একটি দিন: স্থান – চব্বিশ পরগনা, সুন্দরবন, কাল – দেড় হাজার বছর আগে
এখানে জঙ্গল খুব ঘন। চারিদিকে ছোট ছোট নদী নালা। গাছপালা নালার উপরে ঝুঁকে পড়েছে। নালার জল প্রায় দেখা যায় না।
আজ সকালে গাঁয়ের দশ-বারোজন মউলি মধু সংগ্রহের জন্য গাঁ থেকে বেরিয়েছে। সোঁদর বনের মউলি ওরা। ওদের কোমরে আছে টাঙ্গি, পিঠে থলি আর হাতে পাকা বাঁশের মোটা লাঠি। পোঁটলাপুঁটলি নিয়ে সঙ্গে আছি আমি।
শেষ বেলায় গাছের ছায়ায় চারিদিকে ঝুপসি অন্ধকার। বন প্রায় নিস্তব্ধ। একেবারে শব্দহীন। গাছের কোটরে দু-চারটে পাখি ডেকে উঠছে।
আমি খুঁজি লতা, পাতা, নানা ওষধি। সাপের বিষ, জ্বর, আমাশাতে আমার ওষধি অব্যর্থ। পিঠের ঝুলি প্রায় ভরে গেছে পাতা আর শিকড়ে। এখান থেকে অনেকটা দূরে কূল ঘেঁষে আমাদের ডিঙি নৌকা বেঁধে রাখা হয়েছে। ইচ্ছে ছিল সন্ধ্যার আগেই নৌকায় ফিরে যাওয়ার। কিন্তু কপাল মন্দ, মধু সংগ্রহে ওদের বড় দেরি হয়ে গেল।
বেঙ্গির হাতে মুখে মৌমাছি কামড়েছে, জ্বলুনি কমাতে জলে মাটি গুলে মুখে লাগিয়ে দিয়েছি। ও এবার প্রথম এসেছে, একেবারে ছেলেমানুষ। বটে গাছ থেকে ধুনো সংগ্রহ করে, তাতে হল আরও দেরি। সারাদিন খাইনি। পথ চলে ক্লান্ত, ক্ষুধার্ত, তৃষ্ণার্ত। চারিদিকে এত জল, খাবার উপায় নেই। খাবার জল আছে নৌকায়, মাটির ঘড়ায়। এতক্ষণে একেবারে অন্ধকার হয়ে গেছে। বনের মধ্যে কিছু দেখা যায় না। টি টি করে একটা পাখি উড়ে গেল।
সাবধান, সাবধান।
হঠাৎ শুনি গাঁক করে এক শব্দ। মুহূর্তে দেখি বনের রাজা আগুনের ভাটার মতো দুটি চোখ নিয়ে আমাদের বুনোকে ধরে লাফ দিয়ে চলে গেল। বুনোর আর্তনাদ, বাঘের গর্জন, গাছে হনুমানের হুটোপুটিতে মুহূর্তে বনের নিস্তব্ধতা গেল ভেঙে।
ছেলেমানুষ বেঙ্গি বলে, ‘বুনোকে চেষ্টা করব বাঁচাতে?’
দৌড়াও, দৌড়াও। একবার ধরলে সোঁদর বনের বাঘের হাত থেকে রক্ষা নেই।
আবার সব নিস্তব্ধ। দূর থেকে শুধু শুনি বুনোর মাথা কড়মড় করে ভাঙছে আমাদের চিরশত্রু বনের রাজা।
ছপ ছপ নৌকা চলে। চাঁদের আলোয় চারিদিক ঝলমল করছে। শুধু আমরা ক’জনা আঁধার মনে বসে আছি। বেঙ্গি চোখের জল বারেবারে মোছে। বুনো ছিল ওর কাকা।
এই হল মউলিদের জীবন।
মৌচাক থেকে মধু তুলতে এসে বাঘের পেটে যায়, সাপের কামড় খায়। তবু উপায় নেই। এই মধুই আমাদের পেটের খিদে মেটায়।
চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের সময়ে (আজ থেকে ২৩০০ বছর আগে) বাংলার একাংশ শাসিত হত পাটলিপুত্র থেকে। এর কিছু পরে, অশোকের সময়ে আজকের মেদিনীপুরে অবস্থিত তমলুক ছিল তখনকার বিখ্যাত বন্দর, তাম্রলিপ্তি।১ ঘাটশিলার কাছে তামার খনি থেকে তামা তুলে এই বন্দর দিয়েই রপ্তানি হতো। তাই নাম তাম্রলিপ্তি। বাংলার ভৌগোলিক অবস্থিতির জন্য সেই সময় থেকে এই অঞ্চল সড়ক ও সমুদ্র বাণিজ্যে অগ্রসর ছিল। গ্রিকরা লিখে গেছেন ভারতের রাজপথের কথা, উত্তরে খাইবার পাসের কাছে থেকে দক্ষিণে পাটলিপুত্র হয়ে তাম্রলিপ্তি পর্যন্ত দীর্ঘ ছিল এই রাজপথ। অর্থাৎ দক্ষিণবঙ্গের একাংশ তখন ভারতের গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল ছিল। যে সব জাহাজ মূলত ভারতের দক্ষিণ বা পুবের দিকে যেত তাদের প্রধান বন্দর ছিল তাম্রলিপ্তি। এখান থেকে জাহাজ যেত আজকের মায়ানমার, সিংহল, জাভা, সুমাত্রা ও আরও দূরে ইন্দোনেশিয়াতে।২, ৩
