সূচী

ইতিহাস তথ্য ও তর্ক

সম্পাদকীয়

আগস্ট ১, ২০২৪

ভারতের সংবিধানের ৭৫তম বর্ষপূর্তির প্রাক্কালে

ইংরেজিতে একটা কথা আছে কর্ণারস্টোন (Cornerstone)। বাংলা ভাষায় এর কাছাকাছি শব্দ হলো, ভিত্তিপ্রস্তর। যেকোনো বৃহৎ সৌধ বা ইমারতের মূল ভিত্তি রচিত হয় সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ যে প্রস্তরটির ওপরে, তাকে বলে ভিত্তিপ্রস্তর। ধরা যাক সৌধটি হলো একটি রাষ্ট্র। বলা যায়, রাষ্ট্র হলো এক বৃহৎ সামাজিক সংগঠন যেখানে জনগণের একটি সমষ্টিগত পরিচয় আছে। তবে তার সঙ্গে ব্যবহারিক জীবনের সম্পর্ক জটিল এবং মনে হয় যেন অন্তর্লীন— দেশ বলতে বিভিন্ন মানুষের মনে বিভিন্ন রকমের ভাবনার উদয় হয়, আর তাই এই বিমূর্ত সৌধের ভিত্তিপ্রস্তর বোঝা সহজ কাজ নয়। এই জন্য প্রতিটি রাষ্ট্রের মূল অঙ্গীকার ও সুপারিশগুলির রূপরেখা নির্ধারণকারী একটি দলিল থাকে যার ভিত্তিতে রাষ্ট্রযন্ত্রের বিভিন্ন অঙ্গের ক্ষমতার অংশীদারিত্ব ও ক্ষমতা বন্টনের চুক্তি এবং সুপারিশগুলো থাকে। গ্র্যানভিল সেওয়ার্ড অস্টিন ছিলেন ভারতীয় সংবিধানের একজন আমেরিকান ঐতিহাসিক। এই প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন ‘Constitution: Cornerstone of a Nation’ বা সংবিধান হলো একটি দেশের ভিত্তিপ্রস্তর।

স্বাধীনতার ৭৭ তম বর্ষপূর্তির প্রাক্কালে আমাদের সংবিধান নিয়ে একপ্রস্থ আলোচনা করা জরুরি। ১৯৪৯ সালের ২৬শে নভেম্বর যখন ভারতীয় জনগণ গণপরিষদে ‘সংবিধান গ্রহণ, বিধিবদ্ধ ও অর্পণ’ করলেন সেই ক্ষণটিকে আমাদের সংবিধানের জন্মলগ্ন ধরলে আজ এই ২০২৪ সালে সংবিধানের ৭৫ তম বর্ষপূর্তির প্রাক্কালে আমরা দাঁড়িয়ে আছি। সংবিধান একটি প্রাণহীন দলিল মাত্র নয়, সংবিধানে যা লেখা আছে শুধুমাত্র সেটুকুই সংবিধান নয়। সক্রিয় প্রতিষ্ঠানসমূহের একটি ক্রমবর্ধমান ও বিবর্তনমূলক অঙ্গ হল সংবিধান। কীভাবে এবং কাদের দ্বারা এটি কার্যকর হচ্ছে তার ভিত্তিতেই সংবিধান তার প্রকৃত অর্থ লাভ করে। সুতরাং দেশ ও জাতির সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক তত্ত্ব ও মূল্যবোধ বোঝার জন্য সংবিধানের আলোচনা জরুরি।

ভারতীয় সংবিধান বিশ্বের বৃহত্তম লিখিত সংবিধান। ১৯৫০ সালের ২৬ শে জানুয়ারি যখন সংবিধান চালু হয় তখন এতে ২২টি অংশ (Part) ৩৯৫টি অনুচ্ছেদ (Article) ও ৯টি তফশীল (Schedule) ছিল কিন্তু গত প্রায় ৭৫ বছরে শতাধিক সংশোধনের শেষে বর্তমানে এতে আছে ২৫টি অংশ, ৪৭০টি অনুচ্ছেদ, ১২টি তফসিল ও ৫টি সংযোজন (Appendix)।

