সূচী

ইতিহাস তথ্য ও তর্ক

ফরাসি বিপ্লবের ইতিহাসচর্চা

ফরাসি বিপ্লবের ইতিহাসচর্চা

সুভাষরঞ্জন চক্রবর্তী

অক্টোবর ৪, ২০২০ ৪১৬৬ 5

(লেখাটি যোজনা পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল ২০০৮ সালে। লেখকের সম্মতিক্রমে এখানে আমরা প্রকাশ করলাম।)

ফরাসি বিপ্লবের ইতিহাসচর্চা প্রায় ফরাসি বিপ্লবের পরেই শুরু হয়েছিল। ১৭৮৯ সালের ২৭ জুন আর্থার ইয়ং লিখেছিলেন, ‘সমস্ত ব্যাপারটাই মিটে গেছে এবং বিপ্লব সমাপ্ত হয়েছে।’ ইয়ং দীর্ঘদিন ধরে ফ্রান্সে ভ্রমণ করেছিলেন এবং তাঁর প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার কথা লিখেছিলেন। এডমন্ড বার্ক তার ‘রিফ্লেকশন্স অন দ্য ফ্রেঞ্চ রিভোলিউশন’ গ্রন্থে বিপ্লবকে একটি ষড়যন্ত্র হিসেবেই দেখেছিলেন। মিশলের ‘ফরাসি বিপ্লবের ইতিহাস’ ১৭৯৪ সালে রোবসপিয়েরের মৃত্যুর সঙ্গেই শেষ হয়ে যাচ্ছে। নেপোলিয়নের দাবি ছিল যে তিনি বিপ্লবকে ১৭৯৯ সালে সমাপ্ত করেছিলেন। ফরাসি বিপ্লবের চরিত্র, কারণসমূ্‌হ, তাৎপর্য, বিভিন্ন কুশীলবের ভূমিকা, বিপ্লবের প্রভাব ইত্যাদি সমস্ত দিক দিয়েই ঐতিহাসিকরা দু’শো বছরের বেশি সময় ধরে পর্যালোচনা করেছেন এবং নিজেদের অনুভূতি, মতাদর্শ ও সময়ানুযায়ী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন।

ফরাসি বিপ্লবের জটিল প্রক্রিয়া অনুধাবন ও ব্যাখ্যা করতে গিয়ে কেউ স্বাধীনতা ও সাম্যের প্রতিষ্ঠা লক্ষ্য করেছেন,  কেউ বিপ্লবকে একটি ষড়যন্ত্রের ফল মনে করেছেন, আবার কেউ বিপ্লবের মধ্যে নতুন এক শাসন কাঠামোর প্রতিষ্ঠার  প্রয়াস দেখেছেন।  পরবর্তী ঘটনা,  যেমন ইউরোপের উনিশ শতকের রাজনীতি, ১৮৪৮ সালের বিপ্লবসমূহ, এমনকী ১৯১৭ সালের রুশ বিপ্লব ও লেনিনের কাজকর্মের মধ্যেও অনেকে এই বিপ্লবের সুদূরপ্রসারী প্রভাব খুঁজে পেয়েছেন।  বিপ্লবের উৎস ও ফলাফল, ঘটনাবলীর তাৎপর্য,  বিপ্লবের রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক দিকগুলিও ঐতিহাসিকরা বিচার করেছেন নিজেদের আদর্শের নিরিখে। তাই বিপ্লবের ইতিহাস রচনায় আবেগের ও উৎসাহের অভাব কখনও দেখা যায়নি। ১৯৭৮ সালে  ফ্রাঁসোয়া ফুরে তাঁর রচিত বিপ্লবের ইতিহাস প্রকাশ করে এই দীর্ঘ ইতিহাসচর্চায়  ইতি টানতে চেয়েছিলেন। তাঁর  কথায় ‘La Revolution est termine’ (বিপ্লব শেষ হয়ে গেছে)। তাঁর মন্তব্যের ব্যঞ্জনা এই যে, বিপ্লবের আর নতুন করে কোনো ইতিহাস রচনায় প্রয়োজন নেই। তাঁর দাবী ছিল, বিপ্লবের প্রান্তিক রহস্য তিনি উন্মোচন করে দিয়েছেন এবং বিপ্লবের ইতিহাসচর্চার দীর্ঘ জ্যাকোবিন- মার্কসবাদী ঐতিহ্যের যুক্তিকে খণ্ডন করেছেন। ১৯৮৯ সালে ফরাসি বিপ্লবের দ্বিশতবর্ষ উদযাপনের সময় ও তার পরে প্রায় দু’দশকের ইতিহাস-চর্চা ফুরের ধারণাকে সত্য প্রমাণিত করেনি। এ প্রসঙ্গে এরিক হবসবম আরও সংযত ‘The revolution is Still by no means recollected in political tranquillity’. ফুরে ও রিসের সঙ্গে সবুল ও মার্কসবাদীদের বিতর্ক পরলে একথা পরিষ্কার হয়। 

Jacques Bertaux-এর আঁকা Prise du palais des Tuileries – 1793

দু’শো বছরের ওপরে যত ঐতিহাসিক ফরাসি বিপ্লবের ইতিহাসচর্চা করেছেন, তাদের তালিকাও যে কোনো রচনাকে দীর্ঘ করবে। তাই আমরা বিপ্লবের ইতিহাসচর্চার মূল কয়েকটি ধারা ও বিতর্কের মূল বিষয়গুলির মধ্যেই আমাদের আলোচনা সীমাবদ্ধ রাখব।

নিঃসন্দেহে ফরাসি বিপ্লব ইতিহাসচর্চার ক্ষেত্রে সবথেকে আলোচিত ঘটনাগুলির অন্যতম। এই বিপ্লব সমসাময়িক ফ্রান্স ও ইউরোপকে তাদের প্রতিক্রিয়া দিতে উদ্বুদ্ধ করেছিল এবং প্রত্যেক প্রতিক্রিয়ার মধ্যে আবেগ ছিল –  বিপ্লবের পক্ষে বা বিপক্ষে যুক্তি ছিল। ঠিক যেমন ফ্রান্সের মানুষ বিপ্লবের পক্ষে বা বিপক্ষে ছিল। বার্ক, বারুয়েল প্রমুখ বিপ্লবের  পেছনে একটি ষড়যন্ত্র প্রত্যক্ষ করেছিলেন। উনবিংশ শতকে উদারপন্থী ঐতিহাসিকেরা বিপ্লবের নরমপন্থী দিকটির প্রতিই নিজেদের সমর্থন জ্ঞাপন করেছিলেন।  কিন্তু এদের অনেকেই যেমন তিয়ের (Thiers) মিনে (Mignet) বা গিজো (Guizot) ১৭৮৯ সালের বিপ্লবকে ব্যবহার করেছিলেন নিজেদের রাজনীতিকে তুলে ধরার জন্য। তাদের কাছে বিপ্লব নিয়মতান্ত্রিক রাজতন্ত্রেরই প্রতিভূ।

একথা বিশেষ প্রণিধানযোগ্য যে ফরাসি বিপ্লবের বিষয়ে যা লেখা হয়েছে, তা প্রায়শই লেখকদের সামাজিক-রাজনৈতিক আদর্শকেই প্রতিফলিত করেছে। তাই পুরো উনিশ শতক জুড়ে বিপ্লবের সমর্থন ও বিরোধিতা প্রায়শই করা হয়েছে সমসাময়িক রাজনৈতিক উদ্দেশ্য চরিতার্থ করতে।  ফরাসি বিপ্লবের ধ্রুপদী ব্যাখ্যা বিপ্লবের ইতিহাসকে প্রগতির পথে একটি গুরুত্বপূর্ণ স্মারকচিহ্ন হিসেবে তুলে ধরেছে। উনিশ শতকের মাঝামাঝি অন্যান্য অনেক ঐতিহাসিকদের মধ্যে জুল মিশলে (Jules MIchelet) একটি বিশিষ্ট স্থান অধিকার করে রয়েছেন। তার মতে বিপ্লবের ইতিহাসের মূল কুশীলব ফ্রান্সের সাধারণ মানুষ। তার মতে, বিপ্লবের কারণ মানুষের দুর্দশা (revolution de la misere)। এই মতকে ঘিরেই বিপ্লবের চরিত্র সম্পর্কে প্রাথমিক একটি বিতর্ক তৈরি হয়েছিল- বিপ্লবের পশ্চাতে সাধারণ মানুষের দুর্দশা ছিল, না কিছু মানুষের সমৃদ্ধি (prosperity) – এই বিতর্ক এখনও ইতিহাস রচনায় প্রাসঙ্গিক। মিশলের ইতিহাস আমরা আগেই দেখেছি ১৭৯৪ সালে থেমে যায়।