সেই সময়ে ভাগীরথী নদী বহু শাখায় বিভক্ত ছিল। ভাগীরথী প্রবাহের দক্ষিণতম সীমায় ছিল আজকের তমলুক বা তখনকার তাম্রলিপ্তি। পরবর্তীকালে গঙ্গা ক্রমশ পূর্ব দিকে সরে গেলে তাম্রলিপ্তি পরিত্যক্ত হয়।
সুন্দরবন বদ্বীপ অঞ্চল ভূতাত্ত্বিকভাবে সাম্প্রতিকতম কালে তৈরি হয়েছে। যদিও গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র বদ্বীপ অঞ্চল ভৌগোলিকভাবে গঠিত হতে শুরু করে বহু আগে, মিয়োসিন যুগে, তবে সুন্দরবন ব-দ্বীপ বর্তমান অবস্থায় আসে হাজার দশেক বছর আগে।৪
সুন্দরবন অঞ্চলে কবে থেকে জনবসতি ছিল তার পরিষ্কার কোন ইতিহাস দেখি না। এই অঞ্চল চিরদিন উপেক্ষিত। ড: নীহাররঞ্জন রায় বলেছেন, মধ্য যুগে ভৌগোলিক ও রাজনৈতিক পরিবর্তন ঘটেছে সুন্দরবনে। চব্বিশ পরগনার নিম্নাঞ্চলে পঞ্চম শতক থেকে দ্বাদশ শতক পর্যন্ত সমৃদ্ধ জনবসতপূর্ণ জনপদের চিহ্ন প্রায়ই আবিষ্কৃত হচ্ছে। জয়নগর থানার সূর্যমূর্তি, ডায়মন্ডহারবার থেকে একটু দূরে লক্ষণ সেনের পট্টোলী, জয়নাগের তাম্র পট্টোলী প্রাপ্তি চব্বিশ পরগনাতে প্রাচীন বর্ধিষ্ণু জনপদের ইঙ্গিত দেয়। প্রাচীন কিছু লিপিতে ব্যাঘ্রতটিমণ্ডল নামে এক অঞ্চলের কথা শোনা যায়। ড: রায় অনুমান করেছেন, ব্যাঘ্রতটি হয়ত সুন্দরবন।৫
এই সমস্ত তথ্য থেকে অনুমান করা যুক্তিযুক্ত যে, আজ থেকে দেড় হাজার বছর আগে নিম্নবঙ্গ ও সুন্দরবন অঞ্চলে জনবসতি ছিল।
সুন্দরবনের গভীর অন্ধকারাচ্ছন্ন অতীত ইতিহাস নির্মাণ সহজ নয়। সেই ইতিহাস নির্মাণের প্রচেষ্টা নিতে হবে।
তথ্যসূত্র-
১) Ranabir Chakrabarti, “Exploring Early India upto C. AD 1300,” Primus Books, Third Edition (2016)
২) Rupendra Kumar Chattopadhyay, “The Archaeology of Coastal Bengal,” Oxford University Press, October (2018)
৩) Sanjeev Sanyal, “The Ocean of Churn: How the Indian Ocean Shaped Human History,” Penguin Random House, India (2016)
৪) Hazra, S., et.al., ‘Sea Level and associated changes in the Sundarbans’: Science and Culture (ISSN 0036-8156), Vol 68, no 9-12, p 309-321, 2002
৫) নীহাররঞ্জন রায়, “বাঙালীর ইতিহাস -আদি পর্ব,” পশ্চিমবঙ্গ নিরক্ষরতা দূরীকরণ সমিতি (১৯৮০)
৬) হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, “প্রাচীন বাংলার গৌরব,” বিশ্বভারতী, আশ্বিন (১৩৫৩)
৭) রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, “বাঙ্গালার ইতিহাস-প্রথম ভাগ,” মেসার্স গুরুদাস চট্টোপাধ্যায় এণ্ড সন্স, দ্বিতীয় সংস্করণ (১৩৩০)
খুব ভালো লাগলো। এতো পুরনো দিনের কথা জেনে সমৃদ্ধ হলাম।
ধন্যবাদ নেবেন দাদা।
আরে!
এক কিস্তিতেই শেষ হবে নাকি?
আপাতত
হায়। নিষ্ঠুর জীবন, মর্মান্তিক জীবিকা।
Aj o paristhiti kichu kichu jaygay erakom e ache. 3 din ba 5 din ghurte giye katotukui ba amra dekhte pai. kintu tomar pranjal sahoj saral bhashay lekha choto prabandho ti mann chhuye gelo.