সম্পাদকীয়
‘আমরা নই বাঁধা নই দাসের রাজার ত্রাসের দাসত্বে’
মনুস্মৃতিতে (৭.৩-৪) বলা হয়েছে, মানুষের ভয় দূর করতে, তাঁদের রক্ষার্থে, অষ্ট দিকপাল দেবতার সারভূত অংশ গ্রহণ করে প্রভু রাজার সৃষ্টি করেছেন। শাসককে দৈব শক্তির দ্বারা নিযুক্ত বা দেবতাস্বরূপ বলে অভিহিত করার রীতি পৃথিবীর সব প্রাচীন সংস্কৃতিতেই দেখা যায়। প্রাচীন ও মধ্যযুগের ভারতের বহু শাসকই নিজেদের সার্বভৌমত্বের বৈধতা প্রমাণের জন্য ধর্ম ও ঐশী শক্তির আশ্রয় নিয়েছেন। আজও পৃথিবীর যে কয়েকটি দেশে রাজতন্ত্র রয়ে গিয়েছে, সেখানে ধর্ম ও ঈশ্বরের দ্বারাই শাসকের বংশানুক্রমিক উত্তরাধিকারকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। অতি সাম্প্রতিক কালে যাঁরা গ্রেট ব্রিটেনের তৃতীয় চার্লসের রাজ্যাভিষেক দূরদর্শনে দেখেছেন তাঁরা নিশ্চয়ই এই ব্যাপারটি লক্ষ্য করেছেন। অন্ত-মধ্যযুগের ভারতের শাসকদের সিংহাসনের উপর অধিকারের দৈব স্বীকৃতির প্রতীক হিসাবে তাঁদের দৈব শক্তি বা ধর্মীয় ব্যক্তিত্বের কাছ থেকে পতাকা, রাজদণ্ড বা তরবারি প্রাপ্তির কাহিনি প্রচলনের একাধিক উদাহরণ দেখা যায়। আধুনিক বিশ্বে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় শাসকের ক্ষমতার স্বীকৃত উত্স জনসমর্থন। সেই কারণে, সাধারণত আধুনিক যুগের গণতান্ত্রিক দেশের শাসকরা নিজেদের রাষ্ট্রক্ষমতার স্বীকৃতির জন্য সংবিধান ও রাষ্ট্রীয় প্রতীকসমূহের আশ্রয় গ্রহণ করেন। স্বাধীন ভারতের রাষ্ট্রীয় প্রতীক হিসাবে কোনও রাজশক্তির পরিবর্তে অশোকের স্তম্ভশীর্ষের ধর্মচক্রের চয়ন স্বাধীনতার পর ক্ষমতাসীন শাসকদের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রতি দায়বদ্ধতার নিদর্শন।
যখন কোনও আধুনিক রাষ্ট্রে গণতান্ত্রিক শাসনকাঠামো বজায় রেখে সব আর্থিক সুযোগসুবিধা ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিদের মধ্যে সীমাবদ্ধ করে রাখা শাসকদের পক্ষে অসম্ভব হয়ে পড়ে, তখন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার পথ পরিত্যাগ করে স্বৈরতান্ত্রিক পথ অনুসরণের প্রবণতা দেখা দেয়। সাধারণত শাসকরা এই স্বৈরতান্ত্রিক পদক্ষেপগুলিকে নাগরিকদের সামনে এক উগ্র জাতীয়তাবাদের মোড়কে পেশ করেন। পুরোনো গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলিকে নিয়ন্ত্রিত করা বা ভেঙে দেওয়াকে নতুন শক্তিশালী রাষ্ট্র গড়ে তোলার জন্য অপরিহার্য পদক্ষেপ বলে নাগরিকদের কাছে প্রচার করা হয়। স্বৈরতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থাকে পুরোনো শাসনব্যবস্থার ব্যর্থতার প্রতিকার করতে সৃষ্ট এক বৈপ্লবিক নতুন ব্যবস্থা বলে রাষ্ট্রীয় প্রচারতন্ত্রের মাধ্যমে নাগরিকদের বোঝানো হয়। একনায়কতন্ত্রের প্রতি নাগরিকদের আস্থা সৃষ্টির জন্য সংবাদ মাধ্যমে শাসকের ক্রমাগত মহিমামণ্ডন এই শাসনব্যবস্থার অন্যতম বৈশিষ্ট্য। নতুন শাসনব্যবস্থায় নাগরিকদের অর্থনৈতিক দুর্গতিকে