প্রাচীন গান্ধারী বৌদ্ধ সাহিত্য
প্রাচীন গান্ধার
বর্তমান পাকিস্তানের খাইবার-পাখতুনখোয়া প্রদেশের অধিকাংশ, পাঞ্জাব প্রদেশের কিছু অংশ এবং পূর্ব আফগানিস্তানের একটি অংশ বহু প্রাচীনকাল থেকে গান্ধার নামে পরিচিত ছিল, ঋগ্বেদেও (১.১২৬.৭) গান্ধারের উল্লেখ আছে। ষষ্ঠ শতক সাধারণপূর্বাব্দের দ্বিতীয়ার্ধ থেকে চতুর্থ শতক সাধারণপূর্বাব্দের শেষার্ধে আলেকজান্ডারের অভিযান পর্যন্ত গান্ধার (প্রাচীন পারসিক ভাষায় গন্দার) অঞ্চল আকিমিনীয় সাম্রাজ্যের নিয়ন্ত্রণে ছিল। চতুর্থ শতক সাধারণপূর্বাব্দের শেষে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য এই এলাকাকে তাঁর সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করেন। প্রথম সহস্রাব্দ সাধারণপূর্বাব্দের মাঝামাঝি থেকে প্রাচীন গান্ধারের দুটি মুখ্য নগর ছিল পুষ্কলাবতী (বর্তমান চারসদ্দা) ও তক্ষশিলা। সাধারণাব্দের প্রথম শতকে কুষাণ সম্রাট কুজুল কদফিসেস পুরুষপুর অর্থাৎ বর্তমান পেশাওয়ারে নিজের রাজধানী স্থাপন করেন। আকিমিনীয় অধিকারের আমল পর্যন্ত গান্ধার ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের অধিবাসী জনগোষ্ঠীসমূহ সম্ভবত বৈদিক ধর্মীয় বিশ্বাসের অনুসারী ছিলেন। এরপর, সম্ভবত, মৌর্য সম্রাট অশোকের প্রচেষ্টায় ভারতীয় উপমহাদেশের উত্তর-পশ্চিম সীমান্তবতী এই অঞ্চলে বৌদ্ধ ধর্মের প্রসার ঘটে। বর্তমান পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশের তক্ষশিলায় আনুমানিক দ্বিতীয় শতক সাধারণপূর্বাব্দের ধর্মরাজিকা স্তূপের আদিরূপ অশোকের নির্মিত বলে মনে করা হয়। মৌর্য শাসনের অবসানের পর এই অঞ্চলের ব্যাকট্রিয়-গ্রিক, ইন্দো-গ্রিক, শক, পার্থিয় ও কুষাণ শাসকদের, বিশেষ করে কুষাণ সম্রাট কণিষ্ক ও হুবিষ্কের আনুকূল্যে, ভারতীয় বৌদ্ধ ধর্ম গান্ধার অঞ্চলে সামগ্রিক ব্যাপ্তি লাভের পর, রেশম সরণির বণিক ও তীর্থযাত্রীদের চলার পথ ধরে গান্ধার থেকে প্রসারিত হয় মধ্য এশিয়া হয়ে চীন, কোরিয়া ও জাপানে। সাধারণাব্দের পূর্ববর্তী শেষ তিন শতকে যাঁরা গান্ধার অঞ্চলে বৌদ্ধ চৈত্য ও বিহারগুলি স্থাপন করেছিলেন, তাঁরা ছিলেন পরবর্তী কালে শ্রাবকযানী নামে অভিহিত বিভিন্ন প্রাচীন নিকায়ের (সম্প্রদায়ের) অনুগামী। গান্ধারের প্রাচীন খরোষ্ঠী লেখে এর মধ্যে ধর্মগুপ্তক নিকায়ের বেশি উল্লেখ থাকলেও মহীশাসক, কাশ্যপীয়, সর্বাস্তিবাদ ও মহাসাংঘিক নিকায়ের অনুগামীদেরও উল্লেখ রয়েছে।
পরবর্তী কালে, সাধারণাব্দের প্রথম শতকে সম্ভবত গান্ধার অঞ্চলের বিহারগুলি থেকেই মহাযান মতের উদ্ভব ও প্রসার ঘটে। সাধারণাব্দের তৃতীয় শতকের প্রথমার্ধে ইরানের সাসানীয় শাসকদের কাছে কুষাণদের পরাজয়ের পর গান্ধারে বৌদ্ধ ধর্মের প্রভাব ক্রমশ কমে আসতে শুরু করে এবং সাধারণাব্দের সপ্তম-অষ্টম শতকের পর গান্ধার থেকে বৌদ্ধ ধর্মের প্রভাব ধীরে ধীরে বিলুপ্ত হয়ে যায়।
প্রাচীন গান্ধারে বৌদ্ধ ধর্মের প্রভাবের সবচেয়ে পরিচিত নিদর্শন সাধারণাব্দের প্রথম শতাব্দী থেকে নির্মিত গ্রিক ও রোমান শিল্পের দ্বারা প্রভাবিত ‘গান্ধার শৈলী’তে নির্মিত অসংখ্য বুদ্ধ ও বোধিসত্ত্বের মূর্তি এবং বুদ্ধের জীবনী ও জাতকের কাহিনি সম্বলিত ভাস্কর্য আজ পৃথিবীর প্রায় সমস্ত সংগ্রহশালায় দেখতে পাওয়া যায়। এই মূর্তি ও ভাস্কর্যগুলি এক সময় এই অঞ্চলে নির্মিত বহু সংখ্যক স্তূপ বা চৈত্য ও বিহারের অংশ ছিল। বিংশ শতকের প্রায় শেষ দশক পর্যন্ত এই শিল্পকর্মগুলি, কয়েকটি স্তূপের অবশেষ ও বুদ্ধধাতু সম্বলিত পাত্রের ওপর লিখিত কিছু লেখ এবং স্থানীয় শাসকদের দ্বারা উৎকীর্ণ বেশ কিছু সংখ্যক লেখ ছাড়া এই অঞ্চলে প্রচলিত বৌদ্ধ ধর্মের স্বরূপ সম্বন্ধে জানার আর কোনো উপায় ছিল না। কিন্তু বিগত শতকের শেষ দশক থেকে বেশ কিছু সংখ্যক প্রাচীন পাণ্ডুলিপির আবিষ্কার ও পাঠোদ্ধার হওয়ার ফলে প্রাচীন গান্ধারে বৌদ্ধ ধর্মের প্রসার ও বিবর্তন সম্বন্ধে ক্রমাগত নতুন তথ্য উন্মোচিত হয়ে চলেছে।
