জারের রাশিয়া, নিহিলিজম ও কয়েকটি বিখ্যাত রুশ উপন্যাস
বিপ্লবী সাহিত্যিক নিকোলাই চেরনিশেভস্কির ‘হোয়াট ইজ টু বি ডান’ নামের উপন্যাসটি প্রকাশিত হয় ১৮৬৩ সালে, যা পরে লেনিনকে অত্যন্ত প্রভাবিত করেছিল। এই বইটি লেনিনের এতই পছন্দের ছিল যে তিনি অন্তত পাঁচবার এটি পড়েছিলেন, আর তাঁর এক বিখ্যাত বইয়ের নাম দিয়েছিলেন এই বইয়ের নামে। চেরনিশেভস্কির লেখালেখি ও সম্পাদনাকর্ম সমৃদ্ধ সোভ্রেমেনিক (এই রুশ শব্দটির অর্থ সমসাময়িক) নামের জার্নালটি এ সময়ে প্রগতিশীল মহলে অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়ে ওঠে এবং এটির লেখক ও সহ সম্পাদক হবার কারণে চেরনিশেভস্কিকে কারাবাসও করতে হয়েছিল। উপন্যাস শিল্পের নিরিখে না হলেও সামাজিক প্রভাবের দিক থেকে দেখতে গেলে এই উপন্যাস ও তার প্রতিক্রিয়া সমূহও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মনে করা হয় চেরনিশেভস্কি এই উপন্যাস লিখেছিলেন তুর্গেনিভ এর ‘ফাদার্স অ্যান্ড সনস’ এর প্রতিক্রিয়ায়, আবার চেরনিশেভস্কির এই ‘হোয়াট ইজ টু বি ডান’ এর প্রতিক্রিয়াতেই দস্তয়েভস্কি লেখেন তাঁর অতি বিখ্যাত আখ্যান ‘নোটস ফ্রম দ্য আন্ডারগ্রাউন্ড’।
রাশিয়ায় প্রায় পাঁচশো বছর ধরে, তৃতীয় ইভানের (১৪৪০-১৫০৫ সাল) আমল থেকেই চালু ছিল জারের শাসন। রাশিয়ার সম্রাটরা জার নামে পরিচিত ছিলেন। দেশের অধিকাংশ ভূমি এবং সম্পদ জার, তার পরিবার ও অনুচরদের হাতে কেন্দ্রীভূত ছিল। আর কোটি কোটি জনসাধারণ বাস করত উপযুক্ত শিক্ষা, চিকিৎসা, বাসস্থান, খাদ্য, বিশ্রাম বিহীন অবর্ণনীয় দুঃখ কষ্টের মধ্যে। ইউরোপের অন্যান্য দেশের স্বৈরতন্ত্রগুলির চেয়েও রাশিয়ার অবস্থা ছিল খারাপ। ১৯০৫ সালের বিক্ষোভ আন্দোলন পর্বের আগে পর্যন্ত রাশিয়ায় কোনও সংবিধান বা (এমনকী রাজতন্ত্র নিয়ন্ত্রণাধীন) সংসদীয় ব্যবস্থার চিহ্নটুকু পর্যন্ত ছিল না। রাজনৈতিক ক্ষমতার পাশাপাশি ধর্মীয় বিষয়ের কর্তৃত্বও ছিল জারের হাতে। জার শাসনের কোনও কোনও পর্বে অবশ্য কিছু কিছু সংস্কার হয়। অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রথমদিকে জার পিটার দ্য গ্রেট এর আমল (১৬৮২ থেকে ১৭২৫) এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য। পশ্চিম ইউরোপের সঙ্গে রাশিয়া এইসময় সাংস্কৃতিকভাবে অনেকটা কাছাকাছি আসে। মস্কো থেকে রাজধানী সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় সেন্ট পিটার্সবার্গে এবং নতুনভাবে একে গড়ে তোলা হয়। এই আমলে পুরনো মধ্যযুগীয় অনেক ধ্যান ধারণাকে সরিয়ে দিয়ে আধুনিক বিজ্ঞান চিন্তার প্রসার হয়। এই সংস্কার অব্যাহত থাকে ক্যাথরিন দ্য গ্রেট এর আমলেও (১৭৬২ থেকে ১৭৯৬ সাধারণ অব্দ)।
জার দ্বিতীয় আলেকজান্ডারের আমলের (১৮৫৫ থেকে ১৮৮১ সাধারণ অব্দ) আগে থেকেই রাশিয়া একের পর এক কৃষক বিদ্রোহে আলোড়িত হচ্ছিল। ১৮৫০ থেকে ১৮৬০ সালের মধ্যে রাশিয়া জুড়ে প্রায় আটশো কৃষক বিদ্রোহ হয়। ১৮৬২ র বসন্তে রাশিয়ার তৎকালীন রাজধানী সেন্ট পিটার্সবার্গ এ ছাত্রযুব বিদ্রোহের আগুন জ্বলে উঠেছিল। এই বিদ্রোহের পেছনে একদিকে ছিল রাশিয়ার ভেতরের সঙ্কট, অন্যদিকে ছিল চোদ্দ বছর আগে ১৮৪৮ সালে ইউরোপের একের পর এক দেশে ওঠা বিদ্রোহের ঢেউ এর প্রেরণা। ১৮৪৮ এর এই বিদ্রোহ শুরু হয়েছিল ফ্রান্সে এবং ক্রমেই তা ছড়িয়ে পড়ে অনেকগুলি দেশে। পুরনো ধরনের রাজতন্ত্রের জায়গায় জনগণ চাইছিল সাংবিধানিক গণতন্ত্র, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা, মত প্রকাশের অধিকার সহ বেশ কিছু মৌলিক বদল। বেশ কিছু দেশে এই বিদ্রোহকে দ্রুত দমন করা হয়, অসংখ্য বিদ্রোহীকে হত্যা করা হয় বা কারাগারে নিক্ষেপ করা হয়। বেশ কিছু দেশে জনগণ বিদ্রোহের মাধ্যমে অনেক অধিকার আদায় করে নিতেও সক্ষম হয়। অস্ট্রিয়া আর হাঙ্গেরিতে ভূমিদাস প্রথার অবসান হয়, নেদারল্যান্ডে শুরু হয় প্রতিনিধিত্ব মূলক গণতন্ত্র, ডেনমার্কে নিরঙ্কুশ রাজতন্ত্রের পতন ঘটে। এই বিপ্লবের মধ্যে দিয়ে উদারনীতিবাদ, জাতিয়তাবাদ ও সমাজতান্ত্রিক আদর্শ ক্রমশ জনপ্রিয় ও বিস্তৃত হতে থাকে।
