আধুনিক বিজ্ঞানের আলোকে সুকুমারী ভট্টাচার্যের বৈদিক সময়কালের সামাজিক গবেষণা নিয়ে দু-চার কথা
পূর্বকথা
অধ্যাপিকা সুকুমারী ভট্টাচার্য ছিলেন সংস্কৃত সাহিত্যের অসামান্য পণ্ডিত এবং বিশিষ্ট ঐতিহাসিক। তাঁর গবেষণার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল বৈদিক যুগ ও তৎপরবর্তী সময়ের ভারতীয় সাহিত্য। বিশেষভাবে বৈদিক যুগে বিভিন্ন পেশার মানুষের সামাজিক অবস্থান, সেই সময়ে সমাজে নারীর স্থান, ধীরে ধীরে বর্ণ প্রথার প্রবর্তন, পরবর্তীকালে বেদবিরোধী ধর্মগুলির উন্মেষ নিয়ে সুকুমারী ভট্টাচার্যের চর্চা নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে বৈদিক যুগকে দেখতে বাধ্য করে। তাঁর লেখায় শুধু তথ্য পরিবেশিত হয়নি, সেই তথ্যের বিশ্লেষণের ফলে বেদ, উপনিষদ, রামায়ণ, মহাভারত বা পুরাণ নিয়ে ইতিহাসভিত্তিক গবেষণায় যুক্ত হয়েছে নতুন মাত্রা। তাঁর গবেষণাধর্মী রচনা বেদ ও বৈদিক সমাজ, হিন্দু ও বৌদ্ধ ধর্মের তুলনামূলক বিশ্লেষণ ইত্যাদি নিয়ে বহু গুণীজন আলোচনা করেছেন। ভবিষ্যতে এ নিয়ে আরও চর্চা হবে। আর্যভাষীদের ভারতে আগমন, এই দেশে এসে তখনকার দেশজদের সাথে তাদের মিশ্রণ ও তাঁর ফলে জাত মিশ্রসংস্কৃতি ইত্যাদি নিয়ে অধ্যাপিকা ভট্টাচার্যের গবেষণাধর্মী লেখা পাঠককে আজও মগ্ন করে।
বিজ্ঞানের নবতম জ্ঞান আধুনিক জিনবিদ্যা বা জেনেটিক্স ভারতবর্ষ তথা পৃথিবীর প্রাচীন ইতিহাস সন্ধানে ব্যবহৃত হচ্ছে, এবং খুব কম সময়ে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছে। মূলত সেই আধুনিক জিনবিদ্যা বা জেনেটিক্স-এর কিছু প্রকৌশলের সাহায্যে অধ্যাপিকা ভট্টাচার্যের বৈদিক সময়কালের সামাজিক গবেষণাকে লেন্সের নিচে ফেলে এই প্রবন্ধের স্বল্প পরিসরে আলোচনা করব। বিজ্ঞান, সাহিত্য ও সাহিত্যসঞ্জাত ইতিহাসকে বিশ্লেষণ করে মেলানো সহজ নয়। আর তাদের প্রস্থচ্ছেদও খুব বেশি না। তবু কিছু তথ্য ও তত্ত্বের বিশ্লেষণ হয়তো সম্ভব।
সূত্রপাত
জিনবিদ্যার সাহায্যে পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ভারতবর্ষে আগত জনগোষ্ঠীর পরিযানগুলির সময়, উৎসস্থল ও তাদের মিশ্রণ নিয়ে বিজ্ঞানভিত্তিক গবেষণা শুরু হয়েছে। বিশেষ করে শেষ দশ বছরে মানুষের অভিবাসনচর্চা এবং জাতি গঠনের ধারণায় এই বিদ্যাচর্চা অতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছে। দেখা যাক, ভারতবর্ষের বৈদিক সময়কাল, তাদের সমাজব্যবস্থা ইত্যাদি নিয়ে ওই আলোচনা আমাদের কোথায় নিয়ে যায় আর অধ্যাপিকা ভট্টাচার্যের বক্তব্যের সাথে তার সংযোগ কতটা।
জিনবিদ্যার সহায়তায় দুই ধরনের উৎস থেকে বিজ্ঞানীরা তাদের প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহ করেন — আজকের মানুষের দেহকোষের মধ্যে থাকা ডিএনএ এবং প্রাচীন কঙ্কাল থেকে আহৃত ডিএনএ। আমার বা আপনার ডিএনএ বিশ্লেষণ করে আমাদের পূর্বসূরীদের উৎসের খোঁজ পাওয়া যায়। আবার কঙ্কালের প্রাচীন ডিএনএ বিশ্লেষণ করে যেখানে কঙ্কাল পাওয়া গেছে সেই অঞ্চলে যে পরিযান বা মাইগ্রেশন হয়েছিল তার সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা গড়ে তুলতে পারা যায়। সাম্প্রতিককালে প্রাচীন ডিএনএ বিশ্লেষণ করে পাওয়া তথ্য বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর পরিযানের গতিপথের দিশা দেখাচ্ছে।
আর্যভাষীদের ভারত আগমন ও ও ঋগ্বেদ রচনার সময়কাল
বেদ কারা রচনা করেছে? যারা বেদ রচনা করেছে তারা কোথা থেকে এল? এই আলোচনা আজ জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই আলোচনা সার্বিকভাবে করবার জন্য বিজ্ঞান, বৈদিক সাহিত্য, ভাষাতত্ত্ব ও শব্দতত্ত্ব, প্রাচীন ইতিহাস ও প্রত্নতত্ত্বের হাত মেলানো দরকার। জানা দরকার এই বিষয়ে বৈদিক সাহিত্য কী তথ্য দেয়।
দীর্ঘদিন ধরে জিনবিদদের মধ্যে দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন জাতির মানুষের উৎস নিয়ে আগ্রহ আছে। তবে এই কাজে কিছুদিন আগেও তেমন অগ্রগতি হয়নি। কারণ এই অঞ্চলের উষ্ণ এবং আর্দ্র জলবায়ুর জন্য প্রাচীন কঙ্কাল তেমন পাওয়া যায় না। কঙ্কাল থাকে মাটির গভীরে। সময়ের সাথে সাথে সেই দেহাবশেষ থেকে সংগৃহিত প্রাচীন ডিএনএ-র আয়ু হ্রাস পায়। শেষ পর্যন্ত একটা সময়ে এদের আর বিশ্লেষণ করা যায় না।