জুল মিশলে (১৭৯৮-১৮৭৪)

উনিশ শতকের শেষ থেকেই ফরাসি বিপ্লবের পেশাদারী ঐতিহাসিক চর্চা শুরু হয় বলা যায়। বিপ্লবের শতবর্ষপূর্তি এ বিষয়ে উৎসাহ যুগিয়ে ছিল।  সরবন বিশ্ববিদ্যালয়ে ফরাসি বিপ্লবের ইতিহাসের প্রথম আনুষ্ঠানিক অধ্যাপকের পদ লাভ করেন আলফঁস ওলার (Alphonse Aulard, ১৮৪৯-১৯২৮)। প্রাতিষ্ঠানিক ইতিহাসচর্চার ওপরে বিশেষ প্রভাব ফেলেছিল সমাজবাদী রাজনীতিবিদ জঁ জোরেস (Jean Jaures)-এর ইতিহাস – A Socialist history of the French Revolution; তিনি আনাল হিস্তরিক দ্য লা রেভলিউশিঁয় ফ্রঁসেজ (AHRF) নামে একটি পেশাদারী জার্নালেরও সূচনা করেন। জোরেস-এর ইতিহাসে বিপ্লবের আর্থ-সামাজিক দিকগুলিই প্রাধান্য লাভ করেছিল।  ইতিহাসের বিশ্লেষণে মার্কসের চিন্তার প্রয়োগও এসময় লক্ষ্য করা যায়। মার্কস নিজে বিপ্লবের উপরে খুব বেশি লেখেননি, কিন্তু যে ঘটনা সামন্ততন্ত্র এবং অভিজাততন্ত্রের বিরুদ্ধে আক্রমণ দিয়ে শুরু হয়েছিল, তার মধ্যে মার্কসীয় ব্যাখ্যা খুঁজে পাওয়া সহজ ছিল; সুতরাং আধুনিক ইতিহাসের ধারণায় ফরাসি বিপ্লবের স্থান অতীব তাৎপর্যপূর্ণ।  সামন্ততন্ত্র থেকে ধনতন্ত্রের উত্তরণের ইতিহাসে এই বিপ্লবের স্থান কেন্দ্রীয়।

জোরেস বিশ্লেষণের নতুন প্রেক্ষিত তৈরি করেছিলেন। ফরাসি বিপ্লবের প্রাতিষ্ঠানিক ইতিহাসচর্চার ক্ষেত্রে ওলার ও তার উত্তরসূরিদের (যেমন মাতিয়ে, লেফেভর ও সবুল) রচনাই বিপ্লবের ইতিহাসচর্চার মূল ধারাগুলি প্রথমদিকে প্রতিষ্ঠা করেছিল। বিতর্কও এই বিশ্লেষণগুলিকে ঘিরে তৈরি হয়েছিল।

ওলারের ইতিহাস রচনার বৈশিষ্ট্য ছিল বিপ্লবের রাজনৈতিক ঘটনাবলীর  নিখুঁত বিবরণ লিপিবদ্ধ করা। ১৭৮৮ সালে স্টেটস জেনারেলের অধিবেশন আহ্বান থেকে শুরু করে, এর জাতীয় সভায় রূপান্তর, নতুন সংবিধান ও রাজা কর্তৃক দ্বিধাগ্রস্ত অনুমোদন, আইনসভার নির্বাচন ও অধিবেশন, যুদ্ধের সূচনা এবং রাজতন্ত্রের পতন, জাকোবাঁ একনায়কতন্ত্রের উত্থানের পর্যায়ে ( যে সময়ে জিরণ্ডিনদের প্রতি তাঁর পক্ষপাত স্পষ্ট),  রোবসপিয়ের পরবর্তী সময়ের বিবরণ তাঁর ইতিহাসে আছে- ১৭৯৯ সালে নেপোলিয়নের ক্ষমতা দখল পর্যন্ত। ওলারের রচনায় প্রজাতন্ত্রের অন্যান্য মহিমায় উদ্ভাসিত। তিনি তৃতীয় প্রজাতন্ত্রের গণতান্ত্রিক, প্রজাতান্ত্রিক রাজনীতির অনুসারী। সেই মতাদর্শ তাঁর রচনায় বিশেষভাবে উপস্থিত। পুরনো রাজত্বের স্বৈরতান্ত্রিক রীতিনীতিই বিপ্লবের প্রেক্ষাপট। ১৭৯১ সালের সংবিধান অসম্পূর্ণ, কারণ রাজার হাতে তখন প্রচুর ক্ষমতা ন্যস্ত। দাঁতঁর স্পর্ধা ও পারির সংগ্রামী জনতাই বিপ্লবকে নতুন পর্যায়ে উন্নীত করেছিল। ১৭৯৩ সালের ১০ আগস্টের অভ্যুত্থানই বিপ্লবকে যথার্থতা প্রদান করেছিল, প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পথ সুগম করেছিল।

ত্রয়ীঃ বাস্তিল, গিলোটিন আর জনগণের ক্ষমতা দখল।

ওলারের বিবরণ মূলত রাজনৈতিক। সামাজিক দুর্দশা ও হতাশার গভীর বিশ্লেষণ তিনি করেননি। রাজনৈতিক আন্দোলনের পেছনে সামাজিক কারণে পর্যালোচনা তাঁর রচনায় উপেক্ষিত। ১৭৮৭ থেকে ১৭৮৯ পর্যন্ত সংকটের যথাযথ বিশ্লেষণ বা ‘অভিজাত’দের পাল্টা আক্রমণের বিবরণও তাঁর রচনায় অনুপস্থিত। স্মর্তব্য যে, শাতোব্রিয়াঁ বহু পূর্বেই বলেছিলেন যে, ‘the patricians began the Revolution, the plebeians finished it.’

ফরাসি বিপ্লবের ইতিহাসের অধ্যাপকের পদে ওলারের উত্তরসূরি ছিলেন আলবেয়ার মাতিয়ে (Albert Mathiez, ১৮৭৪-১৯৩২)। মাতিয়ের ইতিহাস চেতনার ওপরে সমাজবাদী রাজনৈতিক ও ঐতিহাসিক জোরেসের বিশেষ প্রভাব ছিল। এছাড়া ১৯১৭ সালের বলশেভিক বিপ্লব তাঁকে নাড়া দিয়েছিল। তাই তাঁর রচিত ইতিহাসে বিপ্লবের র‍্যাডিক্যাল পর্যায়ের স্থান কেন্দ্রীয়। দাঁতঁকে ভ্রষ্ট বুর্জোয়া রাজনীতিবিদ হিসেবে বর্ণনা করে তিনি রোবসপিয়েরের ভূমিকাকে গুরুত্ব দেন। ‘সন্ত্রাসের রাজত্ব’কে নিছক বল্গাহীন ও অর্থহীন সন্ত্রাসরূপে তিনি দেখেননি। তার বিশ্লেষণে ‘সন্ত্রাসের রাজত্ব’ যুদ্ধের ও বৈপ্লবিক সংকটের ফলে সৃষ্ট হয়েছিল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় ফ্রান্সে বসবাসের অভিজ্ঞতাকে সম্ভবত তাঁকে ১৭৯৩-৯৪ সালের ঘটনাবলীকে সহানুভূতি দিয়ে বিচার করতে প্রবুদ্ধ করেছিল। কিন্তু ‘সন্ত্রাসের রাজত্ব’-এর প্রতি তাঁর সমর্থন জোরালো ও স্পষ্ট। এর বিপরীতে তেইনকে (Taine) দেখা যায় – ১৮৭১ সালের পারি কমিউনের অভিজ্ঞতা তাঁকে গণবিদ্রোহ সম্পর্কে ভীত করেছিল। মাতিয়ে যাজক শ্রেণী সম্পর্কে তাঁর বিচারের ক্ষেত্রে ওলারের থেকে পৃথক। উচ্চ যাজকদের থেকে নিম্ন যাজকদের (যাদের মধ্যে পুঞ্জিভূত অসন্তোষ ছিল) তিনি আলাদা করে দেখেছেন। সন্ত্রাসের রাজত্বের সময়ে সাধারণ মানুষের ভূমিকাকে তিনি বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন। এপ্রসঙ্গে তাঁর রচিত La Vie Chere: et la mouvement social Sous la Terreur – প্রমাণ করার প্রয়াস নিয়েছে যে সাধারণ মানুষের চাপেই রোবসপিয়ের ও জাঁকোবা নেতৃত্ব ‘সর্বোচ্চ মূল্যের আইন’ জারি করেছিলেন। রোবসপিয়ের একনায়ক নন, একজন গণতান্ত্রিক রাজনীতিবিদ, যিনি সাধারণ মানুষের দাবি ও আশা-আকাঙ্ক্ষাকে বাস্তব শাসনতান্ত্রিক রূপ দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। তিনি সাধারণ মানুষের চাহিদার প্রতি সাড়া দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। বুর্জোয়ারা তাই শেষ পর্যন্ত তাঁর বিপক্ষে চলে যায়। তিনি রোবসপিয়ের ভূমিকা পাঠের জন্য একটি ‘রোবসপিয়ের পাঠ সমিতি’ও স্থাপন করেছিলেন।