গান্ধারী ভাষা ও সাহিত্য
প্রাচীন গান্ধার অঞ্চলে সাধারণাব্দের পূর্ববর্তী তৃতীয় শতাব্দী থেকে সাধারণাব্দের চতুর্থ শতাব্দীর মধ্যবর্তী সময়ে রচিত বৌদ্ধ ধর্মগ্রন্থের পাণ্ডুলিপি, সরকারি দস্তাবেজ, লেখ ও মুদ্রায় একটি প্রাকৃত বা মধ্য ভারতীয় আর্য ভাষার সন্ধান পাওয়া যায়। অশোকের শাহবাজ গরহি ও মানসেহরা শিলালেখ দুটিতে এই ভাষার প্রাচীনতম নিদর্শন পাওয়া গিয়েছে। সম্ভবত সংস্কৃত অথবা গান্ধারের অধিবাসী পাণিনির অষ্টাধ্যায়ী গ্রন্থে (৪.১.৬২, ৬.১.১৮১, ৬.৩.২০, ৭.২.৮৮) ‘ভাষা’ বলে উল্লিখিত প্রাচীন বৈদিক ভাষার স্থানীয় উপভাষা থেকে এই ভাষার উদ্ভব। সাহিত্যিক প্রাকৃত ভাষাগুলির সঙ্গে এই ভাষার উচ্চারণগত পার্থক্য যথেষ্ট, সংস্কৃত ভাষার ‘শ’, ‘ষ’ ও ‘স’-এর পৃথক উচ্চারণ এই ভাষায় অক্ষুণ্ণ ছিল। সংস্কৃত ‘সর্ব’ গান্ধারী ভাষায় অবিকৃত রয়ে গিয়েছে, অন্য মধ্যভারতীয় আর্য ভাষার মতো ‘সব্ব’ হয়ে যায়নি। অন্য সাহিত্যিক প্রাকৃত ভাষার সঙ্গে গান্ধারী ভাষার মৌলিক পার্থক্য হল এই ভাষাটি মূলত কথ্য ভাষা, তাই এই ভাষার কোনো নির্দিষ্ট ব্যাকরণগত রূপ বা বানান ছিল না। এই ভাষার বেশ কিছু শব্দের সঙ্গে বর্তমানে এই অঞ্চলে প্রচলিত দার্দীয় ভাষাগুচ্ছের শব্দমালার যথেষ্ট মিল আছে। শুরু থেকেই এই ভাষা গান্ধার ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে আকিমিনীয় আমলে প্রশাসনিক কাজে ব্যবহৃত আরামীয় লিপি থেকে উদ্ভূত খরোষ্ঠী লিপিতে লেখা হয়েছে। সাধারণাব্দের তৃতীয় শতক থেকে গান্ধার ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে খরোষ্ঠীর পরিবর্তে ব্রাহ্মী লিপির ব্যবহার শুরু হয়ে যায়, এর কিছু কাল আগে থেকেই এই ভাষার সংস্কৃতায়নও শুরু হয়ে গিয়েছিল। বর্তমান জিনজিয়াং-উইগুর স্বায়ত্বশাসিত অঞ্চলের নিয়া ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চল থেকে প্রাপ্ত সাধারণাব্দের তৃতীয় শতকের খরোষ্ঠী লিপিতে কাঠের পাটার ওপর লেখা শানশান রাজ্যের সরকারি দস্তাবেজে এই ভাষার সংস্কৃতায়িত রূপের নিদর্শন পাওয়া যায়, যা আধুনিক বিদ্বজ্জনদের দেওয়া ‘নিয়া প্রাকৃত’ নামে পরিচিত। সাধারণাব্দের পঞ্চম শতাব্দী থেকে গান্ধার অঞ্চলে বৌদ্ধ ধর্মগ্রন্থগুলি সংস্কৃতায়িত গান্ধারী ভাষার বদলে ব্রাহ্মী লিপিতে সংস্কৃত ভাষায় লেখা শুরু হয়। ১৯১৬ থেকে ১৯১৮ সাল পর্যন্ত তক্ষশীলার জউলিয়াঁ বিহারে উৎখননের অর্ধদগ্ধ ভূর্জপত্রের পুথির ৫২টি খণ্ডিত অংশ পাওয়া যায়। পঞ্চম শতক সাধারণাব্দের শেষ দিকের গুপ্ত লিপিতে লেখা এই সংস্কৃত বৌদ্ধ পাণ্ডুলিপির পাঠোদ্ধার করা গেলেও এখনও চিহ্নিত করা সম্ভব হয়নি।১ ১৯৩০ সালে ফরাসি প্রত্নতত্ত্ববিদ জোসেফ হ্যাকিন আফগানিস্তানের বামিয়ানের একটি গুহা থেকে ব্রাহ্মী লিপিতে লেখা কয়েকটি খণ্ডিত সংস্কৃত পুথির সন্ধান পান। এই পাণ্ডুলিপিগুলির মধ্যে মহাসাংঘিক নিকায় থেকে উদ্ভূত লোকোত্তরবাদী নিকায়ের বিনয় এবং সর্বাস্তিবাদী নিকায়ের অভিধর্মপিটকের অন্তর্গত সঙ্গীতিপর্যায় গ্রন্থের পুথিকে চিহ্নিত করা সম্ভব হয়েছে। ১৯৩১ ও ১৯৩৮ সালে বর্তমানে পাক-অধিকৃত কাশ্মীরের গিলগিত জেলার নৌপুর থেকে সাধারণাব্দের ষষ্ঠ থেকে সপ্তম শতকের মধ্যবর্তী সময়ে লেখা বেশ কয়েকটি ব্রাহ্মী লিপিতে লেখা সংস্কৃত বৌদ্ধ পুথি আবিষ্কৃত হয়। গিলগিত থেকে আবিষ্কৃত ভূর্জপত্র ও তালপত্রের পাণ্ডুলিপিগুলির মধ্যে মূলসর্বাস্তিবাদী নিকায়ের বিনয়, একোত্তরিক আগম ও অভিধর্মপিটকের অন্তর্গত ধর্মস্কন্ধ গ্রন্থ এবং মহাযান ধর্মগ্রন্থ বজ্রচ্ছেদিকা সূত্র ও সদ্ধর্মপুণ্ডরীক সূত্রের খণ্ডিত পুথি উল্লেখনীয়।২
