সম্পাদকীয়
“মানুষের অধিকারে বঞ্চিত করেছ যারে”
জুন মাস পলাশীর যুদ্ধের মাস, তাই পরাধীন ভারতে স্বাধীনতার জন্য লড়াইয়ের ইতিহাস চর্চা সম্বন্ধে কিছু ভাবনা-চিন্তা করার উপযুক্ত কাল। সম্প্রতি ‘হীরামণ্ডি’ নামের একটি জনপ্রিয় আন্তর্জাল মাধ্যমের ধারাবাহিকে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে লাহোরের তওয়াইফদের ভূমিকাকে গুরুত্ব দিয়ে দেখানো হয়েছে। এই বছরই প্রকাশিত ‘ড্যান্স টু ফ্রীডম’ বইটিতেও এই একই ইতিহাস চর্চিত হয়েছে। তওয়াইফদের স্বাধীনতা আন্দোলনে অংশগ্রহণের ইতিহাস নিয়ে এই যে চিন্তন শুরু হয়েছে, তার পরিপ্রেক্ষিতে ভারতের প্রান্তিক মানুষদের স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহণ সংক্রান্ত দু’টি বৃহত্তর বিষয় নিয়ে ভাবতে বাধ্য করে। প্রথমত, ভারতের প্রাক-ঔপনিবেশিক অর্থনীতিকে ধ্বংস করে দেওয়ার ফলে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসকরা সমাজের কোন অংশগুলিকে অর্থনীতির মূল ধারা থেকে বিচ্ছিন্ন করে প্রান্তিক জীবনযাপনে বাধ্য করেছিল, আর দ্বিতীয়ত, ব্রিটিশ ভারতের প্রান্তিক মানুষেরা কবে ও কীভাবে স্বাধীনতা আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন।
ভারতে ব্রিটিশদের ক্ষমতা দখলের অব্যবহিত পরবর্তী কালে ঔপনিবেশিক শোষণ ও লুঠের বিরুদ্ধে সংঘবদ্ধ প্রতিরোধ এবং তারপর স্বাধীনতার জন্য সংগঠিত লড়াই এই দুইয়ের মধ্যে সম্পর্ক নিয়ে অবশ্যই চর্চা হয়েছে। ভারতের স্বাধীনতার আন্দোলনে অংশগ্রহণকারীদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অবস্থান নিয়ে চর্চা হলেও, সামাজিক অবস্থান নিয়ে সেই ভাবে চর্চা হয়েছে কি? যে প্রান্তিক মানুষদের ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শোষণের বিরুদ্ধে সংগ্রামে অংশগ্রহণ করতে দেখা গিয়েছিল, পরবর্তী কালে স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রথম সারিতে তাঁদের আর দেখা পাওয়া যায়নি। কিন্তু, তা সত্ত্বেও ব্রিটিশ ভারতের প্রান্তিক মানুষদের স্বাধীনতা আন্দোলনে অংশগ্রহণ করতে দেখা গিয়েছে, স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতৃত্বকে সমর্থন করতে দেখা গিয়েছে।
ভারতের প্রান্তিক মানুষদের আজও সামাজিক ও অর্থনৈতিক শোষণ ও অবমাননার মধ্য দিয়ে জীবনযাপন করতে হয়। সেই কারণে স্বাধীনতা সংগ্রামে তাঁদের অংশগ্রহণের ইতিহাস চর্চার সময় শুধু রাজনৈতিক ইতিহাস চর্চার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকা সম্ভব নয়। আজ ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসকে কয়েকজন বিশিষ্ট ব্যক্তির ব্যক্তিগত ইতিহাসে পর্যবসিত করার পরিকল্পিত প্রয়াস চলছে, স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতার বিশালকায় মূর্তি নির্মাণ করে তাঁর উপর দেবত্ব অর্পণের চেষ্টা হচ্ছে, মানুষের সমবেত সংগ্রামের প্রতি আগ্রহের পরিবর্তে ব্যক্তিপূজার আয়োজন চলছে। সেই কারণে, ভারতের প্রান্তিক মানুষদের স্বাধীনতার জন্য সংগ্রামের ইতিহাস নিয়ে আরও বেশি করে চর্চার প্রয়োজন দেখা দিয়েছে।
‘ইতিহাস আড্ডা’ গোষ্ঠীর পোর্টালে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে প্রান্তিক মানুষদের, বিশেষত ভারতের শ্রমিক, কৃষক ও আদিবাসীদের স্বাধীনতা আন্দোলনে ভূমিকা নিয়ে ইতিমধ্যেই যথেষ্ট চর্চা হয়েছে। স্বাধীনতার ৭৫ বছরে আমরা যে ইতিহাস চর্চা শুরু করেছিলাম, সেই চর্চাকে আরও এগিয়ে নিয়ে যাওয়া হবে। যে প্রান্তিক মানুষদের কথা এখনও আলোচিত হয়নি, তাঁদের কথা বলার জন্য আমরা অবশ্যই প্রতিজ্ঞাবদ্ধ- পলাশীর যুদ্ধের সার্ধ দ্বিশতবর্ষ অতিক্রম করার পরও অসম্পূর্ণ থেকে যাওয়া এই কাজে ‘ইতিহাস আড্ডা’ গোষ্ঠী সতত নিজেদের যুক্ত রাখার চেষ্টা করবে।