অবলাবান্ধব দ্বারকানাথ
সময়টা উনিশ শতকের তৃতীয় পাদ। অধুনা বাংলাদেশের ঢাকা-বিক্রমপুর অঞ্চল যখন স্ত্রী শিক্ষা ও বিধবাবিবাহের প্রসার এবং বাল্যবিবাহ, বহুবিবাহ ও কুলীনপ্রথা বিলুপ্তির লক্ষ্যে তোলপাড় করে তুলছিলেন দুর্গামোহন দাস, তখন অন্য যে কয়েকজন সমমনা সমাজ সংস্কারক নিঃশর্তভাবে তাঁর এই আদর্শবাদী ও সাহসী কাজের সর্বক্ষণের সহযোদ্ধা ছিলেন, তাঁদের একজন হলেন দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায়।
১৮৪৪ সালের ২০ এপ্রিল (বাংলা ৯ই বৈশাখ, ১২৫১) পূর্ববঙ্গের বিক্রমপুর জেলার অন্তর্গত মাগুরখণ্ড গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন দ্বারকানাথ। বাবা কৃষ্ণপ্রাণ গঙ্গোপাধ্যায় সুপ্রসিদ্ধ বেঘের কুলীন ব্রাহ্মণ। মা উদয়তারা দেবী ত্রিপুরা রাজ্যের একজন প্রখ্যাত জমিদার কন্যা। কৃষ্ণপ্রাণ জীবিকা নির্বাহের জন্য ফরিদপুরে বসবাস করতেন। শৈশবে গ্রামের পাঠশালায় গুরুমশাইয়ের অধীনে শিক্ষাপর্ব সমাপ্ত হওয়ার পর দ্বারকানাথকে ইংরেজি শেখানোর বাসনায় ফরিদপুরে স্কুলে ভর্তি করা হল। কিন্তু সেখানে তাঁর স্বাস্থ্য ভেঙে পড়ায় বাধ্য হয়ে আবার তাঁকে মাগুরখণ্ডে ফিরিয়ে এনে পার্শ্ববর্তী কালীপাড়া গ্রামের এনট্রান্স স্কুলে ভর্তি করে দেওয়া হয়।
এই কালীপাড়া স্কুলেই দ্বারকানাথের গৌরবময় ভবিষ্যৎ জীবনের গোড়াপত্তন হল। কাহিনিটা বলা যাক তাহলে। এই স্কুলে প্রখ্যাত মনীষী অক্ষয়কুমার দত্তের ‘বাহ্য বস্তুর সহিত মানবপ্রকৃতির সম্বন্ধবিচার’ এবং ‘ধর্ম্মনীতি’ পুস্তকদুটি পড়ানো হত। নিজের স্ত্রীর সাথে বৌদ্ধিক বনিবনা না হওয়ায় তা নিয়ে অক্ষয়কুমার দত্তের সারাজীবন আক্ষেপ ছিল। তাই হয়তো ১৮৫১ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত অক্ষয়কুমারের ‘বাহ্য বস্তুর সহিত মানবপ্রকৃতির সম্বন্ধবিচার’ গ্রন্থের প্রথম খণ্ডে তিনি দম্পতির সম্পর্ক নিয়ে সবিস্তারে আলোচনা করেছিলেন। “পরস্পর বিরুদ্ধ-স্বভাব, অসম-বুদ্ধি ও বিপরীত-মতাবলম্বী স্ত্রী-পুরুষের পাণিগ্রহণ হইলে উভয়কেই যাবজ্জীবন বিষম যন্ত্রণা ভোগ করিতে হয়। মানসিক ভাব ও বুদ্ধি চালনা বিষয়ে কিঞ্চিৎ বৈলক্ষণ থাকাতে কত কত দম্পতি মহা অসুখে কাল যাপন করিয়া থাকেন; তাঁহারা আপনারাই আপনাদের অপ্রণয়ের কারণ বুঝিতে পারেন না।”১ তাঁর মতে বিবাহের আগে সাবালক ও সাবালিকার উচিত পরস্পরের সঙ্গে ভালোমত আলাপ পরিচয় করে নেওয়া। ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক রুচির মিল না থাকলে দাম্পত্যজীবন সুখের হয় না। “ফলতঃ বিদ্যাবান, উদার-স্বভাব, মহাশয় পুরুষের সহিত কোন বিদ্যাহীনা, কলহ-প্রিয়া, ক্ষুদ্রাশয়া রমণীর পাণিগ্রহণ হওয়া অশেষ ক্লেশের বিষয়।”২ এবং সেক্ষেত্রে বিবাহবিচ্ছেদ নেওয়া কর্তব্য। এরপর অক্ষয়কুমার সওয়াল করেন, “এই সকল কারণে স্ত্রীলোকের বিদ্যাশিক্ষা যে কি পর্যন্ত আবশ্যক, তাহা বলা যায় না; তৎপক্ষে যে শত শত যুক্তি আছে, তম্মধ্যে ইহাকেও এক অখণ্ডনীয় যুক্তি বলিয়া স্বীকার করিতে হইবে।”৩ আজ থেকে ১৭০ বছর আগে অক্ষয়কুমারের এ জাতীয় চিন্তাধারা যে কতটা বৈপ্লবিক ছিল তা নিয়ে বোধহয় আলোচনার প্রয়োজন নেই। সমকালীন বিদ্যাসাগর এবং আরও দশ বছর পরে জন্ম নেওয়া রবীন্দ্রনাথ সম্ভবত সারা জীবন ধরে তা অনুভব করে গিয়েছিলেন। শুধু তাই নয়, উভয় পুস্তকেই অল্পবয়স্ক, বৃদ্ধ, বিকলাঙ্গ ব্যক্তিদের বিবাহের বিরোধিতা করবার পাশাপাশি অক্ষয়কুমার অসবর্ণ বিবাহের বৈধতারও অবতারণা করেছিলেন।
অক্ষয়কুমারের চিন্তাধারায় উদ্বুদ্ধ হয়ে তরুণ যুবকরা বঙ্গদেশের নানা স্থানে একাধিক প্রগতিশীল আন্দোলনের সূচনা করেন। মহেন্দ্রনাথ রায় অক্ষয়কুমারের জীবনচরিতে এই ধরণের একটি আন্দোলনের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দিয়েছেন। “ঢাকা জেলার অন্তর্গত বিক্রমপুর পরগণার মধ্যে কালীপাড়ার স্কুলে ধর্ম্মনীতি ও বাহ্যবস্তুর সহিত মানব-প্রকৃতির সম্বন্ধ-বিচার পুস্তকের অধ্যয়ন অধ্যাপনা প্রচলিত হওয়াতে, কতকগুলি ছাত্র একটি সভা স্থাপন করে এবং প্রতিজ্ঞা-পত্রে এই বলিয়া স্বাক্ষর করে যে, ‘আমরা এই পুস্তকে লিখিত সকল নিয়ম অবলম্বন করিব।’ তাহাতে প্রাচীন পক্ষীয়রা এত রুষ্ট হইয়াছিলেন যে, স্কুল-গৃহ দগ্ধ করিতে উদ্যত হন। কিন্তু ঐ প্রতিজ্ঞা-বদ্ধ ছাত্রেরা কিছুতেই পরাঙ্মুখ হয় নাই। অনেকে গৃহ পরিত্যাগ করিয়া যাবজ্জীবন ঐ নিয়ম অবলম্বনপূর্ব্বক চলিতেছেন।”৪
দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায় ওই সময় ওই স্কুলেরই ছাত্র ছিলেন। ছাত্রদের আন্দোলনের ঢেউ তাঁকেও ছুঁয়ে গিয়েছিল। দ্বারকানাথের কুলীন পরিবারের প্রত্যেকে পুরুষানুক্রমে চল্লিশ-পঞ্চাশটি করে বিবাহ করতেন। অক্ষয়কুমারের জীবনীকার মহেন্দ্রনাথ দত্ত লিখেছেন, “কিন্তু বাহ্যবস্তুর সহিত মানব-প্রকৃতির সম্বন্ধ-বিচার ও ধর্ম্মনীতি অধ্যয়ন করিয়া তাঁহার মনে এটি ঘোরতর দুষ্কর্ম বলিয়া অবধারণ হইল। তিনি প্রতিজ্ঞা করিলেন, আমি এক বই দুই বিবাহ করিব না।”৫ অক্ষয়কুমারের রচনা বাল্যকালে তাঁকে কিভাবে প্রগতিশীল চিন্তাধারার অধিকারী করে তুলেছিল তা বর্ণনা করতে গিয়ে দ্বারকানাথ নববার্ষিকী গ্রন্থে লিখেছিলেন, “ইনিই প্রকাশ্যরূপে বহুবিবাহ ও বাল্যবিবাহের অবৈধতা, বিধবাবিবাহ ও অসবর্ণ বিবাহের আবশ্যকতা দেশীয় লোকদিগকে প্রদর্শন করিয়াছেন। … বঙ্গীয় যুবকমন্ডলীর ভাব ও চিন্তার গতি ইনি যে পরিমাণে পরিচালিত করিয়াছেন, এ পর্য্যন্ত আর কোনো ব্যক্তি সেরূপ পারিয়াছেন কিনা সন্দেহস্থল।”৬
দ্বারকানাথ কিন্তু কালীপাড়া স্কুল থেকে প্রবেশিকা পরীক্ষায় কৃতকার্য হতে পারেন নি। বাধ্য হয়ে কাজকর্মের চিন্তায় তাঁকে বিব্রত হতে হল। পরপর তিন স্থানে তিনি শিক্ষকতার কাজে ব্রতী হলেন। প্রথমে বিক্রমপুরের সোনারঙ, তারপরে ফরিদপুরের ওলপুর এবং সবশেষে ফরিদপুরেরই লোনসিং গ্রামের মাইনর স্কুলে। এই লোনসিং গ্রামেই দ্বারকানাথের জীবনে আরও একটি পরিবর্তন ঘটল। সে কাহিনি আমাদের শুনিয়েছেন শিবনাথ শাস্ত্রী, তাঁর প্রখ্যাত ‘রামতনু লাহিড়ী ও তৎকালীন বঙ্গসমাজ’ গ্রন্থে। “তাঁহার বয়ঃক্রম যখন ১৭ বৎসর তখন একদিন শুনিলেন যে এক হতভাগিনী বিপথগামিনী কুলীন কন্যাকে তাঁর আত্মীয়স্বজন বিষ প্রয়োগ দ্বারা হত্যা করিয়াছে। এই দারুণ সংবাদ তাঁহার পরদুঃখকাতর প্রাণে শেলসম বাজিল। তিনি অনুসন্ধান করিয়া জানিলেন কুলীন কন্যাদিগকে এরূপে হত্যা করা বিরল ঘটনা নহে। তখন তাঁহার অন্তরাত্মা ক্রোধে দুঃখে অধীর হইয়া গেল ! তিনি মনে মনে প্রতিজ্ঞা করিলেন যে, কুলীন শ্রেষ্ঠ হইলেও তিনি বহুবিবাহ রূপ গর্হিত কার্য্যে কখনও লিপ্ত হইবেন না।”৭ সম্ভবত কিশোরবেলায় অক্ষয়কুমারের দ্বারা উদ্বুদ্ধ দ্বারকানাথ এই কারণেও পারিবারিক কুপ্রথার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে পরবর্তীকালে কলকাতায় এসে বসবাস শুরু করেন।
