ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির জন্ম ও চেচাখাতা গড়ের গপ্পো
ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির নাম শুনেছেন তো! সেই কোম্পানি যারা প্রায় গোটা ভারতীয় উপমহাদেশকে কব্জা করে রেখেছিল একশো বছর; সেই কোম্পানি গোটা পৃথিবী জুড়ে যার সাম্রাজ্য ছিল- সেই ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির জন্মই নাকি হয়েছিল আমাদের এই বাংলার কোন এক অখ্যাত অঞ্চলের রাজধানী আর হাট-বাজারকে সাক্ষী করেই! কী, বিশ্বাস হচ্ছে না তো?
আচ্ছা, আর একটা কুলু দিতাশি। আজ আপনাদের একটা গল্প শোনাই, লোম খাড়া করে দেওয়া সিনেমার গল্প। গল্পের নায়ক বছর তিরিশের এক দুঃসাহসিক যুবক। পর্তুগিজ জলদস্যুদের ভয়ে ইউরোপ থেকে ভারতে আসার জলপথ তখন প্রায় বন্ধ। মহারানী এলিজাবেথ সেই দুঃসাহসী যুবকের কাঁধে দিলেন এক গুরুদায়িত্ব। ভারতে পৌঁছতে হবে, দেখা করতে হবে মোগল সম্রাট আকবরের সাথে। দলবল নিয়ে সেই যুবক ভূমধ্যসাগর পার হয়ে চলে এলেন আজকের লোহিত সাগরের উপকূলে। ধরা পড়লেন পর্তুগিজ শাসকদের হাতে, বন্দি হিসেবে পা রাখলেন গোয়ার মাটিতে। শুরু হলো বন্দিজীবন। কয়েক বছর বন্দিজীবন কাটাতে কাটাতে সেই যুবক করলেন পরিকল্পনা, বুঝে নিলেন মানচিত্র। তারপর একদিন আরো দুই সঙ্গীকে নিয়ে পায়ে হেঁটে নদী আর পাহাড় পেরিয়ে পালিয়ে গেলেন সুলতানি রাজত্বে। বিভিন্ন শহর ঘুরে বাণিজ্য করতে করতে একদিন পৌঁছলেন সম্রাট আকবরের সামনে। এলিজাবেথ-এর দেওয়া চিঠি পৌঁছলো আকবরের হাতে। সেই যুবক এরপর চললেন প্রাচ্যের বাজার খতিয়ে দেখার কাজে। পৌঁছে গেলেন সেখানে, আজকের ভারত, মায়ানমার, চীন ও ভুটানের দুয়ার যেখানে খুলে যায়। নিলেন বাণিজ্য ও বাজারের সুলুকসন্ধান। পেলেন রাজকীয় খাতির। বহু বছর পর সেই যুবক যখন ফিরলেন ইংল্যান্ডে, তার পরামর্শে গড়ে উঠলো গোটা দুনিয়া শাসন করা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি! আমৃত্যু ছিলেন তার পরামর্শদাতা।
কি? মনে হচ্ছে হলিউড-বলিউডের কোন সিনেমা? বিশ্বাস করুন, এই গোটা ঘটনার আদ্যোপান্ত নিখাদ সত্যি। যা সিনেমার রুপোলী-পর্দার গল্পকেও অনায়াসে হারিয়ে দিতে পারে। দুঃসাহসী যে যুবকের হাত ধরে গড়ে উঠেছিল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি, সেই যুবকের নাম রালফ ফিচ। যে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি আমাদের দেশকে শাসন করেছে শতাব্দী জুড়ে, সেই কোম্পানির জন্মদাতা তিনি। এখানেই শেষ নয়, পৃথিবীজুড়ে রাজ্য ছিল যে ইন্ডিয়া কোম্পানির, তার সূত্রপাত হয়েছিল এই বাংলার উত্তর প্রান্তের এক দুর্গ নগরীতে। সেই বন্দর নগর আজ ধ্বংসপ্রাপ্ত।
আজ আপনাদেরকে নিয়ে যাব আলিপুরদুয়ার জেলার চেচাখাতা গড়ে, যেখানে রাজা অভ্যর্থনা জানাবেন রালফ ফিচকে। প্রাচ্যের বিভিন্ন দেশের বাণিজ্য সম্ভাবনা খতিয়ে দেখে, বিভিন্ন দেশের বাণিজ্য দ্রব্যগুলির পর্যালোচনা করে যেখানে প্রথম বীজ বপন হবে ইন্ডিয়া কোম্পানির।
যাত্রা শুরু:
১৪৯৮ সালে ভাস্কো দা গামা আবিষ্কার করলেন জলপথে ইউরোপ থেকে ভারতে আসার রাস্তা। উত্তমাশা অন্তরীপ পেরিয়ে সে পথের সন্ধান ইউরোপীয় জাতিগুলির মনে এঁকে দিল উত্তম ‘আশা’র স্বপ্ন। সোনার ভারতের সাথে ব্যবসা-বাণিজ্য করে ফুলে-ফেঁপে ওঠার সম্ভাবনা হু হু করে ছড়াতে লাগলো গোটা ইউরোপের রাজদরবারগুলিতে। অন্যরা যাতে আগেভাগে ভোজসভায় পৌঁছে খাতির যত্ন না পায়, তাই জলপথে কড়া পাহারার ব্যবস্থা বসলো। পর্তুগিজ জলদস্যুদের তরফে বকলমে রাজশক্তির তরফেই। ঠিক যেমনটি হয়েছিল কলম্বাসের আবিষ্কার করা আমেরিকা পৌঁছানোর রাস্তা আটকানোর জন্য স্পেনীয় জলদস্যুদের আক্রমণে। প্রমাদ গুণল ইংল্যান্ড ফ্রান্স ও ডাচরা। ভারতে যেকরেই হোক পৌঁছতেই হবে। দুঃসাহসী ইংরেজ বণিকরা এনে দিলেন একটি বিকল্প পথের সন্ধান। উদ্যোগী হল ইংল্যান্ডের বণিকসভা। সলতে পাকাতে ততদিনে কেটে গেছে দীর্ঘ কয়েক দশক। ইংল্যান্ডের সিংহাসনে তখন মহারানী এলিজাবেথ। সময়টা ষোড়শ শতাব্দীর মাঝামাঝি প্রায়। ইংল্যান্ডের বণিকসভা মরিয়া হয়ে এক অগ্রণী প্রতিনিধি দল পাঠাতে চাইলেন ভারতের উদ্দেশ্যে, যে দল সারা ভারত ঘুরে দেখবে; পর্যালোচনা করবে বাণিজ্য সম্ভাবনার। বিবেচনা করবে ভবিষ্যৎ বাজার বা সাম্রাজ্যের সম্ভাবনার।