১৮৯২ সালে, বর্তমান জিনজিয়াং-উইগুর স্বায়ত্বশাসিত অঞ্চলের প্রাচীন খোটান শহরের কাছাকাছি কোহমারী মাজার এলাকা থেকে আবিষ্কৃত বৌদ্ধ ‘ধর্মপদ’ গ্রন্থের একটি ভূর্জপত্রে লেখা আনুমানিক দ্বিতীয় শতক সাধারণাব্দের পুথিতে যখন প্রথম এক অজ্ঞাত প্রাকৃত ভাষার সন্ধান পাওয়া যায়, তখনই, আধুনিক বিদ্বজ্জনরা, তার সঙ্গে সাহিত্যিক প্রাকৃত ভাষাগুলির অনেক পার্থক্য খুঁজে পান। এরপর, ফরাসী প্রত্নতত্ত্ববিদ ও ভূপর্যটক পল পেলিও বর্তমান জিনজিয়াং-উইগুর স্বায়ত্বশাসিত অঞ্চলের তারিম নদী উপত্যকার উত্তরে স্থিত কুচার কাছাকাছি অঞ্চল থেকে খরোষ্ঠী লিপিতে লেখা ৮টি তালপাতার পুথির খণ্ডিত অংশ সংগ্রহ করেন। বর্তমানে পারীর বিবলিওথেক নাশিওনাল দ্য ফ্রাঁসে গ্রন্থাগারে রাখা এই খণ্ডিত পুথিগুলিতে সংস্কৃত ছাড়া আর যে ভাষার সন্ধান পাওয়া গিয়েছিল, তাও এই প্রাকৃত ভাষা। ১৯২৯ সালে নরওয়ের ভারততত্ত্ববিদ স্টেন কনো খরোষ্ঠী লিপিতে রচিত ৯৬টি লেখ ‘কর্পাস ইনক্রিপশনাম ইণ্ডিকারাম ভলিউম টু, পার্ট ওয়ান’ সংকলনে প্রকাশ করেন। এরপর এই ভাষার আরও নিদর্শন সেখানে খুঁজে পাওয়া যায়। এই ভাষাটির নামকরণ করা হয় ‘উত্তর-পশ্চিমা প্রাকৃত’। ১৯৩২ সালে জার্মান গবেষক এর্নস্ট ভাল্ডস্মিড্ট ধর্মগুপ্তক নিকায়ের ভারতীয় সন্ন্যাসী বুদ্ধযশ ও চীনা সন্ন্যাসী ঝু ফোনিয়ান কর্তৃক ৪১৬ সাধারণাব্দে চীনা ভাষায় অনুদিত ‘দীর্ঘাগম’ (তুলনীয় পালি গ্রন্থ ‘দীঘনিকায়’) গ্রন্থ নিয়ে চর্চা করার সময় উপলব্ধি করেন এই চীনা অনুবাদে উল্লিখিত নামবাচক বিশেষ্য শব্দগুলি সংস্কৃত থেকে নয়, এই প্রাকৃত ভাষা থেকে নেওয়া হয়েছিল।৩ ১৯৪৬ সালে আধুনিক বিদ্বজ্জন হ্যারল্ড ওয়াল্টার বেইলি তাঁর লেখা একটি নিবন্ধে এই ভাষার নতুন নামকরণ করেন ‘গান্ধারী’৪ এবং বর্তমানে এই নামটি অধিকাংশ আধুনিক বিদ্বজ্জনদের দ্বারা স্বীকৃত। এখনও পর্যন্ত এই ভাষায় রচিত কয়েক’শ খণ্ডিত পাণ্ডুলিপি এবং দ্বিসহস্রাধিক লেখ ও প্রশাসনিক দস্তাবেজের সন্ধান পাওয়া গিয়েছে। কয়েক’শ মুদ্রার ওপর এই ভাষায় উত্কীর্ণ লেখ পাওয়া গিয়েছে।
গান্ধারী ভাষায় লেখা ধর্মপদ গ্রন্থের আবিষ্কারের পর, দীর্ঘদিন এই ভাষায় রচিত আর কোনো বৌদ্ধ ধর্মগ্রন্থ আবিষ্কৃত না হওয়ায় আধুনিক বিদ্বজ্জনদের কাছে গান্ধারী বৌদ্ধ সাহিত্য সম্বন্ধে খুবই কম তথ্য মজুত ছিল। উনিশ ও বিশ শতকে আফগানিস্তান থেকে আবিষ্কৃত খরোষ্ঠী লিপিতে লেখা ভূর্জপত্রের সব পাণ্ডুলিপিই পাঠোদ্ধার করার পূর্বেই বিনষ্ট হওয়ায় এই পাণ্ডুলিপিগুলির বিষয়বস্তু সম্পর্কে প্রায় কিছুই জানা যায়নি। বিগত শতকের শেষ দশক থেকে পরিস্থিতি পরিবর্তিত হয়। আফগানিস্তানে তালিবানের প্রসারের পর, ১৯৯৪ সাল থেকে পাকিস্তানে, মূলত পেশাওয়ারের প্রত্নবস্তুর বাজারে আগত গান্ধারী ভাষায় লেখা প্রচুর সংখ্যক প্রাচীন পাণ্ডুলিপি নানা পথে ইউরোপের বিভিন্ন সংগ্রহশালায় উপনীত হয়ে সংরক্ষিত হয়। বিগত তিন দশকে এই প্রাচীন পাণ্ডুলিপিগুলি থেকে গবেষকরা গান্ধারী বৌদ্ধ সাহিত্যের সম্বন্ধে বহু নতুন তথ্য আবিষ্কার করতে সক্ষম হয়েছেন। বর্তমানে গান্ধারী বৌদ্ধ সাহিত্যের পাণ্ডুলিপির মুখ্য সংগ্রহগুলি ব্রিটিশ লাইব্রেরি সংগ্রহ, সিনিয়র সংগ্রহ, বামিয়ান সংগ্রহ এবং বাজৌর ও ‘বিচ্ছিন্ন’ সংগ্রহ নামে পরিচিত। এর মধ্যে বেশ কিছু পাণ্ডুলিপির পাঠ উদ্ধার করে ইতিমধ্যেই প্রকাশিত হয়েছে।
ব্রিটিশ লাইব্রেরি সংগ্রহ
