সূচী

ইতিহাস তথ্য ও তর্ক

সশস্ত্র বিপ্লববাদ থেকে স্বাধীনতার পথে চন্দননগর

সশস্ত্র বিপ্লববাদ থেকে স্বাধীনতার পথে চন্দননগর

অভিষেক চট্টোপাধ্যায়

মার্চ ৩০, ২০২২ ৮৩৭ 1

একটা চিঠি, বাস্তবিক উড়ো চিঠিই বলা চলে। উড়ো চিঠিই যখন, কোনও ইয়ারবন্ধুর করা প্র্যাকটিক্যাল জোক মনে করে উড়িয়ে দেওয়াই স্বাভাবিক। কিন্তু চিঠিটা আদ্যোপান্ত পড়ে কোথাও একটা খটকা লাগল ছেলেটার। কোথাও যেন একটা চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেওয়া হয়েছে তার সাহসিকতার পরীক্ষার জন্য। বুঝতে পেরে মুচকি হেসে চিঠিটা আরেকবার ভালভাবে পড়া শুরু করল… “যদি তুমি সত্য দেশসাধক হও, দেশহিতে জীবন বলি দেওয়ার স্পর্ধা থাকে, তাহা হইলে আগামী অমাবস্যার দ্বিপ্রহর নিশীথে শ্মশানের বটবৃক্ষ মূলে আমার সহিত সাক্ষাৎ করিও।”

উত্তুরে বাতাস বওয়া কনকনে শীতের রাত। খাটো ধুতির খুঁটে বাঁধা চিঠিটা যত্ন করে গুছিয়ে নিয়ে বেরিয়ে পড়ল ছেলেটি। এদিকে চিঠি পাঠানো বন্ধুদ্বয় ততক্ষণে এসে পৌঁছে গিয়েছে গঙ্গাপাড়ের শ্মশানে। পরীক্ষার ফল সম্পর্কে কিছুটা দোলাচলতা থাকলেও, উপস্থিত দুই বন্ধুই একটা বিষয়ে একমত, এই শীতের রাতে ভয়ংকর এই পরিবেশে নিশ্চিতভাবেই আসবে না কাঙ্ক্ষিত আগন্তুক। কিন্তু যদি আসে তাহলে নিশ্চিত হওয়া যাবে ছেলেটির সাহসিকতা সম্পর্কে।

সময় কেটেই চলেছে, একেকটা সেকেন্ড যেন একেক ঘন্টার থেকেও বেশি বলে মনে হচ্ছে ওদের। চারদিকে কোথাও কোনও সাড়া শব্দ নেই। শুধুমাত্র ঝিঁঝিঁ পোকার নিরন্তর শব্দ কানে অনুরণন সৃষ্টি করে চলেছে। কিন্তু সময় তো উত্তীর্ণ ইতিমধ্যেই। তাহলে চিন্তাভাবনা সঠিকই হয়েছে। এবার ফিরে যাওয়ার পালা! ভাবনা মত পিছনে ফিরতেই একটা বলিষ্ঠ হাত স্পর্শ করল কাঁধ, সঙ্গে প্রাণখোলা হাসি। “আমি ঠিকই সন্দেহ করেছিলাম, এ-কাজ তুমি ভিন্ন আর কে করবে!”, পিছনে ঘুরে দেখা গেল আপাদমস্তক কালো অঙ্গাবরণে ঢাকা অসাধারণ এক যুবক যার সর্বশরীর দিয়ে আত্মবিশ্বাস ঝরে পড়ছে। চন্দননগরের গর্ব কানাইলাল দত্ত। ফাঁসির মঞ্চে স্বাধীনতার জয়গান গেয়ে যাওয়া চন্দননগরের সেই দামাল সন্তান। মতিলাল রায় ‘আমার দেখা বিপ্লব ও বিপ্লবী’ গ্রন্থে লিখেছেন, “স্বদেশীর প্রবল উত্তেজনায় আমরা তখন মরিয়া হইয়া উঠিয়াছি। এই অবস্থায় কানাইলালের স্বাদেশিকতার একটি পরীক্ষা লওয়ার লোভ সংবরণ করিতে পারা গেল না। কাজেই আমি বন্ধুর সাথে পরামর্শ করিয়া একখানি উড়ো চিঠি পাঠাইয়া দিলাম।”

কানাইলালের সেদিনের নিশুতি রাতে শ্মশানে আগমনের এবং দেশমাতৃকার কাজে নিজেকে নিযুক্ত করার অদম্য ইচ্ছাশক্তি কাটিয়ে দিয়েছিল বাঙালির শতাব্দী প্রাচীন ভীরুতার অপবাদ। শোনা যায় ফাঁসির আদেশ শোনার পরবর্তী সময়ে ওজন বৃদ্ধি ঘটেছিল তরুণ কানাইলালের। ফাঁসির মঞ্চে হাসিমুখে মৃত্যুকে বরণ করে নেওয়ার মধ্যে ছিল সেই অকুতোভয়, উৎফুল্ল মনোভাবেরই বহিঃপ্রকাশ।

একটু পিছিয়ে যাওয়া যাক। ঊনবিংশ শতকের শেষভাগ, সারা দেশ জুড়ে ব্রিটিশ শাসনের নাগপাশে সাধারণ মানুষের জীবন রীতিমতো দুঃসহ। ১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহের মাধ্যমে যে প্রতিবাদের সূচনা, তাতে জনসাধারণের যোগ খুব বেশি না থাকলেও ইংরেজ বিরোধিতার আগুন ধিকিধিকি জ্বলে উঠছিল প্রায় সমস্ত ভারতীয়দের মধ্যেই। আর এই সংগ্রাম সামাজিক, রাজনৈতিক এবং শিক্ষা-সংস্কৃতির অলিন্দে একটা আলোড়নের জন্ম দিয়েছিল। ভারতীয়দের মধ্যে ধীরে ধীরে জন্ম নিচ্ছিল চেতনার প্রকাশ। এই পরিস্থিতিতে জন্ম নিল ভারতের জাতীয় কংগ্রেস। ১৮৮৫ সনে জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠিত হলেও তার কার্যপ্রণালীতে সকলে খুশি ছিলেন না, ফলে বাংলার বিভিন্ন স্থানে একাধিক গুপ্ত বিপ্লবী সমিতি গড়ে উঠতে শুরু করে। বাংলার তরুণদের মধ্যে ইতিমধ্যেই আলোড়ন ফেলে দিয়েছিল ১৮৯৭ সালের পুনের একটি ঘটনা। দামোদর চাপেকর এবং তার ভাই বালকৃষ্ণ চাপেকার দুই ভাই মিলে আক্রমণ করেন দুই ইংরেজ কর্মচারী র‍্যান্ড এবং আয়ার্স্টের উপর। বিচারে চাপেকর ভ্রাতাদের ফাঁসির আদেশ হলেও এই ঘটনা বাংলার বিপ্লবী যুবকদের মধ্যে রীতিমতো আলোড়ন ফেলে দেয়। চরমপন্থী আন্দোলনের যে ধারা গোপনে বেড়ে উঠছিল তা রীতিমতো সশস্ত্র আন্দোলন, বিপ্লবের রূপ নিয়ে প্রচারিত হতে থাকল বাংলাতে। ইতিমধ্যে প্রায় একই সময়ে বিলেত থেকে বরোদা কলেজের অধ্যক্ষ হয়ে যোগ দিলেন অরবিন্দ ঘোষ। অরবিন্দ ঘোষ মনে প্রাণে বিশ্বাস করতেন যে দেশ থেকে ইংরেজদের তাড়ানোর একমাত্র পন্থা সশস্ত্র আন্দোলন। আর সেই আন্দোলন আসতে পারে তখনই যখন দেশে বিপ্লবী সংগঠনগুলি বিস্তার লাভ করবে।

ইংরেজদের নাকের ডগায় ব্রিটিশ বিরোধী যুবকদের নিয়ে কয়েকটি  সংঘ গড়ে উঠলেও কলকাতা কেন্দ্রিক এই সমস্ত সংগঠনগুলির কার্যকারিতা বেশ অসুবিধাজনক, তার মূল কারণ ব্রিটিশ পুলিশ যথেষ্ট ওয়াকিবহাল ছিল এই সমস্ত গোপন বিপ্লবী কার্যকলাপের। ফলে কড়া নজরদারি এড়িয়ে কিছু করা বেশ দুঃসাধ্য ছিল। তবুও এই সব কিছুর মধ্যেও গড়ে উঠেছিল অনুশীলন সমিতি, যুগান্তর দল। অন্যদিকে ফরাসি শাসনাধীন উপনিবেশ চন্দননগর ছিল তুলনামূলকভাবে বৈপ্লবিক কর্মকাণ্ডের জন্য অনেকটাই নিরাপদ। ফরাসি শাসনে চন্দননগর একেবারে স্বর্গরাজ্য ছিল একথা ভাবলে ভুল হবে কিন্তু বিপ্লবীদের সংঘ স্থাপনের এবং আত্মগোপন করে থাকার জন্য অন্য জায়গার তুলনায় চন্দননগর ছিল অনেকটাই উপযুক্ত।

১৯০২ খ্রিস্টাব্দ, বাংলার মাটিতে ফিরে এলেন অরবিন্দ ঘোষ। কলকাতায় গড়ে উঠল গুপ্ত সমিতি ‘অনুশীলন সমিতি’। ব্যারিস্টার প্রমথনাথ মিত্রের সহযোগী হিসেবে এগিয়ে এলেন সতীশচন্দ্র বসু। এরপর ১৯০৬-এ যুগান্তর সমিতি এবং যুগান্তর পত্রিকা প্রচলিত হওয়ার ইতিহাস কারওই অজানা নয়। এদিকে অরবিন্দ ঘোষের ভ্রাতা বারীন্দ্রনাথ ঘোষও যোগ দিলেন অনুশীলন সমিতিতে।

একদিকে কলকাতায় যখন এই সব কর্মকাণ্ড চলছে পূর্ণমাত্রায়, ফরাসি সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ এবং তাদের মোসাহেবি করা উমেদারদের বিরুদ্ধে ধীরে ধীরে পুঞ্জীভূত হয়ে চলেছে ক্ষোভের আগুন। চন্দননগরের যুবসমাজের মধ্যে পুঞ্জীভূত সেই ক্ষোভের আগুন তাদের সংঘবদ্ধ করেছিল বড় কোনও সংগ্রামের পথে। আর সেই পথ যে সশস্ত্র বিপ্লবের পথ তাতে কারও মনেই কোনও সন্দেহ ছিল না।