স্বয়ং মহারানী এলিজাবেথ প্রতিনিধি দলের হাতে তুলে দিলেন মোগল সম্রাট আকবরকে লেখা চিঠি। স্থাপিত হোক ইংল্যান্ড ও মোগল সাম্রাজ্যের মধ্যে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ। দীর্ঘ পথ। ইংল্যান্ড থেকে ভূমধ্যসাগর পার হয়ে এসে অভিযান পৌঁছলো আজকের মধ্যপ্রাচ্যের বন্দর ত্রিপোলিতে। সুয়েজ খাল তখনো বাস্তবের রূপ দেখনি। নইলে সে পথে লোহিত সাগর, আরব সাগর হয়ে চলে আসা যেত ভারত উপকূলে। ত্রিপোলি থেকে তাই অনেকগুলি বিকল্প। আরবের মরুভূমি – ইরান পার হলেই পৌঁছানো যাবে কাবুলে, সেটাই তখন মুঘল সাম্রাজ্যের সীমানা। অন্যপথ সেই মরুভূমির বুক চিরে লোহিত সাগর হয়ে ভারতের পশ্চিম উপকূল। অভিযাত্রী দল প্রস্তুত হলেন। দলের নেতৃত্ব দেওয়া হল অভিযাত্রী অভিজ্ঞ ব্যবসায়ী জন নিউ বেরিকে, যিনি আরবি ভাষা পর্যন্ত জানেন! দলের বাকি তিনজন ছিলেন দুঃসাহসী অভিযাত্রী, বুদ্ধিমান, অবিবাহিত, বছর তিরিশের উদ্যমী যুবক রালফ ফিচ, রত্ন বিশেষজ্ঞ উইলিয়াম লিডস এবং শিল্পী জেমস স্টরি।
রাজপ্রাসাদ থেকে জেলের গরাদ:
১৫৮৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে, টাইগার জাহাজে এই প্রতিনিধি দল লন্ডন ছাড়লেন এবং ত্রিপোলি বন্দরে পৌঁছলেন ৩০ এপ্রিল তারিখে। এরপরেই অভাবিত বিপদ! বাগদাদ হয়ে হরমুজে আসার পর ফিনিশিয় বণিকদের ষড়যন্ত্রে তাদের বন্দি করলেন পর্তুগিজ শাসনকর্তা । ১১ অক্টোবর তাদের ১১৪টি ঘোড়া আর প্রায় ২০০ জন যাত্রীর সঙ্গে জাহাজে করে বিচারের জন্য পাঠিয়ে দেওয়া হল পর্তুগীজদের প্রধান শাসনকর্তার কাছে। ১৫৮৩ সালের ২৯ নভেম্বর ভারতের গোয়ার মাটিতে প্রথম পা রাখলেন বন্দী হিসেবে, স্থান হল গোয়ার জেলখানার স্যাঁতস্যাঁতে কুঠুরিতে। পড়ে রইল মহারানী এলিজাবেথের দেওয়া চিঠি, সঙ্গে লোকানো রইল ব্যয় নির্বাহের জন্য ইংল্যান্ডের বণিকসভার দেওয়া মূল্যবান কিছু রত্নও।
পাদ্রিদের চেষ্টায় জেলখানা থেকে নজরবন্দি হিসেবে গোয়ায় থাকবার জন্য শর্তসাপেক্ষে মুক্তি পেলেন। যাদের কাঁধে বিশ্বজয়ের দায়িত্ব, যাদের হাতে গড়ে উঠবে আগামী দিনের বিশ্বের মানচিত্র গঠনের ক্ষমতা, তাদের কি বন্দি করে রাখা সম্ভব! তিনজন বন্দি অত্যন্ত বাধ্য ও অনুগত রূপে ঘোরাঘুরি করতে লাগলেন আর আশেপাশের রাজ্যগুলি সম্বন্ধে খোঁজখবর নিতে লাগলেন। গঠন করলেন পরিকল্পনা, বিশ্লেষণ করে নিলেন আশেপাশের রাজ্যগুলির অবস্থান মানচিত্র। কেটে গেল বছর। পাহারাদারদের নজরদারিও হয়ে এল শিথিল। দিনের পর দিন চলল বন্দিদের গোপন শলাপরামর্শ। ধীরে ধীরে সমস্ত মালপত্র বিক্রি করে সংগ্রহ করতে লাগলেন সহজে বহনযোগ্য মূল্যবান রত্ন। অবশেষে ৫ এপ্রিল ১৫৮৪, তারা সকালবেলা ঘুরতে বেরুলেন এবং পায়ে হেঁটে পাশের প্রায় শুকনো নদী পেরিয়ে দুই দিন ধরে হাঁটতে হাঁটতে পর্তুগীজদের গোয়ার সীমান্ত পেরিয়ে বিজাপুরের সুলতান কুতুব শাহের রাজ্যের বেলগাঁও শহরে পৌঁছে গেলেন স্বাধীন নাগরিক হিসেবে। আবার শুরু করলেন তাদের আসল কাজ, গোটা ভারতবর্ষে বাণিজ্য সম্ভাবনা খতিয়ে দেখা এবং রাজশক্তির সাথে যোগাযোগ স্থাপন। এক বিপদসংকুল যাত্রা, অচেনা বিদেশ-বিভূঁইয়ে অচেনা শাসকদের সাথে অচেনা জাতিগোষ্ঠীর সাথে যাত্রা। পৌঁছলেন বিজাপুর গোলকুণ্ডা বন্দর। আবার এগিয়ে চলা। এরপর মধ্য ভারতের উজ্জয়িনী হয়ে, ততদিনে নেমেছে বর্ষা; নদীগুলি হয়েছে ভীষণ, যমুনা নদীর তীরের আগ্রায় পৌঁছলেন সেপ্টেম্বর মাসে। তারপর আগ্রা থেকে পৌঁছলেন সম্রাট আকবরের নতুন রাজধানী ফতেপুর-সিক্রি তে। ইংল্যান্ডের রানী এলিজাবেথের চিঠি অবশেষে পৌঁছলো মোগল সম্রাট আকবরের হাতে।
বাংলার দুয়ারে দুয়ারে:
প্রথম ইংরেজ অভিযাত্রী দল হিসেবে সাদর অভ্যর্থনা করলেন মহামতি আকবর। রাজধানীতে থাকার ব্যবস্থা করলেন তিনি। কিছুদিন বিশ্রাম নিয়ে প্রতিনিধি দলের নেতা জন নিউ বেরি সিদ্ধান্ত করলেন ইংল্যান্ডে ফিরে যাবেন এবং ইংল্যান্ডের বণিকসভাকে জানাবেন তাদের অভিযান সম্পর্কে, ব্যবসা বাণিজ্যের সম্ভাবনা সম্পর্কে এবং রাস্তাঘাটের অবস্থা সম্পর্কে। স্থির করলেন কনস্টান্টিনোপল হয়ে দেশে ফিরবেন। ২৮ ফেব্রুয়ারি ১৫৮৫ সালে নিউ বেরি লাহোরের পথে পা বাড়ালেন। দুর্ভাগ্য তার! তিনি কখনোই আর ইংল্যান্ডে ফেরেননি। অনুমান করা হয় পাঞ্জাবের পথে তিনি ডাকাত দলের হাতে প্রাণ হারান। তবে কি নির্মূল হয়ে গেল এত দীর্ঘ অভিযান? তবে কি ভারতসহ প্রাচ্যের কোন খবরই পৌঁছাবে না আর ইংল্যান্ডের বণিকসভায়?