সংবিধানের বয়স মাত্র ৭৫ হলেও সাংবিধানিক ইতিহাস ও প্রস্তুতি কিন্তু কম সময়ের নয়। একসময়ে এই দেশে ঋগ্বেদ-এ উল্লেখিত ‘সভা’ ও ‘সমিতি’ বা বুদ্ধের সমসাময়িক প্রজাতান্ত্রিক গণরাজ্যগুলির কথা জানা যায়। পরবর্তীকালেও বিভিন্ন সময়ে দেশের আনাচে কানাচে প্রজাতন্ত্রের বীজ লুকিয়ে ছিল। অবশ্য বিগত শতাব্দির ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইন স্বাধীনতা পরবর্তী সংবিধান প্রণয়নে বিশেষ গুরুত্ব দাবি করে। এই আইনের গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন দিকের মধ্যে একটি ছিল ভারতীয় প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন প্রদান। স্বাধীনতার প্রাক্কালে ১৯৪৬ সালের ডিসেম্বরে সৃষ্ট গণপরিষদ সংবিধান প্রণয়নের কাজ শুরু করে পরের বছর অর্থাৎ ১৯৪৭ সালে। ওই বছরই অক্টোবর মাসে সংবিধানের প্রাথমিক খসড়া বহুল পরিমাণে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র নথি ও প্রায় ৮০টি দেশের সংবিধানের উল্লেখযোগ্য বিষয়গুলি একত্রিত করে গণপরিষদের সদস্যদের কাছে পাঠানো হয়। ১৯৪৮ সালের ২৮ শে অক্টোবর গণপরিষদের সভাপতি ডক্টর রাজেন্দ্র প্রসাদের কাছে খসড়া সংবিধান পেশ করা হয়।

অভিযোগ উঠেছিল এবং এখনও ভিন্নরূপে সে অভিযোগ বর্তমান, সংবিধানে ‘মৌলিকত্ব কম আছে’। এ ধরনের অভিযোগের উত্তরে ১৯৪৮ সালের ৪ঠা নভেম্বর গণপরিষদে খসড়া সংবিধান পেশ করার সময় খসড়া কমিটির সভাপতি ডঃ আম্বেদকর যা বলেছিলেন তা প্রণিধানযোগ্য।

“প্রথম লিখিত সংবিধান তৈরি হওয়ার পর একশো বছরেরও বেশি অতিক্রান্ত হয়েছে। বহু দেশ নিজেদের লিখিত সংবিধান তৈরি করার সময় এই সংবিধানকে অনুসরণ করেছে। সংবিধানের উদ্দেশ্য অনেক পূর্বেই নির্ধারিত হয়েছে। অনুরূপভাবে সংবিধানের মৌলিক উপাদানগুলি সারা বিশ্বে সমাদৃত হয়েছে। এই তথ্যানুসারে সমস্ত দেশের সংবিধানের মূল ধারাগুলি একই রকম হতে বাধ্য।…..আমি নিশ্চিতভাবে বলতে পারি, অন্য দেশের সংবিধানের অন্ধ অনুকরণ, এই অভিযোগের ভিত্তি হল আমাদের সংবিধানটি মনোযোগ সহকারে না পড়া। ……ভাল কিছু গ্রহণ করার মধ্যে লজ্জার কিছু নেই, নেই কোনও চৌর্যাপরাধ। একটি সংবিধানের মৌলিক বিষয়গুলি কারও সংরক্ষিত সম্পত্তি নয়।”

