অবনতির সূচনা পর্বে (২০০০ – ১৭০০) হরপ্পাবাসীদের সামাজিক অস্থিরতার কাল এবং কুষ্ঠ, যক্ষ্মা সহ বিভিন্ন রোগভোগ
প্রাথমিক কথন এবং হরপ্পা, শোরকোট ও ডিল্লু রয় থের
রাভি নদীর পাড়ে হরপ্পা শহরের পত্তন আনুমানিক ৩৫০০ সাধারণ পূর্বাব্দে। নেহাতই একটি জন সাধারণ জন বসতি হিসাবে। এই বসতিটিই ক্রমে শহরের বিবর্তিত হয়ে উন্নতির চরমে ওঠে এবং অবশেষে পরিত্যক্ত হয় ১৩০০ সাধারণ পূর্বাব্দে। এক সাধারণ বসতি থেকে শহরে বদলে যাবার ইতিহাস কম বেশি জানা গেলেও এর অন্তিম পরিণতির কোন যুক্তিসঙ্গত কারণ ও প্রকৃত ইতিহাস এখন ও অজানা পর্যায়ে থেকে গেছে। কিছুটা অনুমান করতে পারলেও অজানা বলা হল কারণ একেবারে শেষ সময়েও, শহরে অর্থনৈতিক অবনতির লক্ষণ দেখা দিলেও, চরম দারিদ্র দেখা যায়নি। বা সহজ কথায় শহর পরিত্যাগ করার মত দুরবস্থায় শহরবাসীরা পড়েনি বলেই অনুমান।
১৩০০ সাধারণ পূর্বাব্দে হরপ্পা পরিত্যক্ত হবার পরবর্তী ৬-৭ শত বৎসরের মধ্যে পাঞ্জাবে একাধিক সমৃদ্ধ জনপদ গড়ে উঠেছিল। পরে এলাকাটি পারসিক সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়। তাছাড়া শহর পরিত্যক্ত হবার এক দেড় হাজার বৎসরের মধ্যে রচিত হচ্ছিল নানা বৌদ্ধ ও বৈদিক ধর্মগ্রন্থ। এই হরপ্পা সভ্যতার এলাকাতেই গড়ে উঠেছিল বিদ্যাচর্চার উৎকৃষ্টতম কেন্দ্র। তবু কোথাও সেই পরিত্যক্ত শহরটির কোন উল্লেখ ছিল না। ব্যতিক্রম শুধু একবার ঋগ্বেদে হরিয়ুপ্পা নামের উল্লেখ।
মহেঞ্জোদারো শহরের নাম বদলে একটি স্থানীয় ভাষার অশুভ বর্ণনামূলক নাম বসে ছিল। হরপ্পার বেলাও তাই হয়েছিল ভাবা যেতে পারে, কিন্তু ঋগ্বেদের হরিয়ুপ্পা শব্দটি ইঙ্গিত দেয় হরপ্পা শব্দটি প্রকৃতই প্রাচীন শব্দ। সম্ভবত এর কোন বদল ঘটেনি।
এ পর্যন্ত জানা মতে হরপ্পার প্রথম উল্লেখ পাই ১৮২৬ সালে শখের ব্রিটিশ প্রত্নবিদ চার্লস ম্যাসনের ভ্রমণ বিবরণীতে। তাঁর বিবরণী বলে হরপ্পা শহরটি ছিল জঙ্গলে ভরা, জনমানবহীন। কিন্তু বহু বাড়ি দাঁড়িয়ে ছিল বিস্তৃত এলাকা জুড়ে। এবং শহরটির অস্তিত্ব স্থানীয় লোকের অজানা ছিল না। অজানা ছিল না বলেই চার্লস ম্যাসন স্থানীয় পথপ্রদর্শকের সাহায্যে এখানে আসতে পেরেছিলেন।
হরপ্পার দ্বিতীয়বার উল্লেখ পাই ব্রিটিশ পর্যটক, আলেকজান্ডার বার্ণসের থেকে। বার্ণস মহারাজা রণজিৎ সিংহ ও ব্রিটিশদের মাঝে হাইফেনের মত কাজ করেছিলেন কিছুকাল। সেই সময় উত্তর পশ্চিম ভারতের নানা জায়গা ঘুরতে ঘুরতে তিনি আসেন হরপ্পা শহরে এবং এবারও স্থানীয় পথ প্রদর্শকের সাহায্যে।
আলেকজান্ডার বার্ণসের বিবরণও চার্লস ম্যাসনের থেকে ভিন্ন নয়। তিনিও বলেন এটি পরিত্যক্ত প্রাচীন শহর। তুলুম্বা শহর থেকে ৫০মাইল পূর্ব দিকে গিয়ে, চার মাইল পায়ে হেঁটে তিনি প্রাচীন শহরের ধ্বংসস্তূপটির দেখা পেয়েছিলেন। বোঝা গেল এই ধ্বংস হওয়া শহর থেকে মাত্র চার মাইল দুরেই যানবাহন চলাচলের পথ ছিল। বার্ণসের মতে শহরটি তিন মাইল বিস্তৃত। তিনি দেখেছেন নদীর কাছে চারতলা বাড়ি সমান উঁচু একটি কেল্লা। বাকি সব ধ্বংসস্তূপ। এখানকার ইট খুলে নিয়ে পাশেই গজিয়ে উঠেছে হরপ্পা নামেরই একটি গ্রাম। এই বিষয়টাও লক্ষণীয়। হরপ্পা শব্দটি হারায়নি। আর এই শব্দের সাথে কোন অমঙ্গলসূচক ভাবনাও জড়িয়ে ছিল না। নাহলে একই নামে গ্রামের অস্তিত্ব থাকতো না। বার্ণস লেখেন তিনি এখানে কিছু পারসিক মুদ্রা ও হিন্দু মুদ্রা পেয়েছেন। এই মুদ্রার কোন লেখা তিনি পাঠোদ্ধার করতে পারেননি।
বার্ণস আরও জানান, স্থানীয় লোকের বিশ্বাস দেবতার অভিশাপে শহর জনশূন্য হয়ে গেছে। অভিশাপ নেমেছিল রাজার ইচ্ছায় অজাচার শুরু হলে। আরেকটি বিশ্বাসে, যখন শোরকোট শহরে অভিশাপ নামে, সেই একই সময়ে এই শহরেও অভিশাপ নামে। সেই সময় হল বার্ণসের হরপ্পা ভ্রমণের কাল থেকে ১৩০০ বৎসর আগে। লক্ষণীয় লোক কাহিনীতে একজন রাজার উল্লেখও আছে।
শোরকোট
লোক বিশ্বাসে, হরপ্পার সাথে জড়িয়ে গেছে শোরকোট। বিয়াস নদীর কাছে পশ্চিম পাঞ্জাবের শোরকোট বিশেষ কোন উল্লেখ করার মত জায়গা নয়। সাধারণ ছোট্ট একটি শহর। স্থানীয়দের ধারনায় শোরকোটের প্রাচীন নাম ছিল ইশ্বরকোট। ১৮৩০ সালে বার্ণস ও ক্যানিংহ্যাম শোরকোটে আসেন। শোরকোটে ৩০ মিটার উঁচু, ৫০০ X ৩০০ মিটার লম্বা চওড়া একটি মাটির স্তূপ আছে। যার স্থানীয় নাম ভির। এখানে বার্ণস ও ক্যানিংহ্যাম কোন খনন কাজ করেননি। তবে বার্ণস এখানে একটি গ্রীক তাম্র লেখ পান। সেটি ছিল ব্যাকট্রিয়া ও আফগানিস্তানের ইন্দো-গ্রীক রাজা ডেমেট্রিয়াসের ভাই এবং ভারতের দায়িত্বপ্রাপ্ত অ্যাপোলোডটাসের নাম উল্লিখিত।
অ্যাপোলোডটাস মারা যান ১৪৭ সাধারণ পূর্বাব্দে। ফলে শোরকোট যে বহু প্রাচীন আর গুরুত্বপূর্ণ শহর, তাতে সন্দেহ থাকলো না। তারই সাথে বার্ণস এখানে পেলেন ইন্দো সিথিয়ান প্রথম পূর্ব শতাব্দীর মুদ্রা ও হিন্দু রাজা সহ্যের ৮ম শতাব্দীর মুদ্রা।, আর কিছু মুসলিম আমলের মুদ্রাও। এখানেও বার্ণস ও কানিংহ্যাম আরেকটি লোক কথা, শুনলেন। এক স্থানীয় ব্রাহ্মণ ওনাদের বলেছিলেন শহরের প্রাচীন নাম ছিল শিবনগরি বা শিউপুর।
শোরকোটে পরবর্তী কালে পাওয়া গেল একটি ২১ ইঞ্চি লম্বা ২২ ইঞ্চি উঁচু, তামার রান্নার পাত্র। পাত্রের গায়ে ব্রাহ্মীলিপিতে সংস্কৃত ভাষায় আছেঃ-“বৎসর ৮৩, মাঘ, উজ্জ্বল পঞ্চম দিবস, পবিত্র শিবিপুরায়, রাধিকা মঠের (মনাস্ট্রি) সর্বজনীন সর্বাস্তিবাদী সম্প্রদায়কে উৎসর্গ করা হল বুদ্ধ-দাস-থাপিতা।”এখানে উল্লিখিত বৎসর ৮৩ গুপ্তযুগের। এখনকার হিসাবে এটা হবে ৪০৩ অব্দ।
এতে করে নিশ্চিত ভাবে বলা গেল, বর্তমানের শোরকোট অবশ্যই প্রাচীন শিবিপুর, এবং সেখানে রাধিকা মঠ নামে একটি বৌদ্ধ মঠ ছিল। বোঝাই যায় শহরের নামটি দুই হাজার বৎসরে খানিক বিকৃত হলেও প্রচলিত ছিল; হারিয়ে যায়নি। শিবিপুর উচ্চারণ বিভ্রাটে শিবনগর বা শিউপুর হতেই পারে।
তবে এই এলাকার প্রাচীণ লৌকিক ইতিহাস বলে এখানে ছিল শিবি জাতির বাস। আফগানিস্তানের দিক থেকে আসা শিবিরা ছিল মুণ্ডিত মস্তক শিবভক্ত জাতি। শিবের ভক্ত থেকেই এরা শিবি বলে পরিচিত হতে থাকে।
মহাভারতের কাহিনী অনুযায়ী জয়দ্রথ শিবিদের রাজ্য জয় করেন।
ইন্ডোলজিস্ট ভি. এস. আগরওয়াল, অধ্যাপক ধিলোঁ, অধ্যাপক এগারমন্ট শোরকোটের শিবিপুরা নামের উৎস হিসাবে নানা তথ্য উল্লেখ করে বলেন এলাকাটিতে বসবাস ছিল শিবি জাতির। এদের উল্লেখ আছে ঋগ্বেদে, অষ্টাধ্যায়ীতে, এবং গ্রীক পর্যটকদের লেখায়। এই শিবিদের রাজধানী হিসাবেই এর নামাকরণ হয় শিবিপুরা।
শোরকোটে প্রত্ন খনন না হওয়ায় বৃষ্টির পরে মাটির উপরে ওঠে আসে নানা প্রত্নসামগ্রী। সবই চোরা চালান হয়ে যায়। স্থানীয় ব্যক্তিগত সংগ্রাহকের উৎসাহে সংগৃহীত ও রক্ষিত কিছু প্রত্ন সামগ্রী দেখেন প্রত্নবিদ কেনয়ের। তিনি মত দেন এগুলো ষষ্ঠ পূর্ব শতকের। ফলে মোটা দাগের হিসাবে লৌকিক কথন ধরে শিবিপুরার আয়ুষ্কাল বলা যায় প্রায় দুই হাজার বৎসরের বেশি।
স্থানীয় বিশ্বাসে ১৩০০ বৎসর আগে পশ্চিমদিক থেকে এক রাজা এসে শহরটিকে ধ্বংস করেন। ১৩০০ সাধারণ পূর্বাব্দে হরপ্পা ধ্বংসের সাথে ১৩০০ শতাব্দীর শোরকোট ধ্বংসের এই কাহিনি লোককথায় যুক্ত থাকলেও সরাসরি কোন যোগ আছে কিনা বলা কঠিন। কারণ তাহলে ভাবতে হয় ১৩০০ শতাব্দী অবধি হরপ্পায় লোক বসতি ছিল। এবং তা ছিল কোন রাজার শাসনাধীন। তবে লোককথায় ১৩০০ শতাব্দীতেও হরপ্পা কোন না কোন রাজার শাসনাধীন এলাকার মধ্যে তো ছিলই বটে।
পরবর্তী কালে হরপ্পা প্রত্নখননের কালে জানা যায় এখানে শহরের ধ্বংসস্তূপের উপরেই, প্রাচীন শহরের ইটের গাঁথনিকে ভিত করে গুপ্ত যুগে তৈরি হয়েছিল একটি মন্দির, মোঘল আমলে একটি শরইখানা, যাকে মর্টিমার বলছেন ছোটখাটো কেল্লা। আর তৈরি হয়েছিল একটি দরগা বা মসজিদ কোন এক অজানা সময়ে। মর্টিমারের মতে হরপ্পার হরপ্পানদের তৈরি প্রাচীন কেল্লা (মর্টিমারের সিটাডেল) চার্লস ম্যাসন দেখেননি, দেখেছিলেন বার্ণস। মোঘল আমলের সরাইখানা বা কেল্লা নিয়ে এখন হরপ্পার পুলিশ থানা।
১৮২৬ সালে চার্লস ম্যাসন হরপ্পার উল্লেখ করেছিলেন। তার আনুমানিক ২৫ বৎসর পরে আলেকজান্ডার বার্ণসের থেকে পাই আরেকবার হরপ্পার উল্লেখ। তারপরে ক্যানিংহ্যাম খানিক জরীপ করেন, কিছু প্রত্নদ্রব্য সংগ্রহ করেন। আর বার্ণসের দেখার ৭০-৭১ বৎসর পরে হরপ্পার খনন কাজ শুরু হয়। শেষতম প্রত্ন ধারনায় হরপ্পার অন্তিম দিন ছিল ১৩০০ সাধারণ পূর্বাব্দ। শহর পরিত্যক্ত হবার পরের ৩১০০ বৎসরের মধ্যে কেউ আর হরপ্পার নামোল্লেখ করেনি। যদিও মন্দির কেল্লা মসজিদ তৈরি হয়েছে। আর পাঞ্জাবেরই শোরকোট নামক খুদে এলাকার উল্লেখ পাই গ্রীকদের থেকে, বৌদ্ধ ধর্মালম্বীদের থেকে। এমনকি স্থানীয় লোকেরাও নাম বা ইতিহাস পুরো ভুলে যায় নি, নানা লোক কথা তৈরি হয়েছে। হয়ত হরপ্পার নামও ভোলেনি। তবে তার ইতিহাস ভুলে গেছে সবাই। কেন? উত্তর অজানা।
ডিল্লু রয় থের
২০২০ সালে হরপ্পা থেকে ৭৭ কিলোমিটার দুরে রাজনপুরে একটি প্রত্ন ক্ষেত্র পাওয়া গেছে। নাম ডিল্লু রয় থের। থের স্থানীয় শব্দের অর্থ ধ্বংসস্তূপ। লোকমুখে প্রচলিত এখানে ডিল্লু রয় বলে কোন রাজার রাজত্ব ছিল। লোক কাহিনী বলে ডিল্লু রাজা ছিলেন অতি নিষ্ঠুরর।এবং কোন এক নারীর অভিশাপে তার রাজধানী ধ্বংস হয়ে যায়। খনন খুবই সামান্য হয়েছে। প্রাথমিক অনুমান এখানে কোন শহর ছিল। ছিল মন্দির এবং সম্ভবত বৌদ্ধস্তূপও। শহরের সময়কাল হতে পারে দ্বিতীয় শতাব্দী থেকে অষ্টম শতাব্দী। এখানে কুষাণ-গান্ধার শিল্পের কিছু নিদর্শন পাওয়া গেছে। তার সাথে মাথা ভাঙ্গা একটি ছোট্ট নারী মূর্তি পাওয়া গেছে, প্রাথমিক অনুমান এটি মৌর্য বা পরবর্তী শুঙ্গ আমলের পার্বতী মূর্তি। পাওয়া গেছে অনেক সিল, আর নানা ছোট ছোট মূর্তি। কোন কোনটাতে ব্রাহ্মীলিপিতে কিছু লেখাও আছে। সবে খনন হয়েছে। সব তথ্য প্রত্ন সামগ্রী ভালো করে দেখা বাকী। কারণ মাঝখানের সময় ছিল করোনা বিধি নিষেধের সময়।
সবশেষে হরপ্পা ঘিরে কয়েকটি প্রশ্ন থেকেই গেল। স্থানীয়রা কেন বা কি ভাবে হরপ্পার সাথে শোরকোটকে জড়ালেন? দুটো শহর তো গায়ে গায়ে ছিল না। তবে কি শোরকোটের রাজাই প্রাচীন হরপ্পারও রাজা ছিলেন? অথবা রাজা ছিলেন ডিল্লু রয়? মাত্র ৭৭ কিলোমিটার দুরের রাজা। তাঁরও রাজধানীও অভিশাপে ধ্বংস। এর কি কোন সম্পর্ক আছে বা ছিল হরপ্পার সাথে?