জার দ্বিতীয় আলেকজান্ডারের (১৮৫৫ থেকে ১৮৮১ সাধারণ অব্দ) আমলের প্রথম দিকে ক্রিমিয়ার যুদ্ধে (১৮৫৩ থেকে ১৮৫৬ সাধারণ অব্দ) রাশিয়ার শোচনীয় পরাজয় ঘটে এবং ক্রমশ জনপ্রিয়তা হারাতে থাকা জার-শাসন আরো অনেকটা বে আব্রু হয়ে যায়। ফলে তলা থেকে বিদ্রোহের সম্ভাবনাকে প্রশমিত করার জন্য ওপর থেকে কিছু সংস্কারের কথা ভাবা হয় জার শাসনের তরফে। শুরু হয় বহু আলোচিত ভূমিদাস প্রথার বিলুপ্তি (১৮৬১)। প্রায় পাঁচ কোটি মানুষ অর্থাৎ রুশ জনগণের ৮০ শতাংশই এই সংস্কারের ফলে উপকৃত হচ্ছে – একথা বলা হলেও ভূমিদাস প্রথার বিলুপ্তি জনগণের জীবনের মূল সমস্যাগুলির সমাধান করতে ব্যর্থ হয়। ওপর থেকে লোক দেখানো সংস্কার সত্ত্বেও ভালো ভালো জমিগুলো সবই জমিদারদের হাতে থেকে যায়। কৃষকদের হাতে আসে সামান্য কিছু পতিত বা অনুর্বর জমি। এর সঙ্গেই ছিল চাষীদের জমিতে আবদ্ধ করে রাখার চেষ্টা। অনুমতি না নিয়ে চাষীরা এলাকা ত্যাগ করতে পারত না। ফলে রাশিয়ার বিপ্লবী চিন্তাধারাকে দ্বিতীয় আলেকজান্ডারের সংস্কার প্রশমিত করতে সক্ষম হয় নি।
১৮৩৫ থেকে ১৮৬১ র মধ্যে বিদ্রোহীরা দুশো তিরাশি জন জমিদার বা কুলাককে হত্যা করে। এই বিদ্রোহের পুরোভাগে ছিল নারোদনিক বা জনগণের বন্ধুরা। রাশিয়ায় সামন্ততন্ত্রের দ্রুত অবক্ষয় দেখা যাচ্ছিল, কিন্তু তার জায়গায় আধুনিক পুঁজিবাদ তখনো সেভাবে বিকশিত হয়ে ওঠে নি। ছাত্রযুব এবং জনগণের প্রগতিশীল অংশ সামন্ততন্ত্র এবং জার শাসনের বিরুদ্ধে ক্ষোভে ফেটে পড়ছিল এবং তারা প্রায়শই ব্যক্তি হত্যার পথ বেছে নিত। এরই চরম প্রকাশ দেখা যায় ১৮৮১ সালের ১ লা মার্চ। সেন্ট পিটার্সবুর্গ এর রাস্তায় জার দ্বিতীয় আলেকজান্ডারকে বোমা ছুঁড়ে হত্যা করা হয়। ছ বছর বাদে একইভাবে হত্যার চেষ্টা করা হয় জার তৃতীয় আলেকজান্ডারকে। সেই ব্যর্থ চেষ্টার শাস্তি হিসেবে দু মাস পর ফাঁসিতে প্রাণ বিসর্জন দেন আলেকজান্ডার উলিয়ানভ, সম্পর্কে যিনি ছিলেন ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিনের নিজের দাদা।
১৮৬০ এর রাশিয়ায় বিপ্লবী আদর্শ হিসেবে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে এক নতুন ধরনের চিন্তাধারা – নিহিলিজম। এই মতবাদের পক্ষে বিপক্ষে কলম ধরেন তুর্গেনিভ, চেরনিশেভস্কি, দস্তয়েভস্কির মত সেকালের শ্রেষ্ঠ সাহিত্য প্রতিভারা। পরপর তিন বছরে প্রকাশিত তিনটি ক্লাসিকে নিহিলিজমকে তিনটি আলাদা আলাদা দৃষ্টিকোণে দেখা হয়। ১৮৬২ তে তুর্গেনিভের ‘পিতা-পুত্র’ উপন্যাসটি প্রকাশিত হয়। ১৮৬৩ তে তার জবাব হিসেবে চেরনিশেভস্কি লেখেন ‘হোয়াট ইজ টু বি ডান’ এবং পরের বছর তার প্রতিক্রিয়া লক্ষ করা যায় দস্তয়েভস্কির বিখ্যাত উপন্যাস ‘নোটস ফ্রম দ্য আন্ডারগ্রাউন্ড’ এর মধ্যে। আখ্যানের বাইরে সাহিত্য সমালোচনার জগতেও বিষয়টিকে কেন্দ্র করে বিতর্কর ঝড় বইতে থাকে। এর তিন বছর পরে ১৮৬৬ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর মহত্তম আখ্যান ‘ক্রাইম অ্যান্ড পানিশমেন্ট’।