সৌভাগ্যবশত তা হয়নি। নায়ক দেশে ফিরে যাবার আগে পরবর্তী দলনায়ক নির্বাচিত করেছিলেন রালফ ফিচকে। নির্দেশ দিয়েছিলেন আগ্রা থেকে পৌঁছে যেতে বাংলায়, সেখান থেকে আজকের উত্তরবঙ্গ। দলনেতার শেষ নির্দেশ মতো তাই ফিচ বেরিয়ে পড়লেন বাংলার উদ্দেশ্যে। দীপাবলির পরে এক দিনে আগ্রা থেকে ১৮০টা বজরার এক সম্ভার নিয়ে পণ্যদ্রব্য বোঝাই করে, অভিজ্ঞ ব্যবসায়ী ফিচ যাত্রা করলেন বাংলার পথে। প্রয়াগ, বেনারস, পাটনা কেন্দ্রগুলোতে থামতে থামতে ঘাটে ঘাটে ছুঁয়েছে যাত্রা। চলতে লাগলো বেচাকেনা। পাঁচ মাস পরে পৌঁছলেন তৎকালীন বাংলার মোগল শাসনকেন্দ্র গঙ্গার তীরবর্তী বর্তমান মালদা জেলার তান্ডায়। সেখানে কয়েকদিন থেকে তিনি চললেন উত্তরদিকে, গন্তব্য ঐশ্বর্যশালী কোচ রাজধানী বন্দর-নগরী চেচাখাতা।
অথঃ দুয়ার কথা
কেন এলেন তিনি আজকের উন্নয়নের নিরিখে বঞ্চিত উত্তরবঙ্গের প্রান্তিক জনপদ চেচাখাতা? কি এই স্থানের গুরুত্ব? এ বিষয়ে সামান্য আলোকসম্পাত তাই অতি প্রয়োজনীয়। এখানেই আলোকসম্পাত প্রয়োজন ডুয়ার্স বা দুয়ার অঞ্চলের ভৌগোলিক গুরুত্ব অনুধাবনের। যিশুখ্রিস্টের জন্মের বহু আগে থেকেই এই ভৌগোলিক অঞ্চল এবং দুয়ারগুলির মধ্য দিয়ে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠী চলাচল করেছে একে অন্যের সাথে। পরিচিত হয়েছে ব্যবসা-বাণিজ্যের সম্ভার। চীন থেকে, তিব্বত থেকে, ভুটান থেকে, আজকের মায়ানমার থেকে পরিবাহিত হয়ে পৌঁছেছে মধ্য ভারতের সমভূমি অঞ্চলে, সেখান থেকে মরুভূমির পথে ইউরোপে। উত্তরবঙ্গের দুয়ারগুলি দিয়ে শতাব্দীর পর শতাব্দী চলেছে যে ব্যবসা-বাণিজ্য, জলপথে তা ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্ব জুড়ে। গোটা সমুদ্রের নাম হয়েছে বাংলার নামে। মধ্য এশিয়া, সিল্ক রুট হয়ে বাণিজ্য সম্ভার বাংলা হয়ে পৌঁছেছে তাম্রলিপ্ত সহ গঙ্গারিডি সভ্যতার বন্দরগুলিতে। সেখান থেকে জলপথে পাড়ি দিয়েছে ইউরোপে।
প্রাচীন দ্বারবঙ্গ বা দারভাঙ্গা যেমন মগধ সহ মধ্যভারত থেকে বঙ্গে প্রবেশের দুয়ার, তেমনই বিহারের পূর্ব প্রান্ত থেকে হিমালয়ের পূর্বসীমা পর্যন্ত চালু থাকা মোট আঠারোটি দুয়ার বা গিরিপথ ধরেই সুদূর প্রাচীনকাল থেকেই স্থলপথে যোগাযোগ বজায় থেকেছে দূরপ্রাচ্যের সাথে মধ্যপ্রাচ্য তথা ইউরোপের। এই প্রচলিত আঠারো দুয়ার এর মধ্যে এগারোটি রয়েছে মানস ও তিস্তা (প্রাচীন ত্রিস্রোতা) নদীর মাঝে; বাকি সাতটি আসামে মানস আর ধানসিঁড়ি নদীর মাঝে। বাংলার দুয়ারগুলির মধ্যে রয়েছে ডালিমকোট, ময়নাগুড়ি বা প্রাচীন যমের কোট, চামূর্চি (ভুটানে সামচি নামে পরিচিত), লকি, বক্সা বা পাশাখা, ভুলকা, বারা, গোমর, রিপো, চেরাং এবং বাগ (ছোট বিজনি)। আসামের সাতটি দুয়ারের মধ্যে দুটি দারং জেলায়। বাকি পাঁচটি উজানী অসম হয়ে অরুণাচলের দিকে বিস্তৃত।
যিশুখ্রিস্টের জন্মের বহু শতাব্দী আগে থেকেই এই দুয়ারগুলিকে কেন্দ্র করে সিল্করুট প্রসারিত হয়েছে। পণ্যবাহী দল মহাদেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে পাড়ি দিয়েছে। বৌদ্ধ শ্রমণের দল এই পথ দিয়েই জ্ঞান ও সংস্কৃতির প্রদীপ নিয়ে পৌঁছেছেন মহাদেশের এক অংশ থেকে অন্য অংশে। গোটা উপমহাদেশের বাণিজ্য সম্ভাবনা বুঝতে তো তাই এ পথের গুরুত্ব সর্বাধিক।