এইসব নানা প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও দক্ষিণ এশিয়ার জাতিগোষ্ঠীর পুনর্নির্মাণে শেষ পর্যন্ত বিভিন্ন দেশি ও বিদেশি জিনবিদ ও নৃতত্ত্ববিদ একসাথে কয়েক বছর আগে থেকে গবেষণা শুরু করেন। এই গবেষণা প্রকল্পে তারা ৮,০০০ বছর আগের থেকে লৌহ যুগ পর্যন্ত বিভিন্ন সময়কালের ৫২৩টি প্রাচীন কঙ্কাল সংগ্রহ করে ডিএনএ বিশ্লেষণ করেন। এর মধ্যে কিছু আছে নব্যপ্রস্তর যুগের, কিছু ব্রোঞ্জ ও লৌহ যুগের। এগুলি সংগৃহীত হয়েছিল ইরান, তুরান (আজকের উজবেকিস্তান, তুর্কমেনিস্তান, কাজাখস্তান) ও পাকিস্তান থেকে।১
এইসব কঙ্কালের ডিএনএ বিশ্লেষণ করে বোঝা যায় যে, ভারতীয় উপমহাদেশের প্রাচীনতম অধিবাসী হল আজকের আন্দামান দ্বীপপুঞ্জের শিকারী-সংগ্রাহকরা। প্রায় ৬৫,০০০ বছর আগে আফ্রিকা থেকে একদল মানুষ ভারতবর্ষে এসেছিল। দীর্ঘদিন তারা এই দেশের প্রত্যন্ত প্রান্তরে পশু, পাখি ও মাছ শিকার করে এবং ফল মূল সংগ্রহ করে দিনাতিপাত করেছে। তারপরে ১২,০০০ বছর আগে আবার শুরু হয় সিন্ধু নদের তীরে নতুন মানুষের আগমন। এই দ্বিতীয় পরিযান হয়েছে ইরান দেশ থেকে। ভারতের প্রাচীন শিকারী-সংগ্রাহকদের সঙ্গে এদের মিশ্রণে আনুমানিক ৪,৬০০ বছর আগে থেকে ওই মিশ্র জনগোষ্ঠী শুরু করেছিল মহতী হরপ্পীয় সভ্যতা।
এরপর প্রায় ৪,০০০ থেকে ৩,৫০০ বছর আগে, মধ্য-এশিয়ার স্তেপ অঞ্চল (চিত্র-১) থেকে ইন্দো-ইউরোপীয় পশুপালকরা দলে দলে প্রবেশ করে উত্তর ভারতে। আজকে রাশিয়া, তুরান ও পাকিস্তানে প্রাপ্ত প্রাচীন কঙ্কালের ডিএনএ বিশ্লেষণ করে ভারতবর্ষের বিভিন্ন পরিযানগুলিকে শনাক্ত করা গেছে। তাদের যাত্রাপথও কিছুটা নির্ধারণ করা গেছে।
আবার আজকের ভারতের মানুষের ডিএনএ বিশ্লেষণ করেও ইন্দো-ইউরোপীয় জিনের সন্ধান পাওয়া যায়।
ডিএনএ বিশ্লেষণ করা তথ্যের সাহায্যে জিনবিদরা দাবি করেন যে, আলতাই পর্বতের কাছে সেন্ট্রাল স্তেপভূমির ‘ইন্দো-ইউরোপীয়’ জনগোষ্ঠী ছিল অর্ধ-যাযাবর পশুপালক। স্তেপভূমি থেকে ঘোড়ায় টানা রথে চড়ে এরা অক্ষু নদীর তীরে উত্তর আফগানিস্তান-দক্ষিণ উজবেকিস্তানের ‘ব্যাকট্রিয়া-মার্জিয়ানা আর্কিওলজিক্যাল কমপ্লেক্স’ হয়ে ৩,৫০০ বছর আগে হিন্দুকুশ পর্বতের দিক থেকে এসে পড়ে ভারতভূমিতে। এদের ভাষা ছিল ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাগোষ্ঠীর বৈদিক সংস্কৃত।১
স্তেপভূমি
সেই যাত্রাপথের প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদান এখনও বিশেষ পাওয়া যায়নি। ভারতের পশ্চিমাঞ্চলে সিন্ধু ও তাঁর শাখা নদীগুলির বন্যা ও তার ফলে পাললিক মাটির জন্য সেই সময়ের প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদান পাওয়া অতিশয় কঠিন। তবে পাকিস্তানের সোয়াট উপত্যকার প্রত্নস্থল থেকে, আজ থেকে ৩,২০০ বছর থেকে ২,০০০ বছর আগের, বিভিন্ন দেহাবশেষের যে জিনোম সিকোয়েন্স করা হয়েছিল তাতে ইন্দো-ইউরোপীয় ডিএনএ-এর সন্ধান পাওয়া যায়।
অন্ততপক্ষে ৩,২০০ বছর আগে ইন্দো-ইউরোপীয়রা ভারতবর্ষে ঢুকে গেছে।
সুকুমারী ভট্টাচার্য মনে করেন ইন্দো-ইউরোপীয়রা বিভিন্ন দলে ভারতে এসেছে। তারা যখন এসেছে তখন হরপ্পীয় সভ্যতা অস্তগামী। বিশ্লেষণ করা যাক সুকুমারী ভট্টাচার্যের কিছু গ্রন্থে ঋগ্বেদ, তাদের বাহক ও সেই বাহকদের উৎস নিয়ে বিভিন্ন আলোচনা।
সুকুমারী ভট্টাচার্য তাঁর ‘প্রাচীন ভারত: সমাজ ও সাহিত্য’-তে সাধারণভাবে ঋগ্বেদের রচনাকাল উল্লেখ করেছেন। “পণ্ডিতেরা বলেন ঋগ্বেদসংহিতার রচনাকাল ১,২০০ থেকে ৯০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ।”২ পরে ওই গ্রন্থেই আবারও এই বিষয়টা কিছুটা বিশ্লেষণ করেছেন, “মোটামুটি ১,৫০০ থেকে ১,০০০ বা ৯০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ হচ্ছে ঋক মন্ত্রগুলির রচনাকাল। এ সময়ে সাহিত্য সম্বন্ধে কোনোও আলোচনা শুরু হয় নি, স্বতঃস্ফূর্তি ও স্বচ্ছতা এ কাব্যের প্রধান গুণ।”২