রুশ নিহিলিজমের প্রতিনিধিস্থানীয় চরিত্র হিসেবে বিখ্যাত হয়ে আছে তুর্গেনিভের ‘পিতা পুত্র’ উপন্যাসের বাজারভ। উপন্যাসের শুরুতে আমরা দেখি এক জমিদার নিকলাই কির্সানভ অপেক্ষা করছেন তাঁর পুত্র আর্কাদির জন্য। সে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, ছুটিতে পারিবারিক খামারে আসে। আর্কাদি সঙ্গে করে নিয়ে আসে তাঁর সহপাঠী বন্ধু ডাক্তারির ছাত্র বাজারভকে। বাজারভ শুরু থেকেই তাঁর চমকপ্রদ কথাবার্তা ও ধ্যান ধারণা দিয়ে যে কোনও কারোর ওপর প্রভাব বিস্তারে সক্ষম। বস্তুত আর্কাদি ও অন্যান্য বন্ধুবান্ধবেরা তাঁকে গুরুর আসনেই প্রায় বসিয়ে রেখেছে। পুত্রবন্ধু এই কড়া ধাঁচের যুবকটিকে জমিদার নিকলাই বেশ সম্ভ্রমের চোখেই দেখেন কিন্তু তাঁর দাদা, এক সময়ের মিলিটারি অফিসার ও উচ্চকোটির সমাজে সাড়া জাগানো মানুষ পাভেল কির্সানভ কথায় কথায় তাঁর সঙ্গে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েন। বস্তুত কথার দ্বন্দ্বে তাঁদের ঠোকাঠুকি একবার ভোরবেলার ডুয়েল অবধি পৌঁছে যায়। বাজারভ অক্ষত থাকলেও গুলি ছুঁয়ে যায় পাভেলের হাঁটু, রক্তক্ষরণ ও ক্ষত নিয়ে কদিন বিশ্রামেও থাকতে হয় তাঁকে।
তুর্গেনিভ
পিতা পুত্র উপন্যাসটি প্রসঙ্গে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন আলোচকেরা দুটি প্রজন্মের দ্বন্দ্বের কথা তুলেছেন। একটি হল নিকলাই বা পাভেল কির্সানভদের চল্লিশের প্রজন্ম এবং একটি হল বাজারভ, আর্কাদিদের ষাট এর প্রজন্ম। পঞ্চাশের দশকের মাঝামাঝি এক বক্তৃতায় নতুন জার দ্বিতীয় আলেকজান্ডার ভূমিদাস প্রথা অবসানের কথা ঘোষণা করেন এবং ধীরে ধীরে তার বাস্তবায়নের জন্য গোটা রাশিয়া জুড়ে অসংখ্য কমিটি তৈরি করেন। ষাটের দশকের শুরুতে ভূমিদাস প্রথার অবসান ঘটে এবং লক্ষ লক্ষ রুশ ভূমিদাস মুক্তি পায়। কিন্তু দুই প্রজন্মের যে বিতর্কের কথা বলা হয়, তা শুধু ভূমিদাস প্রথার অবসানকে দেখার প্রশ্নে সীমাবদ্ধ ছিল না। ছিল রাশিয়ার সার্বিক পরিবর্তনের প্রশ্নটিকে কেন্দ্র করে অসংখ্য বিষয়কে বিচারের দৃষ্টিকোণের সঙ্গে। বস্তুতপক্ষে পিতা পুত্র উপন্যাসে যে দুই ধরনের মানুষদের তুর্গেনিভ হাজির করেছেন, তারা কেউই ভূমিদাস প্রথার অবসানের বিরোধী নয়। বাজারভদের মতো রাডিক্যালরা তো বটেই, এমনকি নিকলাই বা পাভেল কির্সানভদের মতো লিবারাল হতে চাওয়া জমিদারকুলও অন্তত প্রকাশ্যে এর বিরোধী নন। বড়জোর এর রূপায়ণ কমিটির কার্যকলাপ প্রসঙ্গে ক্ষেত্রবিশেষে খানিক উদাসীন। যারা ভূমিদাসপ্রথার তীব্র বিরোধী, সেই রক্ষণশীলদের কোনও প্রতিনিধিত্ব পিতাপুত্র উপন্যাসে তুর্গেনিভ রাখেন নি।
উনিশ শতকের মধ্যভাগে রাশিয়ায় নিহিলিজম কেবল একটি দার্শনিক দৃষ্টিকোণ হিসেবেই সীমাবদ্ধ ছিল না। বাকুনিন প্রভৃতির দ্বারা প্রাণিত এই মতবাদ রাষ্ট্র, চার্চ, পরিবার – সমস্ত রকম কর্তৃত্বকে শুধু অস্বীকারই করতে চায় নি, জার শাসিত রাশিয়ার ক্ষমতাতন্ত্রের বিরুদ্ধে আন্দোলনেও সামিল হয়েছিল। যুক্তিবাদ ও বস্তুবাদের ওপর দাঁড়িয়ে ভাববাদী দৃষ্টিকোণগুলিকে যথার্থ নিহিলিস্টের মতোই বাজারভকে দিয়ে খন্ডন করিয়েছেন তুর্গেনিভ, কিন্তু জার শাসনের বিরুদ্ধে নিহিলিস্টরা যে গোপন সংগঠন ও লড়াই এর প্রস্তুতি নিচ্ছিল, তার কোনও হদিশ আখ্যানের মধ্যে দিতে সাহস করেন নি। এর বদলে বাজারভকে কেবল উপন্যাসের দ্বিতীয় পর্বে খানিকটা নারী মোহিত যুবক হিসেবে উপস্থাপন করেছেন। জার শাসন জনিত ভয় থেকে বাজারভকে উজ্জ্বলভাবে আঁকার ক্ষেত্রে লেখকের যে পশ্চাদপসরণ, তার ক্ষতিপূরণ তুর্গেনিভ করতে চেয়েছেন বাজারভের মৃত্যুদৃশ্যকে উজ্জ্বল করে তোলার মধ্যে দিয়ে।