ফ্রান্সের রাজা ষোড়শ লুই ও তার পরিবারকে বন্দি করার একটি দৃশ্য (শিল্পীঃ টমাস মার্শাল, ১৮৫৪)

মাতিয়ের পরে জর্জ লেফেভর (George Lefebvre, ১৮৭৪-১৯৫৭), আলবেয়ার সবুল (Albert Soboul, ১৯১৪-১৯৮২) ও মিশেল ভভেল (Michel Vovelle, ১৯৩৩-২০১৮) বিপ্লবের ইতিহাসের অধ্যাপকের পদ অলংকৃত করেছিলেন। ভভেল-এর পরেই এই পদের উপরে মার্কসবাদীদের একাধিপত্য শেষ হয়। লেফেভর তাঁর ইতিহাস রচনায় ফরাসি বিপ্লবে কৃষকদের ভূমিকার বিশ্লেষণ করেন। কৃষক বিপ্লবের গুরুত্বকে প্রতিষ্ঠা করে তিনি দেখান যে, এর ফলে জাতীয় সভা অধিবেশনের প্রথমেই সামন্ততান্ত্রিক করের অবসান ঘোষণা করে। তাঁর বিশ্লেষণের প্রভাব ফ্রান্সে কৃষি সম্পর্কের বিকাশের ক্ষেত্রে নতুন দিগন্ত উন্মোচিত করে। ‘ল্য গ্রঁ প্যর’ (Le grande peur) বা ‘বিষম ভীতি’ নামক গ্রন্থে তিনি কৃষকদের তথা সাধারণ মানুষের যৌথ মানসিকতার সন্ধান করেছেন এবং এক্ষেত্রে গুজবের ভূমিকার অত্যন্ত চিত্তাকর্ষক আলোচনা করেছিলেন। বিপ্লবের মানসিকতা চর্চার ইতিহাসে তার স্থান পথিকৃতের।

লেফেভর-এর ধারাকে শহরাঞ্চলের ক্ষেত্রে বিস্তৃত করেছেন সবুল। তিনি পারির নিম্নবিত্ত, দরিদ্র শহুরে মানুষের বৈপ্লবিক মানসিকতা ও কাজকর্ম খুঁটিয়ে দেখেছেন। দ্বিতীয় বর্ষের পারির সাঁ কুলোৎদের দৃষ্টিভঙ্গির বিশ্লেষণ করে তিনি দেখিয়েছেন যে এরা নেতাদের নিছক ক্রীড়নক ছিল না। ১৭৯৪ সালে পারির বিভিন্ন সেকসিয়ঁর (মিউনিসিপাল ওয়ার্ডের মত) জনগণের কাজকর্ম বিশ্লেষণ করে তিনি দেখিয়েছেন যে তাদের নিজেদের কর্মের স্বাতন্ত্র্য ও উদ্যোগ ছিল। সবুল এই শ্রেণীর পাঠ করে তার বিবরণী তৈরি করেছেন। কিন্তু তাদের মানসিকতার বিশ্লেষণ পরবর্তী সময়ে করা হয়। জোরেস থেকে সবুল পর্যন্ত ফরাসি বিপ্লবের ইতিহাসচর্চায় বিপ্লবের মূল ঘটনাগুলিকে এইভাবে সংক্ষেপে বিবৃত করা হয়েছে (সবুলের বর্ণনা অনুযায়ী): নিরঙ্কুশ রাজতন্ত্র সংকটমোচনে ও অস্তিত্ব রক্ষায় যে সংস্কার প্রবর্তনের প্রয়াস নেয়, তার বিরুদ্ধে সম্মিলিত অভিজাত প্রতিবাদ ও বিদ্রোহ দিয়েই বিপ্লব শুরু হয়। কিন্তু বিপ্লব এই শ্রেণীর বিপক্ষেই চলে গিয়েছিল এবং সেই বিপ্লবের হোতা ছিল বুর্জোয়ারা। এজন্যই নতুন সংবিধান বুর্জোয়া উদ্যোগের ওপরে নিগড় খুলে দিয়ে তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করে এবং অভিজাতদের বিশেষ সুবিধা কেড়ে নেয়। জাকোবাঁ আধিপত্যের পর্যায়ে এই বুর্জোয়া বিপ্লবকে বহিরাক্রমণ এবং অভ্যন্তরীণ প্রতিবিপ্লব থেকে রক্ষা করতে শহুরে দরিদ্র মানুষ ও কৃষকদের সাহায্য গ্রহণ করা হয়। তাই এই পর্যায়ে নিছক বুর্জোয়া স্বার্থরক্ষার থেকে আরও ব্যাপক একটি আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক কর্মসূচি গ্রহণের ব্যবস্থা করা হয়।

ম্যাক্সিমিলিয়েন দ্য রোবসপিয়ের (১৭৫৮ – ১৭৯৪)

এর পেছনে অবশ্যই ১৭৮৯ সালের বিপ্লবকে রক্ষার বুর্জোয়া তাগিদ ছিল। কিন্তু রোবসপিয়ের পতনের সঙ্গে সঙ্গে আবার সম্ভ্রান্ত শ্রেণীর আধিপত্য লক্ষ্য করা যায়। সম্পত্তির মালিক বুর্জোয়াদের সঙ্গে সঙ্গে বিপ্লবের ফলভোগী অভিজাতদের একটি জোট দেখা গেল। নেপোলিয়নের অভ্যুত্থান এই জোটের স্বার্থ রক্ষার্থে করা হয়েছিল – একদিকে বিদেশি আক্রমণ ও অন্যদিকে প্রতিবিপ্লব থেকে বিপ্লবকে রক্ষা করতে। তাই জঁ তুলার নেপোলিয়নকে ‘বুর্জোয়া সৃষ্ট রক্ষাকর্তা’ রূপে বর্ণনা করেছেন। অর্থাৎ, বিপ্লবকে একটি শ্রেণিসংগ্রাম হিসেবেও দেখা হয়েছে। অভিজাতদের পতনের সঙ্গে বুর্জোয়াদের উত্থান, দরিদ্র মানুষের অন্তত সামরিক জাগরণও উল্লেখযোগ্য। এই বিশ্লেষণের সঙ্গে সবাই স্বভাবতই একমত হননি, কিন্তু এই ঐতিহাসিকদের ব্যাখ্যার কাঠামো কেউ অস্বীকার করেননি। তাদের ব্যাখ্যা বিপ্লবের ইতিহাসচর্চায় একটি orthodoxy বলেই পরিচিত। ভভেল তার গবেষণায় এধরনের ব্যাখ্যার মধ্যেই নতুন মাত্রা যোগ করেছেন। তিনি দেখিয়েছেন যে, দীর্ঘ বিবর্তনের ধারণার সঙ্গে ঘটনার বিশ্লেষণের একটি যোগসূত্র স্থাপন করা সম্ভব। প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে পুরোনো সমাজের দীর্ঘ সময়ের কাঠামো বিচার করে তার সংকট যেমন বোঝা যায়, তেমনি বিপ্লবের সময়ের ঘটনাবলী যে এই কাঠামো থেকেই উদ্ভূত, তাও দেখানো সম্ভব। অর্থাৎ, পরোক্ষ ও দূরবর্তী কারণ এবং প্রত্যক্ষ বা নিকটবর্তী কারণের মধ্যে প্রভেদ খোঁজার কোনো প্রয়োজন নেই। আনল স্কুল এবং ফেরনঁ ব্রদেলের longue duree সংক্রান্ত ধারণার প্রেক্ষিতে এই ব্যাখ্যা বেশ তাৎপর্যপূর্ণ।১০ হবসবমও লিখেছেন, ‘the accumulating tensions within the system May actually produce or facilitate the production of certain precipitants such as economic crisis and wars, and encourage certain situation of political vulnerability in the cold regimes‌, such as financial crisis.’