অর্থাৎ আজ থেকে ৩,৫০০ থেকে ২,৯০০ বছর আগে ঋগ্বেদ রচনা হয় বলে তিনি ইঙ্গিত করেছেন। এই সময়কাল মোটামুটিভাবে আজকের বৈজ্ঞানিক তথ্যপ্রমাণের সাথে মিলে যায়।
পরবর্তীকালে ‘বৈদিক সাহিত্যের রূপরেখা’ গ্রন্থে এই বিষয়ে তিনি কিছুটা বিশদভাবে নিজ মতামত ব্যক্ত করেছেন। এই ধরণের আলোচনাতে একত্রিত জ্ঞানের চর্চা যে প্রয়োজনীয়, সেকথা তিনি ইঙ্গিত করেছেন। বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য যে, নৃতত্ত্ব, ভাষাতত্ত্ব, দর্শন, ব্যাকরণ ইত্যাদি ধ্রুপদী বিষয় শুধু নয়, তিনি কোষবিশারদদের সাহায্য নেওয়ার কথাও বলেছেন। এখানে কোষবিশারদ হল আজকের জিনবিদ বা জেনেটিসিস্ট।৩
বৈদিক সাহিত্য আলোচনা করতে গিয়ে তিনি বস্তুবাদী দৃষ্টিতে বেদকে বিশ্লেষণ করেন, “ঐতিহাসিক উপাদান সামান্য হলেও যতোটুকু আমরা পেয়েছি তাকে উপেক্ষা করার ফলে বৈদিক সাহিত্যের আলোচনা একদেশদর্শিতায় আক্রান্ত। এমন একটা ভুল ধারণা এখানে ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে যে, বৈদিক সাহিত্যের কোনো বস্তুগত উৎস নেই। শূন্যের মধ্যেই তাঁর সৃষ্টি।”৩
বেদ ‘অপৌরুষেয়’ (‘পুরুষ’ দ্বারা কৃত নয়, অলৌকিক) এবং ‘নৈর্ব্যক্তিক ও রচয়িতা-শূন্য’ (যা সাকার নির্গুণ ঈশ্বর-সম্বন্ধীয় এবং যার কোনোও রচয়িতা নেই) বলা যায় না। বেদ রচনা করা হয়েছে। কারা করেছে এবার তা নিয়ে আলোচনা করা যাক।
তিনি বলেন, “ইন্দো-ইউরোপীয় জনগোষ্ঠীর যে শাখা শেষ পর্যন্ত ভারতে পৌঁছেছিল, ইরানের মধ্যে দিয়েই তারা এ দেশে আসে। সম্ভবত তারা কাসাইটদের প্রতিবেশীরূপে কিছুকাল কাটিয়েছে — এই কাসাইট শাখা, বস্তুত, ইন্দো-ইউরোপীয়দের সেই গোষ্ঠী যারা মূল জনস্রোত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে খ্রিস্টপূর্ব ষোড়শ শতকের কাছাকাছি সময়ে ইরানে বসতি স্থাপন করে। গবেষকরা আরও বলেন যে, খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় সহস্রাব্দের দ্বিতীয়ার্ধে অজস্র ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দল ইরান থেকে ভারতবর্ষে নতুন বসতির খোঁজে এসেছিল। অনুমান করা যায়, ১,৩০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ নাগাদ ইরানিদের সঙ্গে প্রত্ন-ভারতীয় আর্যজনগোষ্ঠীর তুমুল মতান্তর ও বিচ্ছেদ ঘটে এবং দক্ষিণ-পূর্ব দিকে ভ্রমণ (পরিযান) করতে করতে এরা একসময়ে ভারতবর্ষে উপস্থিত হয়। এই গোষ্ঠীর আগমনের কিছু পূর্বে, সম্ভবত ১,৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের কাছাকাছি, অন্য একদল ইন্দো-ইউরোপীয় গোষ্ঠী খাইবার গিরিপথ দিয়ে বাল্খ উপত্যকায় উপস্থিত হয়। পণ্ডিতদের মতে, এই সব জনগোষ্ঠীর মধ্যে শেষোক্তরা পরবর্তীকালে বৈদিক আর্য হিসাবে পরিচিত হয়েছিল, কিন্তু প্রথমোক্তরা পূর্বেই ইরান থেকে অল্প সংখ্যায় ভারতবর্ষে এসে শান্তিপূর্ণভাবে প্রাগার্যদের সাথে মিশে গিয়ে আর্যাবর্তে বসত স্থাপন করেছিল।”৩
অধ্যাপিকা ভট্টাচার্য বিশদে লিখেছেন বিভিন্ন ইন্দো-ইউরোপীয় জনগোষ্ঠীর ভারতবর্ষে আগমনের যাত্রাপথ। আগেই উল্লেখ করেছি, জিনবিদরা এখনও পর্যন্ত স্তেপভূমির অর্ধ-যাযাবরদের যে পথ পরিক্রমার বিবরণ দিয়েছেন, সে পথেই অবস্থিত উত্তর আফগানিস্তান-দক্ষিণ উজবেকিস্তানের ‘ব্যাকট্রিয়া-মার্জিয়ানা আর্কিওলজিক্যাল কমপ্লেক্স’। খেয়াল রাখতে হবে, পূর্বতন ব্যাকট্রিয়া হল আজকের বাল্খ। হিন্দুকুশ পর্বতের খাইবার গিরিপথ দিয়ে তারা এই ভারতভূমিতে প্রবেশ করে। জিনবিদরা স্তেপভূমির পশুপালকদের পূর্ণ যাত্রাপথ এখনও আঁকতে পারেননি। পরবর্তীকালে বৈজ্ঞানিক প্রমানের সাহায্যে এই যাত্রাপথ আরও পূর্ণতা পাবে এই বিষয়ে সন্দেহ নেই। তবে ওদের সেই যাত্রায় ইরান, উত্তর আফগানিস্তান ও হিন্দুকুশ পর্বত ছিল এ বিষয়ে সন্দেহ নেই।
