যমুনায় চাপা পড়া কামান আর প্রতাপাদিত্যের গপ্পো
ميم لام سن نن لام اليف ميم سم سن لم ها اليف لام سن اليف ها سن نون اليف حار عين الام عين
‘Mother’s hot eye’!
‘মায়ের আগুনে চোখ’- এমনই নাকি বলা হত বারুদ এর আবিষ্কর্তা চীন দেশের মান্দারিন ভাষায় কামানকে! না, চীনা ভাষায় নয়। আমরা এখন সাক্ষী থাকছি যে কামানের গায়ের লিপির তার ভাষা ফারসি। কিন্তু অবাক করা ব্যাপার, অসম্পূর্ণ পাঠোদ্ধারেও যেটুকু দেখা যাচ্ছে তাতেই কামানের গায়ে লেখা একই শব্দ – ‘মায়ের আগুনে চোখ’, Mother’s hot eye!
খুব বেশিদিন আগের কথা নয়। যমুনা নদীর, নদিয়া জেলার হরিণঘাটা অঞ্চলে এক বসতবাড়ির লাগোয়া জমি পরিষ্কার করা হচ্ছিল। যমুনা নদীর পাড় বরাবর মাটি খুঁড়তেই তলা থেকে উঠে আসে এই বড়োসড়ো কামানটি! অবশ্য এই প্রথম নয়। এর আগেও যমুনা নদী; যা আজকে ছোট ছোট ডোবা আর বুজে যাওয়া খালে পরিণত হয়েছে, সেখানে মাটির একশ থেকে দেড়শ ফুট গভীর থেকে মিলেছে বড় নৌকো, বজরার ধ্বংসাবশেষ (বিজরা মৌজা)। নানা সময়ে মিলেছে আরও নানান প্রত্নসামগ্রী।
হ্যাঁ, আপনাকে নিয়ে ঠিক এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে আছি যমুনা নদীর ধারে। সেই যমুনা, যা প্রাচীন বাংলার অন্যতম প্রধান নদী। সেই যমুনা, যা পাল যুগের বিখ্যাত ত্রিবেণী সঙ্গমের অন্যতম। সেই যমুনা, মনসামঙ্গল রচয়িতা পিপলাই এর ভাষায় – ‘যমুনা বিশাল অতি’। এই যমুনা আগে ইছামতী নদীর সাথে মিলিত হয়ে বাদুড়িয়া, বসিরহাট, টাকি, হাসনাবাদ, হিঙ্গলগঞ্জ সুন্দরবন অঞ্চলের মধ্যে দিয়ে চলে যেত বঙ্গোপসাগর। বঙ্গোপসাগর থেকে আসা বাণিজ্যতরীগুলি প্রথমে ইছামতী ও পরে এই যমুনা হয়ে পৌঁছে যেত মধ্য বঙ্গ। এই যমুনা হয়ে প্রাচীন বাণিজ্যতরীগুলি আবার চলত গঙ্গায়। পৌঁছে যেত উত্তর ভারতের দিকে। এমনই ছিল এই যমুনার গুরুত্ব। অথচ আজ সামান্য কয়েক শতাব্দী পরে এই যমুনাকে আর খুঁজে পাওয়া কষ্টকর।
কেটে গেছে প্রায় হাজার বছর। বদলেছে মধ্য বঙ্গের এই অংশের নদ-নদী, ভূমিরূপ। বদলেছে বদ্বীপ এর সামগ্রিক গঠন প্রক্রিয়া। পুরনো ইতিহাসকে খুঁজে পেতেই তাই আমরা আজ হেঁটে চলেছি যমুনার বাঁক ধরে ধরেই। প্রথমেই উপস্থিত হলাম নদীয়া জেলার মদনপুর রেলস্টেশনে। স্টেশনের সামান্য কয়েক মিটার দক্ষিণে গেলেই খুবই দুর্বল, অবহেলায় পড়ে থাকা যে ডোবা মতো অংশগুলি দেখতে পাব, তাই হচ্ছে প্রাচীন গরবিনী স্রোতস্বিনী যমুনা। এরপর মদনপুর রেলস্টেশনের পূর্ব দিকে চলে গেছে সে, পূর্ব পাড়ার দিকে, তারপর দক্ষিণ দিকে। এরপর যমুনার যাত্রা বিরহীর মদন গোপালের বিরহ বেদনা লাঘব করে পুনরায় দক্ষিণ দিকে, হরিণঘাটা -নগরউখড়া – গোবরডাঙ্গার মধ্যে দিয়ে ইছামতীর কোলে।