১৯৯৪ সালে ব্রিটিশ লাইব্রেরিকে ব্রিটিশ পুথি সংগ্রাহক রবার্ট সিনিয়র তাঁর নিজস্ব সংগ্রহ থেকে খরোষ্ঠী লিপিতে লিখিত লেখযুক্ত পাঁচটি মৃৎকলস, ২৬টি মৃৎপাত্রের টুকরো ও ২৯টি ভূর্জপত্রের গোটানো পুথির অংশ দান করেন। অত্যন্ত ভঙ্গুর অবস্থায় প্রাপ্ত এই গোটানো পুথিগুলি পাঁচটি মৃৎকলসের মধ্যে একটি মৃৎকলসের ভেতরে রাখা ছিল। এই গোটানো পুথি সমেত মৃৎকলসটি ধর্মগুপ্তক নিকায়ের সন্ন্যাসীদের উদ্দেশে নিবেদিত বলে মৃৎকলসের ওপর কালি দিয়ে লেখা খরোষ্ঠী লেখে উল্লেখ রয়েছে। এই কলসটি সম্ভবত পূর্ব আফগানিস্তানের হাড্ডার কাছাকাছি কোনো প্রাচীন বৌদ্ধ বিহারে রাখা ছিল। ব্রিটিশ লাইব্রেরি সংগ্রহের খণ্ডিত পাণ্ডুলিপিগুলি আনুমানিক সাধারণাব্দের প্রথম শতকে লিপিবদ্ধ করা হয়েছিল বলে আধুনিক বিদ্বজ্জনদের অনুমান। এদের প্রায় অধিকাংশই মূলত ধর্মগুপ্তক নিকায়ের গান্ধারী ভাষায় লেখা বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থের খণ্ডিত অংশ। আধুনিক বিদ্বজ্জনরা আছে বৌদ্ধ সাহিত্যের সঙ্গে তুলনা করে খণ্ডিত গান্ধারী পাণ্ডুলিপিগুলিকে ধর্মপদ, খড়্গবিষাণ সূত্র, সঙ্গীতি সূত্রের মূলসমেত একটি টীকা, অনবতপ্তগাথা এবং কয়েকটি ‘অবদান’ পর্যায়ের গ্রন্থের অংশ বলে চিহ্নিত করেছেন।
সিনিয়র সংগ্রহ
ব্রিটিশ পুথি সংগ্রাহক রবার্ট সিনিয়র বিংশ শতকের প্রায় অন্তিম পর্বে ২৪টি ভূর্জপত্রের গোটানো পুথির অংশ সংগ্রহ করেছিলেন। ২০০৩ সালে তাঁর এই ব্যক্তিগত সংগ্রহের কথা প্রথম জানা যায়। যে মৃৎকলসের ভেতরে এই পুথিগুলি রাখা ছিল, ঐ মৃৎকলস ও তার ঢাকনার ওপর লেখা দুটি লেখে কোনো একটি অজ্ঞাত অব্দের, খুব সম্ভব কণিষ্কাব্দের দ্বাদশতম বৎসর অর্থাৎ আনুমানিক ১৪০ সাধারণাব্দের উল্লেখ রয়েছে। রেডিওকার্বন পরীক্ষায় এই পুথির ভূর্জপত্রের দুটি নমুনার কাল ১৩০-২৫০ সাধারণাব্দের মধ্যবর্তী বলে নির্ণীত গিয়েছে। ব্রিটিশ লাইব্রেরি সংগ্রহের মতো এই সংগ্রহের মৃৎপাত্রটিও সম্ভবত পূর্ব আফগানিস্তানের হাড্ডার কাছাকাছি কোনো প্রাচীন বৌদ্ধ বিহারে রাখা ছিল। অনুমান করা হয়েছে, এই পুথিগুলি সাধারণাব্দের দ্বিতীয় শতকের প্রথম দিকেই লিপিবদ্ধ করা হয়েছিল। বর্তমানে ৩৪টি কাঁচের ফ্রেমে সংরক্ষিত এই সংগ্রহে রয়েছে গান্ধারী ভাষায় রচিত ধর্মগুপ্তক নিকায়ের অন্তত ৪১টি ধর্মগ্রন্থের পাণ্ডুলিপির খণ্ডিত অংশ। সিনিয়র সংগ্রহের দুটি গুরুত্বপূর্ণ সংগ্রহ গান্ধারী ভাষায় রচিত সংস্কৃত মূলসর্বাস্তিবাদী বিনয়ের অন্তর্গত ভৈষজ্যবস্তুর একটি সূত্রের সমতুল্য একটি সূত্রের সম্পূর্ণ পাণ্ডুলিপি এবং অনবতপ্ত গাথা গ্রন্থের মঙ্গলাচরণ ও প্রথম অধ্যায়ের অংশ সমন্বিত একটি খণ্ডিত পাণ্ডুলিপি। এছাড়া গান্ধারী ভাষায় রচিত এমন দুটি সূত্রের সম্পূর্ণ পাণ্ডুলিপি সিনিয়র সংগ্রহে আছে, যার সমতুল্য কোনো সূত্র বৌদ্ধ সাহিত্যে অন্যত্র এখনও খুঁজে পাওয়া যায়নি। এই সংগ্রহের অন্যান্য খণ্ডিত পাণ্ডুলিপিগুলিতে গান্ধারী ভাষায় যে ৩৩টি সূত্রগুলি লেখা আছে আধুনিক বিদ্বজ্জনদের মতে তার সঙ্গে তুলনীয় পালি দীঘনিকায়ের অন্তর্গত সামঞঞফলসুত্ত; মজ্ঝিমনিকায়ের অন্তর্গত ধম্মচেতিয়সুত্ত, সংখারূপপত্তিসুত্ত ও চূলগোসিঙ্গসুত্ত এবং সংযুত্ত নিকায়ের অন্তর্গত বনসংযুত্তের ১৪টি সুত্ত; খন্ধসংযুত্তের দুটি নতুম্হাকসুত্ত, উপ্পাদসুত্ত, নিব্বিদাবহুলসুত্ত, বাসিজটসুত্ত, তিস্সসুত্ত, গদ্দুলবদ্ধসুত্ত, অনত্তলক্খণসুত্ত, পুপ্ফসুত্ত ও নদীসুত্ত; সোতাপত্তিসংযুত্তের বেলুদ্বারেয্যসুত্ত এবং সচ্চসংযুত্তের দুতিয়ছিগ্গলযুগসুত্ত।
বামিয়ান সংগ্রহ
১৯৯৪ সালে আফগানিস্তানের বামিয়ান অঞ্চলে স্থানীয় অধিবাসীরা ২০০১ সালে তালিবানদের দ্বারা ধ্বংসপ্রাপ্ত বিশালকায় বুদ্ধমূর্তি দুটির মধ্যে ক্ষুদ্রতর মূর্তিটির কাছাকাছি কোনো একটি গুহার ভেতরে বহু সংখ্যক পুথির সন্ধান পান। পুথিগুলি প্রত্নবস্তুর বাজারে আসার পর নরওয়ের পুথি সংগ্রাহক মার্টিন স্কোয়েন প্রথমে, ১৯৯৬ সালের গ্রীষ্মকালে, এবং তারপর, ১৯৯৭ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত ক্রমান্বয়ে এর বৃহত্তম অংশ সংগ্রহ করেন। এই সংগ্রহের বেশ কয়েক হাজার ব্রাহ্মী লিপিতে সংস্কৃত ভাষায় লেখা বিভিন্ন বৌদ্ধ ধর্মগ্রন্থের পুথির খণ্ডিত অংশ এবং ২৩৮টি খরোষ্ঠী লিপিতে সংস্কৃতায়িত গান্ধারী ভাষায় লেখা তালপাতার পুথির খণ্ডিত অংশ বর্তমানে স্পিক্কেস্টাড শহরে সংরক্ষিত আছে। খুব সম্ভবত এই পুথিগুলি সাধারণাব্দের দ্বিতীয় থেকে অষ্টম শতকের মধ্যে রচিত। গান্ধারী ভাষায় রচিত খণ্ডিত পুথিগুলির মধ্যে মহাপরিনির্বাণ সূত্র ও ৩টি মহাযানী ধর্মগ্রন্থ – ভদ্রকল্পিক সূত্র (৩৪টি খণ্ডিত অংশ), বোধিসত্ত্বপিটক সূত্র (বীর্যপারমিতা শীর্ষক নবম অধ্যায়ের অংশ) এবং সর্বপুণ্যসমুচ্চয়সমাধি সূত্র উল্লেখনীয়। সাম্প্রতিক কালে খণ্ডিত পাণ্ডুলিপিগুলির মধ্যে ২৫টি খণ্ডিত অংশকে গান্ধারী একোত্তরিক আগমের (তুলনীয় পালি অঙ্গুত্তর নিকায়) একটি পাণ্ডুলিপির অংশ বলে চিহ্নিত করা সম্ভব হয়েছে।
পরবর্তী কালে বামিয়ান অঞ্চল থেকে প্রাপ্ত খণ্ডিত পাণ্ডুলিপিগুলির বাকি অংশ জাপানে আরও পাঁচটি সংগ্রহে সংরক্ষিত হওয়ার কথা জানা গিয়েছে। কামাকুরা শহরে সংরক্ষিত জাপানি চিত্রশিল্পী ও সংগ্রাহক ইকুও হিরায়ামার সংগ্রহে ২৬টি খরোষ্ঠী লিপিতে লেখা তালপাতার পুথির খণ্ডিত অংশ রয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখনীয়, গান্ধারী ভাষায় রচিত স্কোয়েনের সংগৃহীত মহাপরিনির্বাণ সূত্র ও ভদ্রকল্পিক সূত্রের পুথির আরও ৬টি খণ্ডিত অংশ। এই সংগ্রহে ৯টি ব্রাহ্মী লিপিতে লেখা তালপাতার পুথির খণ্ডিত অংশও রয়েছে। তোয়ামা শহরে সংরক্ষিত জাপানি পুরোহিত গেনশু হায়াশিদেরার সংগ্রহে রয়েছে ১৭টি খরোষ্ঠী লিপিতে লেখা তালপাতার পুথির অংশ ও ৩৩টি ব্রাহ্মী লিপিতে লেখা তালপত্র ও ভূর্জপত্রের পুথির অংশ। খরোষ্ঠী লিপিতে লেখা পুথিগুলির মধ্যে উল্লেখনীয় স্কোয়েনের সংগৃহীত ভদ্রকল্পিক সুত্রের পুথির আরও দুটি খণ্ডিত অংশ। এছাড়া বামিয়ান অঞ্চল থেকে প্রাপ্ত কিছু খণ্ডিত পাণ্ডুলিপিগুলির অংশ মিহো সংগ্রহালয়, জাপানি আলোকচিত্রশিল্পী আতসুশি নাকার ব্যক্তিগত সংগ্রহ ও কিয়োতোর বুক্কিয়ো বিশ্ববিদ্যালয়ের সংগ্রহে রয়েছে।৫
বাজৌর সংগ্রহ
১৯৯৭ সালে খাইবার-পাখতুনখোয়া প্রদেশের বাজৌর জেলায়, সীমান্তবর্তী নিম্ন দির জেলার মিয়াঁ কিলি গ্রামের কাছে, বাজৌর নদীর ধারে ‘মহল’ নামে পরিচিত একটি প্রাচীন বৌদ্ধ বিহারের ভেতরে একটি প্রকোষ্ঠ থেকে অনেকগুলি ভূর্জপত্রের গোটানো পুথির অংশ আবিষ্কৃত হয়। ১৯৯৯ সালে পাকিস্তানের পেশাওয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্বের অধ্যাপক নাসিম খানের কাছে এই খণ্ডিত পুথিগুলি একটি কার্ডবোর্ডের বাক্সে এসে পৌঁছায়। বর্তমানে ১৯টি ভূর্জপত্রের গোটানো পুথির অংশ পেশাওয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগে ৩৫টি কাঁচের ফ্রেমে সংরক্ষিত রয়েছে। লিপির ছাঁদ থেকে এই পুথিগুলির অধিকাংশ সাধারণাব্দের প্রথম শতকের দ্বিতীয়ার্ধ থেকে দ্বিতীয় শতকের প্রথমার্ধের মধ্যবর্তী সময়ে রচিত হয়েছিল বলে অনুমান করা হয়েছে। এই সংগ্রহে গান্ধারী ভাষায় খরোষ্ঠী লিপিতে লেখা খণ্ডিত পাণ্ডুলিপিগুলির মধ্যে উল্লেখনীয় দুটি কোনো শ্রাবকযানী নিকায়ের বিনয়ের প্রাতিমোক্ষ সূত্রের অংশ, কর্মবাচনা, দক্ষিণাবিভঙ্গ সূত্র, একটি ধারণী ও একটি রক্ষাসূত্রের (সংস্কৃত মনস্বীনাগরাজ সূত্রের সমতুল্য) অত্যন্ত ক্ষুদ্র ভগ্নাংশ। ৪টি প্রাচীন মহাযানী গ্রন্থের খণ্ডিত পাণ্ডুলিপিও এই সংগ্রহে রয়েছে। এর মধ্যে একটি গ্রন্থ মহাযানী অক্ষোভ্যব্যূহ গ্রন্থের সঙ্গে তুলনীয়। এছাড়া, খরোষ্ঠী লিপিতে সংস্কৃত ভাষায় কোনো অজ্ঞাত লেখক রচিত একটি অর্থশাস্ত্র (বা রাজনীতি) বিষয়ক খণ্ডিত পাণ্ডুলিপি ও খরোষ্ঠী লিপিতে লেখা একটি ঋণ চুক্তির অংশও এই সংগ্রহে রয়েছে।
‘বিচ্ছিন্ন’ সংগ্রহ