এরিক হবসবম (১৯১৭-২০১২)

দীর্ঘ সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে বিভিন্ন ঘটনা পু্রোনো রাজত্বের রাজনৈতিক বৈধতা কিভাবে ধ্বংস করেছিল ভভেল তাঁর ‘ফরাসি রাজতন্ত্রের পতন’ (১৯৭২) গ্রন্থে সুন্দরভাবে তা বিশ্লেষণ করেছেন।১১ ‘feudal’ শব্দটি কিভাবে পুরোনো রাজত্বে ব্যবহৃত হয়েছিল, তার ব্যবহার ও অপব্যবহারের বিশ্লেষণ থেকে শুরু করে ভভেল ফ্রান্সের কৃষি সম্পর্কের বিকাশ, চার্চ, অভিজাত, বুর্জোয়া ও কৃষকদের মধ্যে জমির মালিকানার বিতরণ; ভূমি ব্যবহার ও উদ্বৃত্ত আহরণের প্রকার, কৃষক সমাজের আঞ্চলিক প্রভেদ এবং অষ্টাদশ শতকে সামন্ততান্ত্রিক করের চাপ বৃদ্ধি ইত্যাদির বিশদ পর্যালোচনা করেছেন। টেডা স্ককপোল (Theda Skocpol)-ও দেখিয়েছেন কীভাবে উপনিবেশিক যুদ্ধে বেশি ব্যয় করার ফলে ফরাসি রাষ্ট্র একটি বিপ্লবী সংকটে জড়িয়ে পড়েছিল।১২ ফুরে (Furet)-র মন্তব্য, যে অষ্টাদশ শতক একটি ‘Happy Century’ ছিল তা সঠিক বলে মনে হয় না।  এঁরা দেখালেন যে দীর্ঘ সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে ফ্রান্সের সংকটের স্বরূপ বোঝা সম্ভব। বিপ্লব-পূর্ববর্তী ও বিপ্লবের সময়ের সংকটকে একসূত্রে গাঁথাও সম্ভব। অর্থাৎ, দূরবর্তী পরোক্ষ কারণ ও সমসাময়িক প্রত্যক্ষ কারণকে আলাদা করে দেখার কোনো প্রয়োজন নেই। সামাজিক-রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক কাঠামোর পুরোনো ফাটল অনেক সময়ই অর্থনৈতিক সংকট বা যুদ্ধ ইত্যাদির ফলে আরও বিস্তৃত হয় ও ভাঙনের পরিস্থিতি তৈরি করে।

সমসাময়িক নথিপত্রে ফ্রান্সের সমাজকে বিভিন্ন ‘এস্টেট’-এ বিভক্ত হিসেবেই দেখানো হয়েছে। তাই মুনিয়ের (Mounier) প্রমুখ ঐতিহাসিক ফ্রান্সের সমাজকে শ্রেণীতে (class) বিভক্ত বলে মনে করেননি। সমাজে বিভাজন ছিল স্ট্যাটাস-নির্ভর। ভভেল দেখানোর চেষ্টা করেছেন যে এই সমাজ বিভিন্ন শ্রেণীতে (class) বিভক্ত ছিল; সামাজিক শ্রেণীগুলি কিন্তু ক্রমোচ্চ পর্যায়ে বিভক্ত এস্টেট ব্যবস্থার মধ্যেই নিহিত ছিল। এর ভেতরেই নতুন একটি ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থার উপরে নির্ভরশীল কাঠামো পুরোনো ব্যবস্থাকে পরিবর্তনের পক্ষে কাজ করেছিল। পুরনো রাজত্বের শেষ পর্যায়েও মানুষের মনে এস্টেট-বিভক্ত সমাজের ছবিই বজায় ছিল। এই সমাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত ভাষাই মানুষের অভিযোগপত্রে (cahiers) যেমন শোনা গেছে, তেমনই ধনী বুর্জোয়াও অভিজাতদের মর্যাদা পেতে আগ্রহী ছিলেন। কিন্তু এর ভেতরেই ধীরে ধীরে একটি নতুন ব্যবস্থার জন্ম হয়েছিল এবং তার ফলে প্রচলিত ব্যবস্থার সম্পর্কে মোহও দূর হচ্ছিল। বিভিন্ন এস্টেট প্রথাগত অর্থনৈতিক কাজকর্মের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। শোসিনঁ-নগারে (Chaussinand-Nogaret) দেখেছেন যে অষ্টাদশ শতকে ফ্রান্সে অনেক অভিজাতই ধনতান্ত্রিক উৎপাদন ব্যবস্থায় বিনিয়োগ করেছিলেন।১৩ ভভেল, তাই বুর্জোয়া শ্রেণীর মধ্যেও বিভিন্ন স্তর ও অর্থনৈতিক কাজকর্ম দেখেছেন। মিশ্র শ্রেণি, অর্থাৎ অর্থের ব্যবসাদার, কনট্রাকটর, শিল্পের মালিক এমনকী খাজনা বাড়িভাড়ার ওপর নির্ভরশীল মানুষও বুর্জোয়া শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত ছিল। অর্থাৎ, এদের রচনায় ব্যাপক অর্থে সামাজিক বিপ্লবের ব্যঞ্জনাটি টিকে গেল।

ইমানুয়েল ওয়ালারস্টাইনও পরবর্তী সময়ে ফরাসি বিপ্লব ও নেপোলিয়নের যুগের মধ্যে যুগান্তরের আভাস লক্ষ্য করেছেন।১৪ তাঁর মতে, ধনতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা এই পর্বেই একটি ‘World system’-এ রূপান্তরিত হয়। মার্কসবাদী ইতিহাস রচনার পাশাপাশি বিংশ শতকের তিরিশের দশকে ফ্রান্সের বাইরে আমেরিকা ও ইংল্যান্ডের বহু ঐতিহাসিক ফরাসি বিপ্লবের ইতিহাস রচনায় উৎসাহী হন। এদের মধ্যে একটি উদারপন্থী ব্যাখ্যার কাঠামো দেখা যায়। এই প্রগতির কাঠামোর মধ্যেই তাঁরাও বিপ্লবকে দেখেছিলেন, কিন্তু সব সময় একটি যুগান্তর বা সামাজিক-অর্থনৈতিক ব্যবস্থার রূপান্তর তারা এর মধ্যে খোঁজেননি। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য জে এম টমসন, লুই গটশক (Louis Gottschalk) বা হার্ভার্ডের ঐতিহাসিক ক্রেন ব্রিন্টন। আসলে ১৯৩০-এর দশকে এঁরা ১৭৯১-এর নরমপন্থী রাজতান্ত্রিক বিপ্লব এবং পরবর্তী সময়ের প্রজাতান্ত্রিক বিপ্লবের মধ্যে একটি প্রভেদ দেখতে পেয়েছেন। পরবর্তী সময়ে এই মূলগত সামাজিক বিপ্লবের যে ধারণা মার্কসবাদী ঐতিহাসিকরা তৈরি করেছিলেন, যার ভিত্তি ছিল একটি শ্রেণির – মূলত বুর্জোয়া শ্রেণির উত্থান, তার বিরুদ্ধে সরাসরি আঘাত আসে এক ধরনের ঐতিহাসিকদের কাছ থেকে। এই ঐতিহাসিক রচনার ধারাকে ‘সংশোধনবাদী’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এটি প্রথম দেখা যায় ১৯৬০-এর দশকে, আলফ্রেড কবান (Alfred Cobban)-এর Social Interpretation of the French Revolution’ গ্রন্থে।১৫

