন্দরভাবে একইসঙ্গে বলা যায় তা এগুলো না পড়লে জানতেই পারতাম না। এছাড়া অন্যান্য কিছু বইয়েরও সাহায্য নিয়েছি সেগুলোর কথা যেখানে যেমন দরকার পড়বে বলে দেব বাকী পর্বগুলোতে।
কনা পদার্থবিদ্যার বিবর্তন শিরোনামে লেখার প্রথম পর্ব খুব মনোযোগ সহকারে পড়লাম। চমকপ্রদ তথ্য সমৃদ্ধ বিজ্ঞান বিষয়ক এই লেখা আমি সহ আমার মত অনেককেই সমৃদ্ধ করবে। শুভেচ্ছা ও শুভকামনা রইল।
আমি পদার্থবিদ নই পদার্থবিদ্যা নিয়ে লেখাপড়া ও করিনি। আমি একজন সমাজতত্ত্ববিদ। রাজনৈতিক-অর্থনীতি ও সমাজতত্ত্ব আমার বিষয়। ইতিহাস চর্চা করি তাও মানুষের, সমাজের ও মানব সভ্যতার বিকাশের ইতিহাস। সেখানে ধর্মতত্ত্বের কোন স্থান নেই। কারণ ধর্মতত্ত্ব মানুষেরই সৃষ্টি। এ নিবন্ধটি আমার অত্যন্ত ভাল লেগেছে এ কারণে যে বিজ্ঞানের ছাত্র না হয়েও আমি নিতান্ত সরল ভাষায় বুঝেছি বস্তুর বিকাশের এবং পদার্থের ক্রমবিকাশ মানবজাতি ও সভ্যতার ক্রমবিকাশকে বুঝতে সহায়তা করে। মানুষকে বিজ্ঞান মনষ্ক হয়ে উঠতে সহায়তা করে। লেখক কৃশানু নস্করকে এবং ইতিহাস, আড্ডাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।