রাজা রামমোহনের আগে প্রথম বিলাতযাত্রী বাঙালি
(গ্রন্থের নামঃ বিলায়েতনামা, মূল লেখকঃ মির্জা শেখ ইতিসামুদ্দীন, অনুবাদকঃ আবু মহামেদ হবিবুল্লাহ, বাংলা অনুবাদের প্রথম প্রকাশনাঃ মুক্তধারা, জুন ১৯৮১, বর্তমান প্রকাশনাঃ দিব্যপ্রকাশ, ফেব্রুয়ারি ২০১৫)
গ্রামের নাম আজগুবিতলা। কয়েক দশক আগে ও ঝিমধরা ছায়া-অন্ধকার নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতো বিরাট এক তেঁতুল গাছ। আর এই তেঁতুল গাছকে নিয়েই মানুষের মধ্যে গড়ে উঠেছিল অন্ধবিশ্বাস আর কুসংস্কার। এ থেকেই গ্রামের নাম আজগুবিতলা।
শিয়ালদহ-রানাঘাট ট্রেন পথে পালপাড়া স্টেশন থেকে সামান্য পথ গেলেই আপনি পৌঁছে যাবেন এই আজগুবিতলায়। এখানেই অনাদর আর অস্বীকৃতির চিহ্ন বুকে নিয়ে মূক হয়ে রয়েছে বাংলার এক ভুলে যাওয়া ইতিহাসের অধ্যায়। এই গ্রামের একজন মানুষ গোটা ভারতের মধ্যে প্রথম বিলাত যাত্রী! হ্যাঁ, রাজা রামমোহন রায় নন, তারও ৬৫ বছর আগে যে মানুষটি প্রথম বিলেত যাত্রা করেছিলেন, তিনি এই পালপাড়ার আজগুবিতলার মানুষ। আমরা ভুলেছি তাকে। ভুলেছি তার লিখিত ভ্রমণ গ্রন্থের অমূল্য ইতিহাসকে। আজকের কথা সেই মানুষটি এবং তার সেই অমূল্য গ্রন্থ নিয়েই।
রাজা রামমোহন রায়ের ইংল্যান্ড যাত্রার প্রায় ৬৫ বছর আগে, নদীয়ার মানুষ মির্জা শেখ ইতিসামুদ্দীন প্রথম বিলেত যাত্রা করেন। ১৮৩১ সালে দিল্লির বাদশাহের হয়ে দূতকার্য করতে ইংল্যান্ড যান রাজা রামমোহন রায়। কিন্তু আমরা জানি কি, তারও প্রায় ৬৫ বছর আগে দিল্লির বাদশাহের দূত হয়ে নদীয়ার মানুষ ইতিসামুদ্দীন ইংল্যান্ড যান ওই একই কাজে? দুজনেরই কাজ ও গুরুত্ব ছিল একই। কিন্তু, দুর্ভাগ্য, ইতিসামুদ্দীনের কথা মানুষ মনে রাখেননি; মনে রাখেননি তার লেখা অমূল্য ভ্রমণ বৃত্তান্তকেও!