ফরাসি বিপ্লব সামন্ততন্ত্র ধ্বংস করে বুর্জোয়া প্রাধান্য স্থাপন করেছিল – এই ধারণাকে কবান একটি মিথ বলে বর্ণনা করেছেন। ১৭৮৯ সালে স্টেটস জেনারেলে যত বুর্জোয়া সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন, তার মধ্যে মাত্র 13 শতাংশ এসেছিলেন বাণিজ্য ও অর্থের জগৎ থেকে। তাঁর মতে, অর্থের জগতের উদীয়মান বুর্জোয়া (rising bourgeoisie) নয়, ছোটখাটো সরকারি পদ কিনেছিল যেসব বুর্জোয়া বা বুর্জোয়াদের পেশাদার অংশ – যাদের তিনি বলেছেন ‘ক্ষয়িষ্ণু বুর্জোয়া’ (declining bourgeoisie) – তারাই ছিলেন বুর্জোয়াদের বিপ্লবী অংশ। লেফেভর এর উত্তরে বলেছিলেন যে, ১৭৮৯-এর নেতারা পুঁজিপতি না হলেও এদের কাজকর্ম ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থার বিকাশে সাহায্য করেছিল এবং সেটাই সবথেকে বড় কথা- “the myth, if myth, it was, was a necessary one.”১৬ আমেরিকান ঐতিহাসিক জি ভি টেলরও লিখেছিলেন যে, মূলধনের মালিক বুর্জোয়ারা রাজনীতি সম্পর্কে নিস্পৃহ ছিল। ম্যাকমানার্স নামে আরেকজন ঐতিহাসিকও যুক্তি দেখিয়েছেন যে পুরোনো ব্যবস্থাকে বোঝার মূল চাবি অর্থ, বিশেষ সুবিধা নয়। এই ধরনের সংশোধনবাদী ঐতিহাসিকদের মতে, অর্থ ও সম্পদ অভিজাত এবং উচ্চ বুর্জোয়াকে একটি সম্পন্ন উচ্চশ্রেণীতে একসূত্রে গেঁথে ছিল।১৭ যেমন অনেকেই দেখিয়েছেন যে, অভিজাতরা তাদের বিষয়সম্পত্তির দেখাশোনা ভালোভাবেই করতেন, এমনকী ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থাতেও তাঁদের কিছু ভূমিকা ছিল। এই গবেষকদের বক্তব্য, প্রাক-বিপ্লব ফ্রান্সে বিভিন্ন সামাজিক শ্রেণীর অর্থ ও সম্পদের চরিত্র ধনতান্ত্রিক ছিল না। বুর্জোয়া ও অভিজাতদের বহু স্বার্থই এক ছিল। সরকারের বিভিন্ন দাবি তাদের স্বার্থে আঘাত হেনেছিল। প্রশ্ন উঠতে পারে যে তবে এদের মধ্যে বিরোধ ও সংঘর্ষ কেন হল? টেলরের মতে, এর কারণ রাজনৈতিক, সামাজিক নয়। কলিন লুকাসও দেখিয়েছেন, বুর্জোয়া ও অভিজাত একই সম্পত্তির মালিক এলিট-এর অংশ কিন্তু তাদের মধ্যে ‘stress zones’ ছিল এবং এর মধ্যেই বিরোধ ও সংঘর্ষের উৎপত্তি। কেনা রাজপদের অধিকারী বুর্জোয়ার মধ্য ও নিম্ন অংশ আর্থিক সমৃদ্ধির ফললাভ করেনি।১৮

স্টেটস জেনারেল যখন পুরনো ভোটের ব্যবস্থা বজায় রাখতে চাইল, তখন বুর্জোয়াদের এই অংশ ভয় পেয়ে গিয়েছিল। তাঁর মতে, তৃতীয় এস্টেটের বিদ্রোহ মূলত এই এলিটের বিরুদ্ধে অন্যান্য অংশের বিদ্রোহ। এদের সঙ্গে ছিল বাণিজ্যে যুক্ত সেইসব মানুষ, যারা এলিট শ্রেণীতে প্রবেশের মুখে ছিল। এই সামাজিক গোষ্ঠীই বিপ্লবী বুর্জোয়া হয়েছিল।

