সূচী

ইতিহাস তথ্য ও তর্ক

গৌড়েশ্বর গণেশ – এক ধুরন্ধর কূটনীতিজ্ঞ

গৌড়েশ্বর গণেশ – এক ধুরন্ধর কূটনীতিজ্ঞ

নবাঙ্কুর মজুমদার

মার্চ ২৬, ২০২২ ১০০৪ 8

প্রিয় ইমতিয়াজ,

আশাকরি তুমি ভাল আছো। তোমার চিঠির উত্তর দিতে এতোটা দেরি হয়ে গেল ব’লে আগেভাগেই তোমার কাছে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। আসলে ই-মেল, হোয়াটস অ্যাপের যুগে চিঠি লেখার অভ্যেস বা চিঠি পাওয়ার মজা দুটোই তো নষ্ট হয়ে গেছে, তাই সুদূর রাজশাহী থেকে তোমার ডাকটিকিট লাগানো হাতে লেখা চিঠিখানা যখন পেলাম, একটু অবাকই হয়েছিলাম। সত্যি বলতে কি, চিঠিটা খুলে পড়তে পড়তে বারে বারে ফিরে যাচ্ছিলাম ছোটবেলার সেই ডাকপিওনের দিনগুলোতে। নস্টালজিয়া যেন ঘিরে ধরছিল। তাই চিঠির মূল প্রতিপাদ্যতে মন না দিয়ে বাংলাদেশের ডাকটিকিট, সুন্দর খাম, হাতের লেখা ইত্যাদিতে বেশি মন দিয়ে ফেলছিলাম। যাইহোক, তোমার চিঠির বিষয়বস্তুতে ফিরে আসি।

তুমি লিখেছো, রাজশাহীর ভাতুরিয়ার জমিদার গণেশকে নিয়ে তোমার গর্বের অনুভূতির কথা। রাজা গণেশ সম্পর্কে তুমি একটু আধটু পড়েছো, কিন্তু তিনি কিভাবে সামান্য একজন জমিদার হয়ে পঞ্চদশ শতকের মত এক মধ্যযুগীয় পরিমণ্ডলে পরাক্রান্ত ইলিয়াসশাহী সুলতানদের সরিয়ে গৌড়ের সিংহাসন দখল করেছিলেন, তা তোমার কাছে পরিষ্কার নয়। আর সরাসরি না হলেও যে প্রশ্নটার দিকে তুমি ইঙ্গিত করেছো, ভারত জুড়ে মুসলিম শাসনের রমরমার যুগে একজন হিন্দু রাজাকেইবা কেমন করে গৌড়ের অমাত্যরা মেনে নিয়েছিলেন। তোমার এই জিজ্ঞাসা স্বাভাবিক। রাজা গণেশের অধ্যায় যেন ইতিহাসের এক প্রহেলিকা। ওঁর সম্পর্কে এখনও পর্যন্ত যে সব তথ্য আমাদের সামনে এসেছে, সেগুলি যদি বিশ্লেষণ কর, বুঝতে পারবে কতদূর কূটনৈতিক প্রজ্ঞা থাকলে একজন নিছক বাঙালি জমিদার ধর্মীয় অনুভূতি ইত্যাদিকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দীর্ঘকাল ধরে গৌড়-বাংলার কিংমেকার ও দু-দু’বার নিজেই কিং-এর ভূমিকা নিতে পারেন। গণেশকে জানতে গেলে রিয়াজ উস্‌ সালাতিন, তারিখ ই ফিরিশতা, আইন ই আকবরী, তাবাকাৎ ই আকবরী, মাসির ই রহিমী, ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির স্ট্যাটিস্টিক্যাল রিপোর্টার ফ্রান্সিস বুকাননের বিবরণী – এই লেখাগুলোই ভরসা। কিন্তু সমস্যা হল, এগুলির একটিও রাজা গণেশের সমসাময়িক কারও লেখা নয়, অনেক পরের রচনা। একমাত্র গণেশের আমলে কয়েকজন মুসলিম দরবেশের লেখা কয়েকখানি চিঠি তাঁর যুগের প্রামাণ্য দস্তাবেজ। তাই সেযুগের কয়েকটি চিঠির ভরসায় আজ তোমায় এই চিঠি লিখছি বলতে পারো।