চন্দননগরের প্রাচীনতম অংশের অন্যতম ছিল গঙ্গা তীরবর্তী গোন্দলপাড়া। হুগলি জেলার প্রাচীনতম জনপদগুলির মধ্যে অন্যতম গোন্দলপাড়ায় ইতিমধ্যেই মাথাচাড়া দিতে শুরু করেছে বিপ্লবের স্ফুলিঙ্গ। আর তারই ফলাফল গোন্দলপাড়া বান্ধব সম্মিলনী। স্বাস্থ্য, সাহিত্য, শিল্পকলা, ধর্ম, সংগীতচর্চার মিলনক্ষেত্র হিসেবে গড়ে ওঠা সম্মিলনীর সাংস্কৃতিক মিলনক্ষেত্রের আড়ালে ধীরে ধীরে যুবকদের মধ্যে গড়ে ওঠা বৈপ্লবিক চিন্তাভাবনার আলোচনার আখড়া হয়ে ওঠে এই সমিতি। তবে চন্দননগরে বৈপ্লবিক চিন্তাধারার একেবারে শুরুর পদক্ষেপ হিসেবে গোন্দলপাড়া বান্ধব সমিতিকে বিবেচনা করা যুক্তিযুক্ত হবে না বোধহয়। কারণ, এরও বহু পূর্বেই ১৮৮০ নাগাদ গড়ে উঠেছিল গোন্দলপাড়া পাঠ সমাজ। সরাসরি রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে কোনও প্রকার যোগাযোগ না থাকলেও এই সমিতি যুবক সম্প্রদায়ের মধ্যে রাজনৈতিক সচেতনতা গড়ে তুলেছিল তাতে কোনো সন্দেহ নেই। আর যা হয়ত এর পরবর্তী কালের রাজনৈতিক গুপ্ত সমিতিগুলিতে চন্দননগরের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগের প্রাথমিক ভিত্তি প্রস্তর নির্মাণ করেছিল। ঠিক এই সময়েই এই সমস্ত সমিতিগুলি থেকে প্রকাশিত হতে থাকে ‘চন্দননগর প্রকাশ’ এবং ‘হিতসাধিনী’ পত্রিকা। আরও পরে সুরেন্দ্রনাথ সেনের তত্বাবধানে প্রকাশ পায় ‘মাতৃভূমি’। অনুশীলন সমিতির দুই হোতা যতীন্দ্রমোহন বন্দ্যোপাধ্যায় (নিরালম্ব স্বামী) এবং সভাপতি প্রমথ মিত্রের মধ্যে দলের কর্মপ্রণালীগত মতবিরোধের কারণে ধীরে ধীরে বিভাজনের সৃষ্টি হয়, যার ফল যুগান্তর সমিতির সৃষ্টি। যুগান্তর পত্রিকা তার বেশ কিছুদিন আগে থেকেই অনুশীলন সমিতির মুখপত্র হিসেবে প্রকাশিত হতে শুরু করেছিল আর ঠিক সেই কারণেই নতুন সমিতিও সেই নামটিই ব্যবহার করাকে শ্রেয় মনে করে এবং ‘যুগান্তর’ নামটিও জনপ্রিয়তা লাভ করে। ইতিমধ্যে কংগ্রেসের মধ্যেও বেশ কিছু টানাপোড়েনের ফলে নতুন শাখা হিসেবে চরমপন্থী দল গড়ে উঠল সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে। এক্সট্রিমিস্ট সেই শাখা পেল লাল-বাল-পালের যোগ্য নেতৃত্বের ছোঁয়া আর অরবিন্দ ঘোষের যোগ্য অভিভাবকত্ব। চরমপন্থীরা ব্রিটিশহীন মাতৃভূমির স্বপ্নে বিভোর হয়ে উঠলেন আর দলে দলে যোগ্য যুবকের সহযোগিতা তাদের আরও বেশি করে উৎসাহিত করে তুলল। সময়কাল হিসেবে এই সময়টা ছিল ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। দেশপ্রেমের এক নতুন সংজ্ঞা বাঙালি যুবক, তরুণদের তখন উৎসাহিত করে চলেছে। এদিকে আধ্যাত্মিক আকাশে তারকা হিসেবে উদিত হয়েছেন স্বামী বিবেকানন্দ। শিকাগো ধর্মসম্মেলনের মঞ্চ থেকে উন্নত মস্তকে বীর সন্ন্যাসী ঘোষণা করছেন দেশপ্রেমের কথা, দেশের জন্য আত্মত্যাগের আদর্শে উৎসাহিত করছেন তরুণদের। সেই উদাত্ত আবেগের শিহরণ জাগিয়েছিল চন্দননগরের স্বাধীনতাকামী তরুণদের মধ্যেও। আর তারই ফলে গড়ে উঠল ‘সৎপথাবলম্বী সম্প্রদায়’। সংগঠনের প্রাণপুরুষ ছিলেন মতিলাল রায়, যাঁর লেখা পত্রের কথা দিয়েই প্রবন্ধের সূচনা। আশ্চর্য মানুষ ছিলেন এই মতিলাল, জাতিতে চৌহান বংশীয় ছেত্রী রাজপুত মতিলালের জন্ম হয়েছিল চন্দননগরের বোড়াইচণ্ডীতলায়। অরবিন্দ ঘোষের প্রিয় শিষ্য এবং সহকর্মী মতিলাল ছিলেন স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য নিরুচ্চারে কাজ করে যাওয়া এক বিশ্বস্ত সৈনিক। তার প্রতিষ্ঠিত সৎপথাবলম্বী সমিতি শুধুমাত্র ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানের মধ্যে নিজেদের আবদ্ধ না রেখে ধীরে ধীরে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়তে থাকে। স্বদেশী ও বয়কট আন্দোলনের সময় মতিলাল রায় মিছিল বের করেন। এদিকে গোন্দলপাড়ার বসন্তকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, উপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, উপেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ বান্ধব সমিতির মুখ্য ব্যক্তিরা ধীরে ধীরে অনুশীলন সমিতি এবং যুগান্তর সমিতির সভ্যদের সাথে যোগাযোগ শুরু করলেন। সেই সূত্রে মতিলালও জড়িয়ে পড়লেন স্বাধীনতা সংগ্রামের সাথে ঘনিষ্ঠ ভাবে। রাখি উৎসবে সকলের হাতে সৌভ্রাতৃত্বের বন্ধন জুড়ে দিয়ে যে কর্মকাণ্ডের সূচনা হয়েছিল তা পরিণতি পায় প্রবর্তক সংঘের প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। চন্দননগরে স্বাধীনতা সংগ্রামের মুখ্য আখড়া হয়ে ওঠে প্রবর্তক সংঘ। সংঘে যোগদান করেন একঝাঁক তরুণ তুর্কি…কানাইলাল দত্ত, শ্রীশচন্দ্র ঘোষ, মণীন্দ্র নায়েক, সাগরকালী ঘোষ প্রমুখ। প্রবর্তক সংঘে লাঠিখেলা, ছোরাখেলা, অস্ত্রচালনা প্রভৃতি গোপন কৌশল আয়ত্ত করার প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত তরুণের দল যে কোনও উপায়ে চরম আঘাত হানার জন্য প্রস্তুতি সম্পূর্ণ করতে থাকেন নিতান্তই গোপনে। এদিকে অনুশীলন সমিতির একাধিক শাখা দেশের বিভিন্ন প্রান্তে একইভাবে প্রস্তুত হচ্ছিল। একদিকে বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন এবং অন্য দিকে চরমপন্থী আন্দোলনের দিকে দেশজননীর শৃঙ্খলামোচনে উদ্বুদ্ধ যুব সম্প্রদায়ের ক্রমাগত ঝুঁকে পড়ার ঘটনা ক্রমশ বারুদে অগ্নি সংযোগের কাজ সম্পূর্ণ করে।