বাজারভের মতো চরিত্র – যে মূলত কথায় নয়, ব্যবহারিক কাজে বিশ্বাসী – তাকে কাজ ও সাংগঠনিক পরিচয়ের বাইরে এনে ফেললে চরিত্রটির ওপরেই শুধু অবিচার করা হয় না, উপন্যাসের শিল্প সম্ভাবনাকেও দুর্বল করে ফেলা হয়। বিপ্লবীদের দিক থেকে বাজারভ চরিত্রায়ণ ও পিতাপুত্র উপন্যাসটি সম্পর্কে শৈল্পিক আপত্তির উত্তর হিসেবে পালটা একটি উপন্যাসও লেখা হয়েছিল। পিতাপুত্র প্রকাশের পরের বছরেই, ১৮৬৩ সালে, নিহিলিজম এর ইতিবাচক উপস্থাপন সহ নিকোলাই চেরনিশেভস্কি লিখেছিলেন – ‘হোয়াট ইজ টু বি ডান’ নামের এক উপন্যাস। তৎকালীন রাডিক্যাল রুশ যুবকদের মতোই পরবর্তীকালে লেনিনেরও অত্যন্ত প্রিয় বই হয়ে ওঠে এটি এবং রুশ বিপ্লবের প্রস্তুতিপর্ব ও বিপ্লবোত্তর রাশিয়াতেও বইটির বিশেষ জনপ্রিয়তা ছিল। চেরনিশেভস্কি সমকালীন রাশিয়ায় তাঁর প্রগতিশীল চিন্তাধারার জন্য বিখ্যাত ছিলেন। বস্তুবাদী দর্শন, সমাজতান্ত্রিক রাজনীতি – অর্থনীতি, নারীমুক্তি বিষয়ে তাঁর বলিষ্ঠ মতবাদ রাশিয়ার প্রগতিশীলদের কাছে তাঁকে জনপ্রিয় করে তুলেছিল। উনিশ শতকের মধ্যভাগ থেকে রুশ সমাজের প্রগতিশীল অংশ যে সমস্ত সামাজিক সমস্যাগুলি নিয়ে বিব্রত ছিল, ‘হোয়াট ইজ টু বি ডান’ উপন্যাসটিতে চেরনিশেভস্কি তার সমাধানসূত্র হাজির করার চেষ্টা করেন। রুশ সমাজের অসাম্য, সামাজিক দমনপীড়ন ও অর্থনৈতিক পশ্চাদপরতার অন্যতম কারণ হিসেবে তিনি চিহ্নিত করেন পিতৃতান্ত্রিক কর্তৃত্ববাদী রুশ পারিবারিক, সামাজিক, রাজনৈতিক কাঠামোকে। একে বদলানোর জন্য একটি রাডিক্যাল কর্মসূচীর প্রয়োজনীয়তার ওপর তিনি জোর দেন। রাশিয়ার নিজস্ব মূল্যবোধের সঙ্গে পশ্চিম ইউরোপের সামাজিক রাজনৈতিক প্রগতিশীল চিন্তাভাবনাকে মেলানোর কথা তিনি বলেন। ব্যক্তির আত্মবোধের জাগরণের প্রয়োজনীয়তার পাশাপাশি এমন এক আর্থিক নীতিমালার কথা চেরনিশেভস্কি বলেন, যেখানে সমৃদ্ধি আর সামাজিক দায়বদ্ধতার মিশেল থাকবে। তাঁর মতে এই সমস্যাগুলির সমাধানের ক্ষেত্রে মধ্যপন্থী সংস্কার প্রচেষ্টা তেমন কোনও কাজে আসবে না, দরকার হবে পরিবার, সমাজ ও উৎপাদন কাঠামোর আমূল পরিবর্তন। উৎপাদন কাঠামোর ক্ষেত্রে সমবায় নীতির ওপর চেরনিশেভস্কি জোর দিয়েছিলেন। নতুন চিন্তাভাবনার বিকাশের ক্ষেত্রে তার জোর ছিল বিজ্ঞান মনস্ক শিক্ষা পদ্ধতির ওপর। সামাজিক ও নৈতিক উন্নয়নে প্রগতিশীল মতাদর্শের আয়ুধে সজ্জিত বুদ্ধিজীবীদের সক্রিয় ভূমিকার ওপর চেরনিশেভস্কি বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছিলেন। সামাজিক বোধে শাণিত ও নৈতিক বোধে উন্নত এই ‘নতুন মানুষেরাই’ সমাজ, রাজনীতি, অর্থনীতির আমূল পরিবর্তনের কাজ শুরু করবেন, অন্যদের মধ্যে প্রগতিচেতনা ছড়িয়ে দেবেন এবং ক্রমশ রুশ সমাজ, রাজনীতি, অর্থনীতিকে আমূল বদলে দেবেন – এমন এক রূপকল্প ‘হোয়াট ইজ টু বি ডান’ উপন্যাসে চেরনিশেভস্কি হাজির করেছিলেন। উপন্যাসের শৈলি বা নান্দনিকতার দিক থেকে আখ্যানের ইতিহাসে সেরকম উল্লেখযোগ্য না হলেও চেরনিশেভস্কির এই উপন্যাসটি সমাজ রাজনৈতিক মতবাদের দিক থেকে খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
চেরনিশেভস্কি
তুর্গেনিভের ‘ফাদার্স অ্যান্ড সন্স’ উপন্যাসে (১৮৬২) নিহিলিজম সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ আলোকপাত ছিল। তবে এর নায়ক হিসেবে নিহিলিস্ট বাজারভকে যেভাবে চিত্রায়িত করেছিলেন তুর্গেনিভ, তার চরিত্রে যে সব দোষাবহ দিককে সমীকৃত করেছিলেন, তা রাশিয়ার প্রগতিশীলদের অনেককেই খুশি করে নি। এর জবাব হিসেবেই পরের বছর চেরনিশেভস্কির ‘হোয়াট ইজ টু বি ডান’ (১৮৬৩) রচিত ও প্রকাশিত হয়। আবার চেরনিশেভস্কির এই উপন্যাসের জবাব হিসেবে তার পরের বছর প্রকাশিত হয় দস্তয়েভস্কির ‘নোটস ফ্রম আন্ডারগ্রাউন্ড’ (১৮৬৪)।