সংশোধনবাদের ইতিহাস চর্চার প্রবক্তা হয়ে দাঁড়ান ফ্রাঁসোয়া ফুরে (১৯২৭-৯৭)। তিনি আনাল পত্রিকায় প্রথম একটি প্রবন্ধ রচনা করে ফ্রান্সের পুরোনো ব্যবস্থার সামাজিক শ্রেণির অর্থ ও সম্পদের চরিত্র যে  ধনতান্ত্রিক বা capitalist ছিল না, ছিল মালিকানাভিত্তিক বা proprietary – সে কথা প্রমাণ করার চেষ্টা করেন। পরে তিনি ও ডনিস রিশে – মার্কসবাদী বা ধ্রুপদী ব্যাখ্যাকে চ্যালেঞ্জ করে তাদের নিজেদের মত ব্যক্ত করেন এবং এটি যে একটি সামাজিক শ্রেণীর উত্থানের সূচনা করেনি সেই মত প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেন। তাঁরা বলেছিলেন, সন্ত্রাসের ফলে বিপ্লব পথভ্রষ্ট হয়েছিল – ‘skidded off course.’ তারা রাজনৈতিক দিকটির ওপরেই বেশি জোর দেন, সামাজিক দিকটির ওপরে নয়।১৯ ফুরে সরবোনে পড়াশোনা করেছিলেন এবং একোল প্রাতিক দেজোৎ এতুদ্‌ – প্রতিষ্ঠানে তাঁর ইতিহাসচর্চা করেছিলেন। তিনি একদা মার্কসবাদে বিশ্বাস রাখলেও পরবর্তী সময় সেখান থেকে সরে এসেছিলেন। তাঁর ‘Interpreting the French Revolution’ গ্রন্থে তিনি ফরাসি বিপ্লবের পুরোনো ধারণার ওপরে সোজাসুজি আঘাত হানেন। ফুরের আশা ছিল তিনি ফরাসি বিপ্লবের ইতিহাসচর্চাকে তার যে মূল ধারা, অর্থাৎ রাজনৈতিক, সেখানে ফিরিয়ে দেবেন। ফুরের যুক্তি ছিল enlightenment-এর সময়ের কিছু দার্শনিকের, বিশেষ করে রুশোর গণতান্ত্রিক ধারণা বিপ্লবের ভেতরে অন্তর্নিহিত ছিল। এখানে গণতন্ত্রের ধারণা এই নয় যে সম্মতি, অর্থাৎ সমস্ত মানুষের সম্মতি নিয়ে শাসন করতে হবে, এমনকী ব্যক্তিগত অধিকারকেও সম্মান জানাতে হবে। বরঞ্চ বিপ্লব একটা popular sovereignty বা সাধারণের সার্বভৌমত্বের আদর্শ আত্মসাৎ করেছিল। যার ফলে ক্ষমতার যে কোনো অপব্যবহারকে ব্যাখ্যা করা যায় বা যুক্তিসিদ্ধ করা যায় এই বলে যে এটি জনগণের নামে ব্যবহৃত হয়েছিল। সংক্ষেপে গণতন্ত্র বলতে জাতীয় রাষ্ট্রের সেই ক্ষমতা বোঝাচ্ছিল, যার দ্বারা তারা সমস্ত বিরোধীকে পরাজিত করতে পারে। তাই ফুরের মতে, প্রথম দিন থেকেই বিপ্লবের অভিমুখ এমন একটি রাষ্ট্র তৈরি দিকে ছিল যেখানে এই গণতান্ত্রিক মতাদর্শকে ব্যবহার করে একটি নিরঙ্কুশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা যাবে।২০ এই প্রক্রিয়াই শেষ পর্যন্ত ‘সন্ত্রাসের রাজত্ব’-এ পর্যবসিত হয়েছিল এবং এই মত অনুযায়ী, সন্ত্রাসের রাজত্ব কোনো দুর্ঘটনা নয়, বরঞ্চ বিপ্লবের প্রায় কেন্দ্রীয় চরিত্র। এভাবে দেখলে নেপোলিয়নের যুগ বিপ্লবেরই ফল। পরবর্তী সময়ে সাইমন শামা (Simon Schama) তার ‘Citizens’ নামক গ্রন্থে এইমতের প্রতিধ্বনি করেছিলেন।২১ তার ভাষায়, “The terror was merely 1789 with a higher body count.” ফরাসি বিপ্লব পুরোনো একটি প্রবণতাকে নিরবচ্ছিন্ন ভাবে টেনে নিয়ে গিয়েছিল, এই ধারণার উপস্থিতি এই মতের মধ্যে লক্ষ্য করা যায়। অর্থাৎ, বিপ্লব continuity ছিল না discontinuity ছিল? এখানে ফুরের মতের মধ্যে ঊনবিংশ শতকের বিখ্যাত লেখক অ্যালেক্সিস দ্য তকভিলের মতের প্রতিধ্বনি শোনা যায়। তকভিলের যুক্তির মূল কথা ছিল একটি শক্তিশালী কেন্দ্রীয় প্রশাসনিক কাঠামো (ঊনবিংশ শতকের ফ্রান্সের একটি বিশিষ্ট প্রতিষ্ঠান ছিল) – তা কিন্তু ancient regime বা পুরোনো রাজত্বের স্বৈরতান্ত্রিক বা নিরঙ্কুশ রাজারাই শুরু করেছিলেন। এই প্রশাসনিক কেন্দ্রীকরণের বিরোধী ছিলেন অভিজাতরা এবং বিভিন্ন বিশেষ সুবিধাপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান; তাদের মনে হয়েছিল যে তাদের যে স্বাতন্ত্র্য, বিশেষ সুবিধা ও অধিকার ছিল তা এর ফলে নষ্ট হতে পারে। অষ্টাদশ শতকে স্বাধীনতা তাই বিশেষ সুবিধারই নামান্তর ছিল। তকভিল এছাড়া বলেছিলেন, স্বাধীনতা ও সাম্যের মধ্যে একটি দ্বান্দ্বিক সম্পর্ক ছিল। যতই রাজনৈতিক এবং সামাজিক সন্ধান করা হ’ত, ততই ব্যক্তি বা একটি গোষ্ঠীর স্বাধীনতা বা বিশেষ অধিকার বিপন্ন হ’ত। প্রশাসনিক কেন্দ্রীকরণের জয়ের ফলে সাম্যের যে নীতি, সেটি ব্যক্তিগত স্বাধীনতা কিছুটা করেই অর্জিত হয়েছিল। চতুর্দশ লুইয়ের নিরঙ্কুশ রাষ্ট্র থেকে জাঁকোবা একনায়কতন্ত্র পর্যন্ত বা পরে নেপোলিয়নেরও সাম্রাজ্য, তৃতীয় নেপোলিয়নের সাম্রাজ্য – সমস্ত সময় জুড়েই এই স্বাধীনতাকে খর্ব করার প্রয়াস লক্ষ্য করা যায়।২২

La Liberté guidant le people বা মানুষের হাতে স্বাধীনতা, শিল্পীঃ Eugène Delacroix, 1830

মার্কসবাদী, বিশেষ করে বিংশ শতকের মাঝামাঝি সময় থেকে ইতিহাস আলোচনায় যেমন রুশ বিপ্লবের প্রভাব দেখা যায়, তেমনই তকভিলের আলোচনার পুনরুদ্ধারের মধ্যেও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর ঠান্ডাযুদ্ধের প্রভাব ছিল বলে অনেকে মনে করেন। ফরাসি বিপ্লবের এই কেন্দ্রীয় রাষ্ট্র গঠনের প্রক্রিয়ার মধ্যে অনেকে একটি সংগঠিত, কিছুটা শক্তিশালী একটি ‘গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠন’-এর প্রয়াস দেখতে পান। ফুরে এবং তাঁর মতের সমর্থক ঐতিহাসিকদের যুক্তির মধ্যে দেখা যায় যে বিপ্লবের উৎস ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রতিষ্ঠান মধ্যে ছিল না, বরঞ্চ এক ধরনের notable বা মিশ্র এলিট-এর ক্ষমতা প্রতিষ্ঠার মধ্যে ছিল। এই notable-রা মূলত জমির মালিকানা থেকেই তাঁদের স্বাচ্ছন্দ্য আহরণ করতেন। এই মত অনুযায়ী, বিপ্লব কোনো আকস্মিক নাটকীয় ঘটনা নয়, নিছক ক্ষণস্থায়ী একটি বিচ্যুতি। তকভিল সামাজিক সংঘাতকে একটি রাজনৈতিক কাঠামোর মধ্যে ফেলে দেখতে চেয়েছিলেন। তাঁর কাছে বিপ্লব রাষ্ট্রশক্তি ও শাসনব্যবস্থার কেন্দ্রীকরণের প্রতীকও। ফরাসিদের মধ্যে সাম্য যা এসেছিল, তা রাষ্ট্রশক্তির নিরঙ্কুশ শাসনের কাছে আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়েই এসেছিল। বিপ্লবের উৎস নিরঙ্কুশ রাজতন্ত্রের কাজকর্মের মধ্যেই দেখা যায়। বিপ্লবের অভিজ্ঞতা চতুর্দশ লুই থেকে নেপোলিয়ন পর্যন্ত রাষ্ট্রের বিবর্তনকে পূর্ণতা দিয়েছিল। ফুরে এই মতের প্রতিধ্বনি করে বলেছেন, ‘Napoleon was the Louis XVI of the the democratic state.’ রাষ্ট্রশক্তির এই বিবর্তনের সঙ্গে কোনো সামাজিক গোষ্ঠী বা শ্রেণীকে যুক্ত করেননি।২৩