এই বিষয়ে ভাষাতত্ত্ববিদদের সিদ্ধান্ত একবার আলোচনা করা যাক। প্রায় পৌনে তিনশো বছর আগের থেকে উত্তর ভারত, ইরান ও ইউরোপের বিভিন্ন ভাষার মধ্যে এক অভিন্নতা ভাষা তত্ত্ববিদরা লক্ষ্য করেন। আজকের ইউরেশিয়া জুড়ে ছড়িয়ে থাকা বিভিন্ন অঞ্চলে ভাষাগুলির সাদৃশ্য প্রাচীন কোনো এক সময়ে এদের মধ্যে দৃঢ় সাংস্কৃতিক সংযোগের ইঙ্গিত দেয়। এই পর্যবেক্ষণ প্রমাণ করে (প্রাক-) ইতিহাসে এদের মধ্যে কোনো এক সংযোগ ছিল। সমগ্র ইউরোপীয় ও প্রাচ্যের কিছু ভাষার উৎসের সন্ধানে সেই সময় থেকেই এক আদি ভাষার খোঁজ চলে। শেষ পর্যন্ত বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি অবলম্বন করে এই ভাষাগুলি নিয়ে এক ভাষা বৃক্ষ তৈরি করা হয়। এক আদি ভাষা থেকে বিচ্ছিন্ন শাখা প্রশাখাগুলি প্রাচীন ও আধুনিক ইউরোপীয় এবং পশ্চিম ও দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন ভাষা হিসেবে শনাক্ত করা হয়ে। এই আদি ভাষার নাম দেওয়া হয় ‘প্রোটো-ইন্দো ইউরোপীয়’ ভাষা। মনে করা হয় প্রোটো-ইন্দো ইউরোপীয় থেকেই পরবর্তীকালে ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাগুলির উৎপত্তি। আজকে অধিকাংশ ভাষাবিদ মনে করেন প্রায় ৬,৫০০ বছর আগে পন্টিক-স্তেপ অর্থাৎ কৃষ্ণসাগর ও কাস্পিয়ান সাগরের মধ্যবর্তী কোনো অঞ্চলে এক দল পশুপালক প্রোটো-ইন্দো ইউরোপীয় ভাষায় কথা বলত। তারা ঘোড়া ও চাকার ব্যবহার জানত। ওদের সাথেই ওই ভাষা ও তার থেকে উদ্ভূত বিভিন্ন উপভাষা কাস্পিয়ান সাগরের পশ্চিম দিকে ও পরবর্তীকালে দক্ষিণ দিকে বিস্তার লাভ করে।
বিখ্যাত শব্দতত্ত্ববিদ মাইকেল উইটজেল প্রাচীন সাহিত্যগুলির তুলনামূলক আলোচনা করে দেখিয়েছেন যে, আজকের বেশির ভাগ উত্তর ভারতীয় ভাষা এবং তাদের পূর্ববর্তী ভাষা যেমন বৈদিক সংস্কৃত, পালি, প্রাকৃত ইত্যাদি অন্য দেশের ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষার সাথে সম্পর্কিত। ভারতের ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা প্রাচীন হিট্টীয়, ইরানের প্রাচীন ফার্সী, পশতু ইত্যাদির সাথে সম্পর্কিত। বৃহত্তর পঞ্জাব অঞ্চলে ইউরেশীয়রা আসবার সময়ে যেসব শব্দবন্ধ নিজেদের ভাষায় যুক্ত করেছে তাই দিয়ে ওদের আসার পথ, এদেশে আসার সময়কাল, বেদের সময় ইত্যাদি গণনা করা যায়।৪
মাইকেল উইটজেল ‘বিয়ণ্ড দ্য ফ্লাইট অফ দ্য ফ্যালকন্স’ প্রবন্ধে প্রাচীন সাহিত্যগুলি থেকে বিভিন্ন শব্দবন্ধ উদ্ধৃত করে দেখিয়েছেন যে, ঋগ্বেদ ব্রোঞ্জ যুগের শেষের দিকে, আজ থেকে ৩,২০০ থেকে ৩,০০০ বছর আগে রচিত। উত্তর মেসোপটেমিয়ায় মিত্তানী ভাষা ঋগ্বেদের একটু পূর্ববর্তী সময়ের। ১,৩৮০ সাধারণ পূর্বাব্দের (খ্রিস্টপূর্বাব্দ-এর সাংস্কৃতিকভাবে নিরপেক্ষ শব্দ) কাছাকাছি মিত্তানী ও হিট্টীয়দের (ব্রোঞ্জ যুগের আনাতোলিয়ার ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাভাষী) মধ্যে যে চুক্তি হয় তাতে বিভিন্ন বৈদিক দেবতা, যেমন মিত্র, বরুণ, ইন্দ্র ইত্যাদির উল্লেখ আছে। মিত্তানীতে যেসব ইন্দো-ইউরোপীয় শব্দ আছে সেগুলি বৈদিক ইন্দো-আর্য ভাষার থেকে সামান্য প্রাচীন। সেসব তুলনা করে উইটজেল বলেছেন ঋগ্বেদ কোনোমতেই ৩,৪০০ বছরের বেশি আগে রচিত হতে পারে না। এই সময়কাল ইন্দো-ইউরোপীয়দের নিয়ে জিনবিদদের গবেষণা ও সিদ্ধান্তের সঙ্গে মোটমাট মিলে যায়।৪
সুকুমারী ভট্টাচার্যের বৈদিক সাহিত্য, জিনবিদ্যার চর্চা বা আধুনিক শব্দতত্ত্ব বিশ্লেষণ করা তথ্য — এই তিন ধারার গবেষণা একটা জায়গায় মিলে যায়। ইন্দো-ইউরোপীয় বা আর্যভাষীদের উৎস ভারতের বাইরে। স্টেপ-ভূমিতে। তারা ভারতবর্ষে ঢুকেছে আজ থেকে প্রায় ৩,৫০০ আগে। তাদের যাত্রাপথে ছিল আজকের ইরান, তুরান, উত্তর আফগানিস্তান। হিন্দুকুশ পর্বত পেরিয়ে তারা ভারতবর্ষে প্রবেশ করে। আর তারাই বেদ রচনা করেছে আজ থেকে ৩,২০০ বছর আগে।