১৮৪৮ এর ইউরোপ জোড়া বিপ্লবের ঢেউ যখন রাশিয়ায় এসে পৌঁছেছিল, তখন অন্যান্য অনেকের মতো তা স্পর্শ করেছিল সাতাশ বছরের তরুণ দস্তয়েভস্কিকেও। এর তিন বছর আগে, মাত্র চবিশেই দস্তয়েভস্কির প্রথম প্রকাশিত উপন্যাস ‘পুওর পিপল’ প্রকাশের পরেই সাড়া ফেলেছে। সেই সময়কার বিখ্যাত সমালোচক বেলিনস্কি, তরুণ প্রগতিশীল ও পশ্চিমী মনোভাবাপন্ন লোকেদের মধ্যে যার খ্যাতি তখন তুঙ্গস্পর্শী – দস্তয়েভস্কির এই উপন্যাসটির ভূয়সী প্রশংসা করেন। এই উপন্যাসটির সূত্র ধরেই তরুণ দস্তয়েভস্কির খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। দস্তয়েভস্কি ১৮৪৮ এর আলোড়ন তোলা সময়ে রুশ বিপ্লবী মিখাইল পেট্রাশেভস্কি চক্রের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন ও পেট্রাশেভস্কিকে ঘিরে বিপ্লবীদের যে আলোচনাচক্র বসত সেখানে নিয়মিত যাতায়াত শুরু করেন। সেখানে আলোচনা হত ভূমিদাসপ্রথার অবসান বা রুশ সেন্সরশিপের কঠোরতা থেকে মুক্তির প্রয়োজনীয়তা ও পদ্ধতির ওপর। সমকালীন ইউরোপীয় বিপ্লবের প্রেক্ষাপটে জার প্রথম নিকোলাস রুশ তরুণদের এইসব প্রগতিশীল উদ্যোগকে শুরুতেই ধ্বংস করার চেষ্টা করেন। আরো অনেকের সঙ্গে গ্রেপ্তার হন দস্তয়েভস্কিও। প্রথমে তাঁর প্রাণদণ্ডেরই আদেশ হয়েছিল, পরে শাস্তি খানিকটা লঘু করে তাঁকে পাঠানো হয় সাইবেরিয়ায় সশ্রম কারাদণ্ডে। এই কারাজীবন দস্তয়েভস্কির দর্শন ও চিন্তায় মৌলিক বদল আনে। সামাজিক প্রগতিচিন্তার চেয়েও তিনি ব্যক্তির স্বাধীনতাকে বেশি গুরুত্ব দিতে আরম্ভ করেন। এই ভাবনা ক্রমশ ব্যাপ্ত ও গভীর হয়। দস্তয়েভস্কি সোসালিজম, নিহিলিজম ইত্যাদি ধারণাকে ব্যক্তি স্বাধীনতার পরিপন্থী বলে মনে করতে থাকেন এবং এগুলিকে রুশী ঐতিহ্যে ঢুকে পড়া পশ্চিম ইউরোপের প্রভাব বলে মনে করেন। চল্লিশের দশকের বেলিনস্কি ও পেট্রাশেভস্কি চক্রের চিন্তার উত্তরসূরী বলা যায় ষাটের দশকের চেরনিশেভস্কিদের। কিন্তু পেট্রাশেভস্কি চক্রের উৎসাহী তরুণ থেকে বদলে যাওয়া মধ্যবয়স্ক দস্তয়েভস্কি চেরনিশেভস্কির চিন্তা ও দর্শনকে মানতে তো পারলেইনই না, তাকে ব্যঙ্গে সমালোচনায় বিঁধতে চাইলেন ‘নোটস ফ্রম আন্ডারগ্রাউন্ড’ নামের নভেলেট এ। চেরনিশেভস্কির ‘হোয়াট ইজ টু বি ডান’ এবং তার পরের বছর প্রকাশিত দস্তয়েভস্কির ‘নোটস ফ্রম আন্ডারগ্রাউন্ড’কে পাশাপাশি রেখে পড়লে স্পষ্ট বোঝা যায় কীভাবে দস্তয়েভস্কি সরাসরি চেরনিশেভস্কির দর্শন ও চিন্তার বিরুদ্ধ অবস্থান নিয়েছেন। চেরনিশেভস্কি মনে করেছিলেন যে মানুষ স্বাভাবিকভাবেই যুক্তিবাদী, এবং অধ্যয়ন ও প্রগতিশীল চিন্তাভাবনার মধ্যে দিয়ে এই যুক্তিবাদকে ছড়িয়ে দিতে পারলে সামাজিক মুক্তি সম্ভব। বিজ্ঞানচিন্তাই প্রগতিচিন্তার সারাৎসার – এটাই ছিল চেরনিশেভস্কি সহ নিহিলিস্ট বা সোশালিস্টদের মত। উপযোগিতাবাদ, যুক্তিবাদ ও সমাজবাদের দর্শনটিকে দস্তয়েভস্কি নির্ধারনবাদ বলে মনে করলেন এবং ‘নোটস ফ্রম আন্ডারগ্রাউন্ড’ থেকে তাকে খারিজ করা শুরু করলেন। মনে রাখতে হবে দস্তয়েভস্কির সমালোচনা ইংরেজ উপযোগিতাবাদী চিন্তাবিদ জেমস স্টুয়ার্ট মিল ও তাঁর গুরু জেরেমি বেন্থামের দর্শনের দিকেও ধাবিত হয়, কারণ চেরনিশেভস্কি যে সব চিন্তাধারা তাঁর লেখায় হাজির করেছিলেন তার অনেকগুলিরই উৎস রয়েছে মিল, বেন্থামের রচনায়।
‘নোটস ফ্রম আন্ডারগ্রাউন্ড’ এ যে অনামা ‘আন্ডারগ্রাউন্ড ম্যান’কে দস্তয়েভস্কি হাজির করলেন, তিনি প্রথম তারুণ্যে বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদকেই মুক্তির পথ ভেবেছিলেন, কিন্তু চল্লিশে পৌঁছে এর সীমাবদ্ধতাগুলি তার কাছে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। তিনি সামাজিক ইউটোপিয়াবাদকে খারিজ করেন এবং দেখান যে মানুষ মোটেই মূলগতভাবে যুক্তিবাদী নয়, যুক্তির বাঁধনে মানুষের জীবন, চিন্তা ও কাজ বাঁধা থাকে না, সে যুক্তি ও অযুক্তির মিশ্রণে স্বাধীনভাবে নিজের ইচ্ছানুযায়ী পথ চলতে চায়। দস্তয়েভস্কির এই ‘আন্ডারগ্রাউন্ড ম্যান’ এর কাছে জীবনের স্বাধীনতাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার এবং যুক্তিবাদ, সমাজবাদ প্রভৃতি তার মতে স্বাধীনতার জন্য প্রতিবন্ধক। তার মতে যুক্তিবাদ মানুষকে যান্ত্রিক করে দিতে বাধ্য।