রাজা গণেশকে ভাল করে জানতে গেলে তাঁর সমসাময়িক ইলিয়াসশাহী সুলতানদের নিয়েও একটু আধটু আলোচনা জরুরি, আশাকরি তুমি তাতে আপত্তি করবে না।

ইলিয়াসশাহী বংশের তৃতীয় সুলতান গিয়াসউদ্দিন আজম শাহ (১৩৮৯-১৪০৯ সাধারণ অব্দ) রাজসভায় উলেমা ও দরবেশদের প্রাধান্য নিশ্চিত করে তাঁর পূর্বপুরুষদের ধর্মসহিষ্ণু নীতি থেকে অনেকটা সরে এসেছিলেন, তা তো তুমি জানোই। পাশাপাশি মনে করে দেখো, নিজের বাবা সিকন্দর শাহের সাথে সিংহাসন নিয়ে লড়াই, জনৈক সাহেব খাঁয়ের সাথে দীর্ঘকাল ধরে নিষ্ফলা যুদ্ধ বা কামরূপ-কামতা রাজ্যের যৌথ বাহিনীর কাছে পরাজয় সুলতান গিয়াসউদ্দিনকে সেনাবাহিনী থেকে সাধারণ প্রজা, এমনকি নিজের অমাত্যবর্গের কাছেও অপ্রিয় করে তুলেছিল। এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে রাজনীতির রঙ্গমঞ্চে গণেশের প্রবেশ। গিয়াসউদ্দিন আজম শাহের হত্যার ষড়যন্ত্রে গণেশের সরাসরি হাত কতটা ছিল, পরিষ্কার না হলেও সন্দেহটা থেকেই যায়। এরপরে ১৪০৯ সাধারণ অব্দে সইফউদ্দিন হামজা শাহ সিংহাসনে বসলেন, কিন্তু তাঁর রাজ্যাভিষেক অনুষ্ঠান হল ১৪১২ সাধারণ অব্দে। চীনের মিং বংশের ইতিহাস ‘মিং শে’তে এর জলজ্যান্ত প্রমাণ রয়েছে। সেখানে দেখা যাচ্ছে চীন সম্রাট ইয়ুং লো-র রাজত্বের দশম বর্ষে অর্থাৎ ১৪১২ সাধারণ অব্দে সইফউদ্দিনের অভিষেক অনুষ্ঠানে যোগ দিতে চৈনিক প্রতিনিধিমণ্ডল এসেছিল। তুমিই বল, সিংহাসন নিয়ে বড়সড় একটা গোলমাল না হলে রাজ্যাভিষেকে এত দেরি হবে কেন? আমাদের মনে রাখতে হবে, গিয়াসউদ্দিনের মৃত্যুর সাথে সাথেই রাজদরবারের সমীকরণ বদলে গেছে, গণেশের হাতে তখন অপ্রতিহত ক্ষমতা। তাহলে কি এই গোলমালে গণেশের কোনরকম ইন্ধন ছিল? ইতিহাস নিরুত্তর। যাইহোক, অভিষেকের মাত্র কিছুদিনের মধ্যেই সইফউদ্দিন হামজা শাহের অস্বাভাবিক মৃত্যু হল। এবারে গণেশের পছন্দের লোক সইফউদ্দিনের দত্তক পুত্র, মতান্তরে ক্রীতদাস শিহাবউদ্দিন বায়োজিদ শাহ সুলতান হলেন। এখানে তুমি প্রশ্ন করতে পার, কি প্রমাণ আছে যে শিহাবউদ্দিন গণেশের পছন্দের লোক ছিলেন? আমরা ধরে নিতে পারি, দুজন সুলতানের পরপর মৃত্যুতে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ যোগ থাকা গণেশ ততদিনে দরবারী রাজনীতিতে নিরঙ্কুশ প্রাধান্য স্থাপন করে নিয়েছেন। কিন্তু তুমি যদি নিছক অনুমানে এখানে সন্তুষ্ট না হও, তাহলে আমি প্রমাণ হিসেবে ফিরিশতাকে কোট করবো। “তাঁর (শিহাবউদ্দিনের) তরুণ বয়সের জন্য বুদ্ধি অত্যন্ত কম ছিল। কান্-স্ নামে একজন বিধর্মী, যিনি ইলিয়াসশাহী বংশের অন্যতম অমাত্য ছিলেন, তিনি এঁর রাজত্বকালে বিরাট ক্ষমতা ও প্রাধান্য অর্জন করেন এবং রাজ্য ও রাজস্ব- সবকিছুর উপর পরিপূর্ণ কর্তৃত্ব লাভ করেন।”