এই প্রসঙ্গে যে মানুষটি যোগসূত্রের কাজটি সম্পন্ন করেন তিনি হলেন চারুচন্দ্র রায়। চন্দননগরের লালবাগানের সম্ভ্রান্ত পরিবারের সন্তান চারুচন্দ্র ছিলেন সুবক্তা এবং সুলেখক। বাংলা, ইংরেজি, ফরাসি ভাষার সুপণ্ডিত চারুবাবু চন্দননগর কলেজে (তৎকালীন ডুপ্লে কলেজ) অধ্যাপনার কাজ নেন, আর সেই সঙ্গে চলতে থাকে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড। ফরাসিদের কাছেও চারুবাবু একজন সম্মানীয় ব্যক্তি ছিলেন, যে কারণে পরবর্তী কালে তিনি চন্দননগরের মেয়র হিসেবেও নিযুক্ত হন। তাছাড়া পন্ডিচেরির কেন্দ্রীয় আইনসভার সদস্যপদ কিংবা সর্বোচ্চ সম্মান ‘শেভালিওর’ লাভ করেছিলেন। কিন্তু বঙ্গভঙ্গের সময়কালে বাঙালি তরুণদের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে ফরাসি সরকারও ভীত হয়ে পড়ে। ফলে ব্যাপক ধরপাকড় শুরু করে, সেই সঙ্গে তাদের গতিবিধিও নিয়ন্ত্রিত করা হয়। এর মধ্যেই ঘটে যায় এক অশ্রুতপূর্ব ঘটনা, যা শুধু ইংরেজদেরই নয় ফরাসি শাসকদেরও শিরদাঁড়ায় শিহরণ জাগিয়ে তোলে। বারীন ঘোষ ইতিমধ্যে যুগান্তর দলের সাথে যুক্ত হয়েছেন, আর যোগাযোগ বেড়েছে চন্দননগরের সঙ্গেও। এবার তাঁর সাথে যোগাযোগ হল উপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের। উদ্দেশ্য বড় কিছু করার। যদিও তাতে কতটা বুদ্ধিমত্তা আর কতটা আবেগ জড়িয়ে ছিল তা নির্ধারণ করা আজকের সময়ে দাঁড়িয়ে করা সম্ভব নয়। উপেন্দ্রনাথের সাথে যোগাযোগের সময়েই বারীন ঘোষের সাথে পরিচয় হয় উল্লাসকর দত্তের। কুমিল্লার উল্লাসকর দত্ত ছিলেন উদ্যমী, হাসিখুশি যুবক। বোমা বানানোর শিক্ষাগ্রহণের জন্য তিনি হেমচন্দ্র কানুনগোকে ফ্রান্সে পাঠিয়েছিলেন কিন্তু হেমচন্দ্র ফ্রান্স থেকে শিক্ষা সম্পূর্ণ করে ফিরে আসার আগেই উল্লাসকর নিজ উদ্যোগে বোমা বানানোর প্রাথমিক পাঠ গ্রহণ করে বোমা তৈরী করে ফেললেন। বোমা তুলে দেওয়া হল অগ্নিযুগের দুই বীর সন্তান ক্ষুদিরাম এবং প্রফুল্ল চাকির উপর। রওয়ানা হয়ে গেলেন তাঁরা মুজাফফরপুরের দিকে, লক্ষ্য অত্যাচারী ব্রিটিশ শাসক কিংসফোর্ড। কিংসফোর্ড সাহেবের প্রিয় প্লান্টার্স ক্লাবের সামনে অপেক্ষা করতে লাগলেন তাঁরা। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত লক্ষ্য ভুল হয়ে গেল। কিংসফোর্ডের পরিবর্তে নিহত হলেন উকিল কেনেডি সাহেবের স্ত্রী ও কন্যা। ক্ষুদিরাম ধরা পড়লেন উইনি স্টেশনের কাছে আর প্রফুল্ল চাকি ধরা পড়ার লাঞ্ছনা থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য আত্মহত্যা করলেন। কিন্তু দেশমাতৃকার দুই বীর সন্তানের আত্মত্যাগ বিশেষভাবে অনুপ্রাণিত করে তুলল তাদের অনুগামীদের। এর আগেই বারীন ঘোষের নেতৃত্বে বিপ্লবী তরুণদের দল স্থির করেছিল বড়সড় কোনো আঘাত হানার। ১৯০৭ সালের শারদোৎসবের বিজয়ার দিন বারীন ঘোষ সন্ন্যাসীর ছদ্মবেশে দেখা করলেন চারুচন্দ্র রায়ের সাথে। চারুচন্দ্র রায়ের সুযোগ্য শিষ্যবৃন্দের মধ্যে ছিলেন কানাইলাল দত্ত, শ্রীশ ঘোষ প্রমুখ। জাতীয় কংগ্রেসের নেতা সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়কে আমন্ত্রণ জানালেন চারুচন্দ্র। লক্ষ্য চন্দননগরের সুযোগ্য শিষ্যদের স্বাধীনতার এই মহারণে সরাসরি যুক্ত করা। ইতিমধ্যে সশস্ত্র বিপ্লববাদে যুক্ত তরুণের দল ধীরে ধীরে পরিকল্পনার জাল বিস্তৃত করতে থাকে। সম্ভবত চারুচন্দ্র রায়েরও এই বিষয়টি অজানা ছিল না। মতিলাল রায়ের লেখাতেই তার কিছুটা প্রতিফলিত হতে দেখা যায়। ইতিমধ্যে ১৯০৭ সালের ডিসেম্বর মাসে ঘটে যায় সেই ঘটনা যার উল্লেখ আগেই বলা হয়েছে। বঙ্গভঙ্গের ঠিক পরেই  পুনর্গঠিত বাংলা প্রদেশের লেফটনেন্ট গভর্নরের দায়িত্ব নেন অ্যান্ড্রু ফ্রেসার। চন্দননগর এবং ভদ্রেশ্বরের মধ্যবর্তী রেলপথে ফ্রেসার সাহেবের গাড়িতে বোমা নিঃক্ষেপ করে তার প্রাণনাশের চেষ্টা করা হয়। প্রচেষ্টাটি সফল হয়নি। কিন্তু এই খবর দ্রুত চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে হাওয়ার বেগে। ঠিক এর পরপরই আরেকটি একই রকমের প্রচেষ্টা হয় মেদিনীপুরে। কিন্তু সে প্রচেষ্টাও সফল হয়নি। সাধারণ রেলকুলিরা চাপের মুখে সেই দায় নিজেদের কাঁধে তুলে নিলেও ব্রিটিশ শাসকদের হৃৎকম্প শুরু হওয়ার পক্ষে সেটা যথেষ্ট ছিল। এদিকে ফরাসি সরকার ভীত হয়ে প্রবল ধরপাকড় শুরু করলে বিপ্লবীরা ফরাসি সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিহিংসা পরায়ণ হয়ে ওঠে। সেই সময় চন্দননগরের মেয়র তার্দিভাল প্রবল দমন পীড়ন শুরু করলে বিপ্লবীরা তার্দিভালের প্রাসাদে (বর্তমান ইনস্টিটিউট দে চন্দননগর) বোমা নিঃক্ষেপ করেন। ভাগ্য সহায়! বেঁচে গেলেন তার্দিভাল। কিন্তু বিপ্লবীদের কিছুটা সুবিধা হল এই কাজে। প্রাণভয়ে ভীত তার্দিভাল পালিয়ে গেলেন ফ্রান্সে। তার্দিভালের উপর যারা বোমা নিঃক্ষেপ করেছিলেন তাদের মূল ঘাঁটি ছিল চন্দননগর। কাঁরা ছিলেন সেই দলে? এই বিস্ফোরণের পিছনে যাঁরা প্রধান মস্তিস্ক ছিলেন তাঁরা হলেন চারুচন্দ্র রায়, বারীন ঘোষ, শ্রীশচন্দ্র ঘোষ, নরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ। আর যাঁরা সরাসরি এই কাজে যুক্ত ছিলেন, তাঁদের মধ্যে ছিলেন কানাইলাল দত্ত, নরেন্দ্রনাথ গোস্বামী, ড. নগেন ঘোষ প্রমুখ। যদিও লক্ষ্যমাত্রা সম্পূর্ণ হয়নি কিন্তু গুপ্ত সমিতিগুলির ক্ষমতা সম্পর্কে অনেকটা সাবধান হয়ে ওঠে ব্রিটিশ সরকার। এদিকে চন্দননগরবাসীরাও চুপ করে বসে ছিলেন না। শহরের প্রথম সরাসরি রাজনৈতিক সমিতি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে র‍্যাডিক্যাল সভা। র‍্যাডিক্যাল সভার তরফে সংবাদপত্রও প্রকাশিত হতে থাকে। স্বাভাবিকভাবেই ব্রিটিশ ও অন্যান্য সাম্রাজ্যবাদী শক্তির শক্তির বিরুদ্ধাচারণ খুব ভালভাবে নেয়নি সরকার। সবরকমভাবে সেই বিদ্রোহী সুর দমনের চেষ্টার কোনো ত্রুটি রাখেনি ফরাসি সরকারও।

ইতিমধ্যেই কিংসফোর্ডের হত্যার প্রচেষ্টায় ক্ষুদিরাম বসু ধরা পড়েছেন আর প্রফুল্ল চাকি হয়েছেন আত্মঘাতী। ব্রিটিশ পুলিশের দেশীয় অনুচর এবং গোয়েন্দাবাহিনীর মাধ্যমে সরকারের কাছে খবর গেল কলকাতার মুরারীপুকুরে বিপ্লবী সংগঠনের গোপন ডেরার কথা। মানিকতলার কাছে মুরারীপুকুরে অকস্মাৎ হানা দিয়ে উদ্ধার হল বেশ কিছু অস্ত্রশস্ত্র, তাজা বোমা আর সেই সঙ্গে বোমা তৈরির বেশ কিছু কাঁচামাল। গ্রেফতার হলেন বারীন ঘোষ, অরবিন্দ ঘোষ সহ আরও অনেকেই। সেই তালিকায় বহু বিপ্লবীর সঙ্গে ছিলেন কানাইলাল, চারুচন্দ্র রায়, নরেন গোঁসাই সমেত আরও অনেকেই। চন্দননগর কেন্দ্রিক গুপ্ত সমিতির কার্যকলাপেও তা ছিল এক বড়সড় ধাক্কা। তার থেকেও গভীর সমস্যার কারণ হয়েছিল বারীন ঘোষের স্বীকারোক্তি! অরবিন্দ ঘোষের প্রেরণায় বহু তরুণ যারা দেশের জন্য নিবেদিত প্রাণ হয়ে লড়াইয়ে অংশগ্রহণ করেছিলেন তাঁদের হতাশ করে অরবিন্দ ঘোষের মানস জগতে এক বড়সড় পরিবর্তন আসে। আলিপুর বোমার মামলা নামে খ্যাত এই  বিখ্যাত মামলা চলাকালীন সংগ্রামী, সশস্ত্র আন্দোলনের পুরোধা অরবিন্দ ঘোষ আধ্যাত্মিক চেতনার প্রতি ধীরে ধীরে অনুরক্ত হয়ে পড়েন। বিপ্লবী অরবিন্দ ঘোষের উত্তরণ ঘটে ঋষি অরবিন্দ হিসেবে। কিন্তু বারীন ঘোষের স্বীকারোক্তি বহু বিপ্লবীর ধরা পড়ার কারণ হয়ে ওঠে। মামলায় চারুচন্দ্র রায় ছাড়া পেলেও কানাইলাল, নরেন গোঁসাই সমেত বহু বিপ্লবীর জেল হয়। কিন্তু কেন বারীন ঘোষ এতবড় স্বীকারোক্তি দিতে গেলেন? যে স্বীকারোক্তির জেরে এতজন তরুণ বিপ্লবী যাঁরা শুধুমাত্র দেশমাতৃকার সেবায় নিজেদের নিয়োজিত করেছিলেন তাঁরা ধরা পড়লেন, তাঁদের স্বপ্ন তছনছ হয়ে গেল! এ প্রসঙ্গে বারীন ঘোষের নিজস্ব স্বীকারোক্তি কী ছিল তা দেখে নেওয়া যাক। যে বারীন ঘোষ একসময় প্রবল উৎসাহে মন্তব্য করেছিলেন, “আমাদের মত প্রাণদানে প্রস্তুত বেপরোয়া তিনশত ছেলে জোগাড় হলেই ইংরেজ তাড়িয়ে দেশ স্বাধীন করা যাবে…”, মুরারীপুকুর বোমার মামলায় ধরা পড়ার পর তাঁর ভেঙে পড়া অস্বাভাবিক বলে মনে হলেও বাস্তবে খতিয়ে দেখলে কিন্তু খুব বেশি বিস্ময়কর বলে মনে হয় না। কারণ বারীন ঘোষের পরিকল্পনার মধ্যে সম্ভবত যতটা আবেগ ছিল তার ছিটেফোঁটাও বাস্তব ছিলনা। ফলে প্রথম আঘাত আসার পর কোনও বিকল্প রাস্তা তাঁর একবারের জন্যও চোখে পড়েনি। ঠিক সেই আভাসই তাঁর বন্ধু উপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়কে বলা তাঁর মন্তব্য থেকে জানা যায়…“মাই মিশন ইজ ওভার”। তাঁর কাছ থেকে পাওয়া বিবৃতির মাধ্যমে ব্রিটিশ পুলিশের কাছে যেসব তথ্য এসে পৌঁছোয় তাতে খুব স্বাভাবিকভাবেই বিভিন্ন গুপ্তসমিতির সদস্যদের নামগুলি উঠে আসে। আর সেই দলে ছিলেন কানাইলাল সহ আরও অনেকেই। সেই দলেই ছিলেন নরেন গোঁসাইও। নরেন গোঁসাই প্রথমে ধরা না পড়লেও বারীন ঘোষের স্বীকারোক্তি সেই পথ অনেকটাই পরিষ্কার করে দেয়। একথা আজ স্বীকার করে নেওয়াই যায় গুপ্ত সমিতির মন্ত্রগুপ্তির (আননেমড সিক্রেট) যে প্রাথমিক পাঠ বা শপথ, তা তিনি ভঙ্গ করেছিলেন নির্দ্বিধায়। কিন্তু পরবর্তী কালে এই নরেন গোঁসাই ইংরেজদের হয়ে রাজসাক্ষী হতে রাজি হলে বিশ্বাসঘাতকতার তকমা তাঁর নামের সাথে জুড়ে যায়। আলিপুর জেলের মধ্যেই তাঁর সেই বিশ্বাসঘাতকতার মাশুল তাঁকে মেটাতে হয় কানাইলালের রিভলভারের সামনে। রিভলভার পৌঁছে দেওয়ার দুঃসাহসিক কাজ করেছিলেন শ্রীশচন্দ্র ঘোষ, মতিলাল রায় এবং বসন্তকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়। দুঃসাহসিক কাজ, ধরা পড়লেই নিশ্চিত প্রাণদণ্ড, কিন্তু পিছু হাঁটেননি চন্দননগরের সেই তিন দামাল সন্তান।