গঙ্গা থেকে উৎপত্তি হওয়া এবং ইছামতীতে মেশা এই গোটা পথের দৈর্ঘ্য ৫০ কিলোমিটারের বেশি। যার মধ্যে চাকদা কল্যাণী থানায় ১১.২৬ কি. মি., গাইঘাটা থানায় ১৪.৪৮ কি. মি., হরিণঘাটা থানা ৩২.১৯ কি. মি., বনগাঁ থানায় ১৬.১৯ কি. মি., এবং হাবরা থানায় ৪.৮৩ কি. মি. ছড়িয়ে রয়েছে তার যাত্রাপথ। কিন্তু এই বিশাল যাত্রাপথে হাঁটতে হাঁটতে আপনি অনেক সময়ই খুঁজে পাবেন না হাজার বছরের প্রাচীন সেই রূপসীকে। হাজার বছরের বদ্বীপ গঠনের নানা পরিবর্তন যমুনার চলার পথকে কোথাও করেছে কচুরিপানা ঘেরা ডোবা, কোথাও করেছে শুকনো নদী খাত, যেখানে বছরের ২/১ মাস ছাড়া জল থাকে না । আবার কোথাও তা অবলুপ্ত হয়েছে, পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে প্রাচীন বাংলার অন্যতম প্রধান নদীটি।
অথচ পাল ও সেন যুগের বিখ্যাত তীর্থকেন্দ্র এবং অর্থনৈতিক বাণিজ্যকেন্দ্র মুক্ততীর্থ ত্রিবেণীর অন্যতম প্রধান নদী ছিল এই যমুনা। মুক্ততীর্থ ত্রিবেণীর তিনটি ধারা- যমুনা, সরস্বতী, ভাগীরথী বা গঙ্গা। তুলনামূলকভাবে ভাগীরথীর থেকে যমুনা-সরস্বতী ছিল অনেক ছড়ানো ও গতিশীল। যমুনার ধারে গড়ে ওঠা ত্রিবেণী ছিল প্রাচীন বঙ্গ তথা ভারতের অন্যতম প্রধান বন্দর। এমনকি সপ্তগ্রাম বন্দর গড়ে ওঠার আগেও ব্যবসা বাণিজ্য এবং তখনকার দিনে প্রচলিত জলপথ পরিবহনে অন্যতম প্রধান গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র ছিল ত্রিবেণী। সপ্তগ্রাম বন্দর গড়ে ওঠার আগেই যে উল্লেখযোগ্য কেন্দ্র ছিল ত্রিবেণী তার প্রমাণ আমরা পাই সেনরাজ সভাকবি ধোয়ীর লেখা অমরগ্রন্থ ‘ পবনদূত’ থেকে। জানতে পারি, সুদূর দক্ষিণ ভারত থেকে প্রেমিকার বার্তা নিয়ে পবনদূত সেন রাজধানী বিজয়পুরে আসবার আগে অতিক্রম করে আসেন পুণ্যতীর্থ ত্রিবেণী (স্তবক নং ৩২)। পবনদূতের ভাষ্য থেকে আমরা যেমন চিনে নিতে পারি সেন রাজধানী বিজয়পুরের কোলেই ছিল ত্রিবেণীর অবস্থান; তেমনি নিশ্চিত হতে পারি সপ্তগ্রাম বন্দর গঠনের আগেই প্রাচীন বাংলার গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিককেন্দ্র রূপে বিকশিত হয়েছিল যমুনা বিধৌত এই ত্রিবেণী। এ প্রসঙ্গে দেখে নেওয়া যেতে পারে সংস্কৃত সাহিত্য পরিষদ থেকে প্রকাশিত চিন্তাহরণ চক্রবর্তীর মতামত:
“The wind next has to go to Triveni where the Yamuna issues from the Ganges.. it is to be noted that here we have no mention of the famous port of Saptagrama or Satgaon to which frequent references are met within medieval Bengali works. But we are not sure if the port had risen to eminence during the time of Lakshmansena” (page 25).
তারপর কি হলো? সেন রাজধানী বিজয়পুরের কোল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকা মুক্ত তীর্থ ত্রিবেণীর অন্যতম সম্বল স্রোতস্বিনী যমুনার পরিণতি কি হলো? এরপরে আর কোন খবর জানা যায় কি তার?