বার্ণস হরপ্পার ধ্বংসস্তূপে পারসিক ও `হিন্দু` মুদ্রা পেয়েছিলেন। কে সেই হিন্দু রাজা? স্থানীয়দের উল্লেখ করা মত কোন রাজা কি সত্যি ছিলেন হরপ্পায়?পঞ্চম শতাব্দীতে? গুপ্ত যুগের মন্দিরের উপস্থিতি কিন্তু সেকথাই বলে।প্রত্নবিদরা কিন্তু তেমন কিছু বলেন নি। হয়ত নেহাতই লোককথা বলে উল্লেখ করেননি। তাঁরা শুধু বলছেন ১৩০০ সাধারণ পূর্বাব্দে হরপ্পা বরাবরের মত পরিত্যক্ত হয়।
১৩০০ সাধারণ পূর্বাব্দে হরপ্পা শহর পরিত্যক্ত হলেও সেটা খুব আচমকা ঘটা ঘটনা ছিল না। অনেক বৎসর ধরেই আস্তে আস্তে নানা কারণে শহরটি বসবাসের অনুপযুক্ত হয়ে পড়ছিল। সে কারণগুলোর মধ্যে অবশ্যই ছিল অর্থনৈতিক অবনতি। সামগ্রিকভাবে বৃষ্টির পরিমাণ কমে যাওয়া, নদীর গতিপথ পরিবর্তন এইসবের ফলে ঘটা সামগ্রিক অর্থনৈতিক অবনতি। তবু এটাও সত্যি যে, হরপ্পা সভ্যতার মত বিশাল এলাকায় বিস্তৃত সভ্যতার অন্যতম প্রধান শহরটি কেবল একটি কারণে পরিত্যক্ত হতে পারে না। এর পেছনে থাকবে নানা কারণ। সেই কারণগুলোর খোঁজে কয়েকটি গবেষণা হয়। জানার চেষ্টা করা হয় ঠিক কবে আর কিভাবে অবনতির সূচনা হয়েছিল।
হরপ্পাবাসীদের দেহাবশেষ নিয়ে গবেষণা
হরপ্পা শহরের অবনতির ইতিহাস জানার সোজা পথ হল তখনকার বাসিন্দাদের অবস্থা জানা। সেই সূত্রেই গবেষণা হয় হরপ্পার কঙ্কালগুলো নিয়ে।
হরপ্পার কবর থেকে পাওয়া কঙ্কাল নিয়ে নানা ভাগে গবেষণা করেছেন বিভিন্ন বিজ্ঞানীরা। এর মধ্যে নৃতাত্ত্বিক গবেষণায় জানা গেছে হরপ্পা শহরবাসীদের মধ্যে ছিল ভিন্ন ভিন্ন নৃগোষ্ঠী। দাঁতের গবেষণা থেকে জানা গেছে হরপ্পা বাসীদের সম্ভাব্য আদি বাসস্থান, খাদ্যাভ্যাস, এবং তাদের গ্রামাঞ্চল থেকে আসার কথা। আরো দুটি গবেষণায় জানা গেছে হরপ্পার বাসিন্দাদের মধ্যে অনেকেই ছিল সামাজিক পারিবারিক হিংসার শিকার। রোগের মধ্যে হরপ্পাবাসীদের মধ্যে ছিল রক্তাল্পতা, অস্থিসন্ধি সমস্যা এবং কুষ্ঠ ও যক্ষ্মা রোগ।
একটি গবেষণার কাল ১৯৮৭-৮৮ এইসময়ে হরপ্পার আর৩৭(R37) কবরস্থল থেকে মোট ৮৪টি পূর্ণবয়স্ক আর ৪টি কিশোরের কঙ্কাল বের করা হয়। তবে কেবল ১৯টি পুরো কঙ্কাল পাওয়া গেছে। সবগুলোই রাখা আছে করাচীর ন্যাশনাল মিউজিয়ামে। তা ছাড়া ছিল ১৯৬৭ সালে পাওয়া ১৬টি কঙ্কালের একটি কঙ্কাল, যা রাখা ছিল হরপ্পার স্থানীয় সংগ্রহালয়ে সেটিও এই গবেষণায় ব্যবহার করা হয়েছিল।
অপর গবেষণার কঙ্কালগুলোর উৎস কলকাতার অ্যানথ্রোপোলজিকাল মিউজিয়ামে রাখা হরপ্পা থেকে সংগৃহীত কঙ্কালগুলো। কলকাতার সংগ্রহালয়ে রাখা ছিল ২৩৫টি দেহাবশেষ. তারমধ্যে ১৫৭টি পরীক্ষার জন্য ব্যবহার করার যোগ্য ছিল। এই কঙ্কালগুলো নিয়ে হরপ্পা সংক্রান্ত গবেষণা পত্রটি প্রকাশিত হয় ২০১৩ সালে। অন্যান্য গবেষণা পত্র ও প্রবন্ধ বাদেও এই শেষের দুটি গবেষণাই এই লেখার মুল উৎস তার সাথে থাকছে লুকাস ও হেমফিলের হরপ্পাবাসীদের দাঁত নিয়ে গবেষণার খানিক কথা ও অন্যান্য বিজ্ঞানীদের নানা লেখা।
হরপ্পা শহরের আপন ইতিহাস
হরপ্পা শহরের অবনতির কথায় সবার আগে আসবে শহরটির ইতিহাস আর ভূগোলের কথা। রাভি (ইরাবতী⁄পুরুষ্ণী) নদীর দক্ষিণদিকের এই শহরের ভূগোল সচরাচর জানা শহরের থেকে খানিক ভিন্ন। হরপ্পা নামের শহরটির এলাকাতেই আছে আলাদা করে দেওয়াল ঘেরা কয়েকটি এলাকা। এলাকাগুলো এখন পরিচিত প্রত্নবিদদের দেওয়া সাংকেতিক পরিচয়ে`এ.বি`,`ই`ও`ইটি`, `এফ`,`এইচ-টি`(`AB`, `E- ET“F“HT`)। এর মধ্যে `এইচ-টি`অংশে আধুনিক হরপ্পা শহর গড়ে উঠেছে। তার নীচে কি আছে তা সম্ভবত আর কোনদিন জানা যাবে না।
অজানা `এইচ টি` বাদে প্রতিটি এলাকা কিন্তু আলাদা করে দেওয়াল ঘেরা। ফলে মনে হবে একই শহরের মধ্যে কয়েকটি বিচ্ছিন্ন শহর। তবে দুটি দেওয়াল ঘেরা এলাকার মাঝের জায়গাও জনবসতিহীন ছিল না। তাই ধরে নিতে হবে আসলে এটি একটিই শহর।
কবর দেবার এলাকা পাওয়া গেছে`আর-৩৭`, `সিমেট্রি-এইচ` ও `এলাকা-জি`।
হরপ্পা শহরের প্রত্ন খনন স্তরগুলোকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করা আছে।
সাধারণ ভাবে উত্তর-পশ্চিমভারতে খাদ্যোৎপাদন শুরু হয় ৭০০০ থেকে ৫০০০ সাধারণ পূর্বাব্দে।
হরপ্পার শহরঃ-
এলাকা ভিত্তিক বসতি ও প্রকৃত উন্নয়ন কাল(আনুমানিক ৫০০০ থেকে ২৬০০ সাধারণ পূর্বাব্দ।)
হাকরা পর্যায়-
কালস্তর.১এ⁄বি- ৪০০০ থেকে ৩৫০০ সাধারণ পূর্বাব্দ।
এলাকা ভিত্তিক উন্নয়ন কাল
কট ডিজিয়ান পর্যায়-
কালস্তর.২–২৮০০ থেকে ২৬০০ সাধারণ পূর্বাব্দ।
সংযুক্তিকরণ কাল ২৬০০ থেকে ১৯০০ সাধারণ পূর্বাব্দ।
কালস্তর.৩এ–২৬০০ থেকে ২৪৫০ সাধারণ পূর্বাব্দ।
কালস্তর.৩বি- ২৪৫০ থেকে ২২০০ সাধারণ পূর্বাব্দ।
কালস্তর.৩সি- ২২০০ থেকে ১৯০০ সাধারণ পূর্বাব্দ।
আঞ্চলিকতার কাল ১৯০০ থেকে ১৩০০ সাধারণ পূর্বাব্দ।
অন্তিম পর্যায়
কালস্তর.৪– ১৯০০ থেকে ১৮০০ সাধারণ পূর্বাব্দ।
অন্তিম ও সিমেট্রি-এইচ পর্যায়।
কালস্তর.৪ – ১৮০০ থেকে ১৭০০ সাধারণ পূর্বাব্দ।ও ১৭০০ থেকে ১৩০০ সাধারণ পূর্বাব্দ।
এখন পর্যন্ত করা ক্যালিব্রেটেড কার্বন ডেটিং অনুযায়ী হরপ্পার বয়স৩৩৪৫ থেকে ১৯০০ সাধারণ পূর্বাব্দ।
প্রত্নস্তূপ-`এবি` (Mound –AB)
এই এলাকাটি মোটামুটি ভাবে হরপ্পা শহরের কেন্দ্রে। এখানেই হয়ত শুরু হয় হরপ্পার শহর গঠন। এই এলাকার উত্তরাংশেই পাওয়া গেছে প্রাচীনতম বসতির নিদর্শন। বসতির শুরু আনুমানিক ৩৫০০সাধারন পূর্বাব্দ। `এবি` এলাকার বসতি চলতে থাকে ৩৩০০ থেকে একেবারে ১৬০০ অবধি।টানা ১৭০০ বৎসর ধরে।
উল্লেখযোগ্য
এখানে ছিল বিশাল ঢাল সহ কাদামাটির ইটের দেওয়াল ঘেরা এলাকা। ছিল কয়েকটি সাধারণের ব্যবহারের জন্য কুয়া আর লাগোয়া বাঁধানো চাতাল। সম্ভবত স্নান কাপড় কাচা এই সব কাজের জন্য। আর ছিল কয়েকটি বেশ বড় বাড়ি, সম্ভবত অপেক্ষাকৃত ধনীদের বাসস্থান হিসাবে গড়া। এখানে যত প্রত্ন সামগ্রী পাওয়া গেছে তার বেশির ভাগের বয়স ৩হাজার থেকে ২হাজার সাধারণ পূর্বাব্দের।
এই `এবি` এলাকাতেই ছিল মর্টিমার হুইলারের নামাকরণ করা সিটাডেল বা কেল্লা। যদিও কেল্লার সাথে প্রতিরক্ষার পরিষ্কার কোন সম্পর্ক পাওয়া যায়নি। তবু আমরা বার্নসের বিবরণে পাই এটি ছিল চারতলা সমান উঁচু কেল্লা।
প্রত্নস্তূপ-`এফ` (Mound-F)এলাকা
এই এলাকার বসতি শুরু ২৪৫০ থেকে।
উল্লেখযোগ্যঃ-
দেওয়াল ঘেরা এই এলাকায় ছিল মর্টিমার হুইলারের বলা শস্যাগার। যদিও পরে কেনয়ের প্রমাণ করেছেন যে এটি কখনোই শস্যাগার ছিল না। সম্ভবত এটি সাধারণের জমায়েতের জন্য বড় বাড়ি ছিল। ৫১X৪১ মিটার এই বহু প্রকোষ্ঠের বাড়িটির প্রকৃত উদ্দেশ্য প্রকৃতপক্ষে এখনো অজানা। এর অনুমানিক নির্মাণকাল ছিল ২৩০০-২২০০ সাধারণ পূর্বাব্দ।