কিন্তু যে দোষে নরেন গোঁসাই বিশ্বাসঘাতক হিসেবে তকমা পান ঠিক প্রায় একই রকমের অপরাধ বারীন ঘোষও কিন্তু করেছিলেন। অবশ্য নলিনীকান্ত গুপ্ত তার স্মৃতিকথায় বারীন ঘোষের এই অপরাধের কিছুটা লাঘব করেছেন তাঁর আত্মপক্ষ সমর্থনের প্রসঙ্গে বলা কয়েকটি কথার দ্বারা। যেখানে নলিনীবাবু দাবি করেছিলেন -“বারীনদা এবং আমাদের জ্যেষ্ঠ কয়েকজন ধরা পড়েই স্বীকারোক্তি করেছিলেন এক উদ্দেশ্যে -কয়েকজনের আত্মবলি দিয়ে দলটিকে বাঁচাতে। কয়েকজন সামান্য দায়িত্ব নিজেদের ওপর গ্রহণ করে যদি আর সকলকে নির্দোষ বলে প্রমাণ করানো যায়।” হয়ত সে উদ্দেশ্য মহৎ ছিল কিন্তু এর ফলে তরুণ বিপ্লবীদের মনোবল যথেষ্ট আঘাতপ্রাপ্ত হয় আর তাছাড়া তরুণদের হৃদয়ের উঁচু স্থান থেকে তার স্থানচ্যুতি যে হয়েছিল তাতে কোনোই সন্দেহ নেই। পরের ঘটনাগুলি ইতিহাসের বইতে বহুবার উল্লেখিত। মামলার রায়ে অরবিন্দ ঘোষ বেকসুর খালাস পেলেও বারীন ঘোষ, উল্লাসকর প্রমুখের ফাঁসির বদলে দ্বীপান্তরের সাজা হয়। এরপরে একটা লম্বা নীরবতা। ইতিমধ্যে অরবিন্দ ঘোষের মননে আমূল পরিবর্তনের সূচনা। কিন্তু একবার হাত ফস্কে বেরিয়ে গেলেও ব্রিটিশ পুলিশের তীক্ষ্ণ নজর অরবিন্দের উপর। সংবাদ এসে পৌঁছল তাঁর কাছেও। সময়টা ১৯১০ সাল। অরবিন্দ স্থির করলেন কলকাতা থেকে পালিয়ে আত্মগোপন করবেন। প্রথমে চারুচন্দ্র রায়ের কাছে এলেও ব্যর্থ হলেন। আশ্রয় দিলেন মতিলাল তাঁর চন্দননগরের প্রবর্তক সংঘে। প্রায় এক মাসেরও অধিক সময়কাল অরবিন্দ প্রবর্তক আশ্রমে আত্মগোপন করেছিলেন। আর নিজেকে ব্যস্ত রেখেছিলেন যোগ সাধনায়। এই সময়কালে তাঁর মধ্যে এক অসাধারণ পরিবর্তন হয়। এই প্রসঙ্গে একটা কাহিনির কথা বলা যেতে পারে। কথাগুলো আজও লোকমুখে ফিরে ফিরে আসে। মতিলাল রায়ের স্ত্রী ছিলেন রাধারাণী দেবী। স্বামীর সমস্ত কর্মকাণ্ড নীরবে শুধু যে সমর্থনই করে গেছিলেন এই মহিয়সী মহিলা তাই নয় আশ্রমের সমস্ত সুবিধা অসুবিধার প্রতি ছিল তার গভীর দৃষ্টি। এরকমই একদিন রাধারাণী দেবী স্নানান্তে এসে দাঁড়িয়েছেন আশ্রমের দোরগোড়ায়, লক্ষ্য ধ্যানরত শ্রী অরবিন্দের দর্শন। হঠাৎ ধ্যান ভেঙে তাঁকেই দেখতে পেলেন বিপ্লবী অরবিন্দ। সাথে সাথেই মানস জগতে কী যেন এক অদ্ভুত পরিবর্তন দেখা দিল তার। রাধারাণী দেবীকে মাতৃরূপে কল্পনা করে অস্ফুটে বলে উঠলেন “মাদার, দ্যা মাদার, দ্যা মাদার, দ্যা মাদার রিভিলস”। এই ঘটনার কথা আজও রূপকথার মতই জনে জনে ফেরে।

প্রবর্তক সংঘে অরবিন্দ কাটিয়েছিলেন এক মাসেরও বেশি সময়। আর সেই সময়ের মধ্যেই স্থির করেছিলেন তার ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা। অবশ্যই সে পথ ছিল আধ্যাত্মিক পথ, যোগের পথ। হয়ত সেই ভবিষ্যৎ পথ স্থির করার অনেকটাই এসেছিল প্রবর্তক আশ্রমে কাটানো সেই দিনগুলোয়। এরপর ছদ্মনামে এখান থেকেই ফরাসি জাহাজ করে পন্ডিচেরিতে গিয়ে রাজনৈতিক আশ্রয় লাভ করেন তিনি। এদিকে প্রবর্তক আশ্রমের মাধ্যমে সমাজসেবা, আর্তের সেবার কাজ যেমন চালিয়ে যাচ্ছিলেন মতিলাল, ঠিক তেমনই বিপ্লবী কার্যকলাপ চালিয়ে যাওয়ার জন্য ভিতরে ভিতরে রীতিমতো প্রস্তুতি চলছিল পুরোমাত্রায়। কিন্তু আলিপুর বোমার মামলায় একসাথে বহু বিপ্লবী ধরা পড়ায় এবং সেইসঙ্গে বারীন ঘোষের স্বীকারোক্তি এবং অরবিন্দ ঘোষের মনোজগতের আমূল পরিবর্তন সম্পূর্ণভাবে মনোবল ভেঙে দিয়েছিল তরুণদের। সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে ধীরে ধীরে আবার সংগঠন বাড়িয়ে তোলার কাজ করতে থাকেন মতিলাল রায়। কাজটা নিঃসন্দেহে কঠিন হলেও মতিলাল প্রানপণে চেষ্টা করতে থাকেন। যদিও এইসব আকস্মিক ঘটনার কারণে বিপ্লবীরা হতোদ্যম হয়ে পড়ে। সেই সঙ্গে নতুন সমস্যা হিসেবে আসে ঐক্যের অভাব। বিপ্লবী যে গ্রুপগুলো একসময়ে যুগান্তর, অনুশীলন সমিতির সাথে একসঙ্গে কোর কমিটি হিসেবে কাজ করছিল সেগুলোর মধ্যে ভাঙনের রেখা ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে ওঠে। প্রথমে চারুচন্দ্র রায় এবং পরে মতিলাল রায়ও সশস্ত্র বিপ্লবের পথ থেকে ক্রমে সরে আসতে শুরু করেন। যদিও বিপ্লবের সম্পূর্ণ সংশ্রব থেকে সরে আসতে পারেননি ঋষিপ্রতিম মানুষ মতিলাল রায়, বান্ধব সমিতির তরুণদের মাধ্যমে বিপ্লবের আগুন প্রজ্জ্বলিত রাখার কাজ চালিয়ে গেছিলেন নিঃশব্দে। ১৯১৫ সালে মতিলাল প্রকাশ করলেন প্রবর্তক পত্রিকা। যেখানে ঋষি অরবিন্দ লিখলেন, “আমি লিখি আর নাই লিখি, শ্রী ভগবান আমার মধ্য দিয়ে মতিলালকে শক্তি দিয়ে লেখাচ্ছেন।” এমনই অদ্ভুত যোগাযোগ, ভরসা ছিল দুজনের মধ্যে। হয়তো অরবিন্দের সংস্পর্শেই ধীরে ধীরে মতিলালের আধ্যাত্মিকতার দিকে ঝুঁকে পড়া, যদিও নিজের আধ্যাত্মিক আদৰ্শ কোনোদিনও বিপ্লবের কাজে বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি, বরং এক আশ্চর্য শক্তির সঞ্চার করেছিল, যে শক্তি জন্ম দিয়েছিল একজন অসাধারণ সংগঠকের। মতিলাল রায়ের হাত ধরে প্রতিষ্ঠিত হয় প্রবর্তক ব্যাংক, প্রবর্তক পাবলিশার্স, প্রবর্তক ফার্নিচার্স এবং জুটমিল। লোকশিক্ষার মাধ্যমে দেশের মানুষদের আরও বেশি করে সমাজের প্রতি দায়বদ্ধ করা কিংবা দেশের স্বাধীনতার প্রতি আরও বেশি করে আগ্রহী করে তোলার জন্য পুতুল প্রদর্শনী, অক্ষয় তৃতীয়ার মাসাধিক কাল ব্যাপী মেলা প্রভৃতির প্রচলন করেন। জীবনের শেষদিন পর্যন্ত মতিলাল রায় এবং তার স্ত্রী রাধারাণী দেবী নিজেদের নিবেদন করেছেন জনকল্যাণ এবং শিক্ষাবিস্তারের কাজে।

শুধুমাত্র বাংলা নয় বরং সারা দেশের বিপ্লববাদের কাজে সহায়তা করেছিল চন্দননগর। শুধু সহায়তা বললে বোধহয় ঠিক ব্যাখ্যা দেওয়া হবে না, বরং সারা দেশে বিপ্লবের রসদের যোগান দিয়েছিল গঙ্গাপাড়ের এই ছোট্ট ফরাসি উপনিবেশটি। শুধুমাত্র বিভিন্ন প্রদেশের বিপ্লবীদের নিশ্চিন্ত আশ্রয় প্রদানই নয় বরং সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণের মাধ্যমে চন্দননগরের তরুণ বিপ্লবীরা নিজেদের ছাপ রেখেছিল স্বাধীনতা সংগ্রামের কাজে। এরকমই একটি দুঃসাহসিক কাজ ছিল রডা কোম্পানির মাউৎজার পিস্তল সংগ্রহ করা। এই কাজে অংশগ্রহণ করেছিলেন বিপ্লবী শ্রীশচন্দ্র ঘোষ। এই প্রসঙ্গে একজনের নাম উল্লেখ না করলেই নয়, তিনি হলেন মণীন্দ্রনাথ নায়েক। সারা বাংলায় বোমা সরবরাহ করার যে প্রয়োজন ছিল, সেই কাজ নিঃশব্দে করে গিয়েছেন মণীন্দ্রনাথ। বিপুল পরিমাণ  প্রয়োজনীয় অর্থের যোগান দিতেন আশুতোষ নিয়োগী। চন্দননগরের বিপ্লববাদের কথা প্রসঙ্গে যে নাম উল্লেখ না করলে অসম্পূর্ণতা থেকে যায় তিনি হলেন বিপ্লববাদের অন্যতম প্রাণপুরুষ রাসবিহারী বসু। সারা দেশে একসাথে সশস্ত্র অভ্যুত্থানের পরিকল্পনা করলেও তা কোনও ভাবে ফাঁস হয়ে যায় ব্রিটিশ এবং ফরাসি পুলিশের কাছে। ফল ব্যাপক তল্লাশি এবং দমন পীড়ন। সেই দমন পীড়নে সাময়িকভাবে থমকে দিয়েছিল বিপ্লবী কার্যকলাপ। দিল্লিতে বড়লাট হার্ডিঞ্জের গাড়িতে মণীন্দ্রনাথের তৈরি বোমা বিস্ফোরণের প্রচেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার পর পুলিশ রাসবিহারীকে খুঁজতে শুরু করে। কিন্তু ছদ্মবেশ গ্রহণে পারদর্শী রাসবিহারী পুলিশের চোখে ধুলো দিয়ে রীতিমতো পালিয়ে বেড়াতে থাকেন। অবশেষে ১৯১৫ সালে তিনি পি.এন. ঠাকুর ছদ্মনামে দেশত্যাগ করে জাপানে চলে যান, পরবর্তী কালে সেখান থেকেই বিপ্লবী কর্মকাণ্ড পরিচালনা করেন। এ প্রসঙ্গে মণীন্দ্রনাথ নায়েকের কথা বিশেষভাবে বলা প্রয়োজন। মেধাবী ছাত্র মণীন্দ্র ছিলেন চন্দননগর স্কুলের (বর্তমান কানাইলাল বিদ্যামন্দির) ছাত্র এবং চন্দননগরের প্রথম বিজ্ঞান স্নাতক। তিনিই প্রথম বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে বোমা প্রস্তুত করেন চন্দননগরের বোড়াইচণ্ডীতলা অঞ্চলে অরুণ সোমের বাড়ির কারখানায়, অবশ্যই মতিলাল রায়ের প্রেরণায়। সেখান থেকেই বোমা সরবরাহ হয়েছে সারা দেশে, এমনকি বড়লাটের উপর আক্রমণ করা বোমাটিও তাঁরই তৈরি করা। অরবিন্দ ঘোষের এই ঘনিষ্ঠ ভক্ত বহুবার পন্ডিচেরির আশ্রমে দেখা করেছেন তাঁর সাথে। সক্রিয় রাজনীতি থেকে অনেকটা দূরে অবস্থান করা অরবিন্দ মতিলাল এবং মণীন্দ্রনাথের মাধ্যমেই হয়ত বহিঃর্জগতের সাথে কিছুটা যুক্ত ছিলেন।