অবশ্যই জানা যায়। এই যমুনা নীরব সাক্ষী বাংলায় মোগল বিজয় ও পাঠান বিদায়ের পালাবদলের। এই যমুনা নীরব সাক্ষী বাংলার বীর সন্তান, বারোভূঁইয়ার অন্যতম প্রতাপাদিত্যের। মুঘল সম্রাট জাহাঙ্গীর ও তার সেনাপতি মানসিংহ পর্যন্ত যার বীরত্বে মুগ্ধ হয়েছিলেন সেই প্রতাপাদিত্যের সংগ্রাম, অবিশ্রান্ত যুদ্ধের আয়োজন সবই গড়ে উঠেছিল যমুনার এই পাড় ঘেঁষে।
আজ আমি আর আপনি হেঁটে যাচ্ছি যে শুকনো মাঠ, নিচু ডোবার পাশ দিয়ে দিয়ে- আজ থেকে কয়েক শতাব্দী আগে এই জায়গাগুলিতেই ঘটে গেছে বাংলা তথা ভারতের পালাবদলের বিখ্যাত দৃশ্য গুলির। এখানেই কান পেতে থাকলে আপনি শুনবেন মানসিংহের সাথে প্রতাপাদিত্যের লড়াইয়ের তলোয়ার কামানের গর্জন, শুনবেন মানসিংহকে সাহায্যের জন্য ভবানন্দ মজুমদারের সম্মান প্রদর্শন যার মাধ্যমে সূচনা ঘটে নদীয়া রাজবংশের। যমুনার প্রতি বাঁক তাই বাংলার ইতিহাসের অবহেলিত কিন্তু নীরব নিশ্চিৎ সাক্ষী।
ইতিহাস বিখ্যাত বারোভূঁইয়ার অন্যতম প্রধান প্রতাপাদিত্যের রাজ্য, সীমান্ত জড়িয়ে আছে এই যমুনার কূলে। ১৫৯৯ খ্রিস্টাব্দে প্রতাপাদিত্য স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। বাংলার তৎকালীন সুবেদার তা জানতে পেরে দুজন মোগল সেনাপতিকে প্রতাপের বিরুদ্ধে যুদ্ধ অভিযানে পাঠান। কিন্তু প্রতাপাদিত্য চিনতেন এই বাংলার নদনদী। তার বিরুদ্ধে যুদ্ধে বিজয়ী হতে পারেনি সেনাপতিরা। জয়যুক্ত হন প্রতাপাদিত্য। রাজা প্রতাপাদিত্যের সাথে অন্যান্য বারোভূঁইয়াদের ঐক্য সম্পাদিত হয়। ইতিহাস থেকে প্রমাণ পাওয়া যায় প্রতাপাদিত্য এরপর লুট করেন সপ্তগ্রাম বন্দর। প্রমাদ গোনে দিল্লীর মুঘল দরবার। আকবরের পর তখন সিংহাসনে বসেছেন যুবরাজ সেলিম থেকে সম্রাট হয়ে ওঠা জাহাঙ্গীর। জাহাঙ্গীর প্রতাপাদিত্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধে পাঠালেন তার প্রিয় সেনাপতি মানসিংহকে। ১৬০০ খ্রিস্টাব্দে মানসিংহ কাশী থেকে রাজমহল এলেন। দীর্ঘদিন ধরে একটু একটু করে তৈরি হলো সামগ্রিক পরিকল্পনা। ১৬০৩ খ্রি. মানসিংহ এসে দাঁড়ালেন প্রতাপাদিত্যের রাজ্য যশোরের প্রান্তরে।
মানসিংহের শিবির পড়ল বর্তমানের চাকদহ, অতীতের প্রদ্যুম্ন নগরের কাছে আনন্দগঞ্জে। প্রতাপাদিত্য অপেক্ষা করছিলেন যমুনার অপর পারে। কিন্তু সে রাতেই আরম্ভ হলো প্রবল ঝড়জল। সাহায্য করতে এগিয়ে এলেন ভবানন্দ মজুমদার নামের একজন স্থানীয় ভূস্বামী, যিনি পরবর্তীকালে পরিচিত হবেন নদীয়া রাজবংশের স্থপতি হিসেবে। প্রতাপাদিত্য মানসিংহের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ ঘটলেও প্রতাপাদিত্যের বীরত্বে মুগ্ধ হলেন মুঘল সেনাপতি। স্বাধীন মুদ্রা, পতাকা ও সার্বভৌমত্ব দাবি ফিরিয়ে নিলেন প্রতাপাদিত্য। ফিরে গেলেন মানসিংহ। স্থাপিত হলো নদিয়া রাজবংশ। মানসিংহের এ যাত্রা সম্পর্কে রায় গুণাকর ভারতচন্দ্র বলেন:
‘আগে পাছে দুই পাশে দু’সারি লস্কর।
চললেন মানসিংহ যশোহর নগর।।
মজুন্দারে সঙ্গে নিলা ঘোড়া চড়াইয়া।
কাছে কাছে অশেষ বিশেষ জিজ্ঞাসিয়া।’
১৬০৮ সালে প্রতাপাদিত্যের প্রতিনিধি হিসাবে শায়খ বারি এবং তার কনিষ্ঠ পুত্র সংগ্রামাদিত্য প্রচুর উপঢৌকন নিয়ে সুবাদারের দরবারে হাজির হন। চুক্তি অনুসারে, প্রতাপাদিত্যকে সশরীরে হাজির হবার শর্তে রাজপুত্র সংগ্রমাদিত্যকে সুবাদারের জিম্মায় রেখে দেয়া হয়। ১৬০৯ সালে আত্রাই নদীর তীরে প্রতাপাদিত্য মুঘল সুবাদারের নিকট আত্মসমর্পণ করেন। প্রতাপাদিত্য এই মর্মে রাজি হন যে তার রাজ্যে ফেরত যাবার পর তিনি ৪০০ যুদ্ধজাহাজ নিয়ে তার কনিষ্ঠ পুত্র সংগ্রাম আদিত্যকে মুঘল সামরিক বাহিনীতে যোগদান করার জন্য প্রেরণ করবেন এবং তিনি নিজে আড়িয়াল খাঁ নদী ধরে ২০,০০০ পাইক, এক হাজার অশ্বারোহী এবং ১০০ সামরিক নৌ-যান নিয়ে মুসা খানের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করবেন। প্রতাপাদিত্য তার প্রতিজ্ঞা না রাখার কারণে, সুবাদার ইসলাম খান তার বিরুদ্ধে সামরিক অভিযানের প্রস্তুতি গ্রহণ করেন।
সলকার যুদ্ধ:
১৬১১ সালের ডিসেম্বর মাসে মুঘল বাহিনী ইছামতী এবং ভৈরব নদীর তীর ধরে যশোরের উদ্দেশ্যে অগ্রসর হতে থাকে। দ্রুত তারা যমুনা এবং ইছামতীর সঙ্গমস্থলে সলাকা নামক একটি স্থানে পৌঁছায়। আজও রয়েছে এই জায়গা। আজও আপনি উপস্থিত হতে পারেন সেই স্থানে যেখানে মিশেছিল ইছামতী, মরালি এবং যমুনা। আজও এই বিল ‘ সাত সলাকির বিল’ নামেই পরিচিত।
মুঘল বাহিনী সলকার দিকে অগ্রসর হলে উদিত্য নারায়ণ আচমকা তাদের উপর আক্রমণ করেন। মুঘল বাহিনী কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তিনি আফগান জামাল খানকে দুর্গের দায়িত্বে রেখে যান। যশোর বাহিনী মুঘল বাহিনীকে পশ্চাদপসরণ করতে বাধ্য করে। পরে গোলন্দাজ বাহিনীর প্রবল আক্রমণের মুখে যশোর বাহিনীর ব্যাপক ক্ষতিসাধন হয়। খাজা কামাল নিহত হন। উদিত্য নারায়ণ পলায়ন করেন। জামাল খান তার হস্তী বাহিনী নিয়ে উদিত্য নারায়ণকে অনুসরণ করেন।
খাগারঘাটের যুদ্ধ:
প্রতাপাদিত্য দ্বিতীয়বারের মতো যুদ্ধের প্রস্তুতি নেন। এবারের যুদ্ধক্ষেত্র খাগড়াঘাট খাল এবং যমুনার সংগম স্থান। ১৬২২ এর জানুয়ারি; মুঘল বাহিনী যশোর বাহিনীকে আক্রমণ করে এবং তাদের দুর্গের অভ্যন্তরে অবস্থান নিতে বাধ্য করে। যশোর বাহিনীর বিপুল গোলাবর্ষণের মাধ্যমে মুঘল বাহিনীর অগ্রসরকে বাধা দেয়। কিন্তু এক অতর্কিত আক্রমণে মোগলবাহিনী দুর্গ দখল করে নেয়। প্রতাপাদিত্যের ভাগ্য নির্ধারিত হয়ে যায়। রাজা মান সিং লক্ষ্মীকান্তকে সিংহাসনে বসার জন্য অনুরোধ করেন। এভাবেই যমুনার কূল ঘেঁষে নির্ধারিত হয়ে যায় প্রতাপাদিত্যের ভাগ্য। মধ্যযুগের এক বিপুল পরিবর্তন ঘটে সেকালের যৌবনবতী যমুনার এই অখ্যাত গ্রামগুলিতে।
আজ এদের চিহ্নমাত্র নেই, নেই কোনো স্মারক, নেই কোনো উদ্যোগ। এমনকি ইতিহাস সংরক্ষণের কোনো চিহ্নমাত্র নেই।
যুগে যুগে বারবার গতিপথ বদল করেছে চঞ্চলা যৌবনবতী যমুনা এবং এই যমুনাকে কেন্দ্র করেই মধ্য বঙ্গের জলনির্গম এবং বদ্বীপ গঠন প্রক্রিয়া প্রভাবিত হয়েছে যুগে যুগে। ভূমিরূপ গঠনের সীমানা নির্দেশক হিসেবেও ব্যবহার করা হয়েছে যমুনাকে। ১৭৬৪ সালে যখন আঁকা হল রেনেলের ম্যাপ, তখনো সে যমুনা এখনকার মতন কচুরিপানা ঘেরা দুর্বল শীর্ণ নয়। এমনকি ভাবতে অবাক লাগে ১৮১০ সালের সরকারী সার্ভেতে এই যমুনা নদী ও বাগের কালকেই সুন্দরবনের উত্তর সীমান্ত নির্দিষ্ট করা হয়েছিল। অর্থাৎ তখন এই অঞ্চলগুলি ছিল সরকারিভাবেই সুন্দরবনের অংশ। অবশ্য কাঁচরাপাড়া আজও প্রচলিত বনবিবির থানে গেলে সে স্মৃতি উঁকি দেয় বৈকি।
আজ সন্ধেবেলা দাঁড়িয়ে আছি সেই কামানের মুখোমুখি হয়ে, যা আবার সূর্যের আলো দেখলো কয়েক শতাব্দী পরে। অনুভব করতে পারছি এই কামান যেদিন অগ্নি বর্ষণ করেছিল প্রতাপাদিত্যের সাথে মানসিংহের লড়াইয়ের, সেই দিনগুলির কথা ।অথচ কী করুণ পরিণতি আজ এই যমুনার। সামগ্রিকভাবেই বদ্বীপ গঠনের বিবর্তনের সাথে সাথে মধ্য বঙ্গের এই অংশের জলনির্গম বদলেছে দ্রুতগতিতে। আজ যেখানে গঙ্গা প্রবাহিত, আজ থেকে এক হাজার বছর আগে গঙ্গা নদীয়া জেলার পূর্ব দিক দিয়ে বইতো বর্তমানে বীরনগর, প্রাচীন উলা গ্রামের পাশ দিয়ে, রানাঘাট থানার আনুলিয়া অঞ্চল দিয়ে, বইতো বর্তমান চাকদা স্টেশন এর পাশ দিয়ে শিমুরালি মদনপুরের পশ্চিম দিক দিয়ে। অতীতে যা ছিল সক্রিয় বদ্বীপ এর অংশ কালের নিয়মে সেখানে জোয়ার ভাটা বন্ধ হয়েছে, বন্ধ হয়েছে পলি জমা, নদীর গতিপথ বদলে গঙ্গা সরে গেছে আরও পশ্চিম দিকে। যমুনার সাথে সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়েছে। যমুনা ক্রমশ প্রবীণা হয়েছে।