সবচেয়ে বিস্ময়ের কথা হল, যে দ্বারকানাথ নিজে প্রবেশিকা পরীক্ষায় পাশ করতে পারেননি, তিনিই পরবর্তীকালে বাংলার নারী-শিক্ষার জন্যে বিশেষ করে তাদের উচ্চশিক্ষার জন্য এবং শিক্ষাঙ্গনে নারী-পুরুষের সমানাধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের অন্যতম মুখ্য কারিগর হয়ে উঠলেন।
ওই কুলীন কন্যার হত্যাসংবাদ শ্রবণে দ্বারকানাথ স্রেফ বহুবিবাহ প্রথার প্রতি বিদ্বিষ্ট হয়ে ওঠেন তা-ই নয়, উনিশ শতকের অসহায় নারীদের দুঃখে তিনি সত্যিকারের ব্যথিত হন। সেই ভাব থেকেই ১৮৬৯ খ্রিস্টাব্দে তিনি ‘অবলাবান্ধব’ নামে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশ করেন। কি পরিস্থিতিতে অবলাবান্ধবের উদ্ভব হয়, দ্বারকানাথ পরবর্তীকালে ১৮৯৮ সালের ২রা জুলাই ‘সঞ্জীবনী’ পত্রিকায় তা ব্যক্ত করে গিয়েছেন, “… ভাবিলাম, যদি বিন্দু পরিমাণেও ইহাদিগের এই দুঃখ দুর্গতি দূর করিতে পারি, জীবন সার্থক হইবে। এই অভিপ্রায়েই অবলাবান্ধবের জন্ম হয়।”৮ কাগজখানি ঢাকা থেকে প্রকাশিত হতে লাগলো। এই কাজে তাঁর সহায় হলে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট এবং ঢাকা ব্রাহ্মসমাজের অগ্রগণ্য নেতা অভয়কুমার দাসের পুত্র প্রাণকুমার দাস। এই পত্রিকার মাধ্যমে তিনি সমাজের কুপ্রথাগুলির বিরূদ্ধে একপ্রকার যুদ্ধঘোষণা করলেন। শিবনাথ শাস্ত্রী লিখেছেন, “আমরা ‘অবলাবান্ধব’ পড়িয়া অবাক হইতে লাগিলাম। কোন দূরবর্ত্তী গ্রাম হইতে এ কোন ব্যক্তি নারীজাতির শিক্ষা ও উন্নতি সম্পর্কে এরূপ উদার মত ব্যক্ত করিতেছেন।”৯
১৮৭০ সালের প্রথমদিকে দ্বারকানাথ ‘অবলাবান্ধব’ নিয়ে কলকাতায় এলেন। কলকাতায় এসে প্রথমদিকে দ্বারকানাথ যথেষ্ট অসুবিধার মধ্যে পড়ে যান। ঢাকার বন্ধুদের সাহায্য তিনি হারালেন, কলকাতাতেও প্রথমদিকে সেরূপ সাহায্য পেলেন না। এই সময়ে পত্রিকার সমুদয় কাজ তাঁকে একা হাতে করতে হত। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই তাঁকে বেষ্টন করে ব্রাহ্মসমাজের মধ্যে একটি দল গড়ে উঠল। ক্রমেই নব নব লেখককূলের সহায়তায় ‘অবলাবান্ধবে’র শক্তি প্রবলতর হয়ে পড়ে। শোনা যায়, এই পত্রিকার খ্যাতিই উত্তরকালে তাঁকে ‘অবলাবান্ধব দ্বারকানাথ’ নামে সুপরিচিত করেছিল।
ইতিমধ্যে শিবনাথ শাস্ত্রীর প্রচেষ্টায় ব্রাহ্ম-মেসে বাস করে এবং ব্রাহ্ম-সংসর্গ করে দ্বারকানাথ ক্রমেই ব্রাহ্মধর্মের অনুরাগী হয়ে পড়েন। এই বছরেই বরিশাল থেকে প্রখ্যাত সমাজ-সংস্কারক দুর্গামোহন দাসের হাইকোর্টে ওকালতি করতে কলকাতায় আগমন যেন মণিকাঞ্চন যোগ হল। ইতিমধ্যে কলকাতার মাটিতে দ্বারকানাথের পায়ের নিচের জমি শক্ত হয়েছে, তাঁর পাশে ভবিষ্যতের ডেপুটি কন্ট্রোলার জেনারেল রজনীনাথ রায় প্রভৃতি প্রভাবশালী যুবক আছেন। শিবনাথ শাস্ত্রীর ভাষায়, “ইহারা দুর্গামোহন দাসকে পাইয়া, খোঁটার জোরে মেড়ার ন্যায়, বলশালী হইয়া স্ত্রীশিক্ষা ও স্ত্রীস্বাধীনতার জন্য বদ্ধ-পরিকর হইলেন এবং ব্রাহ্মসমাজের মধ্যেই প্রবল আন্দোলন উপস্থিত করিলেন।”১০ ১৮৭১ সালে ব্রাহ্ম বালিকাদের বিবাহোপযোগী বয়স নির্ধারণ করবার জন্য প্রবল জনমত গড়ে তুললেন তাঁরা। এইসব নিয়ে ব্রাহ্মনেতা কেশবচন্দ্র সেনের সঙ্গে নবীন প্রগতিশীল ব্রাহ্মদের একটি সংঘর্ষের সূত্রপাত হল। দ্বারকানাথ সম্বন্ধে জানতে গেলে এই বিষয়টা একটু বিস্তারিত আলোচনা করতে হবে।
ব্রাহ্মসমাজের উপাসনাস্থান ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্মমন্দিরে কেন মহিলাদের জন্য পর্দার বাইরে বসবার স্থান থাকবে না, তা নিয়ে দুর্গামোহন ও দ্বারকানাথের নেতৃত্বে প্রবল আন্দোলন শুরু হয়। তুলনায় পুরোনোপন্থী এবং অন্যান্য প্রাচীন ব্রাহ্মরা এতে রাজি ছিলেন না। এই বিতর্ক চলাকালীন একদিন উপাসনা চলাকালীন দুর্গামোহন দাস এবং ডাক্তার অন্নদাচরণ খাস্তগীর সপরিবারে (স্বীয় পত্নী ও কন্যাগণ সহ) এসে পুরুষ উপাসকগণের মধ্যে আসনগ্রহণ করলেন। কেশব সেন ও অন্যান্য প্রাচীন সভ্যগণ এতে তীব্র আপত্তি জানালে প্রগতিশীলরা ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্মমন্দিরে আসা বন্ধ করে স্বতন্ত্র ব্রাহ্মসমাজ স্থাপন করেন। কিছুদিন পরে কেশব সেন পরাজয় স্বীকার করলে আবার দুই দলে মিলন হয়। কিন্তু স্ত্রীশিক্ষা ও স্ত্রীজাতির সামাজিক স্বাধীনতা বিষয়ে উভয়পক্ষের মতাদর্শে যে পার্থক্য ঘটেছিল তা তিরোহিত হল না। ১৮৭২ সালে কেশব সেন ভারত আশ্রম ভবনে বয়স্থা বিদ্যালয় স্থাপন করে নারীশিক্ষার যে আদর্শ অনুসরণ করতে লাগলেন, তা প্রগতিশীল দলের মনঃপূত হল না। কেশব সেন নারীদের উচ্চ গণিত, জ্যামিতি, লজিক প্রভৃতি শিক্ষা দেওয়া আবশ্যক মনে করতেন না। পক্ষান্তরে দ্বারকানাথ নারীদের বিশ্ববিদ্যালয়ের সিলেবাস অনুযায়ী উচ্চশিক্ষার পক্ষাবলম্বী ছিলেন। এই পরিস্থিতিতে মনোমোহন ঘোষ ও দুর্গামোহন দাসের আর্থিক সহায়তায় দ্বারকানাথ ১৮৭৩ খ্রিস্টাব্দের ১৮ই সেপ্টেম্বর বেনিয়াপুকুর লেনের একটি বাড়িতে পাঁচটি ছাত্রী নিয়ে মিস এক্রয়েড নামক সুশিক্ষিতা এক ইংরেজ মহিলাকে তত্ত্বাবধায়িকা করে বালিগঞ্জে ‘হিন্দু মহিলা বিদ্যালয়’ এবং ছাত্রীনিবাস স্থাপন করলেন। তিনি এই বিদ্যালয়ের একজন শিক্ষকও ছিলেন। এছাড়াও এই স্কুলের জন্য অর্থ সংগ্রহ করা, যানবাহনের বন্দোবস্ত করা, ছাত্রীনিবাসে ছাত্রীদের খাবারের ব্যবস্থা করা, তাদের অসুখ হলে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা – সমস্ত দেখাশোনা দ্বারকানাথ একাই করতেন। ১৮৭৫ সালের এপ্রিলে মিস এক্রয়েড বিবাহ করে চলে গেলে এই বিদ্যালয়টি বন্ধ হয়ে যায় কিন্তু অদম্য দ্বারকানাথ কয়েক মাস পরেই ১লা জুন, ১৮৭৫ খ্রিস্টাব্দে ওল্ড বালিগঞ্জ রোডে ‘বঙ্গ মহিলা বিদ্যালয়’ প্রতিষ্ঠা করলেন। দ্বারকানাথ এই প্রতিষ্ঠানেরও প্রাণস্বরূপ ছিলেন। এখানে অনুসৃত শিক্ষাপদ্ধতি সরকারী শিক্ষাবিভাগের প্রশংসা অর্জন করে – “In every sense the most advanced school in Bengal.”