এই `এফ`এলাকার ঘরবাড়িগুলো ছিল সার বাঁধা। বোঝা যায় বাড়িগুলো আগে থেকে পরিকল্পনা করেই তৈরি হয়েছিল। এবং সম্ভবত এগুলোও অপেক্ষাকৃত ধনীদের বাসগৃহ ছিল।
এখানে একটি দেওয়াল ঘেরা বড় বাড়ি পাওয়া যায়। বাড়ির চৌহদ্দিতে বেশ কয়েকটি ছোটছোট ঘর। সম্ভবত বাড়ির কাজের লোক বা অন্য কোন কাজের লোকের থাকার জন্য।
`এফ`আর`এবি` এলাকার মাঝখানে আছে অনেকগুলো গোলাকার ইট বাঁধানো চাতাল। এগুলোর ব্যবহারিক চরিত্র জানা যায় নি। তবে এর নিচেও ভাঙ্গা মাটির বাসন পাওয়া গেছে।যদিও সেগুলো এই গোলাকার চাতালের ভিত বানাবার জন্য আলাদা করে ফেলা আবর্জনা দিয়ে জমি ভরাটের দরুনও হতে পারে।
পরবর্তীকালে কাছেই পাওয়া গেছে দ্বিস্তরীয় বিশেষ গঠনের চুল্লি।
প্রত্নস্তূপ-`ই“ইটি“(Mound-E, ET)এলাকা।
ক্যালিব্রেটেড কার্বন ডেটিং অনুযায়ী এখানে বসতির শুরু ৩৫১৭ সাধারণ পূর্বাব্দে। সে হিসাবে এই এলাকা আর `এবি` হয়ত সমসাময়িক কালের বসতি ছিল।
এখানে বেশ কয়েকটি উনুনের কার্বন ডেটিং করা হয়েছে। তার মধ্যে সাতটি উনুনের তথ্য বলছে, ক্যালিব্রেটেড কার্বন ডেটিংএ পাওয়া প্রাচীনতম কাল-৩৫১৭ থেকে ২২০১ সাধারণ পূর্বাব্দ অবধি। প্রায় প্রতিটি বাড়ির এই উনুনগুলো ব্যবহার হয়েছে বেশ কয়েক শতাব্দী ধরে।এটিও যথারীতি দেওয়াল ঘেরা বসতি। তবে দেওয়াল তৈরির কাল আনুমানিক ২৬০০ নাগাদ। অর্থাৎ বসতি পত্তনের পরে দেওয়াল তোলার মত উন্নতি করতে লেগেছিল প্রায় হাজার বৎসর। তবে এই দেওয়ালের ইটের গাঁথুনির পাওয়া সর্বোচ্চ স্তরের বয়স আনুমানিক ২০০০ সাধারণ পূর্বাব্দ। তারপরেও এটি সারাইয়ের কাজ হয়ত হয়েছিল কিন্তু সে ইট এখন আর নেই।
হরপ্পার শুরুতে, ৩৩০০-৩৫০০ পূর্বাব্দে, স্বাভাবিক ভাবেই হাতেগড়া মাটির বাসন ছিল। ঘূর্ণিচাকিতে বাসন বানানো শুরু হয় বেশ কিছু পরে, কিন্তু ২৮০০ পূর্বাব্দের আগে। তবে হাত গড়া বাসনও পোড়ানোর আগে তার উপর সাংকেতিক চিহ্ন দেওয়া হত। অনুমান করতে পারি সেই চিহ্ন নির্মাতার পরিচয় বহন করত। এটা খুব সাধারণ ব্যাপার নয়। এক তো এতে অনুমান করা যায় নির্মাতার ব্যক্তি প্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষা ছিল, যা পরবর্তীকালে বংশ পরম্পরায় ব্যক্তি মালিকানায় ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের জন্ম দেবে। তার সাথে সিলে হরপ্পার লিপি লেখার শুরু হবে। আরো আশ্চর্যের কথা হল সিল কিন্তু তখন, সেই আদ্যিকালেই, বানানো শুরু হয়েছিল। খুব ছোট, খুব সাধারণ, বোতামের আকারের সাধারণ নক্সায়। আর ২৮০০ থেকে ২৬০০ পূর্বাব্দের সিলে দেখা গেল হরপ্পা লিপির ব্যবহার।
এর থেকে অনুমান করা যায় মাটির বাসনে আঁচড় কাটা সাংকেতিক চিহ্ন থেকে সিলের হরপ্পান লিপিতে উত্তরণ ঘটেছিল এই এলাকাতেই। এই এলাকার প্রধান বৈশিষ্ট্য এখানেই ছিল হরপ্পা শহরের প্রধান প্রবেশ দ্বার।প্রধান প্রবেশদ্বার বাদেও আরো প্রবেশ দ্বার ছিল এই এলাকার দেওয়ালে। প্রধান প্রবেশদ্বার ছিল প্রথমে ছোট। আন্দাজ আড়াই মিটার চওড়া। পরে বেশ কয়েকবারে অনেকটাই চওড়া করা হয়। দ্বারের কাছে ছিল ব্যবসায়ীদের বিশ্রামের চত্বর। প্রবেশদ্বারের পাশেই একটি ঘর ছিল, যার ব্যবহারের ব্যাখ্যা পাওয়া যায়নি। অনুমান করা যায় শহরে প্রবেশে কড়া নিয়ন্ত্রণ ছিল। ফলে বাইরে থেকে আসা লোকেদের এই প্রবেশ দ্বারের বাইরের চত্বরে অনেকটা সময় কাটাতে হত।
হরপ্পা শহরে জল নিকাশি ব্যবস্থা হয়ত ভালোই ছিল। `ই` এলাকা থেকে জল বাইরে বের হবার বিশাল ড্রেন সেকথাই বলে। কিন্তু খুব স্বাভাবিক ভাবেই হাজার চেষ্টা করলেও দুই হাজার বৎসর ক্রমাগত বসবাসের পরে কোন শহর আবর্জনা মুক্ত থাকতেই পারে না। ছিলও না। তবে ২০০০ সাধারণ পূর্বাব্দের পর থেকেই শহরে আবর্জনার স্তূপ ক্রমাগত বেড়েই চলছিল।
দেখা যায়, জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও অর্থনৈতিক কার্যকলাপের সাথে তাল মিলিয়ে হরপ্পা শহরে নতুন এলাকা সংযোজন হচ্ছিল। সেটাই স্বাভাবিক। তবে তার সাথে আমাদের খেয়াল রাখতে হবে শহরে জমে ওঠা আবর্জনা নিয়মিত সরানো সম্ভব হবার কথা নয়। তার জন্যও তাদের নতুন এলাকায় শহর বাড়াতে হতে পারে। হয়ত আগে তেমনটাই হত। কিন্তু ২০০০ পূর্বাব্দের পরে সেই বাড়ানোর কাজটা একেবারেই বন্ধ হয়ে যায়।
প্রসঙ্গত শহরের এই `ই`আর`এবি`এলাকাতেই বসতি ছিল একেবারে ১৩০০ সাধারণ পূর্বাব্দ অবধি। অবশ্যই মাথায় রাখতে হবে `এইচ` এলাকার কিছুই জানা নেই।
কবরখানাঃ আর৩৭ (R37)
এবি এলাকার দক্ষিণ পশ্চিমের নিচু জমিতে এই কবরখানা আর-৩৭. এলাকা বেশ ছোট মাত্র ৫০X৫০ মিটার। অথচ এটিই শহরের সবচেয়ে বড় কবরখানা। কবরখানার ব্যবহার কাল ২৫৫০ থেকে ২০৩০ সাধারণ পূর্বাব্দ। পাঁচশ বৎসর ধরে ব্যবহার করলে যা হয়, অনেক সময়ই আগের কবরের উপরে নতুন কবর দেওয়া হয়েছে এখানে। এখানে নানা ধরনের কবরের মধ্যে পাওয়া গেছে মৃতদের সাথে কবরে রাখা নানা জিনিষ। যার মধ্যে ছিল নানা রকমের মাটির বাসন, সোনা, রুপা, ঝিনুকের গয়না, চুড়ি, নেকলেস, কবচ, পাথরের পুঁতি, মূল্যবান পাথর, আয়না, চামচ, চিরুনি, মেয়েদের কবরে শঙ্খের চুড়ি।
এখানে উল্লেখ যোগ্য ভাবে একটি মাত্র কবর পাওয়া গেছে যার নির্মাণে ইট ব্যবহার হয়েছিল, আর একটি নারীর কবরে ছিল কাঠের আচ্ছাদন। পরে ১৯৮৮ সালে আরেকটি কাঠের কবর পাওয়া গেছে।যদিও কাঠ নষ্ট হয়ে গেছে। অনেক কবরেই মৃতদেহের মাথা ছিল উত্তর দিক করে।
এখান থেকে উদ্ধার করা, কলকাতায় রাখা এবং পরীক্ষার জন্য নেওয়া ৬৬টি দেহাবশেষের মধ্যে ৬৪ টিই পূর্ণবয়স্ক। মাত্র দুটি শিশু (পাঁচ বৎসরের বেশি বয়স)। ৬৬টি দেহাবশেষের মধ্যে ১৬টি ছিল যথাযথ কবর দেওয়া। ২৯টি কবরে শুধু কিছু দেহাস্থি, আর ২১টি ছিল একসাথে একাধিক দেহ কবর দেওয়া।
প্রথমদিকে এই কবরখানায় পাওয়া কঙ্কালগুলো চলে এসেছিল কলকাতায়। বর্তমানে রাখা আছে কলকাতার অ্যানথ্রোপোলজিকাল মিউজিয়ামে। পরের দিকে বের করা কঙ্কাল আছে করাচির ন্যাশনাল মিউজিয়ামে। একটি আছে হরপ্পার স্থানীয় সংগ্রহালয়ে।
আনুমানিক পাঁচশ বৎসর ধরে ব্যবহার করা কবরখানা `আর৩৭` থেকে পাওয়া কলকাতায় রাখা কঙ্কালগুলোর কার্বন ডেটিং করে বয়স বের করা হয়নি। কারণ এই কঙ্কালগুলো তোলার সময় কার্বন ডেটিং পদ্ধতি অজানা ছিল। কিন্তু গত ৮০-৯০এর দশকে কয়েকটি কবরের কার্বন ডেটিং করে বয়স জানা গেছে। সেগুলো হল ২৩২৭, ২২৮৮, ২২০০, ২১৩৭, ২০৭৬, ২০৭১,২০৪৬, ২০১৬ সাধারণ পূর্বাব্দ।
কবরখানাঃ সিমেট্রি-এইচ (Cemetery-H)