‘বিচ্ছিন্ন’ সংগ্রহ নামে পরিচিত সংগ্রহের অন্তর্গত ভূর্জপত্রের খণ্ডিত পুথিগুলি খাইবার-পাখতুনখোয়া প্রদেশের আফগানিস্তানের সীমান্তবতী মোহমন্দ জেলায় একত্রে, একটি পাথরের বাক্সের মধ্যে খুঁজে পাওয়া গিয়েছিল। ২০০৪ সালে এই পুথিগুলিকে পেশাওয়ার শহরে দেখা গিয়েছিল। বর্তমানে, এই খণ্ডিত পাণ্ডুলিপিগুলি বিচ্ছিন্ন হয়ে, কিছু পাকিস্তানের সরকারি সংগ্রহে, কিছু একটি ব্যক্তিগত সংগ্রহে ও কিছু ইউরোপের একটি সংগ্রহশালায় সংরক্ষিত আছে। খরোষ্ঠী লিপিতে ভূর্জপত্রের ওপর গান্ধারী ভাষায় লেখা পাণ্ডুলিপিগুলির মধ্যে প্রথম পাঠোদ্ধার করা খণ্ডিত পুথিগুলির মধ্যে আছে, ধর্মপদের পূর্ণ ও আংশিক মিলিয়ে মোট ৯০টি শ্লোক (১৮৯২ সালে খোটান থেকে প্রাপ্ত গান্ধারী ধর্মপদের সঙ্গে এর মিল ও পার্থক্য লক্ষণীয়), একটি মহাযানী প্রজ্ঞাপারমিতা সূত্র গ্রন্থের অংশ (অষ্টসাহস্রিকা প্রজ্ঞাপারমিতা গ্রন্থের প্রথম ও পঞ্চম অধ্যায়ের সমতুল্য কিন্তু প্রাচীনতর রূপ), একটি অষ্টকবর্গ/ অর্থপদ সূত্র (পালি সুত্তনিপাতের অন্তর্গত অঠ্ঠকবগ্গের সঙ্গে তুলনীয়) গ্রন্থের অংশ এবং একটি ‘অবদান’ গ্রন্থের অংশ।৬ সাম্প্রতিককালে এই সংগ্রহের আরও ৭টি খণ্ডিত পুথির অংশের পাঠোদ্ধারের পর এগুলিকে আনুমানিক প্রথম বা দ্বিতীয় শতক সাধারণাব্দে রচিত একটি মহাযানী ‘প্রত্যুৎপন্নবুদ্ধসম্মুখাবস্থিতসমাধিসূত্র’ গ্রন্থের অংশ বলে চিহ্নিত করা সম্ভব হয়েছে।৭
অন্যান্য সংগ্রহ
যে ৫টি মুখ্য সংগ্রহের কথা এখানে উল্লেখ করা হল তা ছাড়াও, পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে আরও বেশ কয়েকটি ক্ষুদ্রতর সংগ্রহে গান্ধারী বৌদ্ধ ধর্মগ্রন্থের খণ্ডিত পাণ্ডুলিপি সংরক্ষিত আছে। ২০০২ সালে ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয় একটি ব্যক্তিগত সংগ্রহ থেকে একটি ভূর্জপত্রের পুথির ৮টি খণ্ডিত অংশ ও অন্য একটি ভূর্জপত্রের পুথির ২টি খণ্ডিত অংশ সংগ্রহ করে। ২০০৬ সালে ওয়াশিংটন ডিসিতে অবস্থিত লাইব্রেরি অফ কংগ্রেস আনুমানিক প্রথম শতক সাধারণপূর্বাব্দের খরোষ্ঠী লিপিতে গান্ধারী ভাষায় লেখা বহুবুদ্ধক সূত্রের একটি প্রাচীন রূপের খণ্ডিত ভূর্জপত্রের পাণ্ডুলিপি সংগ্রহ করে। রেডিওকার্বন পরীক্ষার দ্বারা প্রাপ্ত অনুমান সত্য হলে এই পাণ্ডুলিপিটি আজ পর্যন্ত প্রাপ্ত সমস্ত ভারতীয় ভাষায় লেখা পাণ্ডুলিপির মধ্যে প্রাচীনতম।
কথাশেষ
প্রাচীন বৌদ্ধ নিকায়গুলির ধর্মগ্রন্থগুলোর মধ্যে বর্তমানে স্থবিরবাদী নিকায়ের পালি ভাষায় সম্পূর্ণ ‘তিপিটক’ সংকলন এবং ধর্মগুপ্তক, মহীশাসক, মহাসাংঘিক ও সর্বাস্তিবাদী (ও মূলসর্বাস্তিবাদী) নিকায়ের সংস্কৃত (বা প্রাকৃত) ‘ত্রিপিটক’ সংকলনের সম্পূর্ণ বা আংশিক অনুবাদ চীনা ভাষায় আছে। তাছাড়া কয়েকটি প্রাচীন নিকায়ের কিছু সংস্কৃত ধর্মগ্রন্থও খুঁজে পাওয়া গিয়েছে। বিগত কয়েক দশকে গান্ধারী ভাষায় রচিত প্রায় তিন’শর কাছাকাছি ধর্মগ্রন্থের খণ্ডিত পাণ্ডুলিপি খুঁজে পাওয়া গেছে। এই প্রাচীন পাণ্ডুলিপিগুলি আবিষ্কারের পর আধুনিক বিদ্বজ্জনরা ক্রমশ উপলব্ধি করতে পেরেছেন প্রাচীন বৌদ্ধ নিকায়গুলির ধর্মগ্রন্থগুলোর ‘ত্রিপিটক’ সংকলনের ঐতিহ্যের মধ্যে যথেষ্ট পার্থক্য আছে। আধুনিক বিদ্বজ্জনরা লক্ষ্য করেছেন বেশ কিছু গান্ধারী ভাষায় লেখা ধর্মগ্রন্থের সঙ্গে তুলনা করা যায় এমন কোনো গ্রন্থের অস্তিত্ব পালি, সংস্কৃত বা চীনা অনুবাদে নেই।