গণেশ আর কান্-স্ একই লোক কিনা তা আমরা চিঠির শেষে আলোচনা করবো, আপাতত প্রসঙ্গে ফিরে আসি। তাহলে গণেশের হাতের পুতুল শিহাবুদ্দিন তো সুলতান হয়ে বসলেন, কিন্তু সে সুখ বেশিদিন সইলো না। ১৪১২-১৩ সাধারণ অব্দে সিংহাসনে বসে বছর দুয়েকের মধ্যেই তাঁর মৃত্যু হয়। এক্ষেত্রে এত তাড়াতাড়ি শিহাবউদ্দিনের মৃত্যুর দুটো কারণ হতে পারে, হয় কোন রোগভোগে, নয়তো গণেশের সাথে মনোমালিন্যের জেরে গণেশেরই হাতে। তবে তিনি এতোটাই দুর্বল সুলতান ছিলেন যে, গণেশের সাথে মনোমালিন্য করার মত ক্ষমতাও তাঁর ছিল কিনা বিবেচনার বিষয়। তো যাইহোক, শিহাবউদ্দিনের মৃত্যুর পর তাঁর শিশুপুত্র আলাউদ্দিন ফিরোজ শাহকে ১৪১৫ সাধারণ অব্দে সিংহাসনে বসিয়ে গণেশই ব-কলমে রাজত্ব করতে থাকেন।

এতোগুলো বছর ধরে একাধিক সুলতানকে হাতের পুতুল করে রেখে গণেশ কিন্তু তাঁর ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার ঘুঁটি সাজিয়ে যাচ্ছিলেন। এবারে পরিস্থিতি অনুকূল দেখে তিনি ঝোপ বুঝে কোপ মেরে দিলেন, অর্থাৎ বাচ্চা ছেলে আলাউদ্দিনকে সরিয়ে সিংহাসন থেকে রাজত্ব – সব দখল করে নিলেন।

তুমি একে মুসলিম সুলতানদের সরিয়ে এক হিন্দু রাজার বিজয় হিসেবে দেখতেই পার, যার ইঙ্গিত তুমি তোমার চিঠিতে দিয়েছো, কিন্তু আমি এই ব্যাপারটাকে বিদেশি বংশোদ্ভূত সুলতানদের অপসারণ করে বহু বছর পরে একজন ভূমিপুত্রের উত্থান রূপে দেখতে চাইবো। কারণ পরের ঘটনাক্রম পড়লে বুঝতে পারবে আজকের মত সেযুগেও ধর্মকে রাজনীতির বোড়ে হিসেবেই ব্যবহার করা হতো।

আসলে কাহিনীর ট্যুইস্ট এখান থেকেই শুরু হল বলা চলে। গিয়াসউদ্দিন আজম শাহ দরবারী রাজনীতিতে ধর্মকে ঢুকিয়ে দরবেশদের দরবারে যে জায়গা দিয়েছিলেন, এবারের প্রতিবাদটা সেইসব দরবারী দরবেশদের কাছ  থেকেই এল। একজন হিন্দু রাজাকে তাঁরা কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলেন না, পদে পদে অসহযোগিতা শুরু করেছিলেন। বাধ্য হয়ে রাজা গণেশকে প্রতিশোধের রাস্তা নিতে হয়। এ প্রসঙ্গে আমি রিয়াজ উস্‌ সালাতিনে বর্ণিত একটি ঘটনার দিকে তোমার দৃষ্টি আকর্ষণ করবো,– একদিন রাজসভায় রাজা গণেশের উপস্থিতিতে বদর উল ইসলাম নামে এক দরবেশ এসে রাজাকে অভিবাদন না করেই বসে পড়েন। গণেশ এর কারণ জিজ্ঞেস করাতে দরবেশ বলেন, ‘শিক্ষিত লোক বিধর্মীকে অভিবাদন করেন না’। অপমানিত রাজা সেদিন কিছু না বললেও আরও একদিন একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটায় গণেশের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যায়, তিনি সেই দরবেশকে হত্যা করেন। একই সাথে বিরোধীপক্ষের আরও বেশকিছু আলিম ও দরবেশও নিহত হন।