কবরখানাঃ `আর৩৭`(R37) এর গায়েই কবরখানা সিমেট্রি-`এইচ`। এই কবরখানাটি তুলনামূলক ভাবে নবীন। আনুমানিক ১৯০০ সাধারণ পূর্বাব্দ থেকে এই কবরখানা ব্যবহার হচ্ছিল। কবরটিকে দুটি প্রত্ন কালস্তরে ভাগ করা হয়েছে।১৯০০ থেকে ১৭০০ ও ১৭০০ থেকে ১৩০০ সাধারণ পূর্বাব্দ। এখানে কবরের দান সামগ্রী দেখে অনুমান করা হয় কবরখানা আর-৩৭-এর থেকে এই কবরের শায়িত লোকেরা দরিদ্র ছিল। প্রথম স্তরে পাওয়া গিয়েছিল ২৬টি দেহাবশেষ। ২০টি পূর্ণবয়স্ক ও ছয়টি শিশুর দেহাবশেষ পরীক্ষার যোগ্য বলে নেওয়া হয়েছিল।
দ্বিতীয় স্তরে (১৭০০ থেকে ১৩০০)এখানে দেহাবশেষ বড় মাটির হাঁড়িতে পাওয়া গেল। ৩১টি পূর্ণবয়স্ক ও ১৪টি শিশু।
এই কবরখানার বিশেষত্ব হল এখানে কবরে রাখা বাসন ও কবর দেবার পদ্ধতিতে বেশ বড় রকমের পরিবর্তন দেখা গেছে। যেহেতু ভিন্ন ধরনের মাটির বাসন আর ভিন্ন ধরনের কবর দেবার পদ্ধতি সাধারণত ভিন্ন সংস্কৃতির উপস্থিতিই বোঝায়, তাই এই সিমেট্রি-`এইচ` কে একটি ভিন্ন সাংস্কৃতিক নাম দেওয়া হল,`সিমেট্রি-এইচ` সংস্কৃতি। এই সংস্কৃতির সাথে বৈশিষ্ট্যগত কিছু মিল পাওয়া গেছে সোয়াট উপত্যকার কবরে। প্রত্নবিদ মুঘল জানান অনুরূপ সংস্কৃতির লক্ষণ পাওয়া গেছে হাকরা সংস্কৃতির চোলিস্তানে, আর সুতলেজ নদীর কিনারা বরাবর বহু প্রত্ন বসতিতে।
কিন্তু সিমেট্রি-`এইচ` এর উপরের স্তরের (১৭০০-১৩০০ সাদারণ পূর্বাব্দ) কবর ছিল একেবারেই ভিন্ন। এখানে কঙ্কাল রাখা ছিল বড় মাটির পাত্রে। এই কঙ্কাল নিয়ে গবেষণার বিশদ এই লেখায় থাকছে না, কারণ এগুলো হরপ্পা সভ্যতার অবসান আমলের বলে অবনতির কারণ বোঝার জন্য এদের তথ্য সরাসরি কাজে লাগবে না। তবে এদের দাঁতের বৈশিষ্ট্য নিয়ে গবেষণা করা হয়েছে। ফলে তার উল্লেখ থাকবে।
কবরখানাঃ `জি`(Grave-G)
১৮X১৮ মিটার এলাকার কবরখানা-জি কে প্রকৃতপক্ষে কবরখানা বলাই কঠিন। এটি `ই` এলাকায় শহরের ঘেরা দেওয়ালের বাইরে, শহরের ময়লা জল বের হবার ড্রেনের পাশে। এখানে যথাযথ কবর তেমন একটা পাওয়াই যায়নি। মূলত যা পাওয়া গেছে তা হল দেহাস্থি আর করোটি। মর্টিমার হুইলারের মত ছিল যে মৃতদেহগুলো অন্য জায়গা থেকে এনে স্রেফ ফেলে দেওয়া হয়েছিল এখানে।
কিন্তু সেটা অবশ্যই সর্বাংশে ঠিক নয়। কারণ কম হলেও, অতি সাধারণ হলেও, কিছু যথাযথ কবরও এখানে পাওয়া গেছে। কাজেই এই এলাকাকে কবরখানার বদলে মর্টিমারের সুরে সুর মিলিয়ে ভাগাড় বলা সম্ভব না।
তবে স্বভাবতই অনুমেয় এই অযত্নে রাখা বা ফেলে দেওয়া মৃতরা মুল শহরের বাসিন্দা ছিল না। তারা হরপ্পা শহরের অবহেলিত অনাকাঙ্ক্ষিত জন সমষ্টির লোক ছিল।
এখানে পাওয়া কবরে ছিল যৎসামান্য মাটির বাসন, পান পাত্র, পাদানসহ থালা, আর জলের পাত্র। বিচ্ছিন্ন দেহাস্থির মধ্যে পাওয়া গেছে ২০টি করোটি, ৩টি চোয়ালের হাড়, একটি পিঠের হাড়, আর দুটো আংশিক মেরুদণ্ড। করোটিগুলো খানিক রহস্যের সৃষ্টি করে। এগুলো দেহের থেকে বিচ্ছিন্ন করা হয়েছিল না স্বাভাবিক প্রক্রিয়াতেই বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে? মর্টিমার হুইলারের মত, দুই রকমই সম্ভব।এছাড়া পাওয়া গেছে অস্থি আধার পাত্রে রাখা একটি গরুর খুলি ও একটি কুকুরের মেরুদণ্ড।
এই কবরখানা-`জি`এর কোন সুনির্দিষ্ট পুরাতাত্ত্বিক সময় পাওয়া যায় নি।তবে ওখানে পাওয়া মাটির পাত্রের গঠন ইত্যাদি দেখে অনুমান করা হয় এটি কবরখানা-`আর৩৭` আর সিমেট্রি-`এইচ` এর মাঝামাঝি কোন কালের হবে। অর্থাৎ আনুমানিক সাধারণ পূর্বাব্দ ২০০০-১৯00 সময়ের হবে। এখানে পাওয়া দেহাস্থি থেকে কলকাতায় করা পরীক্ষার জন্য পাওয়া যায় মোট বারোজন পূর্ণ বয়স্ক আর নয়জন কিশোরের দেহাস্থি।
নতুন কবর যা খোঁড়া হয়নি
১৯৮৮ সালে জমিতে ফসল উৎপাদনে জনিত কিছু সমস্যার জন্য কয়েকজন পাক বিজ্ঞানী হরপ্পা এলাকায় আসেন। তাঁরা আবিষ্কার করেন আরেকটি কবরখানার অস্তিত্ব। বেশ বড় এলাকা জুড়ে। প্রত্ন বিজ্ঞানীরাও ঘুরে গেছেন। কারণ তখন কবরস্থল`আর৩৭` এ খনন কাজ চলছিল। বিজ্ঞানীদের অনুমান, আনুমানিক ৩০০ কবর থাকার কথা এখানে। তার মধ্যে কম করেও ৬০টি যথাযথ কবর আছে বলে প্রাথমিক ভাবে অনুমান করা হয়েছে। সমস্যা হল এখানে কৃষিকাজ চলছে। অনেকদিন ধরেই চলছে। কাজেই নীচে কবর থাকলেও সেগুলোর অবস্থা কেমন আছে তা বলা কঠিন। তার চেয়েও বড় কথা আদৌ কি কোন দিন খোঁড়া যাবে? হয়ত না।
হরপ্পাবাসীর দেহাবশেষ নিয়ে আধুনিক পদ্ধতিতে গবেষণা।
কয়েক হাজার বৎসরের প্রাচীন বিশাল শহরটিতে অতি সামান্য দেহাবশেষ পাওয়া গেছে। আর সেই দেহাবশেষগুলোও শহরের আয়ুষ্কালের তুলনায় একেবারেই সীমিত সময়ের। এর থেকে শহরবাসীদের সম্বন্ধে কোন নির্ভুল ধারনা তৈরি করা সম্ভব নয়। আমরা কেবল একটা আবছা ধারনা গড়তে পারি। এমনকি যে কয়েকটি দেহাবশেষ পাওয়া গেছে তারমধ্যেও সবকটি পরীক্ষার উপযুক্ত ছিল না। বেশির ভাগ কঙ্কালই আংশিক কঙ্কাল মাত্র, বা শুধুই কয়েক টুকরো অস্থি। খুব সামান্যই উদ্দিষ্ট কাজের উপযুক্ত অবস্থায় ছিল।
কলকাতায় রাখা অস্থিগুলো যে কখনো প্যালিওপ্যাথোলজির কাজে ব্যবহার হবে, তা একশ বৎসর আগে কেউ ভাবেন নি। তখন সংরক্ষণ বলতে লক্ষ্য ছিল কেবল অস্থির ভঙ্গুরতা রোধ করা। ফলে এই দেহাস্থি পরীক্ষার সময় গবেষকরা যে অসুবিধায় বেশি ভুগেছিলেন তা হল বহু বৎসর আগে সংগ্রহ করা এই প্রাচীন দেহাস্থিগুলো টিকিয়ে রাখার জন্য তার উপরে দেওয়া ভিনাইল অ্যাসিটেটের প্রলেপ। ফলে বর্তমান গবেষকদের মাইক্রোস্কোপের ব্যবহারে অসুবিধা হচ্ছিল। যেখানে সম্ভব সেখানে নরম টুথব্রাশ দিয়ে পরিষ্কার করে দেখেছেন, অথবা যেখানে ভিনাইল অ্যাসিটেটের প্রলেপ দেবার সময় তা কোন কারণে ভালো ভাবে লাগেনি, সেই জায়গাগুলোই ভালো করে দেখতে পেয়েছেন।
কলকাতার কঙ্কাল নিয়ে কাজ করা গবেষকরা দেহাস্থি থেকে বয়স নির্দ্ধারণ করার জন্য শিশু থেকে কিশোরদের দাঁত ওঠার সময় আর দাঁতের কতটা পূর্ণতা পেয়েছে তা হিসেবে ধরেছেন। তাছাড়া সাধারণ ভাবে খুলির গঠন, দাঁতের ক্ষয় কানের হাড়ের গঠন এগুলোও দেখা হয়েছে।
কলকাতার গবেষকরা মৃতদের মৃত্যুকালীন বয়সকে তিনটি ভাগে ভাগ করেছেন। তরুণ (১৮-২৯), মধ্যবয়স্ক (৩০-৫৪), বয়স্ক (৫৫ উর্ধ্বে)।
হরপ্পার গবেষক বয়সের ভাগ করেছেন তরুণ(২০-৩০), মধ্যবয়স্ক (৩১-৪০) বয়স্ক (৪০উর্ধ্বে।)
লিঙ্গ নির্ধারণ হয়েছে মূলত শ্রোণী হাড় দেখে।
আরেকটি বিষয় গবেষকদের ভাবিয়েছে, তা হল কিশোরদের কবর এত কম কেন? তবে কি তাদের অন্য কোন পদ্ধতিতে সৎকার করা হত? বা তাদের দেহ অন্যকোন এলাকায় আছে?