সুতরাং আমাদের প্রথম ও প্রধান কর্তব্য সংবিধানটি মনোযোগ দিয়ে পড়া এবং এর মুখ্য উদ্দেশ্য অনুধাবন ও উপলব্ধি করা। স্বাধীনতা দিবস উদযাপনের সঙ্গে এর সম্পর্ক কী, এমনতর প্রশ্ন যাঁদের মনে ভেসে উঠেছে তাঁদের জন্য সেই ১৯৪৯ সালের নভেম্বরে গণপরিষদের সভায় ভাষণ প্রদানকালে ডঃ আম্বেদকর রেখে গেছিলেন এক অসামান্য সতর্ক বাণী,

“আমি মনে করি বদ লোকের হাতে পড়লে একটি ভালো সংবিধান নষ্ট হয়ে যাবে। আবার একটি সংবিধান যত বাজেই হোক কিছু ভালো লোকের তত্ত্বাবধানে থাকলে তা ভালো বলে মনে হতে পারে। সংবিধানের প্রকৃতির ওপর পুরোপুরি ভাবে সংবিধানের প্রয়োগ নির্ভর করে না।

জাতিভেদ ও ধর্মান্ধতার মতো পুরোনো শত্রু ছাড়াও আমরা পরস্পরবিরোধী বহু রাজনৈতিক দল পেতে চলেছি। ভারতীয়রা দেশের ঊর্ধ্বে নিজের স্বার্থকে রাখবে, না দেশকে ব্যক্তিস্বার্থের ঊর্ধ্বে রাখবে তা আমি জানি না। কিন্তু এ কথা নিশ্চিত যে রাজনৈতিক দলগুলি যদি দেশের ঊর্ধ্বে দলীয় স্বার্থকে গুরুত্ব দেয় তবে আমাদের স্বাধীনতা দ্বিতীয়বারের মতো বিপর্যয়ের সম্মুখীন হবে এবং সম্ভবত চিরতরে হারিয়ে যাবে। এই পরিণতির বিরুদ্ধে আমাদের দৃঢ়ভাবে দাঁড়াতে হবে। শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে আমাদের স্বাধীনতা রক্ষা করতে হবে।”

আজকের দিনে দাঁড়িয়ে এই অন্তিম কথাগুলো যেন ভবিষ্যৎ বাণী মনে হচ্ছে। আমরা কি পারব ব্যক্তিগত স্বার্থ, বিভেদ, বিরোধ এসবের ঊর্ধ্বে উঠে দেশের স্বাধীনতা রক্ষা করতে, যেমনটা ডঃ আম্বেদকর চেয়েছিলেন? জানি না; তাই গণপরিষদের সভাপতি ডক্টর রাজেন্দ্র প্রসাদ তাঁর ভাষণে যে আশার বাণী শুনিয়েছিলেন সেটি উদ্ধৃত করেই এ প্রসঙ্গে যবনিকা টানা যাক,

“একটি সংবিধান যন্ত্রের মতো প্রাণহীন। যাঁরা একে ব্যবহার করেন, কাজে লাগান তাঁদের জন্যই সংবিধান প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে। আজ ভারতের দরকার একদল সৎ মানুষ, যাঁদের কাছে দেশের স্বার্থই সব কিছুর ঊর্ধ্বে। আমাদের মধ্যে বিভিন্ন ধরনের ঐক্যবিনষ্টকারী প্রবণতা আছে। আমাদের মধ্যে সাম্প্রদায়িক বিভেদ, জাতিভেদ, ভাষাগত ভেদাভেদ, প্রাদেশিকতা প্রভৃতি আছে। তাই প্রয়োজন হল দৃঢ় চরিত্রের দুরদৃষ্টিসম্পন্ন মানুষ— যাঁরা ক্ষুদ্র গোষ্ঠী ও এলাকার জন্য দেশের স্বার্থগুলি বিসর্জন দেবেন না, বিরোধ বিভেদ সঞ্জাত সংস্কারের ঊর্ধ্বে যাঁরা উঠতে পারবেন। আমরা শুধু এটুকু আশা করতে পারি যে এদেশে এমন মানুষের সংখ্যা অসীম।”

এই আশাটুকুর বাস্তবায়ন হয়তো খুব কঠিন নয়।

মন্তব্য করুন

আপনার ইমেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।