প্রাচীনকাল থেকেই এই অঞ্চলে উৎপাদিত কার্পাস বস্ত্র সহ অন্যান্য বনজ সম্পদের খ্যাতি মোহিত করেছে গোটা ভারতবর্ষকে। ব্রহ্মপুত্র নদের ধারে বালুকা থেকে স্বর্ণরেণু উৎপাদন বা প্রাচীন করতোয়ার বুক থেকে তুলে আনা মুক্ত, পরিণত হয়েছে লোকশ্রুতিতে। অশোকের সময়ের মহাস্থানগড় হোক বা বাসুবিহার, পাহাড়পুর মহাবিহার থেকে বৌদ্ধ শ্রমণদের ভোট তিব্বতে আসা যাওয়া- প্রাচীনকাল থেকেই এই অঞ্চল হয়ে থেকেছে যোগাযোগের প্রধান সেতু। সপ্তম শতাব্দীতে মহাকবি বানভট্ট রচিত হর্ষচরিত পাঠ করলেই আমরা বুঝে নিতে পারি এই অঞ্চলের বিপুল পণ্যসামগ্রীর কথা। কামরূপরাজ ভাস্করবর্মা হর্ষবর্ধনকে যে সমস্ত দ্রব্য উপহার প্রেরণ করেছিলেন, তা আজও যেকোনো মাল্টিন্যাশনালকে চমকে দেবে – ‘বরুনদেবের নিকট হইতে তাহার পূর্বপুরুষগণের উপার্জিত আভোগ নামক ছত্র, ভগদত্ত প্রভৃতি রাজগণ হইতে উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত অলংকার, পদ্মরাগমণিখচিত মুক্তাহার, শুভ্র ক্ষমবস্ত্র, শুক্তিশঙ্খমরকতাদিবিনির্মিত পানপাত্র, সুবর্ণখচিত মহার্ঘ মৃগচর্ম, ভূর্যত্বক সদৃশ কোমল এবং সুখস্পর্ষচিত্রিত বিবিধ উপাদান, পিঙ্গল বর্ণ সুন্দর বিবিধ বেত্রাশন, কৃষ্ণগুরু তৈল, পক্ক ও অপক্ক গুবাক, অগুরুত্বকে লিখিত সুপাঠ্য কাব্য পুস্তকসমূহ, পল্লব যুক্ত বিবিধ সরস ফল, বীণার নিম্নভাগস্থ অলাবু বন্ধন এর উপযুক্ত কৌবের সূত্র, ঘোর কৃষ্ণবর্ণের অগুরু, গোশির্ষচন্দন, তুষারশুভ্র কর্পূর, স্বর্ণশৃঙ্খলিত কণ্ঠ শুক শারি, প্রবাল পাথর, কস্তুরীকাকোষ, মুক্তা খচিত স্থল মিথুন ও জল মিথুন ইত্যাদি’।
‘কোচবিহারের ইতিহাস’ নামক গ্রন্থ থেকে জানা যায়- “প্রথম শতাব্দীর গ্রিক বণিকদিগের লিখিত বিবরণে, এদেশের শিল্পবাণিজ্যের তৎকালিক অবস্থা সংক্ষেপে বর্ণিত হইয়াছে। তাহারা লিখিয়াছেন যে, ‘কিরাদীয়া’ প্রদেশের তেজপত্র তাম্রলিপ্ত বন্দর হইতে ইউরোপে প্রেরিত হয়; উক্ত দেশের সীমান্তে প্রতি বৎসর একটি করিয়া মেলা বসিয়া থাকে, তথায় চীন দেশীয় বণিকেরা আসেন এবং তাহারা রেশমি কাপড় এবং রেশমের পরিবর্তে তেজপত্র লইয়া যান। ঐতিহাসিক বুশেলের মতে খ্রিস্টপূর্ব আনুমানিক পঞ্চম শতাব্দী হইতে ব্রহ্মদেশ এবং আসামের পথে ভারতবর্ষের সহিত চীনের বাণিজ্য দ্রব্যের আদান-প্রদান চলিত”। (পৃষ্ঠা- 53)
অতএব কোনো সন্দেহই নেই রালফ ফিচ রীতিমতো পরিকল্পনা করেই এসেছিলেন উত্তরবঙ্গের এই স্থানে। ব্যাবসায়িক দিক থেকে বহু শতাব্দীর ঐতিহ্যমণ্ডিত এবং অত্যন্ত সম্ভাবনাময় এই স্থানের সরেজমিনে পর্যবেক্ষণ করা ছিল তার জন্যে অতি প্রয়োজনীয় কার্য। বাণিজ্যের সম্ভাবনা খতিয়ে দেখার সাথে সাথে স্থানীয় রাজবংশ ও শাসকবর্গের সঙ্গে সদ্ভাব গড়ে তোলাও ছিল তার অন্যতম উদ্দেশ্য। তৎকালীন ভারতবর্ষে কোচরাজ্য ছিল অন্যতম সমৃদ্ধশালী। মোগল সম্রাট আকবরের সাথে সাক্ষাতের পরেই এই অঞ্চলে আসার ক্ষেত্রে মোগল দরবারে এই রাজ্য সম্পর্কে আলোচনা এবং পরিকল্পনা ফিচ রচনা করেছিলেন বলেই মনে করা যায়, তার কারণ মোগল দরবার তথা সম্রাট আকবরের সাথে রীতিমতো সুসম্পর্ক বজায় ছিল তৎকালীন কোচ রাজা নর নারায়ণের। ‘আকবরনামা’তে লিখিত রয়েছে নরনারায়ণ তৎকালীন সুবাদারের মাধ্যমে আকবরের উদ্দেশ্যে ৫৪টি হাতি সহ আরও বহুমূল্য নজর প্রদান করেছিলেন।
চেচাখেতায় ফিচ ও বিতর্ক
২৫ দিন ধরে নৌকা ভ্রমণ করে শেষ পর্যন্ত ফিচ এসে পৌঁছলেন পাহাড় ঘেরা কোচ রাজ্যের দুর্গ তথা বন্দরনগরী চেচাখেতায়। আসুন, ফিচের কোচদেশ ভ্রমণ কাহিনী শুনেনি তার কথাতেই: “কোচ রাজ্যের রাজা হিন্দু। তার নাম শুকেল কোচ। তার রাজ্য বেশ বড় এবং কোচিন চীন থেকে বেশি দূরে নয়। কারণ এই দেশের লোকেরা বলে সেখান থেকে গোলমরিচ আসে তাদের দেশে। এই দেশের বন্দর এর নাম চেচাখাতা বা চেছাগতা (Cacchegate)। এই দেশের বাড়িঘর বাঁশ আর বেত দু’দিকে সূচালো করে কেটে মাটিতে পুঁতে তার ওপর বানানো হয়, যাতে তার তলা দিয়ে বন্যার জল চলে যায়। তার নিচে হাঁটু পর্যন্ত জল জমে, তখন মানুষ বা ঘোড়া কেউ এ দেশে আসতে পারে না। যুদ্ধ বাধলে এরা জলে বিষ মেশায়। এখানে রেশম, মৃগনাভি এবং কার্পাস বস্ত্র প্রচুর পাওয়া যায়। এ দেশের কান প্রায় মানুষের হাতের পাতার মতো লম্বা(!), ছোট বয়স থেকেই তারা নানাভাবে কান বড় করার চেষ্টা করে। এদেশে সবাই হিন্দু এবং তারা কোন কিছুই হত্যা করে না। এদেশে ভেড়া, ছাগল, কুকুর, বেড়াল, পাখি এবং অন্যান্য প্রাণীদের জন্য চিকিৎসালয় আছে। জীবজন্তুর বয়স হয়ে গেলেও তারা তাদের যত্ন করে, আমৃত্যু পোষে। যদি কেউ কোন পশু পাখি অন্যত্র ধরে সেখানে নিয়ে আসে তারা মুদ্রা বা খাদ্যদ্রব্যের বিনিময়ে সেগুলি তাদের কাছ থেকে নিয়ে সেগুলিকে পশু চিকিৎসালয়ে ছেড়ে দেয়। এ দেশের লোকেরা কাঠবাদাম খায় আবার খুচরো পয়সা হিসেবেও ব্যবহার করে।”
“I went from Bengala into the the country of Couche, which lieth 25 days journey Northwards from Tanda. The king is a Gentile, his name is Suckal Counee; his country is great and lieth not far from Couchin china, for they say they have pepper from thence. The port is called Cacchegate. All the countrie is set with Bambos or canes made sharp at both ends and driven into the earth, and they can let in the water and drown the ground above knee deep, so that horses can pass. They poison all the waters if any wars be. Here they have much silk and muske, and cloth made of cotton. The people have eares which be marueilous great of a span long, which they draw out in length when they be young. Here they be all Gentiles, and they will kill nothing. They have hospitals for sheepe, goats, dogs, cats, birds and for all other living creatures.” Ralph Fitch, ( page- 111-112). (বানান অপরিবর্তিত রাখা হল) ।
এখানেই বাঁধে এক বিতর্ক। ফিচ বলছেন তার সময়ে কোচ রাজ্যের রাজার নাম শুক্লধ্বজ। ফিচ এর মতন একজন সন্ধানী অভিযাত্রী অপরিসীম গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যকেন্দ্রের রাজার নাম টুকু জানবেন না, বা ভুল জানবেন, এমনটা হয় না। কিন্তু মুশকিল হল শুক্লধ্বজ বা বিখ্যাত চিলারায় কোচবিহারের রাজনীতি ও ইতিহাসে কখনোই রাজা বলে চিহ্নিত হননি। তিনি সর্বদাই থেকেছেন রাজার বিশ্বস্ত সেনাপতি হিসাবে। এ প্রসঙ্গে ‘কোচবিহারের ইতিহাস’ গ্রন্থে আমানুল্লাহ খান গুরুতর আপত্তি তুলেছেন। তার বক্তব্য, “ফিচের লিখিত শুক্লধ্বজ রাজা ছিলেন না, অধিকন্তু ওই সময়ে (১৫৮৬ খ্রি.) তিনি জীবিতও ছিলেন না। তাহার পুত্র রঘুদেবনারায়ণ কর্তৃক ১৫৮৩ খ্রিস্টাব্দে হাজোর এবং ১৫৮৫ খ্রিস্টাব্দে পাণ্ডুর দেবমন্দির নির্মাণের বৃত্তান্ত ইতোপূর্বে লিখিত হইয়াছে। লোকের অর্ধ হস্ত দীর্ঘ কর্ণ, জীবহিংসা বিরোধী স্বভাব এবং ইতরপ্রাণীর প্রতি অহিংসার বৃত্তান্ত যাহা লিখিয়াছেন তাহা অশ্রুতপূর্ব, অসম্ভব এবং পর্যটক এর কাহিনী জাতীয় বলিয়া বোধ হয়”।
তবে এই প্রসঙ্গে সম্ভাব্য একটি সূত্র পাওয়া যায় একই লেখনি থেকে। আমানুল্লাহ খান বলছেন, “ইংরেজ বণিক ফিচ ১৫৮৬ খ্রিস্টাব্দে শুক্লধ্বজকে রাজা বলে উল্লেখ করিয়াছেন, কিন্তু তাহার এই উক্তি সত্য বলিয়া গৃহীত হইতে পারে না। তবে জীবদ্দশায় তিনি যুবরাজ বলিয়া পরিচিত থাকায় বৈদেশিক বণিক তাহাকে রাজা বলিয়া মনে করিতে পারেন” (pp-119)।
এ প্রসঙ্গে আমরা দেখে নিতে পারি এ বিষয়ে আর একটি গ্রন্থের সাক্ষ্য। ‘উত্তরবঙ্গের ইতিহাস’ নামক গ্রন্থ থেকে জানা যায় “রাজা নরনারায়ণ এই বিস্তৃত রাজ্য একা ভোগ করেননি। তিনি জ্যেষ্ঠ ভ্রাতাকে পশ্চিমভূমির শাসনকর্তা নিয়োগ করেন এবং পূর্বভূমির (কামরূপ সহ আসাম অঞ্চল) শাসনকার্য কনিষ্ঠ ভ্রাতার (শুক্লধ্বজ) হাতে অর্পণ করেন। কোচ রাজ্যের বিস্তারে সেনাপতি শুক্লধ্বজ এর ভূমিকা ও কৃতিত্ব সর্বাধিক। তার মত কুশলী যোদ্ধা এবং সফল সেনাপতি কোচ রাজবংশে কেউ কখনো জন্মাননি” (pp- 146)।