হরপ্পাবাসী
হরপ্পা শহরের বাসিন্দাদের পরিচয় জনার জন্য সঠিক উপায় অবশ্যই ডি. এন. এ. সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ। কিন্তু হরপ্পায় পাওয়া কঙ্কাল থেকে আজ পর্যন্ত কোন ডি. এন. এ. সংগ্রহ করা হয় নি। যখন হরপ্পার কঙ্কালগুলো তোলা হয় তখনও প্রাচীন দেহাবশেষের ডি. এন. এ. সংগ্রহ করার ও জিন বিশ্লেষণের পদ্ধতি অজানা ছিল। তাই সে কাজ হয়ত আর হবে না কখনো। এছাড়া থাকছে খুলির মাপে জাতি নির্ণয়। সে পদ্ধতিতে যদিও একটা প্রাথমিক অনুমান করা সম্ভব কিন্তু আজকাল তাতেও কমই ভরসা রাখা হয়।
আরেকটি পদ্ধতি থাকছে দাঁতের পরীক্ষা। এই পদ্ধতিতে অনেকটাই ভরসাযোগ্য তথ্য পাওয়া যায়। হরপ্পায় এবং হরপ্পা সভ্যতার একাধিক জায়গায় দাঁতের নমুনা পরীক্ষা হয়ে গেছে। তার থেকে আমরা অনেকটা ভরসা যোগ্য তথ্য পেতে পারি। অনুমান করতে পারি হরপ্পা সভ্যতার গোড়া থেকে শেষ অবধি জনবিন্যাসের বিবর্তন, খাদ্যাভ্যাস, স্বাস্থ্য, আর সামাজিক পরিস্থিতি। যে গবেষকরা গবেষণা করেছেন তাঁরা মিশর থেকে মায়ানমার অবধি দাঁতের তথ্য দেখে অবস্থা বোঝার চেষ্টা করেছেন। তবে ওনাদের আফসোস ভারতের লোথাল কালিবঙ্গান ইত্যাদি এলাকার দাঁতের তথ্য অপ্রকাশিত থাকায়(১৯৯১ অবধি)পুরো চিত্র খানিক অস্বচ্ছ থেকে গেল।
কি পেলেন ওনারা? পেলেন সম্ভব্য জনবিন্যাসে বড় বদল।
১. ৬০০০ পূর্বাব্দের (নব্যপ্রস্তর যুগের) মেহেরগড়ের বাসিন্দা আর ৪৫০০ সাধারণ পূর্বাব্দের (তাম্রযুগের) মেহেরগড়ের বাসিন্দাদের মধ্যে মিল খুব সামান্য। তারা একই এলাকায় দীর্ঘকাল বসবাসকারী ভিন্ন জনগোষ্ঠীর লোক।
২. ৬০০০ পূর্বাব্দের মেহেরগড়ের বাসিন্দাদের সাথে মিল আছে মেসোলিথিক যুগের গঙ্গা অববাহিকার বাসিন্দাদের।
৩. তাম্রযুগের মেহেরগড়ের বাসিন্দাদের সাথে মিল আছে মহারাষ্ট্রের ইনামগাঁও (৩৮০০-৩২০০)(১৮০০-১২০০)এর বাসিন্দাদের, ও উত্তর পাকিস্তানের তিমেরগড় (৮০০ সাধারণ পূর্বাব্দ)এর বাসিন্দাদের।
৪. তাম্রযুগের মেহেরগড়ের বাসিন্দাদের সাথে মিল আছে হরপ্পার হরপ্পা পরিণত পর্যায়ের বাসিন্দাদের।(২৬০০-১৯০০)। এবং খানিকটা হলেও মিল আছে হরপ্পার সিমেট্রি-`এইচ`র (১৯০০-১৭০০)কালের লোকেদের সাথে।
৫. তিমেরগড় (৮০০ সাধারণ পূর্বশতক)এর বাসিন্দাদের সাথে মিল ছিল উত্তর পাকিস্তানেরই শরাইখোলার (৪০০০-৬০০ সাধারণ পূর্বাব্দ) বাসিন্দাদের। কিন্তু পরবর্তী শরাইখোলার (২০০ সাধারণ পূর্বশতক) বাসিন্দাদের সাথে কিছুমাত্র মিল নেই।
৬. হরপ্পার সিমেট্রি-`এইচ` এর উপরের স্তরে (১৭৫০-১৩০০)কঙ্কালের সাথে হরপ্পার সিমেট্রি-`এইচ`র নীচের স্তর (১৯০০-১৭০০), কবরখানা-`আর৩৭` ও কবরখানা-`জি` র লোকেদের কোন মিল নেই।
৭. প্রাচীন শরাইখোলার বাসিন্দাদের সাথে মেসোলিথিক গঙ্গা অববাহিকার বাসিন্দাদের মিল থাকলেও লৌহযুগের পরের শরাইখোলার (২০০ পূর্বশতক) এর বাসিন্দাদের সাথে মিল নেই। তাদের মিল আছে আধুনিক পশ্চিম পাঞ্জাবের বাসিন্দাদের।
৮. মহোঞ্জোদারোর বাসিন্দাদের সাথে কারুর কোন মিল পাওয়া যায় নি। এতে গবেষকরা খুব একটা চিন্তিত নন। কারণ সেখানে দাঁতের নমুনা খুবই কম পাওয়া গিয়েছিল। ফলে যথাযথ যথেষ্ট তথ্য হয়ত পাওয়া যায়নি। তা ছাড়া মহেঞ্জোদারোর মৃতদেহগুলোর মৃত্যুকাল হরপ্পা সভ্যতার কালের মধ্যে পড়বে কি না, তা নিয়েও সন্দেহ থেকেই গেছে। তবে অতি সামান্য যা তথ্য পাওয়া গেছে তাতে অনুমেয় তাদের সাথে হরপ্পার নারীদের একটা ক্ষীণ সম্পর্ক আছে।
৯. পরিণত কালের হরপ্পা বাসীদের সাথে একটা সম্পর্ক আছে ইরানের টেপে হিসার-৩ (৩০০০-২০০০ সাধারণ পূর্বাব্দ) এর বাসিন্দাদের। এই সম্পর্ক গোটা ইরানের বাসিন্দাদের সাথেই কম বেশি থাকছে। তবে মিশর ও আনাতোলিয়ার বাসিন্দাদের সাথে কোন সম্পর্ক নেই।
যেহেতু গবেষকরা রোগের কথা আলোচনা করছেন, তাই জানলে ভালো হয় স্থায়ী ও পরিণত কালের হরপ্পাবাসীরা ঠিক কোন অঞ্চলের লোক ছিল।
স্বভাবতই কয়েক হাজার বৎসরের শহরে, শহরের নিজস্ব বাসিন্দারাই সংখ্যাধিক্য হবে। তবু আসা যাওয়া তো লেগেই থাকবে। হরপ্পার স্থায়ী বাসিন্দাদের ধরলে, সম্ভবত সাধারণভাবে তারা কোন একটি বিশেষ জাতি বা জনগোষ্ঠীর ছিল না। একাধিক জাতির এলাকার লোকেরাই সম্ভবত শহরে বাস করেছে।
দাঁতের নমুনা থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে কেনয়েরের অভিমত হল, শহরের বেশির ভাগ লোকের উৎস ছিল পোথোহার বা পটোয়ার এলাকার। এই পোথোহার এলাকাটি সাধারণভাবে বর্তমানের পাকিস্তান অধিকৃত আজাদ কাশ্মিরের পশ্চিম দিক থেকে খাইবার পাখতুনওয়ালা অবধি বিস্তৃত এলাকা ধরা যেতে পারে।এরই সাথে আরেকটি তথ্য যোগ করা উচিত, পুরুষরা বাইরে থেকে এলেও বেশির ভাগ নারীই কিন্তু হরপ্পার স্থায়ী বাসিন্দা ছিল।
সব মিলিয়ে কবরখানা-`আর৩৭`, সিমেট্র-`এইচ`, আর কবরখানা-`জি` এর মানুষদের মধ্যে কোন উল্লেখযোগ্য রকমের জাতিগত পার্থক্য দেখা যায় নি। অন্যভাবে দেখলে ২৬০০ থেকে ১৭০০ অবধি হরপ্পাবাসীদের মধ্যে কোন উল্লেখযোগ্য জাতিগত পরিবর্তন ঘটেনি।
হরপ্পাবাসীর রোগভোগের কথা
হরপ্পা সভ্যতার উন্নত নগর পরিকল্পনা,জল নিষ্কাশন ব্যবস্থা, পোড়া ইটের ঘর চওড়া রাস্তা, এই সব থেকে ধারনা হবে এই সভ্যতার লোকেরা খাদ্যে, স্বাস্থ্যে, কর্মদক্ষতায়, উপার্জন সুযোগে,পারিবারিক বন্ধনে, সুখী জীবনের অধিকারী ছিল। বাস্তবে এমন সর্বাঙ্গীণ সুখী নাগরিক সমাজ থাকে না কোথাও। আর কিছু না হোক মানুষ নানা রোগে ভুগবেই।সেই রোগের খোঁজে প্যালিওপ্যাথোলজি। তবে হরপ্পাবাসীদের কবর থেকে তোলা কঙ্কাল থেকে কেবল সেই সব রোগের কথাই জানা সম্ভব যা তাদের দেহাস্থিতে ছাপ রেখে গেছে।
রক্তাল্পতা
এপর্যন্ত যা জানা গেছে তা হল বেশিরভাগ হরপ্পাবাসীই, গড়ে, মোটামুটি সুস্বাস্থ্যের অধিকারী হলেও৬.৭%লোক রক্তাল্পতায় ভুগতো। রক্তাল্পতার সমস্যা আসতে পারে খাদ্যে আয়রনের অভাবে। কিন্তু হরপ্পায় যে পরিমাণ পশুর হাড় পাওয়া গেছে তাতে তারা মাংস খেলে আয়রনের অভাব হবার কথা নয় বলে ভাবছেন বিজ্ঞানীরা। তাহলে আমাদের ভাবতে হয়, হয়ত সমাজের কোন শ্রেণী বা গোষ্ঠী মাংস খেত না, অথবা মাংস খাবার মত আর্থিক সচ্ছলতা তাদের ছিল না। তাছাড়া ক্রিমি থেকেও এই রক্তাল্পতা হতে পারে বলে ধারনা করছেন বিজ্ঞানীরা। যতই ভালো পানীয় জলের জোগান বা পরিচ্ছন্নতা থাকুক না কেন ঘন বসতির শহরে ক্রিমির সংক্রমণ ঘটতেই পারে।
ভিটামিন-সি এর অভাব
দেখা গেছে, কবরখানা-`জি` এলাকায় পাওয়া শিশুদের ৩৩%-এর মধ্যে ছিল ভিটামিন-সি এর অভাব। অথচ কবরখানা-`এবি` ও সিমেট্রি-`এইচ` এর শিশুদের মধ্যে ভিটামিন-সি এর অভাব ছিল না। ফলে অনুমান করা হয় কবরখানা-`জি` এলাকার শিশুরা কোন না কোন কারণে অবহেলিত ছিল।
হরপ্পাবাসীদের দাঁত থেকে পাওয়া তথ্য।
১৯৮৮ সালে পাওয়া কঙ্কালের উপর করা জন লুকাসের গবেষণার একটি সংক্ষিপ্তসার দিয়েছেন রবিনস স্কাগ। জন লুকাসের গবেষণা পত্রে দাঁত ফোটাতে হলে দরকার দন্ত চিকিৎসকের। তাই আমি বিজ্ঞানী রবিনস স্কাগের সংক্ষিপ্ত সারেই ভরসা রাখলাম।তার ভিত্তিতে জানা যায় কবরখানা-`আর৩৭` থেকে নেওয়া ৩৬জনের দাঁতের নমুনার থেকে জানা গেছে যে এদের মধ্যে ৭২% শতাংশেরই শারীরিক বৃদ্ধি মাঝপথে বাধা পেয়েছিল।
এই শারীরিক বৃদ্ধির বাধা মেয়েদের মধ্যেই বেশি।স্বাভাবিক, কারণ মেয়েরা অবহেলিতই থাকে। কিন্তু এক্ষেত্রে সমস্যাটি দেখা গেছে পুরুষদের বেলাতেও এই মাঝপথে বৃ্দ্ধি থেমে যাওয়ার লক্ষণ দেখা গেছে। এথেকে অনুমান করা হয় যে আর্থিক দুরবস্থার দরুণ বাল্যাবস্থায় এদের স্থানান্তর হয়েছিল। এবং আইসোটোপের পরীক্ষার ভিত্তিতে জানা যায়, এরা এসেছিল গ্রামাঞ্চল থেকে। দাঁতের এনামেলের স্ট্রোনটিয়াম ও সীসার আইসোটোপ থেকে এইসব তথ্য জানা যায়। এই সূত্র থেকেই জানা গেল যে হরপ্পানদের অনেকেই এসেছে উত্তর-পশ্চিমের পথোহার বা পটোয়ার এলাকা থেকে। এবং তারা এসেছে শৈশবে, সম্ভবত শিশু শ্রমিক হিসাবেই।
হরপ্পাবাসীর দাঁতের রোগ ছিল। তবে তা ভয়াবহ নয়। সাধারণ হারই বলা যায়। ৪.৫% এনামেল নষ্ট, আর ৬.৮%-১২.১% লোকের দাঁতে ক্যাভিটি দেখা গেছে। এসব ঘটতে পারে খাদ্যাভ্যাস থেকে। সম্ভবত তাদের প্রধান খাবার ছিল শর্করা সমৃদ্ধ কৃষিজ খাদ্য।
অস্থিসন্ধি রোগ
এই রোগের পরীক্ষা হয় ১৯৮৮ সালের কঙ্কালগুলোর উপর। কিছু কঙ্কাল কবরে থাকা অবস্থাতেই। সাধারণভাবে অস্থিসন্ধিরোগ থাকলেও সেটা খুব বেশি ছিল না হরপ্পা বাসীদের মধ্যে।তবে তাদের প্রধান সমস্যা ছিল হাঁটু আর মেরুদণ্ড নিয়ে। ৩০৮৪টি মেরুদণ্ডের সংযোগ পরীক্ষার পরে ধারনা করা হয় যে গড়ে ৩৫% লোকের কমবেশি মেরুদণ্ডের সমস্যা ছিল। তবে কোনটাই তেমন গুরুতর নয়। এই মেরুদণ্ডের সংযোগ পরীক্ষা কিন্তু হয়েছিল হরপ্পায় কবরে রাখা দেহগুলোতে। ফলে খুব যে নিখুঁত পরীক্ষা হয়েছে তেমন কথা জোর দিয়ে বলা যাবে না। মেরুদণ্ডের সমস্যার একটা কারণ বলা হয়েছে ক্ষয় হওয়া। তবে সেগুলো যেহেতু বেশি দৃশ্যমান তাই সেগুলোই গড়ের হিসাবে প্রাধান্য পাবে বলে ধারনা করা যেতে পারে।