“ভারতবর্ষে উপনীত হওয়ার বহু পূর্বে বৈদিক আর্যরা তাদের ইন্দো-ইউরোপীয় উৎসভূমি পরিত্যাগ করে দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় বেরিয়ে পড়ে এবং যাত্রাপথের বহু স্থানেই দীর্ঘকাল অতিবাহিত করে। তাই মধ্য প্রাচ্যে প্রত্ন-ভারতীয় আর্য ভাষার কিছু কিছু শব্দের ইঙ্গিত পাওয়া গেছে। আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব বিংশ শতাব্দীতে মিত্তানী রাজ্যের দক্ষিণ-পূর্ব প্রান্তে যে নুজি শিলালিপি পাওয়া গেছে তাতে ঘোড়ার বিভিন্ন রং নির্দেশ করতে নিম্নোক্ত শব্দগুলি ব্যবহৃত হয়েছে। বব্রু (সংস্কৃত- বভ্রু), পরিত (সং -পলিত) ও পিঙ্কর (সং – পিঙ্গল)।” একইভাবে তিনি সাধারণ পূর্ব অষ্টাদশ শতকে কাসাইট জাতির নথিপত্রে উল্লিখিত কয়েকটি ভারতীয় দেবতার নাম আলোচনা করেছেন। শব্দতাত্ত্বিক মাইকেল উইটজেলও মিত্তানী ও কাসাইটদের বিভিন্ন প্রাচীন শব্দ বিশ্লেষণ করে অনুমান করেছেন মিত্তানীরা আরও প্রাচীন ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা ব্যবহার করত।৩
ইন্দো-ইউরোপীয়দের পরিযান
সম্ভবত তাদের এক অংশ ককেশাস পর্বতের পূর্বদিক থেকে ব্যাক্ট্রিয়া হয়ে ইরানের জাগ্রোস পর্বতমালা পেরিয়ে ভারতবর্ষে প্রবেশ করেছে। তবে ইন্দো-ইউরোপীয়দের বিভিন্ন পরিযানগুলির পূর্ণ ইতিহাস জানতে বৈদিক সংস্কৃত, মিত্তানী ও কাসাইটদের ভাষার শব্দবন্ধ নিয়ে আরও গবেষণার প্রয়োজন আছে।
আর্যভাষীদের ভারত আগমন ও তৎকালীন দেশজদের সাথে মিশ্রণ
আজ থেকে ৩,৫০০ বছর আগে ঘোড়ায় টানা রথে চড়ে, বৈদিক ভাষাভাষী স্তেপভূমির অর্ধ-যাযাবর পশুপালকরা সিন্ধু উপত্যকায় প্রবেশ করে। এই দলে নারীর অনুপাত ছিল নগণ্য। ইন্দো-ইউরোপীয়রা ভারতে এসেছিল মূলত পুরুষদের দল নিয়ে। নারীর প্রয়োজনে প্রাচীন দেশজ জনগোষ্ঠীগুলোর সাথে ওদের মিশ্রণ হয়েছিল। হরপ্পীয় সভ্যতার তখন ক্রান্তিকাল। ওদের অবক্ষয়প্রাপ্ত সমাজ থেকে মানুষ তখন দেশের দক্ষিণ দিকে ছড়িয়ে পড়ছে; যত দক্ষিণে যাচ্ছে তত মিশ্রিত হচ্ছে প্রাচীন ভারতীয় আন্দামানী শিকারী-সংগ্রাহক অধিবাসীদের সঙ্গে। প্রায় একই সময়ে উত্তর-পশ্চিম ও উত্তর দিকের বসবাসকারী হরপ্পীয় মানুষ স্তেপের পশুপালকদের সঙ্গে মিশে যাচ্ছে। এই মিশ্রণ সম্পূর্ণ সমসত্ত্ব ছিল না। দেশের বিভিন্ন অঞ্চল, ভাষা ও বর্ণের মানুষের মধ্যে এই মিশ্রণের আনুপাতিক পরিমাণ ছিল ভিন্ন।
এ প্রসঙ্গে সুকুমারী ভট্টাচার্য ‘বেদে সংশয় ও নাস্তিক্য’ গ্রন্থে লেখেন, “ছোট ছোট গোষ্ঠীর আর্যদের সংঘর্ষ ঘটতে লাগল অনুরূপ প্রাগার্য গোষ্ঠীর সঙ্গে। জয় পরাজয়ের পরে অধিকাংশ প্রাগার্য গোষ্ঠী সন্ধি করল আর্য গোষ্ঠীগুলির সঙ্গে এবং তাদের সঙ্গে মিশে গেল।”৫
মিশ্রণ চলেছিল কয়েক হাজার বছর ধরে। আজকের ভারতীয়রা মূলত এই পরিযানগুলির ফলে প্রাচীন তিন জনগোষ্ঠীর মিশ্রণ। বর্তমানে ইন্দো-ইউরোপীয় ডিএনএ পাওয়া যায় সুদূর দক্ষিণেও। এর একমাত্র ব্যতিক্রম আন্দামানের কিছু উপজাতিগোষ্ঠী।৬
গবেষকরা লক্ষ্য করেছেন যে, আজ থেকে ৪,২০০ থেকে ১,৯০০ বছর আগে পর্যন্ত জনগোষ্ঠীগুলির মানুষের মিশ্রণ ঘটেছিল। যত উচ্চ বর্ণে যাওয়া যায়, ইন্দো-ইউরোপীয় জেনেটিক উপাদানের অনুপাত তত বেশি পাওয়া যায়। আর যত উত্তর ও উত্তর-পশ্চিম ভারতে যাওয়া যায় সেখানেও ইন্দো-ইউরোপীয় জিন অধিক পরিমাণে আছে।
আজ থেকে প্রায় দুই হাজার বছর আগে হঠাৎ এই মিশ্রণ বন্ধ হয়ে গেল। কেন? ইতিহাসের কোন যুগে এই মিশ্রণ বন্ধ হল? আজ থেকে ২,৩০০ থেকে ১,৯০০ বছর আগে মনুস্মৃতি লেখা হয়েছে। আর সেই সময় থেকে জেনেটিক আদান-প্রদান বন্ধ হয়ে গেছিল। সেই সময়কাল থেকে নিজের বর্ণের মধ্যে বিবাহ বাধ্যতামূলক হয়ে যায়। এই হল আজকের জেনেটিক গবেষণা থেকে প্রাপ্ত তথ্য।৬ দেখা যাক বৈদিক সাহিত্যে এই ইতিহাস কীভাবে বিবৃত হচ্ছে।
‘প্রাচীন ভারত’ গ্রন্থে সুকুমারী ভট্টাচার্য উল্লেখ করেছেন, “যজুর্বেদের আমলে যে -চারটি বর্ণের উল্লেখ পাই — ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র – প্রথম যুগে এগুলি জন্মগত ছিল না, বরং এদের মধ্যে সম্পর্ক বেশ খানিকটা সঞ্চারী ছিল, অর্থাৎ নিজের রুচি প্রবৃত্তি ও ক্ষমতা অনুসারে এক বর্ণ থেকে অন্য বর্ণে যাওয়া যেত। এর কিছু কিছু নিদর্শন বেদে আছে। পরে অবশ্য ক্রমশই বর্ণগুলি জন্মগত, বংশগত হয়ে ওঠে।”৭
ঋগ্বেদে বর্ণব্যবস্থার উল্লেখ প্রায় নেই। একমাত্র পুরুষ সূত্রে (ঋগ্বেদের দশম মণ্ডলের অন্তর্গত স্তোত্র) এর উল্লেখ আছে, সেটাও প্রক্ষিপ্ত বলে মনে করা হয়।