উপযোগিতাবাদ, যুক্তিবাদ ও সমাজবাদের দর্শনটিকে আরো বড় পরিসরে খণ্ডনের কাজটা দস্তয়েভস্কি করতে চেয়েছেন তাঁর এবং অনেকের মতেই বিশ্বসাহিত্যের সর্বকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ উপন্যাস ‘ক্রাইম অ্যান্ড পানিশমেন্ট’ এ। এই উপন্যাসের নায়ক রাসকেলনিকভ ভাবতে চেয়েছিল, কিছু ব্যতিক্রমী মানুষের সমাজের প্রচলিত নিয়মনীতির বাইরে গিয়ে কাজ করার অধিকার আছে। বিশেষ করে সেই কাজ যদি বেশীরভাগ মানুষের জন্য উপযোগী হয়। আগামীর মহত্তর সৃজনের স্বার্থে বর্তমানের কিছু ধ্বংসাত্মক কাজের ন্যায্যতার কথাও সে ভাবত। রাসকেলনিকভ খুনের পরিকল্পনা করে এমন একজনকে, যে সুদখোর অর্থপিশাচ বন্ধকী কারবারি বহু হতভাগ্য মানুষের দুঃখ ও যন্ত্রণার কারণ। উপন্যাসের প্রথম পরিচ্ছেদেই কথক রাসকলিনকভের সঙ্গে পাঠককে নিয়ে যান সেই সুদখোর বুড়ি আলিওনা ইভানোভনার ঘরে। সেখানে রাসকেলনিকভ জরিপ চালায় খুনের ব্যাপারটাকে মসৃণ করার জন্য, পাঠক বুড়ির সঙ্গে তার পরিচয় সেরে নেবার সুযোগ পায়। পরে সে বুড়িকে কুঠারাঘাত করে খুনও করে। নিহিলিস্ট মতাদর্শ অনুসারে এই কাজটিকে সে প্রথমে ন্যায়সঙ্গত ও প্রয়োজনীয় বলেই ভাবতে চেয়েছিল। কিন্তু খুনের পর থেকে তার ভাবনা জগতে আসে বড়সড় বদল। সে খুনের প্রমাণ লোপ করে অকুস্থল থেকে সফলভাবেই সরে পড়তে সক্ষম হয়। তবে শারীরিকভাবে সরে পড়লেও এই খুনের আবেশ থেকে সে আর বেরোতেই পারে নি। শেক্সপীয়রের লেডি ম্যাকবেথ যেমন ডানকানকে খুন করার পর সবসময় রক্তের গন্ধ পেত আর সেই সূত্রেই করেছিল এই নাটকীয় উক্তি, “All the perfumes of Arabia will not sweeten this little hand”, তেমনি রাসকেলনিকভও অনুভব করে এক মানসিক যন্ত্রণা যেন তাকে ঘিরে রেখেছে। দস্তয়েভস্কির এই শ্রেষ্ঠ আখ্যান রাসকেলনিকভের সেই অপরাধের মানসিক যন্ত্রণা ও শাস্তিভোগেরই কাহিনী। উপন্যাসের প্রথম পর্ব যদি অপরাধ সংগঠনের কথা বলে, পরবর্তী পর্বগুলি বলেছে সেই অপরাধের শাস্তির কথা। এই শাস্তিকে শুধুমাত্র আইনী শাস্তি হিসেবে দেখান নি দস্তয়েভস্কি। রাসকেলনিকভের সঙ্কটটা কখনোই ক্রাইম থ্রিলারের পলায়নপর খুনির সঙ্কট নয়। তার সঙ্কট মানসিক যন্ত্রণা ও অপরাধবোধে ক্ষয়ে যাওয়ার। উপন্যাসের দ্বিতীয় পর্ব থেকে শুরু হয় মনোবিকলনের সেই অধ্যায়। আর দস্তয়েভস্কি দেখাতে থাকেন নিহিলিজম তত্ত্বের যান্ত্রিকতা ও সীমাবদ্ধতা। উপন্যাসের তৃতীয় পর্বের পঞ্চম অনুচ্ছেদটি এই প্রসঙ্গে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এখানেই রাসকেলনিকভ বন্ধু রাজুমিখিনের সূত্র ধরে মুখোমুখি হয় পুলিশের গোয়েন্দা পর্ফিরি পেত্রোভিচের। এই আলাপচারিতাতেই উঠে আসে উপন্যাসের একটি কেন্দ্রীয় থিম – অপরাধ সংগঠন তত্ত্ব – যা রাসকেলনিকভ হাজির করেছিল মাস কয়েক আগে লেখা তার ‘অপরাধ প্রসঙ্গে’ নামক এক প্রবন্ধে। সাময়িক সমীক্ষা পত্রিকায় প্রকাশিত এই প্রবন্ধে মূল আলোচনাটা ছিল অপরাধ সংগঠনের সমস্ত সময়ব্যাপী একজন অপরাধীর মানসিক অবস্থা কী হতে পারে তাই নিয়ে। তবে গোয়েন্দা প্রবর পর্ফিরির কাছে সবচেয়ে আকর্ষণীয় ঠেকেছিল প্রবন্ধের শেষে উপস্থাপিত এক সূত্রাকার ইঙ্গিতে, যেখানে ব্যক্ত হয়েছিল এইরকম এক চিন্তা যে, ‘দুনিয়ার সমস্ত মানুষ সাধারণ ও অসাধারণ এই দুই শ্রেণিতে বিভক্ত। যারা সাধারণ, তাদের নিয়মকানুন মেনে চলতে হবে, আইন লঙ্ঘনের কোনও অধিকার তাদের নেই … আর যারা অসাধারণ তারা যে কোনও রকম অপরাধ সংগঠনের এবং যে কোনও উপায়ে আইন লঙ্ঘনের অধিকারী, একমাত্র এই কারণে যে তারা অসাধারণ।’ পর্ফিরি এইভাবেই রাসকেলনিকভের প্রবন্ধের চিন্তাসূত্রটিকে উপস্থাপিত করলেও তাকে খানিকটা অন্যভাবে ব্যাখ্যা করা দরকার বলে রাসকেলনিকভ মনে করে সেই আলাপচারিতায়। ‘আমি আদৌ জোর দিয়ে বলিনি যে যারা অসাধারণ তারা অবধারিতভাবে সবসময় সবরকম অনাচার করবে এবং করতে বাধ্য থাকবে … আমি এই আভাস দিয়েছিলাম যে অসাধারণ ব্যক্তির এমন অধিকার আছে … অর্থাৎ কিনা আনুষ্ঠানিক অধিকার নয় … সে নিজেই নিজেকে, নিজের বিবেককে মাত্রা লঙ্ঘনের অধিকার দিতে পারে … একমাত্র সেই ক্ষেত্রে যেখানে তার আইডিয়া তা দাবি করে। আর তার সে সমস্ত আইডিয়া মানবজাতির পক্ষেও মঙ্গলজনক হতে পারে। … আমার মতে যদি পরিস্থিতি বিপাকে দেখা যেত যে নিউটন বা কেপলারের আবিষ্কারের পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়াচ্ছে অথবা ব্যাঘাত সৃষ্টি করছে একজন, দশজন বা একশজন মানুষ … এমনকি তার চেয়েও বেশি সংখ্যক মানুষের প্রাণবলি না দিয়ে সেই আবিষ্কার কোনমতে জনসমক্ষে প্রচারিত হতে পারছে না, তাহলে সে আবিষ্কারকে সমগ্র মানবজাতির কাছে সুপরিচিত করে তোলার উদ্দেশ্যে সেই দশজন, এমনকি একশজন মানুষকেও উৎখাত করার অধিকার … শুধু অধিকার নয়, আমি বলব কর্তব্যও … নিউটনের থাকত। তা থেকে কিন্তু আদৌ এই সিদ্ধান্তে আসা যায় না যে ডাইনে বাঁয়ে সামনে যাকে খুশি খুন করার অথবা বাজারে নিত্য চুরি করার অধিকার নিউটনের ছিল।’
দস্তয়েভস্কি
উপন্যাসের প্রায় মাঝামাঝি অবস্থিত এই পরিচ্ছেদটি উপন্যাসের কেন্দ্রীয় থিমটিকে খুব স্পষ্টভাবে নিয়ে আসে আলোচনাবৃত্তে। উনিশ শতকের ষাটের দশকে নিহিলিজম এর মতবাদটি নিয়ে যখন প্রবল বিতর্ক তৈরি হয়েছিল রাশিয়ার সমাজ ও সাহিত্যে, তখন দস্তয়েভস্কিও সেখানে অংশ নিয়েছিলেন একথা আমরা আগে বলেছি। তুর্গেনিভের ফাদার্স অ্যান্ড সনস এ বাজারভের চরিত্রায়ন, তার মতামতের সীমাবদ্ধতা ও পরিণতি ইত্যাদির মধ্যে দিয়ে নিহিলিজমের উপস্থাপিত ধরনটিকে যথার্থ বলে মানতে পারেন নি সে সময়ের রাডিক্যালদের প্রধান মুখ চেরনিশেভস্কি। আবার চেরনিশেভস্কির হোয়াট ইজ টু বি ডান সহ নানা লেখালেখিতে প্রকাশিত নিহিলিজমের জয়গান ছিল দস্তয়েভস্কির সমালোচনার অন্যতম নিশানা। নোটস ফ্রম দ্য আন্ডারগ্রাউন্ড এ প্রথমবারের জন্য এই সমালোচনা প্রকাশিত হয়, পরে একে অন্য স্তরে ও গভীরতায় ধরার চেষ্টা আমরা দেখতে পাই ‘ক্রাইম অ্যান্ড পানিশমেন্ট’ উপন্যাসে। এই পরিচ্ছেদেই রাজুমিখিনের কথার মধ্যে নিহিলিস্টদের অপরাধতত্ত্বর সমালোচনাকে উঠে আসতে দেখেছি আমরা। রাজুমিখিন অবশ্য নিহিলিস্ট এর বদলে ব্যবহার করেছিল সমাজতন্ত্রীদের কথা, তৎকালীন রাশিয়ায় যে পরিচয়গুলো ছিল পরস্পর সম্পর্কিত এমনকি অনেক ক্ষেত্র বিশেষ সম নির্দেশকও। রাজুমিখিন সমাজতন্ত্রীদের অপরাধ সংক্রান্ত দৃষ্টিকোণটি তুলে ধরেছে এইভাবে – ‘অপরাধ হল সমাজব্যবস্থার অস্বাভাবিকতার বিরুদ্ধে একধরনের প্রতিবাদ – এটাই শেষ কথা, এর বেশি কিছু নয়, আর কোন কারণ থাকতে পারে না, আর কোন কারণকে স্বীকার করা যায় না … সমাজকে যদি স্বাভাবিক করে গড়ে তোলা যায় তাহলে সঙ্গে সঙ্গে সব অপরাধও নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে, যেহেতু প্রতিবাদ করার কিছু থাকবে না, রাতারাতি সকলে সৎ হয়ে যাবে।’ এই দৃষ্টিকোণটি রাজুমিখিনের কেন গ্রহণযোগ্য বলে মনে হয় না, তাও সে জানিয়েছে এরপর। ‘মানুষের স্বভাব বা প্রকৃতিকে উপেক্ষা করা হচ্ছে, তাকে একেবারে বাতিল করে দেওয়া হচ্ছে, যেন তার কোন অস্তিত্বই নেই। মানবজাতি ইতিহাসের সজীব পথ ধরে শেষপর্যন্ত বিকশিত হয়ে পরিণামে আপনা আপনি স্বাভাবিক সমাজে রূপান্তরিত হবে – এ মত তারা মানে না। বরং তারা মনে করে কোন গণিতবিদের মস্তিষ্কপ্রসূত এক সমাজব্যবস্থা এক নিমেষে সমস্ত মানবজাতিকে সংগঠিত করে ফেলবে এবং পলকের মধ্যে তাদের করে তুলবে সৎ ও নিষ্পাপ। সেটা ঘটবে যে কোন সজীব প্রক্রিয়ার চেয়ে দ্রুত, ইতিহাসের কোন সজীব পথ ছাড়াই।’ বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র অবশ্যই রাজুমিখিনের মত সরলভাবে সমাজব্যবস্থা, মানব প্রকৃতি ও ইতিহাসের অগ্রগতিকে দেখে না, কিন্তু বর্তমান পরিসরে আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ যেটা তা হল উনিশ শতকের ষাটের দশকের সমাজতন্ত্রীদের ভাবনাচিন্তাকে কীভাবে দেখা হত, তার একটা বয়ান এখানে উপস্থিত। নিশ্চিত যে বিতর্কের সেই ঝোড়ো পটভূমিতে আরো অনেক বয়ান এবং বয়ানগুলির মধ্যে অনেক বিতর্ক নিহিত ছিল। দস্তয়েভস্কি যে চেরনিশেভস্কিদের মত বা নিহিলিস্ট দর্শনকে মানতে পারেন নি এবং এর বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিলেন তা নোটস ফ্রম আন্ডারগ্রাউন্ড থেকে শুরু করে ক্রাইম অ্যান্ড পানিশমেন্ট হয়ে দ্য ব্রাদার্স কারমাজোভ পর্যন্ত পরিণত বয়সের সমস্ত উল্লেখযোগ্য আখ্যানেই স্পষ্ট।
সামাজিক দার্শনিক মতবাদের প্রগতি প্রতিক্রিয়ার ছকে দস্তয়েভস্কির মহত্ত্বকে যে বিচার করা যায় না, বিখ্যাত মার্কসবাদী নন্দনতাত্ত্বিক ও উপন্যাস ব্যাখ্যাতা গেয়র্গ লুকাচ আমাদের তা মনে করিয়ে দিয়েছেন। দস্তয়েভস্কি সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে লুকাচ আমাদের মনে করিয়ে দেন চেকভের একটি গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্যসূত্র। চেকভ বলেছিলেন একজন শিল্পী সাহিত্যিকের কাজ সঠিক প্রশ্ন তোলা, সেই প্রশ্নের সঠিক উত্তর তিনি দিতে পারলেন কিনা, সেটা আদৌ ততটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। চেকভ এই প্রসঙ্গে পুশকিনের ‘ইউজিন ওনেজিন’ আর তলস্তয়ের ‘আনা কারেনিনা’র কথা তুলেছিলেন। পুশকিন বা তলস্তয় এখানে কোনও সমস্যারই নিরসন করতে পারেন নি, কিন্তু সঠিক সমস্যাকে তাঁরা অসামান্যভাবে হাজির করেছিলেন বলেই এগুলি কালজয়ী সাহিত্য হিসেবে গণ্য হয়েছে। দস্তয়েভস্কির সাহিত্য বিশ্লেষণ প্রসঙ্গে লুকাচ এই সূত্রটিকেই অনুসরণ করেছেন। তাঁর মতে দস্তয়েভস্কি সমস্যার যে সমাধানগুলি দেখান সেগুলি যে শুধু পরবর্তীকালের নিরিখেই শুধু ভ্রান্ত ঠেকবে তা নয়, সেকালেও এগুলি ছিল যথেষ্ট প্রতিক্রিয়াশীল চরিত্রের। কিন্তু তাতে দস্তয়েভস্কির অসামান্যতা বাতিল হয়ে যায় না। তিনি বিশিষ্টতার আসনে বসে আছেন সমস্যাগুলিকে সঠিকভাবে হাজির করতে পারার জন্য, সঠিক প্রশ্নগুলিকে অসামান্যভাবে সামনে নিয়ে আসতে পারার জন্য।
রাসকেলনিকভের সমস্যাকে দস্তয়েভস্কি যেভাবে হাজির করতে পারলেন তা কেবল সামাজিক রাজনৈতিক দর্শনের ব্যাপার নয়, একটি চরিত্রের বিশ্বাস ও বাস্তবের তীব্র টানাপোড়েনের বলিষ্ঠ উপস্থাপণ। ‘ক্রাইম অ্যান্ড পানিশমেন্ট’ উপন্যাসের এই রাজনৈতিক দার্শনিক বিতর্কগুলি নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ এবং দস্তয়েভস্কি অত্যন্ত সচেতন উদ্দেশ্যে এগুলিকে উপন্যাসে হাজির করেছেন। কিন্তু ক্রাইম অ্যান্ড পানিশমেন্টের মূল আকর্ষণ রাসকেলনিকভের চেতনাস্তরে ঘটে চলা প্রতি মুহূর্তের উথালপাতালের অন্তরঙ্গ ভাষ্য, তার ক্রমপরিণতির জীবন্ত চিত্র।
আকর
১) ইভান তুর্গেনেভঃ ফাদার্স অ্যান্ড সন্স – প্রগতি প্রকাশনী, মস্কো
২) নিকোলাই চেরনিশেভস্কিঃ হোয়াট ইজ টু বি ডান- প্রগতি প্রকাশনী, মস্কো
৩) ফিওদর দস্তয়েভস্কিঃ নোটস ফ্রম দ্য আন্ডারগ্রাউন্ড –প্রগতি প্রকাশনী, মস্কো
৪) ফিওদর দস্তয়েভস্কিঃ ক্রাইম অ্যান্ড পানিশমেন্ট –প্রগতি প্রকাশনী, মস্কো
আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।🙏 চলুক
এতো চমৎকারভাবে ধারাবাহিক এক আখ্যানকে বর্ণণা করা, খুব ভালো লেগেছে।
এগিয়ে চলুক এভাবেই।অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।