আকবরনামার সাক্ষ্য এবং কোচবিহারের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে এই প্রসঙ্গে আরেকটি আকর্ষণীয় বিষয় জানতে পারা যায়। তা হল শুক্লধ্বজ যে শুধুমাত্র যুবরাজ বা স্বাধীন রাজত্ব ভোগ করতেন তাই নয়, তার পুত্র রঘুদেব নারায়ণ রাজবংশের সিংহাসনে বসার যোগ্যতা পেয়েছিলেন। জানা যায় মহারাজ নরনারায়ণ তার ভাই শুক্লের পুত্র নারায়ণকে ছেলের মতোই স্নেহ করতেন এবং তাকে কোলে করে সময়ে সময়ে সিংহাসনে বসতেন। বার্ধক্যের প্রারম্ভ পর্যন্ত রাজার কোন পুত্রসন্তান জন্মগ্রহণ না করায় রঘুদেবের রাজা হবার সম্ভাবনা ছিল। এমনকি রাজা তাকে যুবরাজ পদে অভিষিক্ত করেছিলেন এবং তিনি পাটকুমার যুবরাজ বলে অভিহিত হতেন। কিন্তু যথাকালে রাজকুমার লক্ষ্মীনারায়ণ জন্মগ্রহণ করার ফলে এই ব্যবস্থা বাতিল হয়ে যায়। রাজবংশে বিবাদের সূত্রপাত ঘটে।
“At fifty years of age (Mal Gosain) nominated his brother’s son the Patkunwar as his successor. His eldest brother Shukl Gosain expressed a wish that he ( Mal Gosain) should marry and the latter out of love to him consented. He had a son to whom he gave the name of Lacsmi Narain. When he died, The kingdom came to him ( Lacsmi Narain)”. The Akbarnama, pp-1067.
নায়কের ঘরে ফেরা:
যাই হোক, চেচাখাতা থেকে ফিরে বাংলার নানা জায়গা ঘুরে তিনি বারোভূঁইয়ার অন্যতম চাঁদ রায়- কেদার রায় এর রাজধানী বিক্রমপুরের শ্রীপুর থেকে একটি জাহাজে করে পেগু বা বর্তমান মায়ানমারের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়েন। সেখান থেকে মালাক্কা প্রভৃতি দেশ ঘুরে আবার তিনি বাংলায় ফেরেন দু বছর বাদে। বাংলা থেকে তার দেশে ফেরার অভিযান শুরু হয় পরের বছর। সমুদ্র পথে সিংহল হয়ে কোচিন-এ যান, সেখানে কয়েক মাস থেকে দক্ষিণ ভারতের বিখ্যাত মশলাপাতি সম্বন্ধে অভিজ্ঞতা লাভ করে দোসরা নভেম্বর ১৫৮৯ সালে গোয়ার জাহাজে ওঠেন। সেখান থেকে বসরা বাগদাদ এবং তারপর মরুপথে ইউফ্রেটিস নদী পেরিয়ে উটের পিঠে করে ত্রিপোলিতে। সেখানে একটি ইংরেজ জাহাজ পেয়ে তাতে করে ১৫৯১ সালের ২৯ এপ্রিল লন্ডনে ফিরলেন আট বছর পরে।
ফিচকে ফিরে পেয়ে এবং বিস্তারিত বিবরণ শুনে ইংল্যান্ডের বণিকসভার সদস্যরা অত্যন্ত উৎসাহিত হয়ে পড়লেন। মধ্যপ্রাচ্য থেকে ভারতে যাবার বিভিন্ন পথ এবং ভারত থেকে বাংলার মধ্যে দিয়ে চীন, ভুটান ইত্যাদি হিমালয়ের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে বাণিজ্য সম্ভাবনার কথা বিশেষভবে জানতে পেরে তারা ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য উদগ্রীব হয়ে উঠলেন। এভাবেই জন্ম নিল ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পান – যার অন্যতম প্রধান পরামর্শদাতা হলেন স্যার রালফ ফিচ। এভাবেই ইংল্যান্ডের অত্যন্ত সম্মানীয় নাগরিক হিসেবে কাটিয়ে ১৬১১ খ্রিস্টাব্দে ফিচের জীবনাবসান ঘটে।
আজকের চেচাখেতাগড় হয়ে জয়ন্তীর পথে:
চলেছি আলিপুরদুয়ার শহর ছাড়িয়ে। গন্তব্য শামুকতলা জনপদের কাছে মহাকালগুঁড়ি। পথেই পেলাম গদাধরকে। এই সেই নদী যা বয়ে চলেছে চেচাখেতা বন্দর-নগরীর পাশ দিয়ে। আজও গদাধর স্থানীয় মানুষের কাছে খুবই পবিত্র স্রোতস্বিনী। বাৎসরিক গঙ্গাস্নানের হিড়িক পড়ে, স্থানীয় মন্দিরের মেলা বসে বিশাল বিশাল মহিরূহগুলিকে জড়িয়ে। পায়ে পায়ে দেখে নেওয়া সেই সমস্ত চিহ্নগুলিকে তারপর গদাধর ধরে এগিয়ে চলা আজকের চেচাখাতা মৌজার দিকে। শামুকতলা বাজার পেরিয়ে সড়কের পাশেই আজকের এই গড়ের ধ্বংসাবশেষ। গুগলের এই বাড়বাড়ন্তের যুগে আপনি উপগ্রহ মানচিত্র থেকেই দেখে নিতে পারবেন কি সুবিশাল অংশ নিয়ে আজও দাঁড়িয়ে আছে প্রাচীনকালের এই বন্দর নগরী। আকারে চতুষ্কোণ বর্গাকার, লম্বা ও চওড়া প্রায় এক কিলোমিটার করে । দু-দুটি সীমান্ত প্রাচীর (rampart) দিয়ে ভেতরের অংশটি সুরক্ষিত। শুরু হলো মাটির বিশাল স্তূপ জঙ্গল পেরিয়ে গড়ের রহস্যময় অন্দরে প্রবেশের চেষ্টা। বাইরের সীমান্ত প্রাচীর আজও ৮ থেকে ১০ ফুট উঁচু, বিশাল চওড়া প্রাচীর আজ বাঁধের মতন মানুষের চলার রাস্তা হিসেবে ব্যবহৃত। সেই বাঁধ ধরে এগিয়ে চলা ভিতরের সীমান্ত প্রাচীরের দিকে। সেটিও মাটি থেকে প্রায় আট দশ ফুট উঁচু। দুটি সীমান্ত প্রাচীরের মধ্যে আবার রয়েছে পরিখা ব্যবস্থা। বোঝাই যায় কত বিপুল আয়োজন ও পরিকল্পনা ছিল এই দুর্গের নিরাপত্তা ব্যবস্থার। ভিতরের কেন্দ্রীয় অংশে আজও উঁচু ঢিবি, স্থানীয়রা জানান কয়েক দশক আগেও এখান থেকে মাটি খুঁড়লেই বেরিয়ে আসতো প্রচুর পরিমাণে বেলেপাথরের স্তম্ভ, নকশা করা স্থাপত্য। সেসব ভুলে মাঝখানের অংশে আজ রবার চাষ করা হচ্ছে।
এই বন্দরনগরীর দু’পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে দুই নদী। এক পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে ছোট্ট নদী তুরতুরি, অন্য পাশ দিয়ে গদাধর। জয়ন্তী পাহাড় শাখা থেকে নেমে আসার পর আরো কিছু শাখা-প্রশাখায় মিলিত হয়ে ধামসাবাদে এসে সুগভীর গদাধর হয়ে বয়ে চলেছে। তুরতুরি আর গদাধর মিশেছে যেখানে, সেই গভীর স্থানেই প্রাচীনকালে গড়ে উঠেছিল প্রাচীন বন্দর নগরী। এটিই ছিল কোচ রাজ্যের প্রাচীন রাজধানী বা হিঙ্গুলাবাস।
শুধু কেন্দ্রীয় দুর্গ নয়; শামুকতলা থেকে আপনি যদি এগিয়ে চলেন হাতিপোতার দিকে, রাস্তার দু’পাশে হঠাৎ আবিষ্কার করবেন প্রায় ২৫ – ৩০ ফুট উঁচু মাটির সুবিশাল প্রাচীর বা মালি। একদিক থেকে আরেকদিকে বিস্তৃত রয়েছে। প্রাচীরের গায়ে গায়ে হাঁটতে থাকলে আপনি বুঝতে পারবেন প্রাচীনকালে এই প্রাচীর এক নদীর পাড় থেকে ছিল অন্য নদীর পাড় পর্যন্ত। এভাবেই রাজধানীর পিছনের অংশকে উত্তরের ভোট-তিব্বতীদের আক্রমণ থেকে সুনিশ্চিত নিরাপত্তা প্রদান করা হয়েছিল। কি বিপুল আয়োজন, বিপুল উদ্যোগ বহু শতাব্দী পরেও তা দেখে আপনি অবাক হবেনই।
বেলা শেষের কথা:
সীমানা প্রাচীরের আড়াল থেকে উঠছে বেপরোয়া নেশার ধোঁয়া। গড়ের বড় অংশজুড়ে আজ চলছে চাষবাস, গড়ে উঠেছে আস্ত একটা কলোনি। এই পটোটলা কলোনির মানুষ জানেন না কী বিপুল ঐতিহ্যশালী এই চেচাখাতা দুর্গনগরী! নিশ্চিত জানেন না বহু শতাব্দী আগে এক ইংরেজ যুবক প্রথম পৌঁছেছিলেন এই নদীবন্দরে, শুরু হয়েছিল এক নতুন ইতিহাস অধ্যায়।
এই চেচাখাতাগড় নিয়েই বারে বারে ঘটে গেছে নানা নাটকীয় কান্ড। বিশ্বাসঘাতকতা আর বীরত্বের সে নানা কাহিনী। মহারাজ উপেন্দ্র নারায়ণের আমল থেকেই একটি বাৎসরিক ভোজসভার আয়োজন হতো কোচ রাজা আর ভুটানের রাজার মধ্যে। মুঘলের বিরুদ্ধে ভুটানের সাহায্যে উপেন্দ্র নারায়ণের যুদ্ধজয়ের স্মারক হিসেবেই সম্ভবত এই সভা অনুষ্ঠিত হতো। ১৭৬৯ সালের সভা চিহ্নিত হয়েছে বিশ্বাসঘাতকতার জন্য। এই ভোজসভায় আমন্ত্রিত ভুটানের রাজা কোচরাজ রাজেন্দ্রনারায়ণকে কৌশলে বন্দি করেন। দ্রুত নিয়ে চলে যান ভোট সীমান্তের বক্সা দুর্গে। সেখান থেকে তৎকালীন ভোট রাজধানী পুনাখা। বন্দি করে রাখা হয় রাজাকে। রাজাকে উদ্ধারের জন্য শেষ পর্যন্ত কোচবিহার করদরাজ্য হতে স্বীকৃত হয় সেই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির চরণে নত হয়েই! যার সূত্রপাত একদিন ঘটেছিল এই মাটিতেই। ইতিহাসের কি বিচিত্র গতি! মহারাজা ধৈর্যেন্দ্র নারায়ণ ১৭৭৪ সালে ভুটানের বন্দিদশা থেকে মুক্ত হয়ে সমতল রাজ্যে প্রবেশ করেন, যে স্থানে প্রথম ভাত খেয়ে ছিলেন রাজা, সেই স্থান আজও পর্যটকদের বিখ্যাত ‘রাজাভাতখাওয়া’।