১৯১৭ সালে সারা বিশ্বের রাজনৈতিক আকাশে এক নতুন চিন্তাধারার শুরু হয়। রুশদেশের সেই আন্দোলনের মুখ্যভূমিকায় ছিলেন শ্রমিক শ্রেণি। পুঁজিবাদ বিরোধী সেই আন্দোলনের ঢেউ এসে লাগে চন্দনননগরের মধ্যবিত্ত তরুণ সম্প্রদায়ের মধ্যেও। এমনিতেই ফরাসি শাসনাধীন এই উপনিবেশের ঔপনিবেশিক বিলাসিতার ছোঁয়া লেগেছিল শহরের উচ্চবিত্ত ও ধনী সম্প্রদায়ের মধ্যে। সেই বিলাসিতার ছোঁয়া জন্ম দিয়েছিল এক ছদ্ম বুর্জোয়া শ্রেণির। যাদের হাবেভাবে চালচলনে লেগেছিলো ফরাসি শাসকদের বিলাসী জীবন যাপনের রঙ্গীন ছোঁয়া, সেই সঙ্গে জুটেছিল এক শ্রেণির উমেদার যাদের কাজই ছিল আমোদ আহ্লাদের মাধ্যমে ফুর্তি আর মদ্য বিলাসে জীবন অতিবাহিত করা। ফলে স্থানীয় নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির অবস্থা ছিল বেশ সঙ্গীন। এই অবস্থায় ফরাসি বিপ্লবের স্বাধীনতা, সাম্য ও মৈত্রীর বাণী খুব বেশি স্পর্শ করতে পারেনি সাধারণ মানুষের মননকে। বরং বেশ কিছু ক্ষেত্রে তাঁরা বেশ বিরক্তই ছিলেন। এই অবস্থায় শ্রমিক শ্রেণির নেতৃত্বে পুঁজিবাদ বিরোধী আন্দোলন বেশ ভালোভাবেই ছুঁয়ে গেছিল সাধারণ চন্দননগরবাসীর মনকে। কিন্তু এই গণতান্ত্রিক আন্দোলনের শরিক হয়েও সশস্ত্র আন্দোলনের আবেগ পুরোপুরি মুছে যায়নি নাগরিকদের মন থেকে। এই প্রসঙ্গে যাঁদের নাম বিশেষত উল্লেখযোগ্য তাঁরা হলেন নারায়ণ চন্দ্র দে, হরিহর শেঠ, সাধুচরণ মুখোপাধ্যায় প্রমুখ। এই সময়ে একই সঙ্গে বিপ্লববাদী আন্দোলনের সাথে সমানতালে বৃদ্ধি পেতে থাকে পৌররাজনীতি। বিপ্লববাদী রাজনীতি জাতীয়তাবাদী রাজনীতির পাশাপাশি বাড়তে থাকে রুশ বিপ্লবের সমাজতান্ত্রিক চেহারা। এই তৃতীয় ধারার প্রভাবেই গড়ে ওঠে চন্দননগর যুব সমিতি। স্থানীয় লক্ষ্মীগঞ্জ বাজারে গড়ে ওঠে দেশজ পণ্যসামগ্রী কেনাবেচার স্থান ‘শিল্প সমবায়’। এই সমবায় আন্দোলন জন্ম দেয় কমিউনিস্ট ধারার এই নতুন রাজনৈতিক মতাদর্শ। যুব সমিতির প্রতিষ্ঠা ছিল এক যুগান্তকারী ঘটনা। যে ঘটনার অভিঘাত সম্পূর্ণ এক নতুন খাতে প্রবাহিত করেছিল তৎকালীন রাজনীতি । বর্তমান চন্দননগরের সত্যিকারের যে পরিবর্তন তার সূত্রপাত সম্ভবত হয়েছিল এই যুব সমিতির হাত ধরেই। সন ১৯২৯-এ যুব সমিতির প্রতিষ্ঠা হয় তুষার চট্টোপাধ্যায়, হীরেন চট্টোপাধ্যায়,কালীচরণ ঘোষ প্রমুখের হাত ধরে, যদিও এর পশ্চাতে প্রধান চালিকা শক্তি হিসেবে দুর্গাদাস শেঠ কিংবা অধ্যাপক জ্যোতিষচন্দ্র ঘোষের কথাও ভুলে যাওয়ার নয়।

যুব সমিতি প্রথমেই যে অন্যায়ের বিরুদ্ধে গর্জে ওঠে তা হল ভোটার তালিকার বিরুদ্ধে আন্দোলন। তৎকালীন চন্দনননগরে ঔপনিবেশিক ঐতিহ্য বজায় রেখেই প্রচলিত ছিল দু’ধরণের ভোটার লিস্ট। এই লিস্টে প্রথমেই আপত্তি জানায় যুব সমিতি, কারণ এই ধরণের তালিকা প্রণয়ন শুধু অন্যায়ই নয় বরং তা ছিল চন্দননগরবাসীর কাছে অত্যন্ত অপমানজনক। এই তালিকা অনেকটাই সাদা এলাকা আর কালো এলাকার স্মৃতি ফিরিয়ে এনেছিল। তালিকাতে প্রথমেই নথিভুক্ত ছিলেন ফরাসি, ভারতীয় ফরাসি এবং ‘রেনেসাঁ’রা। অন্যদিকে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকের মর্যাদা নিয়ে শেষ পংক্তিভুক্ত ছিলেন সাধারণ চন্দননগরবাসী। এই চরম অপমানকর পরিস্থিতির বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তোলার কাজ শুরু করে যুব সমিতি। অভূতপূর্ব সাড়ায় ফরাসি শাসকরাও বাধ্য হয় সেই অপমানজনক ভোটার তালিকা প্রত্যাহার করতে। শুধু তাই নয় সমিতির দুজন নেতা ড. হীরেন চট্টোপাধ্যায় এবং হরিদাস মোদক নির্বাচিত হন পন্ডিচেরির জেনেরাল কাউন্সেলের সভ্য হিসেবে। পৌর রাজনীতির এক নতুন ধারা চলার সাথে সাথে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের ধারাও অব্যাহত ছিল। সেই ধারা যে চন্দননগরবাসী বুকের মধ্যে সযত্নে লালন করে চলেছিলেন, তার একটা বহিঃপ্রকাশ দেখা গেল ১৯২৯-এ। সময়টা ভারতের জাতীয়তাবাদী রাজনীতিতে স্বাধীনতা সংগ্রামের ক্ষেত্রে এক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সময়। ব্রিটিশ সরকারের নির্মম আচরণ এবং পুলিশি অত্যাচারের বিরুদ্ধে যতীন দাস শুরু করেছেন অনশন আন্দোলন। সারা দেশে সেই আন্দোলনের ঢেউ ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ছে, চন্দননগরও তার ব্যতিক্রম নয়। এরমধ্যেই লাগাতার অনশনে মৃত্যুবরণ করলেন যতীন দাস। বিক্ষোভে ফেটে পড়েছিল সেদিন সমগ্র চন্দননগর। বিস্মিত ফরাসি শাসকদের নাকের ডগায় শুরু হল বিপুল সংখ্যক মানুষের বিক্ষোভ, আন্দোলন। ভীত সন্ত্রস্ত শাসক চেষ্টা করল বিদ্রোহ দমন করার সবচেয়ে সহজ পদ্ধতি গ্রহণ করতে। গ্রেফতার হলেন দুর্গাদাস শেঠ, আবারও বিক্ষোভে সামিল হয়েছিল গোটা চন্দননগর। নৃত্যগোপাল স্মৃতিমন্দির (বর্তমান চন্দননগর পুস্তকাগার) প্রাঙ্গণে দামাল বিপ্লবী কানাইলাল দত্তের মূর্তি উন্মোচনে হাজির হলেন বিভিন্ন বিপ্লবী, যাঁদের মধ্যে ছিলেন ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত, সন্তোষ মিত্র, প্রতুল গাঙ্গুলি প্রমুখ।