১১ পরবর্তীকালে উচ্চশিক্ষিতারূপে পরিগণিত একাধিক কন্যা এই বিদ্যালয়ের ছাত্রী ছিলেন ; যথা আচার্য জগদীশচন্দ্র বসুর ভগিনী স্বর্ণপ্রভা বসু (আনন্দমোহন বসুর পত্নী), দুর্গামোহন দাসের দুই কন্যা লেডি অবলা বসু (জগদীশচন্দ্র বসুর পত্নী) ও সরলা রায় (ডঃ প্রসন্নকুমার রায়ের পত্নী), গিরিজাকুমারী সেন (শশিপদ বন্দোপাধ্যায়ের পত্নী), ব্রজকিশোর বসুর কন্যা কাদম্বিনী বসু (দ্বারকানাথ গাঙ্গুলীর পত্নী) এবং শিবনাথ শাস্ত্রীর কন্যা হেমলতা দেবী। পূরবী বসু ‘নারী প্রগতির পথিকৃৎ দ্বারকানাথ ও কাদম্বিনী গঙ্গোপাধ্যায়’ প্রবন্ধে লিখেছেন, “এই বিদ্যালয়ের সূত্রেই তিনি ছাত্রীদের প্রবেশিকা পরীক্ষা এবং ও মহিলাদের মেডিকেল কলেজে প্রবেশাধিকার বিষয়ের আন্দোলনে প্রধান ভূমিকা গ্রহণ করেন। তাঁর সরাসরি হস্তক্ষেপ ও অমোঘ যুক্তির কাছে হার মানতে হয়েছিল প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মান্ধাতার আমলের রীতিনীতি ও নিয়মসমূহ যা নারীকে শিক্ষার অধিকার থেকে বঞ্চিত করে আসছিল।”১২ ১লা আগস্ট, ১৮৭৮ খ্রিস্টাব্দে বঙ্গ মহিলা বিদ্যালয় বেথুন স্কুলের সাথে মিশে যায়। তাঁর এই সমস্ত কাজে সহযোগী ছিলেন শিবনাথ শাস্ত্রী, দুর্গামোহন দাস, আনন্দমোহন বসু, অন্নদাচরণ খাস্তগীর প্রমুখ নেতারা।
তৎকালীন সমাজে মহিলাদের প্রাথমিক পর্যায়ের ঊর্ধ্বে বিদ্যাচর্চার প্রচলন সেভাবে ছিলো না। দ্বারকানাথ এই মনোভাবের তীব্রতর বিরুদ্ধাচরণ করেন। নিজের ছাত্রীদের তিনি সর্বদা উচ্চশিক্ষায় উদ্বুদ্ধ করতেন। বস্তুত দ্বারকানাথের প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপ ও দৃঢ় অবস্থানের জন্যেই ১৮৭৮ খ্রিস্টাব্দের ২৭শে এপ্রিল প্রথমবারের জন্য কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের এনট্রান্স পরীক্ষায় বসবার অনুমতি পাওয়া গেল। ওই বছরই এনট্রান্স পরীক্ষায় সাফল্যের সাথে কৃতকার্য হয়ে বঙ্গীয় স্ত্রীশিক্ষার জগতে বিপ্লব ঘটালেন কাদম্বিনী বসু।
এইখানে কাদম্বিনীর সম্বন্ধে সংক্ষেপে দু-চার কথা আলোচনা করা আবশ্যক। কাদম্বিনীর জন্ম হয় ১৮৬১ সালের ১৮ই জুলাই, বিহারের ভাগলপুরে। তাঁর বাবা ব্রজকিশোর বসু ছিলেন ভাগলপুর স্কুলের হেডমাস্টার। তাঁর মূল বাড়ি ছিলো বর্তমান বাংলাদেশের বরিশালের চাঁদশীতে। তিনি ছিলেন ব্রাহ্ম এবং নারীশিক্ষায় অত্যন্ত উৎসাহী। ‘একলা চলো রে’ প্রবন্ধে ডঃ শামসুল হক লিখেছেন, “সেখানে তিনি নারীমুক্তির জন্য ‘ভাগলপুর মহিলা সমিতি’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেছিলেন।”১৩ যাই হোক, ব্রজকিশোর বাবু উচ্চশিক্ষার জন্য মেয়েকে ভাগলপুর থেকে কলকাতায় নিয়ে এলেন। দ্বারকানাথ ও তার বন্ধু কাদম্বিনীর পিসতুতো দাদা মনমোহন ঘোষের হাত ধরে কাদম্বিনী ১৮৭৩ খ্রিস্টাব্দে ভর্তি হলেন কলকাতার দ্বারকানাথ প্রতিষ্ঠিত হিন্দু মহিলা বিদ্যালয়ে এবং পরবর্তীকালে বঙ্গ মহিলা বিদ্যালয়ে। আর সেখান থেকেই ১৮৭৮ সালে দ্বিতীয় বিভাগে এনট্রান্স পাশ করলেন তিনি। শোনা যায় নাকি মাত্র এক নম্বরের জন্য প্রথম বিভাগ পান নি কাদম্বিনী। খোদ লর্ড লিটন তাঁর প্রশংসা করেন। লেডি লিটনের হাত দিয়ে তাঁকে পুরস্কার ও সার্টিফিকেট দেওয়া হয়। কিন্তু ‘সংবাদ প্রভাকর’ এ বার মোক্ষম প্রশ্নটি তোলে— “কাদম্বিনী এক্ষণে কোন বিদ্যালয়ে পড়বেন?”১৪
এরপর তিনি ভর্তি হলেন বেথুন কলেজে বিজ্ঞান নিয়ে। এই প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য যে, কাদম্বিনীর জন্যেই বেথুন স্কুলকে কলেজে রূপান্তরিত করে ব্রিটিশ সরকার। “১৮৭৮-৭৯ সালে ডিরেক্টর অব পাবলিক ইনস্ট্রাকশন এ ডব্লিউ ক্রফট শিক্ষা রিপোর্টে জানালেন, কাদম্বিনীর জন্যই বেথুন স্কুলকে কলেজে রূপান্তরিত করার কথা সরকার ভাবে এবং তা বাস্তবায়িত হয়।”১৫ এক জন ছাত্রী ও এক জন লেকচারার নিয়ে শুরু হল কলেজ। ইংল্যান্ড থেকে এক ব্রিটিশ মহিলা সুপারিন্টেন্ড্যান্টকে আনা হল। কাদম্বিনী স্নাতক হলেন ১৮৮৩ সালে। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য, তাঁরই সঙ্গে গ্র্যাজুয়েট হলেন আরও এক বাঙালি কন্যা চন্দ্রমুখী বসু। এই দুই কৃতী কন্যাই প্রথম ভারতীয় নারী, যাঁরা গ্র্যাজুয়েট হওয়ার দুর্লভ সম্মান অর্জন করতে পেরেছিলেন। শোনা যায়, সে বার বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনে দুই মহিলার ডিগ্রি নেওয়া দেখতে এত ভিড় হয়েছিল যে, পুলিশকে হিমশিম খেতে হয়েছিল। ভিড় বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস ছাড়িয়ে ট্রামলাইন পর্যন্ত চলে গিয়েছিল। কবি হেমচন্দ্র এই দুই বিদুষীকে নিয়ে কবিতা লিখে ফেলেছিলেন।
এ পর্যন্ত পড়ে ব্যাপারটা যত সহজ মনে হল, কাদম্বিনীর চলার পথটি কিন্তু মোটেই এমন কুসুমাস্তীর্ণ ছিল না। স্ত্রীশিক্ষার এই আধুনিক অগ্রগতিতে রক্ষণশীল হিন্দু সমাজ চরম ক্ষুব্ধ হয়। রণজিৎ বন্দোপাধ্যায় তাঁর ‘উনিশ শতকের নারীমুক্তি আন্দোলন ও বাংলা সাহিত্য’ গ্রন্থে দেখিয়েছেন, ‘বেদব্যাস’, ‘জন্মভূমি’, ‘অনুসন্ধান’, ‘ধর্মপ্রচারক’ প্রভৃতি বাংলা পত্রিকা এর বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জানাল। স্ত্রী-পুরুষকে একই ধরণের শিক্ষা দিলে নারীসমাজের চরম অবনতি ঘটবে – একের পর এক প্রবন্ধে তা প্রকাশ করে কল্পিত নৈতিক অধঃপতনের হাত থেকে বঙ্গীয় নারীসমাজকে বাঁচাবার পবিত্র দায়িত্ব পালন করতে উঠে পড়ে লাগল তারা। এর কয়েকটি দৃষ্টান্ত দেওয়া যাক – “নারীহৃদয়ের কোমলতা দূর হবে” (পরিচারিকা, আশ্বিন ১২৯৭), “নারীরা সংসারকর্মে অপটু হয়ে পড়বে” (ভারতী, পৌষ ১২৯৭), “সন্তান উৎপাদনের ক্ষমতা হ্রাস পাবে” (বেদব্যাস, বৈশাখ ১২৯৬), “বন্ধ্যা হবে” (অনুসন্ধান, বৈশাখ ১২৯৮), “চারিত্রিক অবনতি ঘটবে” (জন্মভূমি, মাঘ ১৩০১)। অর্থাৎ সব মিলিয়ে সমাজের ক্ষতি বৈ লাভ হবে না। সবচেয়ে হাস্যকর কুযুক্তিটি দেয় ভূধর চট্টোপাধ্যায়ের ‘বেদব্যাস’ পত্রিকা তাদের বৈশাখ, ১২৯৬ সংখ্যায় – “কিন্তু প্রকৃত বিদ্যাশিক্ষাও নারীর পক্ষে অমঙ্গলের কারণ। কেননা ইহার দ্বারা পুত্র প্রসবোপযোগিনী শক্তিগুলির হ্রাস হয়। বিদুষী নারীদের বক্ষদেশ সমতল হইয়া যায় এবং তাহাদের স্তনে প্রায়ই স্তন্যদুগ্ধের সঞ্চার হয় না। এতদ্ভিন্ন তাহাদের জরায়ু প্রভৃতি বিকৃত হইয়া যায়।”১৬
চন্দ্রমুখী এ বার বেথুনেই এমএ পড়া শুরু করলেন। কিন্তু কাদম্বিনী সিদ্ধান্ত নিলেন এমবিবিএস পড়বেন। এ বার আরও ভয়ঙ্কর প্রতিরোধ ও লড়াইয়ের ইতিহাসের মুখোমুখি হলেন তিনি। তখন মেডিকেল কলেজে মেয়েদের পড়বার অনুমতি দেওয়া হত না। কাদম্বিনী ডাক্তারি পড়তে চেয়ে প্রথমবার আবেদন করেছিলেন ১৮৮১ সালে। শিক্ষা অধিকর্তা আগ্রহী হলেও কলকাতা মেডিকেল কলেজ কাউন্সিল পাত্তা দেয় নি। কাদম্বিনী আবার আবেদন করেন ১৮৮৩ সালে। সেই খবর ছড়িয়ে পড়তে বেশি সময় লাগেনি। কলকাতার অভিজাত সমাজ নানাভাবে তাঁকে ব্যঙ্গ করতে শুরু করে। তিনি যাতে ডাক্তারি পড়তে না পারেন, চলল তার জন্য নানা অপচেষ্টাও। ছাড়ার পাত্রী ছিলেন না কাদম্বিনীও। অবশেষে দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায়, আনন্দমোহন বসু প্রমুখের প্রচেষ্টায় এবং থম্পসন সাহেবের আইনানুগ মধ্যস্থতায় কাদম্বিনী মেডিকেল কলেজে ভর্তি হলেন।