থেরবাদী বৌদ্ধ ঐতিহ্য অনুযায়ী ‘বুদ্ধবচন’ অর্থাৎ বুদ্ধের বাণী ‘মাগধী’ ভাষায় বৌদ্ধ সংঘে প্রচারিত হয়েছিল। সম্ভবত গৌতম বুদ্ধ মাগধী নামে পরিচিত ষষ্ঠ-পঞ্চম শতক সাধারণপূর্বাব্দের কোনো মধ্য ভারতীয় আর্যভাষাতেই তাঁর উপদেশ দিয়েছিলেন এবং ‘ভাণক’ নামে অভিহিত ভিক্ষুরা সেই উপদেশ স্মৃতি থেকে আবৃত্তি করে ধর্ম প্রচার করতেন। বুদ্ধের মহাপরিনির্বাণের পর রাজগৃহের প্রথম বৌদ্ধ সঙ্গীতিতে এই প্রাচীন মাগধী ভাষাতেই ‘বুদ্ধবচন’ অর্থাৎ বুদ্ধ নির্দেশিত সংঘের নিয়মবিধি ও ধর্মীয় উপদেশসংক্রান্ত সূত্রসমূহ সংকলনের কাজ শুরু হয়। বৌদ্ধ সঙ্গীতিগুলিতে যে বিদ্বজ্জনরা এই সংকলনের দায়িত্বে ছিলেন, সম্ভবত তাঁদেরই ‘সঙ্গীতিকার’ বলে অভিহিত করা হয়েছে। পরবর্তী কালে বিনয়পিটক ও সূত্রপিটকে সংকলিত এই সূত্রগুলির প্রাচীন মাগধী ভাষার আদিরূপটি সম্পর্কে আমরা এখনও বিশেষ কিছু জানতে পারিনি। প্রথম বৌদ্ধ সঙ্গীতির পরবর্তী কয়েক শতকে সংঘের বিভাজনের ফলে উদ্ভূত বিভিন্ন ভারতীয় নিকায়ের বৌদ্ধ বিদ্বজ্জনরা এই সূত্রগুলিকে প্রাচীন মাগধী রূপ থেকে সংস্কৃত ও বিভিন্ন মধ্য ভারতীয় আর্যভাষায় (যেমন, পালি ও গান্ধারী) নিজেদের মতো করে অনুবাদ ও সংকলন করেছিলেন এবং ‘অভিধর্ম’ অর্থাৎ বৌদ্ধ ধর্মের সিদ্ধান্তসমূহ রচনা করেছিলেন। বিভিন্ন প্রাচীন নিকায়ের ধর্মগ্রন্থগুলি কখন বা কী ভাষায় প্রথম লিখিত রূপ গ্রহণ করেছিল তা অবশ্য নিশ্চিতভাবে বলা সম্ভব নয়। শ্রীলঙ্কার থেরবাদী ঐতিহ্য অনুযায়ী ঐ নিকায়ের ধর্মগ্রন্থগুলি প্রথম শতক সাধারণপূর্বাব্দে প্রথম লিখিত রূপ গ্রহণ করেছিল।৮ রেডিওকার্বন পদ্ধতিতে প্রাচীনতম গান্ধারী ধর্মগ্রন্থের পাণ্ডুলিপিও একই সময়কার বলে জানা গিয়েছে। একমাত্র ধর্মীয় চিন্তার ঐক্য ছাড়া প্রাচীন নিকায়গুলির ধর্মগ্রন্থগুলির রচনার মধ্যে খুব বেশি মিল ছিল না। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, বর্তমানে আছে স্থবিরবাদী নিকায়ের পালি ধম্মপদ, ধর্মগুপ্তক নিকায়ের গান্ধারী ধর্মপদ, সম্মিতীয় নিকায়ের সংস্কৃত ধর্মপদ, মহাসাংঘিকদের থেকে উদ্ভূত লোকোত্তরবাদীদের মিশ্রিত সংস্কৃত ও প্রাকৃতে রচিত মহাবস্তু এবং সর্বাস্তিবাদীদের সংস্কৃত উদানবর্গের মধ্যে কিছু মিল থাকলেও যথেষ্ট পার্থক্য রয়েছে। বর্তমানে পাওয়া না গেলেও প্রাচীন চীনা গ্রন্থ থেকে কাশ্যপীয়, মহীশাসক ও বাৎসীপুত্রীয় নিকায়েরও নিজস্ব পৃথক ধর্মপদ গ্রন্থ ছিল বলে জানা গিয়েছে। ক্রমশই এই ধারণা স্পষ্ট হচ্ছে যে, প্রত্যেকটি প্রাচীন বৌদ্ধ নিকায়ের ধর্মগ্রন্থসমূহ এবং গ্রন্থগুলোর সংকলনের নিজস্ব পৃথক ঐতিহ্য আছে ছিল এবং স্থবিরবাদীদের পালি ‘তিপিটক’ বা চীনা ভাষায় অনূদিত ‘ত্রিপিটক’ সংকলনের অন্তর্গত বৌদ্ধ ধর্মগ্রন্থগুলির প্রথমে পৃথক স্বতন্ত্র অস্তিত্ব ছিল। তবে, প্রত্যেকটি প্রাচীন বৌদ্ধ নিকায়ের নিজস্ব ধর্মগ্রন্থগুলোর সংকলন আদৌ একটি নির্দিষ্ট ‘ত্রিপিটক’ সংকলনের আকার নিয়েছিল কিনা এ বিষয়ে আধুনিক বিদ্বজ্জনদের মধ্যে মতদ্বৈধ আছে।
ভবিষ্যতে আরও কিছু প্রাচীন বৌদ্ধ পুথি আবিষ্কার হলেও শ্রাবকযানী বৌদ্ধ নিকায়গুলির ধর্মগ্রন্থগুলোর সংকলনের অধিকাংশ গ্রন্থেরই পাণ্ডুলিপি হয়তো কোনোও দিনই খুঁজে পাওয়া সম্ভব হবে না। তাই বৌদ্ধ ধর্মীয় সাহিত্য রচনার প্রাচীনতম পর্বের সম্পূর্ণ ইতিহাস সম্ভবত আমাদের কাছে অজ্ঞাতই থেকে যাবে। তা সত্ত্বেও প্রাচীন গান্ধারী বৌদ্ধ সাহিত্যের আবিষ্কার ও পাঠোদ্ধার এই ইতিহাসের অন্ধকারাচ্ছন্ন দিকগুলিকে ক্রমাগত আলোকিত করে তুলছে। কিছু গান্ধারী পাণ্ডুলিপি থেকে মহাযানী মতের প্রাথমিক পর্বের কিছু ভাবনার প্রতিফলনও খুঁজে পাওয়া গিয়েছে। তবে গান্ধারের বৌদ্ধ বিহারগুলিতে ঠিক কবে ও কীভাবে মহাযানী মতের সঙ্গে যুক্ত ধারণাগুলির চর্চা শুরু হয়েছিল এবং কেমন করে সেই মত অন্যত্র ছড়িয়ে পড়েছিল, সেই ইতিহাস অবশ্য এখনও খুব স্পষ্ট নয়।
পাদটীকা
- Ramaprasad Chanda, “The Jauliāñ Manuscript” in John Marshall edited, ‘Excavations at Taxila: The Stupas and Monasteries at Jauliāñ’; Calcutta: Superintendent Government Printing, India, 1921, pp. 66-75.
