সূচী

ইতিহাস তথ্য ও তর্ক

‘শয়তানের টাকা’—নেদারল্যান্ড-এ হেইজিংগেন প্রত্নক্ষেত্রের বিবরণ প্রকাশ

‘শয়তানের টাকা’—নেদারল্যান্ড-এ হেইজিংগেন প্রত্নক্ষেত্রের বিবরণ প্রকাশ

ফেব্রুয়ারি ১৯, ২০২৫ ৮৯ 0

অ্যামস্টারডাম থেকে ৮০ মাইল পূর্বে নেদারল্যান্ড জার্মান সীমান্তের কাছে অবস্থিত হেইজিংগেন গ্রাম। ২০২০ নাগাদ সেখানেই মেটাল ডিটেক্টরে সন্ধান মেলে কিছু মুদ্রার। উত্তর জার্মানির খ্রিস্ট ধর্মের প্রসারের আগে নানা পৌরাণিক চরিত্র ও চিহ্ন খচিত মুদ্রাগুলি নজর কেড়েছিল প্রত্নতাত্ত্বিক ও ঐতিহাসিকদের। তাই ২০২০ থেকে ২০২১ পর্যন্ত প্রত্নতাত্ত্বিক খনন চালানো হয় হেইজিংগেনে। ফলাফল—প্রায় ১৯০টির বেশি প্রত্নবস্তু সহ এক বিশাল উপাসনাক্ষেত্রের সন্ধান। প্রত্নক্ষেত্র থেকে মিলেছে সোনার ও রুপোর মুদ্রা, বহুমূল্য অলঙ্কার সহ দেবতাদের উদ্দেশ্যে প্রদত্ত নানা অর্ঘ্য। সমস্ত প্রত্নবস্তুর ও প্রত্নক্ষেত্রের সামগ্রিক বিশ্লেষণের পর গত বছরের ২৪ ডিসেম্বর, ‘মেডিভাল আর্কিওলজি’ (Medieval Archaeology)-তে বিস্তারিত বিবরণ প্রকাশিত হতেই প্রবল চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়েছে প্রত্নতত্ত্ববিদ ও ইতিহাসবিদদের মধ্যে।

‘শয়তানের টাকা’ (চিত্র সৌজন্য – মেডিভাল আর্কিওলজি)

এই উত্তেজনা অহেতুক নয়। হেইজিংগেনের এই প্রত্নক্ষেত্রটি নেদারল্যান্ডের বহুদেববাদী ধর্মবিশ্বাসের অন্যতম শ্রেষ্ঠ নিদর্শন হিসেবে চিহ্নিত করেছেন প্রত্নতাত্ত্বিকরা। প্রত্নক্ষেত্রটির ঠিক মাঝে রয়েছে বৃত্তাকারে বেড়া দিয়ে ঘেরা ধর্মীয় আচার পালনের স্থানটি। কাঠের কতগুলো থাম রয়েছে সারিসারি, তার মাঝে রাখা আছে একটি পাথরের বোল্ডার। কাঠের থামগুলি সাজানো হয়েছে সূর্যের উত্তরায়ণ ও দক্ষিণায়নের সঙ্গে সাযুজ্য রেখে। সম্ভবতঃ ঋতু পরিবর্তনের গতিপ্রকৃতি ও তা দেখে নানা উৎসবের সময় ঠিক করার জন্যই এমন ব্যবস্থা। উপাসনা ও আচার পালনের জায়গাটির সংলগ্ন রয়েছে একটি গবাদি পশু রাখার স্থান। উপাসনাস্থলে যে হাড় পাওয়া গেছে, তা থেকে অনুমান করা যায় এখানে দেবতার উদ্দেশ্যে পশু উৎসর্গ করার রীতি ছিল। সেই প্রেক্ষিতে গবাদি পশু রাখার স্থানের উদ্দেশ্য কী, বুঝতে অসুবিধা হয় না। শুধু মাত্র ধর্মীয় আচার আচরণের দিক থেকেই নয়, স্থানীয় রাজনীতির কেন্দ্রও ছিল এই অঞ্চলটি। তার সাক্ষ্য বহন করে বেড়ার বৃত্তের ঠিক বাইরেই অবস্থিত একটি ‘হেরেনহফ’, অর্থাৎ স্থানীয় অভিজাত নেতা বা সর্দারের বাড়ি। একটি নব্যপ্রস্তর যুগের সমাধি টিলা (burial mound) এবং একটি পবিত্র প্রস্রবণ (sacred spring)-এর উপস্থিতি জানান দেয় এই অঞ্চলের স্থান মাহাত্ম্য সাধারণাব্দের ষষ্ঠ থেকে সপ্তম শতকের মধ্যে ব্যবহৃত হওয়া এই উপাসনাস্থলের থেকে বহু প্রাচীন।        

প্রত্নক্ষেত্রের মানচিত্র (চিত্র সৌজন্য – মেডিভাল আর্কিওলজি)

