সম্পাদকীয়

ইতিহাস ও পরিবেশগত দৃষ্টিভঙ্গি
বিজ্ঞান মন ও মনন, বিজ্ঞান মনস্কতা ও মানসিকতা, বিজ্ঞান চেতনা ও বিজ্ঞান বোধ অথবা বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি—শব্দগতভাবে পৃথক হলেও এগুলো সবই বিজ্ঞান সচেতনতার পরিধিভুক্ত। এদেশে বিজ্ঞান সচেতনতা গড়ে ওঠার শুরু উনিশ শতকে। রামমোহন, ডিরোজিও, বিদ্যাসাগর, অক্ষয় দত্ত প্রমুখ মানুষের চেষ্টায় নবজাগরণের সময় থেকে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে ওঠার জমি তৈরি হতে শুরু করে।
বিজ্ঞান সচেতনতা গড়ে তোলার লক্ষ্যে কিছু করণীয় কাজ আছে। বিশ্বাসের বদলে প্রশ্ন করতে হবে, যাচাই করতে হবে, নিজের চোখ-কান-হাত দিয়ে দেখতে-শুনতে ও স্পর্শ করতে হবে, বুদ্ধি ও যুক্তি দিয়ে উত্তর খুঁজতে হবে। উন্নত মস্তিস্কের অধিকারী মানুষকে এসব করতেই হবে। সমাজের সঙ্গে বিজ্ঞানের যোগাযোগের কথা বললেন জন ডেসমন্ড বার্নাল তাঁর ‘The Social Function of Science’ বইতে। তাঁর মতে, ‘বর্তমান সময়ে বিজ্ঞান যেমন সমাজকে প্রভাবিত করে, বিজ্ঞানও তেমন সমাজের কারণে প্রভাবিত হয়। অন্ধ সেজে এই সত্যকে অস্বীকার করলে আমাদের চলবে না। এই বিষয়ে কার্যকর সচেতনতা গড়ে তুলতে চাইলে, বিজ্ঞান ও সমাজের পারস্পরিক নির্ভরতার কথা আরও গভীরভাবে ব্যাখ্যা করতে হবে।’
আজকে আমরা পরিবেশগতভাবে সারা বিশ্ব এমন এক সংকটের মধ্য দিয়ে চলেছি যা থেকে বেরিয়ে আসার দিশা পাওয়া যাচ্ছে না। বিশ্বউষ্ণায়ন ক্রমশ বাড়ছে। উন্নত দেশগুলো তাদের প্রযুক্তিজনিত উন্নয়নের অবশ্যম্ভাবী পরিণতি শিল্পায়ন ও নগরায়নের ফলে কার্বন নিঃস্বরণের পরিমাণ বাড়িয়ে তুলছে। আর সারা বিশ্বের কর্পোরেট পুঁজি তার মুনাফার জন্য প্রকৃতিকে লুণ্ঠন করে চলেছে। পরিবর্তে তারা পরিবেশ দূষণের দায় চাপিয়ে দিচ্ছে জনবহুল, উন্নয়নশীল ও অনুন্নত দেশগুলোর উপর।
আমাদের দেশের মতো বৃহৎ জনসংখ্যার দেশের প্রধান সংকট বিপুল সংখ্যক মানুষের খাবারের সংস্থান করা। বহুল পরিমাণে রাসায়নিক সার, প্রভূত জলসেচের সহায়তায় সবুজ বিপ্লব-সঠিক না বেঠিক, বড় বাঁধ না ছোট বাঁধ, পারমাণবিক বিদ্যুৎ না অপ্রচলিত শক্তির ব্যবহার—এরকম হাজারটা পরিবেশ সম্পর্কিত প্রশ্ন প্রতিনিয়ত মাথা চাড়া দিচ্ছে। যে পৃথিবীতে বাস করছি, তার বুক থেকে বেঁচে থাকার উপাদান সংগ্রহ করছি, তার সমস্যাগুলো থেকে বেরিয়ে আসার দায়িত্ব আমাদের থেকে যায় বৈকি!