রাষ্ট্রের জন্য আত্মত্যাগ বলে গৌরবান্বিত করা হয়, সাধারণত সেনাবাহিনীর কঠিন জীবনযাত্রার সঙ্গে তুলনা করে নাগরিকদের কৃচ্ছতাসাধনে উদ্বুদ্ধ করা হয়। যেহেতু একুশ শতকের স্বৈরতান্ত্রিক শাসকরা নির্বাচন বন্ধ করতে চান না, তাই তাঁরা নতুন শাসনব্যবস্থার প্রতি জনসমর্থন অটুট রাখার জন্য নিত্য নতুন প্রতীক ও অনুষ্ঠানের আশ্রয় নেন। নতুন প্রতীক চয়নের সময় স্বৈরতান্ত্রিক শাসকরা দেশের প্রাচীন ঐতিহ্য, রাষ্ট্রের নিরাপত্তা ও অভিনবত্বের দিকে নজর রাখেন। কয়েকদিন আগে অনুষ্ঠিত ভারতের নতুন সংসদ ভবনের উদ্ঘাটন এবং উদ্ঘাটনের সঙ্গে যুক্ত অনুষ্ঠানগুলিকে একুশ শতকের পৃথিবীতে স্বৈরতন্ত্রের পরিচিত বৈশিষ্ট্যগুলির নিরিখে দেখার প্রয়োজন আছে।
স্বাধীনতার সময় ভারতের গণ পরিষদ স্বাধীন ভারতে সার্বজনীন ভোটাধিকারের ভিত্তিতে নির্বাচিত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেয়, এবং সেই অনুযায়ী ভারতের সংবিধানে সংসদ ও অন্যান্য গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের কথা উল্লিখিত হয়েছে। বিগত কয়েক বছর ধরে ভারতে উদারবাদী গণতন্ত্রকে প্রতিস্থাপন করে ধর্মীয় জাতীয়তাবাদ দ্বারা আচ্ছাদিত স্বৈরতন্ত্রকে শাসনব্যবস্থা হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করার যে প্রয়াস চলছে, নতুন সংসদ ভবন নির্মাণ এবং তার উদ্বোধন অনুষ্ঠানকে এর থেকে পৃথকভাবে দেখা সম্ভব নয়। এক দিকে দেখা যাচ্ছে, ভারতীয় সংসদে সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও আইন প্রণয়ন ও দেশের সমস্যা নিয়ে আলোচনার ক্ষেত্রে যে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া আগে অনুসরণ করতে দেখা যেত তা আজ প্রায় অদৃশ্য। অন্য দিকে, নতুন সংসদ ভবন নির্মাণ, সেই সংসদে নতুন রাষ্ট্রীয় প্রতীক হিসাবে দিল্লির জাতীয় জাদুঘর থেকে উঠিয়ে আনা দৈব শক্তির দ্বারা স্বীকৃত রাজতান্ত্রিক শাসনের প্রতীক স্থাপন এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ ধর্মীয় সম্প্রদায়ের ধর্মীয় রীতি অনুসরণ করে নতুন সংসদের উদ্বোধনের মাধ্যমে যে বার্তা নাগরিকদের কাছে পৌঁছে দেওয়া হল, তাও অত্যন্ত সুস্পষ্ট।
স্বাধীন ভারতের বিগত সাড়ে সাত দশকের ইতিহাসে নাগরিকদের গণতান্ত্রিক অধিকার হননের ঘটনা দেখা গেলেও যেভাবে বিরোধী শূন্য সংসদে, রাষ্ট্রপতির অনুপস্থিতিতে, ধর্মীয় অনুষ্ঠান সহযোগে রাজদণ্ড স্থাপনের মাধ্যমে নতুন সংসদের উদ্বোধন করা হল, তা এক কথায় অভূতপূর্ব। সকাল যদি পুরো দিনের ইঙ্গিত বহন করে, তাহলে ভারতে গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তার প্রয়োজন আছে। তবে জরুরি অবস্থার সময় গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষার জন্য বিপুল সংগ্রামের কথা আমরা আজও ভুলে যাইনি। তাই আশা করা যায়, ভারতের নাগরিকরা নিঃশব্দে কোনও আদ্যন্ত স্বার্থপর বণিকের দাসে পরিণত রাজার ত্রাসের দাসত্ব মেনে নেবেন না।