তবে সবথেকে অভিনব আবিষ্কার হল দেবতার উদ্দেশ্যে নিবেদিত ছোটো ছোটো স্বর্ণ ও রৌপ্য মুদ্রাগুলি। খ্রিস্টান রচনায় এই মুদ্রার কথা অনেকবার পাওয়া গেছে। এই মুদ্রাকে বলা হত ‘diobolgeldæ’ বা ‘শয়তানের টাকা’—খ্রিস্টান ধর্মপ্রচারকরা এই সকল দেবতা উপাসনাকে শয়তানের আরাধনা হিসেবেই মনে করতেন। বহুদেববাদ থেকে খ্রিস্ট ধর্মে ধর্মান্তকরণের একটি অন্যতম শর্ত রাখা হত ‘শয়তানের টাকা’ উপাসনাস্থলে দান বন্ধ করা। এত সংখ্যায় এবং এই মানের ‘শয়তানের টাকা’ এর পূর্বে এই অঞ্চলে পাওয়া যায়নি। আরও উল্লেখযোগ্য, এই ‘শয়তানের টাকা’ যেমন নেদারল্যান্ড ও উত্তর জার্মানির খ্রিস্ট ধর্মের বিস্তার পূর্বের বহুদেববাদী সংস্কৃতির সমৃদ্ধির চিত্রটি স্পষ্ট করে তার সঙ্গে সঙ্গে মুদ্রাগুলির থেকে হদিশ পাওয়া যায় এই ধর্ম বিশ্বাসের পতনের চিত্রেরও। আনুমানিক সাতশো সাধারণাব্দ নাগাদ এই উপাসনার স্থানটি পরিত্যক্ত হয়, যা নেদারল্যান্ডে খ্রিস্ট ধর্মের দৃঢ় ভাবে প্রতিষ্ঠালাভের বেশ কিছুটা আগে। দামি অলঙ্কার বা স্বর্ণ-রৌপ্য মুদ্রা প্রদানের চলও সপ্তম শতক জুড়ে ক্রমশঃ কমতে কমতে একেবারে বন্ধ হয়ে গেছে। এর জন্য খ্রিস্ট ধর্মের ক্রমবর্ধমান প্রভাবকেই দায়ী করা যেতে পারে। কিন্তু লক্ষণীয়; পশ্চিম, মধ্য ও উত্তর ইউরোপের অন্যান্য অনেক এইপ্রকার উপাসনাক্ষেত্রে যেমন অস্ত্রবলে ধ্বংসের চিহ্ন রয়েছে এইখানে কিন্তু তেমন নেই। হঠাৎ করে বহুদেববাদী উপাসনা বিলুপ্ত হয়নি। ধীরে ধীরে একটি লম্বা সময় ধরে বহুদেববাদ থেকে খ্রিস্টীয় একেশ্বরবাদে স্থানীয় জনগণের সরে যাওয়ার চিত্রটিই বরং স্পষ্ট। প্রথমে সম্ভবতঃ সরে গেছিলেন স্থানীয় প্রভাবশালী ও অভিজাতরা—পবিত্র রোমান সাম্রাজ্য দ্বারা প্রভাবিত হয়ে। তারপর স্থানীয় মানুষ কর্তৃকও উপাসনাস্থলটি পরিত্যক্ত হয়।

আদি-মধ্যযুগের লিখিত উপাদান অধিকাংশই খ্রিস্টীয় যাজক অথবা সন্ন্যাসীদের দ্বারা রচিত। সেই উপাদানে মধ্য ও উত্তর ইউরোপে খ্রিস্ট ধর্ম প্রচারের যে ইতিহাস পাওয়া যায়, তা খুবই অস্পষ্ট ও পক্ষপাতদুষ্ট। অপরদিকে এই অঞ্চলের খ্রিস্ট ধর্মের বিস্তারের পূর্বে যে বহুদেববাদী সংস্কৃতি ও ধর্মবিশ্বাস ছিল, তার সম্পর্কে আমরা খুব অল্পই জানি। এই অজানার অন্ধকারেই কিছুটা আলো নিক্ষেপে সাহায্য করে এই প্রকার প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কার। সোনা আর রুপোর ‘শয়তানের টাকা’-য় খোদিত উত্তর জার্মানির পৌরাণিক নানা চিত্র আমাদের হদিশ দেয় এমন এক জগতের ও বিশ্বাসের দুনিয়ার যার বিবরণ ইতিহাসের লিখিত উপাদানে পাওয়া কঠিন। সেই দিক দিয়ে এই প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কার উদযাপনের দাবি রাখে।

প্রচ্ছদ চিত্র পরিচিতি: পঞ্চম বা ষষ্ঠ শতাব্দীর একটি চিত্র-সম্ভবত ওডিন, স্থানচ্যুত পা সহ একটি ঘোড়ার উপরে। এটি সম্ভবত একটি তাবিজ ছিল।

খবরটি দিয়েছেন অর্কপ্রভ সেনগুপ্ত।

নিচের লিংকে গিয়ে পুরো খবরটি পড়তে পারেন

Elite-germanic-pagans-buried-devils-money-offerings-for-their-gods-at-this-ancient-cult-site

মন্তব্য করুন

আপনার ইমেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।