বিশ্ব উষ্ণায়নের বিরুদ্ধে আমাদের লড়তে হবে। কীভাবে আমরা লড়ব? জীববৈচিত্র্য রক্ষায় আমাদের ভূমিকা কী হবে? বনভূমিকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য আমাদের কী উদ্যোগ নেওয়া দরকার?—এরকম নানা প্রশ্ন আমাদের ভাবিয়ে তোলে। একটা ছোট্ট উদাহরণ দিই। জলসম্পদে পূর্ণ পূর্বভারতের অধিবাসী হয়ে আমরা বুঝতে পারি না কীভাবে প্রতিদিন জলসম্পদের অপব্যবহার করে চলেছি। পৃথিবীর তিন ভাগ জল, এক ভাগ স্থল—এই আপাত সত্য ছেলেবেলা থেকে ছাত্রছাত্রীদের মনে বিপুল জলসম্পদের অফুরন্ত ভাণ্ডারের সন্ধান দেয়। এই জলের কতটুকু যে মানুষের ব্যবহারযোগ্য এবং তার বিপুল অপচয় ভবিষ্যতে কী বিপদ ডেকে আনবে তা নিয়ে আজও আমরা সচেতন হলাম না। টেকসই উন্নয়ন (Sustainable development) আজ একটি বহুচর্চিত বিষয়। বিজ্ঞানের জয়যাত্রার সঙ্গে অনিয়ন্ত্রিতভাবে প্রযুক্তির ব্যবহার দ্বন্দ্বমূলক। এখন নতুন করে ভাবতে হচ্ছে রাতে বৈদ্যুতিক আলোর রোশনাই কমিয়ে কীভাবে বিদ্যুৎশক্তি উৎপাদনজনিত উষ্ণায়নের মাত্রা হ্রাস করা যায়। সুন্দর করার নাম করে পুকুরের ধার বাঁধিয়ে পুকুরকে সুইমিং পুলে রূপান্তরিত করলে চোখের আরাম হতে পারে, কিন্তু সেখানকার জলজ ইকোসিস্টেম ধ্বংস হয়ে যায়। সামাজিক বনসৃজনের নামে সবুজায়ন হয়েছে, কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে সেখানকার গাছপালার সঙ্গে সাযুজ্য না রেখে ইচ্ছামতো প্রজাতির গাছ লাগিয়ে বনজ ইকোসিস্টেমকে নষ্ট করে দেওয়া হয়েছে। পাহাড়ে অনিয়ন্ত্রিত নির্মাণ, নদীখাতকে পরিবর্তিত করে বিদ্যুৎ উৎপাদন ইত্যাদি ব্যবস্থার ফলে দিনের পর দিন প্রকৃতিতে বিপুল বিপর্যয় নেমে আসছে।
প্রাচীন ভারতে পরিবেশ সচেতনতার ব্যাপারটা কেমন ছিল তা নিয়ে একটু আলোচনা করা যাক। সিন্ধু সভ্যতা সম্পর্কে যেটুকু যতটুকু জানা যায় তাতে এইটুকুই বলা যাবে যে একউন্নত সভ্যতার অধিকারী ছিল সে যুগের ওই অঞ্চলের মানুষ। গৃহগুলির স্থাপত্য, শহরের স্থাপত্যে স্নানাগার ইত্যাদির আধিক্য ইঙ্গিত করে যে, তারা জনস্বাস্থ্য সম্পর্কে সচেতন ছিল। হরপ্পীয় মানুষ সর্বপ্রাণবাদী ও প্রকৃতিপূজারী ছিল। জীবনে গাছ ও পশুর গুরুত্ব ছিল। তখন মনে করত সমস্ত পশু, উদ্ভিদ, পাথর, এমনকী সমস্ত প্রাকৃতিক ঘটনারও অনুভূতি আছে। প্রকৃতি মানুষের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ রাখে। তবে অতিরিক্ত গাছ কাটা সম্ভবত পরিবেশে প্রভাব ফেলেছিল। ইন্দো-ইউরোপীয়রাও এদেশের রীতি আত্তীকরণ করে বৃক্ষপূজা করতে শুরু করে। সিন্ধু সভ্যতা-পরবর্তী ভারতে যদি সংস্কৃত সাহিত্যে প্রাচীন পরিবেশ ভাবনার সূত্রগুলি খুঁজে বার করতে হয় তবে দেখা যাবে বেদ, উপনিষদ সর্বত্র মানুষের জীবনযাত্রা সামগ্রিক পরিবেশের সঙ্গে এমনভাবে যুক্ত ছিল যে পরিবেশকে মানুষের জীবন থেকে পৃথক করা কঠিন। পশ্চিমী পরিবেশ ভাবনাতে মানুষ যেমন বিশ্বপ্রকৃতির উপর নিজের অধিকার কায়েম করতে ব্যস্ত হয়ে উঠেছে ভারতবর্ষে তেমনটি হয়নি। ভারতবর্ষের সংস্কৃতি ও দর্শনে মানুষ কোনো অতিরিক্ত শক্তি নয়, সে সামগ্রিক প্রকৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। ওষধি-বৃক্ষ-বনস্পতির সঙ্গে মানুষের এই সংযোগ বেদের যুগে প্রচলিত ছিল। প্রকৃতি ও পরিবেশকে নিয়ন্ত্রণ করা বা দমন করার ভাবনা দূরে থাক, তাদের বিনা কারণে নষ্ট করা অপরাধ বলে গণ্য ছিল।