এইখানে একটু প্রসঙ্গান্তরে যেতে হচ্ছে। এতক্ষণ আমরা দ্বারকানাথের ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে বিশেষ কোনও কথা বলিনি। তুলনামূলকভাবে প্রগতিশীল ব্রাহ্মসমাজে যোগদানের বহু পূর্বেই ১৮৬৩ সালে ভবসুন্দরীর সঙ্গে দ্বারকানাথের বিবাহ হয়। তাঁদের এক কন্যা বিধুমুখী ও এক পুত্র সতীশচন্দ্র। প্রসঙ্গত, এই বিধুমুখীর সঙ্গেই পরবর্তীকালে বিবাহ হয় প্রখ্যাত শিশু সাহিত্যিক উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর। যাইহোক, দ্বারকানাথ ও ভবসুন্দরীর বিবাহিত জীবন দীর্ঘস্থায়ী হয় নি। ১৮৭০ সালে দ্বারকানাথ যখন কলকাতায় এলেন তখন তিনি বিপত্নীক।
দীর্ঘ প্রায় পনেরো বছর বিপত্নীক ছিলেন দ্বারকানাথ। পরবর্তীকালে ধীরে ধীরে আদর্শগত কারণেই প্রিয় ছাত্রী কাদম্বিনীর সঙ্গে তাঁর মানসিক নৈকট্য ক্রমেই গভীর হয়ে ওঠে। কাদম্বিনীও সম্ভবত এমন এক জনকে জীবনসঙ্গী করতে চেয়েছিলেন, যিনি উদারমনস্ক হবেন এবং নারী স্বাধীনতা নিয়ে কেবল বুলি না আউড়ে নিজের জীবনেও সেই আদর্শে অটল থাকবেন। অবশেষে ডাক্তারি পড়তে শুরু করার সময়েই ১৮৮৩ খ্রিস্টাব্দের ১২ই জুন কাদম্বিনীর বিয়ে হয়ে গেল দ্বারকানাথের সঙ্গে, এই বিয়ে ব্রাহ্ম মতে সম্পন্ন করলেন পণ্ডিত রামকুমার বিদ্যারত্ন। তবে এই বিয়ের কাহিনি তুফান তুলেছিল সে যুগের ব্রাহ্মসমাজেও। এর মুল কারণ হল, দ্বারকানাথ ছিলেন কাদম্বিনীর থেকে বয়সে সতেরো বছরের বড় এবং কাদম্বিনীর স্কুলের প্রত্যক্ষ শিক্ষক। বলা বাহুল্য, তৎকালীন রক্ষণশীল সমাজে তাদের এই পদক্ষেপ সহজে গৃহীত হয়নি। গোঁড়া হিন্দুসমাজ তো বটেই, দ্বারকানাথের অনেক নিকটজন এমনকি আধুনিকমনস্ক প্রচুর ব্রাহ্ম নেতাও এই বিয়ে মেনে নিতে পারেননি। এর আর একটা কারণ অবশ্য ছিল যে, সেই সময় বিয়ের পরে মেয়েরা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারতেন না। (আজও কি পারেন?) প্রেমের বিয়ে হলেও কাদম্বিনীর হিতাকাঙ্ক্ষীরা মনে করেছিলেন কাদম্বিনীর মতো অসাধারণ মেধাবী ও দৃঢ়চেতা নারীর পড়াশোনা হয়তো এখানেই শেষ হয়ে যাবে যেমন হয়েছিল দুর্গামোহনের দুই কন্যা, সরলা ও অবলার। “রাগ করে এই বিয়েতে তাই ঘনিষ্ঠ বন্ধু শিবনাথ শাস্ত্রী পর্যন্ত আসেননি।”১৭ যদিও পরবর্তীকালে ইতিহাসবিদদের মধ্যে অনেকেই যদিও এই বিবাহকে আদর্শ বলে আখ্যায়িত করেছেন। তার অন্যতম কারণ দ্বারকানাথ আগাগোড়া ছিলেন কাদম্বিনীর বিদ্যাচর্চার অন্যতম সমর্থক। এমনকি উচ্চশিক্ষার সুত্রে কাদম্বিনীর বিদেশ যাত্রার ক্ষেত্রে দ্বারকানাথের সম্পূর্ণ আগ্রহ ও সহযোগিতা ছিল।
যাইহোক, আবার মুল প্রসঙ্গে ফিরে আসা যাক। কাদম্বিনীর মেডিকেল কলেজে ভর্তি হওয়ার খবরে রক্ষণশীল হিন্দু সমাজে আলোড়ন পড়ে গেল। ব্যঙ্গ বিদ্রূপ সমালোচনার অভাব রইলো না। পূরবী বসু ‘নারী প্রগতির পথিকৃৎ দ্বারকানাথ ও কাদম্বিনী গঙ্গোপাধ্যায়’ প্রবন্ধে লিখেছেন, “তখনকার ‘বঙ্গবাসী’ নামে সাময়িক পত্রিকার ডাকসাইটে সম্পাদক মহেশচন্দ্র পাল একটি কার্টুন ছেপে কাদম্বিনীকে ‘স্বৈরিণী’র সঙ্গে তুলনা করেছেন। কারণ কাদম্বিনী নাকি মোটেই ঘরোয়া নন। ঘর-সংসারের দিকে, ছেলেমেয়ের দিকে তাঁর নাকি মন নেই, নিষ্ঠাও নেই। এতগুলি সন্তানের মা হওয়া সত্ত্বেও তিনি নাকি মাতৃধর্ম পালন করছেন না। এর ওপর আবার সমাজসেবা, স্বদেশী করে বেড়াচ্ছেন, সভাসমিতি করছেন বাইরে। সুতরাং বঙ্গবাসী পত্রিকায় একটা কার্টুন এঁকে দেখানো হলো, বারবণিতা ডা. কাদম্বিনী স্বামী দ্বারকানাথের নাকে দড়ি দিয়ে হিড় হিড় করে টেনে নিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু ছেড়ে দেবার পাত্রী নন কাদম্বিনী কিংবা তাঁর স্বামী। মামলা হল। বঙ্গবাসী পত্রিকার সম্পাদক মহেশচন্দ্র পালের ১০০ টাকা জরিমানা আর ছয় মাসের জেল হল। সেই সময় এই ধরনের মামলা করা, বিশেষ করে এক শক্তিশালী পুরুষ কাগজের সম্পাদকের বিরুদ্ধে কোনো নারীর মানহানির মামলা করাটা মোটেই সহজ ছিল না।”১৮
শুধু রক্ষণশীল সমাজই নয়, তাঁর বিরোধিতা করতে থাকে মেডিকেল কলেজের টিচিং স্টাফও। চিকিৎসকদের একাংশ নারী শিক্ষার্থীকে কিছুতেই বরদাস্ত করতে পারলেন না। এর পরবর্তী ঘটনা তুলে দেওয়া যাক আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত একটি নিবন্ধ থেকে – “তাঁদের অন্যতম ছিলেন রাজেন্দ্রচন্দ্র চন্দ্র। তিনি বিলেতে লর্ড পরিবারের সঙ্গে বিয়ের সূত্রে আবদ্ধ হয়েছিলেন কিন্তু স্ত্রী শিক্ষার ঘোর বিরোধী ছিলেন। অতি রক্ষণশীল এই চিকিৎসক কাদম্বিনীর মেডিক্যাল পড়ার খোলাখুলি প্রতিবাদ করেছিলেন এবং পরবর্তীতে তাঁর মেডিসিন পেপারে এক নম্বরের জন্য কাদম্বিনীকে ফেল করিয়েছিলেন ! … কাদম্বিনীকে ‘ব্যাচেলর অব মেডিসিন’ বা এমবি পরীক্ষায় পাশ করানো হয়নি ! গবেষক নারায়ণ চন্দ্রের লেখানুযায়ী, চিকিৎসক চন্দ্র মেডিসিন পড়াতেন। তিনি কাদম্বিনীকে মৌখিক পরীক্ষায় তাঁর পেপারে এক নম্বরের জন্য ফেল করিয়ে দেন। চিকিৎসক জে এম কোটস ছিলেন তখন মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষ এবং তিনিও মেডিসিনের অধ্যাপক ও অন্যতম পরীক্ষক ছিলেন। তিনি বুঝেছিলেন যে, কাদম্বিনীর সঙ্গে অন্যায় হচ্ছে। তাঁর ইচ্ছানুযায়ী সিন্ডিকেটে আলোচনার পরে কাদম্বিনীকে ‘লাইসেনসিয়েট ইন মেডিসিন অ্যান্ড সার্জারি’ বা এলএমএসের সার্টিফিকেট দেওয়া হয় ১৮৮৬ সালের ৭ই আগস্ট। কিন্তু দু’বছর এলএমএস পড়ার পরে ফাইনালে ফের চিকিৎসক রাজেন্দ্র চন্দ্রের বিষয়ে তাঁকে ফেল করানো হল। তখন অধ্যক্ষ কোটস নিজের অধিকারবলে কাদম্বিনীকে ‘গ্র্যাজুয়েট অফ দ্য মেডিক্যাল কলেজ অব বেঙ্গল’ বা জিএমসিবি উপাধি দেন। ফলে ডাক্তার হয়ে প্র্যাকটিসের ছাড়পত্র পেয়ে যান কাদম্বিনী। ইডেন হাসপাতালে তাঁকে কাজের সুযোগ করে দেন কোটস। কিন্তু যেহেতু ডাক্তারির এমবি বা এলএমএসের ডিগ্রি তাঁর ছিল না, তাই সেখানে তাঁকে নার্সের মর্যাদা দেওয়া হত। রোগ নির্ণয় বা অস্ত্রোপচার করতে দেওয়া হত না।”১৯ কারা যেন গর্বের সঙ্গে দাবি করেন, উনিশ শতকে মেডিকেল কলেজ নাকি বেজায় প্রগতিশীল ছিল !