১৯৩০-এই ঘটে গেল একটা ভয়ঙ্কর ঘটনা, যা আবার দেখিয়ে দিয়েছিল চন্দননগরবাসীর প্রতিবাদের মূর্তরূপ। ঘটনাটা একটু বিস্তারিত বলতে গেলে পিছিয়ে যেতে হয় বেশ কিছুটা। চট্টগ্রামের বীর বিপ্লবীদের একটা বড় অংশ বিভিন্ন জায়গায় ঠোক্কর খেয়ে অবশেষে আশ্রয় পেয়েছেন গোন্দলপাড়ায় গঙ্গার ধারে দাশরথী ঘোষের দ্বিতল বাড়িতে। আশ্রয় খুঁজে দেওয়ার পিছনে গোন্দলপাড়ার বিশিষ্ট বিপ্লবী বসন্ত কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়। বাসা ভাড়া নেওয়ার কাজে সাহায্য করেছেন পরম সাহসিনী সুহাসিনী গাঙ্গুলি এবং শশধর আচার্য। তাঁরা স্বামী স্ত্রীর পরিচয়ে ঘর ভাড়া নিলে সেখানে আশ্রয় পান গণেশ ঘোষ, অনন্ত সিংহ, মাখনলাল ঘোষাল সমেত আরও অনেকেই। প্রায় চার মাসের ব্যবধান, কিন্তু সংবাদ কোনও ভাবে পৌঁছে গেল ব্রিটিশ পুলিশের কাছে। ভোররাতে অকস্মাৎ হানা দিলেন চার্লস টেগার্ট। কুখ্যাত টেগার্ট বাহিনীর সাথে সম্মুখ সমরে প্রাণ দিলেন মাখনলাল। পাশের পুকুর লাল হয়ে গেল বিপ্লবী তরুণের রক্তের স্রোতে। জাল ফেলে তোলা হল শহীদের দেহ। গর্জে উঠল সমগ্র চন্দননগর। জনগণের প্রবল আন্দোলনের নেতৃত্বের ভার সেদিন তুলে নিয়েছিল যুব সমিতি। ব্রিটিশ সরকার সেদিন অনুধাবন করেছিল কত শক্তি ধরে নিরীহ সাধারণ মানুষগুলো। ব্রিটিশ এবং ফরাসি শাসকরা বুঝে গিয়েছিল শেষের দিন সমাগত। আর যুব সমিতি ঝাঁপিয়ে পড়েছিল আরও বেশি করে ব্রিটিশ বিরোধিতায়। আইন অমান্য আন্দোলনের ঢেউ এসে আছড়ে পড়ে চন্দননগরের বুকে। যুব সমিতি আশ্রয় দেয় জেল পলাতক বিপ্লবী দীনেশ মজুমদার, শচীন করগুপ্ত এবং নলিনী দাসকে। ফরাসি কমিশনার মসিয়ে ক্যা নিহত হন তাঁদের হাতে। এই হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার সন্দেহে গ্রেফতার হন যুব সমিতির পাঁচজন নেতৃস্থানীয় সদস্য।

যুব সমিতি চন্দননগরের শ্রমিক এবং খেটে খাওয়া মানুষদের ঐক্যবদ্ধ করা শুরু করলে একে একে গড়ে ওঠে ট্রেড ইউনিয়ন, প্রতিষ্ঠিত হয় মহিলা সমিতি। ছাত্র সংগঠনগুলি বিভিন্ন স্কুল-কলেজে তাদের আন্দোলনের মাত্রা আরও শক্তিশালী করে তোলে।  ফ্যাসিবাদ বিরোধী আন্দোলনের শরিক হয় কমিউনিস্ট ভাবধারায় বিশ্বাসী জনগণ। যুব সমিতির নেতৃত্বের সম্মুখ সারির বেশ কয়েকজন সমাজ পরিবর্তনের ভাবধারায় নিজেদের লক্ষ্য স্থির করে যোগ দেন কমিউনিস্ট আন্দোলনের পথে, যে আন্দোলন চলতে থাকে চন্দননগরের মুক্তিলাভ এবং ভারতে অন্তর্ভুক্তি পর্যন্ত।

১৯৩৪-এ চন্দননগরকে কেন্দ্র করেই গড়ে ওঠে হুগলি জেলা কমিউনিস্ট পার্টি। সংগঠনের তরফে জেলা সভাধিপতির দায়িত্ব পান আনন্দ পাল। অবিভক্ত বাংলার কমিউনিস্ট পার্টির দ্বিতীয় প্রাদেশিক সম্মেলনের গোপন বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় শহরে ফরাসি সরকারের নাকের ডগায় এই সব কর্মকাণ্ড চললেও সরাসরি বাধা আসেনি, কারণ ফরাসি সরকারের আইন অনুযায়ী কমিউনিস্ট পার্টি মোটেও নিষিদ্ধ ছিল না। কিন্তু ঘুরপথে বিভিন্ন বিধিনিষেধের জাল বিস্তার করে ফরাসি শাসকরা প্রচেষ্টা শুরু করেন কর্মকাণ্ডকে বাধা দেওয়ার। বিকল্প একটা পথের ভাবনা কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যরাও ভেবে রেখেছিলেন, তা হল নাম পরিবর্তন। প্রকাশ্যে কর্মকাণ্ড চালানোর জন্য ১৯৩৮-এ সোশ্যালিস্ট পার্টি গঠনের প্রস্তাব গৃহীত হয়। ইতিমধ্যে শুরু হয়েছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। হিটলারের পতনের মাধ্যমে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরিসমাপ্তির পথ প্রস্তুত হয়। কিন্তু সেই সঙ্গে সারা বাংলা জুড়ে নেমে আসে দুর্ভিক্ষের করাল ছায়া। ঠিক একই সময়ে সারা দেশে শুরু হয় ৪২-এর আন্দোলন -‘ইংরেজ ভারত ছাড়ো।’ কিন্তু ভারত ছাড়ো আন্দোলনের খুব বেশি প্রভাব পড়েনি চন্দনননগরের জনগণের উপর। বরঞ্চ ঠিক এই সময়েই কমিউনিস্ট পার্টির ফ্যাসিবাদ বিরোধী আন্দোলন অনেক মানুষকে তাদের দিকে আকৃষ্ট করেছিল। একদিকে দুর্ভিক্ষপীড়িত এবং দুর্গত মানুষের মুখে সামান্য অন্ন তুলে দেওয়া কিংবা তাদের সমস্ত সমস্যায় যথাসাধ্য পাশে দাঁড়ানোর মাধ্যমে মানুষের আরও কাছে আসে কমিউনিস্টরা। বিশেষত মহিলা সমিতিগুলি আরও বেশি করে মানুষের মধ্যে কাজ করতে থাকে। চন্দননগরের মহিলারা অবিভক্ত বাংলার বুকে গড়ে তোলে ‘মহিলা আত্মরক্ষা সমিতি’। ১৯৪৫ সালের এপ্রিলে জার্মানির পতন হল, আর সেই সঙ্গে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরিসমাপ্তি ঘোষিত হল।  ভারতবর্ষ তখনও স্বাধীনতা অর্জনের সংগ্রামে পুরোপুরি লড়ে চলেছে। কিন্তু সেই পরিস্থিতির আঁচ খুব বেশি এসে পৌঁছালো না চন্দননগরে। দেশশ্রী হরিহর শেঠ ‘মুক্তি সাধনায় চন্দনননগর’ প্রবন্ধে লিখেছেন -‘তখনও এখানে মুক্তির সন্ধানে কোনো বিশেষ প্রচেষ্টা পরিলক্ষিত হয় নাই’। যতটা চিন্তা চন্দননগরের আভ্যন্তরীণ বিষয় নিয়ে ছিল, তার খুব কম অংশই হয়ত সর্বভারতীয় রাজনীতির বিষয়ে ছিল একথা মেনে নিতেই হয়। ১৯৪৫-৪৬ সাল ভারতের রাজনীতির একটি গৌরবময় অধ্যায়, নৌ বিদ্রোহ এবং নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর সুযোগ্য নেতৃত্বে চন্দননগরের বীর বিপ্লবী রাসবিহারী বসুর তৈরী আজাদ হিন্দ বাহিনীর মুক্তি সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়া। চন্দননগরবাসীর জীবনে আলোড়ন ফেলে দিয়েছিল এই দুই ঘটনা। এর কিছুদিনের মধ্যেই আসে কাঙ্ক্ষিত সেই দিন -স্বাধীনতা। কিন্তু চন্দনননগরের ভাগ্যাকাশে তখনও পরাধীনতার ছায়া। ফরাসি সরকার তাদের আধিপত্য কায়েম রাখার প্রচেষ্টায় কোনো খামতি রাখেনি। ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দে ভারতে অর্ন্তবর্তী সরকার প্রতিষ্ঠিত হলে চন্দননগরবাসীর মনেও ফরাসি ঔপনিবেশিকতার হাত থেকে মুক্তি লাভের আকাঙ্ক্ষা দুর্নিবার হয়ে ওঠে। কিন্তু ফরাসি সরকার স্বাধীনতা প্রদানে নাছোড়বান্দা মনোভাব প্রদর্শন করতে থাকে। ঠিক এই সময়ে বিশিষ্ট কমিউনিস্ট নেতা জর্জি দিমিত্রভের ফ্যাসিবাদ বিরোধী গণতান্ত্রিক ফ্রন্টের অনুকরণে শহরের গণতন্ত্রপ্রিয় কমিউনিস্ট ভাবধারার মানুষজন মিলে তৈরি করেন এনডিএফ বা ন্যাশনাল ডেমোক্রাটিক ফ্রন্ট। এই সময়েই প্রথমবার এনডিএফ ফরাসি উপনিবেশগুলির স্বাধীনতা এবং ভারতের মূল ভূখণ্ডের সাথে যুক্ত করার দাবি পেশ করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের জন্য পৌর পরিষদের নির্বাচন স্থগিত থাকায় ১৯৪৬-এ সেই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনের ফল বেরোলে দেখা যায় এনডিএফ-এর বেশিরভাগ প্রার্থীই জয়লাভ করেছেন। মেয়র নির্বাচিত হন কমলাপ্রসাদ ঘোষ এবং ডেপুটি মেয়র হন জয়গোপাল মুখোপাধ্যায়। পৌর প্রশাসনের সভায় স্বাভাবিকভাবেই চন্দননগরবাসীর দীর্ঘদিনের দাবি হিসেবে সম্পূর্ণ স্বাধীনতার দাবি গৃহীত হয়। এদিকে জনগণের চাপও ক্রমাগত বাড়তে থাকায় ফরাসি সরকারও ব্রিটিশদের মতই উপনিবেশগুলির স্বাধীনতা প্রদানের কথা ঘোষণা করে ফ্রান্সের উপনিবেশ সচিব মঁসিয়ে মারিয়াস মুতেকে দাবিদাওয়া পেশের আবেদন জানান, সেই মত পরিদর্শক হিসেবে নিযুক্ত হন তেজেনা দে মন্তসেল। ১৯৪৭ সালে মেয়র কমলাপ্রসাদ ঘোষের নেতৃত্বে আরও চল্লিশজনের একটি দল তেজেনার সাথে সাক্ষাৎ করে বেশ কিছু দাবি দাওয়া পেশ করেন। দাবি দাওয়ার মূল সুরই ছিল ফরাসি শাসন ব্যবস্থার হাত থেকে সম্পূর্ণভাবে মুক্তি। সেই দাবির একটি প্রতিলিপি মঁসিয়ে মুতের কাছেও পাঠানো হয়। কিন্তু তখনও ফরাসি সরকার কোনোভাবেই অধিকার ছেড়ে দেওয়ার মত অবস্থায় না থাকার দরুন স্বাভাবিকভাবেই দাবিগুলি অগ্রাহ্য হয়। এদিকে পুনরায় সভা অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে স্বায়ত্তশাসনের দাবি উঠে আসে। সেই মত মেয়র কমলাপ্রসাদ ঘোষ এবং সভাপতি হরিহর শেঠের মাধ্যমে টেলিগ্রাম পাঠানো হয় মারিয়াস মুতের কাছে। কিন্তু ফরাসি সরকার বিন্দুমাত্র গুরুত্ব প্রদান না করায় স্বাভাবিকভাবেই আন্দোলন আরও গভীর হয়ে ওঠে। ঠিক সেই মুহূর্তে যে কোনও ভাবে পরিস্থিতি কিছুটা নমনীয় করার প্রচেষ্টায় কাজ শুরু করে ফরাসি সরকার, আর তার প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে চন্দননগরে পাঠান হয় ভারতের ফরাসি গভর্নর মঁসিয়ে চার্লস ফ্রাসোয়া মেরি ব্যাঁরোকে। ব্যাঁরো সবকিছু গভীর ভাবে পর্যালোচনা করে যে কথা বলে যান তা ছিল চন্দননগরবাসীর নিতান্তই অপছন্দের। ফরাসি গভর্নরের প্রস্তাবে যে দিকটা লুকিয়ে ছিল তা থেকে ফরাসি সরকারের সাথে চন্দননগরের কিছু প্রভাবশালী (রাজনৈতিক) মানুষের গোপন আঁতাতের বিষয়টা আরও বেশি বেশি করে চোখে পড়তে থাকে। সেই প্রস্তাবে বলা হয় চন্দননগরের পৌরবোর্ড ভেঙে সেখানে নতুন একটি পরিষদের উপর সমস্ত দায়িত্বভার তুলে দেওয়া হবে এবং তা হবে ফরাসি সরকারের মনোনীত। ভারত স্বাধীনতা পাওয়ার ঠিক চারদিন আগে ফরাসি গভর্নর পুনরায় চন্দননগর আসেন। আগের ঘোষণার সামান্য কিছু পরিবর্তন করে ঘোষণা করা হয় স্বাধীনতার দিনেই গভর্নর মনোনীত সদস্য এবং পৌর প্রশাসনের তিনজনকে নিয়ে শাসন পরিষদের হাতে দায়িত্বভার অর্পণ করা হবে। এই মনোনীত শাসন পরিষদের সভাপতি হিসেবে হরিহর শেঠের নাম প্রস্তাবিত হয়। তুমুল বিরোধিতার মুখে পড়ে সেই প্রস্তাব, এমনকি সেই মুহূর্তে মনোনীত সভাপতি হিসেবে দায়িত্বভার নিতে অস্বীকার করেন স্বয়ং হরিহর শেঠও। বিস্ময়কর ভাবে পরের দিন অর্থাৎ ১২ই আগস্ট ঠিক একই প্রস্তাব সরকারি সিলমোহর পেয়ে গেল এবং বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় প্রকাশিত হল। সমগ্র ভারত যখন দ্বিশত বর্ষের পরাধীনতার গ্লানি থেকে মুক্তিলাভের আকাঙ্ক্ষায় আত্মহারা, চন্দননগরও স্বাধীনতা লাভের পথে আরও একধাপ এগিয়ে গেল অগণতান্ত্রিক ভাবে গঠিত শাসন পরিষদের মাধ্যমে কার্যভার গ্রহণের দ্বারা। কিন্তু সংগ্রাম তখনও শেষ হয়নি।