আবার অধ্যাপিকা ভট্টাচার্যকে উদ্ধৃত করি, “সাধারণভাবে সমাজে ব্রাহ্মণ বর্ণের আধিপত্য ছিল, বর্ণগুলির মধ্যে তখনও কিছু সঞ্চরণশীলতা ছিল। এক জায়গায় পড়ি শ্যাপর্ণ সত্যকামের কয়েকটি ছেলে ব্রাহ্মণ, কয়েকটি ক্ষত্রিয়, কয়েকটি বৈশ্য। তখনও ব্রাহ্মণের ছেলে জন্মসূত্রে ব্রাহ্মণ হত না এবং ব্রাহ্মণের ছেলের অন্য বর্ণে যেতে সংকোচ ছিল না, যোগ্যতা রুচি ও ক্ষমতা অনুসারে এক বর্ণের লোক অন্য বর্ণে যেতে পারত।”৭
আগন্তুক আর্যভাষী গোষ্ঠীর সঙ্গে স্থানীয় মানুষের মিশ্রণের প্রমাণ ঋগ্বেদে যথেষ্ট আছে। সেই সময়ে কৃষ্ণকায় (শ্যাবায়) কণ্বকে গৌরবর্ণা স্ত্রী উপহার দেওয়া হয়েছে। তেমনই ঋগ্বেদে উল্লিখিত গায়ক দীর্ঘতমাও সম্ভবত কৃষ্ণকায় ছিলেন। তিনি উশিজ নামে এক দাসকন্যাকে বিবাহ করেন ও তাদের গর্ভে কাক্ষীবন্তের জন্ম হয়। পুরোহিত দিবোদাসের নামের থেকে ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে তাঁর জন্ম দাসকুলে। আবার অঙ্গিরাকেও কৃষ্ণকায় বলা হয়েছে। নতুন সমাজে বিজিত অধিপতিকেও উচ্চ স্থান দেওয়া হয়েছে। যদিও এই স্বীকৃতি প্রথম থেকেই দেওয়া হয়েছে, না কি ঋগ্বেদীয় সময়ের শেষভাগে তারা নিজেদের স্থান করে নিয়েছেন, এ নিয়ে তর্ক থাকতে পারে।
সুকুমারী দেখিয়েছেন, বৈদিক সাহিত্যের সাক্ষ্য অনুসারে, একটি নির্দিষ্ট সময়কাল পর্যন্ত সমস্ত বর্ণের মধ্যে যথেচ্ছভাবে মিশ্রণ হয়েছে। অর্থাৎ একটা সময় পর্যন্ত জন্মভিত্তিক বর্ণব্যবস্থা দৃঢ়ভাবে গড়ে ওঠেনি। তাঁর থেকে অনুমান করা যায় যে, যেভাবে আজকে বর্ণ/জাত ব্যবস্থা ও সামাজিক শ্রেণীবিন্যাস চলছে, ইন্দো-ইউরোপীয়রা এদেশে মাইগ্রেশন করবার পরেই সমাজে ঠিক এভাবে বর্ণবিন্যাস ছিল না। তখন নিশ্চিতভাবেই বিভিন্ন বর্ণের মধ্যে বিবাহ হত। বর্ণবিভাগ ছিল পেশার বিভাগ, এবং এই পেশা পরিবর্তন করা যেত।
“যজুর্বেদের সময়ে বহুলভাবে আর্য-প্রাগার্য সংমিশ্রনের ফলে যে সমাজের উদ্ভব হয় তাঁরই বিবর্তন ঘটতে থাকে ব্রাহ্মণ-আরণ্যক-উপনিষদের যুগে।” অবশ্য উপনিষদের যুগ যদি ৫০০ থেকে ২০০ সাধারণ পূর্বাব্দ ধরি তবে জেনোমিক গবেষণার সাথে সময়ের সামান্য ফারাক থেকে যায়।
সে যা হোক, উত্তর ভারতে, বিশেষ করে উচ্চ বর্ণের মধ্যে ইন্দো-ইউরোপীয় প্রোফাইল পাওয়া গেছে বিপুল পরিমাণে। ইন্দো-ইউরোপীয় আগন্তুকরা ভারতবর্ষের দেশজ জনগোষ্ঠীকে নতুন সংকর সমাজে কিছুটা আত্মসাৎ করেছে, আর কিছুটা প্রতিস্থাপন করেছে। সমাজে ক্ষমতাধর ছিল তারাই। বর্ণপ্রথা সেই ক্ষমতাকে পুরুষানুক্রমিক করে দিয়েছে। ক্ষমতার চুড়োয় ছিল বলেই ওদের ভাষা সমগ্র উত্তর ভারতে বিস্তৃত হয়। এ সময়ে জাতপাত প্রথা ধীরে ধীরে প্রতিষ্ঠিত হচ্ছিল। আজকে পিতৃক্রমের দিক দিয়ে উত্তরপ্রদেশের ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয়দের ৫৫-৬০% শতাংশের মধ্যে পাওয়া যায় ইন্দো-ইউরোপীয় জেনোমিক প্রোফাইল। বাঙালি ব্রাহ্মণদের পিতৃক্রমের দিক দিয়ে ৭২% সরাসরি ইন্দো-ইউরোপীয় জেনোমিক প্রোফাইল পাওয়া যায়।৮
ইন্দো-ইউরোপীয়দের গাত্রবর্ণ এবং আধুনিক বিজ্ঞান
ইন্দো-ইউরোপীয়দের চেহারা ছিল লম্বা, দেহবর্ণ হালকা। এই দেহবর্ণ একটা জেনেটিক মিউটেশনের ফলে হয়েছে। জিনের এই মিউটেশন ইউরোপীয় ও দক্ষিণ এশীয়দের একটা অংশের মধ্যে আছে। উত্তর ভারত, পাকিস্তান, মধ্য এশিয়া ও সেন্ট্রাল এশিয়াতে এই মিউটেশন পাওয়া যায়। কিন্তু দক্ষিণ ভারতীয়দের মধ্যে এই মিউটেশন পাওয়া যায় না।৯
‘বেদে ক্ষুধা প্রসঙ্গে’ রচনায় সুকুমারী ভট্টাচার্য উল্লেখ করেছেন, “ঋগ্বেদে প্রাগার্যদের সম্বন্ধে ঘৃণা ও তাচ্ছিল্য প্রকাশ করে বারবার বলা হয়েছে তারা কৃষ্ণাঙ্গ; অর্থাৎ শ্বেতাঙ্গ আর্যরা উঁচু জাতের এমন ইঙ্গিত এতে আছে।”১০
অধ্যাপিকা সুকুমারী ভট্টাচার্য তাঁর ‘প্রাচীন ভারত: সমাজ ও সাহিত্য’-তে লিখেছেন, “যদিও ঋগ্বেদ-এর সমস্ত সৌরদেবতাই হিরণ্যবর্ণ, স্বর্ণাভবেশ ও হিরণ্ময়রথে আরূঢ়, তথাপি তাদের প্রকৃতি ও কর্মক্ষেত্র ভিন্ন।” এখানে বিশেষভাবে লক্ষ্য করার ব্যাপার হল প্রাথমিকভাবে ওদের সকল দেবতাই ছিল কাঞ্চন বর্ণ, সোনার রঙ। শুধু গায়ের রঙ নয়, তাদের বেশ, রথ সব কিছুই সোনার বর্ণ। রঙের প্রতি এমনই মোহ ছিল ওদের।২