ডিগ্রি না পাওয়াটা সম্ভবত কাঁটার মতো কাদম্বিনীকে বিঁধছিল। কারণ, বিরোধীরা প্রতি পদক্ষেপে ওই বিষয়টিকে তুলে তাঁর যোগ্যতা নিয়ে বিদ্রুপ করছিলেন এবং তাঁকে চিকিৎসকের দায়িত্ব দেওয়ার প্রতিবাদ করছিলেন। তখনই বিদেশে গিয়ে ডাক্তারি ডিপ্লোমা নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন কাদম্বিনী। বিলেত যাওয়ার জন্য টাকার সংস্থান করা, বিদেশে থাকার ব্যবস্থা করা সবকিছুর ক্ষেত্রেই জীবনসঙ্গী দ্বারকানাথ ছিলেন তাঁর পাশে। “১৮৯৩ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি মিস প্যাশ নামে মহিলার সঙ্গিনী হয়ে জাহাজে একা বিদেশযাত্রা করেন। লন্ডন পৌঁছন ২৩ মার্চ। তার পরে অবিশ্বাস্য দ্রুততায় মাত্র তিন মাসে প্রার্থিত তিনটি ডিপ্লোমা (এলআরসিপি, এলআরসিএস এবং এলএফপিসি) সংগ্রহ করে দেশে ফেরেন।”২০ এডিনবরার স্কটিশ কলেজ থেকে তিনি এই তিনটি ডিপ্লোমা লাভ করেন। তিনি এবং আনন্দী গোপাল জোশী প্রথম ভারতীয় মহিলা ডাক্তার, যাঁরা ওয়েস্টার্ন মেডিসিন নিয়ে প্র্যাকটিস করার যোগ্যতা অর্জন করেন। তিনিই ছিলেন ভারতের প্রথম মহিলা চিকিৎসক, যিনি ডাক্তারি শাস্ত্রের একাধিক বিদেশি ডিগ্রি অর্জনের দুর্লভ দক্ষতা দেখান। কলকাতায় ফেরার পরে ‘বামাবোধিনী’ বা ‘ইন্ডিয়ান মেসেঞ্জার’-এর মতো কাগজগুলি তাঁর তুমুল প্রশংসা করে। ইতিহাস সাক্ষী দেবে, কাদম্বিনীর এই যে সংগ্রাম ও প্রতিষ্ঠালাভ, যেভাবে পদে পদে যুদ্ধ করে তিনি ব্রিটিশ ভারতের প্রথম দুজন নারী চিকিৎসকের একজন হতে পেরেছিলেন, তা তাঁর নিজস্ব যোগ্যতা, দৃঢ়তা, পরিশ্রম ও মেধার গুণেই সম্ভব হয়েছিল, একথা নিঃসন্দেহ। কিন্তু তাঁর পড়াশোনা ও জীবিকার সাফল্যের জন্যে সর্বতোভাবে সহযোগিতা পেয়েছেন জীবনসঙ্গী দ্বারকানাথের।
আবার দ্বারকানাথ প্রসঙ্গে ফিরে আসা যাক। আমরা আগেই দেখেছি, তুলনামূলকভাবে রক্ষণশীল কেশবচন্দ্র সেনের সঙ্গে একাধিক বিষয় নিয়ে দ্বারকানাথ গাঙ্গুলী, শিবনাথ শাস্ত্রী, দুর্গামোহন দাস প্রভৃতির মতবিরোধ হচ্ছিল। শেষে ১৮৭৮ সালের ৬ই মার্চ যখন কেশবচন্দ্র সেন তাঁদের ধর্মের নিয়ম না মেনে অনেকটা হিন্দুমতেই কুচবিহারের রাজবাড়িতে নিজের মেয়ে অপ্রাপ্তবয়স্কা সুনীতির বিবাহ দিলেন; তখন এই বিরোধিতা চুড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছালো। প্রগতিশীলরা অভিযোগ করলেন, কন্যার বাল্যবিবাহ দিয়ে কেশবচন্দ্র ব্রাহ্ম বিবাহবিধি লঙ্ঘন করেছেন। কুচবিহার কাণ্ডের আগেই প্রতিবাদীরা নিজেদের বক্তব্য রাখবার জন্য ‘সমালোচক’ নামে একটি পত্রিকা প্রকাশ করেছিলেন। এই পত্রিকার প্রথম কয়েকটি সংখ্যা শিবনাথ শাস্ত্রী পরিচালনা করবার পর সম্পাদনার দায়িত্ব নিলেন দ্বারকানাথ। সম্পাদকের ভার গ্রহণ করে দ্বারকানাথ যেন বাস্তবিক অর্থেই প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে অগ্নিবর্ষন করতে লাগলেন। “কেবল তাহা নয়, সে সময়ের বিবাদ-বিসম্বাদে তিনি অগ্রণী হইতে লাগিলেন। বিবাদ অনেকেই করিয়াছিল, কিন্তু অপরের বিবাদ আর দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের বিবাদে একটু প্রভেদ ছিল। অন্যে বিবাদ করে, এবং বিবাদের পশ্চাতে বিদ্বেষ রাখে; গাঙ্গুলী ভায়ার বিবাদে তীব্রতা থাকিত, কটূক্তি থাকিত, উচিত কথা বলা থাকিত, শুনিলে মনে হইত শকুনি যেমন মৃত প্রাণীর পেট পা দিয়া চাপিয়া ভিতরকার নাড়িভুঁড়ি বাহির করে, তেমনি যেন তিনি বিপক্ষের পেট চাপিয়া ঠোঁট দিয়া নাড়িভুঁড়ি বাহির করিতে পারেন, কিন্তু ফলতঃ বিদ্বেষবুদ্ধি তাঁহার মনের ত্রিসীমানায় থাকিত না। তিনি বলিবার যাহা বলিলেন, প্রতিবাদীর মুখের উপরেই বলিলেন; করিবার যাহা করিলেন, দশজনের সমক্ষেই করিলেন; তৎপরেই আর কিছুই নাই, বিদ্বেষ লইয়া ঘরে আসিলেন না। এই গুণের জন্যেই আমরা তাঁহাকে ভালোবাসিতাম।”২১ এক মহান মানুষ কিভাবে অন্য আরেকজন মহান মানুষের চরিত্র বিশ্লেষণ করেছেন, শিবনাথ শাস্ত্রীর এই বক্তব্য থেকে তা বোঝা যায়। জীবনীকার ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দোপাধ্যায় লিখছেন, “কেশবচন্দ্রকে আচার্য্যের পদ হইতে, এমন কি, ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্মসমাজের সম্পাদক পদ হইতেও অপসৃত করিবার চেষ্টা চলিল, কিন্তু কৃতকার্য্য হইতে না পারিয়া বিরোধী দল তাঁহাকে বর্জন করিয়া, ১৮৭৮ সনের ১৫ই মে টাউন হলে সভা করিয়া ‘সাধারণ ব্রাহ্মসমাজ’ নামে একটি সতন্ত্র সমাজ প্রতিষ্ঠা করিলেন।”২২ শিবনাথ শাস্ত্রীর ভাষায়, “ইহার প্রতিষ্ঠার সময় তিনি ইহার একজন প্রধান সারথি ছিলেন।”২৩
১৮৭৮ খ্রিস্টাব্দে সাধারণ ব্রাহ্মসমাজ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরই কর্মকর্তারা ঘোষণা করেন, এই সংগঠনের অন্যতম লক্ষ্য মানবজাতির সর্বাঙ্গীন মুক্তি আন্দোলন। সংগঠনের তৎকালীন মুখপত্র ‘ব্রাহ্ম পাবলিক ওপিনিয়ন’এর প্রথম বর্ষ, প্রথম সংখ্যায় ২১শে মার্চ স্পষ্টভাবে লেখা হয়, “Brahmoism elevates people not only spiritually but socially, intellectually, physically and politically.”২৪ পরবর্তীকালে শিবনাথ শাস্ত্রী আরও ঘোষণা করেন, সাধারণ ব্রাহ্মসমাজের উদ্দেশ্য – অন্যায়ের উপর ন্যায়, অসাম্যের উপর সাম্য, রাজার উপর প্রজার ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা করা।
সাধারণ ব্রাহ্মসমাজ প্রতিষ্ঠা হওয়ার পর সমাজের উৎসাহী প্রচারকদল, যথা – বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী, শিবনাথ শাস্ত্রী, রামকুমার বিদ্যারত্ন ও গনেশচন্দ্র ঘোষ ভারতের সর্বত্র সমাজের আদর্শ প্রচারের লক্ষ্যে ছড়িয়ে পড়েন। ব্রাহ্মধর্ম প্রচার করতে গিয়েই অসমের লাঞ্ছিত নিপীড়িত কুলি সমাজের দুঃখ দুর্দশার প্রতি সাধারণ ব্রাহ্মসমাজের সদস্যদের দৃষ্টি আকর্ষিত হয়। গৌতম বাবু বলেছেন, “তাঁদের ‘সর্বাঙ্গীন মুক্তি’র চেতনায় আঘাত লাগে এবং তাঁরা আরম্ভ করেন আসাম চা-কুলি আন্দোলন।”২৫ অসমে চা-কুলি আন্দোলনে নেতৃত্বদান এবং এই অমানবিক শোষণ ও নিপীড়নের প্রতি শহুরে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণীর তথা সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করা সাধারণ ব্রাহ্মসমাজের পক্ষে এক গৌরবময় কীর্তি। এ প্রসঙ্গে বিস্তারিত পরে আলোচনা করব।
“কোনো ব্যক্তি বা সম্প্রদায়ের আনুগত্য না করিয়া সাধারণভাবে সকল সম্প্রদায়ের ও সর্ব্বপ্রকার অবস্থার লোকের ন্যায়মতে কল্যাণ সাধন করা – এই উদ্দেশ্য লইয়া আনন্দমোহন বসু ও সুরেন্দ্রনাথ বন্দোপাধ্যায়ের সবিশেষ যত্নে এবং দ্বারকানাথ, শিবনাথ প্রমুখ কতিপয় উৎসাহী সভ্যের আন্তরিক সহায়তায় ১৮৭৬ সনের ২৬শে জুলাই কলিকাতায় (৯৩, কলেজ স্ট্রিট) ইন্ডিয়ান এ্যাসোসিয়েশন বা ভারত সভার প্রাণ প্রতিষ্ঠা হয়।”২৬ শহুরে শিক্ষিত মধ্যবিত্তের রাজনীতিচর্চার জন্য প্রতিষ্ঠিত হওয়া ভারত সভা দ্বারকানাথের জন্য নুতন কর্মক্ষেত্র খুলে দিল। আমৃত্যু এই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জড়িয়ে ছিলেন দ্বারকানাথ। ১৮৭৬-৭৮ ও ১৮৮১ সালে কার্যনির্বাহী সভার সদস্য এবং ১৮৮২-৯৮ সহকারী সম্পাদক ছিলেন তিনি।