স্বাধীনতার পুণ্যলগ্নে জাতীয় পতাকা উত্তোলনের মহান কাজ নিয়েও শুরু হয়েছিল ঘৃণ্য রাজনীতি। যে রাজনীতির ফলে চন্দননগরের জনগণের দ্বারা নির্বাচিত মেয়রকে বাদ দিয়ে মনোনয়ন দেওয়া হল তৎকালীন হুগলি জেলা কংগ্রেসের সম্পাদক অতুল্য ঘোষকে। সেখানেও প্রবল বিরোধের সম্মুখীন হয় সেই সিদ্ধান্ত। আর প্রবল প্রতিরোধের মধ্যে অ্যাডমিনিস্ট্রেটর অফিসে সেই কাজ করেন নির্বাচিত মেয়র কমলাপ্রসাদ ঘোষই। কিন্তু ফরাসি এডমিনিস্ট্রেটরের উদাসীন ব্যবহার চন্দননগরবাসীকে ব্যথিত করে। সংক্ষিপ্ত অনুষ্ঠানে ক্ষমতা হস্তান্তর হলেও পরের দিনই বিপুল সংখ্যক মানুষ এই দাবি তোলেন যে, কোনও শর্ত নয়, বরং নিঃশর্তে ফরাসিদের বিদায় নিতে হবে। শয়ে শয়ে নারী পুরুষ জমায়েত হতে শুরু করেন চন্দনগরের গঙ্গাপারে স্ট্র্যান্ড রোডের উপর। সেই সঙ্গে শুরু হয় অনশন ধর্মঘট। অ্যাডমিনিস্ট্রেশন অফিস এবং শাসন পরিষদের কার্যালয় ঘেরাও হয়। পরিস্থিতি ক্রমশ ঘোরালো হয়ে উঠলে ছুটে আসেন পশ্চিমবাংলার প্রধানমন্ত্রী প্রফুল্লচন্দ্র ঘোষ। সেই শত শত বিক্ষোভকারীদের কাছে প্রফুল্ল ঘোষ আশ্বাস দিতে বাধ্য হন যে সেই মাসের মধ্যেই চন্দননগরের পূর্ণ স্বাধীনতা দেওয়ার প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ করতে তিনি নিজে উদ্যোগী হবেন এবং প্রয়োজনে ফরাসি শাসকের সাথে আলোচনা করবেন। বাস্তবিক পক্ষে সেই মুহূর্তে সেই আশ্বাস দেওয়া ছাড়া আর কোনও উপায়ও তাঁর ছিল না। খুশি মনে সেই বিক্ষোভ উঠে গেলেও পরিস্থিতি সেই তিমিরেই রয়ে গেল। জনগণ সারা দেশের সদ্যপ্রাপ্ত স্বাধীনতার আনন্দে গা ভাসাতে গিয়ে লক্ষ্য করল তাদের দাবি সংক্রান্ত যে আশ্বাস সরকারের তরফ থেকে এসেছিলো তার কোনও অগ্রগতিই হয়নি। আবার অসন্তোষ দানা বাঁধতে শুরু করায় এবার ফরাসি শাসকরা বিপদের আঁচ পেলেন, বুঝতে পারলেন আর কোনোভাবেই ঠেকিয়ে রাখা যাবে না জনগণকে। বাতিল হল পূর্বের দেকরে, জারি হল নতুন হুকুমনামা। অ্যাসেম্বলির সদস্য সংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে চন্দননগর হল ‘ville libre’ অর্থাৎ মুক্ত চন্দননগর।

১৯৪৭-এর ২৭শে নভেম্বর। গভর্নরের ঘোষণা অনুযায়ী চন্দননগর হল মুক্ত নগরী, যার শাসন পরিষদের সদস্যরা হবেন জনগণের দ্বারা নির্বাচিত। সত্যিই আনন্দের দিন গঙ্গাপাড়ের ছোট্ট ফরাসি উপনিবেশের জনগণের জন্য। ফরাসি গভর্নর উপস্থিত হলেন জনগণের সামনে, আর ভরিয়ে দিয়ে গেলেন প্রতিশ্রুতির বন্যায়। চার্লস ফ্রাঁসোয়া মেরি ব্যাঁরো তাঁর দীর্ঘ বক্তৃতার মধ্যে উল্লেখ করেন মুক্ত নগরী চন্দননগরের অপার সম্ভাবনার কথা, যে প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী চন্দননগর পাবে স্বাধীন রাষ্ট্রের তকমা, আর সেই শাসন কার্য পরিচালিত হবে চন্দননগরবাসীর নির্বাচিত প্রতিনিধিদের দ্বারা। কিন্তু কিছুদিন যেতে না যেতেই ভুল ভাঙল চন্দননগরের। আর তার কয়েকদিনের মধ্যেই নব গঠিত মনোনীত সদস্যদের নিয়ে গড়া কমিটির পঁচিশ জনের মধ্যে এনডিএফ-এর ছ’জনের প্রত্যেকেই পদত্যাগ করতে বাধ্য হলেন, ফরাসি অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের নতুন দেকরে বলে পৌর পরিষদ ভেঙে সেই দায়িত্ব পছন্দের মনোনীত বোর্ডের হাতে তুলে দিয়ে নিশ্চিন্তবোধ করল ফরাসি ঔপনিবেশিক সরকার। ঠিক সেই মুহূর্তে ফরাসি সরকারের সঙ্গে জাতীয় কংগ্রেসের নেতাদের মধ্যে গোপন আঁতাতের সম্ভাবনায় বিপ্লব-প্রতিবাদ আরও প্রবল হয়ে ওঠে শহরের বামপন্থায় বিশ্বাসী জনগণের মধ্যে। আর ঠিক সেই কারণে ভীত ফরাসি ঔপনিবেশিক সরকার দমন পীড়ন এবং কণ্ঠরুদ্ধ করার অনৈতিক খেলায় মেতে ওঠে। ফল গণতন্ত্রের অন্যতম ভিত্তি সংবাদপত্রের উপর বিধিনিষেধ, বাকরোধ করার প্রচেষ্টা আর সেই সাথে সভা সমিতিগুলিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা।

সম্ভাবনা একটা আগে থেকেই তৈরি হচ্ছিল, এবার তাতে ঘৃতাহুতির মত কাজ করল সাম্রাজ্যবাদী সরকারের মিথ্যাচারের মাধ্যমে জোর করে বামপন্থী ও প্রগতিশীল মানুষজনকে দমন পীড়ন এবং কারাবন্দি করার প্রক্রিয়া। অন্যদিকে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের জোর করে সকলের মতের বিপক্ষে গিয়ে নিরাপত্তা বিল পাশ করার ফলে চন্দননগরে বিদ্রোহের আগুন জ্বলে উঠল পুরোপুরি।

১৯৪৮ সালের জানুয়ারি মাসে নিরাপত্তা বিল পাশ হওয়ায় বিক্ষুব্ধ মানুষজনের সামনের সারিতে এগিয়ে এল এনডিএফ এবং অন্যান্য কমিউনিস্ট দলগুলি। প্রত্যেকের মিলিত প্রতিবাদে সেদিন রাস্তায় নেমে এসেছিল হাজার হাজার গণতান্ত্রিক মানুষজন। চন্দননগরের ঐতিহ্যমন্ডিত স্ট্র্যান্ড রোডে অ্যাডমিনিস্ট্রেশন অফিস এবং বাড়ি ঘেরাও হয়। প্রবল বিরোধী জনমতের চাপে  শাসন পরিষদের মনোনীত সদস্যরা ইস্তফা দিতে বাধ্য হলেন। সদস্যরা ইস্তফা দিলেও সেই ইস্তফা গৃহীত তো হলোই না, উপরন্তু আরও বেশি করে দমন পীড়ন নেমে এল গণতন্ত্রপ্রিয় সাধারণ মানুষের উপর। জোর করে ধরপাকড়ের কাজ চলতে থাকায় রেল স্টেশনে রেল আটকানোর কর্মসূচিতে অংশ নিলেন অনেকেই, নেতৃত্বে অন্তত পাঁচজন। আর সেখান থেকেই গ্রেফতার হলেন তাঁরা। তাঁদের মধ্যেই একজন ছিলেন মণীন্দ্রনাথ কুন্ডু, যাঁর স্মৃতিচারণায় উঠে এসেছে সেদিনের কথা। তিনি উল্লেখ করেছেন, পশ্চিমবঙ্গে সম্ভবত সেটাই প্রথম ট্রেন আটকানোর ঘটনা। আর এরই মধ্যে পশ্চিমবঙ্গ সরকার সবথেকে ঘৃণ্য কাজটি করল কমিউনিস্ট দলগুলিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। ১৯৪৮-এর সেই ঘোষণা বলে কমিউনিস্ট দলগুলি নিষিদ্ধ ঘোষিত হলেও আন্দোলনের পরম্পরা চলতেই থাকল। ক্রমাগত প্রতিবাদের চাপে প্রথমবারের জন্য ফরাসি সাম্রাজ্যবাদী সরকারও কিছুটা নমনীয় হল, ঘোষিত হল সমস্ত ফরাসি উপনিবেশগুলিকে অবিলম্বে স্বাধীনতা প্রদান করা হবে। এই কর্মকাণ্ড এগিয়ে চললে পশ্চিমবঙ্গ সরকারও কিছুটা উদ্যোগ নেয়।