নিজেদের বিশিষ্ট ভাবমূর্তি নিয়ে আর্যভাষীরা নিশ্চয়ই প্রথম থেকেই ছিল সংবেদনশীল। এই সংবেদনশীলতা আর নিজেদের সম্পর্কে অতি উচ্চ ধারণা ওদের প্রথম থেকেই প্রাগার্যদের সম্পর্কে বিরূপ মত পোষণে সহায়ক হয়েছে। শ্বেতকায় আর্যভাষীদের অহংকার ঋগ্বেদেও বহুবার উল্লিখিত হয়েছে। তারা প্রাগার্যদের প্রতি বারেবারে তাচ্ছিল্যসূচক শব্দ ব্যবহার করেছে। উদাহরণস্বরূপ উল্লেখ করা যায় কৃষ্ণবর্ণ, অনাস, হ্রস্বজঙ্ঘ ইত্যাদি। তারা কখনও কৃষ্ণবর্ণের মানুষের বসতিতে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে, কখনও বা পঞ্চাশ হাজার কৃষ্ণবর্ণ মানুষকে হত্যার কথা সগর্বে ঘোষণা করেছে।
‘প্রাচীন ভারত’ গ্রন্থে সুকুমারী ভট্টাচার্য উল্লেখ করেছেন, “আর্যরা এদেশে আসবার পরে তাদের দৈনন্দিন জীবনযাত্রা ও সমাজগঠন কী রকম ছিল তা জানবার মতো উপাদান আমাদের নেই। সিন্ধুসভ্যতার জনপদগুলি থেকে প্রাগার্য অধিবাসীদের যুদ্ধে হারিয়ে বা হটিয়ে দিয়ে আর্যভাষীরা যখন উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত অঞ্চলে প্রথম বসবাস করতে শুরু করল, তখন তাদের জীবনযাত্রা প্রধানত পশুচারণের উপরে নির্ভর করত। প্রাগার্যদের কাছে হয়তো তারা চাষের কাজ অল্প সময়ে শিখে নিয়েছিল। কিম্বা জুলুম করে প্রাগার্যদের ফসল কেড়ে নিয়ে ভোগ করতো।”৭
পরিশেষে
আজকের বৈজ্ঞানিক তথ্যের আলোকে সুকুমারী ভট্টাচার্যের বৈদিক সাহিত্য নিয়ে সামান্য আলোচনা করলাম। প্রাচীন ভারতের ইতিহাস অনুসন্ধানে সাহিত্য, শব্দতত্ত্ব ও জিনবিদ্যার এই মিথস্ক্রিয়া জরুরি। যেহেতু বৈদিক যুগের কোনো প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদান নেই, তাই এই একত্রিত চর্চা খুলে দিতে পারে নতুন চিন্তার জানালা। আশা করা যায় আগামী দিনে এই একত্রিত কাজের পরিসর যাবে অনেক বেড়ে।
এমন নয় যে, অধ্যাপিকা ভট্টাচার্য ছিলেন ত্রুটির উর্ধে। প্রাগার্য সভ্যতা নিয়ে তাঁর এক প্রক্ষিপ্ত বক্তব্য (“খ্রিস্টপূর্ব উনিশ হাজার বছর আগে মানুষ আগুনের ব্যবহার করতে শিখেছে”) সঠিক নয়। তবে বৈদিক সাহিত্য নিয়ে তাঁর আলোচনা গভীর, আধুনিক ও কালোত্তীর্ণ। এখানেই অধ্যাপিকা সুকুমারী ভট্টাচার্যের বিশিষ্টতা। তাঁর বিশ্লেষণ আজকের জিনবিদ্যার চর্চাতেও সমান প্রাসঙ্গিক থাকে।
তথ্যসূত্র
- V. M. Narasimhan et al., ‘The formation of human populations in South and Central Asia,” Science, 365(6457), (2019).
- সুকুমারী ভট্টাচার্য, ‘প্রাচীন ভারত: সমাজ ও সাহিত্য’, “প্রবন্ধ সংগ্রহ,” ১ খণ্ড, গাঙচিল, প্রথম সংস্করণ, প্রথম অধ্যায় (২০১২ – ২০১৪)।
- সুকুমারী ভট্টাচার্য, ‘বৈদিক সাহিত্যের রূপরেখা’, “প্রবন্ধ সংগ্রহ,” ৪ খণ্ড, গাঙচিল, প্রথম সংস্করণ, প্রথম অধ্যায় (২০১২ – ২০১৪)।
- Romila Thapar, Michael Witzel, Jaya Menon, Kai Friese, Razib Khan, “Which of Us Are Aryans?,” Aleph Book Company, Chapter 2, (2019).
- সুকুমারী ভট্টাচার্য, ‘’বেদে সংশয় ও নাস্তিক্য”, “প্রবন্ধ সংগ্রহ,” ২ খণ্ড, গাঙচিল, প্রথম সংস্করণ, প্রথম অধ্যায় (২০১২ – ২০১৪)।
- Priya Moorjani et al., “Genetic Evidence for Recent Population Mixture in India,” Am Journal of Human Genetics, 93(3), (2013): 422–438.
- সুকুমারী ভট্টাচার্য, “প্রাচীন ভারত”, “প্রবন্ধ সংগ্রহ,” ১ খণ্ড, গাঙচিল, প্রথম সংস্করণ, প্রথম অধ্যায় (২০১২ – ২০১৪)।
- Swarkar Sharma et al., “The Indian origin of paternal haplogroup R1a1* substantiates the autochthonous origin of Brahmins and the caste system,” J Hum Genet, 54, (2009): 47-55.
- Chandana Basu Mallick et al., ‘The Light Skin Allele of SLC24A5 in South Asians and Europeans Shares Identity by Descent’: Plos Genetics, November 7, (2013).