আগেই বলেছিলাম, অসমে ব্রাহ্মধর্ম প্রচার করতে গিয়ে ওখানকার কুলি সমাজের শোষণ ও দুঃখ দুর্দশার প্রতি সাধারণ ব্রাহ্মসমাজের সদস্যদের দৃষ্টি আকর্ষিত হয়েছিল। ব্রাহ্মসমাজের রামকুমার বিদ্যারত্ন বার বার অসম অঞ্চলে গিয়ে অসমের কুলি শ্রেণীর উপর ব্রিটিশ মালিকদের অকথ্য অত্যাচারের কথা জানতে পারেন। তিনি ছদ্মনামে একটি পুস্তিকা রচনা করেন, নাম ‘উদাসীন সত্যশ্রবার আসাম ভ্রমণ’। কলকাতায় সব শুনে ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন গগনচন্দ্র হোম, কৃষ্ণকুমার মিত্র, কালীশঙ্কর শুকুল, দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায়, হেরম্বচন্দ্র মৈত্র ইত্যাদি ব্রাহ্মসমাজের যুবনেতারা। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য, এঁরা সকলেই ভারতের প্রথম গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক সংগঠন ভারত সভারও সদস্য ছিলেন। সুরেন্দ্রনাথ বন্দোপাধ্যায়কে সব কিছু জানানো হল। অতঃপর ভারত সভা এবং সাধারণ ব্রাহ্মসমাজ, দুই সংগঠন একযোগে শুরু করল কুলি আন্দোলন।
এই আন্দোলন প্রসঙ্গে বিস্তারিত জানবার আগে আমাদের পিছিয়ে যেতে হবে অন্তত পঞ্চাশ বছর। গৌতম নিয়োগী সম্পাদিত শিবনাথ শাস্ত্রীর আত্মচরিত গ্রন্থে অসমের চা-চাষের ইতিহাসের চমৎকার বর্ণনা আছে। এই ইতিহাসটা না জানলে পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ ঠিকমতো উপলব্ধি করা যাবে না। ১৮৩৯ খ্রিস্টাব্দে ‘আসাম কোম্পানী’ প্রতিষ্ঠা হওয়ার পরেই অসমের চা-শিল্পে লগ্নি শুরু হয়। নীলচাষ বন্ধ হওয়ার পর ব্রিটিশ বণিকরা দলে দলে চা-শিল্পে যোগদান করেন। ১৮৫০ সালে যেখানে স্রেফ হাজার একর জমি চা-চাষ হত, মাত্র ত্রিশ বছরের মধ্যে তা দুই লক্ষ একরে দাঁড়ায়। ওই সময়ে চা শিল্পে বিনিয়োগ ছিল ১৫০ লক্ষ পাউন্ড স্টার্লিং যা কয়েকশো কোটি টাকার সমান। কিন্তু কেবল মুলধন আর জমি হলেই হবে না, চাই সস্তায় শ্রমিক। আরম্ভ হল প্রতারণা ও লোভ দেখিয়ে বাংলা, বিহার, ওড়িশা এবং অসমের দরিদ্র ও অশিক্ষিত মানুষকে ধরে নিয়ে গিয়ে কুলিতে পরিণত করা। ১৮৪০ খ্রিস্টাব্দে দাসপ্রথা লোপ পায় ইংল্যান্ডে কিন্তু তাদের বাণিজ্যিক প্রতিনিধিরা ঔপনিবেশিক ভারতে শুরু করল চা-কুলির নামে প্রকারান্তরে একপ্রকার দাসপ্রথা। তখন চালু ছিল কন্ট্রাক্ট লেবার যার মধ্যে লিখিত ও মৌখিক – দুই রকমের চুক্তির কথা বলা হয় ১৮৫৯ সালের আইনে। ‘হিন্দু প্যাট্রিয়ট’ পত্রিকা মাঝেমধ্যে চা-কর সাহেবদের অত্যাচারের কথা প্রকাশ করত, দক্ষিণারঞ্জন চট্টোপাধ্যায় ‘চা-কর দর্পণ’ নামে একটি নাটকও লেখেন কিন্তু তখনও শিক্ষিত ভারতীয়দের দৃষ্টি এদিকে ঘোরে নি। ইতিমধ্যে ১৮৭৩ খ্রিস্টাব্দে ‘বেঙ্গল অ্যাক্ট’এ মৌখিক চুক্তি পদ্ধতি বন্ধ হয় কিন্তু ব্রিটিশ পুঁজিপতিদের প্রতিবাদের ফলে তাদের স্বার্থে রচিত হয় ‘আসাম ইমিগ্রেশন বিল’, যা পাশ হয় ১৮৮২ সালে। বড়লাট লর্ড রিপন কুলিদের ঠকিয়ে চুক্তিবদ্ধ যাতে না করা হয়, এ ব্যাপারে সরকার সচেষ্ট থাকবে, এই প্রতিশ্রুতি দিলেও তা বাস্তবায়িত হয় নি বরং চা-কর সাহেবরা অন্যায় করবার পরেও ব্রিটিশ বিচারপতিরা তাদের প্রতি পক্ষপাতিত্ব দেখাতেন। ১৮৮৯ সালে ‘তত্ত্বকৌমুদী পত্রিকা’ লিখেছিল, দাসত্বপ্রথা উঠিয়া যাইবার পর জগতে যদি কোনো অমানুষিক ও অসভ্যপ্রথা প্রচলিত হইয়া থাকে, তবে তাহা আইনে বাঁধিয়া হতভাগ্য কুলিদিগকে আসামের ঘোর অরণ্য ও কঠিন-হৃদয় চা-কর সাহেবদিগের পাশব অত্যাচারের কবলে নিক্ষেপ করা। আসামের চা যদি রাসায়নিক উপায়ে বিশ্লিষ্ট করা যায়, তবে তাহার মধ্যে এই কয়েকটি জিনিস দেখিতে পাইবেন – অর্ধ অংশ কুলিদিগের রক্ত, সিকি অংশ ব্যাভিচার আর অপর সিকি অংশ কুলিদিগের হৃদয়ের অপহৃত ধর্মভাব।”২৭ এই অত্যাচারের কাহিনী জনসমক্ষে তুলে ধরে ব্যাপক জনমত গঠনের প্রচেষ্টা করলেন সাধারণ ব্রাহ্মসমাজ ও ভারত সভার সমাজ সচেতন সদস্যবৃন্দ।
ইতিমধ্যে ১৮৮৩ সালের ১৫ই এপ্রিল কৃষ্ণকুমার মিত্র, কালীশঙ্কর শুকুল, দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায়, হেরমচন্দ্র মৈত্র, গগনচন্দ্র হোম, পরেশনাথ সেন প্রমুখের সহযোগিতায় ‘সঞ্জীবনী’ নামে একটি জাতীয়তাবাদী বাংলা সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশ হল। পত্রিকার শীর্ষদেশে ‘সাম্য, স্বাধীনতা, মৈত্রী’ এর আদর্শ মুদ্রিত হত। দ্বারকানাথ ছিলেন পত্রিকার সম্পাদক। পরবর্তীকালে কৃষ্ণকুমার সম্পাদকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। কুলি আন্দোলন চলাকালীন সঞ্জীবনীর এক দুঃসাহসিক সাংবাদিক হিসেবে অসাধারণ খ্যাতি অর্জন করেছিলেন দ্বারকানাথ।
ভারত সভার পক্ষ থেকে একটি স্মারকলিপি দেওয়া হল তৎকালীন বড়লাট লর্ড রিপনকে। সঙ্গে পাঠানো হল রামকুমার বিদ্যারত্নের পুস্তিকাখানি। রামকুমার বিদ্যারত্নের অসমে কুলিদের শোষণ নিয়ে নানা লেখার মধ্যে অন্যতম ছিল সুকুরমনি নামক এক কুলি রমণীর চার্লস ওয়েব নামক এক ব্রিটিশ সাহেবের হাতে খুন হওয়ার ঘটনাকে কেন্দ্র করে একটি লেখা। এক্ষেত্রে চার্লস ওয়েবের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল যে সে সুকুরমনির অসহায় পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে তাকে প্রথমে ধর্ষণ ও পরে হত্যা করে। কিন্তু তার বিরুদ্ধে করা মামলা স্থানীয় আদালত থেকে কলকাতা হাই কোর্ট পর্যন্ত গড়ালেও পর্যাপ্ত প্রমাণের অভাবে সে প্রত্যেক বার ছাড়া পেয়ে যায়।
সঞ্জীবনী পত্রিকায় ওয়েব সাহেবের মামলা, উমেশচন্দ্র হত্যা মামলা ইত্যাদি একের পর এক বিচারের প্রহসনের কাহিনী ছেপে জনসাধারণের মধ্যে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করল। ভারত সভা অসমের চা-কুলিদের সম্পর্কে প্রত্যক্ষ বিবরণ সংগ্রহের জন্য সহ-সম্পাদক দ্বারকানাথকে আসামে পাঠাবার সিদ্ধান্ত নিল।
রামকুমার বিদ্যারত্নের লেখায় অসমে চা-শ্রমিকদের শোষণ বৃত্তান্ত পড়ে দ্বারকানাথ আগেই আগ্রহী হয়েছিলেন। ১৮৮৬ সালের জুলাই মাসে ভারত সভার পক্ষ থেকে এবং সঞ্জীবনী পত্রিকার সাংবাদিক হিসেবে তিনি সেখানে গিয়ে কুলি সমস্যার সরেজমিনে তদন্ত আরম্ভ করলেন। প্রয়োজনে কখনও কুলির বেশে, কখনও বা চা বাগানের আনাচে কানাচে লুকিয়ে দ্বারকানাথ কুলিদের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করতে লাগলেন এবং তাদের মুখ থেকে তাদের যাবতীয় সমস্যা সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করলেন। বলা বাহুল্য, এই কাজে তাঁকে বহু বিপদ অতিক্রম করতে হয়েছিল ও স্থানীয় প্রভাবশালীদের দ্বারা সংগঠিত নানা বাধা বিপত্তি অগ্রাহ্য করতে হয়েছিল। তাঁর আবির্ভাবে ওই অঞ্চলে কিরকম চাঞ্চল্যকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় তা ‘রামতনু লাহিড়ী ও তৎকালীন বঙ্গসমাজ’ গ্রন্থে লিখিত শিবনাথ শাস্ত্রীমশাইয়ের বর্ণনা থেকে পড়া যাক। “তাঁহার প্রকৃতিই এই ছিল যে, যে কার্য্যে হাত-দিতেন তাঁহা প্রাণ মনের সহিত করতেন। একবার তিনি আসামের কুলীদিগের অবস্থা পরিদর্শনের