লিন হান্ট

সংশোধনবাদী মতেরও কিছু সমালোচনা করা হয়েছে। তাঁদের সীমাবদ্ধতা লক্ষ্য করে অনেকে লিখেছেন, মার্কসবাদী বিশ্লেষকদের মত এরাও বিপ্লবের উৎস ও ফলাফল নিয়ে বিশেষভাবে চিন্তিত ছিলেন। বিপ্লবীরা যা চেয়েছিলেন এবং বিপ্লবের ফলে যা ঘটেছিল, সেটা সব সময় এক ছিল না। এর ফলে বিপ্লবীরা কি চেয়েছিলেন, লিন হান্টের (Lynn Hunt) মতে তার গুরুত্ব ততটা বেশি নয়, কিন্তু উৎস এবং ফলাফলের ওপরেই সমস্ত নজর দিলে যেটা হারিয়ে যায়, সেটা হচ্ছে বিপ্লবের সময় এর অভিজ্ঞতা, দৈনন্দিন জীবন ও মানসিকতা। যেখানে লিন হান্টের সঙ্গে ফুরের মতের মিল আছে সেটা হচ্ছে এই ধারণাগতভাবে যে ফরাসি বিপ্লবের ফলে একটি সম্পূর্ণ নতুন রাজনৈতিক সংস্কৃতি বা পলিটিকাল কালচার তৈরি হয়েছিল। হান্টের ভাষায়, ‘for value expectations and implicit rules that expressed and shaped collective inventions and actions, are what I call the political culture of the revolution; that political culture provided the logic of Revolutionary political action.’২৪ কিন্তু ফুরে ও হান্টের রাজনৈতিক সংস্কৃতি সম্পর্কে ধারণায় কিছু প্রভেদ আছে। হান্ট প্রমুখ বিপ্লবী রাজনৈতিক সংস্কৃতির সন্ধান করেছেন সামাজিক কাঠামো, সামাজিক বিরোধ বা সামাজিক পরিচিতির মধ্যে নয়। বিপ্লবীদের সামাজিক অবস্থান বিশ্লেষণ করেও নয়। তাঁরা খুঁজেছেন তাদের ভাষা, তারা যে ছবি ব্যবহার করেছেন, যে মূর্তি নির্মাণ করেছেন, তাদের প্রাত্যহিক রাজনৈতিক কাজকর্ম ইত্যাদির মধ্যে দিয়েই‌, তাঁদের মতে, বিপ্লবীরা সমাজ ও সামাজিক সম্পর্ককে নতুন করে বিন্যস্ত করতে চেয়েছিল। তারা সচেতনভাবে ফরাসি সমাজের অতীতের সঙ্গে সম্পর্ক ছেদ করে নতুন একটি ভিত্তির উপরে একটি জাতীয় কমিউনিটি তৈরি করার চেষ্টা করেছিল। সমস্ত রকমের মতাদর্শই এই প্রাত্যহিক প্রশ্নের উত্তর হিসেবে খোঁজার চেষ্টা করা হয়েছিল। কোনো একটি বিশেষ মতাদর্শের প্রতীক হওয়ার পরিবর্তে বিপ্লবী রাজনীতি রাজনৈতিক মতাদর্শকে জীবন দান করেছিল। দৈনন্দিন বৈপ্লবিক কাজকর্মের মধ্যে, তার ভাষায়, তার যে imagery, তার ভাবভঙ্গি, উৎসব জনগণের বিভিন্ন অভিব্যক্তি ও তার স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশ, যে ধরনের প্রতীক, যে ধরনের রিচুয়াল এসময় তৈরি করা হয়েছিল এর মধ্যে দিয়েই নতুন রাজনৈতিক সংস্কৃতিকে খুঁজে বার করতে হবে। এক্ষেত্রে আরও অনেক ভালো কাজ করেছেন Maurice Agulhon তার একটি বিখ্যাত বই ‘Marianne into Battle’-এ।২৫ তারা প্রজাতন্ত্রের নতুন মূর্তি নির্মাণের জন্য নতুন রাজনৈতিক সংস্কৃতিকে ধরার চেষ্টা করেছেন। মোনা ওজুফ, যিনি একসময় ফুরের সহযোগী ছিলেন – তিনি বিপ্লবের উৎসবের (festival) বিস্তৃত বিবরণ ও বিশ্লেষণের মধ্য দিয়ে এই নতুন রাজনৈতিক সংস্কৃতিকে উপস্থিত করেছেন। আবার এইসব ছবির মধ্যে তাঁরা আরও বিশদ কিছু প্রবণতা লক্ষ্য করেছেন। যেমন Joan Landes লিখেছেন, ‘The collapse of the old patriarchy gave way to a more progressive gendering of the public spear.’২৬ এই প্রসঙ্গে ভভেল এবং তাঁর গ্রন্থ ‘The Revolutionary rentality’ অত্যন্ত প্রণিধানযোগ্য রচনা। ভভেলও ‘continuity thesis’-এর সঙ্গে একমত হননি এবং দেখিয়েছেন, কীভাবে বিপ্লবের সময় একটি মানসিক পরিবর্তন ঘটেছিল। এই জন্য তিনি বিপ্লবী মানসিকতায়, সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন কাজকর্ম, সেসময়কার প্রাত্যহিক হিংসা; অন্য ধরনের বৈপ্লবিক কাজ গান, কবিতা, ছবি, উৎসব, স্লোগান – সমস্ত কিছুর মধ্যে দিয়ে এই দশকে যে আলোড়ন ঘটেছিল সেটাকে ধরার চেষ্টা করেছেন। একই সঙ্গে তাঁরা বোঝানোর চেষ্টা করেছেন যে এই ধরনের গুণগত কিছু ধারনার সঙ্গে কীভাবে পরিমাণগত তথ্য যেটা economic historian-রা ব্যবহার করে থাকেন – তাকে মেলানো যায়। যেমন বিভিন্ন রাজনৈতিক ক্লাবের সদস্য সংখ্যা অঞ্চল অনুযায়ী কিভাবে পাল্টে ছিল, de-christianization আন্দোলন কিভাবে বিভিন্ন অঞ্চলে শক্তি অর্জন করেছিল – এই সমস্তের মধ্যে দিয়ে তাঁরা একটি যৌথ চেতনার সন্ধান করেছিলেন। সেই চেতনার মধ্যে কিন্তু অতীতের সঙ্গে বিচ্ছেদ অনেকাংশেই সম্পূর্ণ। অন্তত এটা বলা যায় যে, এই বিচ্ছেদ বিশেষ অনুধাবনযোগ্য। এককথায় বলা যায় যে বিপ্লবী দশকে যদি mode of production-এ পরিবর্তন নাও ঘটে থাকে, মানুষের মনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং মৌলিক একটি পরিবর্তন ঘটেছিল।

ফ্রাঁসোয়া ফুরে (১৯২৭-১৯৯৭)

দু’ধরনের ব্যাখ্যার মধ্যে সামঞ্জস্য কি সম্ভব? ফুরের আশা সত্ত্বেও বিপ্লবের ইতিহাসচর্চায় ছেদ আসেনি। মার্কসবাদী ও শোধনবাদী ব্যাখ্যার মধ্যে সমন্বয়ের চেষ্টা লক্ষণীয়। রেজিন রবিন একটি অঞ্চলের ইতিহাস খতিয়ে দেখে সিদ্ধান্ত করেছেন যে, এই সময় যুগসন্ধির বা যুগযুগান্তরের পর্যায়।২৭ তাঁর কাছে প্রাক-বিপ্লব যুগের বুর্জোয়াদের দৃষ্টিভঙ্গি একটি উত্তর-সামন্ততান্ত্রিক সমাজে তার অবস্থান থেকেই তৈরি হয়েছিল। এসময় ধনতন্ত্রের বিকাশ সামন্ততান্ত্রিক কাঠামোকে দুর্বল করে দিচ্ছিল – এ ধরনের ব্যাখ্যা  মার্ক্সবাদী বিশ্লেষণের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ, যদিও তা empirical গবেষণার ফসল এবং এখানে তত্ত্ব একটি straitjacket-এর মত ব্যবহৃত হয়নি। অষ্টাদশ শতকের ফ্রান্সকে যদি রূপান্তরের সময় বলে দেখা যায়, যার থেকে উনিশ শতকের ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থা উদ্ভূত হয়েছিল, তাহলে তার সঙ্গে বলতে হবে যে একটি proto-industrial কাঠামো যা সামন্তপ্রভুদের স্বার্থকে আত্মস্থ করতে পারত, তা এই ব্যবস্থার বিবর্তনে গুরুত্বপূর্ণ। স্বভাবতই শ্রেণীসংগ্রামের ধারণা সম্পূর্ণ উপেক্ষিত হয়নি পরবর্তী রচনায়। ১৯৮৯-এর পরে George C. Comninel-এর গ্রন্থে পুরোনো রাজত্বের শ্রেণী সংঘর্ষের সম্ভাবনা সম্পর্কে বিশেষ ওয়াকিবহাল। তিনি শ্রেণীসংগ্রামের উপস্থিতি শুধু স্বীকারই করেননি, তিনি দেখিয়েছেন যে, বিপ্লব এই সংগ্রামেরই এবং পুরোনো রাজত্বের শ্রেণী সম্পর্কের মধ্যে যে সংঘাত ছিল, তারই ফসল।২৮

এলবার্ট সবুল (১৯১৪-১৯৮২)