প্রথম বিলেত যাত্রার অমূল্য অভিজ্ঞতা নিয়ে, ফারসি ভাষায় সুপণ্ডিত এই মানুষটি ইংল্যান্ড থেকে ফিরে এসে, ১৭৮৪ সালে লেখেন তার মহাগ্রন্থ- ‘শিগার্ফে – নামা – এ – বেলায়েত’। এই গ্রন্থ একই সঙ্গে তাঁর আত্মজীবনী ও ভ্রমণ বৃত্তান্ত। পরবর্তীকালে এই বইয়ের অনুবাদ করেছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজির অধ্যাপক কায়সার হক। বইটির ইংরেজি নাম ‘The Wonders of Bilayet’।
সাল ১৭৬৫, পলাশীর যুদ্ধ তখন অতীত। বণিকের মানদণ্ড, রাজদণ্ড রূপে শুধুমাত্র দেখাই যাচ্ছে না, বক্সারের যুদ্ধ জয়ের পর কলকাতা ও ঢাকাকে কেন্দ্র করে ইংরেজ শক্তি মুঠোর মধ্যে পুরে নিচ্ছে গোটা ভারতের শাসন। এই সময়, অর্থাৎ ১৭৬৫ সালে মুঘল বাদশাহ দ্বিতীয় শাহ আলমের অনুরোধপত্র ও এক লক্ষ টাকার উপঢৌকন নিয়ে দূত যাবে ইংল্যান্ডের রাজা তৃতীয় জর্জ-এর কাছে। ঢাকায় তখন প্রথম ইংরেজ প্রশাসক ক্যাপ্টেন সুইন্টন। তিনি এই কাজের দূত মনোনীত হন। তাকে সহযোগিতা করার জন্য নিযুক্ত হন মির্জা শেখ ইতিসামুদ্দীন। ফারসি ভাষায় লেখা অনুরোধপত্রটি পড়া সহ আরও নানা কাজে নির্বাচিত হয়ে তিনি ইংল্যান্ড পাড়ি দেন। প্রায় ছয় মাস লেগেছিল ইংল্যান্ড যেতে। সুদীর্ঘ ৬ মাস লাগার কারণ সুয়েজ খাল পথে যাওয়া যেত না, তাকে যেতে হয়েছিল মারিশাস – উত্তমাশা অন্তরীপ – আফ্রিকার পশ্চিম উপকূল – ফ্রান্সের উপকূল এবং ইংলিশ চ্যানেল হয়ে। দীর্ঘ এই যাত্রাপথে তিনি দেখেছিলেন বহু দেশ, বহু সভ্যতা, বহু সংস্কৃতি। দেখেছিলেন অনেক বিচিত্র মানুষ, তাদের বিচিত্র সব জীবনযাত্রা। তাদের শরিকও হয়েছিলেন তিনি। ১৭৬৫ সালের জানুয়ারিতে কলকাতার হিজলি ঘাটের মসিয়ে সরভিসের জাহাজে চড়ে তিনি যাত্রা করেন ইংল্যান্ডের উদ্দেশ্যে।
বাদশাহি কাজ সমাপ্ত করে পণ্ডিত এই মানুষটি, অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারে মিলিত হন উইলিয়াম জোন্স এবং অধ্যাপক ডক্টর হান্ট এর সাথে। উভয়ই তার পাণ্ডিত্যের প্রশংসা করেন। উইলিয়াম জোন্স পরবর্তী সময়ে কলকাতা হাইকোর্টের জজ হন এবং ১৭৮৪ সালে কলকাতায় প্রতিষ্ঠা করেন এশিয়াটিক সোসাইটি।
কোথায় নদীয়া আর কোথায় অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগার! ফারসি ভাষার পণ্ডিত এই মানুষটির জন্ম ১৭৩০ বা ‘৩২ সালের মধ্যের কোন এক সময়ে নদীয়ার পাঁজনুর গ্রামে। তার পিতার নাম তাজউদ্দিন এবং পিতামহ শিহারউদ্দিন তালিশ। শিহারদ্দিন ছিলেন ‘তারিখ – ই – আসাম’ নামক গ্রন্থের লেখক। যে গ্রন্থে আছে মীর জুমলার আসাম অভিযানের বর্ণনা। তালিশ ভারতবর্ষে আসেন ইরান থেকে, তারপর দু’এক পুরুষের মধ্যেই পাকাপাকিভাবে বসবাস শুরু করেন বাংলাদেশে। পঞ্চনুর থেকেই গ্রামটি পাজনুর নামে পরিচিত হয়। ১৮৫৫-৫৭ সালে গভর্নর জেনারেল ছিলেন লর্ড ডালহৌসি। সেই সময় রেলের রেভিনিউ সার্ভে ম্যাপে এই গ্রামের নাম পরিবর্তিত হয়ে যায়। পরিবর্তন হয়ে ওই জায়গার নাম হয় কাজীপাড়া।