- সুকুমারী ভট্টাচার্য, ‘’‘বেদে ক্ষুধা প্রসঙ্গে”, “প্রবন্ধ সংগ্রহ,” ২ খণ্ড, গাঙচিল, প্রথম সংস্করণ, প্রথম অধ্যায় (২০১২ – ২০১৪)।
অতি সংক্ষিপ্তাকারে নানান গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সন্নিবেশিত হয়েছে। এক কথায় অত্যন্ত সমৃদ্ধ প্রবন্ধ। ইদানিং একটা ভাবনা বারবার মনে উঁকি দিচ্ছে। ইতিহাস, তথ্য ও তর্কের একটি ইউটিউব চ্যানেল থাকলে বেশ হতো। মানুষ পড়ে কম, অডিও ভিস্যুয়াল মাধ্যমে বিচরণ করে বেশি। ভারতের এই অস্থির সময়ে কিছু সংখ্যক মানুষকেও যদি নির্মোহ ইতিহাসে আগ্রহী করে তোলা যায় এই মাধ্যমে, বেশ হয়। এছাড়া মানিটাইজেশনের অর্থ দিয়ে আরও গুরুত্বপূর্ণ কাজ আমাদের এই প্রিয় গ্রুপ করতে পারে।
ভালো প্রস্তাব। আসলে করাী মানুষের অভাব আছে।
পড়লাম খুব মনোযোগ সহকারে। তবে কয়েক বার পড়া দরকার। অতি প্রয়োজনীয় কিছু প্রশ্ন মনে ছিল,তার কিছু উত্তর ও পাওয়া গেল।
মনে হয় এই দৃষ্টিকোণ থেকে এর আগে ভাবা হয়নি। তবে সব টা এক সাথে হয়তো অনুধাবন করতে অসুবিধে হবে অজ্ঞতার কারণে।
লেখা টা কিন্তু একেবারে নতুন ধরনের দিগন্তের সূচনা করলো।
ধন্যবাদ নেবেন। আমিও কয়েক বার পড়ি।
অত্যন্ত প্রয়োজনীয় ও সুখপাঠ্য লেখা। এ ধরনের তুলনামূলক অধ্যয়ন জরুরি। পুরনো গবেষণা তথ্য তত্ত্ব আধুনিক জ্ঞান ও তথ্যের ভিত্তিতে পুনরালোচনা করলেই প্রকৃত জ্ঞানের বিকাশ ঘটতে পারে।
প্রসঙ্গত বলি, অধ্যাপক অতুল সুরের লেখার সঙ্গে আধুনিক গবেষণালব্ধ তথ্য মিলিয়ে দেখার চেষ্টা আমি করেছিলাম একবার। সেক্ষেত্রেও পুরনো আন্দাজি তত্ত্ব আধুনিক তথ্যের সঙ্গে বেশ ভালো মিলে গেছিল।
কাক বসল ও তাল পড়ল।
আর্যদের নিয়ে প্রশ্ন অনেক। এই প্রবন্ধ পড়ে খুব উপকৃত হলাম।
একটা প্রশ্ন। জিন নিয়ে যাঁরা গবেষণা করছেন তাঁরা কি একাধিক সিদ্ধান্তে পৌঁছে যেতে পারেন? যেমন, কেউ কি এমনও বলতে পারেন সাদৃশ্যগুলির কারণ ভারত থেকে পশ্চিম দেশে পরীযানের ফল?
এরজন্য আবার ভিন্ন কিছু বিশ্লেষণ করতে হয়েছে। স্তেপ অঞ্চলে পাওয়া গেছে এমন দেহাবশেষ যার দেহে ইন্দো-ইয়োরোপীয় ডিএনএ-র প্রাচীনতম ভার্শনটি আছে। তাদের আবার আন্দামানি শিকারি-সংগ্রাহক ও হরপ্পীয় মিশ্র জনগোষ্ঠীর ডিএনএ নেই। এদিক থেকে ওদিকে গেলে কিন্তু এদুটো থাকত। এই নিয়ে আমার দীর্ঘ লেখা আছে।
ধন্যবাদ নেবেন। খুব যুক্তিযুক্ত প্রশ্ন।
বেদ কারা এনেছিল এবং কখন এনেছিল? এ অঞ্চলের জনগোষ্ঠীর আদি ইতিহাস কি? এটি একটি মৌলিক প্রশ্ন দীর্ঘকাল যাবৎ! ভরতবর্ষ তথা এ অঞ্চলের জনগোষ্ঠীর ইতিহাস সম্পর্কে মধুশ্রী বন্দোপাধ্যায় ও বেশ কয়েকজন আগেও ‘ইতিহাস, তথ্য ও তর্ক’ পোর্টালে আগে ও লিখেছেন। আমি এই পোর্টালের নিয়মিত পাঠক। মধুশ্রীর বিজ্ঞান ভিত্তিক ইতিহাস লেখার ভক্তও। তাঁর লেখা যথেষ্ট গবেষণা লব্দ্ধ। নিছক সাহিত্য নয়। এ লেখাটি ও অসাধারণ। যথেষ্ট ভাবনা উদ্রেককারী। এটি অত্যন্ত স্বল্প পরিসরে প্রচুর তথ্য প্রদান করেছে। এই লেখা আরো অধিক বিশ্লেষণ, আরো পঠন, আরো মনমশীলতা ও চর্চার জন্য প্রবল আগ্রহ সৃস্টি করে। মধুশ্রী বন্দোপাধ্যায় ও’ ইতিহাস, তথ্য ও তর্ক’ কে অশেষ ধন্যবাদ।
আপনাকেও ধন্যবাদ নিবন্ধটি পড়ে মন্তব্য করার জন্য। এটা আমরা কমই করি।
খুব ভালো বিশ্লেষণ। যেসব জেনেটিক তথ্য জানা ছিল না, সেগুলি পরিষ্কার হল। বিশেষত সুকুমারীদি যে সব চর্চা করেছেন, সেগুলির পরিপ্রেক্ষিত আরও দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হল বলে ভালো লাগছে। আজ সুকুমারীদির জন্মদিন। তাঁর উদ্দেশ্যে শ্রদ্ধা জানাই!
সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় তাঁর অনেক লেখায় এই বিষয়ের উপর আলোকপাত করেছেন৷
তুল্যমূল্য আলোচনা পড়ে ভাল লাগল। আরো ভাল লাগল সুকুমারী ভট্টাচার্য মহাশয়ার গবেষণা যখন বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গিতে সঠিক মান্যতা পায়৷
ইউটিউব নিয়ে চ্যানেল করলে আমি ভলাণ্টিয়ার হিসাবে থাকতে পারি। তবে মনিটাইজেশন ব্যাপারটা খুব সহজ নয়।
সুন্দর আলোকপাত,সুকুমারী ভট্টাচার্যের রচনাবলী অনন্য সম্পদ,তাঁকে শ্রদ্ধা !