এই দুর্গ বহু ঐতিহাসিক যুদ্ধের সাক্ষীভূমি। প্রথম ভুটান যুদ্ধে এক রাত্রিতে ভুটানি সৈন্যের অতর্কিত আক্রমণে এই দুর্গে মারা পড়ে প্রায় ২০০ জন ইংরেজ সৈন্য। এরপর রংপুরের কালেক্টর পার্লিং এবং ইংরেজ সেনাপতিরা কয়েকজন মাত্র সৈন্য নিয়ে পালিয়ে কুচবিহার শহরে গিয়ে প্রাণ বাঁচান। পরে অনেক বেশি সৈন্য নিয়ে এসে ভুটানি সৈন্যকে তাড়িয়ে পুনর্দখল করা হয় এই চেচাখাতাগড়।
দ্বিতীয় ভুটান যুদ্ধের সময় ১৮৬৫ সালে এই দুর্গে শেষবার যুদ্ধ হয়েছিল। ইংরেজ সেনাপতি ওয়াটসনের নেতৃত্বে সুশৃঙ্খলিত ইংরেজ সৈন্য এবং কর্নেল হেদায়েত আলীর সেনাপতিত্বে বিপুল সৈন্যদের আগমনের সন্ধান পেয়ে সেবার ভুটিয়া সৈন্যরা প্রায় বিনাযুদ্ধে এই দুর্গ ত্যাগ করে পালিয়ে যায়। স্থানীয় গ্রামবাসীদের সাথে সাক্ষাতে বেরিয়ে এলো আরেকটি চাঞ্চল্যকর অশ্রুতপূর্ব মৌখিক ইতিহাস। গ্রামবাসীরা জানালেন বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকেও এই অঞ্চলে বিচ্ছিন্নভাবে থাকতেন কিছু ভুটিয়া সৈন্যরা। চা বাগানের বিস্তারের সাথে সাথে এই অঞ্চলে বাড়তে থাকে সাঁওতালি শ্রমিকদের ভিড়। বিংশ শতাব্দীর একেবারে প্রথমের দিকে নাকি এই সাঁওতাল শ্রমিকদের সাথে তীর ধনুকের লড়াই বেধেছিলো বিচ্ছিন্ন ভুটিয়াদের। গড় ছেড়ে, এই অঞ্চল ছেড়ে পালিয়ে যায় ভুটিয়ারা, তারপর থেকে এই অঞ্চলের দখল নিয়ে হয়নি আর কোনো অশান্তি।
আজ এ অঞ্চলকে ভুলেছে সবাই। শেষ করব এই বিষয়ের বিশিষ্ট গবেষক ‘আলিপুরদুয়ারের পথে-প্রান্তরে’ গ্রন্থের লেখক শোভেন সান্যাল এর কথা দিয়ে “আলিপুরদুয়ার জেলা প্রশাসন, জেলা পরিষদ, রাজনৈতিক দলগুলি এবং বুদ্ধিজীবীরা একযোগে চেষ্টা করলে এই হেরিটেজ দুর্গের ধ্বংসাবশেষকে এখনও বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা করতে পারেন। কিন্তু তারা কি তা করবেন? আর বেশি দেরি করলে আলিপুরদুয়ার জেলার এই হেরিটেজ দুর্গ চিরতরে বিলুপ্ত হয়ে যাবে।”
পরবর্তী প্রজন্ম ক্ষমা করবে কি?
গ্রন্থসূচি:
১) বানভট্ট, হর্ষচরিত, সাহিত্য পরিষদ প্রকাশিত সংস্করণ।
২) Abul Fazl (translated by. H. Beveridge. E. D.), The Akbarnama
৩) John Ryley, ‘Horton Ralph Fitch: England’s pioneer to India and Burma’, 1899
৪) খান চৌধুরী আমানুতুল্লাহ আহমেদ, ‘কোচবিহারের ইতিহাস’
৫) সুকুমার দাস, ‘উত্তর বঙ্গের ইতিহাস’
৬) শোভেন সান্যাল, ‘আলিপুরদুয়ারের পথে-প্রান্তরে’
৭) অমিয় কুমার বন্দ্যোপাধ্যায় ও অধ্যাপক সুধীর রঞ্জন দাস, (সম্পাদনা) ‘কোচবিহার জেলার পুরাকীর্তি’
8) মধুপর্নী পত্রিকা, জলপাইগুড়ি জেলা সংখ্যা
ক্ষেত্রসমীক্ষার কাজে:
• আলিপুরদুয়ারের মাননীয় সুরজিৎ বণিক মহাশয় ও পটোটলা কলোনির প্রবীণ গ্রামবাসীবৃন্দ।
Bartman ekta sketch map ei lekhatak aro valo hoto bole mone hoy.lekatatar jonyo lekhakke dhanyabad.
আপনার মতামতের জন্য ধন্যবাদ। আসন্ন পূর্ণাঙ্গ গ্রন্থ টিতে আরো অনেক কিছুর সাথে মানচিত্র সন্নিবিষ্ট থাকবে। সোশ্যাল মিডিয়াতে প্রকাশ হবে জেনে কিছু তথ্য সংক্ষিপ্ত করতে হয়েছে।
ভালো থাকুন।
কত কম কথায় ধারাবিবরণীর মতো বিশাল ইতিহাস আপনি প্রকাশ করলেন ভেবে অবাক হলাম। দুবার পড়লাম। খুব ভালো লাগলো। অভিনন্দন।
আপনার মতামতের জন্য ধন্যবাদ। আসন্ন পূর্ণাঙ্গ গ্রন্থ টিতে আরো অনেক কিছুর সাথে মানচিত্র সন্নিবিষ্ট থাকবে। সোশ্যাল মিডিয়াতে প্রকাশ হবে জেনে কিছু তথ্য সংক্ষিপ্ত করতে হয়েছে।
ভালো থাকুন।
লেখাগুলো খুব ভালো