জন্য স্বয়ং আসামে গমন করিলেন। তখন বর্ষাকাল সমাগত, ব্ৰহ্মপুত্র জলপূর্ণ হইয়া দুই ধার প্লাবিত করিতেছে; যাতায়াত দুঃসাধ্য, তাঁহাকে প্রতিনিবৃত্ত হইবার জন্য কত অনুরোধ করা গেল, তাহার প্রতি কৰ্ণপাত করিলেন না; জলে ঝড়ে প্লাবনে স্বকাৰ্য্য সাধনে রত রহিলেন। একদিন পথে চলিতে চলিতে নদীর স্রোতে জলমগ্ন হইলেন। সে দিন অতি কষ্টে তাঁহার প্রাণ রক্ষা হইল। তথাপি তাঁহার উৎসাহ বা কাৰ্য্যতৎপরতার বিরাম হইল না। সেই কার্য্যেই প্রবৃত্ত রহিলেন। ওদিকে ইণ্ডিয়ান এ্যাসোসিয়েশনের সহকারী সম্পাদক দ্বারকানাথ গাঙ্গুলি আসামে কেন, এই বলিয়া সৰ্ব্বত্রই গবর্ণমেণ্টের কৰ্ম্মচারিগণ সশঙ্কিত হুইয়া উঠিলেন। তিনি যেখানেই যান সঙ্গে সঙ্গে পুলিস ; অধিকাংশ স্থলে ডেপুটী কমিশনরগণ বাঙ্গালি ভদ্রলোকদিগের নিকট হইতে তাঁহার বিষয়ে সংবাদ সংগ্রহ করেন। এইরূপ অসুবিধার মধ্যে কাৰ্য্য করিয়াও তিনি চা-বাগানের কুলীদের বিষয়ে অনেক সংবাদ সংগ্ৰহ করিলেন ; এবং সঞ্জীবনীতে প্রেরণ করিতে লাগিলেন। এই হতভাগ্য কুলীদের দূরবস্থার বিষয়ে লোকে অজ্ঞ ছিল, তাহার প্রেরিত সংবাদে লোকের চিত্ত চমকিয়া উঠিল, কুলীদের রক্ষার জন্য মধ্যবিত্ত ভদ্রলোকদিগের মন ব্যাকুল হইয়া উঠিল। দিন দিন কুলীসংক্রান্ত মোকদ্দমার সংখ্যা বাড়িতে লাগিল।”২৮
কৃষ্ণকুমার ‘চা অথবা কুলির রক্ত’ নামক প্রবন্ধে তীব্র ভাষায় শ্রমিকদের প্রতি অসমের চা-বাগানের মালিকদের হিংস্র অত্যাচারের কাহিনী প্রকাশ্যে তুলে ধরলেন। ‘ব্রাহ্ম পাবলিক ওপিনিয়ন’ পত্রিকাতেও জনমত গড়ে তোলবার জন্য প্রবন্ধ লেখা হল। “শুধু তাই নয়, সাধারণ ব্রাহ্মসমাজের এই উদ্যমী সদস্যরা একটি স্মারক পত্রিকা মুদ্রিত করলেন ব্রাহ্মমিশন প্রেসে – Justice Murdered in India. The papers of the Webb case regarding the sacrifice of a daughter of India to the lust of an Anglo- Indian.’ এবং সমস্ত বিষয়টি ব্রিটিশ পার্লামেন্টে পাঠালেন, এম পি উইলিয়াম কয়োনের মাধ্যমে।”২৯
অবশেষে কলকাতায় ফিরে এলেন দ্বারকানাথ। এসে চা-শ্রমিকদের নিয়ে তাঁর নিজের অভিজ্ঞতা লিপিবদ্ধ করলেন সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জি দ্বারা সম্পাদিত ‘দ্য বেঙ্গলী’ পত্রিকায়, ‘Slave Trade in Assam’ শিরোনামে প্রকাশিত তেরোটি প্রবন্ধে। নিজস্ব অভিজ্ঞতার পাশাপাশি দ্বারকানাথ এতে একাধিক মামলার কথাও প্রমাণস্বরূপ উল্লেখ করলেন। তাঁর বিভিন্ন প্রবন্ধে এইভাবে তিনি বারবার তুলে ধরলেন, কিভাবে আইনের ফাঁক গলে বহু অত্যাচারী চা-কর উপযুক্ত প্রমাণের অভাবে বেকসুর প্রমাণিত হয়ে চলেছে দিনের পর দিন এবং অসহায় কুলিদের ওপর অত্যাচার করেই চলেছে। শোনা যায়, এই সময়ে দ্বারকানাথ ভারত সভার পক্ষ থেকে বেশ কিছু কুলিদের তাদের চা-করদের বিরুদ্ধে মামলা লড়ার জন্যেও অর্থ সাহায্যও করেন।
চা-শ্রমিকদের দুর্দশা এবং তাদের উপর হওয়া অত্যাচারের বিরুদ্ধে স্রেফ পত্রপত্রিকা এবং ভারত সভার মাধ্যমে আন্দোলন করেই সাধারণ ব্রাহ্মসমাজের সদস্যরা তৃপ্ত হলেন না। ১৮৮৭ সালে মাদ্রাজে অনুষ্ঠিত সদ্য প্রতিষ্ঠিত ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের বার্ষিক অধিবেশনে দ্বারকানাথ কুলিদের প্রতি অত্যাচারের বিষয়টি উত্থাপন করবার মনস্থ করলেন, যাতে এটি ভারতের রাজনৈতিক আন্দোলনের অন্যতম একটি ইস্যু হতে পারে। “কিন্তু সেই সময়ে কংগ্রেসের যা চরিত্র তা সাধারণ ব্রাহ্মসমাজের মতো প্রগতিশীল বা সাম্যবাদী চিন্তার ধারক ও বাহক সংগঠনের সঙ্গে তাদের পার্থক্য হতে বাধ্য।”৩০ যথারীতি চা-শ্রমিক প্রসঙ্গটি প্রাদেশিক আখ্যা দিয়ে এড়িয়ে গেলেন জমিদার ও পুঁজিপতি শ্রেণীর প্রতিভূ সর্বভারতীয় নেতারা। পরের বছর প্রথম বঙ্গীয় প্রাদেশিক সম্মিলনে সভাপতি ছিলেন প্রখ্যাত ডাক্তার মহেন্দ্রলাল সরকার। এই অধিবেশনে শ্রীহট্ট অঞ্চলের প্রতিনিধি এবং সাধারণ ব্রাহ্মসমাজের সদস্য বিপিনচন্দ্র পাল বিষয়টি উত্থাপন করলে দ্বারকানাথকে এবিষয়ে আলোকপাত করতে অনুরোধ করা হয়। দ্বারকানাথ কুলিদের শোষণের বিষয়ে বিস্তারিত বক্তৃতা প্রদান করেন ও সেখানে উপস্থিত সকলকে বোঝাতে সক্ষম হন যে এই সমস্যাকে প্রাদেশিক আখ্যা দেওয়া আদতে ভ্রান্ত ধারণা। সভায় ১৮৮৭ সালের কংগ্রেস অধিবেশনের সিদ্ধান্তের সমালোচনা করা হয় ও কুলিদের বিষয়টিকে জাতীয় স্তরের সমস্যা হিসেবে গণ্য হয়। এই প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য, এর পরেও চা-শ্রমিক সমস্যা জাতীয় স্তরে স্বীকৃতি পেতে আরও বছর কয়েক সময় লাগে। অবশেষে ১৮৯৬ সালে কংগ্রেসের কলকাতা অধিবেশনে কুলি সমস্যাকে জাতীয় স্তরের সমস্যার স্বীকৃতি দেওয়া হয়। ১৮৮৮ সালের প্রাদেশিক সম্মেলনে বিপিনচন্দ্র একটি তদন্ত কমিশন গঠনের প্রস্তাব করেন সরকারের কাছে। ব্রিটিশ সরকার কমিশন গঠনের কথা চিন্তা করলেও তাতে ভারত সভার প্রতিনিধি নিতে রাজি হল না।
ধীরে ধীরে দিন বদলাতে লাগল। ১৮৯০ সালে ‘আসাম ইমিগ্রেশন বিল’-এর কয়েকটি ধারা বদলাবার জন্য কমিশন গঠন করল সরকার। কমিশন ১৮৯৪ খ্রিস্টাব্দে সিলেট ও কাছাড় জেলা ব্যতীত অসমের সর্বত্র চুক্তিবদ্ধ কুলি নিয়োগের বিরুদ্ধে মত প্রকাশ করল। ১৮৯৬ খ্রিস্টাব্দের ৩রা ডিসেম্বর ভারত সভার পক্ষ থেকে সরকারের কাছে কমিশনের সুপারিশগুলি কার্যকর করবার দাবি জানানো হল। আগেই জানিয়েছি, ওই বছরই জাতীয় কংগ্রেসের কলকাতা সম্মেলনে কুলি সমস্যা নিয়ে আলোচনার প্রস্তাব গৃহীত হল মুলত দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায়, বিপিনচন্দ্র পাল, যোগেন্দ্রচন্দ্র ঘোষ ও রজনীকান্ত সরকার প্রমুখের প্রচেষ্টায়। এরপর স্যার হেনরী কটন অসমের চিফ কমিশনার থাকাকালীন ব্যক্তিগত প্রচেষ্টায় কয়েকটি ব্যবস্থা নিলেন যাতে কুলিদের অবস্থার খানিকটা হলেও উন্নতি হল। অবশেষে ১৯০১ খ্রিস্টাব্দে ‘আসাম লেবার এ্যান্ড ইমিগ্রেশন অ্যাক্ট’ পাশ হল, এতে কুলিদের আরও কিছু অধিকার স্বীকৃত হল। তবে ততদিনে দ্বারকানাথের মৃত্যু ঘটেছে। শিবনাথ শাস্ত্রী অত্যন্ত আক্ষেপ করে বলেছিলেন, “গবর্ণমেন্ট কুলী আইনের সংশোধন করিতে প্রবৃত্ত হইলেন। কিন্তু ঐ আইন সংশোধন করিয়াও এক্ষণে যাহা আছে তাহাও নির্দোষ নহে। এখনও হতভাগ্য কুলীগন না জানিয়া আপনাদিগকে দাসত্বে বিক্রয় করিয়া বন্দীদশাতে দিন যাপন করিতেছে। আর দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায় নাই, তাহাদের জন্য কাঁদিবার লোকও নাই।”৩১
রাজনীতির ক্ষেত্রেও নারীর অধিকার নিয়ে আন্দোলন শুরু করেন দ্বারকানাথ। আমরা আগেই দেখেছি, তিনি ভারত সভা এবং ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। কংগ্রেসের অধিবেশনে তিনি মহিলাদের প্রতিনিধিত্বের দাবি তুলেছেন একাধিকবার। এর ফলস্বরূপ ১৮৮৯ খ্রিস্টাব্দে ছয়জন মহিলা বোম্বাইতে জাতীয় কংগ্রেসের পঞ্চম অধিবেশনে যোগ দেওয়ার সুযোগ পান। কাদম্বিনী গাঙ্গুলী এবং স্বর্ণকুমারী বসু যুগ্মভাবে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের অধিবেশনে বাংলার প্রতিনিধিত্ব করেন।