অনেক ক্ষেত্রেই দু’টি ভিন্ন ধারার মধ্যে কিছু মিলও লক্ষ্য করা যায়। যেমন, বিপ্লবের ফলে একটি শক্তিশালী রাষ্ট্রের জন্ম সম্বন্ধে মার্কসবাদী ও অন্যান্য ঐতিহাসিকদের ব্যাখ্যা পাওয়া গেছে। কোনো সন্দেহ নেই যে গত চার দশকে ফরাসি বিপ্লবের ইতিহাসচর্চা শেষ তো হয়ইনি, তার বহুমাত্রিকতা অনেকের রচনায় বিশেষভাবে উপস্থিত হয়েছে। যেমন রিচার্ড কবের রচনা। সাধারণ মানুষের ভূমিকা এবং সন্ত্রাসের সময় যে Revolutionary Army তৈরি হয়েছিল, যা সাঁ কুলোৎদের নিয়ে তৈরি হয়েছিল, মজুতদার বা চোরাকারবারিদের ধরার জন্য -তার ওপরে তাঁর বিস্তারিত লেখা একটি সম্পদ। মার্কসবাদী এবং বিশেষ করে George Rude-এর লেখায় সাধারণ মানুষ যেভাবে উঠে এসেছেন – তাতে এটা পরিষ্কার যে দু’ধরনের ঐতিহাসিকরা আস্তে আস্তে তাদের নজর ঘুরিয়েছেন নেতাদের দিকে নয়, সাধারণ মানুষের বিপ্লবে কী যোগদান ছিল, তার ওপরে। ১৭৮৯ থেকে ১৭৯৫ সাল পর্যন্ত এই জনতার উপস্থিতি – তার মধ্যে কৃষক আছে; তার মধ্যে সাধারণ নিম্ন মধ্যবিত্ত মানুষ আছে; ভবঘুরে, কর্মহীন মানুষ আছে – এদের যে ভূমিকা, তা সাম্প্রতিক তিন-চার বছরের ইতিহাসচর্চায় বিশেষভাবে উঠে এসেছে। এটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। Robert Darnton যেমন enlightenment-এর আলোচনার ক্ষেত্রে‌ popular litareture বা সাধারণ মানুষ যে ধরনের লেখা পড়তো, তার ফলে কিভাবে পুরনো রাজত্ব সম্পর্কে ধারণা আস্তে আস্তে খারাপ হয়েছিল, কীভাবে মনের মধ্যে একটা অন্তর্ঘাত তৈরি হয়েছিল – পুরনো ব্যবস্থা, পুরনো কাঠামো, রাজতন্ত্র, অভিজাততন্ত্র সম্পর্কে – সেই নিয়ে বিশদ আলোচনা করে ফরাসি বিপ্লবের ইতিহাসের একটি অত্যন্ত চিত্তাকর্ষক দিক উপস্থিত করেছেন। সুতরাং শেষে বলা যায় যে, ফরাসি বিপ্লবের ইতিহাসচর্চায় বহুমাত্রিকতাই এর সবচেয়ে বড় আকর্ষণের বিষয়। দুশো বছর পেরিয়ে গিয়েও ফরাসি বিপ্লব সম্পর্কে, তার বিভিন্ন দিক, বিভিন্ন জটিল প্রক্রিয়া সম্বন্ধে ঐতিহাসিকদের আকর্ষণ বিন্দুমাত্র কমেনি। সম্ভবত ঐতিহাসিক অনুসন্ধানের লক্ষ্য হিসেবে এখানেই ফরাসি বিপ্লবের অনন্যতা ও বৈশিষ্ট্য।

১) Arthur Young, The Example of France, a Warning to Britain, 1794.

২) Frederick Dreyer, The Genesis of Burke’s Reflections, The Journal of Modern History, 1978.

৩) François Furet, Penser la Révolution Française, Paris: Gallimard, 1978, pp. 35-36.

৪)  Jules Michelet, History of France: Volume 1, G. Howard Smith (T.), 1857.

৫) François Victor Alphonse Aulard, Histoire politique de Révolution française: Origines et développement de la démocratie et de la République (1789-1804), Nouveau Monde editions, 1910.

৬) François-René vicomte de Chateaubriand, Memoirs of Chateaubriand: From His Birth in 1768, Till His Return to France in 1800, 1849 p. – 212

৭) Albert Mathiez, La vie chère et le mouvement social sous la Terreur, Vol- I & II, Payot, 1973.

৮) Georges Lefebvre, La grande peur de 1789 – Suivi de Les Foules révolutionnaires, Armand Colin, 1932, (translated by Joan White, The Great Fear of 1789: Rural Panic in Revolutionary France, Pantheon, 1973.)

৯) Albert Soboul, The French rural community in the eighteenth and nineteenth centuries, S.l., 1958.

১০) Debating the Longue Durée, Annales HSS, 70, no. 2 (April-June 2015): 215–217

১১) Michel Vovelle, The fall of the French monarchy 1787-1792, Cambridge University Press, 1983.

১২) Theda Skocpol, States and Social Revolutions: A Comparative Analysis of France, Russia, and China, Cambridge University Press, 1979.

১৩) Guy Chaussinand-Nogaret, The French Nobility in the Eighteenth Century: From Feudalism to Enlightenment (Translator: William Doyle), Cambridge University Press, 1985.

১৪) Immanuel Wallerstein, The french revolution as a World-Historical event, Ferenc Fehér (Ed.), The French Revolution and the Birth of Modernity, University of California Press, 1990, p. 117 – 132

১৫) Alfred Cobban, The Social Interpretation of the French Revolution (First Published 1964), Cambridge University Press, 2nd edition 1999.

১৬) William Doyle, Origins of the French Revolution, Oxford University Press, 1999, p.-12.

১৭) John McManners, French Ecclesiastical Society Under the Ancien Régime: A Study of Angers in the Eighteenth Century, Manchester University Press, 1960.

১৮) Colin Lucas, Nobles, Bourgeois And The Origins Of The French Revolution, Past & Present, Volume 60, Issue 1, August 1973, Pages 84–126.

১৯) François Furet & ‎Denis Richet, La Révolution française, Aucun apercu, 1989. ‎

২০) François Furet, Penser la Révolution française (Interpreting the French Revolution), Gallimard, 1978.

২১) Simon Schama, Citizens: A Chronicle of the French Revolution, Knopf, 1989.

২২) Alexis de Tocqueville, L’Ancien régime et la revolution, (in English ‘The Old Regime and the French Revolution’), Michel Levy Freres, 1856.

২৩) William Scott, Francois Furet and Democracy in France, The Historical Journal – Vol. 34, No. 1, Cambridge University Press, March, 1991, p. 147-171.

২৪) Lynn Hunt & Jack R. Censer, Liberty, Equality, Fraternity: Exploring the French Revolution, Penn State Press, 2001.

২৫) Maurice Agulhon & Janet Lloyd, Marianne into Battle: Republican Imagery and Symbolism in France, 1789-1880, Cambridge University Press, 1981.

২৬) Joan B. Landes, Women and the Public Sphere in the Age of the French Revolution, Cornell University Press, 1988.

২৭) Régine Robin, La société française en 1789: Semur-en-Auxois, The University of California, 1970.

২৮) George C. Comninel, Rethinking the French Revolution: Marxism and the Revisionist Challenge, Verso, 1987.

২৯) Richard Cobb, Les armées révolutionnaires: instrument de la terreur dans les départements: Avril 1793 – Floréal an II. · Volume 1, Mouton, 1961.

translated In English by Marianne Elliott, The People’s Armies, Yale University Press, 1987.

৩০) Robert Darnton, The Literary Underground of the Old Regime, Harvard University Press, 1982.

Robert Darnton, The Great Cat Massacre And Other Episodes in French Cultural History, Basic Books, 2009.

মন্তব্য তালিকা - “ফরাসি বিপ্লবের ইতিহাসচর্চা”

  1. চমৎকার বিশ্লেষণ।
    আমার মত অনধিকারী র পক্ষে বেশ কয়েকবার না পড়ে পাঠ প্রতিক্রিয়া তৈরি করাও শক্ত।

  2. চমৎকার বিশ্লেষ্ণণ। তবে, দেলাক্রোয়ার ছবিটির বাংলা নাম হবে ‘স্বাধীনতার দেবী জনগণকে পথ দেখাচ্ছেন’।

মন্তব্য করুন

আপনার ইমেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।