আজও আজগুবিতলা বা পুরোনো কাজীপাড়ায় উপস্থিত হলে আপনি দেখতে পাবেন নিস্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে শতাব্দী প্রাচীন মসজিদ। কথিত আছে, দেশভাগের পরবর্তী সময়ে এখানকার মুসলিম জনবসতি স্থানান্তরিত হয় তৎকালীন পূর্ববঙ্গ, বর্তমান বাংলাদেশে। আজ কালের প্রহর গুনছে এই মসজিদ সহ সংলগ্ন স্থাপত্য, প্রথম ভারতীয় বিলাতযাত্রী শেখ ইতিসামুদ্দীনের জন্মস্থান। কোন সংরক্ষণ নেই, কোন উদ্যোগ নেই, নেই কোন সচেতনতা। অজানাই থেকে গেছেন এই মানুষটি। অথচ লন্ডনের ব্রিটিশ মিউজিয়ামে সযত্নে রাখা আছে মির্জা ইতিসামুদ্দীনের লেখা ফারসি গ্রন্থটি। দিব্যপ্রকাশ প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত হয়েছে ইতিসামুদ্দীনের এই যাত্রার বৃত্তান্ত। সাধুবাদ জানাই এই উদ্যোগকে। এই প্রকাশের হাত ধরে আসুন আজ একবার স্মরণ করি কালাপানি পেরোনো প্রথম ভারতীয়কে। স্থানীয় ইতিহাসকে নিয়ে গর্ব করি, মেতে উঠি আরও একবার। জেনে নিন তার সেদিনের ভ্রমণ বৃত্তান্ত আর অমূল্য বর্ণনা।
ক্ষেত্রসমীক্ষায় সাহায্য করেছেন ড. চিন্ময় বিশ্বাস, উত্তম ঘোষ।
ভারতের বাইরে থাকি। এই বইটি কি করে পেতে পারি। যদি ইবুক হিসেবে পাওয়া যায় সবচেয়ে ভালো হয়। উপযুক্ত বিনিময় মূল্য কত এবং ব্যাঙ্ক মারফত পাঠাতে আগ্রহী।
লেখাটি পড়েত পড়তে শ
এ ইতিহাস পড়ে ও জেনে দারুণ লাগলো।অবাক ও হলাম এতদিন না জানতে। লেখক ধন্যবাদ নিন অনেকেই।
Bhalo laglo. Jantam na ei bonganubad prokashonar katha ti. Pray 10 bochor age onyo ref theke porechi. Nijer gobeshonar kaje boiti byabohar korechi
Plus Mirza Abu Talib. Fisher saheb ekti biography likhechen Talib er opore. Uni itisamuddin er opore amar drishti aakorshon koren. Pore partha Chatterjee moshayer blackhole of empire gronthey EU prothom porjotoker opore du ek chitrer alochona royeche.
Ei bangla gronther alochonar ullekh jogyo songjojon holo onar gramtir katha. Desh bhager pore r katha gulo. Gram ti o hariye gelo. Aar ithas bodh o songrokshon? Seto bonkimi dirghosas . Aaj o bortoman.
Gronthyo somalochok ke dhonyobad. Aar bondhubor konar saheb ke. Post tir jonyo.
Grontho somalochonay
আকর্ষণীয় বিষয়। আগ্রহ তৈরি হল বইটি ঘিরে। যোগাড় করার ইচ্ছে ।
জানলাম অনেক অজানা তথ্য। ধন্যবাদ লেখককে।। ‘তারিখ-ই-আসাম’ বইটি কোথায় পাওয়া যেতে পারে।।
Ekti ganer line dhar kore bolte ichha korchhe -purono itihash hariye gele lajja ki tumi pabe na o bondhu.boiti e book hishabe pele bhalo hoy.
এভাবেই অনেক ইতিহাস ঢাকা চাপা হয়ে আছে আমাদের চারপাশেই। ধন্যবাদ উদঘাটনকারী কে।
বইটি পেতে চাই কোথায় পাওয়া যাবে কোলকাতায়