এ ঘটনায় উলেমা ও দরবেশরা তো দমলেনই না, উপরন্তু আরও বেশি করে ক্ষেপে উঠলেন। বিক্ষুব্ধ গোষ্ঠীর নেতা, ভূতপূর্ব সুলতান গিয়াসউদ্দিনের সহপাঠী ও তাঁর আমল থেকে দরবারে প্রাধান্য পেয়ে আসা আলিম নূর কুতব আলম ঘটনায় রঙ চড়িয়ে জৌনপুরের সুলতান ইব্রাহিম শর্কীকে এক আবেগপূর্ণ চিঠি লিখলেন। সেই চিঠিতে ‘বিধর্মীর হাতে ইসলাম বিপন্ন’ ধরণের এক উত্তেজনামূলক ভাষা ব্যবহার করে ইব্রাহিম শর্কীকে বাংলা আক্রমণ করতে প্ররোচিত করা হয়।

অন্যদিকে ইব্রাহিম শর্কীও ঘোলা জলে মাছ ধরতে নেমে পড়তে দেরি করলেন না। তিনি ইসলামের জয়পতাকা তুলে ধরার অছিলায় অবিলম্বে সসৈন্যে বাংলার দিকে এগোলেন। ইতিমধ্যে রাজা গণেশের কাছে খবর পেয়ে জৌনপুরের বাহিনীকে বাধা দিতে এগিয়ে এলেন গণেশের বন্ধু ত্রিহূতরাজ শিবসিংহ। তবে ধারে ও ভারে ইব্রাহিম শর্কীর সৈন্যদল ত্রিহূত বাহিনীর চেয়ে অনেকটাই এগিয়ে ছিল। ফলে স্বভাবতই শিবসিংহ পরাজিত হলেন।

রাজা গণেশ ছিলেন একজন পোড়খাওয়া রাজনীতিবিদ। তিনি ভাল করেই জানতেন রাজনীতির দাবা খেলায় কখনও এগোতে আবার কখনও পিছতে হয়। এবারে তাঁর পিছিয়ে আসার পালা। তিনি নূর কুতব আলমের সাথে ঝটপট সন্ধি করে নিলেন। সন্ধির শর্ত মোতাবেক নিজের ছেলে যদুকে ইসলামে ধর্মান্তরিত করে তার অনুকূলে সিংহাসন ত্যাগ করে আত্মগোপন করলেন গণেশ। যেহেতু বাংলার সিংহাসন আবার মুসলিম রাজার হাতে গেল, হোক না তিনি সদ্য ধর্মান্তরিত হিন্দু, তবু ইসলাম তো আর বিপন্ন রইল না, ফলে ইব্রাহিম শর্কীরও কিছু করার থাকলো না, সন্ধি প্রস্তাব মেনে নিয়ে জৌনপুরের বাহিনী নিয়ে ফিরে যেতে হল। সিংহাসনে বসলেন গণেশের পুত্র যদু, ওরফে জালালুদ্দিন মুহাম্মদ শাহ।

তুমি তোমার চিঠিতে ঐতিহাসিক তথ্যপ্রমাণের পাশাপাশি সন্দেহের জায়গাগুলোতে আমার মতামত জানতে চেয়েছ বলে যদুর ধর্মান্তরণ বিষয়ে আমার মাথায় যে দুটো সম্ভাবনার কথা এসেছে, বলি।

যদুর ইসলাম কবুলের ব্যাপারটা গণেশের সাজানো হতে পারে, আবার এমনও হতে পারে, ধুরন্ধর যদু বাবার প্রভাব মুক্ত হয়ে সুলতান হয়ে বসতে চেয়েছিলেন বলে গণেশের বিরোধীপক্ষে যোগ দিয়ে স্বেচ্ছায় ইসলাম গ্রহণ করলেন। দ্বিতীয় মতটার দিকে পাল্লা ভারী, কারণ, জালালুদ্দিন গণেশের প্রভাবে হিন্দু ধর্মে ফিরে এলেও সুযোগ বুঝে পরে আবার ইসলাম গ্রহণ করে সুলতান হয়ে বসেছিলেন।