বাহু কনুই, কব্জি, কোমর, হাঁটু ও গোড়ালির অস্থিসন্ধির সমস্যাও দেখা হয়েছে। এখানে ১৯৯৪টি অস্থিসন্ধি পরীক্ষা করে দেখা গেছে হরপ্পা বাসীদের প্রধান সমস্যা ছিল হাঁটুর ব্যাথা। গড়ে বাহু ৪%, কনুই ৯%, কব্জি ১৫%, কোমর ও উরুর সংযোগ ৮%, হাঁটু ৩১%, গোড়ালি ১২% ছিল রোগগ্রস্ত। এসব ক্ষেত্রেও বেশির ভাগ ক্ষয় জনিত সমস্যা।চোয়ালের বাত সমস্যা দেখা গেছে ১৭ জনের। তবে এদের দাঁতের ক্ষয়ও বেশি ছিল।
অস্থিসন্ধি রোগ বেশি হারে দেখা গেছে তরুণ ও মধ্যবয়স্কদের মধ্যে। তাই অনুমান করা হল যে এই রোগের কারণ ছিল তাদের কাজের ধরন বা দৈনন্দিন ব্যবহারিক অভ্যাস জনিত। জন্মগত সমস্যা ছিল না। কি সেই অভ্যাস বা কাজ? বিজ্ঞানী অনুমান করেন সমস্যার মুলে ছিল মাথায় ওজন বহন করা। মাথায় ভারি ওজন বহনের অভ্যাস ভারতীয়দের মধ্যে আছে সেটা তো আমরা জানিই। কিন্তু তা যে এত প্রাচীনকালের তা জানা ছিল না। অস্টো-আর্থারাইটিসও ছিল হরপ্পাবাসীদের মধ্যে। এই সমস্যায় মেয়েরাই সম্ভবত বেশি ভুগত। অন্তত একজনের অবস্থা এতটাই খারাপ ছিল যে সে সম্ভবত নিজে থেকে চলাফেরাও করতে পারতো না।
বিকলাঙ্গ
বিকলাঙ্গ বা বিকৃত দেহও পাওয়া গেছে। তবে খুবই সামান্য। ১৯৮৮র ৯২টি কঙ্কালের গবেষণার ভিত্তিতে বলা যায় ৪%। কয়েকটি বিকলাঙ্গ দেহাবশেষ পাওয়া গেছে। একটি ২৫ বৎসর বয়সী নারী কঙ্কাল পাওয়া গেছে যার পায়ের কাছে রাখা ছিল একটি শিশুর কঙ্কাল।শিশু সহ বিকলাঙ্গ নারীর কঙ্কাল বলে সেটা কোন সংক্রামক রোগে মৃত্যু। নতুবা মা শিশু দুজনের এক কবরে ঠাঁই হত না। তবে তার সাথে আরেকটি বিষয় হল বিকলাঙ্গ হলেও হরপ্পা সমাজে তাদের যতদূর সম্ভব স্বাভাবিক জীবন যাপনের সুযোগ ছিল।
বছর কুড়ির একটি নারীর কঙ্কালে দেখা গেছে তার হাতের কনুই থেকে উপরের অংশ বাঁকা ছিল।
৩০-৩৫ বয়সী একজন নারীর মাথা ছিল অস্বাভাবিক। দুই পাশে চ্যাপ্টা, বাঁ চোখের উপরের হাড় উঁচু। উরুতেও এক জায়গায় হাড় উঁচু ছিল।
ভারতে প্রাচীণতম কুষ্ঠরোগের নিদর্শন।
কুষ্ঠ রোগের উৎপত্তি নিয়ে দুটো ধারনা প্রচলিত। একটি হল এর উৎস ভারতে। অপর ধারনাটি হল এর উৎস পূর্ব আফ্রিকাতে। ভারতে উৎপত্তি যাঁরা বলেন তাঁদের মতে, সিন্ধু সভ্যতার আমলে ব্যবসায়ী ও নানা জাতির আনাগোনা যাতায়াতের মাধ্যমে এই রোগ ভারত থেকে ছড়িয়ে পড়ে মেসোপটেমিয়া হয়ে মিশর পূর্ব আফ্রিকায়।
আর যাঁদের মতে উৎপত্তি পূর্ব আফ্রিকাতে, তাঁরা বলেন এটি ভারতে ঢোকে সেই আদ্যিকালেই, ৬০হাজার বৎসর আগে। অথবা, এবং, সিন্ধু সভ্যতার আমলে ব্যবসায়ী ও নানা জাতির আনাগোনা যাতায়াতের মাধ্যমে তা ছড়িয়ে পড়ে পূর্ব আফ্রিকা থেকে মিশর মেসোপটেমিয়া হয়ে ভারতে।
বর্তমানে পৃথিবীজোড়া দুই লক্ষের বেশী কুষ্ঠ রোগীর মধ্যে এক লক্ষই ভারতে। বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল, মিয়ানমার, ইন্দোনেশিয়া ফিলিপিন্স, ব্রাজিল, চীন, কংগো, আইভরি কোস্ট, ইথোপিয়া, মোজাম্বিক, নাইজেরিয়া সুদান বেশি করে এই রোগের কবলে।
রোগের ইতিহাস খুঁজতে খুঁজতে জানা গেছে ১৫৫০ সাধারণ পূর্বাব্দেই মিশরের প্যাপিরাসে এই রোগের কথা লেখা হয়ে গেছে। অথর্ব বেদ, সুশ্রুত সংহিতা, অর্থশাস্ত্র বাইবেলের ওল্ড ও নিউ টেস্টামেন্টেও রোগটির কথা বলা আছে। চতুর্থ শতাব্দীর গ্রীক, তৃতীয় শতাব্দীর চীনের ও প্রথম শতাব্দীর রোমান রচনায়ও রয়েছে।
ভারতে,সম্ভবত প্রাচীনতম, কুষ্ঠরোগী পাওয়া গেছে বালাথালে। উদয়পুরের ৪০ কিলোমিটার উত্তর-পূর্বের বালাথালের পুরাতাত্ত্বিক বয়স ৩৭০০-১৮০০ সাধারণ পূর্বাব্দ। এটি ঠিক হরপ্পা সভ্যতার শহর নয়। এটি ছিল আহির-বানস সংস্কৃতির লোকেদের বাসস্থান।
বালাথালে মোট পাঁচটি কবরের মধ্যে ১৯৯৭-আই নাম দেওয়া একটি কবরে একজন ৩৭(±৫) বয়সী পুরুষের কঙ্কালে কুষ্ঠের চিহ্ন পাওয়া গেছে।যদিও কবরটি পাথরে ঘেরা ছিল তবে তার আলাদা গুরুত্ব নেই কারণ বালাথালে ঘরবাড়ি পাথরেই বানানো। তবে কবরটি ঘুঁটের ছাই দিয়ে ভরা থাকার বিষয়টার গুরুত্ব থাকতে পারে।
কুষ্ঠরোগ
হরপ্পার তিনটি কবরখানাতেই কুষ্ঠরোগী ছিল জানাচ্ছেন কলকাতার গবেষক দল।
১৯৮৮ সালের হরপ্পার গবেষক জানাচ্ছেন `আর-৩৭` কবরখানায় দুইজনের কুষ্ঠ ছিল।সেই হিসাবে মোটামুটি দুই শতাংশ কুষ্ঠরোগী আমরা ধরতে পারি।
কুষ্ঠ রোগীর বাকি তথ্য কলকাতা গবেষকদের জানানো তথ্য।
১. কবরখানা `আর৩৭`- এখানে ছিল ৪.৫%লোকের।
২. সিমেট্রি-`এইচ`- এখানে ছিল ২৬.৯%লোকের।
৩. কবরখানা-`জি`- এখানে ছিল ৩৪.৮%লোকের।
কুষ্ঠরোগ হাড়ে ক্ষত সৃষ্টি করতে দীর্ঘ সময় লাগে বা হাড়ে ক্ষত সৃষ্টি করেনি এমন কুষ্ঠ রোগী থাকার সম্ভাবনাও থাকছে।একথা মাথায় রাখলে দেখা যাবে হরপ্পা শহরে কুষ্ঠরোগীর সংখ্যা যথেষ্ট বেশিই ছিল। এখানে অবশ্যই কবর ভেদে স্থানকাল আর সামাজিক বিভেদের কথা আসবে, সেগুলো নীচে আলাদা করে আলোচনা করা হল।
যক্ষ্মারোগ
এই রোগটির উৎস কিন্তু পশ্চিম এশিয়া। সেখানে যক্ষ্মা রোগ দেখা যায় প্রায় ৭ হাজার বৎসর আগে। আর মিশরে দেখা যায় ৩৫০০-২৬০০ সাধারণ পুর্বাব্দ থেকেই। কাজেই অনুমান করা যেতে পারে এই রোগটি এসেছিল হরপ্পা সভ্যতার বর্হিবাণিজ্যের হাত ধরে। হরপ্পায় যক্ষ্মা রোগের লক্ষণ পাওয়া গেছে ২০০০ সাধারণ পূর্বাব্দে আগে থেকেই।
১৯৮৮ সালের হরপ্পার গবেষক বলছেন তিনি `আর-৩৭` কবরের কঙ্কালগুলোর মধ্যে যক্ষ্মারোগের লক্ষণ দেখেছেন। যক্ষ্মারোগের লক্ষণ দেখতে দরকার খুলির নিচের আরো কিছুটা অংশ। কিন্তু যত করোটি পাওয়া গেছে তার অনেকেরই সাথে নীচের অংশটুকু ছিল না। ফলে যক্ষ্মারোগীর হিসাবে সম্ভাব্য সংখ্যার চেয়েও নীচেই দেখাবে।
কলকাতার গবেষকদলের পরীক্ষায় কবর-`আর৩৭`, সিমেট্রি-`এইচ` আর কবর–`জি` নিয়ে গড়ে ৪.৪% যক্ষ্মারোগের শিকার ছিল। তবেসিমেট্রি-`এইচ` এর ২৬জনের মধ্যেই কেবল৭.৭% জন যক্ষ্মা রোগী।
ম্যাক্সিলারী ইনফেকশন
ম্যাক্সিলারী ইনফেকশন ছিল হরপ্পাবাসীদের মধ্যে। ১৯৮৮ সালের ৯২টি কঙ্কালের মধ্যে ছিল একটি যার এই সমস্যা ছিল খুবই প্রবল। কলকাতার ৬৬ কঙ্কালে এই রোগের ছাপ দেখা গেছে ৪.৪শতাংশের মধ্যে। তার মধ্যে সিমেট্রি-`এইচ` এরই ৭.৭%। ফলে বলা যায় এই রোগের প্রাদুর্ভাব বেশি হারে বেড়েছিল ১৯০০ সাধারণ পূর্বাব্দের পরে এবং শহুরে মধ্যবিত্তদের মধ্যেই বেশি ছিল।কবরখানা-`আর৩৭` এ ছিল ১.৫% আর কবরখানা-`জি` তে ছিল ৪.৪%.
সামাজিক ও পারিবারিক হিংসা
দৈহিক আঘাতের বহু চিহ্ন থেকে গেছে হরপ্পায় পাওয়া কঙ্কালগুলোর মধ্যে। এর মধ্যে দৈহিক আঘাতের চিহ্ন সবচেয়ে বেশি কবরখানা-`জি` এলাকায়। শতকরা হিসাবে যা খুবই অস্বাভাবিক (৫০%)। অস্বাভাবিক আরো বেশি, কারণ এখানে বালক আর কিশোর বয়সীদের দেহাবশেষই বেশি ছিল।
সিমেট্রি-`এইচ` ও শারীরিক আঘাতের বহু চিহ্ন বহন করছে।
কবরখানা-`আর৩৭` এ পাওয়া গেছে শারীরিক আঘাতের বহু চিহ্ন। কবরখানা-`আর৩৭` এ দেখা গেছে মেয়েদের উপরেই বেশি দৈহিক আঘাত ছিল। যা সরাসরি পারিবারিক হিংসাত্মক ঘটনার কথা বলে।
কঙ্কাল এইচ ৮৮/১৮৫ বি. ১.মাথায় ১০মিমি চওড়া ও ৫০ মিমি লম্বা আঘাতের চিহ্ন। এই আঘাতেই তার মৃত্যু হয়।
কঙ্কাল এইচ ৮৭/১৫৬ এ, ২৫ থেকে ৩০ বৎসরের নারী। বাঁ কপালে ভোঁতা কিছু দিয়ে আঘাত করা হয়েছিল। তবে সেই আঘাতই মৃত্যুর কারণ নাও হতে পারে।
কঙ্কাল এইচ ৮৭/১৩৪এ, ৩০-৩৫ বৎসরের নারী। দুইপাশে চ্যাপ্টা মাথা আর চোখের কাছে উঁচু হয়ে থাকা এই বিকৃত দেহের নারীর চোখের কাছে একাধিক আঘাত ও পাঁজরের হাড়ে আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। এই আঘাতগুলো সেরে উঠেছিল তবে সেরে ওঠা হাড়ের অংশে কিছুটা বিকৃতি ছিল।
কঙ্কাল এইচ ৮৭/৯৩ এটি টুকরো হাড় মাত্র। পাঁজরের হাড় ভেঙ্গে ছিল, তবে সেরেও উঠেছিল।
কঙ্কাল এইচ ৮৭/৪৯ বিনাকের হাড় ভাঙ্গা। জোড়া লাগে নি।তবে এই আঘাতে মৃত্যুও হয় নি।
একজন ৩০ বৎসরের মহিলার মাথার পেছন থেকে আঘাত করা হয়। মাথা সরাবার চেষ্টা করেও পুরো সরাতে পারে নি। সেই আঘাতেই মৃত্যু হয়।
এইচ৬৯৮ সিমেট্রি-এইচ। মাথায় চারটি গুরুতর আঘাত। পায়ের হাড় ভাঙ্গা।
জিআইআই ৩২ মাথায় আঘাতের ফলে সেরে ওঠার সময় গঠনে বিকৃতি এসে গেছে।
আইএস ১১- মাথায় ভোঁতা জিনিষের তীব্র আঘাত।
আলোচনা
১৩০০ সাধারণ পূর্বাব্দে হরপ্পা সম্পূর্ণ পরিত্যক্ত হবার কারণ অনুসন্ধানের পথে হরপ্পার শহরের গঠন পদ্ধতি, বিবর্তন, জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার এই সবের সাথে দেখা হয়েছে হরপ্পায় পাওয়া তিনটি কবরের দেহাস্থিতে থেকে যাওয়া রোগ ও আঘাতের চিহ্ন। এর মাধ্যমেই বোঝার চেষ্টা করা হয়েছে কোন পরিস্থিতিতে শহরে জনসংখ্যা কমতে শুরু করেছিল।
অনুসন্ধানের মাধ্যমে জানা গেছে হরপ্পা বাসীদের মধ্যে ছিল সামাজিক বৈষম্য ঘটাতে পারে এমন সংক্রামক রোগের অস্তিত্ব। জানা গেছে সমাজ খুব একটা শান্তিপূর্ণ ছিল না। কেন তাদের দৈনন্দিন জীবনে অশান্তি ও হিংসার বাহুল্য দেখা দিল?এর সাথে রোগ ও সংক্রামক রোগীর সম্ভাব্য সামাজিক বিভেদের সম্পর্ক আছে কি?
