সম্পাদকীয়

উপেক্ষিত ইতিহাস
“ভারত হলো মানব জাতির শৈশবের দোলনা, মানুষের বক্তৃতার জন্মস্থান, ইতিহাসের মা, কিংবদন্তির ঠাকুরমা এবং ঐতিহ্যের মহান মাতা। মানুষের ইতিহাসে আমাদের সবচেয়ে মূল্যবান এবং সবচেয়ে শৈল্পিক উপকরণগুলি শুধুমাত্র ভারতেই সংরক্ষিত আছে!”— সেই ঊনবিংশ শতকে বিখ্যাত আমেরিকান লেখক মার্ক টোয়েন ভারত সম্পর্কে বলেছেন।
হায়, মানুষের ইতিহাসে সবচেয়ে মূল্যবান এবং সবচেয়ে শৈল্পিক উপকরণগুলি সত্যিই কি ভারতে সংরক্ষিত আছে! এই দেশের ইতিহাসে খুঁজতে, বৌদ্ধ ধর্মের প্রত্নস্থলগুলি মাটির নিচে থেকে খুঁড়ে বের করতে, অপেক্ষা করতে হয় বিদেশি আলেকজান্ডার কানিংহ্যাম-এর। অজন্তার চিরায়ত গুহাশিল্পকে আমরা ভুলে গেছিলাম— ১৮১৯ সালে একজন ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ অফিসার ঘটনাক্রমে ‘আবিষ্কার’ করার আগে পর্যন্ত সেগুলো ছিল জঙ্গলে ঢাকা। বেশি কথা কী, সম্রাট শাহজাহানের জ্যেষ্ঠ পুত্র দারা শিকোহের স্মৃতির মতোই তার কবরও হারিয়ে গেছিল। ২০২০ সালে দিল্লিতে অনেকগুলি চিহ্নিত এবং অচিহ্নিত মুঘল কবরের মধ্যে একজন পৌর কর্মকর্তা ৪ বছর অক্লান্ত পরিশ্রম করে এই কবর খুঁজে বের করেন। আমাদের মহেঞ্জোদারো-হরপ্পা, অজন্তা-ইলোরা, অশোকের শিলালিপি-স্তম্ভলিপি, এমনকী তাজমহলে শ্যাওলা ধরে। ‘আবিষ্কার’ করেন বিদেশিরা।
অসংখ্য প্রাচীন ভারতীয় নিদর্শন চিরতরে হারিয়ে গেছে।
আরও অসংখ্য হারিয়ে যেতে বসেছে।
হাজার হাজার বছরের পুরানো স্মৃতিস্তম্ভের কথা বলছি, যেমনটি সত্যিই মার্ক টোয়েনের কথা অনুযায়ী পৃথিবীর খুব কম দেশেই আছে। ভারতে অসংখ্য প্রাচীন মন্দির রয়েছে যা স্থাপত্যের বিস্ময় এবং আমাদের চলমান সংস্কৃতির অংশ। এই প্রাচীন মন্দিরগুলির মধ্যে বহু মন্দির অবহেলায়, যথাযথ পুনরুদ্ধারের অভাবে ভগ্নপ্রায়, অথবা তার প্রাচীন কারুশিল্প চিরতরে হারিয়ে গেছে। কাশ্মীর উপত্যকায় অবস্থিত তিনটি বিখ্যাত মন্দির— মার্তণ্ড সূর্য মন্দির, অবন্তীস্বামী মন্দির এবং অবন্তীশ্বর মন্দির— তিনটি মন্দিরই আরও রক্ষণাবেক্ষণের দাবি করে।
অতটা পুরানো না হলেও এই দু’শো-তিন’শ বছরের পুরানো ভগ্নপ্রায়, বট অশ্বত্থের ডালপালা ও শিকড় দিয়ে আবৃত অসংখ্য মন্দির, মসজিদ, জমিদার বাড়ি, রাজ প্রাসাদ সারা বাংলায় আজ ধ্বংসের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে। এই স্মৃতিস্তম্ভগুলি রক্ষা করা এক উল্লেখযোগ্য চ্যালেঞ্জ। এগুলি রক্ষণাবেক্ষণ ও সংরক্ষণের জন্য অবশ্যই আর্থিক সংস্থানের প্রয়োজন। কিছু স্মৃতিস্তম্ভ বেদখলের সম্মুখীন। কিছু ক্ষেত্রে, মূল্যবান জমি বেআইনিভাবে দখল করা হয়েছে। তবে এগুলোই কি মূল কারণ প্রাচীন স্মৃতিস্তম্ভগুলি ভেঙে পড়ার? অধিকাংশ ক্ষেত্রে স্রেফ মনোযোগের অভাবে এই স্মৃতিস্তম্ভগুলি কালের গহ্বরে চলে যেতে বসেছে। আমরা হারাচ্ছি জাতির পরিচয়, ইতিহাস ও ঐতিহ্যের অংশ।
একটা উদাহরণ দেওয়া যাক। তমলুক রাজবাড়ি (প্রাসাদ), যা সম্ভবত ৫ম সাধারণপূর্বাব্দ শতাব্দীতে তৈরি হয়েছিল, আজ অবলুপ্তির শেষ পর্যায়ে রয়েছে। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে একটি বড় অবদান ছিল এই রাজপ্রাসাদের। তমলুকের রাজা ব্রিটিশ আনুগত্য লাভের আশায় না থেকে বরাবর ব্রিটিশ শক্তির বিরুদ্ধে স্বদেশী বিপ্লবীদের পাশে দাঁড়িয়েছেন। এই রাজবাড়ি ছিল স্বাধীনতা সংগ্রামীদের আশ্রয়স্থল।
এখন এটি আগাছায় পরিপূর্ণ।
একটু অনুসন্ধান করলে বোঝা যায়, নিজেদের ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতি সম্পর্কে জনসচেতনতার অভাব ভারতে স্মৃতিস্তম্ভ এবং ঐতিহাসিক স্থানগুলির অবক্ষয়ের অন্যতম প্রধান কারণ। শুধু কলকাতা শহরে তাকিয়ে দেখুন। রাজা সুবোধ চন্দ্র মল্লিকের পৈতৃক বাড়িটি দেখলে নিজেদের অপরাধী লাগে। হয়তো আগে রঙ ছিল গাঢ় লাল। কিন্তু দীর্ঘ রোদ-ঝড়-জলে সে রঙ আজ বোঝা কঠিন। বাড়িটি আজ বুনো গাছের অধিকারে। প্রতিটি তলায় ভাঙা-কপাট। বহু বিখ্যাত মানুষের আনাগোনা ছিল এই বাড়িতে। আইনি জটিলতায় ধুঁকছে গোটা বাড়ি— মামলা আজও বহমান। ইতিমধ্যে বাড়িটি হেরিটেজ ও বিপজ্জনক দুয়েরই তকমা পেয়েছে। একদিন এই বাড়ি আমাদেরই চোখের সামনে ভেঙে পড়বে। যেমন ভেঙে পড়ছে সারা দেশে বিভিন্ন স্মৃতিস্তম্ভগুলি।
এই বোধহয় সময়, এগুলি রক্ষণাবেক্ষণের জন্য জনসাধারণের মধ্যে সচেতনতা গড়ে তোলবার।
আজকের দিনকে বুঝতে গেলে গতকালকে খুঁজতে হবে, বুঝতে হবে, উত্তরসূরির জন্য রক্ষা করতে হবে ।