মহাভারতে ভৃগু-ভরদ্বাজ সংবাদ এক বিখ্যাত সংলাপ। সেখানে বলা হয়েছে, প্রকৃতিতে আমরা প্রত্যেকে একে অপরের উপর নির্ভরশীল। পরিবেশ বিজ্ঞানের আধুনিক সমস্যাগুলো না জেনেও মানুষ বনের পশুপাখি, বৃক্ষলতার অস্তিত্ব রক্ষায় সচেতন ছিল। মহাভারতের আর একটি উদাহরণ উল্লেখ করব। ভীষ্ম যখন শরশয্যায় মৃত্যুর আগে একটু জল খেতে চাইলেন, তখন কেউ সোনার পাত্রে, কেউ রূপার পাত্রে, কেউ বা মাটির পাত্রে জল নিয়ে এলেন। ভীষ্ম অর্জুনের দিকে তাকালে অর্জুন বরুণাস্ত্র মেরে মাটির নীচ থেকে জল তুললেন। অর্জুন যুধিষ্ঠিরকে জিজ্ঞাসা করলেন মাটির নীচ থেকে যখন এত ভালো জল পাওয়া যায় তখন আমরা সেই জল ব্যবহার না করে ক্রোশ ক্রোশ দূরে জলাশয় থেকে জল আনতে যাই কেন? যুধিষ্ঠির উত্তর দিলেন, এই জল প্রকৃতির সমতা বজায় রাখার জন্য, একে যথেচ্ছ ভাবে ব্যবহার করা চলে না। ভূগর্ভস্থ জলের ব্যবহার নিয়ে সেকালের এই পরিবেশ সচেতনতা বিস্মিত করে।
পরবর্তীকালে রাজারাজড়া, জমিদার-ভুস্বামীরা পরিবেশ সম্পর্কে বুঝে বা না বুঝে অবচেতনভাবে সচেতনতার পরিচয় দিয়েছেন। জলাভূমি রক্ষায়, বনসৃজনে তাঁদের বিশেষ ভূমিকা ছিল। পানীয় জলের জন্য, স্নানের জন্য দীঘি খনন ছিল উল্লেখযোগ্য কাজ। দীঘির আয়তনও ছিল বিশাল। দীঘির পাড় উঁচু করে মাটি দিয়ে বাঁধিয়ে দেওয়া হত যাতে পানীয় জল দূষিত না হয়। রাস্তার ধারে বসানো হত মহীরুহ, যা পথিককে ছায়া দেওয়ার পাশাপাশি পরিবেশকে শ্যামলিমায় ঢেকে দিত। পরিবেশ আমাদের, এক রক্ষার দায়িত্বও আমাদের—এই ভাবনায় একদা সংযুক্ত ছিল ভারতবর্ষের মানুষ।
পরিবেশ ভাবনাকে ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে দাঁড় করালে প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবহারে বিভিন্ন প্রক্রিয়ার সাপেক্ষে এক ঐতিহাসিক বিভাজন সম্ভব। ইতিহাসের বিভিন্ন স্তরে প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবহারের প্রক্রিয়া নানাভাবে নিয়ন্ত্রিত হয়েছে। ইতিহাসের বিভিন্ন পর্যায়ে প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবহারের অন্যতম প্রধান প্রক্রিয়াগুলি হল, (১) খাদ্য সংগ্রহ, (২) শিকার ও খাদ্য সংগ্রহ, (৩) স্থায়ী কৃষি ব্যবস্থা এবং (৪) শিল্প। প্রকৃতির সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে প্রথম তিনটি প্রক্রিয়ার তারতম্য থাকলেও পরিবেশের উপর এদের সামগ্রিক প্রভাব ভয়াবহ নয়। কিন্তু শিল্পগত প্রক্রিয়া প্রাকৃতিক সম্পদের যথেচ্ছ ব্যবহারের মাধ্যমে পরিবেশের ব্যাপক ক্ষতি করে। এই পর্যায়টি হল প্রাচীন থেকে আধুনিক ব্যবস্থায় উত্তরণের কাল।এর পর শুরু হয়েছে প্রভূত মুনাফার জন্য প্রকৃতিকে লুণ্ঠন।
বহু পথ পেরিয়ে এসেও বিজ্ঞানের নানা তত্ত্ব ও পরিবেশবিদ্যার খুঁটিনাটি বিষয়গুলি জেনেও আমরা যে পরিবেশ-সচেতন হয়ে উঠতে পেরেছি, এমনটা নয়। আসলে দরকার আরও বেশি সদিচ্ছা এবং পরিবেশের প্রতি যত্নশীল হওয়া। এই প্রক্রিয়ায় বেশি বেশি সংখ্যক মানুষ এবং নতুন প্রজন্মকে যুক্ত করতে না পারলে এগিয়ে যাওয়া যাবে না।