প্রকৃতপক্ষে দ্বারকানাথ ছিলেন রাষ্ট্রগুরু সুরেন্দ্রনাথ বন্দোপাধ্যায়ের দক্ষিণহস্ত-স্বরূপ। সুরেন্দ্রনাথ তাঁর ‘এ নেশন ইন মেকিং’ গ্রন্থে দ্বারকানাথ সম্বন্ধে মন্তব্য করেছিলেন, “Associated with us in our efforts to organise a new Association upon popular lines was a devoted worker, comparatively unknown then, and, I fear, even now, whose memory deserves to be rescued from oblivion … His co-operation in the organisation of the new Association was of great value to us; and so long as health and strength were spared to him, he worked in the cause of the Association with an energy and devotion, the memory of which, now that he is dead, his friends cherish with affectionate gratitude.”৩২
দ্বারকানাথ কেবল সমাজ সংস্কার এবং রাজনীতি চর্চাতেই জীবন অতিবাহিত করেন নি; সাংবাদিকতা ছাড়াও সাহিত্যক্ষেত্রে তাঁর দান বিপুল না হলেও অকিঞ্চিৎকর নয়। তিনি কোনোদিনই নামের কাঙাল ছিলেন না, অধিকাংশ গ্রন্থে ও প্রবন্ধে লেখক হিসেবে তাঁর নামের উল্লেখ নেই। তার রচিত ও সংকলিত উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ হল, বীর নারী (নাটক), পদ্যমালা, নববার্ষিকী (বাংলা ভাষায় সর্বপ্রথম ইয়ার বুক), জাতীয়সংগীত (সংগৃহীত স্বদেশী গানের সংকলন), জীবনালেখ্য (দুর্গামোহন দাসের পত্নী ব্রহ্মময়ীর জীবনচরিত), সুরুচির কুটির (উপন্যাস) এবং কবিগাথা, সরল পাটিগণিত, ভূগোল, স্বাস্থ্যতত্ত্ব প্রভৃতি কয়েকটি পাঠ্যপুস্তক।
শেষ জীবনে দ্বারকানাথ যকৃতের অসুখে ভুগেছিলেন। ১৮৯৮ সালের জুন মাসে এই অসুখ গুরুতর আকার ধারণ করে এবং ২৭শে জুন (১৩ই আষাঢ়, ১৩০৫ বঙ্গাব্দ) শেষরাত্রে মাত্র ৫৪ বছর বয়সে এই তেজস্বী পুরুষের প্রয়াণ ঘটে। তাঁর মৃত্যুর পর ২রা জুলাই সঞ্জীবনী পত্রিকা লিখেছিল, “আমাদের এই কৃত্রিমতাপূর্ণ ও ছায়াময় জগতে একজন খাঁটি মানুষ আসিয়াছিল, এরূপ মানুষ মধ্যে মধ্যে না আসিলে জগৎ মাটি হইয়া যাইত।”৩৩
দ্বারকানাথ গান লিখতে বড় ভালোবাসতেন। তাঁর সম্পূর্ণ জীবনদর্শনের ব্যাখ্যা বোধহয় এই একটি গানের মাধ্যমেই তিনি প্রকাশ করে গেছেন –
“না জাগিলে সব ভারত ললনা
এ ভারত আর জাগে না জাগে না।”
তথ্যসূত্র :
১) বাহ্য বস্তুর সহিত মানবপ্রকৃতির সম্বন্ধবিচার প্রথম ভাগ, অক্ষয়কুমার দত্ত, তত্ত্ববোধিনী মুদ্রাযন্ত্র, পৃষ্ঠা ১৮৯
২) প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ১৯০
৩) প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ১৯৩
৪) বাবু অক্ষয়কুমার দত্তের জীবন-বৃত্তান্ত, মহেন্দ্রনাথ রায়, সংস্কৃত পুস্তকালয়, পৃষ্ঠা ১১৮
৫) প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ১১৯
৬) সাহিত্য সাধক চরিতমালা ৮০, ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দোপাধ্যায়, বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ, পৃষ্ঠা ৮
৭) রামতনু লাহিড়ী ও তৎকালীন বঙ্গসমাজ, শিবনাথ শাস্ত্রী, এস কে লাহিড়ী এণ্ড কোং, পৃষ্ঠা ৩৪২
৮) সাহিত্য সাধক চরিতমালা ৮০, ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দোপাধ্যায়, বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ, পৃষ্ঠা ১০
৯) রামতনু লাহিড়ী ও তৎকালীন বঙ্গসমাজ, শিবনাথ শাস্ত্রী, এস কে লাহিড়ী এণ্ড কোং, পৃষ্ঠা ৩৪২
১০) প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ৩৩৭
১১) সাহিত্য সাধক চরিতমালা ৮০, ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দোপাধ্যায়, বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ, পৃষ্ঠা ১৩
১২) নারী প্রগতির পথিকৃৎ দ্বারকানাথ ও কাদম্বিনী গঙ্গোপাধ্যায়, পূরবী বসু, জাগরণীয়া, ৮ মে ২০১৭
১৩) একলা চলো রে, ডা. শামসুল হক, আনন্দবাজার পত্রিকা, ১৫, জুলাই, ২০১৭
১৪) টাট্টু ঘোড়ার গাড়িতে চেপে ‘কল’-এ যেতেন, বিবেকানন্দ ব্যানার্জী, আনন্দবাজার পত্রিকা, ১১ মে, ২০১৯
১৫) প্রাগুক্ত
১৬) উনিশ শতকের নারীমুক্তি আন্দোলন ও বাংলা সাহিত্য, রণজিৎ বন্দোপাধ্যায়, পুস্তক বিপনি, পৃষ্ঠা ২৩
১৭) নারী প্রগতির পথিকৃৎ দ্বারকানাথ ও কাদম্বিনী গঙ্গোপাধ্যায়, পূরবী বসু, জাগরণীয়া, ৮ মে ২০১৭
১৮) প্রাগুক্ত
১৯) টাট্টু ঘোড়ার গাড়িতে চেপে ‘কল’-এ যেতেন, বিবেকানন্দ ব্যানার্জী, আনন্দবাজার পত্রিকা, ১১ মে, ২০১৯
২০) প্রাগুক্ত
২১) রামতনু লাহিড়ী ও তৎকালীন বঙ্গসমাজ, শিবনাথ শাস্ত্রী, এস কে লাহিড়ী এণ্ড কোং, পৃষ্ঠা ৩৪৫
২২) সাহিত্য সাধক চরিতমালা ৮০, ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দোপাধ্যায়, বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ, পৃষ্ঠা ২১
২৩) রামতনু লাহিড়ী ও তৎকালীন বঙ্গসমাজ, শিবনাথ শাস্ত্রী, এস কে লাহিড়ী এণ্ড কোং, পৃষ্ঠা ৩৪৫
২৪) আত্মচরিত : শিবনাথ শাস্ত্রী, গৌতম নিয়োগী সম্পাদিত, সাধারণ ব্রাহ্মসমাজ, পৃষ্ঠা ৫৪১
২৫) প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ৫৪১
২৬) সাহিত্য সাধক চরিতমালা ৮০, ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দোপাধ্যায়, বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ, পৃষ্ঠা ১৭-১৮
২৭) আত্মচরিত : শিবনাথ শাস্ত্রী, গৌতম নিয়োগী সম্পাদিত, সাধারণ ব্রাহ্মসমাজ, পৃষ্ঠা ৫৪১
২৮) রামতনু লাহিড়ী ও তৎকালীন বঙ্গসমাজ, শিবনাথ শাস্ত্রী, এস কে লাহিড়ী এণ্ড কোং, পৃষ্ঠা ৩৪৪
২৯) আত্মচরিত : শিবনাথ শাস্ত্রী, গৌতম নিয়োগী সম্পাদিত, সাধারণ ব্রাহ্মসমাজ, পৃষ্ঠা ৫৪৪
৩০) প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ৫৪৫
৩১) রামতনু লাহিড়ী ও তৎকালীন বঙ্গসমাজ, শিবনাথ শাস্ত্রী, এস কে লাহিড়ী এণ্ড কোং, পৃষ্ঠা ৩৪৪
৩২) সাহিত্য সাধক চরিতমালা ৮০, ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দোপাধ্যায়, বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ, পৃষ্ঠা ২০
৩৩) প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ৪২
বেশি বেশি করে লেখাটি সাধারণ মানুষের মধ্যে শেয়ার করা উচিত। রবীন্দ্রনাথ নাথ ঠাকুর তাঁর সময়কার অনেক মনিষীকে নিয়ে প্রবন্ধ লিকেছেন । কিন্তু দ্বারাকানাথ গাঙ্গুলি কে নিয়ে কোনও লেখা নজরে আসে নি । কাদম্বিনী গাঙ্গুলি ভারতের প্রথম মহিলা পেশাদার ডাক্তার ছিলেন । কিন্তু তাঁকে নিয়েও কোনও আলোচনা পাই নি যদিও দুজনেই একই সময়ে জন্মেছিলেন ও কলকাতা ছিল কর্মকেন্দ্র । কারণ কি হতে পারে ?
এমন” অবাল বান্ধব ” পথিকৃৎ এর কথা আরও বেশী করে মানুষ জানুক,কেবল আমাদের মত পড়ুয়ারা না।এই আশা রেখে শ্রদ্ধা জ্ঞাপন।
দ্বারকানাথ যত চর্চিত হবেন ততই তাঁর আদর্শ মানুষের মনকে সচেতন করবে,যুক্তি ও বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গিতে আত্মোপলব্ধির বিকাশ হবে।একামেবাদ্বিতীয়ম অনন্ত-অপার শক্তি আমাদের অন্তরাত্মায় অনুভূত হবেন।
এই ব্লগটি অনেক কষ্ট করে পেলাম । এত সুন্দর লেখা সত্যি কম । ভালো লাগলো । আপনি আরো লিখুন । আমার সাথে যোগাযোগ করলে কৃতজ্ঞ থাকবো