সব কিছু দেখেও কোন চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে আসার পথে কয়েকটি বড় সীমাবদ্ধতা থেকে গেছে। প্রথমত হরপ্পার মত কয়েক হাজার বৎসরের প্রাচীন শহরে কবর পাওয়া গেছে খুবই কম। হাজার হাজার লোকের শহরে কয়েকশ কঙ্কাল কোনমতেই সামগ্রিক পরিস্থিতি অনুমান করার পক্ষে যথেষ্ট নয়। আমাদের দেশের আদ্র আবহাওয়াও প্রাচীন কঙ্কাল টিকে থাকার উপযুক্ত নয়। প্রধান কবরটি আবার বহুকাল ব্যবহার হওয়ায় কবরের উপর কবর তৈরি হয়ে গেছে। সবার উপরে যে কঙ্কাল-দেহাস্থি নিয়ে গবেষণা তারে একটা বড় অংশই বহুকাল বাক্সবন্দি পড়ে ছিল পুরো রাসায়নিক প্রলেপ মাখা অবস্থায়।
হরপ্পা শহরের একাংশে নতুন শহর গড়ে ওঠায় তার নীচে কি আছে তাও অজানা থেকে গেল। তার সাথে ১৯৮৮ সালে যে কবরখানার অস্তিত্ব জানা গেছে, তা খনন হয় নি। তবু এই সীমাবদ্ধতার মধ্যে থেকেই অবনতির সূচনাকালের হরপ্পাকে বোঝার চেষ্টা করা হয়েছে।
২৪৫০ থেকে ১৯০০ সাধারণ পূর্বাব্দ ছিল পরিণত হরপ্পার কাল। ১৯০০ পূর্বাব্দ থেকেই শুরু হয় অবনতির। লোক শহর পরিত্যাগ করতে শুরু করে। অথচ ২০০০ পূর্বাব্দের আগে অবধি লাগাতার শহরের জনসংখ্যা বৃদ্ধি হচ্ছিল।হয়ত শহরের এই উন্নতির মধ্যেই তার পতনের বীজ লুকিয়ে ছিল।
২২০০ সাধারণ পূর্বাব্দের মেঘালয়ান এজে-এর খরা বা কম হারে বৃষ্টিপাতের ফলে উদ্ভুত গ্রামীন অর্থনীতির অবনতি শহরের আর্থিক অবস্থায় ছাপ ফেলবে। তবে কেবল এই একটি কারণেই সুবিস্তৃত হরপ্পা সভ্যতার অন্যতম প্রধান শহর পরিত্যক্ত হতে পারে না। তার সাথে লক্ষণীয় যে পরবর্তী ১৩০০ পূর্বাব্দ অবধি শহরে খুব কম হলেও জনবসতি ছিল। কাজেই কম বৃষ্টির কালে খাদ্যাভাবে শহর পরিত্যক্ত হয় এই ধারনা সম্ভবত সম্পূর্ণ সঠিক নয়।
হরপ্পা শহরের মধ্যেই তিনটি দেওয়াল ঘেরা এলাকা। তারই মধ্যে `এফ` এলাকা সবচেয়ে পরে তৈরি হয়। এই `এফ` এলাকায় ছিল বড় বড় বাড়ি, যেগুলো প্রশাসনিক কারণে ব্যবহার ছাড়াও আলাদা করে অনেক বাসগৃহও ছিল। এই এলাকাটির গঠন বলে দেয় এটি সুপরিকল্পিত এলাকা ছিল। ফলে সহজেই অনুমেয় শহরের ধণাঢ্য নাগরিক এবং প্রশাসনিক ক্ষমতাধরেরা ছিল এলাকাটির বাসিন্দা। অথচ এই এলাকাটিই জনহীন হয়। সম্ভবত ২২০০ পূর্বাব্দে বৃষ্টি কমতে শুরু করলে গ্রামাঞ্চলে অর্থনৈতিক অবনতির সূত্রপাত হয়। একই সময়ে বৃষ্টি কমতে থাকে মেসোপটেমিয়াতেও। সেখানেও অর্থনৈতিক অবনতির সাথে তাল মিলিয়ে রাজনৈতিক টালমাটাল শুরু হয়। হরপ্পা সভ্যতার সাথে বাণিজ্যিক লেনদেন কমতে শুরু করে দ্রুত হারে। ফলে এই `এফ` এলাকার বাসিন্দারা প্রথমেই টের পান আসন্ন অর্থনৈতিক অবনতির সম্ভাবনার কথা। তাঁরা একে একে শহর ত্যাগ করে ভাগ্যবদলের আশায় অন্যত্র চলে যান। অন্যত্র চলে যাবার কথা ভাবা হচ্ছে, কারণ এই জনশূন্য হয়, এবং পরবর্তী কালেও জনবসতি আর হয়নি। এই এলাকার বাসিন্দাদের শহর ত্যাগের সমসাময়িক কালেই শহরের ঘন বসতি এলাকা `এবি` ও `ই` এলাকায় দেখা গেল রাস্তার উপরে ঘরবাড়ি তৈরি হতে শুরু করেছে। অবশ্যই এটা শহরের প্রশাসনিক ব্যবস্থার অবনতিই বোঝায়। এই এলাকার বাসিন্দাদের শহর ত্যাগ আর প্রশাসনিক অবনতি কোনটা আগে বা কোনটা পরে তা বোঝা দুরূহ হলেও তারা যে সম্পর্কিত তা বোঝা কঠিন নয়।
হরপ্পার `এফ` এলাকার বাসিন্দারদের শহর ত্যাগের প্রত্যক্ষ কারণ জানার উপায় নেই। তবে ২৪৫০ থেকে দূরদূরান্তে একাধিক হরপ্পান বসতি গড়ে ওঠা থেকে খানিক অনুমান করা যায় যে হয়ত হরপ্পার বাসিন্দাদের এক অংশ নানা এলাকায় নিজেদের বসতি গড়ে তুলতে উদ্যোগী হয়েছিল। সেই উদ্যোগ সামগ্রিক ভাবে হরপ্পা সভ্যতার পক্ষে মঙ্গলজনক পদক্ষেপ ছিল সন্দেহ নেই। তবে ২২০০ থেকে কম বৃষ্টির দরুণ ঘটা অর্থনৈতিক অবনতি এগুলোকে হয়ত যথেষ্ট সম্পদশালী হবার সুযোগ দেয়নি। পরবর্তী কালে হরপ্পার অবনতির শুরুতে `এফ` এলাকার ধণাঢ্যরা সদ্য গড়া নতুন বসতিগুলোর উন্নতিতে উদ্যোগী হয়ে চলে গেল?
গ্রামাঞ্চলে অর্থনৈতিক অবনতির সাথে তাল মিলিয়ে হরপ্পায় (২৪০০ থেকে ২০০০ অবধি) ঘটেছিল খুব বেশি হারে জনসংখ্যা বৃদ্ধি। এই বৃদ্ধি বলে গ্রামাঞ্চল থেকে বিপুল সংখ্যায় লোক শহরে এসেছিল। এই বাড়তি লোকের জন্য শহরে যথেষ্ট নাগরিক সুবিধা তৈরি ছিল না। অর্থনৈতিক অবনতির কালে শহর আকারে বাড়ানোও অসম্ভব ছিল। ফলে শহরে জনঘনত্ব বৃদ্ধির সাথে তাল মিলিয়ে নাগরিক সুবিধা কমতে থাকে। নাগরিক সুবিধাহীন জনঘনত্ব বৃদ্ধির দরুন সামাজিক অশান্তির সাথে সাথে সংক্রামক রোগের প্রকোপও দ্রুত বাড়তে বাধ্য।
সিমেট্রি-`এইচ` গড়ে ওঠে ১৯০০ পূর্বাব্দে। সেখানে দেখা যায় ভিন্ন সংস্কৃতি লক্ষণ। শুধু মাটির বাসনে নয়, কবর দেবার পদ্ধতিতেও ছিল ভিন্নতা। তবে সব চেয়ে উল্লেখযোগ্য একেবারে ভিন্ন কবরখানা গড়ে ওঠা। এর থেকে অনুমান করা যেতে পারে হরপ্পার স্থায়ী বাসিন্দারা যখন শহর ত্যাগ করতে শুরু করে অথচ সকলে শহর ত্যাগ করেনি, তখনই আরেকদল লোক শহরে থাকতে শুরু করে। স্পষ্টতই এরা স্থায়ী হরপ্পাবাসিদের থেকে ভিন্ন জনগোষ্ঠী। কতটা ভিন্ন? জন লুকাসের ও পরে কেনয়ের ও সহযোগীদের করা দাঁতের আইসোটোপ পরীক্ষার ফল বলছে খুব কিছু ভিন্ন নয়। দাঁতের তথ্য বলে এদের বেশির ভাগ এসেছিল একেবারেই বাল্যকালে, এবং তাদের বাল্যাবস্থা কেটেছে অপুষ্টিতে ভুগে। রফিক মুঘলের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী সিমেট্রি-`এইচ১` (নীচের স্তর) সংস্কৃতির সাথে প্রচুর মিল আছে চোলিস্তানের সংস্কৃতির। ফলে সব সহ ভাবতে পারি শুকিয়ে যাওয়া হাকরা নদী উপত্যকার আর বদলে যাওয়া সুতলেজ নদীর তীরবর্তী বসতিগুলোর লোকেরাই সম্ভবত ভীড় করেছিল হরপ্পায়।
দৃশ্যপট হয়ত এরকম ছিল, যে হরপ্পা শহরে প্রচুর লোক প্রবেশ করছে, যারা শহরে বসবাসে অভিজ্ঞ নয়, যাদের শহরে বাসস্থান নেই এবং তারা সম্পদহীন। তারই সাথে অনুমেয় তাদের অনেকেই ছিল ভাগ্যান্বেষী পুরুষ মাত্র। কঙ্কালের অনেকগুলোই ছিল গ্রাম থেকে আসা পুরুষ কিন্তু নারীরা ছিল হরপ্পারই বাসিন্দা। স্বভাবতই প্রথমেই আসা এই পুরুষেরা শহরে কাজ পাবার পর ঘর সংসার করার জন্য নগরবাসী মহিলাদেরই বেছে নেবে। তাতে বাসস্থানেরও সুরাহা হবে।
জনসংখ্যা বৃদ্ধি শহরে সংক্রামক রোগের প্রকোপ বাড়াবে। কুষ্ঠ যক্ষ্মা রোগে আক্রান্ত লোক হরপ্পাতে আগেও ছিল। কিন্তু সেই হার বহুগুণে বেশি পাওয়া গেল সিমেট্রি-`এইচ` এর কঙ্কালে। ফলে অনুমান করতে পারি এদের মধ্যে আগে থেকেই এই রোগের প্রকোপ ছিল। যদি এরা চোলিস্তান থেকে এসে থাকে সেখানে কি কুষ্ঠ রোগী পাওয়া গেছে? না। তেমন কোন পরীক্ষাই হয় নি। কাজেই হ্যাঁ বা না বলা সম্ভব না। কিন্তু বালাথালের কঙ্কালে কুষ্ঠ পাওয়াতে বলা যায় এই রোগ হরপ্পাতেই সীমাবদ্ধ ছিল না। রাজস্থানের দিকে তো ছিলই। এবং বালাথাল ছিল হরপ্পার থেকে ভিন্ন সংস্কৃতির। কাজেই ধরতে পারি রোগটি কোন সংস্কৃতি বা জনগোষ্ঠীর সীমাতেও গণ্ডিবদ্ধ ছিল না।
কবরখানা-`আর৩৭` ছিল স্থায়ী হরপ্পাবাসীদেরই কবরখানা এতে দেখতে পাই হরপ্পা শহরে শুধু নবাগতদের মধ্যে নয় স্থায়ী বাসিন্দাদের মধ্যেও পারিবারিক ও সামাজিক হিংসার অস্তিত্ব ছিল। স্থায়ী বাসিন্দাদের মধ্যে বাড়ির মহিলাদের উপর শারীরিক অত্যাচার যথেষ্টই ছিল। অথচ একই সাথে বিকলাঙ্গদের প্রতি সামাজিক-পারিবারিক সহযোগিতার প্রমাণও দেখতে পাই।এর থেকে যেটা অনুমান করা যায় প্রকৃতিতে হরপ্পাবাসীদের মধ্যে মানবিকতা বোধ যথেষ্ট থাকা সত্যেও পারিবারিক হিংসার বৃদ্ধির কারণ ঘটেছিল কোন বিশেষ কারণে। সেটা হতে পারে সামগ্রিক আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতির অবনতির কারণেই।
এই সময়কার হরপ্পার আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতির দিকে দেখলে প্রথমেই চোখ পড়বে আর্থ-শ্রেণীভেদের বাহুল্য। কবরখানা-`জি` যেটি শহরের ময়লা জল যাবার পাশে গড়ে ওঠা কবরখানা, তার অবস্থানই বলে, এটি ছিল শহরের অনাকাঙ্ক্ষিত প্রান্তিক দরিদ্র শ্রেণীর কবর। এখানকার সামান্য কয়েকটি যথাযথ কবরের দানসামগ্রীই বলে দেয় এরা অত্যন্ত দরিদ্র ছিল। তার সাথে শুধুমাত্র এখানকারই শিশুদের অস্থিতে ভিটামিন-সি এর অভাব বলে এরা যথাযথ খাবারও পেত না। তাছাড়া কবরখানা-`জি` তে হিংসার বলি ৫০ শতাংশ। এই অস্বাভাবিক পরিসংখ্যান বলে একটি অস্বাভাবিক পরিস্থিতির কথা। এখানে কুষ্ঠ যক্ষ্মা রোগীর হারও যথেষ্ট বেশী।
প্রাথমিক ভাবে মনে হতে পারে এরা সবাই কুষ্ঠরোগী ছিল, তাই এদের শহরে বসবাস করতে দেওয়া হয় নি, এবং এদের উপর অত্যাচারের নির্মমতা ছিল মাত্রা ছাড়া। কিন্তু `আর-৩৭` ও সিমেট্রি-`এইচ`-এ অন্য সবার পাশাপাশি কুষ্ঠরোগীর ও কবর ছিল, এবং সেই কবরগুলোতে দান সামগ্রীতেও কোন ফারাক ছিল না। তাই আমরা ধরে নিতে পারি কুষ্ঠ যক্ষ্মা রোগীর বেলা তেমন কোন উল্লেখযোগ্য বৈষম্যমূলক আচরণ প্রচলিত ছিল না। তা হলে কবরখানা-`জি` তে এই অবস্থা কেন? তার ব্যাখ্যা দিতে গেলে একটিই কথা ভাবা যায়, তা হল আর্থিক বৈষম্য। যেহেতু কবরখানা-`জি` এর ব্যবহার কাল ২০০০ থেকে ১৯০০ অনুমান করা হয়েছে, তাই ভাবা যেতে পারে এই স্থায়ী বাসিন্দাদের শহর ত্যাগ ও অন্য একদল লোকের শহরের বসবাসের সময়ে,গড়ে ওঠা সামাজিক অশান্ত পরিবেশের সুযোগে শহরে আর্থিক বৈষম্য জনিত সামাজিক বিভেদও চরম পর্যায়ে চলে গিয়েছিল। এবং এই চরম বৈষম্যমূলক সমাজ নিয়ে শহরের টিকে থাকার ক্ষমতায় সন্দেহ জাগাবে।
সালতামামি
হরপ্পা সভ্যতা নিয়ে আমাদের মনে যে উজ্জ্বল ছবি আঁকা হয়ে আছে, উপরের লেখা পড়লে তা মলিন হবে অনেকটাই। মনে হবে এক অরাজক শহরের বাসিন্দারা অভ্যস্ত স্বাচ্ছন্দ্য ও নিরাপত্তার অভাবে শহর ছেড়ে পালাতে চাইছে। নাগরিক জীবনে অনভ্যস্ত, দরিদ্র, অপটু লোকে শহর ছেয়ে গেছে। তারা কোন নিয়ম কানুনের তোয়াক্কা না করে যেখানে সেখানে ঘর বানিয়ে থাকছে। মানা করার কেউ নেই। শাসন করার কেউ নেই। রোজগার পাতি দিন দিন কমে যাচ্ছে। শহরের বাজারে খাবারের জোগান কম। দিকে দিকে রোগাক্রান্ত লোক বাড়ছে। মাঝে মাঝেই তুচ্ছ কারণে মারামারি, প্রাণহানি। ঘরে ফিরে হতাশাগ্রস্ত পুরুষরা ক্ষোভ উগ্রে দিচ্ছে ঘরের মহিলাটির উপর।
এক হতাশাজনক পরিস্থিতি। খারাপ লাগলেও এটাই হয়ত সত্যি। পতনোন্মুখ শহরের চেহারা এমনই হবার কথা।
তথ্যসূচীঃ-
1. Gwen Robbins Schug, K. Eline Blevins, Brett Cox, Klesey Gray, V. MushrifTripathi, : “Infection, Disease, and Biosocial Processes at the End of Indus Civilization” Published in PLOS one (17.12.2013)
2. Gwen Robbins Schug, Kelsey Gray, V. Mushrif-Tripathy, A.R. Sankhyan. “A Peaceful realm? Trauma and social differentiation in Harappa” international Journal of Paleopathology, in 2012
3. Gwen Robbins Schug: “If you were a child in the Ancient Indus Valley, what would be an average day like for you?” Published in Harappa.com
4. Nancy C Lovell: “Skeletal Paleopathology Of Human Remains From Cemetery R37 at Harappa, excavated in 1987 and 1988” Publisher_ University of AlbertaEducation and Research Archive (ERA) Published in 2014 at Edmonton Canada.