এরপর শুরু হয় গণভোট পরিচালনা করার প্রক্রিয়া। সেই প্রক্রিয়া দ্রুততর করবার পিছনেও সম্ভবত কিছুটা স্বার্থ কাজ করেছিল। ঠিক সেইসময় যেহেতু কমিউনিস্ট পার্টি নিষিদ্ধ ঘোষিত, বেশিরভাগ নেতা হয় কারাবন্দি নতুবা আত্মগোপন করে আছেন গোপন আশ্রয়ে। ফলে বিরোধীশূন্য নির্বাচন জয় করাই ছিল প্রাথমিক লক্ষ্য। আর সেই লক্ষ্যে সাফল্য আসতে অসুবিধাও হল না খুব একটা। ১৯৪৮এর ২৫শে জুলাই অনুষ্ঠিত নির্বাচনে সহজেই জয়ী হলেন কংগ্রেস প্রার্থীরা। একেবারে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা। আবার স্লথতা! প্রায় ছ’মাস অতিক্রান্ত হলেও কোথাও কোনও রকম অগ্রগতি চোখে পড়ল না। অবশেষে সাধারণ নির্বাচনের দিনক্ষণ ঘোষিত হল। ১৯৪৯এর ১৯শে জুন সাধারণ নির্বাচনের দিন এক অভূতপূর্ব সাড়া দেখা গেল সাধারণ চন্দননগরবাসীর মধ্যে। দীর্ঘদিনের সাম্রাজ্যবাদী শাসকের হাত থেকে পাকাপাকিভাবে মুক্তি লাভের এক আশ্চর্য প্রাণপ্রাবল্যে সেদিন সব হিসেব উল্টে পাল্টে গেল। মোট নির্বাচক সংখ্যার তুলনায় প্রদত্ত ভোটের সংখ্যা কিছু কম হলেও সেই ভোটের প্রায় সবটাই ছিল ভারত ইউনিয়নে মিশে যাওয়ার আকুতি। বিপক্ষে ভোট পড়েছিল মাত্র একশো চোদ্দটি। ভারতের মহান ঐতিহ্যের সাথে মিশে যাওয়ার ইচ্ছে সেদিন ঘটিয়েছিল এক বৈপ্লবিক ঘটনা। যে বিপ্লবের মধ্যে ছিল না হিংসার লেশমাত্র, ছিল প্রবল আত্মপ্রত্যয়। আর সেই আত্মবিশ্বাস এনে দিয়েছিল রেফারেন্ডাম। মুক্ত শহর নয়, ভারতের সঙ্গে একাত্ম হতে চায় এই ছোট্ট ফরাসি উপনিবেশটি। হতে চায় স্বাধীন, কিন্তু ভারত আত্মার অঙ্গীভূত হিসেবেই। কথায় আছে ‘অশুভস্য কালহরণম’। বিদেশী ঔপনিবেশিকরা স্বাভাবিকভাবেই তখনও চেষ্টা করে চলছিল যে কোনও উপায়ে  চন্দননগরের স্বায়ত্তশাসন লাভ এবং ভারত রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্তির পথে যতদূর সম্ভব বাধা সৃষ্টি করতে। তবে এক্ষেত্রে শুধুমাত্র ফরাসি সরকারকেই দায়ী করলে বোধহয় সত্যের পথে যাওয়া সম্ভব হবে না। কারণ তখনকার ভারত সরকারের ভূমিকাও ফেলে দেওয়ার মত নয়। তাদের পদক্ষেপও ছিল যথেষ্ট শ্লথ। আর এই কারণে অনেকটা দেরি হলেও শেষ পর্যন্ত মুক্ত নগরীর তকমা ঘুচে ভারত আত্মার অঙ্গীভূত হওয়ার শুভ দিনক্ষণ ঘোষিত হয়। স্থির হয় যে, ১৯৫০ সালের ২রা মে ভারত রাষ্ট্রের অন্তর্গত হবে শতাব্দী প্রাচীন ফরাসি উপনিবেশ চন্দননগর। ‘ডি ফ্যাক্টো ট্রান্সফার’ অর্থাৎ ভারত সরকারের হাতে অর্পিত হবে তবে আনুষ্ঠানিক ভাবে ভারতের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার আগে পর্যন্ত চন্দননগর ফরাসি ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত হয়ে থাকবে।

ইতিমধ্যে কমিউনিস্ট পার্টির উপর লাগু করা নিষেধাজ্ঞা উঠে গিয়েছে। সুতরাং স্বাভাবিকভাবেই জেলবন্দি নেতাদের মুক্তি হয়। দেকরে অনুসারে নতুন করে নির্বাচনের দিনক্ষণও ঘোষিত হয়। ১৯৫১ সালের সেই নির্বাচনে কংগ্রেস দলের ভরাডুবি ঘটে, পঁচিশটি আসনের সবকটিতেই কংগ্রেসের পরাজয় ঘটে। নতুন শাসন পরিষদ গঠিত হয়। নতুন শাসন পরিষদের সভাপতি হিসেবে নির্বাচিত হন স্বাধীনতা সংগ্রামী তিনকড়ি মুখার্জি। অপরদিকে জনগণের সমর্থন লাভ করলেও ভারত সরকার বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে শাসন পরিষদের অ্যাডমিনিস্ট্রেটরকে পরিবর্তন করে, আর সেই পরিকল্পনা সঠিকভাবে রূপায়িত হয় নতুন অ্যাডমিনিস্ট্রেটরের দ্বারা বিভিন্ন কাজে বাধা প্রদানের মাধ্যমে। ফলে আবার আন্দোলন, রাজপথে জনজোয়ার। অবশেষে ১৯৫২ সালে ভারতের রাষ্ট্রপতি ভারতভুক্তির চুক্তিপত্রে সই করলে এবং ফরাসি সরকারও ট্রান্সফারের চুক্তি সাক্ষর করলে চন্দননগরের ভারতভুক্তি সম্ভব হয়। ভারতের অন্তর্ভুক্ত হয়ে চন্দননগরবাসী ভারতের নাগরিকত্ব পেলেও পশ্চিমবঙ্গ অঙ্গরাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হওয়া তখনও বাকি। সকলকে আশ্চর্য করে চন্দননগরের নির্বাচিত শাসন পরিষদ ভেঙে দেওয়া হল এবং জারি করা হল রাষ্ট্রপতি শাসন। কেন্দ্রীয় সরকার মনস্থ করেছিলেন এক সাধারণ মিউনিসিপালিটির থেকে বেশি কিছু মর্যাদা দেওয়া হবে না চন্দননগরকে। নির্বাচনের দিনক্ষণ স্থির হলে এক অভূতপূর্ব অবস্থার সৃষ্টি হল। মনোনয়ন পত্র প্রত্যাহারের শেষদিনে দলমত নির্বিশেষে সকল দলের সমস্ত প্রার্থীরাই মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করে নিলেন। কেন্দ্রীয় সরকার এবার আর কোনও ভুল না করে চন্দননগরবাসীর সত্যিকারের মানসিকতা বোঝার জন্য তদন্ত কমিশন বসালো। অমরনাথ ঝাঁ-এর নেতৃত্বে সেই কমিশন খুব শীঘ্রই রিপোর্ট পেশ করে। পরের ধাপ ভারত সরকারের পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সাথে আলোচনা এবং রাষ্ট্রপতির অনুমোদন লাভ।

দীর্ঘদিনের আন্দোলন-বিপ্লবের পর মুক্তি। ২রা অক্টোবর, ১৯৫৪ – এক পবিত্র দিবসে কার্যকরী হল চন্দননগর মার্জার অ্যাক্ট। গঙ্গাপাড়ের এক টুকরো ইউরোপ, ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ধাত্রীভূমি চন্দননগর মিশে গেল বাকি পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের সাথে।

তথ্যসূত্র:

১. মতিলাল রায়, “আমার দেখা বিপ্লব ও বিপ্লবী”, প্রবর্তক পাবলিশার্স, কলিকাতা, ১৯৫৭।

২. উপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, “নির্বাসিতের আত্মকথা”।

৩. ক্ষীরোদকুমার দত্ত, “ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও অনুশীলন সমিতি”, অনুশীলন সমিতি ৭৫তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী উদ্যাপন কমিটি, কলকাতা, ১৯৭৭।

৪. অমিয় সাহা সম্পাদিত, সত্যদর্শন অধিকারী ও শুভ্রাংশুকুমার রায় সংকলিত, “চন্দননগর সেকাল ও একাল, একটি সংক্ষিপ্ত রূপরেখা”।

৫. অশোককুমার চট্টোপাধ্যায়, “হুগলি জেলার ইতিকথা ও হুগলি জেলার স্বাধীনতা সংগ্রামীদের ইতিহাস”, মন তর্পণ। 

জন্ম ৫ই নভেম্বর, ১৯৮৩। বেড়ে ওঠা হুগলী জেলার ভদ্রেশ্বরে। পড়াশোনার শুরু চন্দননগরের শতাব্দী প্রাচীন কানাইলাল বিদ্যামন্দিরে। পরে রসায়ন এবং শিক্ষাবিজ্ঞান বিষয়ে স্নাতকোত্তর। পেশাগতভাবে বিদ্যালয় শিক্ষক। শখ ইতিহাস বিষয়ে পড়াশোনা, প্রাচীন মুদ্রা ও ডাকটিকিট সংগ্রহ করা। বিভিন্ন পত্র পত্রিকা, ওয়েবজিনে লেখালেখি করেন। প্রকাশিত পুস্তক তিনটি।

মন্তব্য তালিকা - “সশস্ত্র বিপ্লববাদ থেকে স্বাধীনতার পথে চন্দননগর”

  1. ভালো লাগলো।🌿 বারিন ঘোষ অরবিন্দ ঘোষ এর ভাই ছিলেন।এই সময় স্বামী বিবেকানন্দর ভাই ভূপেন্দ্র নাথ দত্তও সক্রিয় বিপ্লবী কার্যকলাপের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। বিপ্লবীদের নিয়ে একটা ভালো বই আছে।হরিপদ দের লেখা পারুল প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত।পড়ে দেখেতে পারো ভালো লাগবে।

মন্তব্য করুন

আপনার ইমেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।