মূল কাহিনীতে ফিরে আসা যাক। জালালউদ্দিন মুহাম্মদ শাহ ১৪১৫-১৬ সাধারণ অব্দে সিংহাসনে বসলে শর্কী জৌনপুরে ফিরে গেলেন। পথ নিষ্কণ্টক দেখে গণেশও ফিরে এসে সহজেই ছেলের উপর প্রভাব বিস্তার করে ফেললেন। যিনি নিজের ব্যক্তিত্বের বলে অতজন সুলতানকে হাতের পুতুল বানিয়ে রাখতে পেরেছিলেন, নিজের ছেলেকে নিয়ন্ত্রণ করা তাঁর কাছে কি আর এমন কঠিন কাজ! তো, জালালউদ্দিনকে নামেমাত্র সিংহাসনে রেখে গণেশ আবার রাজ্য-রাজস্ব-সেনাবাহিনীতে নিজের আধিপত্য ফিরিয়ে আনলেন। গণেশের মত প্রবল ব্যক্তিত্বের মানুষের পাশে অসহায় জালালউদ্দিনের কিছুই করার ছিল না। গণেশ আগের মতই রাজ্য শাসনের পাশাপাশি তাঁর বিরোধীদের দমন করা শুরু করে দিলেন। সাধের দার উল ইসলামের এই অবস্থা দেখে নূর কুতব আলম আফসোস ছাড়া আর কিই বা করতে পারতেন! এ সময়কার নূর কুতব আলমের লেখা একটা চিঠি সৈয়দ হাসান আসকারি উদ্ধার করেছেন, সেই চিঠি যদি তুমি দেখো বুঝতে পারবে তার ছত্রে ছত্রে কুতব আলমের অসহায়তা ফুটে উঠেছে। কিছুদিনের মধ্যেই  কুতব আলম ভগ্ন হৃদয়ে প্রাণত্যাগ করেন।

পথের শেষ কাঁটা সরে যেতেই গণেশ সহজেই জালালউদ্দিনকে সরিয়ে দ্বিতীয়বার সিংহাসনের দখল নিলেন। এসময় তিনি দনুজমর্দনদেব উপাধি নেন। শ্রীচন্ডীচরণপরায়ণস্য ও  দনুজমর্দনদেব শব্দদুটি লিখে মুদ্রা ছাপানো হয়। জালালউদ্দিনকে প্রায়শ্চিত্ত করিয়ে যদুতে ফিরিয়ে আনা হয়। এতসব ঘটনা জালালউদ্দিনের প্রথমবার সিংহাসনে বসার বছর খানেকের মধ্যেই ঘটেছিল। এবারে দনুজমর্দনদেব গণেশ প্রবল পরাক্রমে রাজ্যশাসন শুরু করলেন। কিন্তু হঠাৎই ছন্দপতন। দেখা গেল এক বছরের মধ্যেই রাজা গণেশ আকস্মিকভাবে চিত্র থেকে হারিয়ে গেলেন। সম্ভবত তাঁর মৃত্যু হল এসময়। এই মৃত্যু স্বাভাবিক মৃত্যু, না যদুর কীর্তি – জানা দুষ্কর, কিন্তু এরপর কিছুদিন গৌড়েশ্বর হিসেবে জনৈক মহেন্দ্রদেবের নাম পাওয়া যায়।

কে এই মহেন্দ্রদেব? মহেন্দ্রদেব কি গণেশেরই আরেক নাম, না তিনি অন্য কেউ? যদি অন্য কেউ হন, তবে কে? যদু অথবা গণেশের অন্য কোনো পুত্র? ইতিহাসের অস্বচ্ছতায় প্রমাণ করা কঠিন হলেও যুক্তিতে মনে হয় ইনি গণেশের অন্য এক পুত্র। যদু সিংহাসন হারিয়ে ইতিমধ্যেই গণেশের বিরুদ্ধে চলে গিয়েছিলেন, নিষ্ফল আক্রোশে তা করা ছাড়া যদুর অন্য উপায় ছিল না। ফলে গণেশের আকস্মিক মৃত্যুতে যদুর বদলে তাঁর অন্য কোনো পুত্র সিংহাসনে বসবেন এটাও স্বাভাবিক। ওদিকে তখৎ হাতছাড়া হয় দেখে যদু আবার ইসলাম কবুল করে জালালউদ্দিন মুহাম্মদ শাহ হয়ে যান। এবারে আর মহেন্দ্রদেবকে অপসারিত করে সিংহাসনের দখল নিতে যদুর কোন অসুবিধে হয় না। ১৪১৮ সাধারণ অব্দ নাগাদ জালালউদ্দিনের দ্বিতীয় শাসনকাল শুরু হল। ১৩ বছর পরে ১৪৩১ সাধারণ অব্দে জালালউদ্দিনের মৃত্যুর পরে তাঁর পুত্র শামসউদ্দিন আহমেদ শাহ গৌড়েশ্বর হলেন। কিন্তু এসব অন্য প্রসঙ্গ, পরে কখনো আলোচনা করা যাবে।