5. Nancy C Lovell: “Spinal Arthritis and Physical stress at Bronze age Harappa” American Journal of Physical Anthropology, Feb. 1994
6. Brian E. Hemphill, John R. Luckas, K.A.R Kennedy: “Biological Adaptations and Affinities of Bronze age Harappans”. In Book “Harappa Excavations 1986-1990” Edited by Richard H Meadow. Published: Monographs of World Archaeology. Prehistory Press, Madison Wisconsin. In 1991.
7. Vasant Shinde, Sweta Deshpande Sinha: “Development of Urbanization in the Mewar Region of Rajasthan India in the Middle of Third Millennium BC” published by Ancient Asia Journal
8. Dr. M Rafique Mughal: “The decline of the Indus Civilization and the late Harappan period in Indus Valley” Lahore Museum Bulletin, July-Dec 1990
9. REM Wheeler:”TheDefences and Cemetery-R37” Ancient India Vol.3. 1946.
10. UNESCO: “Archaeological site of Harappa”
11. “Harappa Civilization” 2nd Harappa International Conference: at Lahore & Sahiwal. 0n 18-20. 12 2016
12. Md. Bin Naveed “A Overview of Harappan Architecture and Town planning” published in World History Encyclopedia, on 13.12.2014
13. Salman Rashid (Fellow of Royal Geographical society): “Treasure Forsaken” March 2014
14. Kaiser Toufil: “A Walk around the ancient mound” Dec.1, 2013
15. The News Multan. (APP): Excavation of Buddhist site:Dillu Roy Unveils Ancient Town Planning. Published in 16 August 2020.
অনেক কিছু জানলাম, যা আগে কিছুই জানতাম না। ইতিহাস তার গতিপথ তৈরি করে নিয়েছে। আশা ভবিষ্যতে আরও অনেক কিছু জানা যাবে! আপনার শ্রমশীল অধ্যয়ন এবং এই লেখা তৈরি করার জন্য অনেক অনেক ধন্যবাদ, অভিনন্দন প্রাপ্য। শুভ কামনা রইলো।
কত অজানাকে জানা।হরপ্পা ময়েনজদাড়ো এর ইতিহাস সেই স্কুল জীবন থেকে পড়ছি।তার সমৃদ্ধ ছিল।কিন্তু অন্তরালের ইতিহাস পড়ে মন খারাপ হয়ে গেল।হিংসা,বিভেদ মানুষ অনন্তকাল থেকে বহন করে আসছে।অনেক ধন্যবাদ এই শ্রমসাধ্য লেখাটির জন্য।
ধন্যবাদ মালিহা খাতুন। হিংসা দ্বেষ আর বিভাজন এর থেকে আমাদের রেহাই নেই । এসব নিয়েই চলতে হবে।
অনেক ধন্যবাদ আপনাকে শিবানন্দবাবু।
খুব সুন্দর
ধন্যবাদ প্রিয়া সাহা।
অসাধারণ তথ্যবহুল লেখা, যার অনেক কিছুই আগে জানা ছিলো না। অনুমান করি লেখার পেছনে দীর্ঘ সময়, শ্রম ও মেধার গভীর সমন্বয় ছিলো।
অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।
ধন্যবাদ শাহজাহান। তা খানিক খাটুনি তো করতেই হয়েছে। আপনারা পড়েছেন , সেই পরিশ্রম সার্থক হয়েছে
অত্যন্ত সুন্দর তথ্যসমৃদ্ধ ও পরিশ্রমী লেখা। নতুন গবেষণার কথাও যেমন জানা গেল তেমনি পুরনো বা আগের গবেষণার সংক্ষিপ্তসার। হরপ্পা বিষয়ে লেখকের আগ্রহ বা বলা উচিত প্যাসন পরিষ্কার ফুটে উঠেছে লেখাতে। বাংলায় হরপ্পা বিষয়ে এতো বিস্তারিত লেখা আর পড়িনি। সংগ্রহে রাখার মতো একটি প্রবন্ধ।
কৃশানু অনেক ধন্যবাদ
দাৰুণ লেখা ।গবেষণাধৰ্মী । পুস্তক আকাৰে প্ৰকাশ কৰা উচিত ।
ধন্যবাদ রতন পাল
অনেক লেখার সারাৎসার এবং আপনার বুদ্ধিদীপ্ত সংযোজন। নতুন গবেষণার দিকনির্দেশন রচনা। অসামান্য সংগ্রহযোগ্য লেখা।
শশাঙ্ক শেখর ঘোষ , অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।
অনেক অজানা তথ্য পেলাম আপনার অসাধারণ লেখার মধ্যে। অনেক অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।
অনেক ধন্যবাদ আনোয়ার হোসেন
কত কি জানলাম।
সেই ছোটবেলা থেকে এই সভ্যতা আমাকে আকৃষ্ট করেছে।কারণ জানি না।
ইতিহাস বইয়ের সেই সাদা কালো অস্পষ্ট ছবিগুলো আমার মনকে কোথায় যেন নিয়ে যেত।
আজ সেই সভ্যতা সম্পর্কে এত কিছু নতুন তথ্য জানলাম তুষারদা আপনার দৌলতে।
জানি এর জন্য আপনাকে কত পড়াশুনো করতে হয়েছে ও খাটতে হয়েছে।
ধন্যবাদ না জানিয়ে আমার অকুন্ঠ ভালোবাসা ও ভালোলাগা জানাই।
ভালো থাকুন,সুস্থ থাকুন।
আর আমাদের জন্য এমন সব লেখা লিখে যান।
মল্লিকবাবু আপনাদের থেকে পাওয়া উৎসাহ আর ভালোবাসাই আমার পাথেয় হয়ে থাক
Apnar lekha pore sob somoy onake kichu jante pari. Khub bhalo laaglo. Aro likhun. Opekkhai roilam.
অনেক ধন্যবাদ আপনাকে, রজত বাবু ।
১. হরপ্পা সভ্যতা খৃষ্টপূর্ব ৬০০০ থেকে খৃষ্টপূর্ব ১৩০০। এই দীর্ঘ সময় একটা সভ্যতার অস্তিত্ব থাকতে পারে কি? পন্ডিতগন বলেন হরপ্পা সভ্যতার মোট সময়কাল খ্রীস্টপূর্ব ২৮০০ থেকে খৃষ্টপূর্ব ১৮০০. আর্যরা(খৃষ্টপূর্ব ১৮০০-খৃষ্টপূর্ব ১৫০০) এসে হরপ্পা সভ্যতা ধ্বংস করে।
এই তথ্যগুলো কতটুকু সঠিক?
২ কলিকাতার কোন মিউজিয়ামে হরপ্পা সভ্যতার মানুষগুলোকে সংগ্রহ করা হয়েছে? দেখার ইচ্ছা। ধন্যবাদ।
রহমান বাবু , হরপ্পা সভ্যতা সাধারণ পূর্বাব্দ ছয় হাজার থেকে নয়, সেই সময়টা মেহেরগড়ের সময়। তখন থেকে প্রকৃতপক্ষে খাদ্য শষ্যের উৎপাদন শুরু। সেটাকে হরপ্পা সভ্যাতা বলা যাবে না। মেহেরগড়ের মানব বসতিটি যা বোঝায় তা হল তখন থেকে হরপ্পা সভ্যতা অবধি একটা ধারাবাহিকতা বজায় ছিল। ধীরে ধীরে সেই নব্যপ্রস্তর যুগের মেহেরগড় থেকে ব্রোঞ্জ যুগের হরপ্পা সভ্যতায় পা ফেলা ।
হরপ্পা শহরেই মানব বসবাস শুরু আনুমানিক ৫হাজার বৎসর আগে শুরু হলেও উন্নত পর্যায়ের বসবাস শুরু ৩৫০০ সাধারন পূর্বাব্দ নাগাদ। তারপরে আপনি যেমন বললেন প্রকৃত হরপ্পা সভ্যতা শুরু হয়ে ২৮০০ সাধারন পূর্বাব্দ থেকে। মানব বসতির তো নানা পর্যায় আছে।
মেহেরগড়ের প্রথম দিকের লোকেরা ছিল মুলত শিকারি-সংগ্রাহক থেকে পরবর্তী ধাপে ওঠার পর্যায়ে। লুকাসের মতে ঐ প্রথম দিককার লোকেরা সম্ভবত হরপ্পা শহরেই আর ছিলো না। ৪৫০০ সাধারণ পূর্বাব্দে (সাড়ে ছয় হাজার বৎসর আগে) মেহেরগড়ে একদজল নতুন লোকেরা বসবাস করতে শুরু করে। এই পরের লোকেদের সাথে ছিল সাথে হরপ্পা বাসীদের মিল। যারা পরিণত হরপ্পা সভ্যতার আমলে হরপ্পা শহরে বসবাস করত।
হরপ্পা মহেঞ্জোদারোর কঙ্কালগুলো কলকাতা আন্থ্রোপলজিকাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার তত্ত্বাবধানে তাদের সংগ্রহালয়য়ে আছে। আমি নিজে সেখানে যাইনি। কাজেই বলতে পারবো না সেটা সর্বসাধারনের দেখা জন্য কি না। সম্ভাবনা হয়ত কমই হবে। তবে একজন আমাকে বলেছিলেন কঙ্কালগুলোর কিছু কলকাতার ন্যাশানাল মিউজিয়ামে প্রদর্শন করে। আমি কয়েকবার সেখানে গেছি, কখনো দেখি নি।
সব পাঠকদের জন্য
হরপ্পা শহরের একজন রাজার নাম জানতে পরেছি। রাজা হর পাল। তবে কবেকার রাজা বা তার বংশ কিছুই জানতে পারিনি
এই তথ্য পেয়েছি নয়নজ্যোত লাহিড়ীর একটি প্রবন্ধে।
তবে প্রসঙ্গত মনে পড়ছে আফগানিস্তানের হিন্দু শাহী রাজবংশের রাজার নাম জয় পাল ।