আজ হরিণঘাটা হয়ে চলার পথে পড়ে চাঁদমারি বয়সার বিল, কুলিয়া ও মথুরা বিল। এগুলি প্রকৃতপক্ষে সেই প্রাচীন যমুনার অদৃশ্য হয়ে যাওয়া দেহের ভাঁজগুলি। যমুনার খোঁজে খোঁজে আপনি চলে আসুন চান্দামারী বয়সারবিল এর পশ্চিম দিকে, দেখবেন প্রায় ১৫ কি. মি. লম্বা এক খাল ভাগীরথীর সাথে যুক্ত। এখানেই কাটান বসন্তের একটা গোটা দিন, আস্ত একটা রাত। কাটান চান্দামারী, মুরাতিপুর, সীমান্ত, কাঁঠালতলা গ্রামের মানুষগুলির অতিথি হয়ে; বড় আন্তরিক এদের মেশা, এদের যাপন। চাষের কাজ, সেচের জল আজও এই যমুনা নদী নির্ভর। গ্রামের প্রাচীন মানুষদের গল্পকথায় এখনো যৌবনের যমুনার প্রাণের স্পর্শ পাবেন। বড়বিল থেকে আপনি চলে আসুন গয়েশপুর পৌরসভার কুলিয়া বিলে। প্রায় ৩০ একর জায়গাজুড়ে। যদিও ‘ বিশেষজ্ঞদের’ মতামত নিয়ে তৈরি করা এই বিলের মাঝখান বরাবর চলে গেছে পিচের কাল রাস্তা। শেষ করেছে এই জলাশয় এর জৈব বৈচিত্র। তাতেও আপনি দুঃখ পাবেন না। বৈষ্ণবদের ঐতিহাসিক তীর্থক্ষেত্র বটে যমুনার কূলে এই অখ্যাত গ্রাম। মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্য দেব অবতরণ করেছিলেন, হ্যাঁ ঠিকই ধরেছেন, শ্রীচৈতন্য দেবের যাত্রাপথ ছিল আমাদের আলোচ্য যমুনা নদীই। যমুনা নদী পথের এই যে ঘাটে তিনি অবতরণ করেছিলেন সেই স্থান পরম বৈষ্ণব তীর্থ কুলিয়ার ঘাট তথা ‘অপরাধভঞ্জন ঘাট’।
যদিও যমুনার পাড় ঘেঁষে তৈরি হয়েছে নদী গবেষণা কেন্দ্র(River research institute), কিন্তু মধ্য বঙ্গের ক্রমাগত বদলে যাওয়া বদ্বীপ আর বদলে যাওয়া নদীগুলিকে নিয়ে হয়নি কোনো পূর্ণাঙ্গ গবেষণা। খুঁজে পাওয়া পুরাবস্তুগুলি নিয়ে গড়ে ওঠেনি কোন সংগ্রহশালা।
বুকে এই প্রশ্ন নিয়েই আপনি ফিরে যান ঘরের পথে- বাঙালি কি সত্যি আত্মবিস্মৃত জাতি নয়?
সহায়ক গ্রন্থসূচি:
• ‘কাঁদে মরালি কাঁদে যমুনা’, সুনীল চন্দ্র দে।
• যশোহর খুলনার ইতিহাস’, সতীশ চন্দ্র মিত্র।
• ‘ নদীয়া কাহিনী’, কুমুদনাথ মল্লিক।
• ‘ পবনদূতম’, চিন্তাহরণ চক্রবর্তী।
• মনসামঙ্গল, বিপ্রদাস পিপলাই।
ক্ষেত্রসমীক্ষায় ভবঘুরে যাদের সাথে পেয়েছি: দেবজিৎ বিশ্বাস, রুবি রায়, রনি রায় এবং চারটি প্রায় ভাঙ্গা সাইকেল।
প্রাচীন বাংলার/ ভারতের ইতিহাস যতই পড়ছি ততই আগ্রহ বাড়ছে। মাটি চাপা পড়া এক কামান আর প্রাচীন নদী যমুনা যারা মধ্যযুগের ঐতিহাসিক কিছু ঘটনার সাক্ষী তার সম্পর্কে জেনে খুব ভালো লাগলো। খুবই তথ্য সমৃদ্ধ পোস্ট। লেখককে সাধুবাদ জানাই।
এই রোমাঞ্চকর ঘটনাটি লেখকের অনবদ্য লিখনশৈলীতে অত্যন্ত আকর্ষনীয় ও আস্বাদনীয় হয়েছে। খুঁজে পাওয়া পুরাবস্তুগুলির জন্য সংগ্রহশালা শীঘ্রই গড়ে উঠবে আশা রাখি।
আলোকিত হ’লাম। অজানা আরও তথ্যের সন্ধানে উদগ্রীব রইলাম।