এবারে তুমিই বল গণেশের উত্থান থেকে পতন পর্যন্ত ঘটনায় নিছক রাজনীতির হাতিয়ার হওয়া ছাড়া ধর্মের আর কি ভূমিকা ছিল? ওহো, একটা বিষয় তো জানাতে ভুলেই গেছি! যাকে নিয়ে এত কাণ্ড তাঁর আসল নামটা কি ছিল? গণেশ, কান্-স্, কানিস কোনটা?  কান্-স্ এর কাছাকাছি শব্দ কংস। তোমার কি মনে হয়, কোন বাঙালি বাপ তার ছেলের নাম কি কংস রাখে? মহাকাব্যের খলনায়ক যে! তাহলে? ব্যাপার আর কিছুই না। …ও সরি সরি। তুমি তো আবার প্রমাণ ছাড়া কিছু শুনতেই চাইবে না। তা, ঐতিহাসিক বেভারেজের যুক্তিটাই প্রমাণ হিসেবে পেশ করি। উনি দেখিয়েছেন, ফার্সি হাতে লেখা পুঁথিতে লিপিকরদের অসাবধানতায় গ্ (گ‎  – গাফ্) ও ক্ (ک – কাফ্) এর পার্থক্য অনেক সময় গুলিয়ে যায়। যেমন- ১৮৯০ সাধারণ অব্দের journal Asiatique-এ কান্দাহারে প্রাপ্ত এক শিলালিপির কথা ছাপা হয়। সেখানে বাঙ্গালা ও গৌড়কে যথাক্রমে লেখা আছে বাঙ্কালা ও কৌড়। একই সূত্রে গণেশ> কান্-স্/কানিস হতেই পারে। আসল নাম গণেশ-ই।

ভাই ইমতিয়াজ, তুমি নিজে রাজশাহীর ছেলে বলে চিঠির ছত্রে ছত্রে রাজশাহীর ভূমিপুত্র গণেশকে নিয়ে তোমার প্রচ্ছন্ন গর্ববোধ আমার নজর এড়ায়নি। গর্ব তুমি করতেই পারো, কিন্তু আমি আবারো বলছি, গণেশের উত্থানকে নিছক ইসলামি শাসনের বিরুদ্ধে একজন হিন্দুর উত্থান – এমন ছোট ফ্রেমে না ভেবে বিদেশী শাসকদের বিরুদ্ধে এক ভূমিপুত্রের উত্থান হিসেবে দেখাই বেশি যুক্তিযুক্ত হবে। ভাবছ তো, রাজা গণেশ সম্বন্ধে এত তথ্য কোথা থেকে সংগ্রহ করলাম? আচ্ছা বেশ, চিঠির শেষে পুনশ্চে সমস্ত তথ্যসূত্র আমি দিয়ে দিলাম, চাইলে মিলিয়ে নিতে পার।

ভাল থেকো। অনেক ভালবাসা রইল।

ইতি

তোমার ভারতীয় বাঙালি বন্ধু

পুনশ্চ:

তথ্যসূত্র:

  • বাংলার ইতিহাসের দুশো বছর- স্বাধীন সুলতানদের আমল (১৩৩৮-১৫৩৮); সুখময় মুখোপাধ্যায়; দিব্যপ্রকাশ, ঢাকা
  • The Rise of Islam & The Bengal Frontier 1204-1760; Eaton, Richard Maxwell; Berkeley: California University Press
  • Hindu-Muslim Relations in Bengal: Medieval Period; J. N. Sarkar; Idarah-I Adabiyat-i-Delli,1985

মন্তব্য তালিকা - “গৌড়েশ্বর গণেশ – এক ধুরন্ধর কূটনীতিজ্ঞ”

  1. জানা ছিল না রাজা গণেশ ও পুত্র যদুর এই তথ্য সমৃদ্ধ ইতিহাস।
    দুজনেই ঐ সময়ের ইতিহাসের বহু আলোচিত চরিত্র।
    কিছু বিস্তৃত ঘটনাক্রম অবহিত হলাম।এটাই প্রাপ্তি।

মন্তব্য করুন

আপনার ইমেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।