- Mark Allon, “Recent Discoveries of Buddhist Manuscripts From Afghanistan and Pakistan and Their Significance” in Ken Parry edited, ‘Art, Architecture and Religion Along the Silk Routes’; Turnhout: Brepols Publishers, 2008, pp. 156-158.
- Xavier Tremblay, “The Spread of Buddhism in Serindia—Buddhism among Iranians, Tocharians and Turks before the 13th century” in Ann Heirman and Stephan Peter Bumbacher edited, ‘The Spread of Buddhism’; Leiden: Brill, 2007, p. 97.
- H.W. Bailey, “Gāndhārī” in ‘Bulletin of the School of Oriental and African Studies, University of London, Vol. 11, No. 4’; Cambridge University Press, 1946, pp. 764-797.
- Kazunobu Matsuda, “Japanese Collections of Buddhist Manuscript Fragments from the Same Region as the Schøyen Collection” in Harrison, P. and J. Hartmann edited, ‘From Birch Bark to Digital Data: Recent Advances in Buddhist Manuscript Research’; Vienna: Österreichische Akademie der Wissenschaften, 2014, pp. 165-170.
- Harry Falk, “The ‘Split’ Collection of Kharoṣṭhī Texts” in ‘Annual Report of the International Research Institute for Advanced Buddhology at Soka University for the Academic Year 2010, Volume XIV’; Tokyo: The International Research Institute for Advanced Buddhology at Soka University, 2011, pp. 12-23.
- Paul Harrison, Timothy Lenz and Richard Salomon, “Fragments of a Gāndhārī Manuscript of the Pratyutpannabuddhasaṃmukhāvasthitasamādhisūtra (Studies in Gāndhārī Manuscripts 1)” in ‘Journal of the International Association of Buddhist Studies, Volume 41’; International Association of Buddhist Studies, 2018, pp. 117-143.
- K.R. Norman, ‘A Philological Approach to Buddhism’; London: School of Oriental and African Studies, University of London, 1997, p. 35.
তথ্যসূত্র
- Pia Brancaccio and Kurt Behrendt edited, ‘Gandhāran Buddhism: Archaeology, Art, Texts’; Vancouver: UBC Press, 2006.
- Harry Falk and Ingo Strauch, “The Bajaur and Split Collections of Kharoṣṭhī Manuscripts within the Context of Buddhist Gāndhārī Literature” in Harrison, P. and J. Hartmann edited, ‘From Birch Bark to Digital Data: Recent Advances in Buddhist Manuscript Research’; Vienna: Österreichische Akademie der Wissenschaften, 2014, pp. 51-78.
- Jens Braarvig edited, ‘Manuscripts in the Schøyen Collection: Buddhist Manuscripts, Volume IV,’; Oslo: Hermes Publishing, 2016.
- Richard Saloman, ‘Ancient Buddhist Scrolls from Gandhāra’; Seatle: University of Washington Press, 1999.
- Richard Saloman, “The Senior Manuscripts: Another Collection of Gandhāran Buddhist Scrolls” in ‘Journal of the American Oriental Society, Vol. 123, No. 1 (Jan. – Mar. 2003)’; 2003, pp. 73-92.
- Richard Saloman, “Recent Discoveries of Early Buddhist Manuscripts” in P. Olivelle edited, ‘Between the Empires: Society in India 300 BCE to 400 CE’; New York: Oxford University Press, 2006, pp. 349-382.
- Richard Saloman, ‘The Buddhist Literature of Ancient Gandhara: An Introduction with Selected Translations’; Somerville: Wisdom Publications, 2018.
- Ingo Strauch, “The Bajaur Collection of Kharoṣṭhī Manuscripts – A Preliminary Survey” in ‘Studien zur Indologie und Iranistik 25’; 2008, pp. 103-136.
- Mark Allon, “Introduction: The Senior Manuscripts” in Andrew Glass, with a contribution by Mark Allon, ‘Four Gāndhārī Saṃyuktāgama Sūtras: Senior Kharoṣṭhī Fragment 5’; Seatle: University of Washington Press, 2007, pp. 3-25.
- Andrea Schlosser, ‘Three Early Mahāyāna Treatises from Gandhāra: Bajaur Kharoṣṭhī Fragments 4, 6, and 11, Gandhāran Buddhist Texts, Volume 7’; Seattle: University of Washington Press, 2022.
অত্যন্ত সুলিখিত ও অসাধারণ তথ্যসমৃদ্ধ একটি প্রবন্ধ। একটা অজানা বা অপ্রচারিত বিষয়ে জানার আগ্র আরও বাড়িয়ে দেয়।
ধন্যবাদ এমন প্রবন্ধটি উপহার দেওয়ার জন্য।
অশেষ কৃতজ্ঞতা জানাই।
চমৎকার লেখা। বুদ্ধের ভাষা মাগধী থেকে কেন অন্য ভাষায় ধর্মগ্রন্থগুলো রূপান্তর হল তার ব্যাখ্যা জানার আগ্রহ রয়েছে। এর সামাজিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষণ।
এছাড়া বাংলা ভাষা সৃষ্টির আগে বাংলা অঞ্চলে যে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা ছিলেন তারা কোন কোন ভাষা চর্চা করতেন সেটা নিয়ে বিশদ পড়ার আগ্রহ রয়েছে। আশা করি লেখক এসব বিষয়ে আশা পূরণ করবে পরবর্তী লেখায়।
প্রথমে আপনার সুচিন্তিত মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ জানাই। আপনি দু’টি বিষয়ের উল্লেখ করেছেন। প্রথম বিষয়টি নিয়ে ইতিমধ্যেই আধুনিক বিদ্বানদের চর্চার কথা জানি, অতএব লেখা সহজ। দ্বিতীয় বিষয়টি নিয়ে চর্চার সম্পর্কে আমি এখনও বিশেষ কিছু জানি না বলে লেখা তুলনামূলকভাবে কঠিন। ভবিষ্যতে নিশ্চয়ই এই দুই বিষয় নিয়ে লেখার চেষ্টা করব।
খুব ভালো লাগলো জেনে যে কোন সুত্রে প্রাচীন ভাষাগুলো ইতিহাসের অজানা তথ্য আস্তে আস্তে অনাবৃত হয়ে উঠেছে। বৌদ্ধধর্ম পল্লবীত হয়ে ওঠার আগে থেকেই উল্লেখযোগ্য ভূমিকা ছিল গান্ধারী ভাষার । হয়তো বা অনুমান যোগ্য ইতিহাস এর হারিয়ে যাওয়া অংশ এই ভাবে প্রকাশিত হবে আগামী দিনে।
ভীষণ ভালো লাগলো, এছাড়া আমাদের তো আর কোনো উপায় ছিল না। ঋদ্ধ হলাম।
মন্তব্যের জন্য অশেষ ধন্যবাদ।