মিশরীয়-জার্মান যৌথ প্রত্নতাত্ত্বিক খননে আবিষ্কৃত নতুন সমাধি
গত ২-রা অক্টোবর মিশরের পর্যটন ও পুরাতত্ত্ব মন্ত্রক একটি ঘোষণার মাধ্যমে জানিয়েছে মিশরের সুহাজ ইউনিভার্সিটি ও জার্মানির ফ্রি ইউনিভার্সিটি অফ বার্লিনের বিশেষজ্ঞদের নিয়ে গঠিত একটি দল মিশরের আসিউত-এর কাছে আবিষ্কার করেছেন প্রায় চার হাজার বছরের প্রাচীন একটি সমাধি (Tomb)। সমাধিটি মিশরের মিডল কিংডম (Middle Kingdom) কালপর্বের (সাধারণ পূর্ব ২০৩০-১৬৫০)। বিশিষ্ট মিশর বিশেষজ্ঞ ক্যাথলিন কুনির মতে এই আবিষ্কার গুরুত্বপূর্ণ। আসিউত অঞ্চলে সাম্প্রতিক সময়ে অধিকাংশ সমাধিই আবিষ্কৃত হয়েছে স্থানীয় লোকজনের দ্বারা। খবর পেয়ে বিশেষজ্ঞ দলের আগমনের পূর্বেই সমাধিতে অপটু হস্তক্ষেপের ফলে তা অনেক সময় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এছাড়া কিছু ক্ষেত্রে বে-আইনি ভাবে সমাধিতে থাকা দুর্মূল্য প্রত্নবস্তু পাচার করার মতো ঘটনাও ঘটেছে। সেই দিক দিয়ে একটি বিশেষজ্ঞ দলের সরাসরি এইরকম সমাধি আবিষ্কার আনন্দের বিষয়।
সমাধিটি ইদি (Idi) নামক এক যুবতীর। ফারাও প্রথম সেনুসরেত (Senusret I) এর সময়কালের এক প্রভাবশালী আমলা, যিনি আসিউত অঞ্চলের প্রদেশপাল ছিলেন, সেই জেফাই-হাপি (Djefaihapi)-এর কন্যা ছিলেন ইদি। মিশরের ‘সুপ্রিম কাউন্সিল অফ অ্যান্টিকুইটিজ্’-এর সাধারণ সম্পাদক মুহাম্মদ ইসমাইল খালেদ জানান ইদি-র সমাধিটির সন্ধান প্রকৃতপক্ষে তার পিতা জেফাই-হাপি-র বিশাল সমাধি খননের সময়েই প্রত্নতত্ত্ববিদদের নজরে আসে। জেফাই-হাপি-র সমাধির উত্তর প্রান্তে মাটির ১৫ মিটার নিচে তাঁরা আবিষ্কার করেন সহস্রাধিক বছর জীবিত মানুষের স্পর্শ বঞ্চিত ইদি-র সমাধি কক্ষটি। তবে আধুনিক সময়ের কোনো হস্তক্ষেপ না থাকলেও ইদি-র সমাধিটি একেবারে অক্ষত অবস্থাতেও পাওয়া যায়নি। সমাধি প্রাথমিক ভাবে পরীক্ষা করার পরেই স্পষ্ট হয়ে যায় যে প্রাচীন কালেই লুঠেরারা ভঙ্গ করেছিল ইদি-র শেষ বিশ্রামস্থলের শান্তি। তাই উল্লেখযোগ্য প্রত্নবস্তু প্রাপ্তির খুব একটা আশা ছিল না। তা সত্ত্বেও কিছু কিছু চিত্তাকর্ষক আবিষ্কার সম্ভব হয়েছে। সমাধিতে পাওয়া গেছে ইদি-র অবশেষ সম্বলিত দুটি কফিন (একটি ৮.৫ ফুট আর আরেকটি ৭.৫ ফুট লম্বা), লুঠেরাদের হাতে ভাঙা ‘ক্যানোপিক জার’ এবং বেশ কয়েকটি মূর্তি।
ইদি-র কফিন (চিত্র সৌজন্য – Ministry of Tourism and Antiquities, Egypt)
ইদি-র কঙ্কালের অবশেষের প্রাথমিক পরীক্ষা থেকে জানা গেছে মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল আনুমানিক চল্লিশ বছর। তাঁর পা-এ একটি জন্মগত ত্রুটি ছিল। আমরা আরও জানতে পারি, তিনি যথেষ্ট প্রভাবশালী মহিলা ছিলেন। সমাধিতে প্রাপ্ত কফিনগাত্রে হায়ারোগ্লিফিক অক্ষরে যে লেখ পাওয়া গেছে তাতে তাঁকে অত্যন্ত সম্মানীয় গৃহস্বামিনী (Lady of the House) রূপে বন্দনা করা হয়েছে। ইদি যে প্রভাবশালী ছিলেন, তা অনুমান করার আরেকটি কারণ হল সমাধিতে প্রাপ্ত মূর্তিগুলির মধ্যে একটি। প্রাথমিক ভাবে মনে করা হচ্ছে, মূর্তিটি ইদি-র নিজের। মিশর বিশেষজ্ঞ ক্যাথলিন কুনি মত দিয়েছেন, মূর্তিটি যদি সত্যিই ইদি-র হয়, তাহলে তা অত্যন্ত দুর্লভ একটি প্রত্নবস্তু। প্রাচীন মিশরীয় সমাধিগুলির মধ্যে প্রয়াত ব্যক্তির আদলে নির্মিত মূর্তি খুব কম ক্ষেত্রেই পাওয়া যায়। যাঁদের সমাধিতে এই ধরনের মূর্তি থাকে, তাঁরা সাধারণত প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব ছিলেন বলে ধরা যায়। আরেক মিশর বিশেষজ্ঞ ফ্রাঞ্চেস্কো তিরাদ্রিত্তি-র মতে প্রাপ্ত মূর্তিগুলির মধ্যে একটি নয়, দুটি মূর্তি রয়েছে যা আদতে ইদি-র। দ্বিতীয় মূর্তিটি একটি চলমান মহিলার। ফ্রাঞ্চেস্কোর মতে, সমাধিক্ষেত্র থেকে ইদি-র আত্মার আসন্ন নিষ্ক্রমণকে প্রতীকীভাবে এই মূর্তির মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।
কফিনগাত্রে গৃহস্বামিনীর স্তুতি ((চিত্র সৌজন্য – Ministry of Tourism and Antiquities, Egypt)
সাসক্যাচুয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের অধ্যাপিকা ক্যারোলাইন আর্বাকল্ দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন আবিষ্কৃত সমাধিতে থাকা কফিনের গায়ে উৎকীর্ণ মন্ত্রগুলির দিকে। তিনি মনে করিয়ে দিয়েছেন, ‘ওল্ড কিংডম’ এবং ‘নিউ কিংডম’-এর আমলের প্রাচীন মিশরীয় পারলৌকিক ধর্মবিশ্বাস সম্পর্কে ভালো ধারণা থাকলেও ‘মিডল কিংডম’-এ প্রাচীন মিশরীয়দের ধর্মবিশ্বাস সম্পর্কে এখনও অনেকগুলি শূন্যস্থান রয়েছে। সেই প্রেক্ষাপটে এই মন্ত্রগুলির মাধ্যমে প্রাচীন মিশরীয়দের পরলোক সম্পর্কে ধারণার বিবর্তনের গতিপথের উপস্থিত শূন্যস্থান পূরণের কাজে কিছু সাহায্য হবে বলে তিনি মত দেন।
ইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্বের অধ্যাপক জোয়ান ফ্লেচার এই আবিষ্কার প্রসঙ্গে বলেছেন, সাধারণত প্রাচীন মিশর নিয়ে অধিকাংশ মাতামাতি-ই ‘ওল্ড কিংডম’-এর পিরামিড যুগ আর ‘নিউ কিংডম’-এর তুতানখামেন বা দ্বিতীয় রামেসিসের মতো তারকা-ফারাওদের রাজত্বকালের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে। তুলনায় ‘মিডল কিংডম’ ব্রাত্য। অথচ এই আমলেই গড়ে উঠছিল মিশরের কেন্দ্রীভূত রাজশক্তির ভিত্তিগুলি। ফারাওরা অভিযান পাঠাচ্ছিলেন সুদান আর লিবিয়া অভিমুখে। পূর্বে প্রাচীন সিরিয়া এবং লেভান্তের শক্তিগুলির সঙ্গে চলছিল ক্ষমতার সংগ্রাম। এই কালপর্বের প্রাচীন মিশরে যে শৈল্পিক ও সাংস্কৃতিক উৎকর্ষ দেখা গিয়েছিল, তা নিয়ে সাধারণ মিশরপ্রেমীদের মধ্যে খুব একটা উৎসাহ দেখা যায় না। ফ্লেচার তাই আশা রেখেছেন ইদি-র সমাধিতে এবং কফিনে উৎকীর্ণ উৎকৃষ্ট চিত্র ও কারুকার্য এই বিষয়ে নতুন করে উৎসাহের জন্ম দেবে। উৎখননের পূর্ণ বিবরণী প্রকাশিত হলে আরও বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য উঠে আসবে বলেও আশা রেখেছেন তিনি।
নিচের লিংক থেকে পুরো খবরটি পাবেন-
অর্কপ্রভ সেনগুপ্ত
প্রচ্ছদ চিত্র পরিচিতিঃ ইদি-র মূর্তি ? ((চিত্র সৌজন্য – Ministry of Tourism and Antiquities, Egypt)
ইদি-র জামা একেবারে যেন আধুনিকতম। চোখের গভীর কাজলও আকর্ষক। এদের তিনটি সময়কালের আরও কিছু খবর থাকলে দেবেন।